জাহ্নবীর জন্য বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন জাভেদ আলীর দূর সম্পর্কের এক ভাই। তিনি সূদুর কুমিল্লা হতে এসেছেন। ভায়োলেট ও সামার দুজনকেই আপাদমস্তক মন দিয়ে দেখলেন তিনি। ভাতিজীদের বিয়ে দেয়াটা এখন ওনার একমাত্র দায়িত্ব, এই ভেবে ভীষণ চিন্তিত দেখাল তাকে। জাভেদ আলী ও পারভীন এখনো কেন মেয়েদের বিয়ে দিচ্ছেন না, এটা ভেবেও অবাক হচ্ছেন তিনি।
জাহ্নবী বাসায় ফিরে দোলন চাচাকে দেখে সালাম জানালো। হাসিমুখে জানতে চাইলো, 'কেমন আছেন চাচা?'
'এইতো আছি। ভালো আছি বলেই তো আসলাম তোমাদেরকে দেখতে।'
জাহ্নবীর আপাদমস্তক দেখলেন তিনি। নাহ, এই মেয়েকে পাত্র পছন্দ করবে কী না, এ ব্যাপারে সন্দেহ আছে ওনার। মেয়ে তো মোটা হয়ে গেছে, গালের চামড়ায় বয়স বৃদ্ধির ছাপ। চোখের নিচে কালো দাগ ভালোমতোই জায়গা দখল করে নিয়েছে। একে বিয়ে দেবেন কীভাবে তিনি! চিন্তিত মনে হল দোলন চাচাকে।
জাহ্নবী জামাকাপড় বদলে চা বানাতে এলো। অফিস থেকে ফিরে এক কাপ চা খাওয়ার অভ্যাস হচ্ছে। আজ অফিসে নবম দিন কাটল তার। কাজ বুঝিয়ে নেয়ার পর বেশ আনন্দে চাকরিজীবন কাটছে। ধীরেধীরে পরিচিতি বাড়ছে, দুজন কলিগদের সঙ্গে টুকটাক কথাবার্তাও হয়। যদিও তাদের সঙ্গে ভালোভাবে মিশতে পারে না জাহ্নবী।
সামার জাহ্নবীকে জিজ্ঞেস করল, 'দোলন চাচার সঙ্গে দেখা করেছিস?'
'হ্যাঁ।'
'আমিও দেখা করলাম। এমনভাবে আমার দিকে তাকালো.. কী বলবো! গ্রামের লোকদের স্বভাব এখনো ভালো হল না।'
'আমার দিকেও তো তাকিয়েছে। ভাবিস না, উনি আমাদের ঘটকালি করতে এসেছেন।'
'কিভাবে জানলে?'
'ঘটকের চোখে তাকানো দেখে।'
'উনি আসলেই তোমার জন্য একটা বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন আপু।'
জাহ্নবী চমকে উঠল। চায়ের কাপে চুমুক দেয়া বন্ধ করে সামারের দিকে তাকিয়ে রইল সে।
সামার বলল, 'ছেলেটা ওমান কিংবা মালয়েশিয়ায় থাকে৷ বয়স আটত্রিশ, এখনো বিয়ে করেনি। ফ্যামিলিতে ক্রাইসিস ছিল, ছেলে বিদেশে গিয়ে আয় রোজগার করে বাড়ির সব সমস্যা দূর করেছে। এখন বিয়ে করতে চায়। এগুলো সব দোলন চাচার কথা। ছেলেটা ঢাকাতেই আছে। আব্বু অনুমতি দিলে তোমাকে দেখতে আসবে।'
জাহ্নবী লম্বা একটা চুমুক দিলো চায়ের কাপে। এক চুমুকেই কাপের সব চা শেষ করল। ভায়োলেটকে উপেক্ষা করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল জাহ্নবী। ভায়োলেট হতাশ হল। আপু এই বিয়ের সম্বন্ধটাও ভেঙে দিতে গেছে, সে নিশ্চিত।
জাহ্নবী খাবার টেবিলের পাশে এসে দাঁড়াল। চা খাচ্ছেন জাভেদ আলী ও দোলন চাচা। পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন পারভীন। ওনার চোখেমুখে চিন্তার রেখা।
জাহ্নবীকে দেখে জাভেদ আলী বললেন, 'মা বসো। কথা আছে।'
নিঃশব্দে একটা চেয়ারে বসল জাহ্নবী। তার মুখ উদ্বেগহীন। পরিবেশ থমথমে লাগছে সামারের। সেও জাহ্নবীর চেয়ারের পেছনে এসে দাঁড়াল। পারভীন কৌতুহলী চোখ নিয়ে জাভেদ আলীকে পর্যবেক্ষণ করছেন। জাহ্নবীর চাকরি হয়েছে। এখন বিয়ে করার প্রশ্নই আসে না। ভেতরে ভেতরে খানিকটা রাগ জন্ম দিচ্ছেন পারভীন। আর কত বিয়ে ভেঙে দেবে তার কুলক্ষণা মেয়েটা?
জাভেদ আলী বললেন, 'তোমার অফিস কেমন চলছে?'
'ভাল, আব্বু।'
'তোমার চাচা একটা ভালো সম্বন্ধ নিয়ে এসেছেন।'
কথাটা বলে জাভেদ আলী একটু থামলেন। কীভাবে পাত্র সম্পর্কে বিস্তারিত বলবেন সেটা ভাবছেন তিনি। পারভীন রাগে গমগম করছে। এই মেয়েকে খুশি করা কঠিন। জাভেদ যাই বলুক না কেন, সে ঠিকই মুখের ওপর বলবে, আমি এখন বিয়ে করবো না আব্বু।
জাভেদ আলী কথা বলার জন্য মুখ খুললেন। তার আগেই সবাইকে অবাক করে দিয়ে জাহ্নবী বলল, 'আব্বু, আমি সামারের কাছে সব শুনেছি। তুমি তাদেরকে আসতে বলো।'
পারভীন চমকে উঠলেন। একইসঙ্গে বিস্মিত হল সামারও। হঠাৎ মনের ভেতর রিনঝিন বাজনা বেজে উঠল পারভীনের। চেয়ারের হাতল শক্ত করে ধরলেন তিনি।
জাহ্নবী বলল, 'কাল আমার অফিস আছে। এখন ছুটিও নেয়া সম্ভব না। পাত্র যদি পরিবার নিয়ে আসে তাহলে আগামীকাল সন্ধ্যার পর আসতে বলো। আর যদি সে একা দেখা করতে চায়, আমি অফিস শেষে তার সঙ্গে কোথাও বসবো৷ আমি তো খুব ভোরেই রওনা দেই, আজ রাতেই তোমরা আপডেট জানিয়ে দিও।'
চেয়ার ছেড়ে উঠে নিজের ঘরে এলো জাহ্নবী। এই প্রথম জাহ্নবীকে আত্মবিশ্বাসী রূপে দেখল তার পরিবার। দোলন নামের আত্মীয়ের কাছে মাথা উঁচু হয়ে গেল পারভীনের। তিনি গর্বের হাসি দিয়ে রান্নাঘরে গেলেন।
সামার এক দৌড়ে ঘরে এসে ভায়োলেটকে ধাক্কা দিয়ে বলল, 'এই জানিস কী হইছে? ভায়োলেট, জানিস কী হইছে?'
'কী?'
'আপু সবার সামনে বলেছে, পাত্রকে আসতে বলো। সে যদি পরিবার নিয়ে দেখা করতে চায়, তাহলে কাল সন্ধ্যার পর বাসায় আসতে বলো। আর যদি একা দেখা করতে চায়, আমি অফিস শেষে সন্ধ্যার পর তার সঙ্গে কোথাও বসবো।'
জাহ্নবী যেভাবে কথাটা বলেছিল, সেই একই সুরে সবটা বলল সামার। ভায়োলেট বিস্মিত হয়ে বলল, 'সত্যি!'
'হুম। শুধু তাই না, আপুর যে কী কনফিডেন্স! আমি তো পুরাই সারপ্রাইজড!'
ভায়োলেটের হাত ধরে উৎফুল্ল হয়ে কথাগুলো বলে গেল সামার। দুই বোন অবাক হয়ে একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইল। ঠোঁটে লেগে রইল প্রাণবন্ত হাসি।
রাত প্রায় সাড়ে দশটার দিকে জাভেদ আলী জাহ্নবীর রুমে এলেন। তিনবোন তখন বিছানার ওপর বসে গল্প করছিল। জাহ্নবী অফিসের বস নাদির সাহেবের কথা বলছিল আর বাকি দুজন তখন হাসছে। জাভেদ আলীকে দেখে গল্প থামালো ওরা।
তিনি বললেন, 'তোমাদের হাসির শব্দে আমারও ইচ্ছে করলো এখানে এসে আড্ডা দেই।'
'আসো আব্বু। দেখো তোমার মেয়ে কত মজা করছে অফিসে।' বলল সামার।
'অফিসে আবার মজা কিসের?'
'ওর অফিসে একজন বস আছে, নাদির সাহেব। লোকটা নাকি পুরাই প্রফেশনাল। এভাবে হাঁটে..'
হেঁটে দেখাল সামার। হেসে উঠল ভায়োলেট ও জাহ্নবী। জাভেদ আলী বললেন, 'এটা তুই কিভাবে দেখলি? জাহ্নবী বলেছে?'
'হ্যাঁ। বসো না, তুমিও শোনো।'
জাভেদ আলী তিন মেয়ের মাঝে বসলেন। বাবাকে ঘিরে রইল ওরা। অনেকদিন পর জাভেদ আলী'র মনে হল ওনার তিনটা বাচ্চাকাচ্চা আছে। মেয়েগুলো বড় হয়ে যাওয়ার পর সেভাবে আর আড্ডা দেয়াই হয়ে ওঠে না। সবাই নিজেদের মতো ব্যস্ত। আজকে ওদেরকে কাছে পেয়ে আনন্দে ওনার বুক ভরে যাচ্ছে। এটা হল বাবা হওয়ার আনন্দ!
তিনি বললেন, 'তোমার মা যদি দেখে আমরা এভাবে আড্ডা মারছি, তাহলে আজকে আমাদের খবর আছে।'
সামার বলল, 'আড্ডাকে তো মেরে ফেলেছি বললে, তাহলে আর ভয় কিসের?'
হাসল সামার। জাভেদ আলী বললেন, 'ওর বোকা বোকা চেহারাটা ভাসছে আমার সামনে।'
'আব্বু, মাকে তুমি বোকা বোকা বলেছে! দাঁড়াও এক্ষুণি বলে দিচ্ছি। মা.. মা..'
সামারের কথা শুনে বাকিরা শব্দ করে হেসে উঠল। পারভীন এসে বললেন, 'কী হয়েছে?'
জাভেদ আলী নিশ্চুপ। ভায়োলেট বলল, 'মা, দোলন চাচা নাকি গোপনে কী নিয়ে এসেছেন? তোমাকে গোপনে দিয়েছেন সেটা? আব্বু বলল আমাদের।'
পারভীন অবাক হয়ে স্বামীর দিকে তাকালেন। সবাই মুখ টিপে হাসছে। ওনার আর বুঝতে বাকি রইল না, এটা দুষ্টুমি। কারণ, জাহ্নবী ছাড়া বাকি সবাই দেখেছে দোলন খালি হাতে এসেছে এই বাড়িতে।
হেসে ফেললেন পারভীন নিজেও। সামার মাকে ধরে নিয়ে এসে বিছানার এক পাশে বসাল। জাহ্নবীকে বলল, 'আপু, তুমি না বলছিলা প্রথম বেতন পেয়ে মাকে কী দিবা?'
জাহ্নবী লাজুক ভঙ্গীতে হাসল। জাভেদ আলী আরেকটু আনন্দ যোগ করার জন্য বললেন, 'তোমাকে বেয়াই এনে দেবে, বেয়াই।'
হেসে ফেলল সামার ও ভায়োলেট। জাহ্নবী লজ্জা পেয়ে চুপ করে রইল। পরিবারের সঙ্গে কখনোই এভাবে মিশতে পারেনি সে। সবসময় দুরত্ব বজায় রেখে নিজের ঘরে একা একা থেকেছে। যখন বাবার সঙ্গে সামার ও ভায়োলেট মজা করত, সে রুমে শুয়ে কেঁদেই বুক ভাসিয়েছে। কাছে আসতে পারেনি তাদের। তার জীবনে এই অদ্ভুত পরিবর্তন কী করে হল, জানেনা সে। তবে এই জীবনটা যে বড্ড বেশী সুন্দর! এত সুন্দর কেন হয় জীবন?
পারভীন বললেন, 'রাত অনেক হয়েছে। তোরা শুতে যা। দোলন ভাই ঘুমে টুপছে। বিছানা রেডি করে দে জাহ্নবী।'
কথাটা বলার পর পারভীনের মন খারাপ হল। মনে হলো, এই সংসারে তিনিই সবার চেয়ে খারাপ। সবাই মিলে এত সুখী সুখী একটা পরিবার তাঁর। আড্ডা আর হাসিতে মেতে উঠেছে সবাই। অথচ তিনি সেখানে নিরামিষ, ঢেলে দিলেন পানি।
জাহ্নবী বলল, 'আম্মু, ওরা বড় হয়েছে। এক বিছানায় তিনজন ঘুমানো কষ্টকর। দোলন চাচা ও বাবা এক রুমে ঘুমাক। আজ তুমি আমার রুমে শোও। বহু বছর তোমার সঙ্গে ঘুমাই না, মা।'
জাহ্নবীর শেষ কথাটা খুব মায়ায় ভরা। বুকটা ছ্যাৎ করে উঠল পারভীনের। কান্না এসে গেল। ভাবলেন, শেষ কবে ঘুমিয়েছিলাম আমার বড় মেয়ের সঙ্গে? ত্রিশ বছর আগে! অনেক লম্বা সময়। এত বছরে দুরত্ব ছাড়া আমাদের মধ্যে আর কিছুই জন্ম নেয়নি।
তিনি চোখের পানি লুকানোর জন্য উঠে গেলেন। বাকিরা বিস্মিত হয়ে বসে রইল। এমন মুহুর্ত যেন কখনোই আসেনি তাদের পরিবারে। ভায়োলেট ও সামার একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইল। ওরা ভীষণ অবাক হয়েছে। জাহ্নবীর এই পরিবর্তন গুলো সবচেয়ে বেশি আনন্দ দিচ্ছে ওদের।
কিন্তু এর বাইরেও আরেকটা সত্যি আছে। সবার চোখের আড়ালে, সবার অজান্তেই, সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছেন যিনি, তিনি হলেন পারভীন। তিনি নিজের অনুভূতি কাউকে দেখাতে পারেন না। জাহ্নবীর পরিবর্তনে ওনার মতো খুশি কেউই হতে পারে নি।
বাথরুমের বেসিনে মুখে পানি দিয়ে চোখের জল আড়াল করলেন তিনি। মুখ ধুয়ে আবারও এসে দাঁড়ালেন জাহ্নবীর ঘরের দরজায়। স্বামীকে বললেন, 'দোলন ভাইকে নিয়ে রুমে যাও। সামার, ভায়োলেট তোরাও শুতে যা। রাত জেগে জেগে সবকটা চোখের নিচে কালি জমাই ফেলছিস।'
সামার ও ভায়োলেট জাহ্নবীকে 'গুড নাইট' বলে নিজেদের ঘরে চলে এলো। সামার ভায়োলেটকে ধরে উল্লাস করতে করতে বলল, 'মাই গড! আমি এতটা স্তব্ধ হয়ে গেছি ভায়োলেট বিশ্বাস কর।'
'হ্যাঁ আপু। আমিও। জন্মের পর থেকে দেখছি, বড় আপু সবসময় বাসায় গেস্ট আসলে নিজের রুম ছেড়ে দিয়ে আমাদের রুমে এসে শোয়। এই প্রথম সে নিজের রুম ছাড়ে নি। আপুর মাঝে কত চেঞ্জ এসে গেছে খেয়াল করেছ তুমি?'
সামার ও ভায়োলেট দুইবোন উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ল। বিছানায় শুতে গিয়ে তাদের মনে হল, এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে, বাড়ির সবাইকে নিজের সত্যিকার রূপ দেখিয়ে দিয়েছে বড় আপু। এমন একটা জাহ্নবীকেই আশা করেছিল তারা। তবে কখনো এমন দিন আসবে, এটা সত্যিই অকল্পনীয় ছিল!
জাভেদ আলী বেরিয়ে যাওয়ার আগে জাহ্নবীকে বললেন, 'মা, কাল সন্ধ্যায় ছেলে একা তোর সঙ্গে দেখা করবে। চাইলে সামার অথবা ভায়োলেটকে সাথে নিয়ে যেতে পারিস। না চাইলে একাই যাস। ছেলের নাম্বার দিচ্ছি, তোরা যোগাযোগ করে কোথায় দেখা করবি ঠিক করে নিস।'
জাহ্নবীর মাঝে তেমন কোনো পরিবর্তন দেখা গেল না কথাটা শোনার পর। নাম্বারটা ফোনের কল লিস্টে রাখল সে। পারভীন জাহ্নবীর পাশে শুয়ে পড়লেন।
জাহ্নবী ও পারভীন পাশাপাশি শুয়ে আছেন। ঘরে আবছা অন্ধকার, আবছা আলো। কেউই কোনো কথা বলছেন না। পারভীনের ইচ্ছে করছে কোনো কথা বলে মেয়ের সঙ্গে শত বছরের দুরত্বটাকে ঘুচিয়ে দিতে। জাহ্নবীর ইচ্ছে করছে মাকে জড়িয়ে ধরে মায়ের শরীরের ঘ্রাণ নিতে। মা'র মাঝে যে মা মা ঘ্রাণ, যে অদ্ভুত এক মায়া, সেই মায়ার আস্বাদন পেতে। কান্নায় চোখ ভিজে উঠল জাহ্নবী'র। অপরদিকে অনেক আগেই চোখের নোনাজলে চিবুক ভিজে গেছে পারভীনের।
অনেকটা সময় পেরিয়ে গেল। জাহ্নবীর মনে হতে লাগল, মা ঘুমিয়ে পড়লেই সে মাকে জড়িয়ে ধরার সুযোগটা হারিয়ে ফেলবে। মাকে অসম্ভব ভালবাসে সে, আর কখনো একসাথে ঘুমানো হবেনা হয়তো। পারভীন নিজে থেকে কথা বলবেন না, সেটা জানে জাহ্নবী।
জাহ্নবীই আগে কথা বলল, 'মা..'
পারভীনের গলা থেকে অদ্ভুত এক স্বর বের হল, 'হু..'
জাহ্নবীর বুক কেঁপে উঠল। মনে হচ্ছে, মা কাঁদছেন। বিষয়টাকে এড়িয়ে গিয়ে কথা বলে সহজ হওয়ার জন্য সে বলল, 'তুমি ছেলেটাকে দেখেছ?'
'না। কোথ থেকে দেখবো?'
'দোলন চাচা দেখায়নি কোনো ছবি?'
'আমি দেখলে তো তুইও দেখতি।'
'মা, আজকে অন্তত এভাবে কথা বোলো না। আমার খুব কষ্ট হয়। জানি তুমি আমাদেরকে অনেক ভালোবাসো। তাও কেন এমন করো...'
জাহ্নবী কথাটা শেষ করতে পারল না। কান্নায় ভেঙে পড়ল সে। এই কথাগুলো সে বলতে চায় নি। আবেগের স্রোতে বলে ফেলেছে। নিজেকে সংবরণ করতে পারল না জাহ্নবী। ধীরেধীরে মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল।
এইতো, এখন মায়ের শরীরের ঘ্রাণটা পাচ্ছে সে। টেরই পায়নি, পারভীন নিজেও বারবার চোখ মুছে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন।
জাহ্নবী বলল, 'তুমি অনেক সুখী একটা মানুষ আম্মু। আমার মা। আব্বুর মতো এমন একটা ভালো মানুষের সাথে সংসার করছ। তিন তিনটা সুন্দর মনের মেয়ে আছে তোমার। তোমার কিসের অভাব? সবসময় তুমি এমন করো যেন আমরা তোমার পেটের মেয়ে নই। আর এমন করবা না। আমার লক্ষী মা। তুমি অনেক ভাল। অনেক।'
জাহ্নবীর কান্নায় পারভীনের শাড়ি ভিজে যেতে লাগল। তিনি পাথর হয়ে আছেন। কেবল চোখ ফেটে বেরোচ্ছে জল। কিন্তু মুখে কিছুই বলতে পারলেন না। কিন্তু ওনার মনে হলো, নিজের মেয়েদের সঙ্গে এতদিন অন্যায় করেছেন তিনি। সত্যিই জাহ্নবীর কথাই ঠিক, তিনি অনেক সুখে আছেন।
জাহ্নবী একসময় অনুভব করল, পারভীন ওর মাথায় হাত রেখেছে। মায়ের চিরচেনা ঘ্রাণ যেন জীবনে প্রথমবার পাচ্ছে সে। মাকে জড়িয়ে ধরে শান্ত ভঙ্গীতে একদম বাচ্চাদের মতো শুয়ে রইল জাহ্নবী।
পারভীন অনেক্ষণ পর নরম গলায় বললেন, 'ঘুমা এখন। কালকে আবার সকালে উঠতে হবে। অফিস আছে। সকালে নাস্তা খাবি না ভাত খাবি?'
'ভাত খাবো। শুটকি ভর্তা করবা আম্মু?'
'আচ্ছা করবো। দুপুরের জন্য ভাত নিবি?'
'না। ক্যান্টিনে খাবো। কালকে তো ছেলেটার সঙ্গে দেখা করতে যেতে হবে। টিফিন বাটি হাতে করে নিয়ে যাবো?'
পারভীন ফিক করে হেসে ফেললেন। বললেন, 'নিয়ে যাবি সমস্যা কী? তোর টিফিন বাটিটা সুন্দর। শাপলা ফুলের ডিজাইন করা। জাতীয় ফুল। ছেলে বুঝবে তুই দেশপ্রেমী।'
মা ও মেয়ে উচ্চশব্দে হেসে উঠল। হাসতে হাসতে মাকে জড়িয়ে ধরে রইল জাহ্নবী। আজকের রাতটা যেন না ফুরায়। আজন্মকাল ধরে চলতে থাকুক।
.
.
.
চলবে.......................................................................