ভিনা চশমা চোখে হিসাব মেলাচ্ছে,গত পাঁচ মাসে একটা ঠিকানায় চারটা পার্সেল গেছে।পার্সেল চারটা মাসের একদম শেষ অর্ডার,শেষ পার্সেল।প্রতি মাসে যতটুকু টার্গেট থাকে তা প্রায়ই এচিভ করা যায় না,কারণ নতুন বিজনেস,এখনো সেভাবে পরিচিতি পায়নি।কিন্তু যতটুকু ঘাটতি থেকে যায়,এই শেষের অর্ডারের মাধ্যমে সেই ঘাটতি পূরণ হয়ে যায়।এটা অবশ্যই খুশির বিষয়,কিন্তু ভিনার মনে খুঁতখুঁত লাগছে।এটা কোনোভাবেই কাকতালীয় হতে পারে না।
সেই অর্ডারের ঠিকানা,ফোন নাম্বার সব মিলিয়ে বুঝলো একি ব্যক্তিই বারবার মাসের শেষে খুব সুনিপুণভাবে হিসাব মিলিয়ে অর্ডার দিচ্ছে।
চশমা খুলে হাতে নিয়ে অনেক্ষণ ভাবার পরে ভিনা বুঝতে পারলো এই কাজ কার হতে পারে।বেশি সময় লাগায় নিজের উপর বিরক্ত লাগছে,কারণ এই দরদ কে দেখাতে পারে সেটা পানির মতো স্বচ্ছ।
অনুগ্রহ...যে বিষয়টা জীবনে ঘৃণা করে,সেটারই মুখোমুখি হওয়া লাগে।সবচেয়ে বিশ্রী হলো এই অনুগ্রহ অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো সম্পর্কের দিকে রুশানকে প্রলুব্ধ করবে।
-ভিনা!এত রাতে ফোন দিলে,জরুরি কিছু?
-ধানমন্ডি ৭ এ গত পাঁচ মাসে চারটা পার্সেল গেছে,সেটাও আবার ঠিক মাসের শেষে।সায়বা আব্দুল্লাহ,উনি তোর কে হয়?
রুশান হতবাক হয়ে গেছে ভিনার সরাসরি প্রশ্নে।খুব সন্তপর্ণে সে সায়বাকে দিয়ে এই পেইজ থেকে কৌশলে জিনিস কেনাতো।সায়বা রূপ সচেতন হওয়ায় সুবিধা হয়েছিলো ভালোই।ভিনা এই ছোট্ট কারসাজি ধরে ফেলবে,বুঝতে পারেনি রুশান।
-সা..সায়বা আব্দুল্লাহ?ইয়ে,সায়বা মানে...
-মানে মানে কী?
-উনি আমার খালা হয়।
-এভাবে মানুষ ঠকানো ঠিক রুশান?
-ঠকানো কীভাবে?তুমি কি আজেবাজে প্রোডাক্ট সেল করো নাকি?সবই তো অথেনটিক। এর জন্যই তো খালাকে বলেছিলাম কিনতে।
-ভদ্রমহিলা চার মাসে যে পরিমাণ প্রোডাক্ট নিয়েছেন,সেটা যেকোনো সাধারণ মানুষের দেড় দুই বছর চলে যাবে।এইযে বাড়তি খরচ করিয়েছিস,এটা হচ্ছে ঠকানো।অনলাইন বিজনেসে শুরুতেই কি অনেক লাভ হবে?আর লাভ কম হলেই কি তোকে ব্লেম দিতাম আমরা?এই কাজ না করলেই কি হতো না রুশান?তোর স্বেচ্ছায় করা সাহায্য নিয়েছি,অনুগ্রহ তো চাইনি।
-এটা অনুগ্রহ না ভিনা,প্লিজ আমাকে ভুল...
-কোনো অজুহাত না।আমি আগেই পরিষ্কার করে দিলাম,এসব যেন আর না দেখি।আর যদি তাও মাথায় এসব ঘুরঘুর করে,আমার বাসায় আর যাওয়া লাগবে না তোর।রাখলাম।
ভিনা রুশানকে কোনো কথা বাড়ানোর সুযোগ না দিয়ে ফোন কেটে দিলো।রুশান হতাশভাবে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো।আজকে ভিনার প্রথম ভালোবাসা হলে এই ছোট ছোট এফোর্ট গুলোই কী চমৎকারভাবে মুগ্ধ করতো ভিনাকে।মাঝখানে যাবির এসে,সবকিছু এলোমেলো করে দিয়ে গেলো।থাকলোই যখন না,আসার দরকার কী ছিলো ভিনার জীবনে?এত নিষ্ঠুর কেন দুইজনের নিয়তি?
•••••••••••••••
রেহানকে ইদানিং বেশ ফুরফুরে মেজাজে দেখে সায়বার ভীষণ ভালো লাগে।কত বছর পর এভাবে দেখছে ছেলেটাকে।নাবিহার সেই ঘটনার পর মুষড়ে পরেছিলো রেহান,এত বেশি মানসিক আঘাত পেয়েছিলো যে জার্মান যাওয়ার পর প্রথম দুই বছর কারো সাথেই যোগাযোগ করেনি রুশান ছাড়া।জেবার কাঠিন্য দেখে সায়বার অবাকই লাগে,ছেলের সাথে মা এত অভিমান করতে পারে?যেখানে দোষ জেবারই ছিলো বেশি।শুধু রেহান না,সায়বার নিজের মেজাজ ও খুব ভালো থাকে।এতদিনের সংসারে স্বামীকে অনেক ভালোবেসেছেন,সম্মান করেছেন,কিন্তু কখনো তেমন আপন মনে হয়নি।সেদিন সাহস করে ওয়াহিদকে সত্যি কথা বলায় এক নিমিষেই যেন বহু বছরের অদৃশ্য দূরত্বের দেয়াল ভেঙে গিয়েছিলো।বিয়ের পর এই প্রথম নিজের হাজবেন্ডকে তুমি তুমি করে ডাকা হচ্ছে।নতুন প্রেমের মতো সবকিছুই তার রঙিন,স্বপ্নময় আর সুন্দর মনে হচ্ছে।একি ছাদের নিচে থেকেও এই মানুষটাকে পুরোপুরি কখনোই জানার চেষ্টা করেননি।এর জন্য জেবাই দায়ী অনেকাংশে।তার এই বোনকে সায়বা কখনোই ক্ষমা করবেন না।
রেহান ফোন হাতে ছাদে এলো।কতবছর পর নিজের দেশে বিকেল দেখছে।মাসখানেক হলেও আসার পর একদিন ও ছাদে যায়নি এর মাঝে,আজকে হুট করেই ছাদে উঠতে ইচ্ছে করেছে,শুধু তাইনা,ছাদে এসে প্রিতিকেও ফোন দিতে ইচ্ছা করেছে।নিজের একনিষ্ঠ প্রেমিক পদবি ধীরে ধীরে এমন ম্রিয়মাণ হতে দেখে মনে কিঞ্চিৎ খারাপ লাগা আছে,যদিও সেটা কিঞ্চিৎই।
-বাহ্!এসময়ে ফোন দিলে?
-ব্যস্ত ছিলে নাকি?
-না,ছাদে এসেছি চকো আর বেরিকে নিয়ে।কতবছর পর যে ছাদে উঠলাম!
-আমিও ছাদে উঠলাম অনেক বছর পর,ভাবলাম ফোন দেই তোমাকে।
-আমাকে?বিশেষ কোনো কারণ?
-না,কোনো বিশেষ কারণ নেই যদিও।
-অকারণে ফোন দেয়া তো ভালো লক্ষণ না।
-খারাপ লক্ষণের আর কিছু করার বয়স পার হয়ে গেছে।এখন সব সোজাসাপটা বলার সময়।
-কিছু বলবে?
-বলবো না,প্রশ্ন করবো,উত্তর দেয়া তোমার ইচ্ছার উপর ডিপেন্ড করে।
-ঠিকাছে,করো।
-তুমি কেন এতবছর পর ছাদে উঠলে?
-তুমি যেকারণে উঠোনি এতদিন,আমিও সেকারণেই।
-সেপারেট কেন হয়েছিলে?এক শব্দে বললেই হবে।
-প্রতারণা।
-যেই করেছে না কেন,উপযুক্ত শাস্তি পাবেই।
-হয়ত।
-তোমরা কয় ভাই বোন?
-আমি একা।
-তোমার বাবা মা কেমন আছে?
-মা আছে ভালোই।বাবা ভালো নেই।
-কেন?
-আমার মা দেশের বাইরে আছে,ওখানেই তার আলাদা সংসার।আমার বাবা বহুবছর মেন্টাল এজাইলেমে ছিলো।এখন চাচার কাছে আছে।বাবাকে দেখে রাখার বিনিময়ে তার সব সম্পত্তিও নিয়ে নিয়েছে।ইচ্ছা ছিলো বাবার বাড়িতেই থাকবো,বাবার কাছে।যেহেতু এখন তার কিছুই নেই,বাধ্য হয়ে মার তত্ত্বাবধানে থাকতে হচ্ছে।এর বেশি কিছু বলার নেই।
-এতখানি বিশ্বাস করার জন্য থ্যাংকস। তোমার প্রতি সিম্প্যাথি দেখাবো না,তোমার কোনো প্রয়োজন নেই সেটার। তুমি চমৎকার একজন মানুষ,নাহলে এতদূর অবশ্যই আসতে পারতে না।যাই হোক,ভার্সিটিতে যাচ্ছো কবে?
-ঐত,চকো আর বেরির কোনো ব্যবস্থা করতে পারিনি।মনে হয় না এখন ভর্তি হবো।
-প্রথমবার বিড়াল পালছো?
-হ্যাঁ।
-আমিও প্রথমবার পালবো।তোমার ভার্সিটি থেকে আমার খালার বাসা বেশি দূরে না।প্রতিদিন সকালে এসে বিড়াল নিয়ে গেলাম,ক্লাস শেষে ফেরৎ দিয়ে যাবো নাহয়।
-সিরিয়াসলি!
-হ্যাঁ,আপাতত কয়েক মাস চাকরি করার ইচ্ছা নেই,ফ্রিই থাকি সারাদিন।
-হেল্পের জন্য থ্যাংকস, কিন্তু আগে বাসায় জিজ্ঞেস করে নাও।অনেক ফ্যামিলিই বিড়াল পালা পছন্দ করে না।
-ব্যাপার না।ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
-তবুও,শিওর হয়ে জানিও।
-ঠিকাছে।
রেহান প্রিতিকে আশ্বস্ত করলেও বাসায় এসে ধরাশায়ী হলো।পুরো ঘটনা বলার পর সায়বা চিৎকার দিয়ে আঁতকে উঠেছে।
-বাবারে,ভালোবাসি দেখে কি এমন আবদার করবি?
-বিড়াল ই তো খালা,আর বিড়াল কিন্তু নাপাক প্রাণি না,কোনো সমস্যা নেই।
-আমি বিড়াল ডরাই বাবা,এর চেয়ে প্রেম করে বিয়ে করে ঘরে বউ তোল,তাও সামলানো যাবে।বিড়াল আনিস না লক্ষ্মী বাপ আমার।
-খালা প্লিজ?
-দেখ,তোর খালুর খাবারে পশম টশম গেলে কী হবে বল তো!মানুষটার কিছু হয়ে গেলে?
রেহান বুঝলো কোনোভাবেই সায়বা কে রাজি করানো সম্ভব না।প্রিতি ঠিকি বলেছে,নিশ্চিত না হয়ে কথা দেয়া ঠিক হয়নি,যাই হোক,এটা নিজের বাড়ি না।পরেরদিন সকালে রেহান নাস্তা শেষে ব্যাগ গুছিয়ে রেডি হয়ে গেলো।রেহানকে এভাবে দেখে সায়বার কাঁদো কাঁদো অবস্থা।
-রাগ করলি তুই আমার সাথে?
-মোটেও না,আমি বাবার জন্য যাচ্ছি।বাবা অনেক অপেক্ষা করে আমার। কয়দিন পর আবার আসবো।
সায়বা আশ্বস্ত হতে পারলেন না,অনেকবার নানারকম কথা নিয়ে রেহানকে যেতে দিলেন,তবুও বিশ্বাস করলেন না রেহান বিড়ালের ঘটনায় যায়নি।
রেহান বাসায় ফেরার পুরো রাস্তায় এ বিষয় নিয়ে ভাবলো।সত্যিই শুধু প্রিতির পড়াশোনায় যেন বিড়াল রাখা নিয়ে সমস্যা না হয়,এর জন্য বাসায় ফিরছে,জেবার বাসায়। একজন সদ্য পরিচিত মানুষের শখের বিড়াল রাখার জন্য রেহান বহু বছরের অভিমান তুচ্ছ করে বাড়ি ফিরছে,মানুষের মন অনেক আজব জিনিস।
•••••••••••••
ফারজানা ভার্সিটির অডিটোরিয়াম এর গেটের ঠিক বাইরে অস্থিরভাবে অপেক্ষা করছে।এখন কোনো অনুষ্ঠান নেই,তাই এ জায়গাটা খালি।রুশান বিকাশে টাকা দিতে চেয়েছিলো,কিন্তু আজকে সেমিস্টার ফি দেয়ার শেষ দিন,তাই ক্যাশ টাকাই দিচ্ছে।প্রায় পনের মিনিট পর,বেশ বিরক্তি নিয়ে রুশান সামনে আসলো।
-ক্যাফেটেরিয়াও তো ছিলো,এখানে কেন আসতে বললে?
-সবার সামনে নিতাম নাকি?
-আমি কি খোলা টাকা দিতাম?খামে ভরে ভদ্র মানুষের মতই দিতাম,কাউকে ইন্টেনশনালি ছোট করার স্বভাব আমার মধ্যে নেই।
-স্যরি
-হুম
-আমি জলদিই টাকা ফেরৎ দিয়ে দিবো।
-হ্যাঁ,জলদিই দিতে হবে।কারণ আমি স্টুডেন্ট।
ফারজানার নিজের রাগ কষ্ট করে আটকে রেখে চেহারা দুখী দুখী করে রাখলো,যে ছেলে গাড়ি নিয়ে ঘুরে তার নাকি টাকার অভাব!
-ক্লাব ফেয়ার দুই সপ্তাহ পর,ক্লাবগুলোতে তো আছোই,তাইনা?
-হ্যাঁ,কেন?
-না মানে আমাদের তো সেভাবে দেখা হয়না।দেখা হলে না দিতে পারবো।
-এত জলদি ম্যানেজ করতে পারবে?
-চেষ্টা করবো যতটুকু পারি।
-হু
রুশান এক মিনিট ও দেরি না করে চলে আসলো। এই টাকা ম্যানেজ করতে কী পরিমাণ কষ্ট হয়েছে,সেটা শুধু ঐ জানে।নিজের জমানো টাকা আর রেহানের কাছ থেকে ধার নিয়ে এই টাকা দিচ্ছে।যেহেতু বাসা থেকে হাত খরচ নেয়না,তাই সামনের দিনগুলোয় বেশ চেপে চলতে হবে।রেহান পুরো ঘটনা শুনে সাবধান করেছিলো যদিও,কিন্তু টাকার অভাবে একটা মেয়ের জীবন নষ্ট হবে,এটা রুশান মেনে নিতে পারেনি।শত্রুতা শত্রুতার জায়গায়,তাই বলে মানবিকতার সাথে আপস করা সম্ভব ছিলো না।
.
.
.
চলবে........................................................................