মেঘফুল - পর্ব ০৮ - মিশু মনি - ধারাবাহিক গল্প


জাহ্নবী চাকরির ইন্টারভিউতে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ভালো করেছে। ফলাফল কী আসে এখন সেই অপেক্ষার প্রহর গুণতে হবে। জাহ্নবী ইতিমধ্যেই সেই প্রহর গুণতে আরম্ভ করে দিয়েছে। কলিংবেলের আওয়াজ শুনে তার ভ্রম ভাঙলো। 
লুকিং গ্লাসে চোখ রেখে রীতিমতো চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল তার। সেদিনের ওই লোকটা এসেছে, কী যেন নাম? অর্ণব! জাহ্নবী দরজা খুলে খানিক্ষণ তাকিয়ে রইল অর্ণবের দিকে। হাতে ব্যাগ, চোখে সানগ্লাস আর ঘর্মাক্ত শার্টে কিম্ভূতকিমাকার দেখাচ্ছে তাকে। 
অর্ণব বলল, 'আসতে পারি?'
'হ্যাঁ আসুন না। বাবা তো বাসায় নেই।'
অর্ণব অস্বস্তিতে পড়ে গেল। আজকে সে শুধু জাভেদ আলীর কাছেই আসে নি, আজ সে সুখবর জানাতে এসেছে। সুখবরের সঙ্গে এনেছে কুমিল্লার মাতৃভাণ্ডারের রসমালাই। সবাইকে মিষ্টিমুখ করানোই তার নৈতিক ইচ্ছা। 
জাহ্নবী অর্ণবকে বসতে বলে পারভীনকে খবরটা দিয়ে এলো। অর্ণবের আবারও আসার পেছনের কারণ জানতে না পারলেও বিরক্ত হয়েছেন তিনি। বিরসমুখে জাহ্নবীকে বলে দিলেন, ' তোর বাপকে কল দিয়ে বল। ছেলেটাকে চা নাস্তা খাওয়া। বাপের সমাজসেবার ষোলকলা পূর্ণ কর বাপ মেয়ে মিলে।'

জাহ্নবী অর্ণবের সামনে সোফায় বসল। এদিক সেদিক তাকিয়ে আমতা আমতা করতে লাগল জাহ্নবী। অর্ণব রসমালাইয়ের প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বলল, 'এটা রাখুন।'
জাহ্নবী বলল, 'এটার কী দরকার ছিল বলুন তো?'
'দরকার তো অবশ্যই ছিল। একটা সুখবর আছে।'
'কী! '
'আমার চাকরি হয়েছে।'
'বাহ, খুব ভালো সংবাদ।'

মিষ্টি করে হাসল জাহ্নবী। অর্ণব বসে রইল শান্ত হয়ে। জাহ্নবীর হঠাৎ মনে হল, আজকে অর্ণবকে অনেক আত্মবিশ্বাসী দেখাচ্ছে। গতদিনের তুলনায় সে খুবই স্মার্ট এবং শান্ত। চাকরি হওয়াটাই নিশ্চয়ই এর কারণ! মানুষের মাঝে যখন স্বনির্ভরতা আসে, নিজেও সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। 
জাহ্নবী বাটিতে করে রসমালাই ও নাস্তা এনে দিলো অর্ণবের জন্য। অর্ণবকে বলল, 'আপনি হাতমুখ ধুয়ে আসুন।'
' কিছু মনে না করলে আমি একবার ওয়াশরুমে যেতাম। চট্টগ্রাম থেকে এসেছি তো।'
' ওহ! সরি। আমারই বলা উচিৎ ছিল।'

অর্ণবকে বাথরুম দেখিয়ে দিলো জাহ্নবী। হাতমুখ ধুয়ে এসে বসল অর্ণব। জাহ্নবী চা নিয়ে বসে আছে। অর্ণব বিভ্রান্তিতে পড়ে গেল, আগে নাস্তা খাবে নাকি চা? চা তো ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।
জাহ্নবী হেসে বলল, ' চা খেয়ে নিন আগে।'
অর্ণব হাত বাড়িয়ে টেবিল থেকে চায়ের কাপ তুলে নিলো। ধন্যবাদ জানালো চায়ের জন্য। চা খাওয়া শেষ করে নাস্তা খেলো অর্ণব। জাহ্নবী বাবার জন্য অপেক্ষা করছে। অর্ণবকে একাকী বসিয়ে রেখে ভেতরে যেতেও পারছে না সে। 

কিছুক্ষণ পর জাহ্নবী বলল, 'আপনি আমার রুমে গিয়ে বিশ্রাম নিন। আব্বু চলে এলে আসবে একটু পরেই।'
অর্ণব ইতস্তত করতে করতেই ব্যাগ নিয়ে জাহ্নবীর ঘরে চলে গেল। জাহ্নবী বসে রইল শান্ত ভঙ্গীতে। অদ্ভুত ব্যাপার, গত বারের মতো আজ ওর বিরক্ত লাগছে না, অস্বস্তি হচ্ছে না, এমনকি মুহুর্তের জন্যও মনে হচ্ছে না, মেহমান কেন তার রুমে গেল? বরং মেহমানকে আপ্যায়ন করতে পেরে খুশি খুশি লাগছে। নিজের মাঝে আসা অদ্ভুত পরিবর্তন টের পেয়ে ভালো লাগায় ভেতরটা ছেঁয়ে গেল জাহ্নবীর। 

অর্ণব দরজায় দাঁড়িয়ে গলা খাকাড়ি দিয়ে জাহ্নবীকে ইশারা করল। জাহ্নবী জানতে চাইল, 'বলুন?'
'ফোনের চার্জার হবে? আমার চার্জারটা এখানে লাগছে না। মাল্টিপ্লাগ হলেও হবে।'
জাহ্নবী ঘরে প্রবেশ করল। দরজায় দাঁড়িয়ে রইল অর্ণব। জাহ্নবীর বেশ লজ্জা লজ্জা লাগছে। ড্রয়ার হতে চার্জার বের করে টেবিলে রাখল সে। বের হওয়ার সময় অর্ণব বলল, ' থ্যাংকস আপু।'
জাহ্নবী অর্ণবের দিকে এক পলক তাকালো। কোনো উত্তর দিতে পারলো না। অর্ণব চার্জার হাতে নিয়ে দেখল এই চার্জারের পিন দিয়ে তার ফোনে চার্জ দেয়া সম্ভব না। অর্ণব আবারও জাহ্নবীকে বিরক্ত করতে চাইলো না। তাই চুপচাপ বসে রইল জাহ্নবীর বিছানায়। মেয়েদের অসাধারণ করে ঘর গোছানোর ব্যাপারটা ওকে মুগ্ধ করে। চারপাশে চোখ বুলিয়ে সব মেয়েলি জিনিস দেখতে পাচ্ছে সে। অর্ণব চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইল। 

ভায়োলেট বাসায় ফিরে জাহ্নবীকে জিজ্ঞেস করল, 'অর্ণব সাহেব এসেছে নাকি?'
জাহ্নবী অবাক হলো, 'হ্যাঁ। তুই কিভাবে জানলি?'
' ওনার জুতা দেখলাম দরজার সামনে।'
'বাপরে, তুই মানুষের জুতাও মনে রাখিস?'
'এটা একটা সাধারণ ব্যাপার আপু। মনে রাখার মতো কিছু না।'
ভায়োলেটকে আজ অনেক বিক্ষিপ্ত দেখাচ্ছে। জাহ্নবী ভায়োলেটের ঘরে বসে আছে। ভায়োলেট গোসল করতে ঢুকে অনেক্ষণ সময় কাটালো। নিশ্চয়ই ওর কিছু হয়েছে। জাহ্নবী অনেক কষ্টে দমিয়ে রাখলো কৌতুহল। 

ভায়োলেট ভেজা চুল পিঠের ওপর এলিয়ে দিয়ে ল্যাপটপ নিয়ে বসল। খাতায় কী যেন লিখল অনেক্ষণ ধরে। জাহ্নবী বসে রইল দূরে। জাভেদ আলী এখনো বাসায় ফেরেননি। 

জাহ্নবী অর্ণবের দরজায় শব্দ করে বলল, 'আপনি খেতে আসুন।'
অর্ণব খাবার টেবিলে এসে জানতে চাইল, 'আংকেল এসেছেন?'
'না।'
'আন্টি কোথায়?'
'মা ঘুমাচ্ছেন।'
'আপনাদেরকে আবারও কষ্ট দিচ্ছি। কিছু মনে করবেন না প্লিজ।'
' আরে না না, আপনি নির্দ্বিধায় খান।'

অর্ণব জাহ্নবীর দিকে এক পলক তাকিয়ে খাবার খেতে শুরু করল। জাহ্নবী ভায়োলেটকে খাবার খেতে অনুরোধ করলে সে জানালো, 'পরে খাবো।'
ভায়োলেটকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত দেখাচ্ছে। জাহ্নবীর ভালো লাগছে না কিছুই। খাবার খাওয়ার এক পর্যায়ে অর্ণব বলল, ' আপনাকে একটা কথা বলি, কিছু মনে করবেন না তো?'
'না। বলুন?'
' ওই চার্জার দিয়ে ফোনটা চার্জ হয় নি। আমি কী এখানে আমার ফোনটা চার্জে দিতে পারি?'

জাহ্নবী চোখ তুলে তাকালো অর্ণবের দিকে। আচমকা বিদ্যুৎ শক খাওয়ার মতো শরীর কাঁপুনি দিয়ে উঠলো জাহ্নবীর। অর্ণবের সঙ্গে এই চোখাচোখি ওর সত্তাকে নাড়িয়ে দিয়েছে। জাহ্নবী বেশ অনুভব করল কত দ্রুত হৃদস্পন্দিত হচ্ছে তার। 
অর্ণব খাবার টেবিলের পাশে চার্জে লাগিয়ে দিলো ফোনটা। জাহ্নবী দ্রুতপদে চলে এলো সেখান থেকে। কখনো কোনো পুরুষের সঙ্গে এত কাছাকাছি থেকে চোখাচোখি হয় নি তার। খুব অন্যরকম লাগছে ওর। একটা আবছা অস্থিরতা ওকে ক্রমশ ভারী করে তুললো। 
অর্ণব খাওয়া শেষ করে টেবিলের পাশেই বসে রইল অনেক্ষণ। জাহ্নবী ভায়োলেটের ঘরে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। সে আর একটিবারও অর্ণবের সামনে যায় নি। 

জাভেদ আলী বাসায় এলেন সন্ধ্যাবেলা। অর্ণবের চাকরি প্রাপ্তির খবরটা শুনে সবচেয়ে বেশী খুশি হলেন তিনি। সবার আগে পারভীনকে মিষ্টি খাওয়াতে গেলেন। পারভীন চোখ বুজে গম্ভীর মুখে শুয়ে আছেন। জাভেদ আলীর এইসব আধিখ্যেতা ওনার একেবারেই অপছন্দ।

জাভেদ আলী যখন বললেন, ' ছেলেটার কষ্ট দূর হলো অবশেষে। বেচারা ঢাকা শহরে এসে থাকার জায়গা পায়নি, বন্ধু মোবাইল নিয়ে সরে পড়েছে। এখন সে নিজের টাকায় বাসা নিয়ে থাকতে পারবে। হা হা হা।'
'এত খুশির কী আছে? যেন তোমার ছেলে চাকরি পেয়েছে?'
' ছেলের মতো তো।'
'যাও কোলে নিয়ে নাচো।'
'হা হা হা। ছেলেটা চাকরি পেয়ে আমার জন্য মিষ্টি নিয়ে এসেছে পারভীন। এর চাইতে বড় কৃতজ্ঞতা আর কীভাবে প্রকাশ করে মানুষ?'

পারভীন উত্তর দিলেন না। জাভেদ আলী বললেন, 'ওর বাবার অনেক টাকা পয়সা। কিন্তু ছেলে ভালো, বাবার টাকায় চলে না। সে নিজে ইনকাম করে নিজের খরচ চালায়। নতুন চাকরি পেয়েছে, বড় কোম্পানিতে বড় পোস্ট। সত্তর হাজার টাকা বেতন।'
পারভীন এখনো অন্যদিকে তাকিয়ে আছেন। যেন এই বেতনের কথা শুনেও তিনি খুশি হতে পারেননি। বিছানা থেকে নামলেন তিনি। জাভেদ আলীর সঙ্গে আর কথা বাড়ালেন না। মিষ্টিও খেলেন না। জাভেদ আলী একাই মিষ্টি মুখে দিয়ে বসে রইলেন। 

জাহ্নবী ভায়োলেটকে বলল, ' সামারকে ফোন দিয়েছিলি?'
'না। একটা টেক্সট দিয়েছিলাম সকালে। ওর ওখানে নেটওয়ার্ক নেই সম্ভবত। রিপ্লাই পাইনি।'
'ওহ আচ্ছা। ভায়োলেট, আমার চাকরিটা হবে তো?'
'টেনশন কোরো না আপু। বি কনফিডেন্ট। চাকরি না হলে অন্য আরেকটা হবে। হাসিখুশি থাকো।'
জাহ্নবী উদাস গলায় বলল, 'চাকরি পাওয়ার আনন্দ অনেক জানিস? অর্ণব চাকরি পেয়েছে। ওর চোখেমুখে কী যে আনন্দের ঝিলিক! চেহারাটাই পালটে গেছে বেচারার। আগে ছিল অস্থির প্রকৃতির, পাগল পাগল। অথচ আজকে স্মার্ট, শান্ত শিষ্ট। ভেতর থেকে চেঞ্জ এসে গেছে ওর।'
ভায়োলেট হেসে বলল, 'তোমারও আসবে আপু। পুরো জীবনটাই চেঞ্জ হয়ে যাবে তোমার।'
' দোয়া করিস আমার জন্য। যদিও জীবনটা এখনই চেঞ্জ হতে শুরু করেছে।'
'কী বলো আপু! প্রেমে পড়েছ নাকি?'
'আরে ধুর। ওসব না। আমি আর আগের আমি নেই, সেটাই বুঝিয়েছি।'
ভায়োলেট হেসে বলল, ' মজা করছিলাম। তোমাকে যেন সবসময় এমনই দেখি আপু। আমার যে কী আনন্দ হচ্ছে, বোঝাতে পারবো না তোমায়।'

এমন সময় পারভীন এসে জাহ্নবীকে ডাকলেন। জাহ্নবী জবাব দিয়ে বলল, 'বলো আম্মু।'
' বাসায় চিনিগুড়া চাল ছিল না? পাচ্ছি না কেন?'
' চাল নেই আম্মু। সেদিন খিচুড়ি রান্না করে খেয়ে ফেলেছি।'
পারভীনের আর কোনো কথা শোনা গেল না। জাহ্নবী জানতে চাইল, 'চিনিগুড়া চাল দিয়ে কী করবা?'
' পায়েস রান্না করতাম একটু। দুইবোন নিচে যা না, মিনাবাজার থেকে কিছু বাজার টাজার করে নিয়ে আয়। পোলাও রান্না করি না অনেকদিন।'

জাহ্নবী ও ভায়োলেট একে অপরের দিকে তাকালো। পায়েস, পোলাও, শব্দ দুটো চমকে দিয়েছে ওদেরকে। চোখ বড়বড় করে ওরা একে অপরের দিকে চেয়ে রইল। ভায়োলেট মুচকি হেসে বলল, 'আম্মু, আমরা নিচে যাচ্ছি একটু পর। আর কি কি লাগবে বলো?' 
পারভীন মেয়েদের সামনে এসে দাঁড়ালেন। ওনাকে অনেক উৎফুল্ল দেখাচ্ছে। রোগা রোগা ভাবটা আর নেই। চিন্তা করে বললেন, 'গরুর গোশত খাবি? না মুরগী?'
' তুমি যা রাঁধবা আমরা তাই খাবো আম্মু।'
' তাহলে গরুর গোশতই ভালো হবে। দুধ আনবি এক কেজি। কিসমিস, বাদামও নেই বাসায়।'

পারভীন বাজারের লিস্ট বলে যাচ্ছিলেন। এক পর্যায়ে ভায়োলেট বলল, 'আম্মু কী অর্ণব সাহেবকে জামাই বানানোর চিন্তা করছো নাকি?' 

কথাটা বলেই দুষ্টুমিভরা হাসি দিলো ভায়োলেট। জাহ্নবী চমকে উঠলো। পারভীনের মুখখানা কালো হয়ে উঠল মুহুর্তেই। রেগে বললেন, 'লাগবে না তোদের বাজারে যাওয়া। রান্নাই করবো না কিছু।' 
রাগে আগুন হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন পারভীন। ভায়োলেট মুখ টিপে হাসতে হাসতে বিছানায় শুয়ে পড়ল। হাসি আটকে রাখতে পারছে না সে। এই বয়সেও আম্মুর এমন অভিমানী স্বভাব খুবই আনন্দদায়ক লাগে ওর কাছে। জাহ্নবী বলল, 'কাজটা ঠিক করলি তুই? মা রেগে গেছে।'
'আমি মজা করে বলেছি।'
'মা মজা বোঝে বলে তোর মনে হয়?'
'ওহ নো। মা এখন ডিপ্রেশনে চলে যাবে। যাই, শান্ত করি গিয়ে।'

ভায়োলেট মাকে ডাকতে ডাকতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। জাহ্নবী বসে রইল স্থবির হয়ে। ওর বুক ধরফর করছে। কোনো এক অজানা কারণে ভায়োলেটের বলা কথাটা ওর দেহে শিরশিরে এক অনুভূতির জন্ম দিয়েছে। শিউরে উঠছে গা। জাহ্নবী চোখ মেলে রাখতে পারল না। আজ এত ছটফট লাগছে কেন! 
.
.
.
চলবে..........................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp