নির্ঘুম চোখে বসে আছে জাহ্নবী। কোলের ওপর রাখা একটা বই। পান্নাবাহারকে পুনরায় দেখতে না পাওয়ার শোকটা কাটিয়ে উঠলেও তাকে ভুলতে না পারার শোক আঁকড়ে রয়েছে জাহ্নবীকে। বারবার নিজেকে বলছে সে, 'যে আমার নয়, তাকে নিয়ে ভাব্বার অধিকারও আমার নেই।'
মানব মনের সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, কাউকে ভুলতে চেষ্টা করা মানে তাকে বারবার স্মরণ করা। জাহ্নবী যতবার পান্নাবাহারকে ভুলে যেতে চাইছে, ততবারই মনে জেগে উঠছে তার মুখচ্ছবি। রিকশা থেকে নেমে মানিব্যাগ থেকে টাকা বের করে ভাড়া দিচ্ছিল যখন, কী অপূর্বই না লাগছিল তাকে! ভেতর থেকে আরও একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো ওর। ভায়োলেট বাসায় গিয়েছে। মা বাবা হয়তো আশা করে আছেন জাহ্নবী স্যালারি পেলেই তাদের কাছে ছুটে যাবে। কিন্তু হাত একদম ফাঁকা করে ফেলেছে সে। এদিকে বাবা মা কী ভাবছেন কে জানে!
পারভীন অর্ণবের কথা ভাবছেন। ছেলেটার বাবা মা কেউ নেই এ শহরে। তাই তো প্রথম বেতন পেয়েই সবার আগে তার কাছে ছুটে এসেছে। নিজের ছেলের মতো তাকে স্নেহ করতে না পারলে ছেলেটা ভীষণ কষ্ট পাবে। তাই অর্ণবের সঙ্গে বসে গল্প করছেন তিনি। অর্ণব তার বাবা, মায়ের কথা শোনাচ্ছে।
সামার এসে পারভীনের পাশে বসতে বসতে বলল, 'মা, আমি অর্ণব ভাইকে নিয়ে একটু ছাদে যাই? ওনার সঙ্গে আমার জরুরি কথা আছে।'
পারভীন ভ্রু কুঁচকে ফেললেন। খানিকটা অবাক হয়েছেন তিনি। প্রথমে 'না' বলতে চাইলেও পরক্ষণেই কী যেন ভেবে ওনাকে আনন্দিত দেখালো। তিনি বললেন, 'একটু পর যা।'
'না আমার এখনই যেতে হবে। খুব জরুরি কথা। অর্ণব ভাইয়া, চলেন আমার সঙ্গে।'
পারভীন এবার বিরক্ত হলেন। এই মেয়ের একটুও লাজ লজ্জা বলে কিছু নেই। মনেমনে বললেন, অর্ণবের সঙ্গে তোর কথা থাকতেই পারে, তাই বলে মায়ের সামনে থেকে জোর করে তুলে নিয়ে যেতে হবে! তার বাকি দুই মেয়ের চাইতে এই মেয়েটা সম্পূর্ণ আলাদা হয়েছে। তিনি বিব্রত ভঙ্গীতে উঠে নিজের ঘরে গেলেন।
সামার হাসিমুখে বলল, 'চলুন।'
অর্ণব লাজুক হাসলো। চোখ তুলে সামারের দিকে তাকাতেও লজ্জা করছিল ওর। ছেলেদের লজ্জা পেতে দেখলে সামারের ভীষণ হাসি পায়। মুখ টিপে হেসে অর্ণবকে নিয়ে ছাদে চললো সে।
ছাদের চারপাশ জুরে টবে অসংখ্য গাছ লাগানো। কিছু গাছ বেশ লম্বা হয়ে উঠেছে। সামার দু একটা গাছের পাতায় হাত বুলিয়ে গুণগুণ করে গান গাইছে। অর্ণবের হৃদস্পন্দন আকাশচুম্বী। আজ খুব অন্যরকম লাগছে তার।
সামার হাত ঘুরিয়ে নাচার ভঙ্গীতে অর্ণবের দিকে ফিরে বলল, 'আমাকে আপনার ভালো লাগে?'
অর্ণব চমকে উঠল। গলা শুকিয়ে এলো তার। চোখ বন্ধ করে দ্রুত শ্বাস নিতে লাগল সে।
সামার বলল, 'আমাকে মা পছন্দ করে না। কারণ আমি মুখে যা আসে তাই বলে দেই। অনেকেরই এটা পছন্দ না। তাই জিজ্ঞেস করলাম আমাকে আপনার ভালো লাগে কী না। ভালো না লাগলে আমি কথাটা বলবো না।'
অর্ণব ঢোক গিলে দাঁড়িয়ে রইল। চোখ পিটপিট করছে সে। সামার আরও একটা গাছের পাতা ছুঁয়ে দিয়ে বলল, 'আমার আম গাছ ভালো লাগে। কিন্তু আম খেতে ভালো লাগে না। এজন্য যখনই গাছে আম ধরে, আমি ছিঁড়ে খেলতে খেলতে ফেলে দেই। এজন্যও আম্মু আমাকে দেখতে পারে না।'
শব্দ করে হাসলো সামার। অর্ণব মুচকি হেসে বলল, 'কিন্তু এই স্বভাবগুলোর জন্যই তো আপনি সামার। এগুলোই আপনাকে আর সবার চাইতে আলাদা করেছে।'
'বাহ আপনি তো সবকিছু বেশ ভালো বোঝেন। জানেন আমিও এটাই বলি। আমার মতো মেয়ে এই ভুখণ্ডে আর একটিও নেই। ঠিক বলেছি?'
'হুম একদম ঠিক বলেছেন।'
সামারের মন ফুরফুরে। দক্ষিণা বাতাস গায়ে দোল দিচ্ছে। ফতফত শব্দ করে উড়ছে গাছের পাতা। একটি পাতার সঙ্গে আরেকটি পাতার সন্ধিতে যে শব্দ হচ্ছে, তাতেও মনে প্রেম জাগছে অর্ণবের।
হাঁটতে হাঁটতে ছাদের অন্যদিকে এসে দাঁড়ায় সামার। রাতের শহর ছাদ থেকে দেখার মজাই আলাদা। সবকিছুকে কেমন অচেনা অচেনা লাগে তখন। সে এখনই কথাটা অর্ণবকে বলে দেবে।
অর্ণব হা করে সামারের দিকে চেয়ে আছে। সামারের কথাটা শোনার জন্য তার একটুও তাড়া নেই। কথা শেষ হলেই তো এই মুহুর্তটি শেষ। যদিও অর্ণব জানেনা কথাটি কী বিষয়ে! তবে এই মুহুর্তকে দ্রুত ফুরিয়ে যেতে দিতে রাজি নয় সে। দরকার হলে সামারের কথা শোনার জন্য সে সারা রাত অপেক্ষা করবে।
'আপনার প্রেমিকা আছে?'
সামারের প্রশ্ন শুনে চমকে উঠলো অর্ণব। এমন প্রশ্ন সোজাসাপটা মুখের ওপর বলে দেয়া যায় নাকি! উফফ হাত পা কেমন শিরশির করে উঠল অর্ণবের।
লাজুক কণ্ঠে সে বলল, 'না নেই।
' কখনো করেছেন?'
'কী!'
'প্রেম।'
অর্ণব লাজুক ভঙ্গীতে হাসলো। 'করবো না আবার। আজকাল তো সবাই প্রেমে পড়ে। প্রেম না করলে কী এত বড় হতে পারতাম? হে হে।'
নিষ্পাপদের মতো শব্দ করে অর্ণব হাসছে। সামার কয়েক মুহুর্ত অর্ণবের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হুট করেই বলে ফেলল, 'আমি একজনকে ভালবাসি।'
অর্ণব শিহরিত হল। কেন যে মনে হচ্ছে সামার তার কথাই বলবে ওকে। সামারের মুখে অর্ণবকে ভালবাসার কথা বলার চাইতে আর স্মৃতিমধুর কোনো মুহুর্তই আসবে না অর্ণবের জীবনে।
অর্ণব লাজুক গলায় বলল, 'তাই!'
'হুম। দেখেন সব কথা আমি সবাইকে মুখের ওপর বলে দেই। আপনি কিছু মনে করেন নি তো?'
অর্ণব মুচকি হাসল। সে কিছু মনে করেনি। সে নিশ্চিত হয়ে গেল সামার তাকেই ভালবেসে ফেলেছে। শহুরে এই রাত্রিকে ভয়ংকর সুন্দর মনে হতে লাগল অর্ণবের। সেদিনের শাড়ি পরে তার সঙ্গে দেখা করতে আসা, তার অপেক্ষায় বসে থাকা, আজ ছাদে ডেকে নিয়ে এসে ভালবাসার কথা বলা, সবকিছুই যেন একটা ইঙ্গিত ই দেয়, 'আমি তোমাকে ভালবাসি অর্ণব।'
এসব ভাবতে ভাবতে অর্ণব কাল্পনিক এক রাজ্যে প্রবেশ করলো। তার চোখের সামনে ভেসে উঠল তার ও সামারের দুই রুমের একটা ছোট্ট বাসার সংসার। মেঝেতে ঝকঝকে সাদা টাইলস। জানালা দিয়ে মিঠে রোদ আসে তাতে৷ শীতকালের কাচামিঠে রোদে স্নান করে চুল শুকাতে বসে সামার। পরনে আকাশী রঙের শাড়ি। মুচকি হেসে অর্ণবের দিকে তাকিয়ে সামার জিজ্ঞেস করবে, 'এই কী দেখছো অমন করে?'
অর্ণব কী বলবে তখন? 'তোমাকে দেখছি। জগতের শ্রেষ্ঠ রূপবতী মেয়েটি আমার স্ত্রী৷ আমি সেটা ভাবছি।'
সামার লাজুক হেসে অর্ণবকে মারতে আসবে। সামারের হাত ধরে ওকে কাছে টেনে নেবে অর্ণব। আহ! কল্পনায় ভবিষ্যতের স্বপ্নমধুর দিনের স্পর্শ পেয়ে অর্ণব বর্তমানের সুখটাকে আরও চারগুণ বাড়িয়ে ফেলল। ছাদে ভেসে আসা বাতাসকে ওর মনে হতে লাগল স্বর্গের হাওয়া।
সামার বলল, 'কিন্তু একটা সমস্যা আছে।'
'কী সমস্যা?'
'আমি কিছুতেই আব্বু আম্মুকে এটা বলতে পারছি না। আসলে লাইফে এখন বিশেষ কিছুই নেই করার। এখনই বিয়েটা করতে পারলে জোশ হয়। বিয়ে মানে একটা নতুন এডভেঞ্চার। কিন্তু নিজের বিয়ের কথা তো আর নিজে বলা যায় না।'
অর্ণব লজ্জায় অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে ফেলল। আজ সবকিছু এত ভালো লাগছে কেন তার! সে জানতে চাইলো, 'আপনি কী এখনই বিয়ে করতে চাইছেন?'
'হুম। চাইছি বলতে বড় আপার ব্যাপারটা হয়তো জানেন। আমি আর ফ্যামিলিকে প্রেশারে রাখতে চাই না। মেয়েদের বিয়ে না হলে বাবা মা অনেক টেনশনে থাকে। কিন্তু তারা বোঝেই না, ইউরোপ আমেরিকায় মেয়েরা সারাজীবন বিয়ে না করেও কাটিয়ে দিতে পারে।'
শব্দ করে হাসলো অর্ণব। সামারের কথা শুনতে ওর ভীষণ ভালো লাগে। চঞ্চল এই মেয়েটার দিকে তাকালেই ওর বুকে মৃদঙ্গ বেজে উঠে। হাসি থামতেই সামার অর্ণবের হাত ধরে ফেলল। চমকে উঠলো অর্ণব।
সামার অনুরোধের সুরে বলল, 'প্লিজ অর্ণব ভাই। আপনি আব্বুকে বলেন। আব্বু আপনাকে অনেক পছন্দ করে। আম্মুও করে। আপনি যদি তাদেরকে আমার পছন্দের কথা জানান, তারা কিছুতেই না করতে পারবে না। আগে প্রাথমিকভাবে জানান আপনি। বাকিটা আমি ম্যানেজ করবো। পাত্রপক্ষ কবে আমাকে দেখতে আসবে সেসব আমিই ঠিক করে নেবো। আপনি জাস্ট প্রাথমিকভাবে আব্বু আম্মুকে জানান, আমি একজনকে পছন্দ করি। বড় আপা যদি এখন বিয়ে না করে, তাহলে তারা যেন...'
সামার হাত সরিয়ে নিলো। আরজুর সঙ্গে অর্ণবের পরিচয় করিয়ে দিতে হবে। আরজুকে দেখলেই অর্ণবের ভালো লেগে যাবে। আর একবার ভালো লেগে গেলে সে নিশ্চয়ই মনের মাধুরি মিশিয়ে বাবা মাকে আরজুর ব্যাপারে বলতে পারবে।
অর্ণব মুগ্ধতায় মাখামাখি। এত সুন্দর মুহুর্ত তার জীবনে আসেনি কখনো। সামার নিজেই তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেবে এ কথা স্বপ্নেও ভাবেনি সে। খুব দ্রুতই সে জাভেদ আলীর সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলবে।
সামার বলল, 'আপনি চুপ করে আছেন কেন? আচ্ছা শুনু। আপনি কাল ফ্রি থাকলে বাইরে আমার সঙ্গে কোথাও দেখা করুন।'
'অবশ্যই। কাল আমি অফিসের পর সারা রাত ফ্রি।'
সামার বলল, 'তাহলে কাল দেখা করুন। একটা জরুরি বিষয় বলবো আপনাকে।'
অর্ণব দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। ভীষণ উত্তেজিত বোধ করছে সে। অতীতে অনেক মেয়েই তাকে বলেছে, 'আপনি একটা বোকা। অর্ণব, তুমি এত বোকা কেন?' এই কারণে একটাও ভালো মতো প্রেম হয়নি তার। হলেও বেশিদিন টেকেনি। সেখানে সামারের মতো একজন রাজকুমারী এই বোকাটাকে ভালবাসেছে, বিয়ে করতে চাইছে, এটা তার জন্য অনেক বড় প্রাপ্তি। অর্ণব মনেমনে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল সৃষ্টিকর্তার প্রতি।
সামার বলল, 'আপনি তাহলে যান। আমি আরও কিছুক্ষণ ছাদে থাকবো।'
অর্ণবের বলতে ইচ্ছে করছিল, 'আমিও থাকি?' কিন্তু আজকে এরবেশী চাওয়াটা অনৈতিক হয়ে যাবে। না চাইতেই অনেক কিছু পেয়ে গিয়েছে সে। আনন্দে আত্মহারা হয়ে ঠিকমতো বাসায় পৌঁছাতে পারবে তো, ভাবতে ভাবতে অর্ণব সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে লাগল।
আরজুকে ফোন করে ঝলমলে গলায় সামার বলল, 'অর্ণব ভাইকে বলেছি তোমার কথা। বাবার সঙ্গে আলাপ করতেও বলেছি।'
'ওকে মিষ্টি পাখিটা। ওদিকটা তুমি সামলাও, আমি এদিকে আমার বাসায় ম্যানেজ করি।'
'আমরা কী সত্যি সত্যি বিয়ে করবো আরজু?'
'হুম। তাই তো মনে হচ্ছে।'
'কিন্তু আরজু, আরও কিছুদিন প্রেম করলে ভালো হতো না?'
'সে কী! আমিই এই কথা গত কয়েকদিন যাবত বলছি। আর তুমি উলটো আমাকে বুঝাচ্ছো এই সময়ে বিয়ে করলে আমরা আরও অনেক বেশী সময় একসঙ্গে থাকতে পারবো ইত্যাদি ইত্যাদি। এখন আবার নিজেই এই কথা বলছো?'
সামার খিলখিল করে হাসলো। হাসতে হাসতে গাছের পাতায় হাত বুলিয়ে সামার বলল, 'আমি বিয়েতে কিন্তু লাল শাড়ি পরবো না।'
'তো কী প্প্রবে?'
'অন্য যেকোনো কালার। এই ধরো সাদা, বাদামী, খয়েরী।'
'লাল আর খয়েরীর মধ্যে কোনো পার্থক্য আছে?'
' আছে না আবার? তুমি আমাকে মাঝেমাঝে বলো আমি নাকি শ্রদ্ধা কাপুরের মতো দেখতে। আমাদের মধ্যে পার্থক্য আছে নাকি নেই?'
'নাহ নেই।'
'এই, একটা মাইর খাবে। সামার ইজ সামার। নো কম্পেয়ার হুম।'
খুশির আবেগ মেশানো আনন্দময় কণ্ঠে কথা বলতে লাগল সামার। রাত গভীর হতে থাকে। একসময় জাভেদ আলী ছাদে এলেন মেয়েকে ডাকতে। বাবার হাত ধরে সামার বলল, 'আব্বু, আমি অনেক দ্রুত বড় হয়ে গেছি তাইনা?'
'হুম রে মা। বড়রা বড় হয়না, তারা একইরকম থাকে। অথচ ছোটরা বড় হয়।'
'মানে!'
'জাহ্নবীকে গত পনেরো বছর ধরে মনে হচ্ছে একইরকম দেখছি। বড় হচ্ছে না। কোনো চেঞ্জ নেই। অথচ তুই আর ভায়োলেট কত দ্রুত বড় হয়ে গেলি।'
'বাহ দারুণ একটা কথা বলেছো তো আব্বু। বড়রা বড় হয় না, বড় হয় ছোটরা।'
'আমি তো এককালে দার্শনিক ছিলাম।'
'দার্শনিক জাভেদ আলী। হা হা হা।'
বাবা ও মেয়ে অনেক্ষণ শব্দ করে হাসলেন। একসঙ্গে দাঁড়িয়ে রইলেন ছাদে৷ জীবনটা অতটাও খারাপ না, যতটা মানুষ বলে। ভাবতে ভাবতে হেসে উঠল সামার।
.
.
.
চলবে.........................................................................