মেঘফুল - পর্ব ১৭ - মিশু মনি - ধারাবাহিক গল্প


সন্ধ্যার পর হলুদ আলোয় রাঙা একটা রেঁস্তোরায় বসে আছে জাহ্নবী ও ভায়োলেট। লোকটার সঙ্গে এখানেই দেখা করার কথা। এখনো আসছেন না তিনি। এই সময়ে রাস্তায় খুব জ্যাম থাকে, জাহ্নবীর অপেক্ষা করতে খারাপ লাগছে না। সে তার সময়মতই আসুক। 

পুরো রেঁস্তোরায় মাত্র চারজন ব্যক্তি ছাড়া আর কেউ নেই। দরজা ঠেলে একজন ব্লেজার পরা লোককে আসতে দেখে জাহ্নবী নিশ্চিত হল ইনিই সেই! লোকটার দিকে তাকালে সবার আগে যে জিনিসটার দিকে চোখ যায় সেটা হচ্ছে ওনার মেদ। বয়সের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে যেটা। জাহ্নবীর এসব নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। মানুষটা কেমন সেটাই আসল কথা।

মানুষটার সঙ্গে কথা বলে বোঝা গেল তিনি লোক ভালো। ক্লিন সেভ করার কারণে ওনাকে বেশ ভদ্রলোক মনে হচ্ছে। 
জাহ্নবীর সামনে বসেই তিনি বললেন, 'আপনারা কিছু খান নি?'
জাহ্নবী মনেমনে ভাবল, 'এখানে এসেছি আপনাকে দেখতে। এসেই খাওয়াদাওয়া শুরু করবো? কী অদ্ভুত!'
তিনি বললেন, 'আমি অবশ্য খেয়েই বের হয়েছি। আমার এখন কিছু খাওয়ার দরকার নেই। আপনাদের জন্য অর্ডার দেই। কী খাবেন বলেন?'

ভায়োলেট দুষ্টুমি করে বলল, 'আপনার খাবার কী এখনো পেটে আছে?'
'মানে!'
'না, কিছু না।'
মুচকি হাসল ভায়োলেট। লোকটা তার মশকরা বুঝতে পারে নি। সিরিয়াস মুখ করে রেখেছে এখনও। বললেন, 'আমি আবার কম খাবার খাই। আর ফাস্টফুড এভোয়েড করার চেষ্টা করছি এখন।'
'মেদ বাড়ছে বলে?'
'ঠিক তা নয়, ফাস্টফুড জাতীয় খাবার কম খাওয়াই ভালো।'
'ওহ আচ্ছা।'

জাহ্নবী চুপচাপ মাথা নিচু করে বসে রইল। লোকটা কী পরিচয় জানতে চাইবে না নাকি? অনেক্ষণ নিরবে কেটে যাওয়ার পর জাহ্নবী বলল, 'আপনার সঙ্গে পরিচিত হওয়া দরকার।'
'অবশ্যই। আমি মোস্তফা কামাল। মালয়েশিয়ায় একটা ব্যবসা আছে আমার। নতুন ব্যবসা। আগে অবশ্য চাকরি করতাম। এখন ব্যবসা শুরু করেছি। অন্যের আন্ডারে কাজ করতে আর ভালো লাগে না। অনেক কষ্টই তো করলাম জীবনে। আপনাদের নাম কি? আচ্ছা, আপনাদের মধ্যে জাহ্নবী কে?'

জাহ্নবী ও ভায়োলেট একে অপরের দিকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো। ভায়োলেট মুখ থমথমে করে তাকিয়ে আছে। জাহ্নবী বলল, 'আমি।'
লোকটা এতক্ষণ দুজনের দিকেই তাকিয়ে কথা চালিয়ে যাচ্ছিল। এবার সে জাহ্নবীর দিকে মনযোগ দিলো। জানতে চাইলো,
'আপনি পড়াশোনা শেষ করেছেন?'
'হ্যাঁ।'
'অনার্স না মাস্টার্স?'
'মাস্টার্স।'

লোকটা বলল, 'ওহ, ভালো তো। আমি মাস্টার্স করতে পারিনি। অনার্স সেকেন্ড ইয়ার পর্যন্ত পড়ে বিদেশে দৌড় দিছি। লাইফটা অনেক কমপ্লেক্স। পড়াশোনা সবার জন্য না।'
জাহ্নবী চুপ করে রইল। এই কথার উত্তরে কিছু বলার মতো খুঁজে পাচ্ছে না সে। লোকটা বারবার এক আঙুল দিয়ে কান চুলকাচ্ছে। আঙুল কানের ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়ে নাড়াচ্ছে। বিব্রতবোধ করছে জাহ্নবী।

মোস্তফা কামাল বললেন, 'আমি অনেক স্ট্রাগল করে মানুষ হইছি বুঝছেন। আমি যখন ইন্টারে পড়ি, তখন আমার আব্বা মারা যান। এরপর থেকে আর পড়াশোনা চালানোর মতো সুযোগ ছিল না। তবুও অনেক কষ্টে অনার্সে ভর্তি হই। দুই ভাই, চারবোনের সংসার আমাদের। আমার মা একদম গৃহিণী ছিলেন। কিছুই করতেন না। ওনার পক্ষে এত বড় সংসার টানা সম্ভব ছিল না। আমি ছিলাম সবার বড়। আমার চারবোন তখন ধীরেধীরে বিয়ের উপযুক্ত হয়ে উঠতেছে। মাথার ওপর অনেক চাপ ছিল। তো ভাবলাম আমাকে দেশের বাইরেই যাইতে হবে। জায়গা জমি যা ছিল সব বিক্রি করে বাইরে চলে যাই। ধার দেনাও হইছিল অনেক। প্রথম একটা বছর অনেক কষ্ট হইছে। যা কাজ পাইছি, সেটাই করছি। এমন কোনো কাজ নাই যেটা আমি করিনাই। দেশে টাকা পাঠাইতে হবে তো! এরপর আস্তে আস্তে কাজ করতে করতে দেশে টাকা পাঠানো শুরু করি। নিজে কিছুই খাইতাম না। বলতে গেলে তিনবেলা ভালোমতো ভাতও খাই নাই। সব দেশে পাঠাইছি। আমার ভাই পড়াশোনা করছে, বোনদেরকে খরচ দিছি। পাঁচ ছয় বছরের মধ্যেই বোনদেরকে বিয়ে দিয়ে দিছি। সবার ভালো ঘরেই বিয়ে হইছে। ওরা সবাই ভালো আছে। বড় বোনের মেয়ে ক্লাস এইটে উঠলো এইবার। হা হা। আমি এখনো বিয়েই করি নাই।'

মোস্তফা কামাল থামলেন। একটা নিশ্বাস নিলেন। ওনার চেহারায় এক ধরনের প্রশান্তির ছাপ ফুটে উঠল। সবার পাশে দাঁড়াতে পেরে তিনি গর্বিত, আনন্দিত। জাহ্নবী তাকিয়ে রইল ওনার দিকে।
তিনি কিছুক্ষণ পর আবারও বলতে শুরু করলেন, 'এখন আমার গ্রামে ভালো অবস্থা। জায়গা জমি কিনছি, বাড়ি করছি। তিনতলা ফাউন্ডেশন দিয়ে বাড়ি করছি কিন্তু শুধু নীচতলার কাজ হইছে। ওটা আস্তেধীরে করা যাবে। আমার ভাই, ভাইয়ের স্ত্রী আর মা থাকে ওই বাড়িতে। মাঝেমাঝে বোনেরা বেড়াতে আসে। মা নিজের মতো থাকে।'

ভায়োলেট জানতে চাইলো, 'আপনি বিয়ের কতদিন পর মালয়েশিয়া চলে যাবেন?'
'এইতো আড়াই মাস পর।'
'স্ত্রীকে নিয়ে যাওয়ার প্লান আছে?'

মোস্তফা কামাল কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। ওনাকে চিন্তিত মনে হল। মাথা চুলকালেন তিনি। তারপর মুচকি হেসে বললেন, 'হ্যাঁ সেটা তো আছেই। আমার ব্যবসাটা আরেকটু বাড়ুক। একটু সময় লাগবে আরকি। এখন বিয়ে করে স্ত্রীকে গ্রামে রেখে যাবো। মা'র সাথে থাকবে। এরপর আমি সব গুছিয়ে নিয়ে তারপর...'

ভায়োলেট জাহ্নবীর দিকে তাকালো। জাহ্নবী কিছু জানতে চাইলে জিজ্ঞেস করতে পারে। কিন্তু জাহ্নবী কী জিজ্ঞেস করবে বুঝতেই পারছে না। ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে ওনার কথাগুলো শুনছে সে। এই লোকটা কী তার মেঘের মানুষ? হয়তোবা, হয়তো না। লোকটাকে দেখে স্বপ্নের সেই মেঘের মানুষ মনে হচ্ছে না কেন!

মোস্তফা কামাল বললেন, 'শুনেছি আপনি চাকরি করেন? কিসের চাকরি?'
ভায়োলেট বলল, 'চাকরি করলে আপুকে গ্রামে রেখে যাবেন কীভাবে? ওকে তো ঢাকাতেই থাকতে হবে।'

মোস্তফা কামাল মুচকি হাসলেন। উত্তর দিলেন না। খাবারের মেনু এগিয়ে দিলেন জাহ্নবীর দিকে। জাহ্নবী ভায়োলেটকে অনুরোধ করল। অবশেষে খাবার অর্ডার করল ভায়োলেট।  
খাবার খেতে খেতে মোস্তফা কামাল জাহ্নবীকে বললেন, 'আপনি প্রবাসী ছেলে পছন্দ করেন? অনেকেই তো প্রবাসীদের বিয়ে করতে চায় না।'
জাহ্নবী ম্লান হাসল। এর উত্তর হতে পারে, হ্যাঁ অথবা 'না। মোস্তফা কামাল কী ভাবলেন সেটা স্পষ্ট হলো না। জাহ্নবীর জানতে ইচ্ছে করছিল, লোকটা কী বৃষ্টিতে ভিজতে পছন্দ করে? খোলা বারান্দায় ভিজতে ভিজতে জাহ্নবীর হাত ধরে থাকতে ভালো লাগবে ওনার? কিন্তু জাহ্নবী জিজ্ঞেস করতে পারল না। মাথা নিচু করে রইল। সামার হলে ঠিকই মুখ ফুটে বলতে পারত, কিন্তু সে এটা কখনোই পারবে না! 

মোস্তফা কামাল চলে যাওয়ার আগে জাহ্নবী ও ভায়োলেটকে রিকশায় তুলে দিলেন। রিকশা ভাড়া দিয়ে দিলেন জোর করে। জাহ্নবী দ্বিধাগ্রস্ত মনে বাড়ি ফিরল। এই দ্বিধা হচ্ছে মোস্তফা কামালকে তার ভালো লেগেছে নাকি লাগেনি সেটা নিয়ে। মাঝেমাঝে মনটাও মন্তব্য জানাতে ভুল করে। ভুল সিগন্যাল দেয়!

গোসল সেরে ভেজা চুলে বিছানার ওপর বসল জাহ্নবী। এক কাপ কফি নিয়ে এলো ভায়োলেট। জাহ্নবী আশা করেছিল ভায়োলেট ছেলেটার ব্যাপারে তার সঙ্গে আলোচনা করবে। কিন্তু কিছুই বলল না ভায়োলেট। কফিটা রেখে নিভৃতে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

রাত্রিবেলা পারভীন একবার জানতে চেয়েছিলেন, 'ছেলেকে কেমন দেখলি?' জাহ্নবী উত্তর দিয়েছে, 'ভালো। ছেলে কিছু জানায় নি?'
পারভীন উত্তর দিলেন, 'না।'

জাহ্নবী ঘুমাতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত আশা করছিল ভায়োলেট তার রুমে শুতে আসবে। গত কয়েকদিন তার সঙ্গেই ঘুমিয়েছে ভায়োলেট। কিন্তু আজ সে এলো না। হয়তো আপুকে একা থাকতে দেয়া উচিৎ বলেই এলো না। জাহ্নবী বিছানায় শুয়ে অনেক্ষণ এপাশ ওপাশ করল। দোলন চাচা আগামীকাল চলে যাবেন। তিনি নিশ্চয়ই চলে যাওয়ার আগে ভালো বা মন্দ কিছু একটা জানিয়ে যাবেন। জাহ্নবীর আর এই ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে ইচ্ছে করছে না। মৃদু শব্দে রবীন্দ্র সংগীত শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ল সে। 

সকালের নাস্তা খেয়ে অফিসে রওনা দিলো জাহ্নবী। মোস্তফা কামালের ব্যাপারটা বারবার মনের ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে। লোকটা যদি তাকে পছন্দ করে ফেলে, তাহলে কী জাহ্নবী বিয়েটা করবে? ওর পরিবার খুশি হবে এই মুহুর্তে সে বিয়ে করলে। কিন্তু দোটানায় ভুগছে জাহ্নবী। কোনোরকম সিদ্ধান্তে আসতে পারছে না। মোস্তফা কামালকে তার ভালো লেগেছে কী না, এই প্রশ্নে দ্বিধান্বিত হয়ে আছে।
নাদির সাহেব এসে বললেন, 'হ্যালো মিস জাহ্নবী, হোয়াট এবাউট ইউ?'
'ফাইন, স্যার।'
'গতকাল আপনাকে যে মেইলটা পাঠিয়েছিলাম সেটা দেখেছেন?'
'সরি স্যার। আমি আসলে দেখতে পারিনি। গতকাল আমার ব্যক্তিগত কিছু কাজ ছিল। আই এম রিয়েলি সরি।'
'ইটস ওকে। মেইলটা চেক করুন। ফ্রেশ থেকে কোনো রেসপন্স আসলে আমাকে জানাবেন।'
'জি, স্যার।'

নাদির সাহেব দ্রুত চলে গেলেন। লোকটা এক ধরনের মৃদু অথচ দৃঢ় পারফিউম ব্যবহার করে। উনি কাছে এলেও খুব একটা ঘ্রাণ নাকে আসে না। অথচ চলে গেলেও মনে হয় কোথাও একটা ঘ্রাণ ফেলে গেছেন। যেটা এখনো ওনার কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। 

জাহ্নবী কাজে মন দিতে পারল না। মোস্তফা কামাল এখনো তার মগজে কিলবিল করছে। লোকটার সবকিছু ঠিক আছে, তারপরও কী যেন নাই! জাহ্নবী অস্থির হয়ে উঠে হাঁটা শুরু করল। 
তার রুমের পাশেই বিশাল জানালা। কাঁচের স্বচ্ছ এই জানালা প্রতি একদিন পরপর পরিষ্কার করা হয় বলেই সারাক্ষণ ঝকঝক করতে থাকে। এই জানালায় দাঁড়ালে বাইরের পৃথিবীকে অনেক নিস্তব্ধ মনে হয়। আজ আকাশটা মেঘলা। বৃষ্টি হলে জাহ্নবী সব কাজ ফেলে বৃষ্টি দেখতে পারত। 
'আমরা কেউই ব্যক্তিগত সমস্যার বাইরে নই।'

কথাটা শুনে চমকে উঠে পাশ ফিরে জাহ্নবী দেখল নাদির সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন। এই জানালার মতোই স্বচ্ছ কাঁচের ভেতর স্পষ্ট তাকিয়ে আছে ওনার দুটো শীতল চোখ। জাহ্নবী ওনার দিকে তাকানো মাত্রই তিনি আরেকটা লাইন যুক্ত করলেন। 
'কিন্তু আমাদের উচিৎ কর্মস্থলে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের ব্যক্তিগত জীবনকে দরজার বাইরে রেখে আসা। অফিস ছুটি হলে আপনি আবার ব্যক্তিগত সমস্যাকে দরজা থেকে ধরে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে পারেন।'

জাহ্নবীর ভীষণ ভালো লেগে গেল কথাটা। ম্যাজিকের মতো কাজ করল ওর জীবনে। যদি সত্যিই এমন হতো, কতই না মজা হতো! সমস্যাকে দরজার বাইরে রেখে আসা যেত যদি..
নাদির সাহেব বলল, 'কী ভাবছেন? সমস্যাকে বাইরে রাখতে যাবেন?'
জাহ্নবী মুচকি হেসে বলল, 'হুম।'
'যান। অনুমতি দিলাম।'

অভিভূত হল জাহ্নবী। মুখে প্রসন্ন হাসি ফুটে উঠল তার। নাদির সাহেবকে ধন্যবাদ জানিয়ে অফিসের প্রধান দরজার দিকে এগিয়ে গেল সে। পিছন ফিরে এক পলক নাদিরকে দেখার ইচ্ছে হল। ইচ্ছেটাকেও সঙ্গে নিয়ে চলল জাহ্নবী। 
অফিসের প্রধান দরজার বাইরে আসতেই এক রাশ দমকা হাওয়া এসে গায়ে লাগল। নিজেকে সতেজ লাগল অনেকটা। জাহ্নবী কয়েক পা হাঁটতে হাঁটতে বলল, 'মোস্তফা কামাল, আপনি আমাকে আর অশান্তি দেবেন না প্লিজ। আপনাকে নিয়ে আমি এখন একদমই ভাবতে চাই না। আমাকে মন দিয়ে আমার কাজ করতে দিন। আমি একটা সুখী মেয়ে হতে চাই, অনেক সুখী মেয়ে। আপনি এখন আমার অফিসের ভেতরে যাবেন না। এখানেই থাকুন।'

কথাটা বলে জাহ্নবী দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল। নিজেকে হালকা লাগছে তার। মনে হচ্ছে সত্যি সত্যি মোস্তফা কামালকে নিয়ে হওয়া টেনশন সহ তার সমস্ত দুশ্চিন্তাকে বাইরে রেখে আসতে পেরেছে। একদম নির্ভার হৃদয় নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল জাহ্নবী। 
নিজের ডেস্কে এসে নাদির সাহেবকে ধন্যবাদ জানানোর জন্য খুঁজছিল সে। ওনাকে কোথাও দেখা গেল না। জাহ্নবী মুচকি হেসে কাজে মন দিলো। 

বাড়ি ফিরে দেখল মা ঘরের দরজা বন্ধ করে শুয়ে আছেন। আবারও ওনার চিরচেনা ডিপ্রেশনের জগতে প্রবেশ করেছেন কী না কে জানে! সামার ও ভায়োলেট কেউই বাসায় নেই। জাহ্নবী এক কাপ চা খেয়েই শুয়ে পড়ল। মাথা ব্যথা করছে তার।
জাহ্নবীর ঘুম ভাংল ভায়োলেটের ডাকে। রাত দশটা বাজে। ভাত খেতে ডাকছে ভায়োলেট। জাহ্নবী ভায়োলেটকে বলল, 'কোথায় গিয়েছিলি?'
'তোর জন্য বাসা দেখতে।'
'কেন!'
'তুই নতুন বাসায় উঠবি না?'
'আমার আসলে তোদের সবাইকে রেখে একা একা থাকার কোনো ইচ্ছেই নেই।'

ভায়োলেট খানিক্ষণ জাহ্নবীর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, 'সত্যি?'
'হুম।'
'ঠিক আছে। তাহলে আর বাসা খুঁজবো না।'
'ভায়োলেট, ছেলেটা কিছু জানিয়েছে?'
'কোন ছেলে?'
'মোস্তফা কামাল?'
'উনি ছেলে না আপু, উনি একটা লোক। ওনার সঙ্গে তোমাকে একদমই মানাবে না। ওনার কথা বাদ দাও।'

জাহ্নবী বলল, 'মানাবে না মানে কি? সবাই আল্লাহ'র সৃষ্টি। এভাবে বলিস না। আমি নিজেও দেখতে আহামরি কিছু না।'
'আমি ওনার সঙ্গে চেহারা নিয়ে মানানোর কথা বলিনি। আমি বলতে চাচ্ছি মাইন্ড সেটআপের কথা। একটা মানুষের মাইন্ডসেট টাই আসল। ওনার মাইন্ডসেটআপ আর তোমার মাইন্ডসেটআপ কখনো মিলবে না। কাজেই ওনার কথা ভাবা বাদ দাও।'
'আচ্ছা। বাদ দিলাম। এরপর বাসায় কী বলবো?'

ভায়োলেট চলে যেতে যেতে বলল, 'সেটা আমি দেখছি।'

ঘর থেকে বেরিয়ে গেল ভায়োলেট। জাহ্নবীর মন ফুরফুরে হয়ে উঠল। মনে হচ্ছে এইমুহুর্তে সে একটা বিশাল ঝামেলা থেকে মুক্তি পেয়েছে। মোস্তফা কামালের ব্যাপারটা তাকে ভীষণ যন্ত্রণায় ফেলে দিয়েছিল। এখন মনে হচ্ছে ভায়োলেট ঠিকই বলেছে। দুজনের মানসিকতা এক হবে না।

জাহ্নবী হাতমুখ ধুয়ে ভাত খেতে আসল।
খাওয়া শেষে সবাই টেবিল ছেড়ে চলে গেলে পারভীন জাহ্নবীকে বললেন, 'তোর অফিস কেমন চলে রে?'
'ভালো।'
'তোকে একটা কথা বলবো, রাখবি?'
'হ্যাঁ। বলো মা?'
পারভীন একটা নিশ্বাস ফেলে কিছুক্ষণ জাহ্নবীর দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন, 'অর্ণবকে তোর ভালো লাগে?'

জাহ্নবী অবাক হল। মোস্তফা কামালকে বাদ দিয়ে মা এখন অর্ণবকে নিয়ে লেগেছে কেন! বিস্মিত চোখে মা'র দিকে তাকিয়ে রইল জাহ্নবী।
পারভীন বললেন, 'আমার একটা অনুরোধ রাখ। অর্ণব অনেক ভালো একটা ছেলে। ওকে আমার খুব পছন্দ। আমি আগামীকাল ওকে বাসায় আসতে বলবো। তুই সেজেগুজে থাকবি। সামার ও ভায়োলেটকে ওর সামনে যেতে মানা করবি। তুই একা ওর সঙ্গে গল্পগুজব করবি।'
জাহ্নবী পারভীনের মুখ থেকে দৃষ্টি সরাতে পারল না। হা করে চেয়ে রইল সে। 

পারভীন বললেন, 'পারবি না? এই কাজটা অন্তত কর। আমাকে এবার তোরা একটু শান্তি দে। তোর বাপকে বলছিলাম অর্ণবের ফ্যামিলির সঙ্গে কথা বলতে। সে একটা মাথামোটা। এসবের কিছু পারবে না। তার নাকি লজ্জা লাগে। তুই এখন যেভাবে পারিস কাজটা কর। অর্ণবকে আমি তোর সঙ্গে বিয়ে দিতে চাই।'

জাহ্নবী এখনো ফ্যালফ্যাল করে পারভীনের দিকে তাকিয়ে আছে। অসহ্য লাগছে ওর। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে মনে হচ্ছে। অনেক কষ্টে সে বলল, 'মোস্তফা কামাল আমাকে পছন্দ করে নাই, তাই না?'
পারভীন উত্তর দিলেন, ' তা আর করবে কেন? এই বয়সের মেয়েকে কেউ পছন্দ করে? চেহারা হইছে বুড়ির মতোন। বুড়িকে কে বিয়ে করতে চায়? সে ভায়োলেটকে পছন্দ করছে। দোলন ভাই এখন চাইতেছে ভায়োলেটের সঙ্গে বিয়ে দিতে। আমি কেন দিবো? আমার মেয়ে রাজকন্যার মতোন। ওর মতো বুড়া লোকের সঙ্গে আমি ভায়োলেটকে বিয়ে দিবো? আমার মাথা খারাপ? মুখের ওপর না করে দিছি।'

জাহ্নবী অবাক হল। মাকে মাঝেমাঝে বুঝতে পারে না সে। রেগে গেলে মানুষ অদ্ভুত আচরণ করে। আর বাংলাদেশী সমাজে মানুষ সবসময়ই অদ্ভুত আচরণ করে। মোস্তফা কামালের বয়স আটত্রিশ। অথচ পঁয়ত্রিশ বছরের একটা মেয়েকে বিয়ে করতে তার সমস্যা! সে বাইশ বছরের মেয়েকে বিয়ে করতে চায়! আর পারভীন আটত্রিশ বছরের একটা ছেলেকে বুড়া ভাবছে। যার সঙ্গে ভায়োলেটকে বিয়ে দিতে চান না, অথচ জাহ্নবীর সঙ্গে এই লোকটাকেই বিয়ে দিতে চান তিনি। কারণ তিনি নিজেও জাহ্নবীকে বুড়ি বলেই সম্বোধন করছেন। পঁয়ত্রিশে কি কোনো মেয়ে বুড়ি হয়ে যায়? 

জাহ্নবী নিজের ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে বসে রইল। এত বিরক্ত লাগছে সবকিছু! ইচ্ছে করছে বাড়ির বাইরে গিয়ে সব সমস্যা দরজার বাইরে রেখে আসতে। জাহ্নবী বিরক্তমুখে অনেক্ষণ হাঁটাহাঁটি করল। অসহ্য লাগছে।
দরজা খুলে ভায়োলেটের ঘরে এলো সে। ভায়োলেট কিছুক্ষণ আগেই ঘুমিয়েছে। রাত এগারোটার পর সে আর জেগে থাকতে পারে না। জাহ্নবী ভায়োলেটকে ধাক্কা দিয়ে ঘুম থেকে জাগিয়ে দিলো। চোখ পিটপিট করে তাকালো ভায়োলেট। 

জাহ্নবী বলল, 'তুই আমার জন্য বাসা খুঁজে দে। আমি কালকেই এই বাড়ি থেকে চলে যাবো। আমার কালকের মধ্যেই বাসা লাগবে।'
ভায়োলেট এখনও চোখ কচলাচ্ছে। কিছুই বুঝতে পারছে না সে। জাহ্নবী কিছুক্ষণ আগেও তাকে বলেছে, সে এই বাড়ির সবাইকে ছেড়ে কোথাও যেতে চায় না। এই অল্প সময়ের মধ্যে আবার কী হল! নিশ্চয়ই আপু শুনে ফেলেছে মোস্তফা কামাল তাকে নয়, ভায়োলেটকে পছন্দ করেছে। তাই এত রাগ!

জাহ্নবী বলল, 'তুই কী শুনতে পাচ্ছিস আমার কথা? আমাকে কিন্তু কালকের মধ্যেই বাসা খুঁজে দিবি।'

সামার অবাক হয়ে ওদের কাণ্ড দেখছে। জাহ্নবীর রাগত মুখ লাল হয়ে উঠেছে ইতিমধ্যেই। নিজের ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে দিলো সে। কিচ্ছু ভালো লাগছে না। 
জাহ্নবী ফোন হাতে নিয়ে দেখল নাদির সাহেবের কল! এত রাতে স্যার কল দেয়ার মানুষ নন। তবে?
.
.
.
চলবে.........................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp