মাই মিস্টিরিয়াস প্রিন্স - পর্ব ২১ - মৌমিতা মৌ - ধারাবাহিক গল্প


অনন্যার মন এখন দোটানায় ভুগছে। জীবনে আগেও অনেকের প্রতি মুগ্ধতা অনুভব করেছে, কিন্তু আরণ্যক, সে ছিল বিশেষ কিছু। ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পর দিন প্রথম দর্শনেই ভালো লেগে গিয়েছিল আরণ্যককে। এক অদ্ভুত মায়া জড়ানো কন্ঠ, মন ভোলানো হাসি, স্ট্রং পার্সোনালিটি, সর্বক্ষেত্রে আরণ্যকের সাফল্য, সবকিছু অনন্যাকে প্রবলভাবে আকর্ষিত করতো।

দীর্ঘ দুই বছরের সম্পর্ক, অথচ তারা একসাথে কাটিয়েছে কেবল কিছু চুপচাপ মুহূর্ত। ক্যাম্পাসে আরণ্যকের পরিচিতি থাকার কারণে চাইলেও কখনোই অতোটা সময় কাটানোর সুযোগ হয়ে উঠেনি। আরণ্যকের ভয় ছিল,যদি কেউ জেনে যায়? সেই ভয় তাকে ঘিরে রাখত, আর দূরত্ব তৈরি করত। অনন্যাও মুক্ত ছিল না। মামার রাগী মুখ বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠত, ভয় হতো যদি কিছু জানাজানি হয়, ঘরের ভেতর অশান্তির ঝড় বইবে। অন্যের বাড়িতে আশ্রিত মেয়ে, অনন্যা। তার খাওয়া-পরার হিসেবেই মাঝেমধ্যে খোঁটা শুনতে হয়। এর মধ্যে যদি এসব কথা জানা যায়, তাহলে আত্মীয়স্বজনের চোখে অপমানিত হতে হবে, আর সেই গুঞ্জন পৌঁছাবে বিদেশে থাকা বাবা-মায়ের কানেও। এইসব আশঙ্কা তাদের মাঝের দূরত্বকে আরও গভীর করত। আরণ্যক চুপচাপ নিজেকে গুটিয়ে নিত, আর অনন্যা সেই নীরবতাকে মেনে নিয়ে নিজেও দূরে সরে যেত। 

আর কৌশিক স্যার? দেখা হওয়ার প্রথম দিন অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে লাইব্রেরীতে আটকে পড়েছিল দুজন। আরণ্যক এসেছিল তাদের বের করতে। কিন্তু সাথে সাথেই করতে পারেনি। চাবি নিয়ে আসতে তার দুই ঘণ্টা সময় লেগে গিয়েছিল। লাইব্রেরী স্যার ভুলবশত নিজের পকেটে চাবি ভরে নিয়ে বাসায় চলে গিয়েছিলেন সেদিন। সেই চাবি আনতে স্যারের বাসায় ছুটতে হয়েছে আরণ্যককে। নতুন বিদেশি প্রফেসরের সাথে অনন্যা অনেকক্ষণ সময় কাটিয়ে ছিল সেদিন। সময় কাটানো বলতে অন্ধকার রুমে আলো ফেলে বইয়ে মনোযোগ দেওয়া। সেদিন স্যারের সামনে বসে মনের কথারা জানালা ধরে পালিয়ে ছিলো একটা সময়। দুজনে বইয়ের দিকে গভীর মনোযোগ দিয়ে বসেছিল। তাও সেটা দুজনের মনের ভুল। তারা বইয়ে মুখ গুঁজে পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছিল একে অপরকে।

এক দিকে প্রথম দেখায় ভালোবাসা আর অপর দিকে একজন রহস্য মানব! একদিকে ঘৃণার উদ্রেক হতে শুরু করেছে অপরদিকে রহস্যের মায়াজালে আবদ্ধ হতে হতে মনটা সেদিকেই চলে যাচ্ছে অনন্যার। 

অনন্যা পাঁচ মিনিট ধরে কৌশিক স্যারের পাশে হাঁটছে, অথচ লোকটার যেন কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। চেহারায় সেই চিরচেনা নির্লিপ্ত ভঙ্গি, যেন পাশে কেউ হাঁটছে কি না, সেটাই তার খেয়াল নেই।

অনন্যা বিরক্ত হয়ে গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
"আপনার ক্লাস এতো তাড়াতাড়ি শেষ?"

"মনোযোগ তো দাও না। বিশ-পঁচিশ মিনিটে কত কিছু পড়িয়ে ফেলেছি, বুঝবে কী করে!"

"ওও হুম! আপনিও তো আমার দিকে মনোযোগ দেননি," অনন্যা একটু বাঁকা হাসি দিয়ে বলল।

কৌশিক থমকে দাঁড়িয়ে চোখ ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
"কী বললে?"

"কিছু না।" অনন্যা অনুচ্চ স্বরে জবাব দিলো, মুখে এক চিলতে রহস্যময় হাসি।

কিছুক্ষণ চুপচাপ হাঁটার পর হঠাৎ কৌশিক স্যার বলে উঠলো,
"ছেলেটা কে?"

প্রশ্ন শুনে অনন্যা চমকে দাঁড়িয়ে গেলো। মুখের হাসিটা মুহূর্তে মিলিয়ে গেলো। কৌশিক স্যার ইতিমধ্যে অনেকটা এগিয়ে গেছেন। অনন্যা এক পা, দু’ পা পেছনে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর ধীরে ধীরে ছুটে গিয়ে তার পাশে দাঁড়াল।

একটু দুষ্টু স্বরে, মিষ্টি হেসে বলল,
"বয়ফ্রেন্ড।"

কৌশিক নিজের হাতের ল্যাপটপটা অনন্যার হাতে ধরিয়ে দিলো। গম্ভীর স্বরেই বললো,
"আমাকে বোকা পেয়েছো? ভুলভাল বোঝাবে না। ছেলেটা তোমার এক্স বয়ফ্রেন্ড। রাইট?"

"হু! সেই তো একি। "

দুজনে ধীরে ধীরে পঞ্চম তলায় উঠে যাচ্ছে। কৌশিক স্যার গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
"ছেলেটার ভীতু ভাবটা ধীরে ধীরে কেটে যাচ্ছে। সামনে বড় কিছু করতে পারে। সো এর মাঝে আমার নাম যাতে না আসে, এটা খেয়াল রাখবে। তারপর যা ইচ্ছে করো।"

অনন্যা ভ্রু কুঁচকে তার দিকে তাকিয়ে বলল,
"এর মানে কী? আমি যদি আবারও আরণ্যকের গার্লফ্রেন্ড হয়ে যাই, তাহলে আপনার কোনো সমস্যা হবে না?"

কৌশিক মাথা নিচু করে একটু হেসে নিলো, তারপর ঠান্ডা গলায় বললো,
"সমস্যা? অবশ্যই সমস্যা হবে। ভদ্রতার খাতিরে আমার বাড়িতে থাকতে দিয়েছি তোমাকে। আরণ্যককে বয়ফ্রেন্ড বানিয়ে বাসায় যখন-তখন আনলে, সমস্যা তো হবেই। সো এই ব্যাপারে স্পষ্টভাবে ডিসএগ্রি করছি আমি।"

অনন্যার মুখ গোমড়া হয়ে গেলো। ভদ্রতার খাতিরে থাকতে দিয়েছে? কিছুক্ষণ চুপ থেকে হঠাৎই অনন্যা গলার স্বর নামিয়ে বলল,
"সেদিন রাতে আপনি আমার সাথে যা যা করেছেন, সব কিন্তু আমার মনে আছে।"

কৌশিক থমকে দাঁড়ালো, তার মুখের নির্লিপ্ত ভঙ্গি মুহূর্তেই বদলে গেল। চোখে একধরনের চাপা উত্তেজনা ফুটে উঠল। সে অনন্যার দিকে তাকালো,

"কোন দিন রাতে?" , কৌশিক চিন্তিত হয়ে মনে করার ভঙ্গিতে বললো।

"এতো গভীর মুহূর্তের কথা কীভাবে ভুলে যেতে পারেন আপনি?"
অনন্যা বেশ জোরেশোরেই বলে উঠল, তার কথাগুলো দেওয়ালের ওপারেও প্রতিধ্বনি তুলতে চাইছিল।

কৌশিক থামলো না, বরং মুহূর্তের মধ্যে অনন্যার হাত ধরে টেনে নিয়ে চলতে লাগল। তার দৃঢ় মুঠোর শক্তি এতটাই ছিল যে, অনন্যা ল্যাপটপটা অন্য হাতে সামলে রাখতে গিয়ে খানিকটা হোঁচট খেয়ে পড়ল।

কৌশিকের চোখে যেন আগুনের ঝলক। সিঁড়ির প্রতিটি ধাপ পেরোনোর সময় তার পায়ের গতি বেড়ে যাচ্ছিল। ছয় তলায় উঠে একটা ফাঁকা রুমের সামনে থেমে গেলো সে। রুমটা অনেকক্ষণ থেকেই খালি ছিল, এই তথ্য তার নজর এড়ায়নি।

অনন্যা বিস্ময়ে স্থির হয়ে গেল। কৌশিক তাড়াতাড়ি তাকে টেনে নিয়ে রুমে প্রবেশ করলো। দরজা বন্ধ করে যখন সে লক করলো, তখন অনন্যার চোখে এক ঝলক শীতল আতঙ্কের ছায়া লক্ষ্য করা গেল। চারপাশে একবার শান্ত নিবিড় দৃষ্টি বুলিয়ে নিল কৌশিক। এটা ছয় তলার কমন রুম, এখন ফাঁকা। সবার ক্লাস চলছে, আর সৌভাগ্যক্রমে এখানে সিসিটিভি নেই। কৌশিকের চোখ অন্ধকারে জ্বলছে বলে মনে হলো। অনন্যা নিজের ভিতরে এক অজানা আতঙ্কের স্রোত অনুভব করল।

কৌশিক ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে এলো। ঠোঁটে একপ্রকার রহস্যময় হাসি। আর চোখে বিদ্রূপের ঝিলিক। অনন্যা ল্যাপটপটা বুকের কাছে শক্ত করে চেপে ধরল। সেদিন রাতের বিভীষিকা তার মনের গভীরে এখনও দগদগে ক্ষতের মতো রয়েছে। আজ কি সেই রাতের চেয়েও ভয়ংকর কিছু ঘটবে?

"লুক অ্যাট মি, শিকদার।" কৌশিকের গলা শীতল, অথচ তাতে এমন এক শাসনের সুর যা হৃদয় কাঁপিয়ে দেয়।

অনন্যা দুদিকে মাথা নাড়িয়ে না জানালো। তার মুখ নিচু, চোখ মাটিতে।

কৌশিক এক ধাপ এগিয়ে এসে বলল, "সেদিনের অসমাপ্ত কাজ আজ শেষ করতে হবে আমাকে।"

"কী করতে চান আপনি?" অনন্যার কণ্ঠস্বর কঠিন হয়ে উঠলো, কিন্তু অন্তরে লুকানো ভয়েরা লাফাচ্ছে, উত্যক্ত করছে তাকে।

কৌশিক ধীরে ধীরে হাত উঠালো। তার হাতের আঙুল স্পর্শ করল অনন্যার মাথার চুলে। খুব শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো মেয়েটার মাথার চুল। টেনে মুখ উপরে তুললো অনন্যার।

"তোমার কিছু স্মৃতি আমি মুছে ফেলবো। সেদিনের রাতের স্মৃতি! যা কখনো হওয়া উচিত ছিল না, তা মুছে ফেলাই ভালো তাই না?
সেদিন তো ঘুমিয়ে ছিলে তাই করতে পারিনি, কিন্তু আজ পুরোপুরি সজ্ঞানে আছ।"

অনন্যা দ্রুত মাথা নাড়ল, নিজের অস্বীকারটা সুরক্ষিত করতে চাইল। কিন্তু কৌশিক থেমে থাকেনি। সে অনন্যার চিবুক ধরে তার মুখ আরো উপরে তুলল। চোখে চোখ রাখল। অনন্যার চোখ তখনো নিচে স্থির করা।
কৌশিক ঠোঁটে এক ঠাণ্ডা বিদ্রূপ নিয়ে বলল,
"এতো জেদ করে লাভ নেই। বেশিক্ষণ টিকবে না। তাকাও আমার দিকে...... আই সেইড লুক অ্যাট মি।"

অনন্যা আবারও মাথা নাড়িয়ে অসম্মতি জানাল। লোকটা কী জাদু জানে? সেদিনের স্মৃতি মুছে নিতে চাইছে কেন আর কীভাবে মুছবে? কিন্তু কৌশিকের ধৈর্য্য যেন ফুরিয়ে এসেছিল। সে হঠাৎ অনন্যার গাল চেপে ধরে তার মুখ নিজের দিকে ফিরিয়ে নিল। চোখে চোখ পড়তেই যেন অদ্ভুত এক শূন্যতা ঘিরে ধরল দুজনকেই। অনন্যার দৃষ্টি স্থির হয়ে গেল, সে আর নিজের মধ্যে নেই, নিষ্পলক চাহনি নিয়ে কাটিয়ে দিলো কয়েক সেকেন্ড। কৌশিকের ঠান্ডা আকাশি চোখ ধীরে ধীরে অনন্যাকে গ্রাস করে ফেলছে। অদ্ভুত শক্তি অনন্যার মস্তিষ্ককে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে।

কিয়ৎক্ষণ পর কৌশিক অনন্যার চুল, মুখ এক ঝটকায় ছেড়ে দিয়ে ঠাণ্ডা গলায় বলল, "ল্যাপটপটা আমার ডেস্কে রেখে আসো। আর হ্যাঁ, ডেস্কের দুই নম্বর ড্রয়ারটা স্পর্শ করবে না।"

অনন্যা ভেতরে ভেতরে অসাড় অনুভব করছিল। হঠাৎ বাস্তবতার দমকা হাওয়া তাকে ধাক্কা দিয়ে সব বুঝিয়ে দিল। দু'মিনিট সময় লেগেছিল পুরোপুরি বাস্তবে ফিরে আসতে। তখনই সে শুনতে পেল কৌশিকের কণ্ঠস্বর। অনন্যা মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানালো। কিন্তু কিছুক্ষণ আগে যা ঘটলো তা মনে করতে পারলো না।

কৌশিক দ্রুত রুমের দরজা খুলে বেরিয়ে গেলো, আর অনন্যাও একদম শান্তভাবে, যেন কিছুই হয়নি, রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। টিচার্স রুমে পৌঁছে অনন্যাকে বেশ কিছু সময় খুঁজতে হলো কৌশিকের ডেস্ক। অবশেষে ল্যাপটপটা ডেস্কে রেখে, হঠাৎ তার মনে পড়ে গেলো, কৌশিক দুই নম্বর ড্রয়ারটা স্পর্শ করতে নিষেধ করেছিল। কিন্তু কেনো? অনন্যা কেন ড্রয়ারটা খুলতে যাবে? ভাবতে ভাবতে অনন্যা একটু দ্বিধায় দুই নম্বর ড্রয়ারটা খুলে ফেললো। তবে মুহূর্তেই তার মুখের অভিব্যক্তি বদলে গেলো। ড্রয়ারে ছিল ছোট ছোট প্লাস্টিকের প্যাকেট, যার মধ্যে অনেকগুলো রাবার ব্যান্ড এবং চুল বাঁধার ডিজাইনেবল ক্লিপ ছিল। অনন্যা হাসি চাপতে পারলো না, খুশিতে তার চোখ ঝিলমিল করছিল।

লোকটা আসলেই একটা ইঁদুর! কী ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা বলে। অনন্যা একটি রাবার ব্যান্ড নিয়ে নিজের খোলা চুলগুলো বেঁধে ফেললো। তারপর বাকিগুলো নিজের ব্যাগে রেখে দিলো। টিচার্স রুম থেকে বের হতে হতে অনন্যা ভাবছিল, সেদিন রাতে ঘটে যাওয়া মুহূর্তের কথা, প্রিন্সেস আরিসা আর স্যারের চোখের সেই অদ্ভুত আলো এসব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করার কথা ছিল কৌশিক স্যারকে। একটু আগে তো কথা হয়েছিল তখন কি জিজ্ঞেস করেছিল লোকটাকে? কিছুই তো মনে পড়ছে না এখন। কেমন মাথাটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।

••••••••••••

নোহারা কসমেটিক শপে কাজ করে। কাজটা বেশ পছন্দ ওর, যদিও শপের মালিক একটু কড়া স্বভাবের। দেরি হলে বকাঝকা অবশ্য অনিবার্য, তবে মাসের শেষে ঠিক সময়ে টাকা হাতে তুলে দেন তিনি। এই কড়া মেজাজের আড়ালেই একধরনের স্নেহ লুকিয়ে থাকে। খাওয়া-দাওয়া নিয়ে কখনোই অবহেলা পছন্দ করেন না উনি, বরং মাঝেমধ্যে ফ্রিতে কিছু খাবার দেন এবং মাঝেমধ্যে ভালো ভালো ব্র্যান্ডের কসমেটিকস দিয়ে দেন। নোহারা মনে মনে হাসে, মহিলার মধ্যে একটা মা মা ভাব আছে। এজন্য বেশ ভালো লাগে। 

আজও কাজ শেষে নিজের ছোট ব্যাগটা গুছিয়ে নোহারা শপ থেকে বের হলো। রাস্তার বাতিগুলো মৃদু আলো ছড়াচ্ছে, আর শহরের ব্যস্ততাও ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে আসছে। প্রতিদিনের মতোই নোহারা শান্ত মনে রাস্তায় হাঁটতে শুরু করলো। কসমেটিকস শপ থেকে ওর বাসা দশ মিনিটের রাস্তা। বেশিরভাগ সময় হেঁটেই যাওয়া হয়। বাসায় ফেরার শর্টকাট রাস্তাটা নোহারার চেনা। এক সরু গলি, যেখানে আবর্জনার স্তুপে ঢাকা পরিবেশ। কেউই সহজে এই গলিতে যেতে চায় না। কিন্তু নোহারার অভ্যাস হয়ে গেছে, প্রতিদিন এই রাস্তা পেরিয়েই সে বাড়ি ফেরে।

আজও সেই পথ ধরতে গলির মুখে পৌঁছে থেমে গেল নোহারা। কয়েক কদম এগিয়ে চোখ আটকাল এক অদ্ভুত দৃশ্যে। আবছা আলোয় দেখল এক যুবক-যুবতী, একে অপরকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের আচরণটা কেমন অদ্ভুত ঠেকলো নোহারার কাছে। সে বিস্মিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

বিরবির করে উচ্চারণ করলো,
"এহহে! ছে! বাংলাদেশ আর আগের জায়গায় নেই। মানুষ রাস্তাতেই...!"

কথা সম্পূর্ণ না করেই সরু চোখে ঠিকমতো তাকালো নোহারা। সোডিয়াম বাতির আলোতে জড়িয়ে ধরা যুবকটির মুখমণ্ডল হলুদ দেখাচ্ছে, কিন্তু লোকটার চোখ দুটোর মণি লাল ঝিলিক দিচ্ছে, চোখে লাগছে নোহারার‌। হঠাৎ লোকটার দাঁত বড় হয়ে দংশন করলো জড়িয়ে থাকা যুবতীর ঘাড়ে। যুবতী স্বল্প চিৎকার করলো। 

বিষয়টি দেখে সারা শরীর কেঁপে উঠলো নোহারার। সে মুখ চেপে পিছনে দৌড় দিতে গেলে পায়ের আওয়াজ হলো। যার কারণে সামনে থাকা যুবক যুবতীর ক্রিয়াকর্ম বন্ধ হয়ে গেলো। নোহারা আবারো পিছনে তাকিয়ে ছুটতে লাগলো। এদিকে আঘাত পাওয়া যুবতী ছুটে পালিয়েছে। যুবকটা উপায় না পেয়ে নোহারার পিছনে আসছে।

নোহারার বুকের ভেতর যেন ড্রাম বাজছে। দুরুদুরু কাঁপছে পুরো শরীর। মাথায় কিছুই কাজ করছে না,কী করবে, কোথায় যাবে, কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। নিজের বাসার উল্টো দিকে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ পিছনে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল কেউ আসছে না। সামনে তাকাতেই নোহারার ভেতর থেকে যেন আত্মা বেরিয়ে যেতে চাইলো।

তার সামনে, রাস্তার আলো-আধারিতে দাঁড়িয়ে আছে সেই যুবক। চোখে অদ্ভুত স্থিরতা, ঠোঁটে এক ঠাণ্ডা হাসি। নোহারা ভয়ে তৎক্ষণাৎ উল্টো দিকে ছুটতে চাইলে পা হড়কিয়ে ব্যাগসহ রাস্তায় পড়ে গেল।

মুহূর্তে সমস্ত শরীরে ভয়ের স্রোত বয়ে গেল। মনে হলো, এইবার হয়তো সব শেষ।

যুবকটি হাঁটু গেড়ে বসলো নোহারার সামনে। শান্ত স্বরে বলে উঠলো,
"রিলেক্স, বেইব!"

নোহারার মুখে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট। সে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে যুবকটির দিকে তাকালো। একদম বিদেশিদের মতো দেখতে লম্বা, ফর্সা আর চোখের মণি এখন স্বাভাবিক। দাঁতগুলোও স্বাভাবিক মনে হচ্ছে। কিন্তু নোহারার মনের ভয় কমল না। খুব দ্রুত গলায় কথা ফসকে বেরিয়ে এলো,
"আপনি... আপনি ভ্যাম্পায়ার, তাই না?"

যুবকটি ঠোঁটের কোণে হাসি টেনে বলল না কিছু। হালকা হেসে রাস্তায় পড়ে থাকা নোহারার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। আশেপাশে মানুষজন পাশ কাটিয়ে হেঁটে যাচ্ছে, যেন কিছুই দেখছে না।

নোহারা একটু দ্বিধা নিয়ে হাত ধরল। উঠে দাঁড়িয়েই পা সরিয়ে বেশ কয়েকটা পদক্ষেপ দূরে গিয়ে দাঁড়াল, যুবকের থেকে যতটা সম্ভব দূরত্ব বজায় রেখে। মনে হলো, কখন না জানি লোকটা তার শিরা চিরে রক্ত চুষে নেয়।

যুবকটি মৃদু হাসি ধরে রেখে বলল, ব্রিটিশদের মতো পরিশীলিত ইংরেজিতে, 
"হ্যাঁ, ঠিক ধরেছ। আমি ভ্যাম্পায়ার। কিন্তু তুমি আমার পরিচয় এত তাড়াতাড়ি জেনে গেলে, ব্যাপারটা মজার হলো না।"

নোহারার মুখে বিস্ময়। যুবকটি ধীর স্বরে নিজেকে পরিচয় করিয়ে দিল, "আমি নিকোলাই ভেস্পার, দ্য গ্রেটেস্ট এমোঙ অল ভ্যাম্পায়ার।"

"ভেস্পার? মানে সন্ধ্যা!"
নোহারা দ্রুত স্বরে বলে উঠলো। নিক হাত তালি দিয়ে বললো,
"বাহ, অনেকেই এই বিষয়টা জানে না। বাট আই এম ইমপ্রেসড।"

নোহারা ভয়ের মধ্যে হেসে ফেললো, চুল ঠিক করে বললো,
"আমার ভোকাবুলারি মোটামুটি ভালো আর কি!"

"হাসছো? ব্যাপারটা সন্দেহের মনে হচ্ছে। কেউ যদি জানে আমি ভ্যাম্পায়ার তাহলে কতক্ষণে পালাবে সেই চিন্তা করে।"

নোহারার হাসি একটু কৃত্রিম মনে হলেও, সে জবাব দিল,
"আমিও তো তাই চিন্তা করছিলাম। আর হাসি হলো আমার সেফটি মেকানিজম।"

নিকের মুখে এবার এক মৃদু হাসি ফুটল, তবে তা ছলনার মতো। তার চোখের দৃষ্টি বদলে গেল। ঠান্ডা, মজার ভঙ্গি থেকে এক ঝাঁক কঠোরতার প্রভাব ভারী হয়ে উঠল। সে কঠোর স্বরে বললো,
"হুম! তো আমার শিকারকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছো তুমি, এখন কীভাবে নতুন শিকার খুঁজবো? নাকি তুমিই আমার পরবর্তী টার্গেট হবে? কোনটা? এন্সার মি!"

নোহারার গলা শুকিয়ে এল। মুখের রং উধাও হয়ে গেল, চোখে সোঁদা আতঙ্কের ছায়া। রাতবিরাতে এ কোন ঝামেলায় জড়িয়ে পড়লো সে!
.
.
.
চলবে......................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp