স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা - পর্ব ২৬ - মুশফিকা রহমান মৈথি - ধারাবাহিক গল্প


জাওয়াদের চোখ মোটেই আদিবকে দেখছে না। দেখছে আদিবের সম্মুখে নীল শাড়ি পড়া রমনীর দিকে। চিংকি আদিবের সাথে কি করছে? জাওয়াদের মুখশ্রীতে আষাঢ়ের মেঘ জমলো। চোয়াল শক্ত হলো। আদিব জাওয়াদের বাল্যবন্ধু। বন্ধু শব্দটা আদিবের ক্ষেত্রে খাটে না। সে বন্ধুত্বের মর্ম বুঝে না। বন্ধুত্ব হতে হয় নিঃস্বার্থ। কিন্তু আদিবের বন্ধুত্বে স্বার্থন্বেষী চিন্তাধারা আর ঈর্ষা লক্ষ করেছে জাওয়াদ। সে সর্বদা মুখে মিষ্টতা আর হৃদয়ে বিষ নিয়ে ঘোরা মানুষ। হরহামেশা জাওয়াদের সফলতায়, জনপ্রিয়তা ছিলো তার চক্ষুশূল। শুধু চক্ষুশূল হলে হয়তো জাওয়াদ ব্যাপারটিকে উপেক্ষা করে যেত। কিন্তু সে রীতিমত সুযোগ খুজতো জাওয়াদকে হেনস্তা করতে। জাওয়াদের এখনও মনে আছে আদিব একটি মেয়েকে পছন্দ করতো। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত মেয়েটি তার প্রেমকে প্রত্যাখান করে। উপরন্তু সে জাওয়াদের উপর মোহিত ছিলো। আদিব বিশ্বাস করেই নিয়েছে মেয়েটি জাওয়াদের জন্য তাকে প্রত্যাখান করেছে। জাওয়াদ তার গভীর প্রণয় জানা সত্ত্বেও বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। বন্ধু হয়ে তার পিঠে ছোরা মেরেছে। যা সম্পূর্ণ কাল্পনিক। জাওয়াদ মেয়েটি সম্পর্কিত কিছুই জানতো না। কি অদ্ভূত! জাওয়াদের এখনো কলেজের ফেয়ারওয়েলের দিনটি মনে আছে। ক্লাসের সামনে এই আদিব তাকে বিশ্রীভাবে অপমান করেছিলো। সবার সামনে জাওয়াদকে বিশ্বাসঘাতক বন্ধুরুপে প্রতীয়মান করতে চেয়েছে। অথচ জাওয়াদ কখনো তার বন্ধুদের খারাপ চায় নি। আদিবের এহেন কাজ জাওয়াদকে আঘাত করেছিলো। শুধু তাই নয়, জাওয়াদের মতো গোছানো, পরিপাটি, স্থিরচিত্তের মানুষ মারামারি করেছিলো। কারণ সে ধৈর্য্যচ্যুত হয়েছিলো। আহত হয়েছিলো। আদিবকে সে ঘৃণা করে। সেই মানুষের সাথে চিংকি কি করছে—চিন্তা করতেই মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে গেলো। 

*****

দীপশিখা চুপ করে বসে রয়েছে। একপ্রকার বাধ্য হয়ে সে এখানে এসেছে। মা উঠে পড়ে লেগেছেন বিয়ের জন্য। এই পাত্রের খোঁজ বড়খালা দিয়েছেন। পরশু সকালে তিনি হুট করে ফোন করেছেন। কণ্ঠে অসীম ব্যস্ততার ভঙ্গি এবং জোরালো ভাব। নিরুপমা ফোন ধরতেই ধমকের স্বরে বললেন,
 “সকাল সকাল কি হিমালয়ে গিয়েছিলি? ফোন ধরতে এতো সময় লাগে কেন?”

নীরুপমাও খামখেয়ালি স্বরে বললো,
 “আপা কেউ সারাদিন কাজকর্ম ছেড়ে ফোনের পাশে বসে থাকে না”
 “ওরে আমার কামের বেটি। বকিস না বেশি। শোন, একটা সুসংবাদ আছে। সুসংবাদ দেওয়ার জন্য ছটফট করে মরছি অথচ তোদের কাছে আমার দাম নেই। মরে গেলে বুঝবি কি অমূল্য জিনিস হারিয়েছিস। বুঝলি! আজকাল কারোর সময় আছে অন্যের জন্য কিছু করার? আমি করছি। তোদের উচিত আমার প্রতি চিরকৃতজ্ঞ থাকা।”
 “তুমি বেশি কথা বলো আপা। আসল কথা বল”
 “কথা হল তোর ছোট মেয়ের জন্য একটা লাখে একটা ছেলে পেয়েছি। তোর ঐ নাবিক জামাইয়ের মত কোনো গরুকে তুলে আনি নি। এই ছেলে যে সে ছেলে নয় ডাক্তার ছেলে। তাও আবার এভারকেয়ারের ডাক্তার। বুঝতে পারছিস? দামী হাসপাতাল। শুনেছি ডাক্তাররা নাকি তাদের পরিবারের লোকদের ফ্রি চিকিৎসা দেয়। কি সুবিধা বুঝতে পারছিস? ধর হুট করে মোস্তফার বুকে ব্যথা শুরু হল, ডাক্তার জামাই চট করে একটা ব্যবস্থা করে ফেলবে। আইসিউ, সিসিউ তো ওদের হাতেই। নাবিক জামাইয়ের মত না, আসতে আসতেই শ্বশুর পটল তুলেছে আর জামাই সাগরে সাঁতরাচ্ছে”

চিংকির বড়খালার বেশি কথা বলার বাতিক। ছেলে তার যে খুব পছন্দ হয়েছে এটা সেটারই লক্ষণ। সে সর্বদা নিজেকে উচু পর্যায়ে রাখতে চান। এতে তিনি অসীম আনন্দবোধ করেন। এই আনন্দ পেতে অন্যকে নিচু করতে দ্বিধাবোধ করেন না। নীরুপমা ধিমি স্বরে বললো,
 “ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার বুঝি না, ছেলে কেমন?”
 “ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার বুঝিস না মানে? ছেলে ডাক্তার, মানুষ বাঁচায়। এতেই স্পষ্ট ছেলে ভালো। আর বদ অভ্যাসের কথা বলতে গেছে শূন্য। ছেলে অতিভদ্র। আমি কথা বলেছি। অমায়িক আচরণ। তোর খাটাস মেয়ে যা বলবে মাথা নাড়াবে। এমন ছেলেই তো চাই। নীরু দেরি করিস না। ছেলের মার্কেট এখন উত্তপ্ত। ডাক্তার ছেলে খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছে না বললে চলে। তাই লুফে নে”
 “আচ্ছা, আমি মোস্তফার সাথে কথা বলছি”
 “ঐ ছাগল কি বুঝে?”
 “কিছু না বুঝলেও মেয়ের বাবা সে”
 “আবার বলছি, ছেলের চাহিদা আকাশছোঁয়া। আমি অনেক কষ্টে ঠেকিয়ে রেখেছি। নয়তো মেয়ের মায়েরা কিন্তু লাফাচ্ছে ছেলেটাকে জামাই করতে”

নীরুপমা ফোন রেখে দিলেন। দীপশিখা তখন বাটিতে মুড়ি ঢালছিলো। সকাল এগারোটায় মানুষ নাস্তা খাবে। হয় পাউরুটি নয় রুটি নয় পরোটা। অনেকে ভাত খায়। কিন্তু দীপশিখা মুড়ি মাখছে। তাও মাংসের আচারের ঝোল দিয়ে। এই আচারটা মোস্তফা নিয়ে এসেছেন। অমৃত স্বাদ বলে সে আখ্যা দিয়েছে। তাই দীপশিখা সেই অমৃত দিয়ে মুড়ি মাখছে। অস্বাভাবিক কাজ। স্বাভাবিক মানুষ অস্বাভাবিক কাজ করে না। কিন্তু আজ দীপশিখা অস্বাভাবিক কাজ করছে। তার মনে অসীম আনন্দের লহর বইছে। এমন হওয়ার কথা নয়। তার জীবনে কোনো আনন্দের ঘটনা ঘটে নি। অথচ তার সকালের ঘুম থেকে উঠার পর থেকেই আনন্দ লাগছে। তার ধরনীতে কোনো দুঃখ নেই। দুঃখ অলীক কল্পনা তার অস্তিত্ব তার পৃথিবীতে নেই। দীপশিখা সেই সুখেই মুড়ি মাখিয়ে খাবে। খুব ঝাল দিলো যেন ঠোঁট পুড়ে যায়। মাঝে মাঝে ঝালে নাক মুখ আঁধার করে খেতে ইচ্ছে করে। মাথা থেকে ধোঁয়া ছুটবে এমন ঝাল। নীরুপমা তার এমন মুড়ি খেতে দেখে কঠিন গলায় বললেন,
 “তোমার জন্য চিয়া পুডিং ফ্রিজে আছে। সেটা ছেড়ে কি খাচ্ছো এগুলো?”

দীপশিখা চোখ তুলে মায়ের দিকে তাকালো। মৃদু হেসে বললো,
 “আমার মুড়ি খেতে ইচ্ছে করছে”

নীরুপমা কাঠ গলায় বললেন,
 “তোমার এসব অনিয়মের জন্য স্বাস্থ্যের এই হাল। আজকালকের মেয়ে তুমি। হবে ফিগার কন্সাস। অথচ কি অবস্থা?”
 
দীপশিখা উত্তর দিলো না। সে মন দিয়ে মুড়ি খাচ্ছিলো। নীরুপমা তখন বললেন,
 “তোমার বড়খালা একটি ভালো ছেলে খুঁজেছে। ছেলেটির সব ডিটেইলস উনি আমাকে পাঠাবেন বলেছে। তাই নিজেকে প্রস্তুত করে ফেলো”
 “আমি বিয়ে করবো না মা”
 “কি বললে?”
 “আমি বিয়ে করবো না। আমার এসব ভালো লাগছে না”
  “বুঝেছি। আমি ছেলেটির ছবি তোমাকে পাঠাচ্ছি। দেখা করে আসবে”
 “তুমি জোর কেন করছো মা?”
 “কারণ আমার মানসম্মান এখানে জড়িত। বাকিটা তোমার ইচ্ছে”

দীপশিখা মায়ের কথায় আহত হলো। মায়ের জেদ সে জানে। এখন যদি দীপশিখা অমত করে তবে তিনি অখুশি হবে। মুখে কিছু বলবেন না। কিন্তু তার অভিমান, রাগ ছলকাবে ঘরময়। বাবাও তখন কিছু করতে পারবেন না। ফলে মনের বিরুদ্ধে একপ্রকার বাধ্য হয়েই এই পাত্রের সাথে দেখা করা। 

দীপশিখার সম্মুখে কতিপয় ডাক্তার পাত্র বসে আছে। আদিব মাহতাব তার নাম। আদিব মাহতাবের প্রশংসায় বড়খালা পাঁচশত শব্দের রচনা লিখে পাঠিয়েছে দীপশিখাকে। দীপশিখা অবশ্য তা পড়ে নি। লোকটির মধ্যে একটা ব্যস্ত, ব্যস্তভাব আছে। পাত্রী দেখার আগ্রহ হয়তো নেই তার। দীপশিখা লাস্যময়ী রমনী নয় যে কেউ তাকে দেখে মুগ্ধ হবে। ফলে লোকটি আসার পর থেকে যে একটিবারও তাকে ভালো করে লক্ষ করে নি ব্যপারটি লক্ষ করেছে দীপশিখা। সে একবার ঘড়ি দেখছে, মেন্যু দেখছে। একবার কৃত্রিম হাসি লেপ্টে শুধালো,
  “কি খাবেন?”

দীপশিখা বললো,
 “যা আপনার ইচ্ছে অর্ডার করুন”
 “ওকে”

দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করলো না। দীপশিখা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। সময়টা কাটলে হয়। কিন্তু এর মধ্যেই তার সম্মুখে খাম্বার মতো দাঁড়ালো সুউচ্চ যুবক। তার কন্ঠে অসীম বিরক্তি এবং কৌতুহলের সংমিশ্রণ,
 “দীপশিখা, কেমন আছো? তোমাকে এখানে দেখবো কল্পনা করি নি”

দীপশিখা অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। জাওয়াদকে এখানে দেখবে সে আশা করে নি। থতমত কণ্ঠে বললো,
 “আপনি?”

এর মধ্যেই আদিব মাহতাব নামক পুরুষটি বলে উঠলো,
 “জাওয়াদ যে, হোয়াট এ্যা প্ল্যাজেন্ট সারপ্রাইজ! কেমন আছিস?”

জাওয়াদ একবার চোখ ছোট ছোট করে চাইলো আদিবের দিকে। তারপর তাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে দীপশিখাকে শুধালো,
 “তুমি কি একে চেনো?”
 
কণ্ঠে কেমন যেন খবরদারিভাব অনুভূত হলো দীপশিখার। ফলে সে সহজ গলায় বললো,
 “চেনার জন্যই আসা। আমার সাথে আপনার বোধহয় গুরুত্বপূর্ণ কোনো কথা নেই, তাই দয়া করে আমাদের ডিসটার্ব করবেন না”
 “মানে?”
 “মানে উনার সাথে বিয়ের কথা চলছে। আমরা কাইন্ডা ডেটে এসেছি টু নো ইচ আদার। সো আপনি ইন্টারাপ্ট করছেন”
 “তুমি একে বিয়ে করবে?”

জাওয়াদের কণ্ঠে স্পষ্ট রাগ প্রতীয়মান হলো। সে চেঁচিয়ে বললো কথাটা। ফলে রেস্টুরেন্টের সকলের দৃষ্টি তার উপর চলে এলো। দীপশিখার অস্বস্তি লাগছে। এর মধ্যিখানেই আদিব বলে উঠলো,
 “তোরা একে অপরকে চিনিস?”

জাওয়াদ কঠিন স্বরে বললো,
 “সেটা দিয়ে তোর কোনো কাজ নেই। নিজের চড়কায় তেল দে”
 “এক্সকিউজ মি”

জাওয়াদ আবার দীপশিখাকে শুধালো,
 “আমি জানি আমাকে তোমার জীবনে কোথাও তুমি রাখতে চাও না। কিন্তু তাই বলে……

জাওয়াদের কথাটা শেষ হতে দিল না দীপশিখা। সে উঠে দাঁড়ালো। আদিবকে সরল গলায় বললো,
 “মিস্টার আদিব, আপনি মাইন্ড না করলে আমি এখান থেকে যেতে চাচ্ছি। আমার এখানে ভালো লাগছে না”

জাওয়াদের বুকের চিনচিনে ব্যথাটা তীব্র হলো। অসহনীয় হয়ে উঠলো যেন। একেই দীপশিখার থেকে চোখ সরতেই চাইছে না তার। উপর থেকে দীপশিখার এই আদিবের সাথে বিয়ের কথা হচ্ছে ব্যপারটি তার অসহ্য লাগছে। মনে হচ্ছে কেউ তার চোখে পেঁয়াজের রস ঢেলে দিয়েছে। দীপশিখা দাঁড়ালো না। সে বেরিয়ে গেলো। তার পিছু পিছু আদিবও বেরিয়ে গেলো। 

রেস্টুরেন্ট থেকে বের হতেই আদিব শুধালো,
 “আপনারা একে অপরকে চিনেন?”
 “আমার সাথে বিয়ের হবার কথা ছিলো। কিন্তু বিয়েটা ভেঙ্গে গেছে”
 “কেন ভাঙ্গলো?”
 
দীপশিখা চুপ করে রইলো। উত্তর দিতে ইচ্ছে হলো না। সে হাটতে শুরু করেছে। বাতাস বইছে। চৈত্র সমীরণ। দীপশিখার এই সমীরণের স্পর্শ ভালো লাগছে। কারণ অবশ্য আছে। আদিব পেছনে চাইলো। জাওয়াদের মুখশ্রীতে তীব্র বিষাদের ছায়া। তার চোখ টলমল করছে। কিছু একটা ভেবে সে পা বাড়ালো দীপশিখার সাথে। 

******

আদিব যতটা ব্যস্ত ভঙ্গি দেখিয়েছিলো। পড়ে অবশ্য তেমন ব্যস্ততা দেখালো না। একঘন্টা কাটানোর পর তাকে বাসায় পৌছে দিলো সে। বাসার গেটের কাছে আসতেই জাওয়াদকে দেখতে পেলো দীপশিখা। তাদের চোখাচোখি হলো। দীপশিখা কেঁচিগেট খুলতে যাবে ঠিক তখনই পেছন থেকে জাওয়াদ তাকে জড়িয়ে ধরলো। শক্ত সে বাধন। কপাল কাঁধে ঠেকিয়ে কাতর স্বরে বললো,
 “প্লিজ তুমি আমাকে একটি সুযোগ দেও।”
.
.
.
চলবে.......................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp