মেঘফুল - পর্ব ৪২ - মিশু মনি - ধারাবাহিক গল্প


ল্যাম্পপোস্টের আলোয় মৃদুমন্দ হাওয়ার সাথে শহুরে রাত্রি পেয়েছে পূর্ণতা। রিকশার ক্রিংক্রিং শব্দ আর গাড়ির হর্ণের তালে জাহ্নবী'র স্বপ্নস্বপ্ন লাগার ভ্রম ভঙ্গ হয়। রিকশায় চড়ে কখনো এত আনন্দ পায়নি সে। পান্নাবাহার এত যত্ন করে ফুলের বিশাল ডালিটা কোলে নিয়ে বসে আছে, মনে হচ্ছে এরচেয়ে সুন্দর দৃশ্য সে আর কখনো দেখেনি।

সারল্য বলল, 'একটা কথা বলবো জাহ্নবী?'
'বলুন।'

উদাস গলায় সারল্য বলল, 'আমার খুব মন খারাপ ছিল আজ। স্পেশাল দিনগুলো আমি খুব গুরুত্ব নিয়ে সেলিব্রেট করতে পছন্দ করি। অথচ আমার জীবন থেকে সব স্পেশাল দিন বিলীন হয়ে গেছে। কী অদ্ভুত না!'
জাহ্নবীর ইচ্ছে করল সারল্য'র মুখখানা একপলক দেখতে। কিন্তু এত কাছাকাছি বসে আছে তারা, ঘাড় ঘুরিয়ে তার মুখের দিকে তাকাতে লজ্জা পাবে সে। তাই ফুলের দিকে তাকিয়ে সে বলল, 'আমি তো আপনার দিনটা স্পেশাল করে দিলাম। এটার কী কোনো দাম নেই? নাকি আরও আরও বিশেষ কিছু করতে হবে?'
জাহ্নবীর কথায় হেসে ফেলল সারল্য। সত্যিই আজ এই মেয়েটার কাণ্ডে তার দিনের শেষ ভাগটুকু খারাপ কাটেনি। অদ্ভুত ধরনের নতুন এক অভিজ্ঞতার ভেতর প্রবেশ করেছে সে।

জাহ্নবী বলল, 'আপনি খুব তারাতাড়ি আমার বন্ধু হয়ে গেছেন। আমার জীবনে আসলে কখনো কোনো বন্ধু ছিল না। নাদির স্যার আমার প্রথম বন্ধু। তার সূত্রে এইযে আপনার সঙ্গেও আমার বন্ধুত্ব হল। স্যারের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা ফুরাবে না কখনো।'
'আপনার কখনো বন্ধু ছিল না?' বিস্ময়ের সঙ্গে জানতে চায় সারল্য।

জাহ্নবী ম্লান হেসে বলল, 'আপনার কী মনেহয় এই পৃথিবীতে আপনি একাই খুব নিঃসঙ্গ? আপনার চাইতেও একাকী, অসহায় মানুষ এখানে আছে।'
'হুম। আমার জীবনটা আগে অন্যরকম ছিল। হাসি, আড্ডা, বন্ধুবান্ধব নিয়ে ভরপুর। গত আড়াই বছরে সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেছে।'

জাহ্নবী বিষয়টাকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টায় বলল, 'আপনার বন্ধুরা সবাই অনেক ফ্রি মাইন্ডের। আমার ভালো লেগেছে। আচ্ছা, আপনি কি প্রায়ই ওখানে চা খেতে আসেন?'
'কোথায়?'
'টি মিট টোস্টে?'
'যখন খুব একা লাগে তখন আর বন্ধুরা ডাকলে আসি।'
'এখন তো দোকানের সামনেই আপনার একজন বন্ধু বাস করে।'
সারল্য মুচকি হেসে বলল, 'ঠিক আছে। এখন থেকে আপনাকে ডাকবো।'
মনেমনে দারুণ খুশি হল জাহ্নবী। এলোমেলো বাতাসে কানের পাশে থাকা ছোট ছোট চুলগুলো উড়ে এসে মুখের ওপর পড়ছিল। সরাতে ইচ্ছে করল না। আজকে রংধনু ভাললাগায় মেতে উঠেছে মন। 

বাসার সামনে পৌঁছে রিকশা ভাড়া দেয়ার সময় ছোটখাটো একটা তর্ক হয়ে গেল। দুজনেই ভাড়া পরিশোধ করতে চায়। শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দিলো জাহ্নবী। সারল্য ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে জাহ্নবীকে বলল, 'আপনি ফুলের ডালি নিয়ে ওপরে যেতে পারবেন বলে মনে হয় না। আমি পৌঁছে দিয়ে আসি।'
'না, না। তার দরকার নেই। দাড়োয়ান চাচাকে একশো টাকা দিলেই উনি পৌঁছে দেবেন। আপনাকে আর কষ্ট দিতে চাইনা।'
'ফুলের মতো চুপচাপ থাকুন। ফুল হয়ে যান। পারলে ডালির ওপর বসে পড়ুন। আপনাকেও বাসায় রেখে আসতে পারবো।'
জাহ্নবী মুচকি হেসে বলল, 'আচ্ছা ঠিক আছে। আসুন। কিন্তু আমার তো মেয়েদের ফ্ল্যাট। আপনাকে চা খেতে বলতে পারবো না।'
'আমি চা খাওয়ার লোভে ওপরে যাচ্ছি না।'

মুখ টিপে হাসলো জাহ্নবী। সারল্য ফুলের ডালি নিয়ে লিফটে প্রবেশ করল। লিফটের আয়নায় ওকে খেয়াল করছিল জাহ্নবী। তার শুদ্ধতম মানুষটাকে এখন আরও বেশী বিশুদ্ধ দেখাচ্ছে। 

ফ্ল্যাটের দরজায় ডালি রেখে সারল্য বলল, 'আমি তাহলে আসি।'
'দরজা থেকে আপনাকে বিদায় দিতে আমার খারাপ লাগছে।'
'তাহলে সিঁড়ি থেকে দিন।'
'হা হা হা।'

জাহ্নবী শব্দ করে হাসলো। দরজা খুলে ডালিটাকে ভেতরে রেখে সে বলল, 'চলুন। আপনাকে টি মিট টোস্ট থেকে এক কাপ চা খাওয়াই।'
'রাত দশটা বাজে।'
'তো?'
'সারাদিন অফিস করে আপনি ক্লান্ত।'
'আমি ক্লান্ত সেটা আমার চাইতে আপনি বেশী টের পাচ্ছেন?
'তা পাচ্ছি না।'
'তাহলে চলুন, চা খেয়ে আমার অপরাধবোধটা কমাই।'

'When tea meet toast' নামের দোকানটিতে প্রবেশ করতে এতটা ভালো কখনোই লাগেনি জাহ্নবীর। আজ খুব একটা ভীড় নেই। একটা টেবিলে মুখোমুখি বসলো তারা। জাহ্নবী'র মাঝে নেই কোনো জড়তা, নেই কোনো ভয়ডর। সে নির্দ্বিধায় উঠে গিয়ে দুই কাপ চা ও তিন ধরনের টোস্ট দিতে বললো। সঙ্গে অনুরোধ করল তার প্রিয় সেই গানটা বাজাতে। 

এরপর চেয়ারে এসে বসলো সে। তাকালো পান্নাবাহারের দিকে। মধুর সুরের প্রিয় সেই গানটা বেজে উঠল তখন।
"তোমাকে বুঝিনা প্রিয়, বোঝো না তুমি আমায়..
দূরত্ব বাড়ে যোগাযোগ নিভে যায়।"

বুকের ভেতর চিনচিন করে ওঠে জাহ্নবী'র। এই তো সেদিন প্রথম দেখা, এই গানটাই বাজছিল তখন। সারল্যকে দেখে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিল সে। আবারও ফিরে পেয়েছিল নতুনভাবে। একটা নতুন জন্ম হয়েছে তার। এই তার পান্নাবাহার। 

সারল্য'র কথায় জাহ্নবী'র সম্বিত ফিরল, 'আপনি বিয়ে করেননি কেন?'

জাহ্নবী চমকে উঠল। তার বলা উচিৎ 'আপনাকে পাইনি বলে'। কিন্তু এটা নিছক মিথ্যা বলা হয়ে যায়। তাই সত্যিটাই বলল সে, 'একটা বয়স পর্যন্ত আমার ছেলেদের প্রতি কোনো আগ্রহ ছিল না। প্রেম, সংসার এসবের প্রতিও না।'
'আর এখন?'
সারল্য'র চোখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা শুনে জাহ্নবী কেঁপে উঠল। এখন তার মনের অবস্থা বোঝার মতো সাধ্যি কী তার নিজেরও আছে!

সে লাজুক হেসে মাথা নামিয়ে ফেলল। উত্তর দিলো না। সারল্য আর এ ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করলো না। চা চলে এসেছে। চায়ের মগে টোস্ট চুবিয়ে খেতে শুরু করল সারল্য। 

জাহ্নবী মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল তার দিকে। মনে হচ্ছে সারল্য একটা ছোট্ট শিশু। তার প্রিয় গানটা ততক্ষণে শেষ। পুরোটা সময় একটা ঘোরের মধ্যে ডুবে ছিল সে। হঠাৎ যেন ধাক্কা খেলো। লাজুক হেসে চায়ের কাপ তুলে নিলো জাহ্নবী। বলল, 'চায়ের বিলটা আমি দিয়েছি কিন্তু।'
'বন্ধুদের ভেতর এরকম থাকতে হয়না জাহ্নবী।'
'বন্ধুদের ভেতরেই এরকম থাকতে হয়।'
'হয় না।'
'তাহলে আপনার ফুলের ডালি ফেরত দেবো, নেবো না।'
সারল্য হাসতে হাসতে বললো, 'উফফ বাবা। মানলাম, আপনিই ঠিক। আমিই ভুল। বন্ধুদের মধ্যে এরকম হয়। এখন থেকে আমি আর কোনো বিলই দেবো না। সব আপনি দেবেন।'

জাহ্নবী হেসে বলল, 'দেবো।'
'এক বালতি চা খাবো আজকে।'
'খান। পরে শরীরের রক্তকণিকা গুলো চা কণিকায় পরিণত হবে।'
'আমি চা মানব হয়ে যাবো।'

দুজনেই হেসে উঠল। জাহ্নবী মুগ্ধ হয়ে দেখল ওই মানুষটার হাসি। ওর পলক ফেলতে ইচ্ছে করে না। কেবল ইচ্ছে হয় আজন্মকাল ধরে চেয়ে থাকি মানুষটার বিশুদ্ধ মুখের পানে।

পান্নাবাহারকে বিদায় দিয়ে বাসায় এসে অনেক্ষণ ফুলের ডালি নিয়ে বসে রইল জাহ্নবী। ওর বাসায় থাকা প্রত্যেকটা মেয়েকে ফুল উপহার দিলো। ভায়োলেটকে এক গুচ্ছ ফুল দিতে ইচ্ছে করছে। তাকে ফোন করল জাহ্নবী। কিন্তু কলটা রিসিভ হল না।

নির্জন ঘরটাতে শুতেই ঘুমে চোখ বুজে এসেছে ভায়োলেটের। ঘুমের ঘোরে সে শুনতে পাচ্ছে সামারের গলা। তার পাশেই শুয়েছে সামার। আরজুর সাথে ফোনে কথা বলছে। এখানে আসার কথা জানেনা আরজু। জানলে নির্ঘাত আজ এত হেসে হেসে কথা বলতে পারত না সামার। গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল ভায়োলেট। 

জানালায় মৃদু শব্দ হচ্ছে। খসখস শব্দ। সামার ফোন সরিয়ে বারকয়েক ভায়োলেটকে ডাক দিলো। সাড়া না পেয়ে ভয়েই শিউরে উঠল সে। খসখস শব্দটা ক্রমশ বেড়ে চলেছে। ফোন কেটে দিলো সামার। ঘরের আলো জ্বালিয়ে দিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইল। শব্দটা যাচ্ছে না। ভায়োলেটও উঠছে না। বাধ্য হয়েই অর্ণবকে কল দিলো সে। শব্দের কথা জানাতেই অর্ণব দ্রুত চলে এলো। 
দরজা খুলে দিয়ে সামার বলল, 'শুনতে পাচ্ছেন?'
'হ্যাঁ। আমি দেখছি।'
জানালা খুলে কিছুই দেখতে পেলো না অর্ণব। বলল, 'বাইরে গিয়ে দেখে আসি।'
'না, যাবেন না। আমার ভয় করছে।'
'জিনিসটা বাইরে। আমি গিয়ে দেখি কীসের শব্দ।'
'আমিও যাবো।'

অর্ণব ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। সামারকে সঙ্গে নিয়ে বাসা থেকে বের হল সে। বাড়ির পেছন দিকের জানালার পাশে শব্দের উৎপত্তি খুঁজতে এসেছে তারা। অর্ণবের হাতে টর্চ লাইট। জানালার কাছে আলো ধরতেই একটা কালো প্রাণী দেখে লাফ দিয়ে অর্ণবকে জাপটে ধরল সামার। অর্ণব চমকে ওঠে। সামারের উষ্ণ শরীরে বাসন্তী সুবাস। তার শরীরে চনমনে ঢেউ এসে দোলা লাগে। বুকটা টনটন করে ওঠে। অর্ণব মৃদু স্বরে বলল, 'ওটা একটা কুকুর। ময়লার বিন থেকে পলিথিনের ঠোঙা নিয়ে এসেছে। সেটারই খসখস শব্দ শুনেছেন।'

ধীরেধীরে অর্ণবকে ছেড়ে দিয়ে সরে দাঁড়ায় সামার। ওর লজ্জা লাগছে। লাজুকতা কাটাতে কিছুটা রাগমিশ্রিত স্বরে সে বলল, 'আপনি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছেন? যান কুকুরটাকে তাড়িয়ে দিন।'

অর্ণব হা করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। সে তাকে যেভাবে জাপটে ধরে রেখেছিল, তাতে কুকুর তাড়াতে যাওয়ার সুযোগ সে কোথা থেকে পাবে! মেয়েটার স্বভাবটাই এমন। অর্ণবকে সবসময় ঝাড়ির ওপর রাখতে পারলে আনন্দিত হয় সে। 
অর্ণব কুকুর তাড়িয়ে দিয়ে এসে বলল, 'চলুন।'
এবার আগে আগে হাঁটছে সামার। ভয়ের বিন্দুমাত্র আভাস নেই তার মাঝে। অর্ণব মনেমনে বলল, 'অদ্ভুত!'
ঘরে ঢোকার আগে সামার বলল, 'আমার খুব খিদে পেয়েছে।'
'আচ্ছা মাকে ডেকে দিই।'
'না, না। ওনাকে ডাকলে লজ্জা পাবো৷ আপনি কিছু একটা এনে দিন।'
'আমি দেখছি ফ্রিজে কী আছে।'

সামার বৈঠকখানায় সোফায় বসে পড়ে। মিনিট খানেকের মাথায় ফিরে এলো অর্ণব। হাতে একটা বাটি। সে বাটিটা সামারের সামনে রেখে বলল, 'পেস্ট্রি আর মিষ্টি আছে। হবে?'

মুচকি হেসে তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে সামার খেতে আরম্ভ করল। এক কামড় দিয়েই রাগের সুরে বলল, 'এত ঠাণ্ডা একটা খাবার আপনি আমাকে খেতে দিলেন?'

ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে অর্ণব বলল, 'ওরে বাপ এটা ফ্রিজ থেকে বের করেছি। ঠাণ্ডা তো হবেই। একটু অপেক্ষা করে তারপর খান।'
সামার উত্তর দিলো না। কোঁচকানো ভ্রু নিয়ে সে অর্ণবের দিকে তাকিয়েই রইল। মুশকিলে পড়েছে অর্ণব। তাকে একা বসিয়ে রেখে ঘরে যেতে পারছে না, আবার এখানে বসে থাকতেও বিব্রত লাগছে তার। সে মাথা নিচু করে গম্ভীর হয়ে গেল।

সামার মিষ্টি খাচ্ছে। রাগ ঝড়ে গেছে তার। খাওয়া শেষ করে এক গ্লাস পানি ঢকঢক করে খেয়ে বলল, ' থ্যাংক ইউ সো মাচ।'
'এখন ঘরে যান।'
'আমরা কালকে কখন বের হচ্ছি?'
'সকালের নাস্তা খেয়ে।'

ঘরে চলে গেল সামার। ঠায় বসে রইল অর্ণব। তার শরীর ও মন অদ্ভুতভাবে দোলাচলে দুলছে। আবারও এই মেয়েটাকে ভালবাসতে শুরু করেছে সে। কিন্তু তাকে কখনোই পাবেনা জেনেও ভালবাসাটা নিতান্তই ভুল। মনকে এই ভুল করা থেকে কীভাবে আটকে রাখবে সে? ভালবাসা তো আটকে রাখা যায় না। যতটা আটকাতে চেষ্টা করা হয়, ততটাই তীব্র হয় মায়া। সেই মায়া কাটিয়ে বেরিয়ে আসা কঠিন, ভীষণ কঠিন।
.
.
.
চলবে........................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp