'আপনার গলার স্বর আমার ভীষণ পরিচিত। যেন বহুবার কোথাও শুনেছি এই কণ্ঠ।' বেশ আবেগ ফুটে উঠলো ফোনের ওপাশের মানুষটার কথায়।
জাহ্নবী শিহরিত হলো। সামার কী তবে সারাক্ষণ এমন মিষ্টি কথায় মুখর হয়ে থাকে! ওর হৃদয় আন্দোলিত হলো। কাঁপা কাঁপা গলায় জাহ্নবী বলল, 'আপনি এত রাতে কেন ফোন করেছেন?'
কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গেই জাহ্নবীর বুক ধড়ফড় করতে শুরু করল। একইসাথে সেই তীক্ষ্ম ব্যথার বীণ বাজতে লাগল। জাহ্নবী বারান্দার রেলিংয়ে হাতের মুঠো রেখে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে।
লোকটা বলল, 'আমি আপনাকে সরি বলার তাগিদ অনুভব করছি। আপনাকে বারবার বিরক্ত করাটা আমার উচিৎ হয় নি।'
'আচ্ছা। '
'আর 'হ্যা, আপনাকে ফোন দেয়ার আরও একটা কারণ হচ্ছে ধন্যবাদ জানানো। আপনি আজ ওভাবে না রিয়েক্ট না করলে এই বিষয়টা আমার কখনোই শেখা হতো না। থ্যাংকস ম্যাডাম।'
'আচ্ছা? তাই?'
জাহ্নবী জানেনা এই আগন্তুকের সঙ্গে ভায়োলেটের ঠিক কী বিষয়ে কথা হয়েছে। নিতান্তই না জানার কারণে 'আচ্ছা' আর 'তাই' শব্দ দিয়ে কথা চালিয়ে যেতে হল ওকে।
লোকটা বলল, 'আমাদের কম্পিউটারে সবার ডাটা থাকে সেটা তো জানেনই। সেখান থেকেই নাম্বার নিয়ে কল দিয়েছি। কিছু মনে করেননি তো?'
'মনে করাটাই কী স্বাভাবিক নয়?'
উত্তরটা দিতেই জাহ্নবী টের পেলো ওর গলা কাঁপছে। বলল,' কেউ সেচ্ছায় ফোন নাম্বার না দিলে তাকে কোনোভাবেই ফোন করা উচিত না।'
'ইস, তাহলে আরেকটা ভুল করে ফেললাম। এই ভুলের জন্য কী ক্ষমা করা যাবে?'
জাহ্নবীর মনে অন্যরকম একটা সুখের দোলা লাগল। মৃদু হেসে বলল, 'না যাবে না।'
'তাহলে কী শাস্তি দেবেন আমায়?'
জাহ্নবী চুপ করে রইল। শাস্তি? সে ওই লোকটাকে কীভাবে শাস্তি দেবে? যাকে চেনেই না সে। ভায়োলেটের সঙ্গে কোন ঘটনার মধ্য দিয়ে পরিচয় হয়েছে সেটাও ওর অজানা।
লোকটা বলল, 'আপনি কি লাইব্রেরিতে আসা বন্ধ করে দেবেন?'
জাহ্নবী কোনো উত্তর খুঁজে না পেয়ে বলল, ' হ্যাঁ। আমি লাইব্রেরিতে যাওয়া বন্ধ করে দেবো।'
'এটাই কি আমার শাস্তি?'
'জি। বুঝতে পেরেছেন নাকি আরও বুঝিয়ে বলবো?'
জাহ্নবী মধুর সুরে শেষ কথাটা বললো ঠিকই কিন্তু নিজের মাঝেও মধুপানের স্বাদটুকু উপভোগ করলো। কারও সাথে কথা বলতে বুঝি এতটাই ভালো লাগে! এই আস্বাদন আরও পেতে চায় জাহ্নবী।
লোকটা বলল, 'আপনার নামটা খুব সুন্দর, ভায়োলেট। আমার মনেহয় বাংলাদেশে এই নাম আর কারও নেই।'
জাহ্নবীর বলতে ইচ্ছে করলো, 'আমার নাম ভায়োলেট নয়।' কিন্তু বলতে পারলো না। ওর মন খারাপ হয়ে গেল। মনের ভাটায় টান পড়ে তা যেন শুকিয়ে আরও খরায় রূপ নিলো।
জাহ্নবী নিঃশব্দে ফোন কানে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওপাশের ছেলেটার গলায় তখন মাখো মাখো উদ্বেগ, , 'আপনি কথা বলছেন না কেন? বিরক্ত হচ্ছেন?'
'যদি বলি হচ্ছি?' মুখ টিপে হেসে উত্তর দিলো জাহ্নবী।
'তাহলে বিরক্ত করার দায়ে এই অধমের গর্দান কাটা যাবে।'
' তাই? এত সহজেই বুঝি গর্দান দিয়ে দেবেন?'
' আপনি চাইলে তো দিয়ে দেবো-ই।'
' কেন? আমি চাইলে কেন দিয়ে দিবেন?'
'কারণ ভায়োলেট নামে বাংলাদেশে আর কেউ নেই। তাই।'
'হা হা হা।'
জাহ্নবী হাসছে। ওর মজা লাগছে কথা বলতে। একইসাথে খারাপ লাগছে এই ভেবে যে, কেন ওর নাম ভায়োলেট হলো না?
জাহ্নবী বাচ্চাদের মতো হঠাৎ জানতে চাইলো, ' আচ্ছা, আপনার নাম কি?'
' অর্জন।'
' স্বাধীনতা অর্জন?'
' হা হা হা।' হাসতে লাগল অর্জন। আর জাহ্নবী মনেমনে ভাবতে লাগল, কী বলে ছেলেটাকে মুগ্ধ করা যায়। যেভাবে ছেলেটা কিছুক্ষণ আগে ওকে মুগ্ধ করে দিয়েছিল। কিন্তু তেমন কিছু তো ওর মাথায় আসে না। ও একটা গবেট।
মুখ টিপে হাসলো জাহ্নবী।
অর্জন বলল, 'আপনি কী ভাবছেন আমি জানি।'
জাহ্নবী চমকে উঠলো, 'কী ভাবছি?'
'ভাবছেন অর্জন নামেও বাংলাদেশে আর কেউ নেই।'
জাহ্নবী হেসে উঠলো। লোকটা চমৎকার কথা জানে। পরক্ষণেই হাসি মিলিয়ে গেল ওর। আচ্ছা, সে কি আদৌ কোনো লোক? নাকি ছেলে? বয়স কত হবে তার? প্রশ্নগুলো মনের কোণে উঁকি দেয়ামাত্রই জাহ্নবীর শরীরে কাটা দিতে লাগল।
জাহ্নবী হঠাৎ কিছু না বলেই কল কেটে দিলো। নিজের ভেতর এক ধরনের অপরাধবোধ কাজ করতে শুরু করেছে। ফোনটা সে না ধরলেও পারতো। এই অপরাধবোধে আজ সারা রাত ঘুমাতে পারবে না সে।
অপরিচিত নাম্বারটা থেকে আবারও এলো কল। জাহ্নবী ফোনটা সাইলেন্ট করে ভায়োলেটের বালিশের কাছে রেখে দিলো। মানুষের যখন কেউ থাকে না, তখন একাকীত্ব তাকে এমনভাবে চেপে ধরে যে, একটা মানুষ পাবার জন্য পাগল হয়ে ওঠে সে। মন হয় প্রচণ্ড ব্যকুল। এই ব্যকুলতাই এই অপরাধ করতে উৎসাহিত করেছে ওকে।
জাহ্নবী শুয়ে পড়ল ভায়োলেটের পাশে। ভায়োলেটের গা থেকে একটা মিহি সুবাস ভেসে আসছে। জাহ্নবীর ইচ্ছে করছে ঘর থেকে বের হয়ে পাগলের মতো কোনো একদিকে চলে যেতে। মনস্তাত্ত্বিক জটিলতাগুলোকে অশান্তির সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছে দিচ্ছে ওকে।
কয়েক মিনিট বাদে জাহ্নবী আবারও ভায়োলেটের ফোনটা হাতে তুলে নিলো। অর্জন একবার কল দিয়েছে মাত্র। জাহ্নবীর আশা ছিল আরও কয়েকবার কল আসবে। হতে পারে অর্জন নিতান্তই ভদ্রলোক। ভায়োলেট কোনো সমস্যায় পড়তে পারে, সেই ভেবে আর কল দেয় নি।
জাহ্নবী কয়েকবার এপাশ ওপাশ করল। ভায়োলেটের মোবাইল নিজের বালিশের নিচে লুকিয়ে রাখল। ওর ভীষণ অস্থির লাগছে। শরীরে এক ধরণের আবেদন অনুভব করছে সে। একইসাথে অপরাধবোধের প্রবল যন্ত্রণা ওকে গ্রাস করতে লাগল। এই দু'য়ের মাঝে দুলতে দুলতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ল জাহ্নবী।
পারভীনের চেঁচামেচিতে ঘুম ভাংলো যথারীতি। ভায়োলেট এখনও ঘুমে। জাহ্নবী ভায়োলেটের মোবাইল বের করে একবার দেখেই রেখে দিলো। অর্জন কোনো মেসেজ দিয়েছে কিনা সেটা দেখাই ছিল ওর উদ্দেশ্য।
সবার নাস্তা যখন প্রায় শেষ, ভায়োলেট তখন উঠে এলো ঘুম থেকে। জাহ্নবী থালাবাসন ধুচ্ছে। ভায়োলেট এক কাপ চা নিয়ে খাবার টেবিলে বসল।
জাহ্নবী ছুটে এসে বলল, ' পরোটা দেই তোকে?'
' পরে খাবো৷'
' ডিম ভাজি করেছি। ধনেপাতা কুচি দিয়ে, তোর তো খুব প্রিয়?'
ভায়োলেট একপলক জাহ্নবীর দিকে তাকিয়ে মুহুর্তেই চোখ নামিয়ে নিলো। জাহ্নবী চমকে উঠলো। আবারও থালাবাসন ধুতে চলে এলো সে। মানুষ যখন কোনো অন্যায় করে, সারাক্ষণ আতঙ্কে থাকে সে। জাহ্নবীর এখন সেই দশা চলছে।
ভায়োলেট বলল, 'বাবা কোথায়? নাস্তা খেয়েছে সবাই?'
জাহ্নবী রান্নাঘর হতে উত্তর দিলো, ' খেয়েছে। আব্বু নিচে গেছে।'
' মেজো আপু খেয়েছে?'
' ও এখনও ঘুমে।'
' মেজোপুর এখন সুখের সময়। ওর সুখ দেখলে হিংসে হয় না তোমার?'
জাহ্নবী থালাবাসন ধোয়া বন্ধ করে উত্তর দিলো, 'আমার তো তোর সুখ দেখলে হিংসে হয়।'
ভায়োলেট হাসতে হাসতে বললো, ' ভালো বলেছো। আমি আসলেই সুখী।'
'তোর মতো সুখী যদি হতে পারতাম!'
ভায়োলেট চায়ের কাপ রান্নাঘরে রেখে বলল, 'সুখী হতে চাইলে এই বাড়ি ছেড়ে বের হও আপা। অনেক সুখী হবা।'
জাহ্নবী বিস্ময়ে হা করে ভায়োলেটের দিকে তাকিয়ে রইল। ভায়োলেট বেরিয়ে গেছে। কিন্তু ওর কথার রেশ জাহ্নবীর গায়ে বাতাসের মতো লেপ্টে আছে এখনও।
জাহ্নবী কাজ শেষ করে ভায়োলেটের ঘরের দরজায় এসে বলল, 'আসবো?'
সামার শুয়ে শুয়ে মোবাইলে চোখ বুলাচ্ছে। রীতিমতো অবাক হয়ে বলল, 'আসেন ম্যাডাম। আমাদের রুমে ঢোকার আগে পারমিশন নিতে হবে বুঝি?'
'হ্যাঁ নিতে হবে না? তোরা বড় হয়েছিস তো।'
'বারে, বড় হয়েছি তো কী হয়েছে? আমরা কি সাতসকালে বড়দের মতো কাজ করবো নাকি?'
কথাটা বলেই হেসে উঠলো সামার। হাসলো ভায়োলেটও। জাহ্নবী ইতস্তত বোধ করল। সামার বলল, 'বড়দের কাজকারবার রাতেই শেষ। এখন শুধু রেস্টের সময়। বলো কী বলবা?'
জাহ্নবী লজ্জায় তাকাতে পারছে না। সামার দ্বিধাহীনভাবে সব ধরনের মজা করতে পারলেও সে পারে না।
ভায়োলেট বলল, 'আমি জানি বড় আপু কি বলতে চায়?'
জাহ্নবী শিউরে উঠল। বুক ধক করে উঠলো তার। ভায়োলেটের দিকে অবাক হয়ে তাকাল সে। ভায়োলেট হাসতে হাসতে বলল, 'আরে আপু, আমাদের সঙ্গে একটু সহজ হও না।'
জাহ্নবী স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ভায়োলেট কী তাহলে মোবাইল দেখে ফেলেছে? নাকি শুনে ফেলেছে সব কথা!
ভায়োলেট বলল, 'আপুকে একটু আগে বলেছি সুখী হতে চাইলে বাড়ি থেকে বের হও। নিশ্চয় এটা নিয়ে টেনশান করছে। তাইনা আপু?'
নিশ্চিত হলো জাহ্নবী। স্বস্তির সঙ্গে তাকালো ভায়োলেটের দিকে। এদেশে যদি কারও মোবাইল ফোনের দিকে বিন্দুমাত্র আগ্রহ না থাকে, তবে সে হচ্ছে ভায়োলেট। প্রতিটা মানুষই বোধহয় ঘুম থেকে উঠেই আগে মোবাইল নিয়ে একবার চেক করার অভ্যাস আছে। ভায়োলেট সেখানে সবার চাইতে আলাদা।
জাহ্নবী ভায়োলেটকে বলল, 'আমার রুমে আয় তো।'
ভায়োলেট হেসে বলল, 'চলো।'
.
.
.
চলবে.....................................................................