অন্তর্দ্বন্দ্ব - পর্ব ৬০ - সাবরিনা ইমরান - ধারাবাহিক গল্প


কুয়াশা জড়ানো সূর্যোদয়।চারদিকে শান্ত শীতল পরিবেশ,কেউ যেন মায়া দিয়ে থামিয়ে রেখেছে কোলাহল। ভিনা আজ সূর্য ওঠার আগে বের হয়েছে হাঁটতে।রাস্তায় স্বাস্থ্য সচেতন কিছু মানুষ এবং রাস্তার ঘুমপ্রিয় কুকুর ছাড়া তেমন কিছু নেই।অদূরে বয়স্ক এক মহিলা পরিচ্ছন্ন কর্মী মনের খেয়ালে রাস্তা পরিষ্কার করছে।এদের মধ্যরাত থেকে সকাল পর্যন্ত কাজ করতে হয় যার কারণে প্রতিদিন সূর্য ওঠা দেখা।তাদের যদি বলা হয় সূর্যোদয় দেখতে কিছু মানুষ আয়োজন করে বের হয়,তারা তাচ্ছিল্যের হাসি দিবে।একি ঘটনা একেকজনের জীবনে একেকভাবে প্রভাব ফেলে।

ভিনা বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলো।দুই ঘন্টা বিভিন্ন নতুন রাস্তায় হাঁটার পর ফিরলো ঘরে।মুনা তখন মাহভিনকে নিয়ে পুরো ঘরে ঘুরছেন এবং রুটি দিয়ে কম ঝাল ভাজি খাওয়ানোর চেষ্টা করছেন।

-- মা,মাহভিনের খাওয়া শেষ হলে এদিকে এসো।
--ঠিকাছে,এইতো পনেরো মিনিটে আসছি।আর শোন,রুশান এসেছিলো একটু আগে।না পেয়ে খুঁজতে গেছে।আমি তো ভেবেছি তুই রুশানের সাথেই হয়ত হাঁটতে বের হয়েছিস।তোকে যে জানাবো ফোন ই রেখে গেছিস।
-- আচ্ছা,আমি জানিয়ে দিবো ওকে।তুমি আসো জলদি।

ভিনা এই ফাঁকে মোবাইল চেক করলো।এখানে অনেকগুলো মেসেজ জমে আছে রুশানের।ভিনা সুন্দর করে ক্ষমা চেয়ে নিলো। ততক্ষণে মুনা ছোটাছুটি করে মাহভিনকে খাওয়ানো শেষ করলেন।ভিনা লক্ষ্য করেছে ইদানিং মাহভিনের জন্য আর মন কাঁদেনা।এমন না টান নেই,কিন্তু মাহভিনকে যাবির ছাড়া অপূর্ণ লাগে।মাহভিনের কাছে গেলেই অদ্ভুত শূণ্যতা জেঁকে বসে।মনে হয় কেউ পাজেলের একটা বড় অংশ চুরি করে নিয়ে গেছে।এই অপূর্ণ পাজেলের অংশ হতে ভিনার কষ্ট হয়।তাই আজকাল দূরে রাখে নিজেকে।মা বাবা নিয়ে পরিপূর্ণ একটি পরিবারে মাহভিনকে বেশি মানায়।মা ছাড়া যেমন একা কেটেছে ভিনার জীবনের একাংশ,ভিনা চায়না বাবা ছাড়া সেরকম ভাঙা জীবন মাহভিনের কাটুক। ভিনা নিজেকে প্রশ্ন করলো,যাবির থাকলে কি মাহভিন ছাড়া থাকা সম্ভব হতো?তখন কি অধিকার কাজ করতো না?তখন কি মাহভিনকে দূরে রেখে নিজের ভাঙা সংসার করার সাহস হতো?মুনাকে নিজের সন্তান দেয়ার উদারতা কি আসলে নিজেরই ব্যর্থতার অংশ না?

-- এইনে এসে পরেছি।বল কী বলবি?
-- মাহভিন তো বড় হয়ে গেছে।তুমি একসময় চাকরি করতে,স্বাবলম্বী ছিলে।এখন আমি চাই মাহভিন্স এর দায়িত্ব তুমি নাও।
-- কী বলছিস এসব?আমি পারবো নাকি?
-- যদি বলি আমার চেয়েও ভালো পারবে?
-- রুশানের ফ্যামিলি তো এমন না।তাহলে ছাড়তে কেন চাচ্ছিস?
-- বিয়ের সাথে এইটার কোনো সম্পর্ক নেই মা।আমি চাই তুমি স্বাবলম্বী হও।আমি এই বিজনেস করছিই তোমার জন্য।আমার নিজের এত আগ্রহ ছিলো না।
-- ভিনা....সত্যি বলছিস?
-- হ্যাঁ মা,সত্যি বলছি।আগামী এক সপ্তাহ তুমি আমার সাথে সময় দিবে।আমি তোমাকে সবকিছু ভালোমতো বুঝিয়ে দিবো।তোমার হাত দিয়েই মাহভিন্স একদিন অনেক বড় হবে দেখো।

মুনা ভিনাকে জড়িয়ে ধরলেন শক্ত করে।ভিনাও শান্তি অনুভব করলো।অন্তত যা চেয়েছিলো তা দিতে পেরেছে।পরবর্তী এক সপ্তাহ ভিনা রাত জেগে মুনাকে সব বুঝিয়ে দিলো।

জমিরা বিবির মারা যাওয়ার দুই মাস পার হয়ে গেছে।এখন রুশান বিয়েতে দেরি করতে চায় না।এই দুই মাস সময়ে জেবা অনেক চেষ্টা করেছেন রুশানের বিয়ে ভাঙার।একদিন তিনি সায়বার বাসায় গিয়েছিলেন হুট করে।সায়বার সামনেই তিনি কাইফকে ডেকে নিলেন,এরপর দরজা বন্ধ করে সরাসরি জিজ্ঞেস করলে ভিনা রুশানের কথা।কিশোর কাইফ চেষ্টা করেছিলো কিছু না বলার।কিন্থ জেবার ব্ল্যাকমেইলের কাছে আর টিকতে পারেনি।জেবা সরাসরি বলেছিলেন-
--তোমার ভাইয়ের জীবন তোমার হাতে।মিথ্যা কথা দিয়ে বিয়ে হলে সেই বিয়ে টিকবে না।ক্ষতি রুশানেরই হবে।

পরে কাইফ জানায় ভিনাকে কবে থেকে পছন্দ করে,ভিনার আগের সম্পর্কের কথা,রুশানের ভালোবাসার কথা।কাইফ এটাও বলেছিলো রুশান সব জানে।জেবা বিশ্বাস করেননি।তার ধারণা ছিলো রুশান এতটাও উদার না যে অতীত থাকা সত্ত্বেও কোনো মেয়েকে ভালোবাসবে। জেবার এ দম্ভ কাচের মতো ভেঙ্গে গিয়েছিলো কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে।

-- তুমি কি ভিনাকে জেনে শুনে বিয়ে করছো?তুমি কি জানো ভিনা থার্ডক্লাস একটা মেয়ে?ওর আগে যাবির নামের একটা সামান্য টিচারের সাথে প্রেম ছিলো।
-- জানি আমি,সব জানি।শোনো মা,থার্ডক্লাস তারা যারা অতীত নিয়ে মানুষের পিছে লেগে থাকে।তোমার নিজের ছেলে কত ছ্যাচড়া ধারণা আছে তোমার?আমার কপাল যে ভিনা আমাকে বিয়ে করছে।

জেবা সেদিন নিজের অহমিকা,কাঠিন্য ভুলে গিয়ে বাচ্চাদের মতো কাঁদা শুরু করেছিলেন।বুঝে গিয়েছিলেন রুশানকে ফিরানোর উপায় আর নেই।রুশানের বিন্দুমাত্র খারাপ লাগলো না।রুশান ভালোমতো জানে জেবার এই কান্না নিজের পরিকল্পনা বিফলে যাওয়ার দুঃখে।
কাইফকে এসবে টেনে আনার জন্যই রুশান আরো বিয়ের জন্য তোড়জোড় করতে থাকে।এবার ফারুক সাহেব নিজেও এগিয়ে আসেন।এদিকে প্রিতি রেহানকে বুঝানোর পর রেহান ও মেনে নেয় আগে বিয়ের কথা।দুই পরিবার বিয়ের আলোচনায় বসলে সিদ্ধান্ত হয় একদম ছোট করে আয়োজন হবে,যেহেতু কিছুদিন আগেই বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠর মৃত্যু হয়েছে।ভিনা এই দীর্ঘ সময়ে চিঠির ব্যাপারে খোঁজ নিতে নিতে ক্লান্ত হয়ে যাওয়ায় ভিনাও বিয়েতে রাজি হয়ে যায়।সেহিসেবে ভিনার বিয়ের মাত্র এক সপ্তাহ বাকী আছে।যেহেতু এখনো মৃত বাড়ির আভাস রয়ে গেছে,তাই বোঝার উপায় নেই বাড়ির বড় মেয়ের বিয়ে হচ্ছে।ভিনা নিজেকে প্রস্তুত করছে নতুন জীবনের জন্য। ভেতরে একটা স্বস্তি যে দুঃস্বপ্ন সত্যি হয়নি। সবাই সুস্থভাবে চোখের সামনে আছে।জীবনে সুখী হতে এর চেয়ে বেশি কী প্রয়োজন?

______________________

ভিনা কাঁচা ঘুম থেকে অস্থির হয়ে উঠে বসলো।দুপুরের ভাত ঘুম দিয়েছিলো অনেকদিন পর।চুমকি এসে খাম দিয়ে গেছে।চোখ মুছে হাতে রাখা খামের দিকে তাকালো।আবারো চিঠি।এবার যদি কিছু থাকে!

খাম খুলে দেখলো পছন্দের ইউনিভার্সিটি থেকে স্কলারশিপের এপ্লিকেশন এক্সেপ্ট করা হয়েছে।তিন মাসের ভেতরে ক্যাম্পাসে ক্লাস এটেন্ডের জন্য অনুরোধ করা হয়েছে।

এক সময়কার অধরা স্বপ্ন আজকে হাতের মুঠোয়।হায়রে সময়!ভিনার মধ্যে কোনো উত্তেজনা কাজ করছে না।উলটো বিরক্ত হলো এই চিঠি পেয়ে।ড্রয়ারের এক কোণায় ফেলে রাখলো সেটা।কিছুক্ষণ এদিক সেদিক করে ঘুমিয়ে পরলো।
সন্ধ্যার দিকে মুনা আসলেন ফোন হাতে।ভিনাকে ডাক দিয়ে উঠালেন।

-- এই ওঠ না ভিনা।প্রিতি তোর সাথে কথা বলতে চাচ্ছে।
-- প্রিতি আপু?দাও দাও

মুনা ভিনার হাতে ফোন দিয়ে চলে গেলেন।দুই বোন মন খুলে নিজেদের কথা বলুক।

-- হ্যালো আপু,কেমন আছো তুমি?
-- ভালো নেই রে।আজকে চলে আয় না আমার কাছে।আমার কাছে থাকবি।না করিস না প্লিজ।
-- এখন? কালকে সকালে আসি?
-- না এখনই।এখনই আয় বলছি।

ভিনা রাজি হয়ে গেলো।তবু একটু খচখচ করছে ভেতরে।বিয়ের আগেই ভাসুরের বাসায় থাকতে যাওয়া শোভনীয় হবে কিনা চিন্তিত।এদিকে প্রিতিকেও না বলা গেলো না।সোহেলকে জানাতেই উনি ফারুক সাহেবের সাথে কথা বললেন।ফারুক সাহেব হেসেই সব উড়িয়ে দিলেন।হেসে বললেন-
মেয়েকে দেখি এখনই আমার দায়িত্বে দিয়ে দিচ্ছেন ভাই।

ভিনা খুশিমনে রওনা দিলো প্রিতির বাসায়।বাসায় যেয়ে ফ্রেশ হওয়ার পর রাতের বেলা বসলো দুইজন।অনেক্ষণ গল্প করার পর প্রিতি হুট করে কান্না করে দিলো।ভেজা গলায় বললো-

-- আমি মারা গেলে আমার বাবুর খেয়াল রাখবি তুই?বল রাখবি?
-- কীসব আবোল তাবোল বলো তুমি?
-- আমি স্বপ্ন দেখেছি রে।আমার শরীর ও না কেমন লাগে।
-- এসময়ে দুঃস্বপ্ন আসা স্বাভাবিক।ভাই দেখো অন্যের বাচ্চা আমি সামলাতে পারবো না।তুমি নিজে নিজের বাচ্চা পালো।
-- যাহ্ অসভ্য।

ভিনা জড়িয়ে ধরলো প্রিতিকে,পেটে হাত বুলিয়ে দিলো।আরো অনেক্ষণ সময় কাটানোর পর ভিনা গেস্ট রুমে দরজা লাগিয়ে ঘুমাতে চলে গেলো।

রাতের বেলা কল আসলো ভিনার ফোনে,অসংখ্যবার।ভিনা ঘুম ঘুম চোখে কল রিসিভ করলো।এরপর চিৎকার দিয়ে ভেঙে পরলো কান্নায়।কোনোমতে রুশানকে ফোন দিলো-

-- জলদি আসো রুশ,আমাকে নিয়ে যাও...
.
.
.
চলবে.........................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp