মেঘফুল - পর্ব ২২ - মিশু মনি - ধারাবাহিক গল্প


আজ রবিবার। 
লাইব্রেরি উঠোনে একাই একটা টেবিলে গালে হাত দিয়ে বসে আছে সামার। কালো রঙের শাড়িতে তাকে অপূর্ব সুন্দর লাগছে। মনটা ভার কারণ এখনও অর্ণব আসেনি। প্রায় এক ঘন্টা ধরে বসিয়ে রেখেছে অর্ণব। সে এমন একটা মানুষ যে খুব কাছের কেউও নয়, আবার ঠিক সামান্যতম পরিচয়ও নয়। তাই রাগ করাও যাচ্ছে না, আবার অপেক্ষা করাও আনন্দদায়ক হয়ে উঠছে না। 
সামার কারও জন্য এতক্ষণ অপেক্ষা করার মানুষ নয়। আজকে একটা বিশেষ দিন বলেই সে অপেক্ষা করে আছে। কারণ আজ অর্ণবের সঙ্গে সে আরজুর পরিচয় করিয়ে দেবে। সামারের বাবা জাভেদ আলী অর্ণবকে অত্যধিক স্নেহ করেন। অর্ণব যদি আরজুর কথাটা বাবাকে বলে, তাহলে তিনি চোখ বন্ধ করে আরজুর সঙ্গে সামারের বিয়ে দিতে সম্মত হবেন, সামারের এটাই বিশ্বাস। বাবার সঙ্গে সে সব ধরনের কথাই মন খুলে বলতে পারে। কিন্তু তাই বলে নিজের প্রেমিকের কথা নিজে বলতে তার বড্ড লজ্জা লাগবে। একারণেই অর্ণব ভাইয়ার কাঁধে দায়িত্বটা দিয়ে দেবে সে। কিন্তু দুর্ভাগ্য এই যে, অর্ণব এখনও এসে পৌঁছতে পারে নি। 

সোনালী বিকেলবেলা কালো রঙের শাড়ি পরে 'বেঙ্গল বই' নামের লাইব্রেরির উঠোনে এসে বসেছে সামার। আরজু চলে এসেছে কিছুক্ষণের মধ্যেই। দুজনে মুখোমুখি বসে কফি পান করতে করতে অনেক গল্পগুজব হয়েছে। একে অপরের সঙ্গে কাটানো সুন্দর মুহুর্তের এক ফাঁকে আরজু জানতে চাইলো, 'তোমার ভাইয়া নাকি আসবে? কোথায় সে?'

সামার অর্ণবের নাম্বারে কল দিলো। ফোন রিসিভ করে হতাশা মেশানো গলায় অর্ণব বলল, 'সরি সামার। আজকেই তুমি অপেক্ষা করছ আর আজকেই আমার একটা জরুরি কাজের দায়িত্ব দিয়েছে।'
'সমস্যা নেই। আপনি কাজ শেষ করেই আসুন।'
'তুমি এতক্ষণ অপেক্ষা করবে?'
'আমার সঙ্গে একজন আছে। তার সঙ্গে আপনার আলাপ করিয়ে দেবো। আপনি তারাতাড়ি চলে আসুন।'
'ওকে। তারাতাড়ি আসছি।'

তারাতাড়ি আসার প্রতিশ্রুতি দেয়ার পরও অর্ণবের তারাতাড়ি আসা হলো না। এদিকে আরজুকে অফিসিয়াল কাজের জন্য এক ভাইয়ের সঙ্গে আজ মিটিং করতে হবে। আরজু সামারকে বলল, 'তুমি বরং অপেক্ষা করো। আমি মিটিংটা শেষ করেই চলে আসবো। ওনার আসতে কতক্ষণ লাগবে?'
'ভাইয়া তো বলেছে আর আধা ঘন্টার মধ্যেই পৌঁছে যাবে।'
'কিন্তু লক্ষিটি আমাকে যেতে হবে যে! তুমি ওনার সঙ্গে বসে চা খাও। আমি এক ঘন্টার মধ্যেই মিটিং শেষ করে চলে আসবো।'

আরজুও বিদায় নিয়ে নিজ কাজে চলে গেল। সামার বসে রইল একা একা। তার অপেক্ষা আর ফুরালো না। সেই থেকেই গালে হাত দিয়ে থাকতে থাকতে সামারের গাল চুপসে যাওয়ার জোগাড়। 

এমন সময় অর্ণব ছুটে এসে বলল, 'আই এম সরি 
সামার। আমার আজকে অনেক প্রেশার ছিল। আজকেই এমন হবে এটা আমি জানতাম না। সরি।'

সামার একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, 'ইটস ওকে। খারাপ লেগেছে অপেক্ষা করতে। তবে সমস্যা নেই।'
'সমস্যা নেই কেন?'
'এতক্ষণ অপেক্ষা করিয়ে রেখে আবার জিজ্ঞেস করছেন সমস্যা নেই কেন?'
'সমস্যা থাকাটাই স্বাভাবিক। আর তুমি বলছ সমস্যা নেই। তাই জিজ্ঞেস করছি।'
'আপনি বসুন। মনে হচ্ছে অফিস থেকে সোজা এখানে চলে এসেছেন?'
'হ্যাঁ। বাসাতেও যাইনি। পায়খানা প্রস্রাব কিচ্ছু না করেই চলে এসেছি।' জোকসের সুরে বলল অর্ণব।

'কেন? এত জরুরি কাজগুলো আপনার করা দরকার ছিল।'
বলেই শব্দ করে হেসে উঠল সামার।তার সঙ্গে হাসল অর্ণবও। 

চারপাশে চোখ বুলালো অর্ণব। জায়গাটা তার বেশ পছন্দ হয়েছে। চারপাশে অনেক গুলো ছোট ছোট গোল টেবিল। কোথাও দুজন, আবার কোথাও তিনজন। সবাই গল্প করছে। মুখরিত হয়ে আছে আজকের সুবর্ণ সন্ধ্যা। 

অর্ণব বলল, 'তোমাকে কলিজা সিঙারা খাওয়ানোর কথা আমার। আমি একদিন এসে দেখে গিয়েছি কোথায় এই সিঙারা পাওয়া যায়। তুমি বসো। আমি নিয়ে আসি।'
'সিঙারা খাওয়াটা কী এইমুহুর্তে বেশী জরুরি?' জানতে চাইল সামার।

অর্ণব মুচকি হেসে শার্টের গুটানো হাতা মেলে দিতে দিতে বলল, 'হ্যাঁ জরুরি। তুমি সিঙারা খেতে এসেছো।'
'আপনাকে কে বলেছে আমি সিঙারা খেতে এসেছি? আমার কি জরুরি কাজ থাকতে পারে না?'

অর্ণব হেসে বলল, 'তা তো পারেই। আমার সঙ্গে বসে বসে সিঙারা খাওয়াটাও জরুরি কাজ।'
সামার ভ্রু কুঁচকে জানতে চাইলো, 'আপনি সবসময় কথা কম বলেন। আজ এত খই ফুটাচ্ছেন মুখে। কাহিনী কী?'
অর্ণব লাজুক হেসে উত্তর দিলো, ' মাঝেমাঝে অকারণে দিনটা ভালো যায়।'
'আপনি কিন্তু একটু আগেই বললেন আজকের দিনটা খারাপ। আপনার কাজের প্রেশার ছিল।'
'কাজের প্রেশারের মধ্যেও মাঝেমাঝে আনন্দ থাকে।আনন্দের ব্যাপার মাথায় থাকলেই কাজ করে আনন্দ পাওয়া যায়।'
'আনন্দের ব্যাপার আছে নাকি? শুনি?'
অর্ণব মুচকি হেসে বলল, 'আছে আছে। বলা যাবে না। তারপর বলো, কেমন আছ?'
'ভালোই। আপনি আমাকে তুমি বলা শুরু করেছেন কবে?'

অর্ণব লজ্জা পেয়ে মাথা ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকাল। এই প্রশ্নের জবাব দিতে পারবে না সে। সামার এমন প্রশ্নই বা করবে কেন! লজ্জায় লাল হয়ে উঠল অর্ণবের মুখ। কিছুক্ষণ আগেও মুখে খই ফুটলেও এখন সেটা ভাতের মতো গম্ভীর হয়ে উঠেছে। 
সামার বলল, 'কী ভাবছেন?'
'তুমি না আজকে কার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিবা?' 
'হুম। সেও কিছুক্ষণের মধ্যে চলে আসবে।'
'তাহলে আমরা কি সিঙারা পরে খাবো নাকি সে এলে খাবো?'
'আপনি তো দেখি সিঙারা খাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে আছেন! ঠিক আছে যান, নিয়ে আসুন।'

সামার হাসতে হাসতে বলল কথাটা। অর্ণব উঠে দাঁড়াল। শার্টের গুটানো হাতা আবারও নামাতে শুরু করল। ধীরেধীরে এগিয়ে গেল সিঙারা আনতে। সিঙারার জন্য লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। লাইনে দাঁড়িয়ে অর্ণব সামারকে দেখতে লাগল। সন্ধ্যার সুন্দর শহুরে আবহাওয়ায় কালো শাড়িতে কী মোহময়ীই না লাগছে সামারকে! অর্ণবের মুহুর্তের জন্যও দৃষ্টি সরাতে ইচ্ছে করল না। 

সিঙারা ও কফি নিয়ে এলো অর্ণব। সামার ভীষণ আদুরে ভঙ্গীতে ফোনে কথা বলছে। এতটা কোমল ও লাস্যময়ী কখনোই লাগেনি তাকে। অর্ণব কাছাকাছি এলে সামার ফোন নামিয়ে রেখে বলল, 'এতগুলো সিঙারা কেন এনেছেন?'
'খাবো '
'একটা খারাপ খবর আছে।'
'কী খবর?'
'যার সঙ্গে আজ আপনার দেখা করিয়ে দেবার কথা ছিল, সে আসতে পারছে না।'

অর্ণবকে এতে আরও আনন্দিত মনে হল। এটাকে খারাপ খবর বলার মানেই হয় না। সামার আর তার মাঝে অন্যকেউ কথা বললেও আজ ভালো লাগবে না অর্ণবের। 
অর্ণব বলল, 'তোমার বান্ধবী নাকি? দেখো আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েও লাভ নাই। আমি কিন্তু প্রেম টেম করতে পারবো না।'

বলেই হাসল অর্ণব। সামার একটা নিশ্বাস ফেলল। আরজু বান্ধবী নয়, বন্ধু। তার একমাত্র ভালবাসার মানুষ। কিন্তু কথাটা না বলে আবারও নিশ্বাস ফেলল সামার। যে আসবেই না, তার ব্যাপারে কথা বলতেও ইচ্ছে করছে না। সামার চেয়েছিল আজকে আরজুর সঙ্গে এত চমৎকার একটা বিকেল কাটানোর পর অর্ণবের সাথে তার পরিচয় করিয়ে দেবে। অর্ণব বাবাকে আরজুর কথা বলে তাকে রাজি করাবে। সবকিছু কত স্বপ্ন স্বপ্ন মনে হচ্ছিল। একদিকে অর্ণব দেরীতে এলো। অন্যদিকে আজকেই আরজুর মিটিং। তার আবার মিটিং শেষ হয়নি। এখন নাকি বড্ড মাথাব্যথাও করছে। এরপরেও তাকে কষ্ট দেয়ার ইচ্ছে নেই সামারের। তাই আরজুকে আসতে বারণ করে দিলো সামার। 

অর্ণব বলল, 'তোমার অনেক বান্ধবী বাকি?'
'হুম।'
'ভালো। আমি তোমাকে তুমি করে বলাতে কিছু মনে করো নি তো?'
'না।'

সামার সিঙারা খাচ্ছে। আরজুকে ছাড়া সে কত কিছুই তো খায়। কই কখনো তো এত খারাপ লাগেনি! আজ মনে হচ্ছে এখানে আরজুকে ছাড়া তার বসে থাকাটা বৃথা। অপেক্ষাও তো ছিল তারই জন্য। আর ভালো লাগছে না সামারের। 
সামার সিঙারা শেষ করল। অর্ণব একটা খাওয়া শেষে আবার আরেকটা নিয়ে খাচ্ছে। মনে হচ্ছে সিঙারা খেয়ে সে কতই না আনন্দ পাচ্ছে। সামার ওর আনন্দটাকে নষ্ট করে দিতে চাইলো না। বসে রইল শান্ত ভঙ্গীতে। 

অর্ণবের কাছে সিঙারার স্বাদ অমৃতের মতো লাগছে। তার সামনে বসে আছে এই পৃথিবীর সবচেয়ে স্নিগ্ধ মেয়েটি। কালো শাড়িতে তাকে অপ্সরীর চেয়েও সুন্দর লাগছে। আচ্ছা, সে কী আজ আমার জন্যই শাড়ি পরেছে! মনেমনে ভাবল অর্ণব। এই ভাবনাও ওকে আনন্দিত করে তুলল। 

সামার বলল, 'আমি বাসায় যাবো অর্ণব ভাই। আপনিও অনেক টায়ার্ড। বাসায় গিয়ে রেস্ট নেন।'
'আরে না না। আমি মোটেও টায়ার্ড নই।'
'অন্য একদিন বসা যাবে। আজকে আমি যাই। আমার মাথা ধরেছে।'
'চলে যাবা?' ঠিক আছে। আরেকটা সিঙারা খাও?'
'না ভাই। আজকে আর খাবো না। আপনি খাচ্ছেন দেখতে ভালো লাগছে। আপনার খাওয়া শেষ হলে আমি উঠবো।'

অর্ণব দ্রুত খাওয়া শেষ করল। একটা সিঙারা অনাদরে পড়ে রইল পিরিচে। সামার নিশ্চয়ই অনেক ক্লান্ত। ঘন্টাখানেকের বেশী সময় অপেক্ষায় বসে ছিল সে। অর্ণবের অপেক্ষা! এই ভাবনাও অর্ণবকে আনন্দ দিচ্ছে। তার জন্য কেউ এক ঘন্টা ধরে বসে অপেক্ষা করবে, এ তো তার কল্পনারও অনেক উর্ধ্বে। সেই অপেক্ষারত রমণী আজ আবার শাড়ি পরেছে!

সামারকে বিদায় দেয়ার সময় অর্ণব বারবার বলল, 'আমি তোমাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসি?'
'এখন রাস্তায় অনেক জ্যাম হবে। আপনার কষ্ট করে যেতে হবে না। রাতে ফিরতেও কষ্ট হবে।'

অর্ণব আর কথা বাড়াল না। যদিও তার বলতে ইচ্ছে করছিল, 'কষ্ট হলে হোক।' কিন্তু সে বলতে পারেনি কথাটা। এত সহজে সবকিছু বলে দেয়া যায় নাকি! যদিও আজ সামারের শাড়ি পরার কারণ্টা ভাবতে গেলেই অর্ণবের মনে হচ্ছে সামারও নিশ্চয়ই চায় অর্ণব তাকে ভালবাসুক। কিংবা সেও অর্ণবের প্রতি দুর্বল হতে শুরু করেছে। এইসব রঙিন ভাবনায় মুখরিত হয়ে রইল অর্ণব। জীবনটা এত সুন্দর করে তার কাছে কখনোই ধরা দেয়নি আগে।

সামার বাসায় ফিরে শুনলো মোস্তফা কামাল লোকটা জাহ্নবীকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে। জাভেদ আলী অনুমতি দিলেই তিনি স্বপরিবারে জাহ্নবীকে দেখতে আসবেন। পারভীন ইতিমধ্যেই জাহ্নবীকে ফোন করে কিছুটা ইঙ্গিত দিয়েছেন। তিনি চান যেভাবেই হোক, মেয়েটার বিয়েটা যেন এবার হয়ে যায়। 
.
.
.
চলবে........................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp