মেঘফুল - পর্ব ৪০ - মিশু মনি - ধারাবাহিক গল্প


বিকেলের পড়ন্ত রোদে জানালার পর্দাটা ঝিলমিল করছে। ঘুম ভাঙা চোখে সেদিকে চেয়ে আছে জাহ্নবী। হঠাৎ খেয়াল হল বালিশের নিচে ফোনটা কাঁপছে। শব্দ হচ্ছে ভূ-উ-উ-উ।
জাহ্নবী ফোন হাতে নিলো। অপরিচিত নাম্বার। ফোন কানে ধরে সে বলল, 'হ্যালো..'
'জাহ্নবী বলছেন?'
'জি। কে বলছেন?'
'আমি সারল্য।'
'সারল্য কে?'
'সারল্য আমি।' 

জাহ্নবী চোখ কচলে উঠে বসলো। অপরিচিত কণ্ঠস্বর, কখনো না শোনা নাম। ভ্রম লেগে যাচ্ছে তার। চুপ করে রইল সে। 
ওপাশ থেকে সারল্য নামের ব্যক্তিটি বলল, 'আমাকে চিনতে পারছেন না? সেদিন একসঙ্গে মিটিং করলাম? নাদিরের বিজনেস মিটিং।'

জাহ্নবী মনে করার চেষ্টা করল। সেদিন মিটিংয়ে বেশ কয়েকজন লোক ছিল। সবাই তাদের মতো মতামত দিয়েছে, জাহ্নবীর মতের প্রশংসাও করেছে কয়েকজন। কিন্তু তাদের মধ্যে সারল্য কে হতে পারে, সেটা কিছুতেই সে মনে করতে পারছে না। 

সারল্য বলল, 'চিনতে পারেননি এখনও?'

জাহ্নবী না চিনেও চেনার ভঙ্গীতে বলল, 'হ্যাঁ। বলুন।'
'এদিকে আমি একটা কাজে এসেছিলাম। গাড়ি এনেছি সাথে। নাদির বলল আপনাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে।'

জাহ্নবী আড়মোড়া ভেঙে একটা বড় করে শ্বাস নিলো। জানালায় রৌদ্রমুখর পর্দাটা দেখতে ওর ভীষণ ভালো লাগছে। ঘুমের ঘোর কাটাতে সে জানালার পর্দা সরিয়ে দিলো। নাদির স্যার আজকেও একটা মিটিং ডেকেছেন। আজ ওয়েবসাইট ডিজাইনটা দেখাবেন সবাইকে। জাহ্নবী ভুলেই গিয়েছিল মিটিংয়ের কথা। 
শুক্রবার আজ। ছুটির দিন বলে সে লম্বা ঘুম দেয়ার পায়তারা করেছিল গত রাতেই। সারা রাত জেগে ভোরবেলা ঘুমিয়েছে। সেই ঘুমের দৈর্ঘ্য বিকেল তিনটায় গড়াবে এটা ভাবেনি সে।

জাহ্নবী বলল, 'আমি একা চলে যেতে পারবো।'
'আপু, আমরা এখন একই টিমের মানুষ। এক প্রকার কলিগ বলা যায়। একসাথে অনেকদূর কাজ করতে হবে। এতটা পর ভাব্বেন না প্লিজ।'

জাহ্নবী কিছুক্ষণ ভেবে বলল, 'আচ্ছা ভাই। আপনি কোথায় আছেন এখন?'
'আমি বাজারের রোডের মাথায় আছি। আপনাকে অনেক্ষণ আগেই কল দিয়েছিলাম।'
'আমি ঘুমে ছিলাম ভাই।'
'বুঝতে পেরেছি আপু। আপনি তাহলে রেডি হোন। আমাকে কল দিলেই আপনার বাসার নিচে চলে আসবো।'
'আচ্ছা ভাইয়া।'

জাহ্নবী ফোন রেখে রাস্তার দিকে তাকালো। আজ লম্বা ঘুম দিয়েছে সে। এখন খিদেয় পেট মোচড় দিচ্ছে। রান্না করে তারপর খেতে হবে তাকে। ইচ্ছে করছে বাইরে খেয়ে নিতে। কিন্তু মিটিং তো আরও দেড় ঘন্টা পর। এতক্ষণ লোকটাকে বাইরে অপেক্ষা করাতেও তার খারাপ লাগছে। 

জাহ্নবী দ্রুত তৈরি হয়ে সারল্য'কে ফোন করে বাসার ঠিকানা বলে দিলো। পেটে ক্ষুধা আর লম্বা ঘুমের পর ফোলা ফোলা চোখ মুখ নিয়ে বের হল সে। মনেমনে আজ দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করল, মিটিংয়ে নিশ্চয়ই পান্নাবাহারও আসবে। সে তার সঙ্গে স্বাভাবিক আচরণ করবে, অতীতের সবকিছু ভুলে যেতে হবে তাকে।

গেটের বাইরে একটা কালো রঙের গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে। গাড়ির গ্লাস নামিয়ে যে লোকটা তার সঙ্গে কথা বলল, তাতে রীতিমতো ভিড়মি খাওয়ার জোগাড় হল তার। এ তো পান্নাবাহার নিজে!

জাহ্নবীর মনটা বিরক্তিতে ভরে গেল। মাত্রই সে এই লোকের কথা ভাবছিল। গাড়িতে উঠে বসতে বসতে জাহ্নবী জিজ্ঞেস করল, 'আপনার নাম সারল্য?'
'হ্যাঁ। আপনি জানতেন না?'
'না। জানলে কি আর এত চমকাতাম?'

পান্নাবাহার হেসে বলল, 'আপনি কী অন্য কাউকে আশা করেছিলেন?'
'তা নয়। আমি আসলে আপনার নামটা জানতাম না। বাসার নিচে কে অপেক্ষা করছে সেটা সম্পর্কে কোনো ধারণাই ছিল না আমার।'
'ওহ।'

সারল্য অঅর্থাৎ জাহ্নবীর পান্নাবাহার গাড়ি স্টার্ট দিয়েছে। গলি পেরিয়ে মেইন রাস্তায় এসে উঠল গাড়ি। সারল্য'র মুখে সম্ভবত চুইংগাম। দ্রুত চিবোচ্ছে সে।
জানতে চাইলো, 'আপনি কি খুব চুপচাপ প্রকৃতির?'
'হুম।'
'আমিও চুপচাপ প্রকৃতির।'

জাহ্নবী কিঞ্চিৎ ত্যাড়া সুরে উত্তর দিলো, 'আপনাকে দেখে সেটা মনে হচ্ছে না।'
'হা হা হা। পরিচিত কারও সাথে আমি অতটাও চুপচাপ থাকতে পারিনা।'
'আমি আপনার পরিচিত?'

সারল্য মুখ টিপে হেসে বলল, 'অবশ্যই পরিচিত। আমার মেয়ের কাছেও আপনি পরিচিত। ওকে পিৎজা খাইয়েছেন। সে এখন চেনে আপনাকে।'

জাহ্নবী চোয়াল শক্ত করে বসে রইল। এই বিরক্তিকর পথটা কখন শেষ হবে সেই প্রহর গুণছে সে। দ্রুত ফুরিয়ে যাক পথ। লোকটার পাশে বসে থাকতে খুব অসহ্য লাগছে তার। 

পথকে দ্রুত ফুরাতে বললে সে আরও দীর্ঘ হয়ে যায়। আজও তাই হল। জ্যাম আর সিগন্যালে বসে থাকতে থাকতে অসহ্যকর হয়ে উঠল সব। জাহ্নবীর করুণ মুখ দেখে কিছু একটা আন্দাজ করতে পারল সারল্য। সে জানতে চাইলো, 'কোনো প্রবলেম হচ্ছে আপনার?'
'না।' মুখ কঠিন রেখেই উত্তর দেয় সে। 
'আমার মনে হচ্ছে কোথাও একটা সমস্যা আছে। আচ্ছা দুপুরে কী খেয়েছেন?'
'কিছু খাইনি।'
'সে কী! কেন?'
'আপনার ফোন পেয়েই ঘুম ভেঙেছে আজ। এই প্রথম আমি এত দীর্ঘ সময় ঘুমালাম। রান্না করা ছিল না। খেতে হলে রান্না করে খেতে হবে।'
'আপনি একা থাকেন?'
'হ্যাঁ।'
'মা কিংবা শাশুড়ীকে সঙ্গে রাখতে পারেন। হাজব্যান্ড রান্না করে দেয় না?'

জাহ্নবী একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল পান্নাবাহারের দিকে। মন আনচান করে উঠল তার। এই বয়সী একটা মেয়ের স্বাভাবিকভাবেই স্বামী, সন্তান, শ্বশুরবাড়ির মতো বিশাল পরিবার নিয়ে আনন্দে থাকার কথা। তাকে দেখলে নিশ্চিতভাবেই বিবাহিত মনে হয়। সে তো সিনেমার নায়িকা নয়। বয়সের ছাপটা তার চেহারায় যথেষ্টই ফুটে আছে।

জাহ্নবী বলল, 'আমি বিয়ে করিনি।'
'সত্যি! আরে বাহ। আপনি তো দারুণ মজার জীবন কাটাচ্ছেন তাহলে।'

জাহ্নবী মুখ ঘুরিয়ে সামনের দিকে তাকাল। জ্যাম ছাড়ার নাম নেই। তবে এখন বসে থাকতে বিরক্ত লাগছে না। মজার জীবন কাটানোর কথা শুনে তার হাসতে ইচ্ছে করছে। এই জীবনটা কোনো অর্থেই তার কাছে মজার নয়। ভীষণ তিক্ত একটা জীবন তার। একাকীত্ব, সমাজের লোকদের কটু কথা আর মায়ের চোখের কাটা হয়ে এতদিন বাঁচতে হয়েছে তাকে। একটা ছেলের কাছে এই জীবনটা যতটা সুন্দর মনেহয়, একটা মেয়ের কাছে ততটাই যন্ত্রণার। 

জাহ্নবী দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। ছেড়ে দিয়েছে জ্যামও। দ্রুত ছুটল গাড়ি। পান্নাবাহারের চুইংগাম চিবানো এখনও থামছে না। এই একটা চুইংগাম সে অনেক্ষণ ধরে চিবোচ্ছে। জাহ্নবী মাঝেমাঝে তার দিকে তাকিয়ে আবারও দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। পথটা দ্রুত ফুরিয়ে গেল এবার। 

মিটিং শুরু হতে আরো অনেক সময় বাকি। জাহ্নবীকে বসিয়ে রেখে সারল্য উঠে গেল। একা বসে রইল সে। সারল্য'র পরনে সাদা পাঞ্জাবি। খুব সম্ভবত নামাজ শেষ করে বেরিয়েছিল সে। 

একজন ওয়েটার বিরিয়ানির প্লেটার দিয়ে গেল জাহ্নবী'র সামনে। জাহ্নবী হতচকিত হয়ে জানতে চাইলো, 'আমি তো খাবার অর্ডার করিনি?'
'স্যার দিতে বলেছেন।'
'সাদা পাঞ্জাবি পরা স্যার?'
'জি ম্যাডাম।'

জাহ্নবীর মন কৃতজ্ঞতায় ভরে গেল। মানুষটা ভীষণ ভালো। তার এইমুহুর্তে খাবারের খুব প্রয়োজন ছিল। নিজেই বসে বসে ভাবছিল কিছু খাবে কী না। এদিকে লোকজন খুব একটা আসে না। জায়গাটা রেস্তোরাঁর তবে মূল রেস্তোরাঁ থেকে বিভক্ত। এটা সম্ভব ভিআইপি জোন, প্রত্যেকের আলাদা করে বুকিং করতে হয়। 

জাহ্নবী আশেপাশে একবার তাকিয়ে খেতে শুরু করল। পান্নাবাহারকে খেতে বলা উচিত। অপেক্ষা করেও লাভ হল না। এলো না সে। জাহ্নবী একা একাই খাবারটা খেয়ে নিলো। এর ফাঁকে ওয়েটার এসে জানতে চাইলো আরও কিছু লাগবে কী না। দুইটা কোল্ড ড্রিংকস দিতে বললো জাহ্নবী। তবে একটা ড্রিংকস রেখে দিল সারল্য'র জন্য। 

খাওয়া শেষ করে জাহ্নবী চুপচাপ বসে রইল। সারল্য আর এলো না। একেবারে নাদির স্যার সহ চলে এলো সে। জাহ্নবী নাদিরের সামনে ওকে ধন্যবাদ দিতে পারল না। নাদির জানতে চাইলো, 'কী অবস্থা?'
'এইতো স্যার ভালো।'
'বোন, দোহাই লাগে এখন আমাকে স্যার বইলো না। উই আর ফ্রেন্ডস।'
'ওকে স্যার।'
'মাইর দিবো মেয়ে একটা।'

জাহ্নবী ফিক করে হেসে ফেলল। নাদির আরও দুজন বন্ধুকে রিসিভ করতে গেলে জাহ্নবী সারল্যকে বলল, 'ধন্যবাদ।'
'স্বাগত।'
'এটা আপনার জন্য দিতে বলেছিলাম।'
জাহ্নবী কোমল পানীয়ের বোতলটা এগিয়ে দেয় সারল্য'র দিকে। সে সহাস্যে বোতলটা নিয়ে বলল, 'থ্যাংক ইইইউউ।'

কৃতজ্ঞতাসূচক হাসলো জাহ্নবী। অদ্ভুত ব্যাপার, এই মুহুর্তে তার একটুও অস্বস্তি কিংবা বিরক্তি হচ্ছে না। বরং পান্নাবাহারকেও তার একজন বন্ধু বলে মনে হচ্ছে। সারল্য, কী সুন্দর নাম! মানুষটার বিশুদ্ধ চেহারার মতোই তার নামটা। ওনার অপূর্ব মুখে সরলতার প্রতিচ্ছবি। 

নাদিরের ব্যবসা সংক্রান্ত মিটিং শেষে খাবারের অর্ডার দেয়া হল। জাহ্নবী সহজ হতে চেষ্টা করছে সবার সঙ্গে। তাদের পাঁচ জনের টিম। এই টিম নিয়েই নাদির শুরু করতে যাচ্ছে নিজের বহুল প্রতিক্ষীত ব্যবসা। জাহ্নবী খুব উত্তেজিত বোধ করছে। খুব শীঘ্রই তারও এমন একটা নিজস্ব ব্যবসা হবে। তারা দুই বোন মিলে কাজ করবে সেখানে। অনেক গুলো কর্মচারী তাকে 'আপা' বলে ডাকবে। ভাবলেই আনন্দের শিহরণ বয়ে যায় তার মাঝে। 

রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে জাহ্নবী সারল্য'র কথা ভেবে হাসছিল। ফোনে ছেলেটার কণ্ঠস্বর একদমই আলাদা। চিনতে পারেনি সে। বাসার সামনে তাকে দেখে কী আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিল জাহ্নবী! তাকে মনের মানুষের আসন থেকে সরিয়ে বন্ধুর আসনে বসাতে পেরে জাহ্নবী'র বেশ হালকা লাগছে। 

সামারের মনটা আজ খুবই ভালো। দুদিন আগে আরজুর সঙ্গে ঝগড়া শুরু হয় তার। সেদিন অর্ণবের সঙ্গে কেনাকাটা করতে দেখে প্রচণ্ড রেগে গিয়েছিল আরজু। অর্ণবের সাথে তার বিয়ের কথাবার্তা হওয়ার ব্যাপারটা সামারই তাকে বলেছে। ব্যস, তারপর থেকেই অর্ণব শত্রু হয়ে গেছে আরজুর। নিজের প্রিয়তমাকে হবু জামাইয়ের সঙ্গে দেখলে যে কারোরই মাথা খারাপ হবে। তার মাথা ঠিক করতে দুদিন সময় লেগে গেছে সামারের। অবশেষে আজ ঝগড়া মিটিয়ে আবারও সবকিছু ঠিক করতে পেরে সামার আনন্দে ঝলমল করছে। 

কিন্তু আনন্দ বোধহয় তার কপালে সইছে না আজকাল। জাভেদ আলী মেয়েদের ডেকে জানালেন, আগামী পরশু আমরা সবাই মিলে চিটাগাং যাচ্ছি, অর্ণবদের বাসায়।

আকাশ থেকে পড়ল সামার। নিজেকে সামলে নিতে পারল না সে। রেগে আগুন হয়ে জানতে চাইলো, মানে কী এসবের?
'তোর শাশুড়ী বারবার করে ডাকছেন। পারভীনও চাইছে ওনাদের বাড়িটা দেখে আসতে। তাছাড়া তোর মা অনেকদিন কোথাও ঘুরতে যায় না। চট্টগ্রাম জায়গাটা দেখে আসুক।'
'তাহলে মাকে নিয়ে যাও। আমরা কেন?'
'পাগলী মা আমার। রাগ করছিস কেন? অর্ণবও যাবে তো। আমরা যাচ্ছি অথচ হবু ছেলের বউ যাবে না, সেটা ওনারাই বা মানবে কেন।'

সামারের ইচ্ছে করল বাবার মুখের ওপর কড়া করে কিছু কথা শুনিয়ে দিতে। কিন্তু বাবাকে আঘাত দিয়ে কথা বলতে পারবে না সে। জাভেদ আলী ভীষণ নরম মানুষ, ভালো একজন বাবা। ঝামেলাটা সামার নিজেই পাকিয়েছে। এখন বাবার সঙ্গে রাগ দেখিয়ে লাভ নেই। বাবা জানেন তিনি মেয়ের নিজের পছন্দ করা ছেলের সঙ্গে বিয়ে ঠিক করেছেন। হুট করে তাকে কিছু বলে ফেলা অন্যায়। 

সামার বেশ বুঝতে পারছে সবকিছু তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। এর লাগাম টেনে ধরতে না পারলে সত্যি সত্যি অর্ণবের সঙ্গে তার বিয়ে হয়ে যাবে। যা করার তাকেই করতে হবে। চট্টগ্রাম গিয়ে ওর পরিবারের সঙ্গে কথা বলে বিয়েটা যেভাবেই হোক ভেঙে ফেলতে হবে তাকে। কিন্তু অর্ণবের বাসায় যাওয়ার ব্যাপারটা কিছুতেই আরজুকে জানানো যাবে না। 

সোমবার রাতে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে বাসা থেকে রওনা দিলো তারা। কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে আগে থেকেই অপেক্ষা করছে অর্ণব। সেদিনের ঘটনার পর সে এখনও সামারের সামনে দাঁড়াতে লজ্জায় নীল হয়ে যাচ্ছে। 
একটা কেবিন বুক করা হয়েছে। সামার ও ভায়োলেটের ট্রলিটা অর্ণব নিজ দায়িত্বে ট্রেনে তুলে দিচ্ছে দেখে ভেতরে ভেতরে রাগ হল সামারের। পারভীন ও জাভেদ আলী একই আসনে বসলেন। মুখোমুখি আসনে বসলো সামার ও ভায়োলেট। সামার ফোনের স্ক্রিনে মত্ত হয়ে উঠেছে। অর্ণব কেবিনে নেই। হয়তো ট্রেন ছাড়ার পর আসবে সে। কিন্তু শেষে দেখা গেল অন্য একটা বগিতে নিজের আলাদা টিকেট কেটেছে সে। এটা শুনে বেশ স্বস্তি পেলো সামার। 

ট্রেন ছাড়ার কিছুক্ষণ পর অর্ণব কেবিনে এলো। সঙ্গে করে খাবার ও চাওয়ালাকে নিয়ে এসেছে। পারভীন ওর কর্তব্যপরায়ণ ভাব দেখে অভিভূত। তিনি আড়চোখে সামারকে লক্ষ করছিলেন। কিন্তু মেয়ের চোখে অর্ণবের প্রতি কোনো প্রেম দেখতে না পেয়ে যারপরনাই চিন্তিত তিনি। 

অর্ণব কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলে সামারও সঙ্গে বের হল। পেছন থেকে ডাকল ওকে, 'শুনুন।'
অর্ণব এগিয়ে এসে বলল, 'সরি।'
'কেন?'
'সেদিনের জন্য।'
'বাদ দিন। এখন যেটা বলবো সেটা শুনুন। আপনার বাড়িতে গিয়ে আসল ঘটনা আংকেল আন্টিকে খুলে বলবেন। আমাদের মধ্যে কোনো প্রেম, ভাললাগা কিচ্ছু নেই। আমরা কোনো বিয়েশাদির মধ্যেও নেই।'
'আচ্ছা।'

শুকনো মুখে উত্তর দিলো অর্ণব। সামার রেগে বলল, 'আপনি এমন ক্যান?'
ড্যাবড্যাব চোখ করে অর্ণব সামারের দিকে তাকাল। সামার বলল, 'বোকা, হাবাগোবা, বিদঘুটে একটা ছেলে আপনি। আমি এ ধরনের মানুষজন একদমই সহ্য করতে পারিনা।'
'আমাকে সহ্য করারও দরকার নেই। যেভাবে সবসময় খারাপ আচরণ করেন, সেভাবেই করুন। আর বেশী দিন তো আমাকে পাবেন না।'

সামার এবার সত্যিই ভীষণ লজ্জিত অনুভব করল। অর্ণবের সাথে করা তার খারাপ আচরণ গুলো স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠল চোখের সামনে। কিছু বলতে পারল না সে।

অর্ণব বলল, 'সত্যিটা প্রকাশ পেলে আপনার মা আর আমার মুখ দেখতে চাইবে না বলেছেন। আমিও আর মুখ দেখাতে কখনো যাবোনা আপনাদের বাড়িতে। সবকিছু শেষ হয়ে যাবে। আর একটু সহ্য করুন। হাতজোড় করে বলছি।'

সামার লজ্জায় মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকায়। তারপর একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, 'ওয়াশরুম কোনদিকে?'
'আসুন।'
ওয়াশরুমে প্রবেশ করল সামার। অর্ণব ট্রেনের দরজা ধরে দাঁড়িয়ে রইল। সামার বেরিয়ে এসে দাঁড়ায় তার পাশে। শীতল বাতাসে সাঁইসাঁই করে উড়ছে তার চুল। অন্ধকার রাতের শহর ছেড়ে ছুটে চলেছে তূর্ণা এক্সপ্রেস। হঠাৎ করেই ভালো লাগতে শুরু করল সামারের। দীর্ঘদিন পর ট্রেনে উঠেছে সে। তিক্ত মেজাজ ঝেড়ে ফেলে ভ্রমণটাকে উপভোগ করতে লাগল।

অর্ণব বলল, 'ঠাণ্ডা লাগবে। কেবিনে যান।'
'আর একটু দাঁড়াই।'
'আচ্ছা।'
.
.
.
চলবে.........................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp