মেঘফুল - পর্ব ৩৮ - মিশু মনি - ধারাবাহিক গল্প


জাভেদ আলীকে সঙ্গে নিয়ে আলোচনায় বসেছে তার দুই মেয়ে জাহ্নবী ও ভায়োলেট। কথা শুরুর আগেই ক্রমাগত ঘামছে জাহ্নবী। 

ভায়োলেট আগে মুখ খুলল, 'বাবা, তোমাকে একটা কথা বলবো। রাগ করতে পারবে না।'
'রাগ করার মতো কথা তোরা বলবিও না আমি জানি।' হেসে উত্তর দিলেন জাভেদ আলী। 

ভায়োলেট এক পলক জাহ্নবীর দিকে তাকিয়ে বলে, 'বাবা, আজকের কথাটা রাগ করার মতোই। আমি জানি এটা তোমাকে বলা ঠিক হবে না, কিন্তু তুমি ছাড়া তো আর কেউ নেই বলার মতো।'
'আহা না বললে বুঝবো কীভাবে মা?'
'বাবা আমি একটা ব্যবসা করতে চাই।'
'ব্যবসা করবি! তুই?'
'হ্যাঁ। আমি আর আপু দুইজন মিলে। জাভেদ আলী দুই মেয়ের মুখের দিকে তাকান। জাহ্নবী ঘামছে এখনও। বাবার খুব কাছের হয়েও তাকে ভীষণ ভয় পায় সে।
ভায়োলেট বলল, 'আমার পুরো বিজনেস প্লান রেডি। দুই বছর ধরে এটাকে গড়ে তুলেছি। তুমি কী শুনতে চাও?'

জাভেদ আলী উৎসাহের সঙ্গে বললেন, 'অবশ্যই শুনতে চাই। আমার দুই মেয়ে আমার কলিজার টুকরা। তারা বিজনেস করবে আর সেই আইডিয়া আমি শুনবো না?'
'বাবা, আগে বলো আমাদের ওপর তোমার ভরসা আছে তো?'
'এতদিন পরেও তোরা বুঝতে পারছিস না আমার তোদের ওপর ভরসা আছে কী না?'

জাহ্নবী বলল, 'আব্বু, আমরা সবসময় যা করতে চেয়েছি, তুমি আমাদেরকে সেটারই অনুমতি দিয়েছো। আমি অনেক বিয়ে ভেঙে দিয়েছি, তুমি কখনো কিছু বলো নি। কিন্তু এখন যেটা বলবো সেটা শোনার পর হয়তো ভাব্বে এটা আমাদের ছেলেমানুষী আবদার। আসলে এটা কোনো ছেলেমানুষী নয়। এই আইডিয়া সফল হলে আমাদের সমাজের উন্নতিতে যেমন কাজ করবে, তেমনই ভায়োলেটের এতদিনের গড়ে তোলা স্বপ্নটাও পূরণ হবে।'

জাভেদ আলীর চোখে ও মুখে তীব্র কৌতুহল ফুটে উঠল। মেধাবী মেয়েদেরকে নিয়ে তিনি সবসময়ই গর্ববোধ করেন। তার মেয়েরা আর যাই করুক, কখনো অন্যায় আবদার করবে না, এই বিশ্বাস তার আছে। 
ভায়োলেট তার পুরো 'স্টার্টআপ' পরিকল্পনা বাবাকে খুলে বললো। সবটা শুনে মাথা ঝাঁকালেন জাভেদ আলী। অনেক্ষণ গম্ভীর মুখে বসে থেকে তিনি আইডিয়া নিয়ে ভাবলেন। বাবার কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখে জাহ্নবী ও ভায়োলেট একে অপরের হাত চেপে ধরে আতংকিত হয়ে পড়ল।

জাভেদ আলী বললেন, 'এই আইডিয়া তোর মাথায় এসেছে মা?'
ভায়োলেট বলল, 'হ্যাঁ বাবা। তোমার ভালো লাগে নি?'
'অনেক বড় আইডিয়া। এই বিজনেস দাঁড় করাতে অনেক অভিজ্ঞ লোকজন দরকার।'
'আমার সবকিছু ঠিক করা আছে বাবা। কোন সেক্টরে কোন ধরনের লোক নিয়োগ দিতে হবে সব কিছু ভেবে রেখেছি।'
'তাহলে তো ভালো। কিন্তু অভিজ্ঞ লোকদের বেতনও দিতে হবে অনেক।'
'তা তো দিতেই হবে।'
'কিন্তু মা, ব্যবসার শুরুতে সবাইকে বেতন দেয়ার মতো এত টাকা তো আসবে না।'

ভায়োলেট মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, 'হ্যাঁ বাবা। সেজন্য বেশী করে ইনভেস্ট করতে হবে। তুমি কোনোকিছু নিয়ে চিন্তা করো না। আমার সব প্লান রেডি। শুধু ইনভেস্টমেন্ট পেলেই কাজটা শুরু করবো।'
'ইনভেস্ট করতে কত টাকা লাগবে?'
'প্রথম ধাপে বিশ লাখ লাগবে বাবা।'

জাভেদ আলী কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, 'হুম। এরকম এমাউন্ট আমিও ভাবছিলাম। ইনভেস্ট করবে কে ব্যবসায়?'
জাহ্নবী মুখ খুলতে যাচ্ছিল। ভায়োলেট তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, 'বাবা, ইনভেস্টর পাচ্ছি না। আমরা তো নতুন উদ্যোক্তা, ব্যাংক থেকে লোন দেবে না আমাদের। আর আমার তো তেমন কেউ পরিচিত নেই যার কাছে এত টাকা চাইতে পারি।'
জাভেদ আলী গম্ভীর মুখে বললেন, 'হুম। বুঝতে পারছি।'
'একজনকে রাজি করানো যেত, উনি বেশী ইন্টারেস্ট চান। প্রতি মাসে যদি ব্যবসা থেকে এত পরিমাণে টাকা সুদ দিতে হয়, ব্যবসা করবো কী করে বলো?'
'তাহলে কী করতে চাস মা? ব্যাংক হোক বা কোনো প্রতিষ্ঠান, ইনভেস্ট করলে তাদেরকে ইন্টারেস্ট দিতেই হবে।'
'আমি কারও কাছে লোন নিতেই চাই না।'
'তাহলে?'

জাভেদ আলী মেয়েদের মুখের দিকে তাকালেন। একজন বাবা জন্মের পর থেকে পরম আদরে মেয়েদের বড় করে তুলেছেন। এত বছর পর সেই মেয়ের মুখ দেখে ঘটনা বুঝতে তার অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। জাহ্নবী ও ভায়োলেটের মুখ দেখে তিনিও সবকিছু স্পষ্ট অনুধাবন করতে পারছেন। 

খানিক্ষন চুপ থেকে তিনি বললেন, 'তোদের কোনো ইচ্ছে তো কখনো অপূর্ণ রাখিনি মা।'
জাহ্নবী বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলল, 'বাবা ভায়োলেট একদিন তোমাকে একটা ফ্ল্যাট নয়, একটা বাড়িই তৈরি করে দেবে দেখো। তুমি সবাইকে গর্ব করে বলবে, আমার মেয়ে অমুক কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা।'

জাভেদ আলী স্তব্ধ হয়ে থাকেন। জাহ্নবী বাবাকে জড়িয়ে ধরে আবেগপ্রধান হয়ে পড়ে। ভেজা গলায় বলে, 'বাবা, তুমি ওকে ব্যবসা করার টাকা দাও। ও আমাদের সবাইকে রাজপ্রাসাদ বানিয়ে দেবে। ভায়োলেট অনেক ট্যালেন্টেড একটা মেয়ে।'
বলতে বলতে গলা ধরে আসে জাহ্নবী'র। চোখ বেয়ে অশ্রু গড়াতে থাকে। আর কিছু বলতে পারে না সে। ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। ভায়োলেট কিছু বলে না, শান্ত হয়ে বসে থাকে বাবার পাশে। জাভেদ আলী কোনো কথা বলেন না। 

কয়েক মুহুর্ত কেটে যায় নিরবে। ভায়োলেট স্বাভাবিক গলায় বলল, 'মাকে কিছু বলো না বাবা। রেগে যাবে।'
'আচ্ছা।'
'আমি আর কিছুক্ষণ তোমার পাশে বসে থাকি?'
জাভেদ আলী মাথা ঝাঁকান। তার মুখে কোনো শব্দ আসে না। মেয়েদের ওপর যথেষ্ট ভরসা করেন তিনি। কিন্তু এতগুলো টাকা দিয়ে দিলে তাদের ভবিষ্যতে আসলেই কী ঘটবে তা কেউ জানে না। শঙ্কা, দ্বিধা ও উত্তেজনা নিয়ে তিনি স্তব্ধ হয়ে বসে থাকেন। 

সকালে ঘুম ভাঙার পর জাহ্নবী ফোন হাতে নিয়ে দেখে, নাদির মেসেজ পাঠিয়েছে। জরুরি মিটিংয়ে বসতে চাইছে সে। আজকে ছুটির দিন। দুপুরে একসাথে খাবার খেয়ে আলোচনায় বসার নিমন্ত্রণ জানিয়েছে। জাহ্নবী ঘুম লেপ্টে থাকা চোখ মুখে পানির ছিটা দিতে দিতে আয়নায় তাকিয়ে ভাবে, 'আমার ভাগ্যে এ কোন অদ্ভুত পরিস্থিতি এসে জুটল! এক জীবনে যাকে দেখে আপন ভেবে স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম, তার সঙ্গে আমার কখনোই এক হওয়া সম্ভব না। সেই মানুষটার সঙ্গেই আমার বারবার মুখোমুখি হতে হবে। প্রকৃতি এভাবে খেলা না করলেও পারত।'

রেস্তোরাঁর এক কোণায় বসেছে তারা। পান্নাবাহারের পরনে সাদা পাঞ্জাবি, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। জাহ্নবীর সঙ্গে আজ চোখাচোখি হল না তার। 
আলোচনা শেষ করতে করতে বিকেল গড়িয়ে এলো। নাদির খুব দ্রুত অফিসের চাকরি ছেড়ে দিয়ে নিজের ব্যবসায় নামবে। এখানে উপস্থিত সবাইকে পাশে চায় সে। জাহ্নবী'র বলতে ইচ্ছে করছিল, 'আমি পারবো না থাকতে।' কিন্তু বলতে পারল না। প্রথমত, নাদির স্যারের দেয়া সম্মানকে তুচ্ছ করতে চায় না সে। আর দ্বিতীয়ত, তার অভিজ্ঞতার প্রয়োজন। 

বিদায়ের সময় নাদির জাহ্নবীকে বলল, 'আমার গাড়িতে চলুন, আপনার ওদিকেই যাচ্ছি। নামিয়ে দেবো।'
জাহ্নবী বারংবার 'না, না' বললে রীতিমতো জোর করেই জাহ্নবীকে গাড়িতে উঠতে বাধ্য করল নাদির। গাড়ি চালাচ্ছে পান্নাবাহার। পেছনের সিটে নাদিরের সঙ্গে বসলো জাহ্নবী। 

নাদির অনেকটা সময় ব্যবসা নিয়ে কথা চালিয়ে গেল। হঠাৎ একটা ফোনকল আসায় কথায় বিরতি দিলো সে। ফোন রেখে বলল, 'আমাকে এক জায়গায় যেতে হবে। ভাইয়া, তুই ওনাকে নামিয়ে দিয়ে আসবি?'
'আচ্ছা, দিয়ে আসবো।'

মুহুর্তেই গাড়ি থেকে নেমে গেল নাদির। জাহ্নবী অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়ে গেল। পান্নাবাহার গাড়ি চালু করে জানতে চাইলো, 'কোথায় যাবেন যেন?'
জাহ্নবী উত্তর দিলো না। মাথা নিচু করে বিরক্তিভাব কাটানোর চেষ্টা করছে সে।
পান্নাবাহার আবারও জানতে চাইলো, 'কোথায় যাবেন? কিছু হয়েছে?'
'না তো।'
'কথার জবাব দিচ্ছেন না।'
'আপনি বরং আমাকে এখানেই নামিয়ে দিন, আমি একটা গাড়ি নিয়ে চলে যাবো।'

পান্নাবাহার পেছন ফিরে তাকাল, 'কেন?'
চোখাচোখি হল দুজনাতে। হঠাৎ জাহ্নবী'র বুকের মধ্যিখানে ধক করে ওঠে। সে মৃদুস্বরে উত্তর দেয়, 'আপনাকে কষ্ট দিতে চাচ্ছি না।'
'আপনি গাড়ি থেকে নেমে গেলে কী গাড়ি আমাকে একা একাই বাসায় পৌঁছে দেবে? আমাকে চালাতে হবে না?'
'তা বলছি না। আবার অতদূর যাবেন..'
'অতদূরটা কোথায় সেটা বলতে অসুবিধা কিসে? নাকি আমাকে বাসার ঠিকানা বলতে চান না? ভয় পাচ্ছেন? আরে বাবা বিনা দাওয়াতে যাবো না আপনার বাসায়।'
'আমি কী সেটা বোঝাতে চেয়েছি?'
'এখন তো সেটাই মনে হচ্ছে।'
'বেশী বেশী মনে হচ্ছে। আপনার মেয়ে কেমন আছে?'
'ভালো আছে। ও সবসময় ভালোই থাকে। হাসিখুশি, আনন্দমুখর।'

জাহ্নবী আর কিছু বলল না। পান্নাবাহার বলল, 'গাড়ি এভাবে চলতে থাকলে ঢাকা পেরিয়ে যমুনায় গিয়ে পড়বো।'
জাহ্নবী মৃদুস্বরে বাসার ঠিকানা বলতে বাধ্য হল। বাসার কাছাকাছি পৌঁছে পান্নাবাহার জানতে চাইলো, 'চা খাবেন?'

জাহ্নবী ক্ষণিকের জন্য হতভম্ব হয়ে যায়। এই সেই দোকান যেখানে প্রথমবার পান্নাবাহারকে দেখেছিল সে। আজ সেই দোকানেই পান্নাবাহার তাকে চা খাওয়ার আমন্ত্রণ জানাচ্ছে! 
জাহ্নবী উত্তর দেয়, ' না। এতদূর কষ্ট করে আসার জন্য ধন্যবাদ আপনাকে।'
'ওয়েলকাম। ভাবলাম আপনার উছিলায় আমারও এক কাপ চা খাওয়া হবে। আজ আর খাওয়া হল না।'
বাসার সামনে গাড়ি দাঁড় করালো পান্নাবাহার। জাহ্নবী কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে নেমে গেল গাড়ি থেকে। পান্নাবাহার গাড়ি ঘুরিয়ে ইশারায় বিদায় জানালো তাকে। ভেতর থেকে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে জাহ্নবী'র। প্রকৃতি এত অদ্ভুত খেলা খেলে কেন মানুষকে নিয়ে!

বাসায় প্রবেশের সাথে সাথেই ভায়োলেটের ফোন। উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে ভায়োলেট বলল, 'আপু, বাবা আমাকে বিশ লাখ টাকা দিচ্ছে ব্যবসা করার জন্য।'
জাহ্নবীর ইচ্ছে করছে আনন্দে লাফিয়ে উঠতে। স্বপ্ন পূরণের এক অদম্য বাসনা ভেতর থেকে উঁকি দেয়। খুশির জোয়ারে ভাসতে ভাসতে জাহ্নবী বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। চোখ বন্ধ করতেই তার মনে ভেসে উঠল এক অপূর্ব দৃশ্য। সে হেঁটে যাচ্ছে তার কর্পোরেট অফিসে। আশেপাশে বসে থাকা সব স্টাফ দাঁড়িয়ে তাকে 'গুড মর্নিং ম্যাম' বলছে। জাহ্নবী লাজুক হেসে তাদেরকে বলে, 'প্লিজ আমাকে ম্যাম ডাকবেন না। আমাকে আপনারা আপা ডাকতে পারেন।'
.
.
.
চলবে.........................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp