মেঘফুল - পর্ব ৪৭ - মিশু মনি - ধারাবাহিক গল্প


পারভীনের করুণ দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে অর্ণবের মনে মায়া হলো। তিনি সন্তানের মতো স্নেহের ডোরে বেঁধেছেন অর্ণবকে। পরম মমতায় তাকে আপন করে নিয়েছেন। আজকের পর থেকে হয়তো আর এই সম্পর্কটা থাকবে না। অর্ণব গুটিগুটি পায়ে ঘরে প্রবেশ করে পারভীনের পাশে বসল। 

পারভীন মানুষের সঙ্গে মিশতে অভ্যস্ত নন। তবুও অর্ণব পাশে বসামাত্র ওনার হৃদয়ে মায়ার উদ্রেক হলো। এই ছেলেটাকে সবসময়ের জন্য নিজের ছেলে বানিয়ে ফেলার সাধটাকে বুঝি তার মেয়েটা পূরণ হতেই দেবে না। তিনি একটা ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে অর্ণবের দিকে তাকালেন।

অর্ণব মাথা নিচু করে মৃদু স্বরে বলল, 'আন্টি আমাকে ক্ষমা করবেন। আপনি হয়তো এতক্ষণে সবকিছু শুনেছেন। আসলে সব দোষ আমার। আমি একটা বোকা ছেলে। আপনার মেয়ের কথা বুঝতে পারিনি আমি। সবকিছু গোলমাল পাকিয়ে ফেলেছি। কিন্তু এটা আমাকেই সমাধান করতে হবে। জীবনটা তো আর নাটকের মতো না। আমরা দুজন দুজনকে চাইনা, কেউ কাউকে পছন্দ করিনা, মিছেমিছি আমাদের বিয়ে দিয়ে দুজনের জীবনটা নষ্ট করে দিবেন না আন্টি।'

অর্ণব কথাটা বলতে গিয়ে বুঝতে পারল তার গলা কাঁপছে। কারণ শেষ বাক্যটা মিথ্যে ছিল। সামার তাকে পছন্দ করেনা সত্যি, তবে সে হৃদয়ের গহীন অরণ্যে ছোট্ট কুঁড়েঘর বানিয়েছে সামারের জন্য। গত কয়েকদিনে কাছ থেকে দেখার পর সামারের প্রতি তীব্র প্রেমের বাসনা জেগে উঠেছে তার। সে সামারকে চায়, এমনকি এখনও মনেমনে সে চাইছে, দূর্ঘটনার মতো তাদের বিয়েটা হুট করে হয়ে যেত যদি!

সামারের চোখে নায়ক সাজার জন্য পারভীনের কাছে এসে কথাগুলো স্বীকার করে নিলো অর্ণব। এতে হয়ত তাদের বিয়েটা হবেনা, তবে সামারের মনে নিশ্চয়ই তার জন্য একটা সহানুভূতির জায়গা তৈরি হবে। ভালবাসার তৃষ্ণা মানুষকে বাস্তবতা থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়। অর্ণবের মাঝেও ভর করেছে সেই তৃষ্ণা। সামারকে পাওয়ার আশা সে ছাড়বে না।

বিনয়ের সুরে অর্ণব বলল, 'আপনি আমাকে ছেলের মতো আপন করে নিয়েছেন আন্টি। আমি আপনার ছেলে হয়ে থাকবো। আমাদের সম্পর্কটা হাজার বছর স্থায়ী হোক সেই দোয়া করি। কিন্তু সামারের ইচ্ছের বিরুদ্ধে আপনি প্লিজ ওর ওপর কিছু চাপিয়ে দেবেন না।'
পারভীন স্থির চোখে অর্ণবকে দেখছেন। এই বিনয় মুগ্ধ করছে তাকে। তিনি গম্ভীর স্বরে বললেন, 'এতদিন কথাগুলো আমাকে বলো নাই কেন তোমরা? আমাদেরকে সহজ সরল পেয়ে এভাবে মিথ্যাচার করে গেছো।'
'ভুল বুঝবেন না আন্টি। আসলে আমি বিষয়টাকে গোলমেলে পাকিয়ে ফেলেছি। আব্বা আম্মাকে কষ্ট দিতে চাচ্ছিলাম না। পরে কিছু একটা বলে ওনাদেরকে ম্যানেজ করা যাবে সেই আশায়..'

অর্ণব আর কিছু বললো না। সামার এসে দাঁড়িয়েছে দরজায়। তার উপস্থিতি বুঝতে পেরে মাথাটা আরও নিচু করে ফেললো অর্ণব। ভদ্রতার সঙ্গে বলল, 'আন্টি আমি সবাইকে ম্যানেজ করবো। আপনারা সামারকে কিছু বলবেন না। ওকে ওর পছন্দের ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিবেন। তাতে ও সুখী হবে। মেয়ে সুখী হোক সেটা তো সব বাবা মায়েরাই চান।'

সামার ভেতরে ঢুকে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে পারভীনের দিকে তাকিয়ে রইল। তার মাকে দেখে এখন অসুস্থতায় শয্যাশায়ী মানুষের মতো মনে হচ্ছে। কী অসহায় দেখাচ্ছে ওনাকে! সামার জানেনা এরপর ওনার শারীরিক পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে। অনাকাঙ্ক্ষিত এই পরিস্থিতি যেন খুব দ্রুত সমাধান হয়ে যায়।

অর্ণব বলল, 'আন্টি, প্লিজ কষ্ট পাবেন না। আমাকে মাফ করে দিন।'
অর্ণব উঠে দাঁড়াল। এরপর পারভীন কী বলবেন তা জানেনা সে। কিছু বললেও সেটাকে সামলে নেয়ার মতো শক্তি তার নেই। তাই যত দ্রুত সম্ভব এখান থেকে সরে যেতে চায় সে। সবকিছু সময়ের ওপর ছেড়ে দেয়াই এখন সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্ত। 

অর্ণব ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে সামার ভায়োলেটকে বলল, 'আমার সঙ্গেই সবসময় কেন এমন হয় বলতো?'
সামারের হাত ধরল ভায়োলেট। মৃদু স্বরে বলল, 'সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে আপু।'

পারভীনের দৃষ্টি সিলিংয়ের দিকে। তিনি ভাবছেন কীভাবে আত্মীয় স্বজনদের মুখ দেখাবেন। সবার কাছে তাকে কথা শুনতে হয়। কোনো অনুষ্ঠানে যেতে পারেননা এসবের ভয়ে। মেয়েদের বিয়ে না দিয়ে তিনি যেন জীবনের সবচেয়ে বড় অন্যায়টা করেছেন। কিন্তু তিনি কীইবা করতে পারেন। যার জীবন, সিদ্ধান্তটা তো তারই নেয়া উচিৎ। 

সামার বলল, 'আম্মু, আমাকে দোষারোপ করতে পারবা না। আমি বিয়ে করতে রাজি হইছি। অর্ণবকে বলছি বিয়ের আয়োজন করতে। এখন সেই বিয়ে করতে চাচ্ছে না। এটা কিন্তু আমার দোষ না।'
পারভীন চুপ করে রইলেন। সামার চুপ থাকতে পারল না। সে আবারও বলল, 'আমি চাইনা আমার জন্য কেউ মরুক। আমাকে নিয়ে কারও না ভাবলেও চলবে।'
ভায়োলেট সামারের হাত চেপে ধরে বলল, 'চুপ কর আপু।'

সামার মুখে কাঠিন্য এনে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। বাড়িতে মেহমান গিজগিজ করছে। কারও সাথে দেখা হলেও বিরক্ত লাগছে তার। সিঁড়ি বেয়ে সোজা ছাদে চলে গেল সে। মেজাজটা অন্তত ক্ষিপ্ত।

ভায়োলেট অর্ণবের কাছে এসে বলল, 'আমার আপু একটু অবুঝ। ও হয়তো আপনাকে উল্টাপাল্টা কিছু বলে ফেলবে। হয়তো এতক্ষণে বলেও ফেলেছে। আপনি কিছু মনে করবেন না। তবে আমি বলবো, বিয়েটা আটকান। আপনার বাসায় কিছু জানানোর দরকার নেই। আমার মা বাবা সত্যিটা জেনে গেছেন। আমি ওনাদের চিনি। একটু পরেই সব শান্ত হয়ে যাবে। মা অভিমানী মানুষ, আপুও অভিমানী মেয়ে। তারা একে অপরের সঙ্গে রেগে থাকবে, এতটুকুই। এর বেশী কিচ্ছু হবে না। আপনি যেভাবে প্লান করে আপনার পরিবারকে সামলাচ্ছিলেন, সেভাবেই আগান। অসুবিধা হবেনা। ধীরেসুস্থে ওনাদেরকে ম্যানেজ করে নিলেই হবে।'

শান্ত গলায় এত সুন্দর করে ভায়োলেট কথাগুলো বলে গেল যে, কঠিন হলেও অর্ণবের ভালো লাগল শুনতে। সে ম্লান হেসে বলল, 'থ্যাংক ইউ ভায়োলেট। আপনি সবকিছু খুব ভালো বোঝেন। আপনার বোনটা যদি বুঝতো!'
ভায়োলেট শুষ্ক হাসি টেনে বলল, 'আপুর একটু মাথা গরম।'
'শুধু মাথা না, ওর সবটাই গরম। এত রাগী, বদমেজাজি মেয়ে আমি আর একটাও দেখিনি।'
'তাও তো আপনি ওকে ভালবাসেন।'
অর্ণব চমকে উঠলো। ভায়োলেটের চোখের দিকে তাকিয়ে এই সত্যটা স্বীকার করতে পারছিল না সে। তাই অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রাখল। কীভাবে বুঝল এই মেয়েটা!

ভায়োলেট বলল, 'আপনাকে একটা কথা বলবো অর্ণব ভাইয়া। পরিস্থিতি শান্ত হোক। সবকিছু স্বাভাবিক হোক। তারপর বলবো।'

ভায়োলেট চলে গেল সেখান থেকে। অর্ণব একটা নিশ্বাস ফেললো। সে সামারকে ভালোবাসে, এটা ভায়োলেটের মুখে শোনার পর কেমন যেন টনটন করছে বুকের ভেতর। সত্যিই সে ভালবাসে সামারকে। শেষ পর্যন্ত সে সামারকে প্রাপ্তির চেষ্টা অবশ্যই করবে। 
অর্ণব রান্নাঘরে ঢুকে তার মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, 'আম্মা, শুনলাম আজ নাকি আমার বিয়ে দিতে চাও?'
'সবাই বলছিল। আমরা সামারের মাকে জানিয়েছি। দেখি ওনারা কী বলেন।'
'আম্মা, আমি আপনার একমাত্র ছেলে। ভালো চাকরি পাইছি। এইভাবে আমি বিয়ে করতে চাই না। আগে আমাকে একটু গোছাইতে দাও। দেখবা আমার আম্মাকে আমি রানীর মতো রাখবো। খুব ধুমধাম করে সবাইকে জানিয়ে বিয়ে করবো।'
'এখন কাবিন করে রাখ। অসুবিধা কী? পরে সময়মত বিয়ে উঠাইয়া নিবো।'
'না গো আম্মা। কাবিন করলে আমার ওপর প্রেশার আসবে। বিয়ের পর আগের মতো কিছুই হয় না। আমি টাকা পয়সা, চাকরি কিছুই গোছাইতে পারবো না। আগে একটু গোছাইতে দাও আমাকে।'
'আচ্ছা বাবা, তুই যা ভালো মনে করিস।'
অর্ণব মায়ের মুখখানা ধরে তার মাথায় একটা চুমু খেয়ে বলল, 'খিদা লাগছে। কিছু খাইতে দাও। আর ওদেরকে একটু নাস্তা দাও। অনেক্ষণ সবাই না খেয়ে আছে।'
'আচ্ছা দিচ্ছি। তুই বস।'

অর্ণব স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। সামার তাকে ভরসা করেছিল। শেষ পর্যন্ত এই বিশ্বাসের মর্যাদা রাখতে পেরেছে সে। আগামীকাল এখান থেকে সসম্মানে চলে গেলেই আর ঝামেলা নেই। বাকিটা নাহয় সময়ই বুঝে নেবে। তার হঠাৎ মনে পড়ল সামারের কথা। রাগে আগুন হয়ে কোথায় গেল মেয়েটা!

নাস্তার টেবিলে বসে জাহ্নবী সারল্যকে বলল, 'আমাকে এক্ষুনি বের হতে হবে। অফিসে দেরী হয়ে যাচ্ছে।'
'দেরী হতে দিচ্ছে কে? আপনাকে অফিসে পৌঁছে দেয়ার জন্যই তো এত সকাল সকাল উঠলাম।'

মুচকি হাসলো জাহ্নবী। গত রাতে সারল্য'র বারান্দায় দাঁড়িয়ে কত গল্প করেছে ওরা! জীবনের গল্প, অতীতের গল্প, কত সুখ, ব্যথার গল্প। একটি রাতই দুজনকে এনে দিয়েছে আরও অনেক অনেক কাছে। মনের এত কাছাকাছি থাকা মানুষটাকে বাস্তবতায় কাছাকাছি পেয়ে জাহ্নবীর স্বপ্ন স্বপ্ন লাগে সবকিছু। 

সারল্য বলল, 'আপনি শাড়িটা চেঞ্জ করলেন কেন? ওটা পরেই অফিসে চলে যেতেন।'
'মাথা খারাপ? আমি শাড়ি পরে অফিসে যাবো?'
'হ্যাঁ। এখন তো মেয়েরা শাড়ি পরে ইউনিভার্সিটিতে যায়, অফিসে যায়। আমার মায়ের শাড়িটা আপনাকে ভালো মানিয়েছিল। সত্যি বলতে এর আগে মা ছাড়া কাউকে কখনো মায়ের শাড়িতে দেখিনি।'

লাজুক ভঙ্গীতে হাসলো জাহ্নবী। কথাটা শুনতে বড্ড ভালো লেগেছে তার। মনটা ফুরফুরে হয়ে গেল মুহুর্তেই।
সারল্য তার মাকে ডেকে বলল, 'আম্মু তোমার শাড়িটায় জাহ্নবীকে ভালো মানিয়েছে। ওটা ওকে দিয়ে দাও।'
জাহ্নবী তৎক্ষনাৎ বলে উঠল, 'আরে না না। আমি খুব কম শাড়ি পরি। আমার লাগবে না খালা।'

সারল্য বলল, 'না আম্মু, তুমি ওকে দিয়ে দাও। তোমার তো অনেক শাড়ি।'
সারল্য'র মা মুচকি হেসে জাহ্নবীর পাশে এসে দাঁড়ালেন, 'নিয়ে যাও মা। সারল্য এত করে বলছে যখন।'
'খালা, লাগবে না।'
'আমি দিচ্ছি তুমি নাও। তুমি আমাকে খালা বলে ডাকছো না? খালার তরফ থেকে উপহার মনে করে নাও।'

জাহ্নবী এবার আর না করতে পারলো না। সারল্য'র মা ঘরে গিয়ে একটা কাগজের ব্যাগে শাড়িটা তুলে দিলেন জাহ্নবী'র হাতে। কৃতজ্ঞতায় ওনাকে জড়িয়ে ধরে জাহ্নবী বলল, 'আমাকে মায়ায় জড়িয়ে ফেললেন খালা।'
'মাঝেমাঝে আইসো বাসায়। খালাকে দেখতে, কেমন?'
জাহ্নবী লাজুক হেসে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, 'আসবো খালা।'
আরও একবার মহিলাকে আলিঙ্গন করে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল জাহ্নবী। এখন তাকে বের হতে হবে। সারল্য চা শেষ করে অপেক্ষা করছে তার জন্য। 
.
.
.
চলবে......................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp