খাবার টেবিলে একসঙ্গে খেতে বসেছে সবাই। জাভেদ আলী সবসময়ই মেয়েদেরকে বলেন, 'সুখে দুঃখে যাই থাকি, সবাই একসঙ্গে খাবার খাবো, এটাই শান্তি।' আজকে খেতে বসে বরাবরের মতোই তিনি চাকরি জীবনের গল্প করছেন। গল্পের ফাঁকে ভায়োলেট বলল, 'আব্বু, তোমাকে একটা কথা বলতে চাই।'
'হ্যাঁ মা, বল? কিসের ব্যাপারে?'
'আব্বু, বড় আপুর ব্যাপারে। তুমি রাগ করতে পারবে না।'
জাভেদ আলী পারভীনের দিকে তাকালেন। খাওয়া বন্ধ করে জাহ্নবীর মুখপানে একপলক দৃষ্টি রাখলেন পারভীন। মেয়ে নিশ্চয়ই বলবে সে অর্ণবকে বিয়ে করতে পারবে না। এ ছাড়া আর কিইবা বলার আছে তার। পারভীন মুখ নিচু করে খাবার খেতে লাগলেন।
ভায়োলেট বলল, 'বড় আপু প্রতিদিন খুব ভোরে বের হয়। তারপরও অফিসে পৌঁছাতে লেট হয়। আর এতদূর থেকে যাতায়াত কষ্টকর, ভাড়াও বেশী পড়ে যায়। এজন্য আপু চাইছিল ওর অফিসের কাছাকাছি একটা বাসা নিয়ে থাকতে।'
জাভেদ আলী জাহ্নবীর দিকে তাকালেন। চুপচাপ বাবার দিকে চেয়ে আছে জাহ্নবী। তিনি বললেন, 'জাহ্নবী বড় হয়েছে। নিজের ভালোমন্দ সিদ্ধান্ত নেয়ার উপযোগী হয়েছে। ও যদি অফিসের কাছে বাসা নিয়ে থাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে তাহলে থাকুক। আমি বাঁধা দেবো কেন বল। জাহ্নবী, মা তুমি কি বাসা দেখেছ?'
জাহ্নবী মাথা ঝাঁকালো, 'একটা বাসার ব্যাপারে খোঁজ নিয়েছি।'
পারভীন তৎক্ষনাৎ অভিমানী গলায় উত্তর দিলেন, 'সব যখন ঠিক করেই ফেলছিস আর জিজ্ঞেস করার দরকার নেই। কেন বাসা নিচ্ছিস আমি জানিনা নাকি। এখন তো মা বুড়ি হইছি। মা'র চেচামেচি আর ভালো লাগে না। বিয়ে করতে বলি, কত কী বলি। সেসব আর শোনা লাগবে না। একা বাসায় থাকলে আত্মীয় স্বজনদের কথাও আর শোনা লাগবে না। সব তো শুনি আমি। বুঝবে কি তোমরা।'
জাহ্নবী কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের হল না।
সামার বলল, 'এত কথা কেন বলছ মা? আপুর ব্যক্তি স্বাধীনতা আছে। সে যেখানে ইচ্ছে থাকুক না। আমরা এখানে কথা বলবো না। আমি তো অনার্সে প্রথম দুই বছর হোস্টেলে ছিলাম, সাবলেট ছিলাম। আমাকে তো এত কথা বলো নি।'
পারভীন রাগত স্বরে বললেন, 'আমি কাউকে কিছু বলবো না। যার যা ইচ্ছে করো। বিয়েশাদি করার কোনো নাম নাই কারও। যেন জন্ম দিয়া ভুল করছি। পড়াশোনা করতে চাইছো, করাইছি। অনার্স পাশ করে মাস্টার্সে ভর্তি হবা বলছ, ভর্তি করে দিছি। অপরাধ করছি আমরা? জাহ্নবীর এত ভালো ভালো বিয়ের প্রস্তাব আসল, সে বিয়ে করবে না। আত্মীয় স্বজনের কাছে কথা শুনতে শুনতে আমার জান যায়। বিয়ে করবি না সন্ন্যাসে যা। তোর এই সমাজে থাকার দরকার কি?'
সামার হাত ধুয়ে উঠে যেতে যেতে বলল, 'সন্ন্যাসেই যাচ্ছে। খুশি হও এবার। খুব শীঘ্রই আমি বিয়ে করবো। এবার অন্তত শান্তিতে থাকো। একা একা বিয়ে করবো না। ধুমধাম করেই করবো।'
পারভীন কিছু বললেন না। কয়েক মুহুর্ত বসে থেকে ধরা গলায় বললেন, 'আমার মেয়েরা আজকে আমার মুখের ওপর কথা বলে। কী মানুষ করলাম..'
কেঁদে ফেললেন তিনি। খাবার টেবিল ছেড়ে উঠে নিজের ঘরে চলে গেলেন। জাভেদ আলী পরিস্থিতি শান্ত করার চেষ্টা করলেন।
'তোর মায়ের কথা বাদ দে। ও এখনও বাচ্চাদের মতো গাল ফুলায় থাকে। জাহ্নবী মা, তোমার কোনোকিছু দরকার হলে আমাকে বলবে আমি কিনে দেবো। নতুন বাসায় কি এই মাসেই উঠবে?'
জাহ্নবীর মন খারাপ হয়ে গেছে। মৃদু স্বরে বলল, 'আমার জন্য পাত্র দেখো আব্বু। আমাকে তোমরা সবাই মাফ করে দিও।'
কাঁদতে কাঁদতে নিজের ঘরে গেল জাহ্নবী। জাভেদ আলী বিব্রতবোধ করছেন। ভায়োলেট হাসিমুখে বলল, 'আব্বু, এই বাড়িতে আমরা দুইজন ছাড়া সবারই মাথা গরম। তুমি কষ্ট পেও না। সব ঠিক হয়ে যাবে।'
জাভেদ আলী হেসে ফেললেন, 'তুই সবার চাইতে ভালো বুঝিস। ওরা বড় হয়েও বাচ্চাদের মতো আচরণ করে। কী আর করবো আমি বল।'
'আব্বু তুমি খাও। খাবারটা শেষ করো।'
জাভেদ আলী খাওয়া শুরু করলেন। সবাই নিজ নিজ ঘরে চলে গেছে। টেবিলে বসে নির্লিপ্ত ভঙ্গীতে খাবার খাচ্ছে ভায়োলেট ও তার বাবা। জাগতিক বিষয় নিয়ে তাদের কোনো দুশ্চিন্তা নেই।
খুব সকালেই অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা দিল জাহ্নবী। রাতে ভালো ঘুম হয়নি। মাথাব্যথা করছে। আজকে গরমের তীব্রতাও অনেক। ঘামতে অফিসে এসে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। এখন অফিসটাই ওর সবচেয়ে শান্তির জায়গা। আগামীকাল শুক্রবার। দুদিন অফিস বন্ধ থাকবে। এই সময়টা কাটাবে কীভাবে সে!
অফিস শেষ করে বাসায় এসে দেখল জাভেদ আলী ভায়োলেটকে নিয়ে বাসার ছোট ছোট পাতিল, একটা গ্লাস, চামচ, প্লেট সবকিছু বস্তায় তুলে রেখেছেন। জাহ্নবীকে দেখে তিনি বললেন, 'তোর নতুন জীবনের জন্য আমরা এগুলো গোছাচ্ছি। তুই তো ব্যস্ত মানুষ। গোছানোর সময় আছে?' হাসলেন তিনি।
জাহ্নবীর ইচ্ছে করল বাবাকে জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ভায়োলেট একটা একটা করে বিভিন্ন জিনিস এনে জড়ো করছে আর জাভেদ আলী নিজের হাতে সবকিছু গুছিয়ে দিচ্ছেন, যেন এরচেয়ে সুন্দর দৃশ্য আর হয় না।
জাহ্নবী বলল, 'আব্বু, আমি যাবো না নতুন বাসায়। এখানেই থাকবো।'
জাভেদ আলী থতমত খেয়ে গেলেন। এত উৎসাহ নিয়ে তিনি সবকিছু গোছগাছ করছেন, আর মেয়ে নাকি যাবে না!
নিজের ঘরে এসে জামাকাপড় বদলে নিলো জাহ্নবী। ভায়োলেট চা নিয়ে এসেছে। জাহ্নবী বলল, 'বস এখানে।'
বসল ভায়োলেট। ফ্যানের বাতাসের শো শো শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। হঠাৎ করেই চারপাশ নিস্তব্ধ হয়ে উঠেছে।
ভায়োলেট নিস্তব্ধতা ভেঙে বলল, 'আপু আমি তো ওই বাসায় এডভান্স দিয়ে এসেছি আজ সকালে। আব্বু বলল কাল যেহেতু শুক্রবার। তাই কালকেই তোমার ওই বাসায় ওঠা ভালো হবে। এ কারণেই আর তোমাকে জিজ্ঞেস করিনি। তুমি কি আসলেই উঠতে চাচ্ছ না?'
জাহ্নবী নিরুত্তর তাকিয়ে রইল। দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো মুখ থেকে, 'জানিনা রে। বুঝতে পারছি না আমার কী করা উচিত।'
'তুমি যাও। কিছুদিন থেকে দেখো ভালো লাগে কী না। এতদূর থেকে অফিসে যাওয়াটাও তোমার জন্য কষ্টকর।'
'হুম, এটা ঠিক বলেছিস। আজকে বুঝেছি সেটা। এই গরমে অফিসে যেতে জান বের হয়ে যায়। রিকশা ভাড়া এত বেশী চায়, আমি দামাদামি করতে পারিনা। সবসময় ঠকি। হা হা।'
জাহ্নবীর হাসি দেখে হেসে ফেলল ভায়োলেট। বড় আপু এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে সেটা মেনে নিতে আজকে ওর কষ্ট হচ্ছে। অথচ এতটা আবেগ কখনও বড় আপুর জন্য ছিল না। আজকে ভায়োলেটের মনে হচ্ছে, আপুর মতো এতটা সাদামাটা, এত পরিষ্কার মনের মানুষ খুব কমই হয়। আপুকে সত্যিই অনেক ভালবাসে সে।
জাহ্নবী চা শেষ করে শুয়ে পড়ল। ভায়োলেট নিজেও শুয়ে পড়ল বোনের পাশে। মুখোমুখি শুয়ে দুজনে তাকিয়ে রইল একে অপরের দিকে। জাহ্নবী বলল, 'জানিস আজকে কী হয়েছে? নাদিস স্যার একটা কালো ব্লেজার পরে এসেছে আজকে। ওনার ব্লেজারের ঠিক এই জায়গাটায় সাদা রঙের ময়লা। অনেকটা পাখির গু'য়ের মতো। স্যার হয়তো জানতেন না। সবাই ওনাকে দেখে মুখ টিপে হাসছে। এমন প্রফেশনাল আর সিরিয়াস একটা মানুষের এই দশা। হাসবে না? আমারও হাসি এসেছিল। আগে আমি হেসেছি। পরে আমি স্যারের রুমে গিয়ে ওনাকে বলে এসেছি।'
ভায়োলেট জানতে চাইল, 'কীভাবে বললে?'
জাহ্নবী হেসে ফেলল, 'আমি ওনার দরজায় গিয়ে বললাম, স্যার আসবো? তিনি সিরিয়াস ভঙ্গীতে তাকালেন, আসুন। বসুন। কী হয়েছে? আমি তো লজ্জায় মরে যাই। বললাম, স্যার আপনার কোটটার দিকে একবার খেয়াল করতে হবে। মনে হচ্ছে সেখানে কিছু আছে। স্যার বললেন, কী আছে? আমি বললাম, আপনি দেখুন স্যার।'
জাহ্নবী হেসে উঠল। ভায়োলেট ওকে জড়িয়ে ধরে বলল, 'আপুরে, তুমি চলে যাবে কাল?'
'হুম।' একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল জাহ্নবী।
'তোমাকে অনেক মিস করবো আপু।'
ভায়োলেট জাহ্নবীকে শক্তভাবে জড়িয়ে ধরে রইল। অনেক রাত অব্দি আজ গল্প করল ওরা। জাহ্নবী শুধু বলেই গেল। আজ যেন কথার ফুলঝুরি মেলে দিয়েছে সে। ভায়োলেট আজ শুধু শুনলো। বড় আপুর মতো গম্ভীর একজন মানুষ এত কথা বলছে, শুনতে ভালো লাগছিল তার। রাতের খাবার খাওয়ার পর আবারও গল্পে মেতে উঠল ওরা। চলল রাত দুইটা পর্যন্ত। আজকে ভায়োলেটের একটুও ঘুম পায় নি। বড় আপুর সব কথা শুনতে তীব্র আগ্রহ জাগছিল তার।
পরদিন সকাল দশটায় জাভেদ আলী নিজেই জাহ্নবীকে নিয়ে নতুন বাসায় এলেন। সঙ্গে এলো ভায়োলেট। দুই বোন মিলে ঘর পরিষ্কার করে ফেলল। জাভেদ আলী কিনে নিয়ে এলেন একটা ছোটখাটো আকারের খাট। ব্যাচেলর মেয়েদের বাসা। জাহ্নবীর একার জন্য একটা রুম। রুমের একদিকে বিশাল জানালা। সোনালী রোদ জানালা ফুরে ঘরে ঢুকে যাচ্ছে। জানালার পাশে দাঁড়াল জাহ্নবী। ভায়োলেট তার কথা রেখেছে।
বিছানা পেতে একটা ওয়ারড্রবে সমস্ত জামাকাপড় ও জিনিসপত্র গুছিয়ে নিলো জাহ্নবী। প্লাস্টিকের র্যাকে তার থালাবাসন সাজানো হল৷ বাবা একটা আয়নাও কিনে এনেছেন। সঙ্গে বাইরে থেকে দুপুরের খাবার। তিনজন একসঙ্গে খাবার খেয়ে রওনা দিলেন জাভেদ আলী ও ভায়োলেট।
জাহ্নবী নিজের এই নতুন ঘরের চারপাশে তাকাল। বেশ বড় ঘর বলা চলে। ঘরের একদিকে বারান্দা। বেশ বড় পরিসর। বারান্দার সামনে খানিকটা খোলা জায়গা। সম্ভবত এটা দক্ষিণ দিক। অনেক বাতাস আসবে। ভায়োলেটের প্রতি কৃতজ্ঞতায় মনটা ভরে উঠল। অন্য জানালাটির পাশে দাঁড়ালে বাইরের শহর দেখা যায়। মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা অসংখ্য বিল্ডিং। জাহ্নবীর নিজেরও ওরকম মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে করে।
.
.
.
চলবে.......................................................................