মেঘফুল - পর্ব ২৪ - মিশু মনি - ধারাবাহিক গল্প


জাহ্নবী বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে রইল। বিয়ের দিন ক্ষণ ঠিক হয়েছে কী না সেটা শোনার জন্য অপেক্ষা করছে সে। অস্থিরতা ক্রমশ ওর মাথা ভারী করে তুলল। ঠিক এমন সময় স্বস্তির বৃষ্টি নামল। ভায়োলেট ফোন করেছে। 

জাহ্নবী ফোন রিসিভ করে অস্থির গলায় বলল, 'তুই কোথায়? আমার এদিকে সব শেষ হয়ে যাচ্ছে।'
'কিছুই শেষ হবেনা যদি তুমি চাও।'
'আমি কী চাই সেটাই তো বুঝতে পারছি না।'
'তাহলে বাবার কাছে যাও। গিয়ে বলো, আমাকে কয়েকদিন সময় দাও। আমি আরও ভেবে দেখি।'
'আমি পারছি না রে।' হতাশ গলায় বলল জাহ্নবী।
'না পারলে চুপচাপ বিয়ে করে ফেলো।'

জাহ্নবী চুপ হয়ে গেল। অন্যপাশে ভায়োলেটও কোনো কথা বলছে না। জাহ্নবী বলল, 'আমি এখন বিয়ে করতে চাইছি না। মানে এটা আগের গুলোর মতো নয়। আগে তো সত্যিই বিয়ে করতে চাইতাম না। কিন্তু এবার আমার ঠিক মোস্তফা কামালকে.. বুঝাতে পারছি না। আমি পাগল হয়ে যাবো ভায়োলেট।'

ভায়োলেট ধীরগলায় বলল, 'তাহলে আব্বুর রুমে যাও। গিয়ে বলো, তোমার আরও কিছুদিন সময় লাগবে। তুমি বললে আব্বু অবশ্যই সময় দেবে। জোর করে বিয়ে দেয়ার হলে আগেই দিয়ে দিতো। আমাদের আব্বু সেরকম মানুষ নন।'

জাহ্নবী বলল, 'আব্বুকেই তো বলতে পারছি না।'
'যাও, গিয়ে বলো। সময় নাও। সব ঠিক হয়ে যাবে।'

জাহ্নবী কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, 'আচ্ছা আমি যাচ্ছি। কিন্তু সময় নেয়ার পরও আমার মতামত 'না' হওয়ার সম্ভাবনাই বেশী। ওনাদের দাবী, মেয়েকে ওরা চাকরি করতে দেবে না। গ্রামে গিয়ে শাশুড়ীর সঙ্গে থাকতে হবে।'

ভায়োলেট বলল, 'তাহলে সেরকম মেয়েকেই খুঁজতে বলো। যে মেয়ে চাকরি করেনা, শাশুড়ীর সেবায় নিজেকে সবসময় নিয়োজিত রাখবে। চাকরি করা একটা মেয়েকে ওরা চাকরি ছাড়তে বলবে কেন? তুমি তো মোস্তফা কামালের প্রেমিকা নও। ওনাকে বিয়ে করতেই হবে, এমন মাথার দিব্যি তোমাকে কেউ দিয়ে রাখেনি।'

জাহ্নবী ভরসা পেলো ভায়োলেটের কথায়। লজ্জাকে ভেতর থেকে টেনে বের করে একদিকে সরিয়ে রাখল। তারপর গেল জাভেদ আলীর সঙ্গে কথা বলতে।

পারভীন বিছানায় শুয়ে আছেন। জাভেদ আলী বসে আছেন সোফায়। ওনার সবচেয়ে ভালো গুণ হল, তিনি কখনোই চিন্তিত থাকেন না। বেশ সুখী সুখী মানুষ মনেহয় তাকে। 

জাহ্নবীকে দেখে তিনি বললেন, 'কিছু বলবি মা?'

লজ্জাকে সরাতে চেয়েও সরানো যায়নি বোধহয়। জাহ্নবী কথাটা বলতে গিয়ে মাথা নিচু করে রাখল। মৃদু স্বরে বলল, 'আব্বু আমার কিছুদিন সময় লাগবে।'
জাভেদ আলী পারভীনের দিকে তাকালেন। স্ত্রী'র প্রতিক্রিয়া দেখে তারপর কথা বলবেন। কিন্তু পারভীন শুয়েই রইলেন, ওনার মাঝে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। 

জাহ্নবী বলল, 'আমি চাকরি ছাড়তে পারবো না আব্বু। তুমি চাও তোমার মেয়েরা মাথা উঁচু করে বাঁচুক। আমি আর মরার মতো বাঁচতে চাই না।'
'ঠিক আছে। আমি ছেলের সঙ্গে কথা বলবো। তুই চিন্তা করিস না। তোর মতো থাক।'

জাহ্নবী বাবাকে ধন্যবাদ জানিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। পারভীন উঠে বসলেন। ওনার প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে স্বামীর ওপর। কঠিন মুখ করে রেখেছেন তিনি। 

জাভেদ আলী বললেন, 'কী হল? রেগে গেছ মনে হচ্ছে?'
পারভীন বললেন, 'মেয়েটাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে রাজী করা যেত না? তুমি বুঝালে ও ঠিকই রাজী হতো। এত বছর বিয়ে করতেই চায় নি। এখন যেটুকু হোক রাজী তো হয়েছে। ভালো করে বুঝাতে পারতে।'

জাভেদ আলী উঠে যেতে প্রস্তুত হলেন। ছেলেপক্ষ বাইরে অপেক্ষা করছে। পারভীনের কথাকে পুরোপুরি অগ্রাহ্য করলেন তিনি। অশান্তিতে পড়ে গেলেন পারভীন। এই লোকটা আজীবন নিজের মতো থেকে এসেছে। কখনো তার কথাকে গুরুত্ব দেয় নি। ওনার আহ্লাদেই মেয়েগুলো এমন হয়েছে। বিরক্তমুখে বসে রইলেন পারভীন। রাগ ঝাড়ার মতো সুযোগ পাচ্ছেন না। 

জাভেদ আলী মোস্তফা কামালকেই সরাসরি বলে দিলেন, 'আমার মেয়েটা চাকরি ছাড়বে না। ও কিছুদিন সময় চেয়েছে। আপনারাও ভেবে দেখুন। আমি জোর করে মেয়েদের ওপর কিছু চাপিয়ে দিতে চাই না।'

দোলন চাচা তৎক্ষনাৎ বললেন, 'আরে এতে চাপিয়ে দেয়ার কী আছে? তুমি ওর বাবা। জোর করার হলে করবা। আমরা মেয়ের ওপর জোর খাটাবো না তো কে খাটাবে? এত ভালো ছেলে আমাদের মোস্তফা, ওর মতো ছেলে দ্বিতীয়টা আমাদের গ্রামে আর পাবা না। মেয়েকে ভালো করে বুঝাইলেই হবে। আমি বুঝেছি ওর মত আছে।'

দোলন চাচা দাঁত বের করে হাসলেন। জাহ্নবীর বড় মামা বললেন, 'আমিও মা'র সাথে কথা বলবো। মেয়ে আমার বড়ই লক্ষী। আমাকে যথাযথ সম্মান করে। আমার কথা নিশ্চয়ই ফেলবে না।'

জাভেদ আলী বিব্রতবোধ করছেন। সবার সামনে জোর গলায় কিছু বলতেও পারছেন না। কিন্তু জাহ্নবীকে মন খারাপ হতে দিতে পারবেন না তিনি। তার মেয়েটা সদ্য হতাশা থেকে বেঁচে উঠেছে। এই মেয়েকে নিয়ে ওনার দুশ্চিন্তার অন্ত ছিল না। 

তিনি বললেন, 'জাহ্নবী চাকরি করুক। আমিও চাই ও চাকরি করুক। আপনারা ভেবে দেখুন মোস্তফার মাকে ঢাকায় নিয়ে এসে রাখা যায় কী না। মোস্তফা দেশের বাইরে থাকল ওনার স্ত্রীকে ঢাকায় একটা ফ্ল্যাট নিয়ে রাখলে তাতে কোনো অসুবিধা তো দেখি না।'

মোস্তফা কামালের দুলাভাই উত্তর দিলেন, 'গ্রামে এত টাকা পয়সা করে বাড়িঘর করেছে, ঢাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে থাকার জন্য তো না। আপনারাও নাকি ফ্ল্যাট কিনতেছেন শুনেছি। আপনারা নিজের বাসা রেখে কী ভাড়া বাসায় থাকবেন?'

জাভেদ আলী চুপ করে রইলেন। অতিথির মুখের ওপর তিনি কিছু বলতে চান না। মুচকি হাসলেন তিনি। হেসে বললেন, 'আপনারা ভেবে দেখেন। আমি আমার মেয়েদের কোনো ইচ্ছাকে অপূর্ণ রাখিনি কখনো।' 

মোস্তফা কামালের পরিবার খাওয়াদাওয়া শেষে বিদায় নিলো। বাড়িতে থমথমে পরিবেশ বিরাজমান। পারভীন ঘর থেকে বের হচ্ছেন না। সামারের ঘরে বালিশে মুখ গুঁজে শুয়ে আছে জাহ্নবী। 

কিছুক্ষণপর পারভীন ও তার ভাইয়ের কথোপকথন শোনা গেল, 'তোর মেয়ের বিয়ে আর দেয়ার দরকার নাই। এত করে ছেলেপক্ষকে ম্যানেজ করলাম। দুলাভাই কী বলল? মেয়ের ইচ্ছে অপূর্ণ রাখবে না। তাতে আমাদের কী? তোমার মেয়ের ইচ্ছে সারাজীবন আইবুড়ো হয়ে থাকবে। রাখো ঘরের খুঁটি বানিয়ে। ছোটবোনদেরকে বিয়ে দিতে হবে না?'

পারভীন কাঁদতে কাঁদতে বললেন, 'আমার কপাল খারাপ। এ জীবনে এত দুঃখ সইতেছি। না পারি সইতে, না পারি কাউকে কিছু বলতে।'
'তোর দোষ আছে আপা। তুই মেয়ের ওপর জোর করলে আজকে এই দিন দেখা লাগত না। তোমরা মেয়েদেরকে বড় বড় ভার্সিটিতে পড়াও। কত মেধা, কত জ্ঞান। এই জ্ঞান নিয়েই এখন ঘরে বসাই রাখো। চাকরি করুক। কী আর করবে..'

জাহ্নবী একটা নিশ্বাস ফেলে উঠে বসল। প্রায়ই মায়ের মুখে এমন কথা শোনাটা তার অভ্যাস হয়ে গেছে। মাঝেমাঝে বিভিন্ন আত্মীয়রা বাসায় বেড়াতে এলে তখনও নানান কথা শুনতে হয় তার। সে সবসময় মনেমনে চেয়েছিল, যদি আজ কোথাও চলে যেতে পারতাম! এখানে আর থাকতে ইচ্ছে করছে না। আজকে তার চলে যাওয়ার মতো একটা স্থান আছে। তার নিজের বাসা আছে!

শত যন্ত্রণাতেও জাহ্নবীর মুখে জয়ের হাসি ফুটে উঠল। সে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। স্বাভাবিক ভঙ্গীতে মাকে বলল, 'আম্মু আমি যাই। বাসায় ভাত তরকারি আছে। সেগুলো নষ্ট হয়ে যাবে।' 

পারভীন ও তার ভাই অবাক হয়ে জাহ্নবীর চলে যাওয়া দেখলেন। জাহ্নবী জাভেদ আলীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এলো। এখন খুব শান্তি শান্তি লাগছে তার। এইমুহুর্তে মনে হচ্ছে, কে কী বলল তাতে বিন্দুমাত্র কর্ণপাত না করে নিজের মতো বাঁচতে হবে। হঠাৎ ভায়োলেটের কথা মনে পড়ল তার। জাহ্নবী ফোন বের করে ভায়োলেটের নাম্বারে কল দিলো। ফোন ধরল ভায়োলেট। ব্যস্ত গলায় বলল, 'আপু, বলো?'
'বাসায় কোনোমত ম্যানেজ করা গেছে। তুই কই?'
'আমি একটা কাজে আছি।'
'রাত হচ্ছে। বাসায় আসবি না?'
'যাবো। তুমি বাসায় আছো?'
'না। আমি চলে যাচ্ছি।'
'আচ্ছা আপু। নিজের যত্ন নিও।'
'তুইও যত্ন নিস।'

ফোন কেটে দিলো জাহ্নবী। ফুটপাত ধরে হাঁটতে ভালো লাগছে। এই উষ্ণ শহরে আর শীতল হাওয়া বইছে। কিছুক্ষণ আগেই বৃষ্টি হয়ে গেছে এক পশলা। মৃদুমন্দ বাতাসে নিজেকে বয়ে নিয়ে চলল জাহ্নবী। বয়ে নিয়ে চলল তার নতুন করে বাঁচার স্বপ্নকে। 

বেশ কিছুদিন কেটে গেল। জাহ্নবী নিজের জীবন ও কর্মব্যস্ততাকে সঙ্গে নিয়ে ভালোই আছে। কাল পরশু বেতন পাবে সে। প্রথম স্যালারি। মনে অদ্ভুত আনন্দ হচ্ছে তার। অনেকদিন সে বাবার বাসায় যায় নি। কাল বেতন পেলেই পুরো টাকাটা বাবার হাতে তুলে দেবে৷ তারপর বাবার কাছে চেয়ে নেবে তার বাসার ভাড়া ও হাত খরচের টাকা। নিশ্চয়ই অনেক খুশি হবেন জাভেদ আলী। 

জাহ্নবী সন্ধ্যার অন্ধকারে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে কফি খাচ্ছে। মাঝেমাঝে চোখ চলে যাচ্ছে 'when tea meet toast' দোকানটির দিকে। বেলকনিতে দাঁড়িয়ে প্রায়ই জাহ্নবী সেদিকে তাকায়। কাউকে দেখার প্রত্যাশা করে। তবে সেটা কেবলই অবচেতন মনে। সচেতন মনে সে জানে, ওই পান্নাবাহারের সঙ্গে আর কখনো দেখা হবেনা তার। এই ভাললাগার অনুভূতিটুকু কেবল ক্ষণিকের জন্যই ছিল। 

জাহ্নবী কফি শেষ করে গাছের সঙ্গে কথা বলল। তার এখানে মোটেও একলা লাগে না। বরং একা থাকার এই চমৎকার জীবনকে সে উপভোগ করছে ভীষণ। এমন সময় দরজায় দাঁড়িয়ে পাশের রুমের একজন মেয়ে বলল, 'আপু আপনার কাছে একজন গেস্ট এসেছে। আপনি গিয়ে দেখে আসেন।'

চমকে উঠলো জাহ্নবী। তার কাছে আসার মতো তেমন কেউ নেই। সে গেটে এসে দেখল ভায়োলেট এসেছে। জাহ্নবীকে জড়িয়ে ধরল ভায়োলেট। অনেকদিন পর ভায়োলেটের উষ্ণতা ভালো লাগল জাহ্নবীর। 

ঘরে এসেই বিছানায় শুয়ে পড়ল ভায়োলেট। জাহ্নবী কফি বানিয়ে আনলো। ভায়োলেট কফির ঘ্রাণ শুঁকে বলল, 'তোমার বানানো কফিতে একটা আলাদা স্মেল পাই আপু।'

জাহ্নবী হেসে বলল, 'তাই নাকি? খা। আরও এক কাপ বানিয়ে দিবো। এক কাপ না, এক মগ।'
ভায়োলেট দুষ্টুমি করে বলল, 'তুমি এক বালতি ই বানিয়ে দিও। হা হা হা।'

জাহ্নবী কফি শেষ করে ভায়োলেটের পাশে শুয়ে পড়ল। ভায়োলেটের ভরা যৌবন। রূপের স্নিগ্ধ মাধুরি মেশানো তনু। দ্রুত বড় হয়ে গেল মেয়েটা। অথচ সেদিনই ছিল ছোট্ট, চুল ঝুটি করে পুরো বাড়ি দৌড়ে বেড়াত!

ভায়োলেট বলল, 'কী দেখছ আপু?'
'তোর কথা শুনবো আজ। তুই বলেছিলি সময় হলে বলবি। আজ বলতেই হবে।'
'আচ্ছা আপু। আজকে বলবো। আজ অনেক কথা বলবো তোমায়।'

জাহ্নবী মনেমনে ভীষণ খুশি হল। কৌতুহল ফুটে উঠল তার চোখেমুখে। বলল, 'সত্যি! আমি শুনবো। তোকে আমার কেমন যেন রহস্যময়ী লাগে ভায়োলেট।'
ভায়োলেট শব্দ করে হাসলো। 'কী যে বলো আপু!'
জাহ্নবী বলল, 'সব কাজ শেষ করে আসি। তারপর শুনবো তোর সব কথা।'

ভায়োলেট একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। মুখে লেগে রইল ম্লান হাসি। তার কথাগুলো সে কক্ষনো কাউকে বলেনি!
.
.
.
চলবে.......................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp