নবোঢ়া - পর্ব ৫০ - ইলমা বেহরোজ - ধারাবাহিক গল্প


          রাতের চাদরটা তখনও পুরোপুরি গুটিয়ে নেয়নি আকাশ। দিগন্তের কিনারায় সূর্যটা তার প্রথম আলোর আঁচল মেলে ধরেছে। সিদ্দিক সবজি বাগানে হেঁটে হেঁটে হাতের জল-ছিটানো সেচনির সরু মুখ দিয়ে জলের মুক্তো ছড়িয়ে দিচ্ছে ফুলের ডালে আর কচি পাতার গায়ে। গ্রীষ্মের দাবানলে ভোরবেলার এই ঠাণ্ডা-মিষ্টি মুহূর্তটা তার হৃদয়ে আনন্দ জোগায়। গাছপালাগুলোও এই সময়টাতেই তৃষ্ণার্ত কণ্ঠে তৃপ্তি নিয়ে জল গ্রহণ করে তাদের শিকড়ের গভীরে। কেন যে ভোরটা এত অল্প সময়ের জন্য আসে কে জানে! হঠাৎ মনোযোগে ছেদ পড়ে কারো পায়ের শব্দে। ফজিলা মাটির পথ বেয়ে আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে হাতে সবজির ঝুড়ি নিয়ে। তাকে দেখলেই সিদ্দিকের বুকের ভেতর শব্দ জেগে ওঠে ঘণ্টার মতো; শোনা যায় না, ভোলাও যায় না। মেয়েটার কালো মুখে এমন জাদুকরী উজ্জ্বলতা যে, দেখলেই তার হৃদয় মোমের মতো গলে পড়ে! সে সেচের কাজ ফেলে রেখে এগিয়ে যায় সবজি তোলার কাজে হাত লাগাতে। চাল কুমড়ার ঝোপঝাড়ে হাত বাড়াতে গিয়ে চোখ পড়ে দূরে, ঘোড়ার আস্তাবলের পেছনের ঝোপঝাড়ে। কিছু একটা পড়ে আছে মাটিতে। ভোরের ধূসর আলোয় পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না, তবে একটা অমঙ্গলের আভাস বুকে কাঁপুনি ধরিয়ে দেয়। ফজিলা চলে যেতেই ভয় আর অস্থিরতা নিয়ে এগিয়ে যায় আস্তাবলের দিকে। কাছে যেতেই তার মাথায় বজ্রপাত হয়। মাটিতে নিথর হয়ে শুয়ে আছে বাড়ির বিশাল কালো কুকুরটা। জিভ বেরিয়ে আছে, গলায় দাগ। ভয় আর হতভম্বতায় শ্বাস আটকে আসে সিদ্দিকের। বুকের ভেতরে কিছু একটা থরথর করে ভেঙে খানখান হয়ে যায়। দৌড়ে ছুটে যায় মহলের দিকে।

ভেতরে, এই মোরগ-ডাকা ভোরে সুফিয়ান ভূঁইয়া, শব্দর আর নাভেদকে ডেকে এনে ব্যবসার দায়িত্ব ও বিয়ের আয়োজন নিয়ে আলাপ করছেন। দুটো কাজই যাতে নিখুঁতভাবে সম্পন্ন হয়। বিয়ের ঝামেলায় যেন ব্যবসার সামান্যতম ক্ষতিও না হয়। নাভেদ ব্যবসার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছে। আর শব্দর নিয়েছে জাওয়াদের জাঁকজমকপূর্ণ বিয়ের সব আয়োজন। দুজনেই বারবার আশ্বাস দিচ্ছে। কিন্তু সুফিয়ানের মন থেকে উদ্বেগ যাচ্ছে না। সবকিছু ঠিকঠাক হবে তো? এই চিন্তায় তার ঘুম হারাম। সিদ্দিক সেখানে হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বলে, 'হুজুর, ঘোড়ার আস্তাবলের পেছনে কালো কুকুরটা মরে পড়ে আছে।'

সবার চোখে বিস্ময়ের বিদ্যুৎ চমকে ওঠে। তারা সবাই একসাথে ছুটে যায় জায়গাটায়। আস্তাবলের পেছনে পৌঁছে থমকে দাঁড়ায়। সিদ্দিক ফিসফিস করে বলে, 'কেউ ইচ্ছে করেই মেরেছে হুজুর... দেখুন গলায় দাগ৷ কেউ শ্বাসরোধ করে মেরেছে হুজুর।'

সুফিয়ানের বুকের ভেতরটা হাহাকার করে ওঠে৷ তিনি ভালোবেসে কুকুরটাকে রাজা বলে ডাকতেন। চারদিকে নজর বোলান। একটু দূরে পড়ে থাকা খাবারের বাটিতে চোখ পড়তেই মনে তিতা সন্দেহ জন্মায়, রাজাকে কেউ ভালোবাসার ছলে খাইয়েছে। খাবারে নিশ্চয়ই কোনো মরণঔষধ মেশানো ছিল। তারপর রাজা যখন অবশ হয়ে পড়েছে, ঠিক তখনই হত্যাকারী তার প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। নয়তো রাজার মতো দুর্দান্ত, হিংস্র জন্তুকে জেগে থাকা অবস্থায় মারা অসম্ভব। ভয়ানক দৃশ্যটা কল্পনা করতেই সুফিয়ানের চোখে ভিজে ওঠে। কুকুরটি অনেক বছর ধরে এই বাড়ির পাহারাদার। তাকে মেরে ফেলার মানে, বাড়ির নিরাপত্তার দেয়ালে ফাটল ধরেছে। 

বড়ভাইকে ভেঙে পড়তে দেখে শব্দর দ্রুত বলে, 'ভাইজান, আমি খোঁজ নেব কে এই নোংরা কাজটা করেছে।'

সুফিয়ান শান্ত কণ্ঠে উত্তর দেন, 'না, এখন নয়। বাড়ি ভর্তি অতিথি। এই খবর ছড়িয়ে গেলে, আমাদের দুর্বলতা প্রকাশ পাবে। মর্যাদা খর্ব হবে।' ঘাড় ঘুরিয়ে সিদ্দিকের দিকে তাকিয়ে বলেন, 'রাজাকে উত্তর পাশে, আম গাছের নিচে মাটিচাপা দিয়ে দে কেউ দেখার আগেই।'

সিদ্দিক মাথা নামিয়ে সম্মতি জানায়। একবার চোখ মেলে তাকায় রাজার দিকে। সারাদিন ছায়ার মতো পিছু নেওয়া বিশ্বস্ত সাথীটিকে আর দেখতে পাবে না, এই ভাবনায় বুকের ভেতরে জলরঙের মতো শোক ভেসে ওঠে সারা বুকজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। সে শিশুর মতো দুই হাতের তালু দিয়ে চোখের জল মুছে ঝুঁকে পড়ে রাজা নামের কুকুরটির উপর। 

ভোরের মিঠে আলোয় রাইহা ঘুমকাতুরে চোখে টলমল করতে করতে এসে দাঁড়ায় বাগানের নরম, শিশিরভেজা ঘাসের উপর। তার গায়ে কমলা রঙের পাতলা সুতির শাড়ি, নীল ব্লাউজের গলা আর হাতায় কমলা কাপড়ের সুন্দর কুচি। চারদিকে চোখ বুলিয়ে দেখে, দূরে কৃষ্ণচূড়া গাছের মাথায় দিনের প্রথম সোনালি রোদ ঝিলমিল করছে। ঘাড় ঘোরাতেই চোখে পড়ে, দূরের আস্তাবল থেকে বেরিয়ে আসছে সুফিয়ান, শব্দর আর নাভেদ। এই ভোরবেলায় ওরা ওখানে কী করে? কৌতূহলে তার চোখের পাতা কাঁপে। তিনজন মহলে ঢুকতেই দুই হাতে পাটের ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে আসে আসাদ আর মনির। দুজন বাজারের দিকে রওনা হয়েছে। আসাদের দিকে তাকালে কেন যেন রাইহার বুক দুরুদুরু করে ওঠে। লোকটা সবসময় নিজের সাথে একটা নীরব জগৎ নিয়ে ঘোরে। তার মনে হয়, 'মৌনতা' শব্দটাই বুঝি আসাদের জন্য বানানো। যে যা বলে, সে শুধু মাথা নিচু করে সায় দেয়। রাইহা গলা উঁচিয়ে ডাকে, 'এই যে মৌনমহারাজ!'

আসাদের পা থমকে যায়। এই নামে রাইহা ছাড়া আর কেউ ডাকে না তাকে। মনির ততক্ষণে গেট পেরিয়ে গেছে। পিছনে ঘুরে দেখে, সূর্যের প্রথম আলো এসে পড়েছে রাইহার গায়ে। তার চোখ দুটো পরিষ্কার আকাশের মতো নীল। তাকালে মনে হয়, স্বর্গের কোনো পরী নেমে এসেছে এই গ্রামের উঠানে। আসাদ লজ্জায় চোখ নামিয়ে ফেলে। নিচু জাতের, গরিব মানুষের চোখে এত সৌন্দর্য দেখাও যেন পাপ। রাইহা দু-পা এগিয়ে এসে বলে, 'তোমার হবু বউ তো জাওয়াদের প্রেমের ট্রেন ধরে পালিয়েছে! এখন কী করবে ভেবেছ? সন্ন্যাস নিবে, নাকি কাঁথা মুড়ি দিয়ে কাঁদবে?' বলেই সে খিলখিল করে হেসে ওঠে। সে দারুণ খুশি হয়েছে আসাদের বিয়ে ভেঙে যাওয়ায়। আসাদ কোনো কথা না বলে হাঁটতে শুরু করে। রাইহাও তাল মিলিয়ে হাঁটে আর বলে, 'বাজারে যাচ্ছ? আমাকেও নিয়ে চলো।'

আসাদ থামে না, হাঁটতেই থাকে। পরনে তার ঢোলা ফতুয়া, ধুলোমাখা পায়জামা। রাইহা জেদ করে বলে, 'আমাকে না নিয়ে গেলে কিন্তু ফুফুজানকে সব বলে দেব!'

আসাদ এক মুহূর্ত থেমে দাঁড়ায়, চোখে অস্থিরতা দেখা দেয়। কী এমন বলবে মেয়েটা? রাইহা মিটমিট করে হেসে বলে, 'নিয়ে চলো, নইলে সব ফাঁস করে দেব।' 
গত এক সপ্তাহ ধরে এভাবেই বলে যাচ্ছে। রোজ একই জেদ, সে হাটবাজার দেখতে চায়। এমন একগুঁয়েমি! ওদিকে সুফিয়ান ও কোহিনূর দুজনেরই নিষেধাজ্ঞা, এই পরিবারের কোনো মেয়ে-বউ কিংবা দাসী বাজারে যেতে পারবে না। বাজার পুরুষদের জন্য। আসাদেরও সাহস হয় না সেই নিষেধাজ্ঞা ভাঙার, ভূঁইয়া পরিবারে যে মেয়েটা এখন কন্যা হিসেবে পরিচিত, তাকে নিয়ে বাইরে বেরোনো তার মতো গাড়োয়ানের পক্ষে অসম্ভব। তবু প্রতিদিন রাইহার অনুরোধ শুনে তার মনের ভেতর প্রবল ইচ্ছা জাগে- যদি পারত, কাঁধে তুলে এই রূপকথার মতো সুন্দর রাজকুমারীকে নিয়ে শুধু হাটবাজার নয়, গোটা কান্তারপুর ঘুরে বেড়াত! ভাবতে ভাবতে সে বাড়ির গণ্ডি পেরিয়ে দূরে চলে যায়।
রাইহা সেদিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকে। তাকে কেউ আমলে নেয় না। এমনকি একজন সাধারণ গাড়োয়ানও না। চোখ দুটো অজান্তেই ভিজে ওঠে। ধীরে ধীরে সূর্য উঠে পড়ে মাথার উপর। রাইহা সেখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। বাড়িজুড়ে শুরু হয় জাওয়াদ-গুলনূরের বিয়ের ধুম। আগামী দুইদিন ঢাকঢোল বাজবে, গান চলবে। সবার নজর থাকবে 
বরকনের দিকে। ইদানীং তার ইচ্ছা হয়, বাবা-মায়ের কাছে ফিরে যেতে, সবার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে থাকতে।

কোহিনূর শুয়ে আছেন সাজানো-গোছানো ঘরের রাজকীয় পালঙ্কে। একজন দাসী পায়ের পাতায় তেল মালিশ করছে। আরেক দাসী কাঁসার থালায় সাজানো সুপারি যাঁতির ধারালো ফলায় কেটে পান পাতায় মুড়ে কোহিনূরের সামনে এগিয়ে দিচ্ছে নত মাথায়। তিনি হাত বাড়িয়ে পানটি হাতে নেন। চিবোতে চিবোতে জানালার বাইরে দৃষ্টি মেলে ধরেন। গোটা জমিদারবাড়ি উৎসবের জোয়ারে ভেসে যাচ্ছে। বিস্তীর্ণ আঙিনায় বাওল দল মাদল আর একতারার সুরের জালে বেঁধে রেখেছে সবার মন। কাঠের মঞ্চে পুতুলনাচের তাল লেগেছে, শিশু-কিশোররা আনন্দের হাততালিতে মুখরিত করে তুলেছে পুরো পরিবেশ। অতিথিশালার বারান্দা মেহমানদের আগমনে জমজমাট, সকাল হতেই রান্নাঘরে শুরু হুলস্থূল কাণ্ড; ধোঁয়া, গরম, হাঁড়িপাতিলের শব্দ, দৌড়াদৌড়ি আর হাঁকডাক। পুরো জমিদারবাড়ির রগে রগে বয়ে যাচ্ছে বিয়ের আমেজ। এই সব কিছুর মাঝেও কোহিনূরের মন অন্য ভাবনায় মগ্ন। গুলনূরের বিদায়ের দিন আজ। আগামীকাল দুপুরেই আবার পালকিতে করে তাকে ফিরিয়ে আনা হবে। আজ যাবে ভূঁইয়াদের বাংলো বাড়িতে, বিয়ে পড়ানোর ঠিক আগ পর্যন্ত সেখানেই অবস্থান করবে। 

দরজায় মৃদু করাঘাতের শব্দে ভাবনার সুতো ছিঁড়ে যায়। 
কোহিনূর গলা উঁচু করে বলেন, 'এসো।'

গুলনূর নতশির হয়ে ঘরে ঢুকে। কোহিনূর ইশারায় দাসীদের বিদায় হতে বললে তারা চলে যায়। সঙ্গে সঙ্গে ঘরে কবরস্থানের নীরবতা নেমে আসে। তিনি মেরুদণ্ড সোজা রেখে ধীর গতিতে উঠে বসেন। ইশারায় গুলনূরকে বসতে বললে গুলনূর কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে বিছানার এক প্রান্তে বসে।

'দুপুরে খেয়েছ?' জিজ্ঞাসা করেন কোহিনূর।

গুলনূর মাথা নাড়ায়। কোহিনূর মুহূর্তকাল নীরব থেকে বলেন, 'বিয়ের আগে তোমার সাথে আলাদা করে আর কথা বলার সুযোগ পাব না, তাই এখনই ডেকে নিলাম। কিছু কথা না বললে মনের ভেতর বোঝা হয়ে থেকে যাবে।'

তিনি উঠে গিয়ে আলমারি থেকে পুরনো মেহগনি কাঠের বাক্স নিয়ে আসেন। বাক্স খুলতেই সূর্যালোক-ছায়ার মতো ঝিকিমিকি করে ওঠে একটি রুবির আংটি। রত্নটির দীপ্তি গুলনূরের চোখে ধাঁধা লাগিয়ে দেয়। তিনি নিজ হাতে গুলনূরের বাঁ হাতের অনামিকায় আংটিটি পরিয়ে দিয়ে বলেন, 'এই আংটির মতোই ভালোবাসার বাঁধনে জড়িয়ে রাখবে স্বামীকে। কোনোদিন ওকে কষ্ট দিবে না। জাওয়াদ বাইরে থেকে যতই কঠিন দেখাক, ভিতরে ও ছেলেবেলার মতোই কোমল, অবুঝ। কোনো যন্ত্রণা মেনে নিতে পারে না। যতটুকু ধৈর্য ছিল সেটাও দুই বছর আগে হারিয়ে ফেলেছে ...' কথা অসম্পূর্ণ রেখেই থেমে যান।
গুলনূর চোখ তুলে তাকায়। কোহিনূর নিঃশ্বাস ফেলে বলতে থাকেন, 'তুমি তো দেখেছ তোমার জন্য কী না করেছে। কত উন্মাদনা করেছে! এসব কোনো পুরুষ হঠাৎ করে করে না। যদি না হৃদয় উজাড় করে ভালোবাসতে পারে। মানুষ বলে, পুরুষেরা কাঁদতে পারে না, এই কথাটা আমি মানি না। আকাশ ভেঙে পড়লে, বুক ফেটে গেলে তারাও কাঁদে। জাওয়াদ কাঁদে। অঝোরে কাঁদে। পুরুষ মানুষ কাঁদে না, কাঁদলে দুর্বল লাগে - এই কথা আমাদের সময়েও শুনেছি। অথচ আমি কত পুরুষকে কাঁদতে দেখেছি! তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেদনা নিয়ে কাঁদতে দেখেছি জাওয়াদকে। ও কাঁদলে পাথরও যেন গলে যায়। তুমি কখনো সেই কান্নার কারণ হয়ো না। একজোড়া চোখ, একজোড়া হাতই পারে একজন পুরুষকে আবার দাঁড় করাতে। সেই চোখ, সেই হাত যেন হয় তোমার। তুমি আমার জাওয়াদের ভরসা, শান্তি হয়ে থেকো।'

গুলনূর এক হাত দিয়ে আরেক হাত আঁকড়ে ধরে। কোহিনূর আরও বলেন, 'একটা কথা মনে রাখবে, নারীর রূপলাবণ্য নয়, তার দেয়া সম্মান, ভালোবাসাই একজন পুরুষকে বশ করে রাখে। তুমি যদি জাওয়াদের মনের ভাষা উপলব্ধি করতে পারো, ও তোমাকে চোখে হারাবে। আমার শ্বশুরবাড়িতে আমি যা কিছু অর্জন করেছি, সব পেয়েছি তোমার দাদাশ্বশুরের স্নেহের কারণে। আমি সবসময় বিনয়ের মুকুট মাথায় রেখেছি, বিনিময়ে উনি আমার জন্য ওই বাড়িটাকেই রাজ্য বানিয়ে রেখেছিলেন। আমি কখনো উনার মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করিনি। স্বামী নারীর অহংকার। তার পরিচয়ের মূলে যে নাম, সে তো তার পুরুষেরই নাম।' 

তিনি জানালার বাইরে তাকিয়ে আরও গম্ভীর হয়ে বলেন, 'জাওয়াদকে শ্রদ্ধা করবে, কিন্তু ভয় পাবে না। ভয় পেলে ভালোবাসা মরে যায়। কোনোদিন যদি কোনো কারণে তোমার রাগ হয়, অভিমান জাগে, শালীনতার সীমার মধ্যে থেকেই রাগ করবে। স্বামীকে হেয় করলে সংসারের আশীর্বাদকে উপেক্ষা করা হয়। বিশেষ করে অন্যদের সামনে। স্বামীর যতই দোষ থাকুক, বাইরের মানুষের সামনে তার পক্ষেই থাকবে। ঘরে এসে যা বলার বলবে। সংসার তখনই ধ্বংসের পথে এগিয়ে যায় যখন স্ত্রী স্বামীর বিরুদ্ধে যায়। স্বামী হচ্ছে সংসার নামক রথের চালক। আর স্ত্রী হচ্ছে সেই রথের ছন্দ। ছন্দ যদি তাল হারায়, রথও পথে ভেঙে পড়ে।' 

কোহিনূর থামেন, এগিয়ে এসে গুলনূরের কাঁধে হাত রেখে বলেন, 'তোমার হাতে জাওয়াদকে সঁপে দিলাম, আমার মান রেখো। এখন যাও, সাজসজ্জা করো। কিছুক্ষণ পরেই তোমার যাত্রা।'

গুলনূর ধীর গতিতে উঠে দাঁড়ায় চলে যেতে। কী ভেবে আবার পেছনে ফিরে তাকায়। ধীরে ধীরে চোখ তুলে প্রথমবারের মতো কোহিনূরের চোখে চোখ রাখে। তারপর এগিয়ে এসে গভীর শ্রদ্ধায় পা স্পর্শ করে সালাম জানিয়ে প্রস্থান করে সেখান থেকে। কোহিনূর কিছুটা বিহ্বলতায় পড়ে যান। এইমাত্র...এই মুহূর্তে যে গুলনূরকে প্রত্যক্ষ করলেন, সে যেন কোথাও অপরিচিত! দাঁড়ানোর ভঙ্গিমা, চোখের দৃষ্টিভঙ্গি হঠাৎই অন্যরকম লাগল! 

সোনালি বিকেলের মধুরিমা আলোয় স্নাত হয়ে আছে গুলনূরের পুরো অস্তিত্ব। নারকেল তেলের মাদকতা মাখানো চুলের সুবাস ঘরের বাতাসকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছে। জানালার ওপারে প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে চারচাকার ছাউনি-ঢাকা পালকি-গাড়ি, যার গাঢ় রক্তাভ মখমলের আবরণ রোদের আলোয় ঝিকমিক করছে। জোড়া দুধসাদা ঘোড়ার কণ্ঠে বাঁধা রুপালি ঘুঙুর। আর তার দেহে জড়ানো জ্যোৎস্নারঙা বেগুনি শাড়ি। খোঁপায় গাঁথা সাদা বেলি ফুলের মালা। গলায় চিকন সোনার হার, ঠোঁটে লালিমা, হাতে কাচের চুড়ি। তাকে দেখাচ্ছে রাজদরবারের মহারানীর মতো। যেই একবার তাকায়, তার চোখ আটকে যায়। কেউ বিশ্বাসই করতে পারছে না, এই মেয়ে কান্তারপুরের জমিদার বাড়ির দাসী ছিল! তার বর্তমান অবয়ব দেখে মনে হচ্ছে, রাজ্যপাটের উত্তরাধিকারিণী সে, জন্ম থেকেই রাজরক্ত বইছে তার শিরায়। অনেক দাসী-বাঁদির অন্তরে ঈর্ষার বিষাক্ত সাপ ফণা তুলে দুলছে। যে এতদিন ছায়ার মতো অবহেলিত ছিল, আজ হয়ে উঠেছে সবার নয়নমণি। কী অভাবনীয় ভাগ্য!
গুলনূর যখন ঘোড়াগাড়িতে পা রাখে, তখন গ্রামবাসী আর অতিথিদের চোখেমুখে স্তম্ভিত বিস্ময়। কিছুদিন আগেও যেসব কুৎসিত কানাঘুষা ছিল জমিদারপুত্র আর দাসীর নিষিদ্ধ প্রেম নিয়ে, আজ সেই কলঙ্কের গুজবকে ছাপিয়ে গেছে তার মোহনীয় আভা। এ যদি যোগ্য পাত্রী না হয় তবে আর কে হবে? গুলনূরের রূপ-মাধুর্যের চেয়েও বেশি মনোমুগ্ধকর তার মুখের ধারালো অভিব্যক্তি; কত দৃঢ়, কত আত্মবিশ্বাসী! যে সংকোচ আর ভীতি এতদিন তার চেহারায় লেগে থাকত সেসব আজ হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। এখন তার দৃষ্টিতে এমন আধিপত্যের ভাব যেন সে এই প্রাসাদের চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারিণী! এমনকি কোহিনূরও হতবিহ্বল হয়ে দেখছেন গুলনূরের পরিবর্তন। 

ঘোড়াগাড়িটি মৃদু গতিতে মাটির সড়ক বেয়ে এগিয়ে চলতে শুরু করে। গুলনূর শানিত পিঠে বসে থাকে। এই পথ তাকে চিরতরে কান্তারপুর থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে যাচ্ছে। মহলের প্রতিটি বারান্দার স্মৃতি, প্রাঙ্গণের হর্ষ-বিষাদের গল্প, ভোরের শিশিরসিক্ত ঘাসের মাতাল গন্ধ- সবকিছু ছেড়ে আজ বিদায় নিচ্ছে সে। এত আড়ম্বর, এত দৃষ্টি, এত জাঁকজমকের মধ্যেও তার চোখ দুটি অবিরাম খুঁজে ফিরছে জাওয়াদকে। শেষবারের মতো একটু দেখা কি মিলবে না? কানে এসেছে, ভোরবেলাই নাকি সে নদী পার হয়ে গেছে শব্দরের সঙ্গে, কোনো গুরুত্বপূর্ণ স্বজনকে নিয়ে আসতে। গুলনূর দীর্ঘশ্বাস ফেলে হৃদয়ের গহনে চাপা পড়া স্মৃতির ঢেউগুলো মুছে ফেলার চেষ্টা করে। 

দোতলা কাঠের বাংলো বাড়িটি দাঁড়িয়ে আছে রূপকথার রাজপ্রাসাদের মতো। চারিদিকে বিস্তৃত বাগানের হৃদয় থেকে হাওয়ায় মিশে আসছে মৌচাকের অমৃত সুবাস, লীন হয়ে গেছে ফুলের মাদকতা-মাখা সুগন্ধের সাথে। চাঁদের রুপালি কিরণধারা বাগানের ঘাসের উপর বিছিয়ে দিয়েছে মুক্তোর গুঁড়ার মতো শোভা। এই স্বর্গীয় পরিবেশের কেন্দ্রস্থলে, দোতলার সর্বাপেক্ষা মনোহর ঘরে বসে আছে গুলনূর। তার চারপাশে সুসজ্জিত বিয়ের সমস্ত আয়োজন। হাঁটুর উপর চিবুক রেখে গহন দুঃখ নিয়ে তাকিয়ে রয়েছে জানালার দিকে। তার চোখ দুটি হারিয়ে গেছে হয়তো ফেলে আসা অথচ গভীর ক্ষত করে রাখা কোনো নিষ্ঠুর অতীতের গহ্বরে, অথবা অজ্ঞাত ভবিষ্যতের অন্ধকার প্রান্তরে, যে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। পাশে সাজিয়ে রাখা টকটকে লাল বেনারসি শাড়ি, সোনালি সুতার কারুকাজ চিকচিক করছে হারিকেনের আলোয়। গহনার বাক্স খোলা পড়ে আছে। সোনার অলংকার, মুক্তোর মালা, চুনির কানের দুল, নীলকান্তের আংটি - সবকিছুই ঝলমল করছে আলোর নাচনে। কাল সকালে এসব পরেই সজ্জিতা হবে সে নতুন বধূ হয়ে, জমিদারপুত্র জাওয়াদের স্ত্রী হয়ে। ভাবতেই বুক থেকে বেরিয়ে আসে গভীর দীর্ঘশ্বাস। বুকের উপর যেন কোনো ভারী পাথর চেপে বসে আছে। জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরে চোখ মেলে সে। চাঁদ এখন আকাশের মাঝামাঝি। তার চারিদিকে ছোট ছোট তারারা টিমটিম করছে। আস্তে আস্তে বাতাস এসে পর্দার সাথে খেলা করছে, তারপর তার মুখ ছুঁয়ে চলে যাচ্ছে। সেই সাথে ধীরে ধীরে খালি হয়ে আসছে বুকের ভেতরটা। একটা শূন্যতা আস্তে আস্তে গিলে নিচ্ছে তার সমস্ত অস্তিত্বকে। চোখের সামনে ভেসে উঠছে জাওয়াদের মুখ। মানুষটিকে আর কখনো দেখা হবে না, এই নির্মম বাস্তবতা বিষবাণের মতো বিদ্ধ করছে হৃদয়কে। জাওয়াদ... তার শত্রুর উত্তরাধিকারী। তবুও অন্তরের নিগূঢ় কোণে কেন এমন আকর্ষণ অনুভূত হয়! কেন তার স্মৃতিতে এত মধুর অনুভূতির সঞ্চার হয়!

'কেন তুমি দৈত্যকুলে জন্মগ্রহণ করলে, রাজকুমার?' 

তার অজান্তেই আর্তনাদ করে ওঠে ভেতরের সত্তা। প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় আকাশপানে। সেই প্রশ্নেই চমকিত হয় সে স্বয়ং। ক্রোধে, দুঃখে, হতাশায় অস্থির হয়ে পড়ে। তার কি এই ভয়াবহ ষড়যন্ত্র থেকে সরে দাঁড়ানো উচিত? না! নিজেকেই তীব্র ভর্ত্সনা করে সে। নিজের সাথেই তর্কে লিপ্ত হয়, 'সন্তানেরা যদি পিতা-মাতার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়, তাহলে তাদের কৃত পাপেরও দায়ভার বহন করতে হবে। একজনের প্রতি ক্ষণিকের কৃতজ্ঞতার আবরণে আমি আমার সকল ক্ষত ভুলে যেতে পারি না।'
নিজে সাথে চলতে থাকে তার তীব্র সংগ্রাম। এক অদৃশ্য শক্তি যেন সমস্ত টানাপড়েন ছিন্নভিন্ন করতে চাইছে অন্তর থেকে। সে উঠে পড়ে পালঙ্ক থেকে। অস্থিরতায় পায়চারি শুরু করে ঘরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। তার পদধ্বনি কাঠের মেঝেতে বাজতে থাকে গুমগুম শব্দে। কতক্ষণ এভাবে হাঁটাহাঁটি করেছে জানে না। শেষে ক্লান্ত হয়ে বিছানায় শুয়ে নরম বালিশে মাথা রাখতেই সারাদিনের ক্লান্তি এসে ভর করে চোখের পাতায়। বিষণ্ণতায় ভরা চিন্তাভাবনা নিয়েই ধীরে ধীরে তলিয়ে যায় ঘুমের রাজ্যে। যেখানে নেই কোনো উদ্বেগ, নেই কোনো দ্বন্দ্ব-সংঘাত। হঠাৎ দরজায় তীব্র শব্দ, সাথে দাসীর কণ্ঠস্বর, 'বেগম সাহেবা! ছোট হুজুর এসেছেন! বেগম, শুনতে পাচ্ছেন?'

শব্দগুলো গুলনূরের স্বপ্নমগ্ন অন্তরে বিকট ঝড়ের মতো আছড়ে পড়ে। চোখের পাতা কম্পিত হয়ে ওঠে, হৃৎস্পন্দন অনিয়মিত তালে নাচতে থাকে। এক লাফে বিছানা ছেড়ে উঠে বসে, দ্রুততায় ছুটে যায় বারান্দার দিকে। জানালার পাল্লা সরাতেই দৃষ্টিতে ধরা পড়ে, বাগানের নিভৃত কোণে দাঁড়িয়ে আছে জাওয়াদ। মুখ অন্যদিকে ফেরানো। ক্ষণিকে গুলনূরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ জুড়ে বিদ্যুৎ প্রবাহ বয়ে যায়। জাওয়াদ এসেছে! হৃদকম্পন পতাকার মতো পত্পত্ করে উড়তে থাকে তার সত্তার সীমানা জুড়ে। আর এক নিমেষও দেরি না করে দ্রুতপায়ে এগিয়ে যায় দরজার দিকে। দিনের বেলা যে শাড়িটি পরে গ্রামবাসীদের মুগ্ধ করেছিল, সেই শাড়ির আঁচল মেঝেতে ঝাঁকুনি খাচ্ছে, আর পায়ের তালে তালে কাঠের সিঁড়ি কড়কড় করে বাজছে। শব্দে ঘুম ভেঙে যায় সমস্ত দাসীর। গুলনূরের ঘোর কেটে যায় আকস্মিক, দরজার কাছে পৌঁছেই তার অনুভূতি হয়, সে প্রেমে মত্ত নারীর মতো আচরণ করছে! বিস্ময়ে তৎক্ষণাৎ নিজেকে সংযত করে। আঁচল টেনে আনে মাথার উপর, ঘোমটা নামিয়ে রাখে কপাল পর্যন্ত। তারপর পা বাড়ায় বাগানের দিকে।

পদশব্দ না হলেও জাওয়াদ অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে অনুধাবন করে গুলনূর এসেছে। সে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। পরনে তার চিরপরিচিত ইউরোপীয় সাহেবদের মতো শার্ট-প্যান্ট। গুলনূরকে দেখেই মুহূর্তের জন্য প্রস্তরবৎ হয়ে যায়। কথা বলার সামর্থ্য হারিয়ে ফেলে। মেয়েটার চোখে কাজলের রেখা, ঠোঁটে এখনও লালিমা লেগে আছে, গলার ঝলমলে চিকন হার, গায়ে জড়ানো মায়াবী কোমল রঙের হালকা বেগুনি শাড়ি! কী অলৌকিক সৌন্দর্য! তার হৃদয় ঢোলের মতো বাজতে শুরু করে। গুলনূর কুর্নিশ করে সম্মানপ্রদর্শন করে। জাওয়াদ এগিয়ে এসে তার একটি আঙুল দিয়ে গুলনূরের চিবুক স্পর্শ করে তুলে ধরে উপরে। চোখযুগল মিলিত হতেই কোমল কণ্ঠে বলে, 'অপূর্ব।'

গুলনূরের গালদুটো গোলাপ দলের মতো রক্তিম হয়ে ওঠে। দৃষ্টিগোচর হয় জাওয়াদের এক হাতে একটি স্বচ্ছ কাঁচের পাত্র, যার ভেতরে জোনাকি পোকারা নৃত্য করছে। কৌতূহল জেগে ওঠে তার অন্তরে। প্রশ্নময় দৃষ্টিতে জাওয়াদের দিকে তাকায়। জাওয়াদ তার চোখের ভাষা বুঝে মৃদু হেসে বলে, 'নতুন রানীর নিরাপত্তার জন্য আলোর ক্ষুদ্র সৈনিকদের সাথে নিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু এসে দেখি রানীর রূপে মুগ্ধ হয়ে তার চেয়েও অধিক আলোর প্রহরী এই সমগ্র বাড়িটাই পাহারা দিয়ে রেখেছে।' কথা বলার সময় সে চারিদিকে ইঙ্গিত করে। গুলনূর বিস্ময়ে লক্ষ্য করে, বাগান জুড়ে অগণিত জোনাকি পতঙ্গ ঝিকমিক করছে। কী হৃদয়হরণকারী দৃশ্য! 

জাওয়াদ অনেকক্ষণ আগেই বাড়ি ফিরেছিল। যাকে আনতে গিয়েছিল নদীর ওপারে, সেখানে পৌঁছে শুনতে পায়, ভদ্রলোকের স্ত্রী ভোরে মৃত্যুবরণ করেছেন। মৃত্যু সংবাদ শুনে সে এবং শব্দর কিছুক্ষণ স্তব্ধ দাঁড়িয়ে থাকে, তারপর সেই শোক-ভেজা পরিবেশে সারাদিন কাটিয়ে রাতে ফেরে। বাড়ি ফিরে যখন জানতে পারে, গুলনূরকে পাঠানো হয়েছে বাংলোবাড়িতে, তখনই তার হৃদয়ে গুলনূরকে এক পলক দেখার আকুলতা দানা বাঁধতে শুরু করে। সে যেতে চায় তখনই...এক মুহূর্তও দেরি না করে। কিন্তু পরিবারের প্রবীণদের অনুরোধে সেই ইচ্ছেকে সাময়িক বিরতিতে রাখতে বাধ্য হয়।
বাড়িতে তখন চলছে বিয়ের আগের রাতের প্রথাগত উৎসব। প্রাঙ্গণ মুখরিত গানের সুরে, অতিথি আপ্যায়নের রমরমা, সুস্বাদু খাদ্যের সুবাসে ভরে উঠেছে বাতাস। বিশেষ অতিথিদের জন্য ছিল মদের আসর, কুসুমভরা কোলাহলের পেছনে গোপন ঐশ্বর্য! এসব আয়োজনে বাড়ির প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের উপস্থিতি অপরিহার্য বলে ধরে নেওয়া হয়।

'কাল তো দেখা হবেই,' এই ভেবে নিজেকে প্রবোধ দেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করেছে। কিন্তু রাত গভীর হলে একাকীত্বে সে অস্থির হয়ে ওঠে। মনে হতে থাকে, কেউ হৃদয়ের গহীনে বাঁধা সূতোয় ধরে অবিরাম টেনে চলেছে, কষ্টার্জিত সংযম ভেঙে যেতে থাকে একে একে। শেষমেশ সবার নিষেধ ঝেড়ে ফেলে ছুটে আসে বাংলোবাড়ির দিকে...গুলনূরের কাছে।

সে কাঁচের পাত্রটি এগিয়ে দিয়ে বলে, 'ধরো, এদের মুক্ত করে দিই।'

গুলনূর পাত্রটি ধরে, আর জাওয়াদ আলতো করে ঢাকনাটা খুলে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে অসংখ্য জোনাকি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে, অন্ধকার বাগানজুড়ে আলো ছড়ায় ক্ষীণ...কিন্তু মায়াময়। ফুলের গন্ধ, পাতার স্পর্শ আর জোনাকিদের আলো মিলিয়ে স্বপ্নিল পরিবেশ সৃষ্টি করে। যেন তারা স্বপ্ন আর জাগরণের মাঝামাঝি কোথাও আছে এখন। জাওয়াদ স্বপ্নালু চোখে বলে, 'ওদের মতোই উড়ো সারাজীবন, আলো জ্বেলে। আমি সেই আলোতে জীবন দেখব।'

গুলনূর পথভোলা বালিকার মতো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। সেই দৃষ্টির গভীরে যে নির্ভেজাল কোমলতা, তা জাওয়াদকে এক মুহূর্তের জন্যও দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতে দেয় না। আজ গুলনূরকে অন্যরকম লাগছে! ঠিক যেন আকাশ থেকে নেমে আসা পরী। তার কানের পাশে যদি একটি গোলাপ থাকত, তবে সে সৌন্দর্যের পরিপূর্ণতা পেত। এই ভাবনা মাথায় আসতেই সে চোখ বুলিয়ে খুঁজে পায় কাছেই একটি গোলাপগাছ। তাড়াহুড়ো করে ফুল তুলতে গিয়ে তার আঙুলে কাঁটা ফুটে যায়। চট করে সে হাতটা সরিয়ে নেয়। গুলনূর আতঙ্কিত হয়ে ছুটে এসে জাওয়াদের হাত নিজের হাতে তুলে নেয়। অনামিকার ডগায় ফুটে ওঠা ক্ষুদ্র ক্ষত থেকে গড়িয়ে পড়ছে রক্তবিন্দু। উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে সে ক্ষতস্থানে চেয়ে থাকে, ভ্রু কুঁচকে যায় চিন্তায়। জাওয়াদ বলে, 'খুবই সামান্য। কোনো গাছই চায় না তার ফুল জোর করে কেউ ছিঁড়ে নিক। তাই হয়তো একটু শাস্তি দিয়েছে।'

গুলনূর ঝোপঝাড়ের দিকে এগিয়ে গিয়ে কী যেন খুঁজতে থাকে। কৌতূহল নিয়ে জাওয়াদ জিজ্ঞাসা করে, 'কী খুঁজছো?'

মুহূর্তেই গুলনূর কয়েকটি নিরাময়ী পাতা পেয়ে যায়। যত্ন করে পাতাগুলো তুলে নিয়ে আঙুলের মাঝে নিয়ে চটকাতে থাকে। চোখের পলকে পাতাগুলো সবুজ রসে ভিজে ওঠে। সবুজ রস লেগে থাকা পাতাটা জাওয়াদের ক্ষতের উপর আলতো করে চেপে ধরে।
পুরুষ এহেন সামান্য আঘাতে ব্যথিত হয় না! ভেবে মস্তিষ্ক ক্লান্ত করে না৷ কিন্তু গুলনূরের যত্ন, প্রেমঘন উদ্বেগে মনে হচ্ছে, সে সত্যি ভীষণ আহত। বুকের গভীরে আনন্দের ঝরনা বয়ে যাচ্ছে। যদি ক্ষতটা আরেকটু বড় হতো! সে মুগ্ধতায় চেয়ে থাকে হবুস্ত্রীর দিকে। গুলনূর নরম পাতাটা ক্ষতের ওপর আলগোছে চেপে ধরে রাখে। জাওয়াদের ভাবে, এই স্বর্গীয় মুহূর্তটি যদি অনন্তকালের জন্য থেমে যেত, অনন্তকাল ধরে গুলনূর এভাবেই তার শরীর ছুঁয়ে থাকত! অনুভব করে, সাধারণ অনুভূতির চেয়ে গভীর কিছু, অদেখা আগুনের হল্কা তার শিরায় শিরায় প্রবাহিত হচ্ছে। গুলনূরকে কাছে টেনে নেওয়ার তীব্র আকুলতা, বুকে জড়িয়ে রাখার পাগলপারা বাসনা, নিঃশব্দে আরও কাছে গিয়ে তার নিঃশ্বাসের উষ্ণতায় নিজেকে ভাসিয়ে দেওয়ার তৃষ্ণা; এসব তো আগে কখনো জেগে ওঠেনি তার হৃদয়ে! অজান্তেই মনের গোপন কোণে প্রেমের দেবতা জেগে উঠেছে, শরীরের প্রতিটি রোমকূপ থেকে গুলনূরকে আরও কাছে পাওয়ার আকুতি উঠছে! এমনকি গুলনূর যখন নিরাময়ী পাতা খুঁজছিল, সেই সুযোগে তার প্রেমাতুর দৃষ্টি গুলনূরের দেহের সুন্দর বাঁক, শাড়ির ভাঁজে লুকানো কোমরের মোহনীয় রেখা দেখে নিয়েছে। এতদিন তো এমন প্রেমময় চোখ ছিল না তার। আজ কেন এই জাদু? জাওয়াদ চমকে ওঠে নিজের পরিবর্তন টের পেয়ে। হাত সরিয়ে নিয়ে একটু দূরত্ব বজায় রেখে বলে, 'এইটুকুর জন্য এত যত্নআত্তির দরকার নেই। যাও, ঘুমিয়ে পড়। একা একা ভয় লাগলে কোনো দাসীকে ডেকে নিও। কাল থেকে তোমার আর কোনো ভয়ের কারণ থাকবে না। আমরা একসাথে থাকব...সারাজীবন।' বলেই হাসে জাওয়াদ। চোখ দুটিতে আলো জ্বলে ওঠে। আদুরে গলায় বলে, 'এখন যাও, ঘুমিয়ে পড়ো। সকালে অনেক ব্যস্ততা।'
গুলনূর স্বভাবের নরম বশ্যতায় কুর্নিশ করে বাড়ির দিকে পা বাড়ায়। সঙ্গে সঙ্গে বুকের ভেতর ফিরে আসে সেই চিনচিনে যন্ত্রণা আর হৃদয় খালি হওয়া শূন্যতা। সে পেছনে ফিরে তাকায়। জাওয়াদ চলে যাচ্ছে...চিরতরে। ভেজা কণ্ঠে ফিসফিস করে বলে, 'পৃথিবীর কারো সাধ্যি নেই তোমার-আমার মঞ্জিল এক করার।' 

জাওয়াদও ফিরে যেতে গিয়ে একবার ঘুরে দাঁড়ায়। কিছুটা এগিয়ে এসেই মনে পড়ে যায়, সেদিন রাতের রহস্যময় ঘটনার পর সবাই ভেবেছিল তার মা অসুস্থতার কারণে দুঃস্বপ্ন দেখে ভয় পেয়েছিলেন। কিন্তু সে জানত, কেউ একজন সত্যিই ছিল সাদা শাড়ি পরে! এই দুই দিন ধরে সবার ওপর নজর রেখেছে সে। সন্দেহজনক কিছুই চোখে পড়েনি। এমনকি সেই সাদা শাড়িটা, যেটা ওই ঘরে পড়ে ছিল, সেই কাপড়ে যে মাদক সুগন্ধ মাখানো ছিল সেটাও আর কোথাও পায়নি। কিন্তু এইমাত্র সেই একই মাদকতা ভরা সুবাস ভেসে এসেছিল গুলনূরের দেহ থেকে। জাওয়াদ দ্রুত মাথা ঘুরিয়ে তাকায়। ততক্ষণে গুলনূর বাড়ির ভেতর মিলিয়ে গেছে রাতের অন্ধকারে।

——————————

শব্দর দ্বিতীয় তলার বারান্দা অতিক্রম করে ঘরে ঢুকে দেখে, আয়নার সামনে বসে জুলফা তার চুলের খোঁপায় রূপার কাঁটা গাঁথছে। ঘরের পরিবেশ ভারী হয়ে আছে চুলের সুরভি আর আতরের সুবাসে। নিজ প্রতিচ্ছবিতে মগ্ন জুলফা শব্দরের আগমন টের পেতে অনিচ্ছুক, নাকি অবগত হয়েও এড়িয়ে যাচ্ছে তা বোঝা যাচ্ছে না। শব্দর এগিয়ে এসে বলে, 'যাত্রাপালার সকলে কি তোমাকে কেবল জেসমিন পরিচয়েই জানত?' 

জুলফার হাত স্থির হয়ে যায়, খোঁপা খুলে চুল হাতে ঝুলে পড়ে। আয়নায় অনড় দৃষ্টিতে তাকিয়ে উত্তর দেয়, 'দর্শকের কাছে জেসমিন হিসেবে পরিচত থাকলেও, আমার সঙ্গে যারা কাজ করত সকলেই আসল নাম-পরিচয় জানত। হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন? কিছু হয়েছে?'

শব্দর ঠোঁট চেপে মুহূর্তকাল ভেবে নিয়ে শুধায়, 'আগামীকাল বিকেল থেকে বাড়িতে মেহমানদের ভিড় জমবে। কালীগঞ্জ থেকে অনেক অতিথি আসবে। কেউ যদি তোমাকে চিনে ফেলে, যদি বলে বসে তুমি যাত্রাদলের নাচিয়ে জেসমিন, ভাইজান কিছুতেই মেনে নেবেন না। বেদেকন্যা পরিচয়ে হয়তো সহনশীল থাকতেন, কিন্তু যাত্রার মেয়ে,' শব্দর বিরতি নিয়ে পুনরায় বলে, 'সেটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।'

'জানাজানি হলে আপনার ইজ্জত চলে যাবে?'

'যদি সম্মানের কথা ভাবতাম, তোমাকে বিয়েই করতাম না। তুমি কে, কোন্‌ পরিবেশ থেকে এসেছ -সবকিছু সম্পর্কে জেনেই তোমাকে ঘরে এনেছি, রানি করেছি। কিন্তু ভাইজান জানতে পারলে... তোমার মুখ দেখা দূরে থাক, আমার দিকেও তাকাবেন না। বিয়ের রাতে তো সব বলেছিলাম, মনে নেই?'

জুলফা নিরুত্তর। 

শব্দর বলে, 'এক কাজ করো। আগামীকাল গুলনূরের সঙ্গে বাংলোবাড়িতে চলে যাও। সবাইকে বলব, গুলনূরের আপন বলতে কেউ নেই সেজন্য তুমি কনেপক্ষ নিয়েছ। বিয়ের দিন ফিরে এসে অসুস্থতার বাহানায় কিছুক্ষণ আড়ালে থেকো।'

জুলফা উঠে দাঁড়ায়। আয়নার সামনে রানির ভঙ্গিমায় সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে অনড়ভাবে জানায়, 'আমি জমিদারবাড়ির বউ হয়ে চোরের মতো লুকিয়ে থাকব না। আমাকে লুকিয়ে রাখতে হলে এই বিয়ের অর্থই বা কী? আমার মর্যাদা, আমার অধিকার সব কোথায়?'

শব্দর অনুনয়ের সুরে বলে, 'জুলফা, ভাইজানের কথা একটু ভাবো। সামান্য এই সহযোগিতাটুকু করো। বিনিময়ে যা চাইবে, তাই পাবে।' 

'আমার চাওয়ার কিছু নেই। শুধু মর্যাদার সাথে নিজের পরিচয়টুকু চাই।' পায়ের নিচে নরম গালিচায় মৃদু শব্দ তুলে ঘর পেরিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে যায় জুলফা। মনে মনে ভাবে, শব্দরের স্ত্রীর পরিচয় তার কখনোই দরকার ছিল না। কিন্তু তার অতীত লুকানোর জন্য শব্দরের এই লজ্জা, এই ভীতি সেটাও সে কিছুতেই মানবে না। তার অহংবোধ মানতে দিবে না।

শব্দর তার পেছনে ধাওয়া করে, তখন বারান্দার মুখে এসে উপস্থিত হয় মনির। মাথা নত করে সালাম জানিয়ে বলে, 'হুজুর, বড় হুজুর আপনাদের দুজনকে ডেকেছেন।'

'খানিক পরেই আসছি।'

'এখনই যেতে বলেছেন, হুজুর।'

শব্দরের কণ্ঠ শুষ্ক হয়ে আসে। বুকের ভেতরে একটা আশঙ্কা ধুকপুক করে ওঠে। 'ভাইজান কি জুলফার পরিচয় জেনে গেছেন? বাড়িতে এমন কেউ এসেছে যে জুলফার সঙ্গে পূর্ব পরিচিত?' উৎকণ্ঠায় মুখ বিবর্ণ হয়ে যায় তার। সে জুলফার দিকে তাকায়। জুলফা ততক্ষণে বারান্দা অতিক্রম করে বৈঠকখানার দিকে যাচ্ছে। সেও দ্রুত জুলফাকে অনুসরণ করে নিচ তলায় নেমে আসে। সেখানে পৌঁছে দেখে নয়নাভিরাম এক দৃশ্য! বৈঠকখানা যেন রূপকথার রাজপ্রাসাদে রূপান্তরিত হয়েছে। এক প্রান্তে বিছিয়ে রাখা হয়েছে রঙবেরঙের, নকশিকাঁথার মতো কারুকার্যময় অসংখ্য শাড়ি আর জামদানির মেলা। শহরের সবচেয়ে নামকরা তাঁতিকে হাজির করেছেন সুফিয়ান। বৈঠকখানার আসনে আজ প্রথমবারের মতো বসেছে গুলনূর। পর্দার আড়ালে থাকা দাসী আজ মুখ আধা-ঢাকা ঘোমটায় জাওয়াদের পাশে বসে আছে পূর্ণাঙ্গ গৃহিণীর ভূমিকায়। তাদের থেকে কিছুটা ব্যবধানে সুফিয়ানের পাশে বসেছে নাভেদ।

তাদের উপস্থিতি টের পেয়ে সুফিয়ান মুখ তুলে বলেন, 'এসো জুলফা। দেখো, যেটি ভালো লাগে সেটিই নাও।'

জুলফা একটু দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে এগিয়ে আসে। ঘরভর্তি মানুষজন, অপরিচিত চোখের পলক। সে কিছুটা অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে একটা ঝকঝকে লাল জামদানির দিকে হাত বাড়ায়। দৃষ্টি গিয়ে পড়ে নাভেদের উপর। নাভেদ মৃদু মাথা নেড়ে ইশারা করে, এটা নয়। জুলফা সঙ্গে সঙ্গে হাত গুটিয়ে নেয়। এরপর আরেকটা নীলাভ রঙের শাড়ির দিকে হাত বাড়ায়, এবারও নাভেদ চোখের কোণে মানা করে। তৃতীয়বার একটা অপূর্ব খয়েরি-সোনালি মেশানো আভার জামদানিতে স্পর্শ করে। নাভেদ এবার মৃদু সম্মতি জানায়। জুলফা ঠোঁটে একটুখানি হাসি ফুটিয়ে বলে, 'এইটাই নেব। রঙটা চমৎকার।'

শব্দর একটা সূক্ষ্ম জরির কাজ করা কমলা রঙের শাড়ি তুলে ধরে উৎসাহের সঙ্গে বলে, 'এটাও নাও। তোমাকে ভীষণ মানবে।'

জুলফা তৎক্ষণাৎ বলে, 'না, না। দুটো লাগবে না। আমার একটাই যথেষ্ট। আমি যেটা পছন্দ করেছি সেটিই নেব।'

মুহূর্তের মধ্যে বৈঠকখানায় বিস্ময়কর নিস্তব্ধতা নেমে আসে। স্বামী পছন্দ করে দিচ্ছে অথচ সেটি নিবে না! এ কেমন স্ত্রী! শব্দর সকলের সামনে কিছুটা অস্বস্তি অনুভব করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে সে নিজেই কণ্ঠস্বর কোমল করে বলে, 'ঠিক বলেছ। তুমি যেটি পছন্দ করেছ সেটিই সর্বাধিক সুন্দর। সেটিই নাও।'

একে একে সকলে মনোমতো শাড়ি নির্বাচন করে। রাইহা শব্দরের পছন্দের শাড়িটি নিজের জন্য পছন্দ করে। শব্দর স্নেহমিশ্রিত হাসি দেয় তার দিকে তাকিয়ে। শেষে সুফিয়ান মেরুদণ্ড সোজা করে সামান্য হেলান দিয়ে বসে বলেন, 'নাভেদ, এবার তুমি তোমার স্ত্রীর জন্য একটি পছন্দ করো। কত করে বলেছি বউমাকে নিয়ে আসতে, আনলে না কেন?'

জুলফা বিদ্যুৎ-কাটা খেয়ে তাকায় নাভেদের দিকে। তার চোখে বিস্ময়। যেন আকাশ ভেঙে পড়েছে মাথার উপর। চোখাচোখি হয় দুজনের। সেই দৃষ্টিসংঘর্ষে যেন সময়ও থমকে যায়। নাভেদ ক্ষণিকের জন্য টলমল করে পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নেয়। সকলে তাকিয়ে আছে তার দিকে। কণ্ঠে ভারসাম্য ফিরে আসতে একটু সময় লাগে, তারপর গলা মোলায়েম করে বলে, 'ওর সামনে পরীক্ষা, চাচাজান। কী করে বলি, আনন্দ-উৎসবে এসো? সময়টা একদম মানানসই নয়।'

ঘরের ভেতরে গুঞ্জন শুরু হয়ে যায়। রাইহা, ললিতাসহ সকল দাস-দাসীরা চোখ গোল গোল করে তাকিয়ে আছে। কেউই জানত না নাভেদের স্ত্রী আছে। বৈঠকখানা রীতিমতো কানাকানির আড্ডাখানায় রূপ নেয়। 
-'নাভেদ বাবু বিবাহিত?'
-'কবে থেকে? কার সাথে?'
-'এতদিন কেন গোপন রেখেছেন? কাউকে বলেননি কেন? নিশ্চয় ঘাপলা আছে।'

এইসব হল্লার ভিড় কানে পৌঁছায় না জুলফার। তার বুকের ভেতর কী যেন চুরমার হয়ে যাচ্ছে। চোখ দুটি ডুবে যাচ্ছে অভিমানের গভীর কালো জলে। মুখজুড়ে বিশ্বাসভঙ্গের তিক্ত ছাপ। মনের ভেতর কেউ যেন চিৎকার করে বলছে, 'তুই বোকা! তুই প্রতারিত!'

বৈঠকখানা ভাঙতেই জুলফার ভেতরটা ছাইচাপা আগুনের মতো দপদপ করে জ্বলে ওঠে। হৃদয়ের গভীরতম প্রকোষ্ঠে নিভু নিভু আগুনের শিখা হঠাৎ করে প্রবল দাবানলে রূপ নেয়। বিস্ময় আর উৎকণ্ঠায় বুকের মধ্যে বিষের থেকেও তীব্র যন্ত্রণাদায়ক স্পন্দন অনুভূত হয় - যেন কোনো অদৃশ্য খঞ্জর দিয়ে বারবার আঘাত করা হচ্ছে। নাভেদ দুই দিনের জন্য পুরো ব্যবসায়িক দায়িত্বের সম্পূর্ণ বোঝা নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে। তাকে এখন আড়তে বসে থাকতে হবে... শোলা কাঠের মতো শুষ্ক, নিরস হিসাবের খাতাগুলোতে মুখ গুঁজে কাজ করতে হবে। তাই বৈঠক শেষ হওয়ার সাথে সাথেই সে ঝড়ের বেগে আড়তের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেছে। জুলফা মরিয়া হয়ে সুরঙ্গপথের মাধ্যমে বের হয়ে নাভেদের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করে। কিন্তু দাসীদের সদা-চঞ্চল পায়ের শব্দ, রান্নাঘর থেকে ভেসে আসা বাসনের কংকন আর অতিথিদের গোলমাল কোলাহলে পুরো পরিবেশ মুখোরিত হয়ে আছে। এই পরিস্থিতিতে সুরঙ্গপথ ব্যবহার করা তো দূরের কথা, এমনকি বারান্দার প্রান্তে অকারণে গিয়ে দাঁড়ানোও সম্ভব হচ্ছে না। চরম অসহায়ত্বে জুলফার চোখে জল এসে যায়। সেই জল ধীরে ধীরে তার কোমল গাল বেয়ে নিচের দিকে গড়িয়ে পড়ে। যতবার চোখ ভিজে যায় ততবার আঁচল তুলে সেই জল মুছে ফেলে, যাতে কেউ টের না পায়। দূর থেকে ললিতা জুলফার চোখ-মুখের অস্বাভাবিক লালচে আভা এবং বারবার গভীর নিশ্বাস নেওয়ার দৃশ্য লক্ষ্য করেন। চোখাচোখি হতেই জুলফা তার ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে অঝোর কান্নায় ভেঙে পড়ে। বেশ কিছুক্ষণ অতিবাহিত হওয়ার পর হঠাৎ মনে উজ্জ্বল আলোর ঝলকানির মতো ভেসে ওঠে একটা সমাধান। সে তৎক্ষণাৎ শঙ্খিনীর মাধ্যমে শব্দরকে ডেকে পাঠায়। শব্দর ঘরে পৌঁছাতেই জুলফা অত্যন্ত নম্র ও সংযত ভঙ্গিতে বলে, 'আমি চিন্তা-ভাবনা করেছি। আপনার কথা মেনে চলা আমার কর্তব্য। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি গুলনূরের সঙ্গে বাংলো বাড়িতে যাব।'

গতকাল থেকে দুশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে থাকা শব্দরের চোখ দুটি বিস্ময়ে প্রশস্ত হয়ে যায়। প্রায় এক মিনিট পর্যন্ত সে অবাক দৃষ্টিতে জুলফার দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর আবেগের প্রবল স্রোতে ভেসে গিয়ে সে জুলফার ঠোঁটে গভীর, আবেগপূর্ণ... আরক্ত চুমু অঙ্কিত করে দেয়। মুখে আনন্দের উজ্জ্বলতা নিয়ে সুফিয়ানের কাছে গিয়ে বলে, 'গুলনূর আমাদের বাড়ির পুত্রবধূ হতে যাচ্ছে, তার মর্যাদা ও সম্মানের যথোচিত খেয়াল রাখার জন্য বাড়ির একজন কর্তীর সঙ্গে থাকা উচিত ভাইজান। অন্যথায় সমাজের মানুষ বলবে যে, সম্ভবত আমরা অন্তর থেকে এই বিয়েতে সন্তুষ্ট নই, তাই ভবিষ্যৎ বধূকে একা ছেড়ে দিয়েছি।'

সুফিয়ান ধীরস্থিরভাবে গভীর চিন্তা-ভাবনার সাথে সম্মতিসূচক মাথা নেড়ে বলেন, 'ভুল বলোনি! ললিতা পাত্রের মা, সে যেতে পারবে না। তুমি বরং জুলফাকে বলো সে যেন এখনই প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেয়।'

পরদিন বিকেল গড়িয়ে যেতেই আকাশে সূর্যের শেষ রশ্মিগুলো প্রিয়তমার ঠোঁটের মতো কোমল চুমুর আদলে বিদায়ী সম্ভাষণ জানায়। গুলনূরের জমকালো, সুশোভিত ঘোড়ার গাড়িটি রাস্তায় এগিয়ে চলে। ঠিক তার পিছু পিছু, ছায়ার মতো আঁকড়ে থাকা আরেকটি গাড়ি - হলুদ ফুলের মালায় সাজানো, যার কাঠের পাটাতনে বসে থাকা জুলফা তার অস্থির, অদূরদর্শী দৃষ্টি দিয়ে পথের দিকে তাকিয়ে আছে। বাংলো বাড়ির প্রশস্ত প্রাঙ্গণে গাড়ি এসে থামতেই সে নিঃশব্দে, ভূতের মতো নেমে পড়ে। একবার চোখ বুলিয়ে নেয় চারপাশের পরিবেশ। প্রতিটি কোণ, প্রতিটি গাছের ছায়া, প্রতিটি জানালার অবস্থান সবকিছু মনে গেঁথে নেয়। রাত নামার সাথে সাথেই পেছনের দরজা দিয়ে চুপিসারে বেরিয়ে যায়। বোরকার ঘন কালো কাপড়ে নিজেকে সম্পূর্ণ জড়িয়ে নিয়ে, নিকাব টেনে মুখ আড়াল করে সোজা চলে যায় আড়তের দিকে।

রাত তখন বেশ গভীর হয়ে গেছে। আড়তের চারপাশ নিস্তব্ধতায় ডুবে গেলেও প্রধান দরজার কাছটায় কেরোসিন বাতির ফিকে, মিটমিটে আলোয় অস্পষ্ট ছায়া নড়াচড়া করছে। এমন সময় একজন লুঙ্গি পরিহিত কর্মচারী হঠাৎ করে একটি মহিলার অবয়ব দেখে হতবাক হয়ে থমকে দাঁড়ায়। তার চোখ সন্দেহে কুঁচকে যায়, জিজ্ঞেস করে, 'কে আপনি? এখানে কী চান?'
জুলফার চোখ তখন উন্মাদের মতো হন্তদন্ত হয়ে চারপাশ খুঁজে বেড়াচ্ছে নাভেদকে। তার দৃষ্টি অস্থির, উৎকণ্ঠিত।
কর্মচারীটি একটু এগিয়ে এসে কণ্ঠস্বর চড়িয়ে আরো কঠোরভাবে জিজ্ঞেস করে, 'কাকে খুঁজছেন বলুন তো?'

জুলফা কাঁপা কাঁপা, নিচু স্বরে উত্তর দেয়, 'নাভেদ সাহেব... তিনি আছেন?'

পাশের ছোট্ট ঘরটায় নাভেদ তখন হিসাবের বিভিন্ন খাতা উল্টে-পাল্টে দেখছে। হঠাৎ দরজার ওপাশে পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনে তার সমস্ত শরীর সতর্ক হয়ে ওঠে। সে গা টান করে উঠে দাঁড়ায়। পর্দার ফাঁক দিয়ে চোখ রাখতেই তার দৃষ্টি পড়ে চিরচেনা অবয়বের উপর। তৎক্ষণাৎ সে সেলিমকে পাঠিয়ে দেয়। সেলিম এগিয়ে এসে কর্মচারীকে বলে, 'আপনি যান, আমি দেখছি বিষয়টা।'

কর্মচারী কৌতূহলী ও সন্দেহপূর্ণ দৃষ্টিতে দুজনকে একবার দেখে, পেছনে তাকিয়ে ধীর পায়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও সরে যায়। সেলিম কণ্ঠ খাঁদে নামিয়ে ফিসফিস করে বলে, 'ভাইজান বলেছেন, আমার সাথে যেতে। উনি কিছুক্ষণ পরেই আসবেন। এই জায়গা আপনার জন্য মোটেও নিরাপদ না।'

কোনো প্রশ্ন না করে, কোনো দ্বিধা-সংকোচ না দেখিয়ে জুলফা নিঃশব্দে সেলিমের পিছু পিছু হাঁটতে থাকে। দুজনে পাশাপাশি, সম্পূর্ণ কথাবার্তাহীন দীর্ঘ পথ পাড়ি দেয়। কাঁচা, উঁচু-নিচু রাস্তা পেরিয়ে, গাছপালার ঘন পাতার ফাঁকে আলো-ছায়ার খেলা মাড়িয়ে প্রায় ত্রিশ মিনিট অবিরাম হাঁটার পর তারা এসে দাঁড়ায় একটি নিভৃত ঝুপড়ি কুটিরের সামনে। কুটিরের দুপাশে দুটি সুউচ্চ তালগাছ পাহারাদারের মতো মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। ডান পাশে বিস্তৃত মৌসুমি সবজির ক্ষেত রয়েছে, যেখানে সেচের জন্য কাটা নালায় পানি টুপটাপ শব্দে বয়ে চলেছে অবিরাম। আকাশে অসংখ্য তারা টিমটিম করে জ্বলছে, বাতাসে জোনাকিরা উড়ে বেড়াচ্ছে আলোর নৃত্য নিয়ে। শুধু জুলফার হৃদয়ে কোনো আলো নেই। সমস্ত পৃথিবী তার কাছে শূন্য, নিরর্থক লাগছে। এক ভয়ানক শূন্যতায় সে নিঃশব্দে পুড়ে যাচ্ছে। জুলফা নিরাসক্ত গলায় বলে, 'উনি কখন আসবেন?'

সেলিম মাথা নিচু করে মাটির দিকে তাকিয়ে বিনীতভাবে বলে, ' আপনি ভেতরে গিয়ে বসুন, বেগম সাহেবা। ভাইজান এক্ষুনি এসে যাবেন।'

জুলফা ঠোঁট কামড়ে নিঃশ্বাস টেনে কুটিরের ভেতর ঢুকে ভারাক্রান্ত পায়ে। দেওয়ালের বাঁশের আলমারিতে বোরকা আর নিকাবের কৃষ্ণবস্ত্র ঝুলিয়ে রাখে। চারপাশে বেতের আসবাবপত্র। চেয়ারে ধুলোর মখমলি আস্তরণ, ছোট্ট খাটিয়ায় পাতলা তোশকের কোমল বিছানা। দীর্ঘ মুহূর্ত কেটে যায় মনের অতলান্ত গহ্বরে ডুবে থেকে। হঠাৎ দূরাগত দিগন্ত থেকে ভেসে আসে ঘোড়ার হ্রেষাধ্বনি। জুলফার হৃদয়পিঞ্জর থরথর করে কেঁপে ওঠে। ক্ষিপ্র গতিতে ছুটে গিয়ে দরজার সামনে স্থিরচিত্রের মতো দাঁড়িয়ে পড়ে।
আকাশজুড়ে তখন জোনাকির মিছিল আর দূর দিগন্তে নক্ষত্রদের ঝিকমিক মেলা। এমন রাতের বুকে দুর্বার বাতাসের গর্জনের সাথে এসে পৌঁছায় ঘোড়ার খুরের টুংটাং শব্দ। ঘোড়ার পিঠে বসে আছে নাভেদ। দৃশ্যটি চোখে পড়তেই জুলফার অন্তর টালমাটাল হয়ে যায়। চোখের কোণে জমে ওঠে অশ্রুকণা, বুকের ভেতর শুরু হয় বজ্রপাতের গর্জন। সে ছুটে যায়; নাভেদ ঘোড়ার পিঠ থেকে লাফিয়ে মাটিতে নামে। দুই হাতে তুলে জুলফার গালের অশ্রুধারা মুছে দিয়ে বলে, 'কী হয়েছে আপনার? এমন ব্যাকুলতার কারণ কী?'
দাঁতে কান্না চেপে নাভেদের বুকের পোশাক মুষ্টিবদ্ধ করে আঁকড়ে ধরে, প্রচণ্ড ক্রোধে জুলফা বলে, 'আপনি সত্যিই জানেন না? জানেন না এই হাহাকারের মূল কারণ?'

নাভেদ জুলফার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, 'শান্ত হোন...শান্ত হোন।'

'শান্ত? আমি শান্ত হব?' জুলফা দাবানলের মতো জ্বলে ওঠে, আপনি বিবাহিত, এই সত্য কেন গোপন রাখলেন আমার কাছে? কেন প্রকাশ করলেন না এই সত্য?'

'বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলেই কি প্রেমের সত্যতা অসত্যে রূপান্তরিত হয়?' প্রশ্ন করে নাভেদ। দুই হাত তুলে জুলফার অশ্রুমাখা মুখ স্পর্শ করতে উদ্যত হয়। কিন্তু জুলফা বিদ্যুৎগতিতে দূরে সরে দাঁড়ায়, 'হ্যাঁ, হয়! আপনি আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। আপনার ঘরে স্ত্রী আছে, তাহলে আমার অবস্থান কোথায় এই সম্পর্কে? আমি কী আপনার কাছে?' জুলফা শিশুর মতো ফোঁপাতে থাকে।

নাভেদ শান্ত কণ্ঠস্বরে উত্তর দেয়, 'আপনিও তো পরের ঘরের স্ত্রী। তবুও আপনাকে ভালোবেসেছি।'

বাক্যের তীব্র আঘাতে জুলফা ক্ষণিকের জন্য স্থবির হয়ে পড়ে। সত্যিই তো! সেও তো বিবাহিতা নারী। কিন্তু সে কিছুই গোপন রাখেনি। অথচ নাভেদ সত্য লুকিয়ে রেখেছে। আবার এভাবে তীক্ষ্ণ প্রশ্নের সম্মুখীনও করছে! অভিমানের দাবানলে তার হৃদয় দগ্ধ হয়ে ওঠে। সে কুটিরের ভেতরে দৌড়ে চলে যায়। বোরকা-নিকাব পরতে উদ্যত হতেই পেছন থেকে নাভেদ এসে তাকে জড়িয়ে ধরে।
'ছাড়ুন...'জুলফার গলায় ফুঁসতে থাকা নোনা ব্যথার আর্তনাদ, 'দূরে থাকুন।'

নাভেদের বাহু ইস্পাতের শিকলের মতো শক্ত হয়ে জড়িয়ে ধরে। বৃষ্টিফোঁটার মতো নীরব চুম্বনের স্রোত নিয়ে আসে জুলফার কাঁধে। জুলফা ছটফট করে নাভেদের বাহুবন্ধন থেকে মুক্তির খোঁজে, অথচ অন্তরে অন্তরে দপদপ করে ওঠে অবদমিত আকুলতার ঢেউ। কানের কাছে ফিসফিসিয়ে নাভেদ বলে, 'আপনি ছাড়া আমার এই ভূমণ্ডলে আর কেউই নেই। আপনি আমার সিংহাসনের একমাত্র সম্রাজ্ঞী। আপনি আমার, আর আমি কেবলমাত্র আপনার।'

হারিকেনের কম্পিত শিখায় জুলফার চোখে অশ্রুরাশির আলো চিকচিক করে। সে অর্ধ-সংশয়ে ফিসফিসিয়ে বলে, 'মিথ্যা... তাহলে বৈঠকখানায় যে কথা...'

কথা সমাপ্ত হওয়ার পূর্বেই নাভেদ বাধা দিয়ে বলে, 'সেদিন ঝড়ের সন্ধ্যায় স্কুলের বারান্দায় আমাদের একসাথে দেখার পর চাচাজান জিজ্ঞাসা করেছিলেন, মেয়েটি কে! আমি আপনাকেই আমার গৃহিণী বলে পরিচয় দিয়েছি, কেবল ভিন্ন নাম আর ভিন্ন পরিচয়ে।' 

'বিশ্বাস করি না।'

'কসম এই পৃথিবীর, কসম আপনার...এক বিন্দুও মিথ্যে বলছি না।'

শব্দগুলো জুলফার হৃদয়গহ্বরে অমৃতের মতো প্রবেশ করে; শেষ সন্দেহের কুঞ্চিত ভাঁজ মুছে যায়। সে নীরবে ফুঁপিয়ে ওঠে, আঁচলে মুখ ঢেকে আর্তকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করে, 'সত্যি বলছেন আপনি...?'

নাভেদ তাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলে, 'দেখুন, এই চোখজোড়ায় কি মিথ্যার কুয়াশা আছে? কী দেখতে পাচ্ছেন? নির্মল আকাশের মতো স্বচ্ছ নয় কি?'

এতটুকু আশ্বাসেই জুলফার বুকের ভেতর জমে-থাকা হাহাকার বাঁধ ভেঙে সমুদ্রের জোয়ারের মতো উপচে পড়ে। নাভেদ নত হয়ে তার গালের অশ্রুধারা ঠোঁটের উষ্ণতায় শুষে নেয়। মুহূর্তেই জুলফার দেহে বিদ্যুতের ঝলক দৌড়ায়। বিচ্ছেদের দহন মানুষের হৃদয়কে দুর্বল করে, ভালোবাসার ক্ষুধা বাড়িয়ে তোলে। সে খিদে সংযমকে ঝাপসা করে দেয়, বাস্তবতার সব সীমারেখা ফিকে হয়ে যায়। জুলফাও সেই আকর্ষণের নাইলনের সুতোর টানে ধরা পড়ে। নাভেদ সেই রাতে জুলফার হৃদয়ের উপর যে কৌশলের জাল বিস্তার করেছিল তার চূড়ান্ত পরিণতি দেয়। শরীরের সবটুকু তাপ, সবটুকু উচ্ছ্বাস ঢেলে দিয়ে তারা নিষিদ্ধ উপাখ্যানকে পূর্ণতায় অভিষিক্ত করে৷ 

বিয়ের দিন। সূর্য এখনও ঘুমের কোলে, অথচ জমিদারবাড়ির প্রতিটি মানুষ জেগে উঠেছে অনেক আগেই। রাত থেকেই অনেকে ঘুমহীন। আকাশ আলোর আভায় রাঙিয়ে ওঠার আগেই উঠানে পড়েছে পায়ের শব্দ, হাঁকডাক। কেউ মালাই সন্দেশে রুপালি কাজু বসাচ্ছে নিপুণ হাতে, কেউ ঘিয়ের সুবাসে ভেজাচ্ছে চাল, পোলাওয়ের হাঁড়ি বসানো হচ্ছে একের পর এক লম্বা বাঁশের চুল্লিতে। রান্নাঘরের আগুন আজকের জন্য অম্লান শিখা...নেভবার সম্ভাবনা নেই। সকালের আলো ছড়ানোর সাথে সাথে প্রবেশ করতে থাকেন একে একে অভিজাত আমন্ত্রিতরা। প্রত্যেকের কণ্ঠে একই সুর, একই বিস্ময়, 'ভূঁইয়া পরিবার দাসীকে ঘরের বউ বানাচ্ছে! কী বিশাল হৃদয়! কী মহত্ত্ব!'

আলোকরশ্মির মতো ছড়িয়ে যাচ্ছে গুলনূরের ভাগ্য পরিবর্তনের কাহিনী, আর ভূঁইয়া পরিবারের প্রশংসাবাণী। এই প্রশংসায় আনন্দে আত্মহারা হয়ে আছেন সুফিয়ান। হৃদয়ে সঞ্চিত ক্রোধ, মনোকষ্ট, দ্বিধা-দ্বন্দ্ব সবকিছু মুছে গেছে। যে বিয়েকে তিনি অপমানের কারণ মনে করেছিলেন, সেটাই পরিণত হয়েছে গৌরব ও আনন্দের উৎসে। দীর্ঘকাল পর তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে এসে জাওয়াদকে 'তুই' সম্বোধনে বলেন, 'তাড়াতাড়ি তৈরি হ, দুপুরের মধ্যে বউমাকে এখানে চাই।'

মানুষটার আনন্দ দেখে জাওয়াদের বুকে আনন্দের স্রোত বইতে শুরু করে। ঘরে বসে থাকা বাল্যবন্ধু শুভঙ্কর হাসতে হাসতে বলে, 'তাহলে পড়েই গেছিস প্রেমে! কাঠালের আঠার মতো আটকে গেছিস!'

জাওয়াদ মুচকি হেসে গায়ে শেরওয়ানি জড়াতে জড়াতে বলে, 'প্রেম বললে সঠিক ব্যাখ্যা হয় না।'

'তাহলে কী? পাগল হয়ে বিয়ে করছিস, অথচ প্রেম নয়?'

'জানি না শুভো, শুধু এটুকু জানি...গুলনূর আশেপাশে থাকলে বাতাসটা হালকা লাগে। বুকটা শান্ত হয়।'

'মানে অক্সিজেন?'

হো হো করে হাসে জাওয়াদ। তার চোখের তারায় ভাসছে গুলনূরের নিষ্পাপ মুখ। আর মাত্র কিছু মুহূর্তের মধ্যেই সাক্ষাৎ হবে গুলনূরের সাথে। নববধূর পোশাকে কেমন লাগবে তাকে? লাল বেনারসি শাড়িতে, অলংকারে সুসজ্জিত অবস্থায় কতটুকু মনোহর দেখাবে? নিজের দৃষ্টি কি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে ওই রূপের মোহনায়? এইসব চিন্তাভাবনার মাঝেই বুকের অন্তরালে একটা গোপন উত্তেজনা বয়ে যাচ্ছে। আজ রাত থেকে তারা একই ছাদতলে বসবাস করবে। পাশে থাকবে গুলনূর। তার নিশ্বাসের পাশে আরেকটি নিশ্বাস। একটি কোমল দেহ তার পাশে ঘুমাবে রাতের পর রাত। কল্পনা করতেই জাওয়াদের সমগ্র শরীরে একটা নেশার অনুরূপ উত্তপ্ত অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ছে। মনে হচ্ছে জীবনের সরচেয়ে সুন্দর অধ্যায় আরম্ভ হতে চলেছে। সে জানালার কাছে দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে তাকায়। চোখের সামনে ভেসে উঠে বিয়ের জমকালো আয়োজনের ছবি। সুফিয়ান সাহেব নিজের পুরো সামর্থ্য নিংড়ে দিয়ে এই বিশাল উৎসবের ব্যবস্থা করেছেন। ঘোড়ার গলায় ঝুলানো ঘণ্টার আওয়াজ শুনে ছোট ছোট বাচ্চারা হইচই করতে করতে দৌড়ে আসছে। মেয়েরা লজ্জাবতী লতার মতো পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে উঁকিঝুঁকি মারছে। যুবকেরা এদিক-সেদিক ঘুরপাক খেয়ে বেড়াচ্ছে, উদ্দেশ্য একটাই একবার হলেও দেখে নেওয়া কারুকার্যখচিত বিয়ের আসর। দূর-দূরান্ত থেকে এসেছেন সন্ন্যাসী, ফকির আর দরবেশরা। যাদের সচরাচর দেখা মেলে না। কেউ হাতে পিরিচ ভরে খিচুড়ি খাচ্ছেন, কেউ মিষ্টির প্লেট হাতে নিয়ে হাসিমুখে আড্ডা দিচ্ছেন। দুপুর গড়িয়ে যেতেই উৎসব পুরোদমে জমে ওঠে। বাউল-ফকিররা এখন গলা ছেড়ে গাইছে প্রেম আর মিলনের গান। সুরের ঢেউয়ে ভেসে যাচ্ছে সবার মন। আসরে যেই অতিথি বসছেন, অমনি তার সামনে হাজির হচ্ছে নানা পদের মুখরোচক খাবার। সুর আর আতিথেয়তার প্রবাহ যেন থামার নামই নেই। বিকালে শুরু হবে আসল অনুষ্ঠান। গুলনূর পা রাখবে এই জমিদারবাড়ির মাটিতে। বিয়ে পড়ানো হবে। সব অতিথি দোয়া-আশীর্বাদ করে বিদায় নেবেন। সকলেই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে সেই পবিত্র মুহূর্তের জন্য। 

সূর্য যখন ঠিক মাথার চূড়ায়, তখন জাওয়াদ সবার দোয়া-আশীর্বাদ নিয়ে ঘোড়ার গাড়িতে উঠতে যাবে গুলনূরকে পালকিতে করে আনার জন্য, ঠিক সেই মুহূর্তেই হঠাৎ একটা আওয়াজে সবার নজর চলে যায় মূল ফটকের দিকে। ঘণ্টার মিষ্টি ঝনঝন শব্দে দুলতে দুলতে একটি পালকি ধীর গতিতে এগিয়ে আসছে। সূর্যের তির্যক আলোয় মখমল আর জরিকাটা কাপড়ে মোড়ানো পালকিটি দেখতে একেবারে রাজকীয়। চারজন বেহারা ঘাম মুছতে মুছতে এসে সেটি মাটিতে নামিয়ে রেখেই মুখ নিচু করে দ্রুত ফটকের বাইরে মিলিয়ে যায়। এই পালকিতে চড়ে তো গুলনূরের আসার কথা! কেউ কিছু জিজ্ঞেস করার ফুরসতও পায় না, বেহারারা উধাও। সবার চোখ বিস্ময়ে বিস্ফারিত। গণ্যমান্য ব্যবসায়ী, এলাকার মাতব্বর, দরবেশ-ফকির, গ্রামের সাধারণ মানুষ সবাই উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠে দাঁড়ায়। মুহূর্তেই চারদিকে পিনপতন নিস্তব্ধতা নেমে আসে। জাওয়াদ স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ঘোড়ার গাড়িতে ওঠার কথা ভুলে গিয়ে কপালে চিন্তার রেখা নিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে যায় পালকির দিকে। হাত বাড়িয়ে পর্দাটা সরায়। সঙ্গে সঙ্গে কেউ একজন চিৎকার করে বলে ওঠে, 'এ কী! একটা কুকুর!'

পালকির ভেতরে বসে আছে সাজানো-গোজানো একটা ছোট্ট কুকুর! মাথায় টিপ, গায়ে পরানো ছোট্ট লাল রঙের শাড়ি, মেহেদি রঙে আঁকা পায়ে নকশা। বউয়ের সাজে সেজে বসে আছে নিখাদ নিরীহ চোখে তাকিয়ে।

সবাই যেন পাষাণমূর্তি হয়ে যায়। হাঁ করে তাকিয়ে থাকে সকলে। জাওয়াদের বুকের ভেতর কিছু একটা থাবা মারে। পা দুটো সিসার মতো ভারী হয়ে আসে। কানে ভেসে আসে কারও গলার আওয়াজ, 'হায় খোদা, জমিদারের ছেলে কুকুর বিয়ে করবে নাকি?'

সুফিয়ান ভূঁইয়া মানুষের ভিড় ঠেলে হুড়মুড় করে পালকির সামনে এসে দাঁড়ান। খবর পৌঁছে যায় খাসমহলেও। ঝড়ের গর্জনের মতো লাঠি ঠুকতে ঠুকতে ছুটে আসেন কোহিনূর। প্রধান দরজার সামনেই এসেই থমকে দাঁড়ান। কুকুরের সামনে পড়ে আছে একটা ছোট চিরকুট। জাওয়াদ কাঁপা হাতে সেটি কুড়িয়ে নেয়। সেখানে লেখা:

নারীর নয়, কুকুরের আজ অধিকার, যেমন তোমাদের বিবেক, তেমনই উপহার।
যারা মানুষকে ভাবে জন্তু-জানোয়ার,
তাদের জন্য পশুই মানানসই সংসার||

চোখের সামনে সবকিছু ঝাপসা হয়ে আসে তার। হাতের লেখাটা সে চিনে...গুলনূরের ছবির মতো সুন্দর হাতের লেখা! কিন্তু এমন নিষ্ঠুর শব্দ তো গুলনূর লিখতে পারে না৷ মনে হচ্ছে যেন মাথার উপর ঘূর্ণিঝড় আছড়ে পড়ছে। বাতাসে সব উড়ে যাচ্ছে, ধুলো উড়ছে... সেই ধুলোয় অন্ধ হয়ে যাচ্ছে সে। বুকের নরম মাটিতে কার এত কুঠারাঘাত! পেছনে দাঁড়ানো সুফিয়ানের মুখ রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। রাগে, লজ্জায়, অপমানে তিনি কাঁপছেন। জাওয়াদ ছলছলে চোখে চারপাশে তাকায়, ব্যর্থ ভাবে হাসতে চেষ্টা করে, এটা নিশ্চয়ই কারও বেখাপ্পা রসিকতা! কেউ নিশ্চয়ই গুলনূরকে দিয়ে এসব লিখিয়েছে! এমন সময় পথচারী কয়েকজনের মুখ থেকে আরেকটি খবর ছড়িয়ে পড়ে, বধূসাজে একটি মেয়েকে তারা দেখেছে এক সুদর্শন যুবকের সাথে রেলস্টেশনের দিকে যেতে! মুহূর্তেই চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে আরও ভয়ংকর সব কথা,
-'বউ প্রেমিকের সাথে পালিয়ে গেছে।'
-'বউয়ের বদলে রেখে গেছে একটা কুকুর!'
-'কুকুরই নাকি এই বাড়ির যোগ্য বউ!' 

কিছুক্ষণ আগের প্রশংসার বন্যা এক মুহূর্তে শুকিয়ে মাটির সঙ্গে মিশে যায়। বদলে আসে তিরস্কার, ঠাট্টা-বিদ্রুপের ঢল। যারা একটু আগেও 'কী মহান হৃদয়!' বলে বাহবা দিচ্ছিল, তারাই এখন ফিসফিস করে বলতে থাকে,
-'দেখেছ, অহংকারের ফল!'
-'নিশ্চয়ই তলে তলে কিছু করেছে, তারই প্রতিশোধ নিয়েছে।'
-'এই হলো দাসীকে বউ বানানোর পরিণাম! কত দুঃসাহস! জমিদার পুত্র রেখে প্রেমিকের সঙ্গে ভেগে গেল!'

অতিথিরা একে একে মুখ ঘুরিয়ে নিতে শুরু করে। কেউ কেউ তো দ্রুত পায়ে বেরিয়ে যেতে থাকে, তারা এই লজ্জার ভাগী হতে চায় না। জমিদারবাড়ির মর্যাদা মাটিতে মিশে যায় এক আসরেই। যে পরিবারকে গ্রামের মানুষ শ্রদ্ধা করত, সেই পরিবারই হয়ে যায় হাসির খোরাক...ফিসফিসানির কেন্দ্র। এই অসহনীয় অপমান সহ্য করতে না পেরে বিয়ের সেই মজলিসেই কোহিনূর আর সুফিয়ান- দুজনেই কাঠের পুতুলের মতো লুটিয়ে পড়েন মাটিতে।

অন্যদিকে, জাওয়াদ তার নীল গাড়ির স্টিয়ারিং চেপে ধরে বাংলোর দিকে ছুটতে থাকে। বুকের ভেতরে যেন একটা পাখি পাগলের মতো ডানা ঝাপটাচ্ছে। কী এক অশুভ আশঙ্কা তার মেরুদণ্ড বেয়ে সাপের মতো হামাগুড়ি দিয়ে উঠছে। গুলনূরের নিশ্চয়ই কিছু একটা হয়েছে। তার মগজে এই চিন্তাটা কীলকের মতো বিঁধে গেছে। নিজের হৃদয়ের কাছে মিনতি করে, 'বাংলোতে গিয়ে দেখব গুলনূর আমার জন্য অপেক্ষার করছে। আমি ও'কে নিয়ে আসব।'

গতকাল রাতে গুলনূরের গায়ে যে সুগন্ধি পেয়ে তার মনে সন্দেহের বীজ বপন হয়েছিল, সেটাই তাকে বাড়ি ফিরে গুপ্তচরের মতো গুলনূরের ঘরের ট্রাঙ্ক খুলতে বাধ্য করেছিল। সেখানে পাওয়া সুগন্ধির কাচের বোতল আর সাদা ব্লাউজ-পেটিকোট তার সব সন্দেহকে সত্যে রূপ দিয়েছিল। সে নিশ্চিত হয়েছিল, গুলনূরই সেই রহস্যময় আগন্তুক। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, তার অন্তরে কোনো ক্রোধের আগুন জ্বলেনি। সে সরলমনে ভেবেছে, হয়তো কোনো অভিমানে গুলনূর তার মাকে ভয় দেখিয়েছে। পরে কৈফিয়ত নিবে। গুলনূরের প্রতি তার যে অগাধ বিশ্বাস, সেটা তার মনে কোনো কালো সন্দেহের ছায়া পড়তে দেয়নি। সেসব মনে পড়ে তার হাত দুটো কাঁপতে থাকে পাতার মতো। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে, যেন বুকের উপর পাহাড় চেপে বসেছে। স্মৃতির অতল গহ্বর থেকে দুই বছর আগের সেই অভিশপ্ত দিনটা ভেসে ওঠে। যেদিন মায়ের নিষিদ্ধ প্রণয়ের আখ্যান আর নিজের জন্মরহস্য জেনে সে মানসিক চোরাবালিতে দুই বছর ধরে হাবুডুবু খাচ্ছিল। সেই মরণ চোরাবালি থেকে যে মেয়েটি বাঁচাল, তাকে নিয়ে কি সন্দেহের বিষবৃক্ষ রোপণ করা যায়? সেই মেয়েটিই কি আবার তাকে অন্ধকারের অতলে ঠেলে দিতে পারে? এই নিষ্ঠুর পৃথিবী তাকে এতটা নিঃসঙ্গ, এতটা পরিত্যক্ত করে রাখতে পারে না। প্রকৃতির সব উপাদান - আলো, বাতাস, জল - সবকিছু মিলে তার বিরুদ্ধে চক্রান্তের জাল বুনতে পারে না। তার এত সাহস নেই, তার হৃদয়ে এত দুর্দান্ত শক্তি নেই এই আঘাত সহ্য করার!

গ্রামের উঁচু-নিচু, গর্ত ভরা কাঁচা রাস্তায় জাওয়াদ উন্মাদের মতো গাড়ি চালাতে থাকে। এই পথগুলো যানবাহন চলাচলের উপযোগী নয়, কিন্তু তার সেদিকে মনোযোগ নেই। তার চোখ দুটো থেকে বেদনার নদী বয়ে যাচ্ছে। প্রতারণার আতঙ্কে চোখের জল শুকানোর নাম নিচ্ছে না। হাত দুটো এমনভাবে কাঁপছে যেন ম্যালেরিয়া জ্বরে পড়েছে। শরীরে শক্তি নিঃশেষ হয়ে আসছে। চোখের পাতা বার বার ঝিমিয়ে আসছে, মেঘাচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে দৃষ্টি। সে নিজেকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে, বাংলোবাড়িতে পৌঁছে সে অন্য কোনো সত্য আবিষ্কার করবে। গুলনূর বিশ্বাসভঙ্গের পাপে পা রাখতে পারে না। কিন্তু তার পূর্বেই গাড়িটা একটা গভীর গর্তে আটকে গিয়ে চিৎ হয়ে পড়ে যায় অসহনীয় অস্থিরতায়।
·
·
·
চলবে............................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp