আরশির প্রতিমুখে - নবনীতা শেখ - অনু গল্প


          পড়াশোনা সম্পূর্ণ করে অথবা মাঝপথেই ছেড়ে দিয়ে প্রায় সব বন্ধুরাই এখন সংসারী; দেখা-সাক্ষাৎ নেই বললেই চলে। সিঁথির খুব মনে পড়ল—সেই স্বর্ণালি দিনগুলোর কথা। তারপর আর না ভেবে, হুট করেই যোগাযোগে থাকা গুটিকয়েক বন্ধুদের সামনে প্রস্তাব রাখে—রিউইউনিয়নের।

মনের সূক্ষ্ম শূন্যতা থেকে এই পরিকল্পনা জপলেও, সাড়া পায় ভাবনাতীত। আস্তে-ধীরে সব বন্ধুদের কন্ট্যাক্ট নম্বর জোগাড় করে জানাতে গিয়ে দেখল—বাকিরা তার চেয়েও অধিক উৎসাহী। 

ক্লাসের সবচেয়ে পড়াকু থেকে শুরু করে, শেষের দিক থেকে প্রথম স্থান উত্তীর্ণ করা প্রায় সব বন্ধুরাই আসছে। খুশিমনে এখন সবাইকে কল দিয়ে ডেট জানাচ্ছে সিঁথি। কাগজের লিস্টটিতে থাকা নম্বরদের ভীড়ে একটি নম্বর তার মনোযোগ নিগূঢ়ভাবে আকর্ষণ করল। নম্বরটি তার কৈশোরের প্রিয় সখী—ইন্দুপ্রভার!

সাংসারিক জীবনের ব্যস্ততার জন্য আর একে-অপরের খোঁজ নেওয়ার অবসর পায়নি। তাই-তো পুণর্মিলনের অছিলায়, গুটিকতক বসন্ত পার হওয়ার পর গত সপ্তাহে তাদের কথা হলো। কথা শুরুর প্রথম ঘন্টা-খানেক, আবেশে দুই সখী কেবল কেঁদেই গিয়েছিল। তারপর থেকে প্রায়শই কথা হয়।

সিঁথি আজ আবার কল লাগাল। শেষ রিং হয়ে কেটে যাওয়ার আগ-মুহুর্তে কল রিসিভ হলো। ওপাশ থেকে মিষ্টি একটি আওয়াজ এলো, “স্যরি-রে! সোনাইকে স্নান করাচ্ছিলাম। এজন্য ফোন ওঠাতে দেরি হয়ে গেল!”

সিঁথি বলল, “সমস্যা নেই। শোন, ডেইট ফিক্সড হয়ে গেছে!”

“ওহ্ তাই? কবে? কোথায়?”

“শুক্রবারে, আমাদের এমসিসি ক্যাম্পাসে।”

“এই শুক্রবারে?”

“হ্যাঁ। আসতে পারবি না?”

“আসব তো! না আসতে পারলেও আসব!”

সিঁথি হেসে উঠল, রঙ্গ করে বলল, “আচ্ছা ইন্দু, তোর বর মানা করলে?”

“সুব্রতকে তুই চিনিস না, ও কক্ষনও কোনো কাজে মানা করে না আমায়।” —গর্ব করে বলল ইন্দুপ্রভা। সিঁথি আরও কিছু বলতে যাবে, সাথে সাথে বাচ্চার কান্নার আওয়াজ ভেসে এলো ওপাশ থেকে। ইন্দুপ্রভা তড়িঘড়ি করে বলল, “খিদে পেয়েছে ওর, আমি খাইয়ে নিই।”

সিঁথি ‘আচ্ছা’ জানিয়ে কল কেটে দিলো। এরপর বাকি সবাইকে কল করতে লাগল। অনেকটা সময় এগোল। রাত হয়ে গেল। শেষ নম্বরটিতে এসে, লম্বা একটা শ্বাস ফেলে কল লাগাল, রিসিভও হলো তৎক্ষনাৎ।

ওপাশ থেকে ভরাট-গম্ভীর আওয়াজ এলো, “হ্যাঁ, সিঁথি! বলো।”

সিঁথি হেসে বলল, “ভালো আছ, দিব্য?”

দিব্য হাসল, “হ্যাঁ, আছি। তোমার খবর বলো!”

“ভালো ভালো।”

“আচ্ছা! বেবি কী করছে?”

“ওর নানুর কাছে আছে। শোনো, যার জন্য কল দিলাম! আমাদের রিইউনিয়নের ডেইটটা শুক্রবারে পড়েছে।”

“গ্রেট! সবাই আসছে?”

“যাদের সাথে কন্ট্যাক্ট করতে পেরেছি, তারা সবাই আসছে।”

“ওহ্!”

“তুমি কি স্পেসিফিক কারোর খবর চাইছ?”

ধরা পড়ে গিয়ে অপ্রস্তুত হাসল দিব্য, “এমনি আর কী!”

মলিন হেসে সিঁথি জানাল, “হ্যাঁ, ও আসছে ওদিন।”

দিব্যর হাসিকে প্রশস্ত করে দিতে এই শব্দ ক'টাই যথেষ্ট ছিল।

••••••••••••

শুক্রবার, এমসিসি প্রাঙ্গণ। 

আনাচে-কানাচেতে উৎসবমুখর আনন্দ। সবটা দেখে সিঁথি অবাক হচ্ছে। একসময়ের ক্লাসের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটির চোখের নিচে এক ইঞ্চি পুরু কালো দাগ, মুখ ভর্তি ব্রণের নিদর্শন, শরীরটাও মুটিয়ে গিয়েছে; চোখ-মুখে হতাশা আর জীবনের প্রতি প্রবল বিতৃষ্ণা। সবচেয়ে পড়াকু ছেলেটা বেকারত্বকে আপন করেছে, চাকরি পায় না। ব্যাকবেঞ্চার ছেলেটা! একসময় প্রতিটি ক্লাসে দাঁড়িয়ে থাকত, মার খেতো, বকা খেতো! প্রতিটি টিচারের কাছে শুনেছে, ‘তোর দ্বারা কিচ্ছু হবে না’, সেই ছেলেটি আজ দেশের সেরা দশজন বিজনেসম্যানের একজন। 

ক্লাসের সবার আইডল ছিল যেই প্রেমিক-যুগল, তাদের দুজনের আজ দুটো ভিন্ন সংসার। একসময় যেই ছেলেটা একাধিক প্রেমে মশগুল থাকত, সে আজ দিনে এখন অবধি কোনো মেয়ের চোখের দিকে তাকায়নি, সেই যে মাথা নিচু করে রেখেছে; এই নিয়ে প্রশ্ন করায়, জবাবে বলেছে—‘আমার সুন্দরী বউ মান করে গাল ফুলোবে’। 

আর সবচেয়ে বেশি চমকিত হয়েছে, তারা একে-অপরকে সেই আগের মতো ‘তুই’ সম্বোধন করতে না পেরে। অথচ, একসময় কত অনয়াসে তুইতোকারির সাথে হেসে-খেলে গালি দিয়ে দিত। 

দিব্য এগিয়ে গিয়ে সিঁথির পাশে দাঁড়াল। প্রশংসা-স্বরূপে বলে উঠল, “অ্যারেঞ্জমেন্টটা দারুণ হয়েছে। শুধু অনুপস্থিতি, চাঁদের আলোর।”

সিঁথি চকিতে বলে উঠল, “এই, তুমি দিনের বেলায় চাঁদের আলো খুঁজছ কেন, বলো তো!”

বিপরীতে দিব্য ঠোঁট চেপে হাসল। তখনই সিঁথির ফোন বেজে উঠল, ইন্দুপ্রভার নম্বর। দ্রুততার সাথে কল রিসিভ করে বলল, “কই তুই? এখনও আসিসনি কেন?”

ওপাশ থেকে ইন্দুপ্রভা বলল, “জ্যাম ছিল রে! এখন গেইটের সামনে আছি, আয় তো!”

সিঁথি ‘আসছি’ বলে, চলে গেল। দিব্য ওখানেই দাঁড়িয়ে ফোনে চোখ রাখল। কিছুক্ষণের মাঝেই গেইট দিয়ে সিঁথির সাথে বাচ্চা-কোলে একজন অসম্ভব সুন্দরী রমনীর প্রবেশ ঘটল। শুভ্রাঙ্গে মেরুন রঙা সুতির শাড়ি। দিব্যর চোখ ওদিকে যাওয়ার পর আর সরানোর ফুরসত পেল না, অপলকভাবে কেবল দেখে গেল। কী সুন্দর দেখাচ্ছে! একদম গ্রহন লাগা চন্দ্রের মতন সুন্দর!

মাত্র করা এই কাজটা চরম অনুচিত জেনেও, নিজেকে আটকাল না সে; তাকিয়ে রইল অনিমেষ। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল তাকে, জীবনে এসে এসেও এলো না যে। আর সবশেষে ইন্দুপ্রভার চোখ এলো ওর দিকে। চোখাচোখির এই মুহূর্তে ইন্দুপ্রভা চমৎকারভাবে হাসল। সিঁথিকে কিছু একটা বলে এগিয়ে এলো ওর দিকে। দিব্য নিজেও এগোল।

মুখোমুখি এবার দুজন। কথার সূচনা করল ইন্দুপ্রভা, “কেমন আছিস, ভাই? কত্ত পালটে গেছিস!”

পরপরই থেমে আবার বলল, “কত্ত অ্যাট্রাক্টিভ হয়ে গেছিস!”

লাগামহীন মুখ তার, দিব্য এতে একসময় অভ্যস্ত ছিল। তাই কেবল হাসল, মাথা চুলকে বলল, “ভালো আছি, তুই?”

“বেশ আছি। তোর দিক থেকে নজরই ফেরাতে পারছি না রে! যখন এইচএসসি দিলাম, তোর দাড়ি তো দূর, গালে লোমই ছিল না! আর এখন কী সুন্দর চাপ দাড়ি! সার্জারি করিয়েছিস নাকি, হুঁ?”

“এতদিন পর দেখা, একটুও পালটাসনি তুই! এখনও সেই আগের মতোই মজা ওড়াচ্ছিস!”

“আমি পালটাইনি ঠিকই, কিন্তু তুই বহুত পালটে গেছিস।”

“সময় পালটে দেয়।”

“স্মৃতিরা আঁকড়ে রাখে।”

“তোকে ধরে রেখেছে? রাখতে পেরেছে?”

“না পারলে তো বদলে যেতাম।”

জবাবে তর্ক হতো, তাই দিব্য এড়িয়ে গেল পালটা প্রশ্নে, “মেয়ে?”

কোলে ঘুমন্ত মাস দশেকের বাচ্চাকে ইঙ্গিত করে প্রশ্নটা করল দিব্য। ইন্দুপ্রভা উপর-নিচ মাথা ঝঁকিয়ে ইতিবাচক সম্মতি প্রদান করল। দিব্য বাচ্চাটির দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে ইন্দুপ্রভাকে শুধাল, “নাম কী?”

ইন্দুপ্রভা মেয়েকে বুকের সাথে আরও মিশিয়ে নিয়ে বলল, “আমার চন্দ্রা।”

বিনিময়ে দিব্য হেসে বলল, “সুন্দর নাম!”

এরপরই আবার বলল, “তোর বরের কী খবর?”

“ভালো রে। ওর মতন মানুষ হয় না। কী যে যত্ন নেয় আমার! ও না থাকলে তো একা হাতে এই দুষ্টকে সামলাতেই পারতাম না!”

“যাক ভালো! এখন থাকিস কোথায়, ইন্দু?”

“থাকি তো ঢাকাতেই। কিন্তু তুই আমাকে ইন্দু ডাকছিস কেন? আগে না ‘চাঁদ’ ডাকতিস?”

“তোর মনেও আছে?” —অবাক হলো দিব্য। রাগ করল ইন্দুপ্রভা, “মনে থাকবে না?”

রাগ দমাতে সময় নিল না। ক্ষণিকেই কমিয়ে নিল, প্রসঙ্গ পালটে ফেলল, “আচ্ছা, তোর বউয়ের কী খবর? হুঁ? বাচ্চা-কাচ্চা কয়টা? তোর না ইচ্ছে ছিল—বিয়ের পর ডজনে ডজনে বাচ্চা নেওয়ার। সেসব ইচ্ছে গেল কই?”

দিব্য যেন মজা পেল এবং নিজেও খানিকটা নিল, “অন প্রসেসিং..”

“ওরে! বউ সুন্দরী খুব, না?”

চোখ টিপে দিব্য বলল, “তোর চেয়েও খু-ব সুন্দরী।”

মুখ ভেঙাল ইন্দুপ্রভা, “হুহ! আমার মতো সুন্দরী দুইটা পাবি? খোঁজ না শহর! পেলেও দেখা পেয়ে যেতে পারিস, বাট নিজের করে পাবি না।”

মিনমিনে স্বরে দিব্য বলল, “এইজন্যই মেবি তোকে পাইনি।”

শুনতে পেল না ইন্দুপ্রভা। শুধাল, “হুঁ?”

জোরপূর্বক হাসল দিব্য, “লাভ ম্যারেজ?”

ইন্দুপ্রভা মুচকি হেসে বলল, “হ্যাঁ।”

“কয়বছর?”

“চার বছরের প্রেম, তিন বছরের সংসার।”

“বেশ লম্বা সময়!”

“বে-শ বেশিই!”

“তোর-আমার চেয়ে বেশি না।”

“এহ্! কীভাবে?”

“প্রথমে ক্লাস ওয়ান-থ্রী অবধি ক্লাসমেট। থ্রীতে তুই সেকেন্ড আর আমি ফার্স্ট হয়ে যাওয়ায়, শত্রুতা শুরু; চলে সিক্স অবধি। সেভেনে গিয়ে ফ্রেন্ডশিপ করি। টুয়েলভ অবধি চলে সেই ফ্রেন্ডশিপ। বারো বছরের রিলেশন! বাহ্! তোর বরের চেয়ে বেশি টাইম স্পেন্ড করেছি আমি তোর পিছে!”

ইন্দুপ্রভা একহাতে মেয়েকে সামলে, অন্যহাতে দিব্যর বাহুতে মেরে বলল, “হ্যাঁ, এই কথা আমার বরের সামনে বলিস।”

“কী করবে তোর টাকলা বর?”

“বেশি কিছু করবে না, জাস্ট পেদাবে ধরে। আর আমার বর টাকলা না, ছাগল! এভারেজ চুল। তবে তোর চুলগুলো অনেক বড়ো। অনেক বেশিই বড়ো। আর..”

“কী?”

“এটাও অ্যাট্রাক্টিভ খুব! কাটিস না, কেমন? সুন্দর লাগে, মানায় তোকে।”

ঘাড় দু'পাশে নেড়ে দিব্য বোঝাল, “অ্যাজ ইউ সে, ম্যাম!”

দূরে দাঁড়িয়ে থাকা হাওয়াই-মিঠাইয়ের গাড়ি দেখে ইন্দুপ্রভা বলে উঠল, “মনে আছে? একবার হাওয়াই মিঠাই খাওয়ার জন্য মাঝ রাস্তায় কী বায়না ধরেছিলাম! সে কী কাণ্ড! মা এখনও মাঝে মাঝে সেসব সুব্রতর সামনে বলে, দুজনে মিলে খুব ক্ষেপায় আমায়। মনে আছে সে-কাহিনিগুলো?”

“মনে না থাকার কথা তো নয়। আমি ভেবেই পাইনি, কোনো ষোড়শী কী করে মাঝ-রাস্তায় হাওয়াই মিঠাইয়ের জন্য কাঁদে! অনেক বাজে ভাবে ফাঁসিয়ে দিয়েছিলি.. ফেঁসে গেছিলাম তোর মাঝে।”

শেষ কথাটি দিব্য বেশ মিনমিনে স্বরে বলল, বুঝতে না পেরে ইন্দুপ্রভা শুধাল, “হুঁ?”

“বুঝবি না, বাদ দে!”

“কীসব বলছিস!”

ইন্দুপ্রভা থামল, এরপর আবার বলল, “বল!”

কথা এড়িয়ে গেল দিব্য, “এমন ভাবে কান্না করছিলি সেবার, যেন আমরা ছেলেধরা! আর তোকে আজীবনের মতো ধরে রাখব আমরা!”

এর মধ্যেই চন্দ্রার ঘুম ভাঙল। জেগে উঠেই কাঁদা শুরু করল। ইন্দুপ্রভা দিব্যকে বলে ওদিকটায় হাঁটাহাঁটি করতে লাগল। দিব্য একদৃষ্টে চেয়ে রইল। অন্যমনস্কভাবে বিড়বিড়িয়ে উঠল, “তুই আমার জীবনে ঠিক সেই হাওয়াই মিঠাইয়ের মতোই মিষ্টি-মায়াবি ছিলি, ভীষণ রকমের আদুরে ছিলি। দূর থেকে তার মেঘবরণ রূপ, নাজুক স্বভাব দেখে আমি কখন যে মায়ায় জড়িয়ে গেলাম, বুঝতেই পারলাম না। ধর্ম ছিল বাতাসের ন্যায়! না-বুঝেই ধরতে গেলাম, ছুঁয়েও যেন হারিয়ে ফেললাম। হাওয়ায় মিশে গেল, আমার হাওয়াই মিঠাই।”

থামল দিব্য। গভীর শ্বাস নিয়ে বলল, “তোর জন্য যেটা বন্ধুত্ব ছিল, আমার দিকে সেটা প্রেম ছিল, চাঁদ। তোকে চেয়েছিলাম অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে, তবে পাইনি ইচ্ছেকৃতভাবেই। তুই যে আমার জন্য নিষিদ্ধ, চাঁদ! প্রতি মুহূর্তে স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করি—তোর প্রতি আমার সকল অনুভূতি হোক নির্বাসিত। অথচ, আমি আজও একাকী বসে, তোর খোয়াবে দিন গুনি। বিয়ে করিনি রে! মনের মতো পাই না। পেলেই করে নেব।”

মুচকি মুচকি হাসতে লাগল দিব্য। এক হাত প্যান্টের পকেটে পুরে অন্য হাত দিয়ে ফোন টিপতে টিপতে এগিয়ে গেল সে স্কুলের ভেতর। প্রতিটা দেয়াল, প্রতিটা ইট—সবটায় মিশে আছে কত সব স্মৃতি! একে একে সে প্রতিটি ক্লাসরুমে ঢুকল। স্কুল চত্তর থেকে বেরিয়ে কলেজের সাইন্সের ভবনে চলে গেল। অফিসরুম-লাইব্রেরি-টিচার্সরুম! সবগুলো সেই আগের মতোই আছে! করিডোরের সামনে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতেই বর্ষণের ডাক এলো, আকস্মাৎ মনে পড়ল—এক বিকেলের স্কুল ছুটির আগমুহূর্তের বৃষ্টিকথন। তখন সদ্য কৈশোরে পদার্পন করা এক কিশোরী ভারি ঝুমবৃষ্টির মাঝে ক্যাম্পাসের সেই কদম গাছের সামনে লাফাচ্ছিল। সেই দৃশ্যটা সুন্দর ছিল। এতটাই সুন্দর ছিল যে, সেই ঘটনার বারো বছর পর আজও দিব্যর চোখের সামনে বৃষ্টি নামলেই তা ভেসে ওঠে। বৃষ্টি নামলেই এক চন্দ্র মুখ ভেসে ওঠে। সেই মুখকে সবাই চেনে ‘ইন্দুপ্রভা’ নামে।

——————
প্রেমদণ্ডঃ
——————

“আজ যে ক্যাম্পাসে সিনিয়রদের রিইউনিয়ন—তা আমাকে বলিসনি কেন?”

কুন্দনের কথায় পাশ থেকে জয়া বলে উঠল, “হ্যাঁ, সেই! তুমি যে শুক্রবারে গ্রাম থেকে বাসায় ফিরেই কলেজের লাইব্রেরিতে চলে আসতে চাইবে—আমার জানা ছিল?”

কুন্দন সরু চোখে তাকিয়ে বলল, “কেন জানা থাকবে না? অবশ্যই জানা উচিত ছিল। বান্ধবীর মনের কথা বুঝতে পারো না—সেই তুমি কচুর সখী আমার!”

মুখ ভেঙাল জয়া। কুন্দন স্কুল মাঠের ভেতরের জমজমাট পরিবেশটাকে পাশকাটিয়ে কলেজের ভেতরে ঢুকে গেল। মেঘ ডাকছে। বৃষ্টি নামবে বলে! 

জয়া বিরক্তি নিয়ে বলল, “বৃষ্টি পড়বে! আজ আসার কি খুব দরকার ছিল?”

লম্বা বিনুনি পাকানো চুলগুলো নাড়াতে নাড়াতে কুন্দন ছোটো করে কেবল বলল, “খু-ব!”

করিডোরের মাঝদিকেই লাইব্রেরি। জয়া হাঁটতে হাঁটতে ভেতরে ঢুকে গেল। ঠিক দরজার চৌকাঠেই দাঁড়িয়ে পড়ল কুন্দন। মাথা হালকা ঘুরিয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখল এক ভদ্রলোককে, উলটো ঘুরে দাঁড়িয়ে আছে। পেছন থেকে বেশ পরিপাটি দেখতে! এক দৃষ্টে চেয়ে আছে ক্যাম্পাসের ওই কদম ফুল গাছের ওদিকে। কে জানে—কেন!

কাঁধ ঝাঁকিয়ে কুন্দন ভেতরে প্রবেশ করল। কিছু বই জমা দিয়ে জয়াকে নিয়ে দোতলায় চলে গেল। কোনো উদ্দেশ্য নেই। মজাটা এখানেই। যখন আমরা আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে জ্ঞাত হব, তখন থেকেই একঘেয়েমির জীবন কাটাব আমরা.. নিজেদের অজান্তেই; সে-সবে নিরাশ হব, ব্যথিত হব। এক্ষেত্রে পরিকল্পনাহীন জীবন সর্বসুন্দর। যেখানে কোনো আশাই থাকবে না, সেখানে হতাশার স্কোপ তো আরও দূরের কথা।

জয়া হাঁটতে হাঁটতে বলল, “তো, মিস কুন্দনিকা! আপনার মতে প্রেম কী?”

জবাবে কুন্দন হাসল। জয়া তাড়া দিলো, “বলো বলো বলো! হোয়াট ইজ দ্য ডেফিনেশন অব্ লাভ?”

কুন্দন প্রসস্ত হেসে বলল, “প্রেম পৃথিবীর একমাত্র ওয়ার্ড, যার কোনো ডেফিনেশন হয় না। এটা যার কাছে যেমন, তার কাছে তেমনই। কারো কাছে ফ্রেন্ডশিপ, কারো কাছে লং টাইম অ্যাটাচমেন্ট আর কারো কাছে ইনফ্যাচ্যুয়েশন।
বিজ্ঞদের মতে, প্রেম বলতে দুনিয়াতে কোনো শব্দই নেই। একটা অদ্ভুত ফিলিংস আছে! বোঝানোর প্রেক্ষিতে বলা হয়, আই অ্যাম ইন লাভ!”

জয়া হাতে তালি দিয়ে বলল, “তোর কাছে পৃথিবীর সব প্রশ্নের উত্তর আছে, না?”

“আমার কাছে মাথা আছে, যেটা তোর নেই।”

“অপমান!”

“যা ভাবিস!”

“আচ্ছা, শোন! করিডোরে যেই ভাইয়াটা দাঁড়িয়ে ছিল, দেখেছিস না?”

“হুঁ।”

“কেমন লাগে রে? দেখতে মাশাআল্লাহ ভালোই! পার্সোনালিটিও ভালোই লাগছে!”

“মুখে লাগাম দে, ভাই ডেকেছিস তুই।”

“আব্! ভুলে। ভাই-টাই বাদ! ওটাকে পটিয়ে দে।”

কুন্দন কড়া চোখে তাকিয়ে জয়াকে বলল, “লাথি খাবি, সর এখান থেকে।”

মিনমিন করে জয়া বলল, “হ্যাঁ, সেটাই!”

ক্ষণিকের মধ্যেই ভারি বর্ষণ শুরু হয়ে গেল। স্কুল চত্ত্বরে বসা সবাই স্কুলের ভেতরে অবস্থান নিল। কুন্দন স্থির চোখে দেখল। হঠাৎই মস্তিষ্কে অদ্ভুত, ভারি উদ্ভট একটা কথা এলো। মাথা থেকে বের করতে পারল না সে। ভাবতে ভাবতেই বিনুনি গাঁথা চুলগুলো সামনে এনে নিল। মুখে ছেয়ে গেল স্নিগ্ধ হাসি। পরনে পালাজো আর গোল জামা। এক হাতে জামাটা হালকা উঁচিয়ে কুন্দন দৌড়াতে লাগল। পেছন থেকে জয়া বলতে লাগল, “ভাই! থাম! পড়ে যাবি।”

হাসতে হাসতে কুন্দন বলল, “পড়লাম!”

“ব্যাথা পাবি।”

“পেলাম।”

“মরতেও পারিস।”

“মরলাম।”

সিঁড়ির কোণায় এসে দাঁড়িয়ে পড়ল। খেয়ালে এলো কিছুক্ষণ আগে স্বল্পক্ষণের দেখা একটা লোককে আর হঠাৎ মস্তিষ্কে উদিত সেই কথাটিকে! সে পিছে মুড়ল না, অথচ ধীর পায়ে খানিকটা পেছালো। মাথা বিপরীতে ঝুঁকিয়ে বলল, “ধাক্কা লাগলে কি প্রেম হয়, জয়ু?”

জয়া চোখ-মুখ কুঁচকে বলল, “তুই না বললি—প্রেম বলতে কিছুই নেই?”

“হ্যাঁ, নেই-ই তো! তার মানে কি আমি তোকে বার বার বলব—এই জয়ু, আমার না ইয়ে পাচ্ছে! আমার না ইয়ে ইয়ে লাগছে! আমার বোধহয় ইয়ে হয়েছে! এটা বলব?”

বোকার মতো তাকিয়ে রইল জয়া। বড্ড ভাব নিয়ে অভিজ্ঞবার্তা ছুড়ল কুন্দন, “শোন, জয়া! যখন দেখবি—অনুভূতিকে ব্যাখ্যা করার জন্য নির্দিষ্ট কোনো শব্দ পাচ্ছিস না, তখন সেই শব্দকে তুই প্রেম ধরে নিবি। কারণ দুনিয়াতে প্রেমব্যতীত এমন কোনো শব্দ নেই—যার ব্যাখ্যা আছে, অথচ তাকে সংজ্ঞায়িত করা যায় না। একটা ছোট্ট ট্রিকস শিখিয়ে দিলাম।”

“ওহে প্রেমগুরু! এবার বলেন—পাগলের মতো ওভাবে দৌড়াচ্ছিলেন কেন?”

“কারণ আমি ভিজব।”

“বৃষ্টিতে?”

“আপাতত প্রকৃতির বৃষ্টিতে ভেজার ইচ্ছে আছে। কিন্তু ওই-যে, ধাক্কা লেগে যদি প্রেম হয়ে যায়, তবে প্রকৃতির বৃষ্টিতে ভেজার ইচ্ছেটা প্রেমবৃষ্টিতে ট্রান্সফার হতে সময় নেবে না।”

“বুঝিনি ব্যাপারটা!”

“মাথা থাকলে বুঝতিস। যেহেতু নেই, তাই বাদ দে। শুধু বল—ধাক্কা লাগলে প্রেম হয়?”

ভাবতে থাকল জয়া। অনেকটা সময় ভেবে উত্তর দিলো, “ধাক্কা খেয়ে প্রেম তো কেবল সিনেমায় হয়!”

প্রশস্ত হাসল কুন্দন, “এদিকে জীবনটা সিনেমার চেয়েও সিনেম্যাটিক। প্রেম না হয়ে যাবে কই? লেট'স ডু অ্যান এক্সপেরিমেন্ট!”

“কীসের?”

“ধাক্কা লেগে প্রেমের।”

তারপরই সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগল সেই আগের মতো গতিশীল ভঙ্গিতে। লোকটাকে এখনও সেখানটাতেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল। পেছন থেকে জয়া বিভিন্ন অঙ্গ-ভঙ্গিতে বোঝাতে লাগল, “যাস নে! যাস নে! মুখে যত কিছুই বলি না কেন, সামনাসামনি কিছু করিস নে! বাঁশ তোকে ডাকছে রে! ওদিকে কান দিস নে!”

এমন ইঙ্গিতে কুন্দনের পেট ফেটে বেরিয়ে আসতে চাওয়া হাসিটা কী কষ্টে যে আটকাল! ছুঁটছে এমন গতিতে যেন ট্রেইন মিস যাবে। ওই তো তার গন্তব্য! ঠিক গন্তব্যের কাছাকাছি যত পা যাচ্ছে, তার গতি কমছে খুবই অমায়িকভাবে, চেহারায় অন্যরকমের দ্যুতি খেলছে। লোকটার খুব কাছে এসে একটা অদ্ভুত সুন্দর ঘ্রাণ পেল, কিছুটা মাদকীয়! পুরুষ পুরুষ ঘ্রাণ কি একেই বলে? 

সে সব যাক! যে কাজের জন্য এসেছিল, সেটা আপাতত করা যাক! মাথাটা ঝুঁকে নিচের ঠোঁটটা কামড়ে ধরল। আড়চোখে লোকটার পিঠের দিকে তাকিয়ে, কাঁধ এগিয়ে হালকা ধাক্কা লাগাল। অসাবধানতাবশত লোকটা পিছিয়ে গেল, অবাক হলো, চোখ মুখে প্রবল অস্বস্তিভাব উপচে পড়ল যেন! কুন্দন চোখ নামিয়ে ফেলেছে, চেহারা দেখেনি। গতি সেই আগের মতো বাড়িয়ে সেভাবেই দৌড় লাগাল। 

ক্ষণিকের মাঝেই কুন্দনের অধর প্রসারিত হলো, তার চোখ হাসতে লাগল। প্রেম হয়নি! তবে কিছু একটা হয়েছে! অন্যরকমের কিছু একটা! অদ্ভুত অদ্ভুত ভাবটা! যার ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে, সংজ্ঞায়িতও করা যাচ্ছে। সে থামল সাইন্সের ভবন থেকে বেরিয়ে কিছুটা পেছোনে। কিছুক্ষণের মাঝেই সেখানে জয়া এলো।

প্রশ্ন করল, “প্রেম হলো?”

স্মিত হেসে কুন্দন বলল, “ইনফ্যাচুয়েশন হলো।”

“এরপর?”

“এরপর আর কী! ওসব প্রেম-টেম বলতে কিচ্ছু হয় না। বোঝা শেষ আমার। চল, ভিজি!”

“প্রেমবৃষ্টিতে?”

“উঁহু! দুঃখ-বৃষ্টিতে।”

“যাহ্! দুঃখ কেন?”

“কারণ আজ আমার মন খারাপ।”

“এই না ভালো ছিল?”

“হ্যাঁ, এখন নেই। মেয়ে-মন হচ্ছে আকাশের মতন; কখন শরতের সুখ-মেঘ হয়ে উড়বে, আর কখন ধূসররঙের দুঃখ-মেঘ হয়ে গুমোট বাঁধবে, বোঝা দায়। ওমন সুদর্শন পুরুষের সাথে ধাক্কা খেয়েও মোহময়ী কুন্দনিকার প্রেম না হওয়ার জন্য তাকে কঠোরভাবে প্রেমদণ্ডে দণ্ডিত করা হোক। এখন আগামী আটচল্লিশ ঘন্টা সে দুঃখ বিলাস করবে। এমন কষ্টের তুমি কী বুঝবে, জয়া বাবু?”

জয়া মিনমিনে স্বরে বলতে থাকল, “আরও ছাতার মাথা প্রেমের উপন্যাস পড়!”

•••••••••••••

দিব্য অবাক হয়ে তাকিয়ে ভাবল—আজকালকার মেয়ে-ছেলেরা কী উশৃঙ্খল হয়ে গেছে! এভাবে একটা পুরুষকে কোনো মেয়ে কী করে ধাক্কা দিতে পারে! সে খুব করে ধরতে পেরেছে—ব্যাপারটা সম্পূর্ণ ইচ্ছাকৃত! মেয়েটাকে আরেকবার সামনে পেলে কষিয়ে একটা থাপ্পড় লাগাতে ভুলবে না। আলে-গালে থাপড়াতে থাপড়াতে বলবে, “এত ফ্যান্টাসি আসে কোত্থেকে তোর? বল! আজ তোর সব সখ মেটাব। নে, আরেকটা থাপ্পড় খা।”

বলতে বলতেই রাগ তার বাড়তে লাগল। ঠিক তখনই কল এলো সিঁথির। দিব্য রিসিভ করে বলল, “বলো!”

সিঁথি শুধাল, “কই আছ এই বৃষ্টির মাঝে! খুঁজে পাচ্ছি না যে!”

“আমি সাইন্সের বিল্ডিংয়ে আছি।”

“ওখানে?”

“হ্যাঁ, ঘুরে দেখছিলাম!”

“এই বৃষ্টিতে?”

“বৃষ্টির আগেই এসেছিলাম।”

“ওহ্ আচ্ছা!”

“হুম।”
থামল দিব্য। গম্ভীর শ্বাস ফেলে জিজ্ঞেস করল, “ও কী করছে?”

সিঁথি বলল, “তেমন কিছু না। বাকিদের সাথে গল্প জুড়েছে। এখনও কী চঞ্চলই না আছে! একটুও পালটায়নি!”

হেসে কল কেটে দিলো দিব্য। প্রকৃতি জানে—কাকে কীভাবে মানায়! আর তাকে সেভাবেই রাখে। মেয়েটাকে এভাবেই মানায়। দিব্যর মন থেকে বেরিয়ে এলো একটাই দোয়া, ‘ও ভালো থাকুক।’

প্যান্টের পকেটে হাত পুড়ে ওখান থেকে সরতে যাওয়ার আগেই চোখ গেল ফের সেই কদম গাছটির কাছে। অবাক হলো! খুব বেশিই! একটা মেয়ে কী আনন্দে বৃষ্টিবিলাস করছে! কদম গাছের নিচটায় কাঁদাপানিতে লাফাচ্ছে। হালকা রঙা পালাজোর নিচের দিকটা কাঁদায় মেখে গেছে। কাটা চুলগুলো ভিজে মুখের সামনে লেপটে আছে। সে তবুও থামছে না, একটা ফুলের নাগাল পাওয়ার কী চেষ্টাই না করছে! অবশেষে ফুল হাতে পেল! চোখ মুখে কী অজানা সুখ লক্ষণীয় হলো!

দিব্য অনিমেষনেত্রে তাকিয়ে গেল। আশ্চর্যের কথা এ-ই—সে ভুলেই গেছে, খানিকক্ষণ আগে ধাক্কা মারার অপরাধে যেই মেয়েকে গালমন্দ করছিল, কয়েকটা থাপ্পড়ও অবশ্য দিতে চেয়েছিল! সেই মেয়েটিকে দ্বিতীয় দেখায় মনে ধরে গেল। না না! চোখে ধরল কেবল! এরপর মস্তিষ্কে ধরবে, তারপর না মনে! অনেক দেরি! অ-নে-ক!
মনকে কড়া শাসনে এনে দিব্য প্রস্থান ঘটাল। 

—————
বিয়েঃ
—————

বৃষ্টি কমতে কমতে বিকেল হলো! সন্ধ্যার আগ দিয়েই সবাই বিদায়ের জন্য তৈরি হয়ে গেল। ইন্দুপ্রভার সাথে এমন সময় দিব্যর আবারও দেখা হলো। চন্দ্রা তখন সিঁথির কাছে।

ইন্দু অকারণেই আজ খুব হাসছে। সে জানে—তাকে হাসলে খুব সুন্দর লাগে। গালের টোলটা দারুণ ভাবে মনোযোগ আকর্ষণ করে। ঠিক এই কারণেই সে সর্বদা হাসতে থাকে। তবে আজ তুলনামূলকভাবে একটু বেশিই হাসছে। হাসতে হাসতে দিব্যর দিকে এগিয়ে গেল।

দিব্য মুখ কুঁচকে ফেলল, “আমাকে কি জোকার লাগছে?”

হাসি না থামিয়ে দু-ধারে মাথা নাড়ল ইন্দুপ্রভা। দিব্য আবার শুধাল, “ননস্টপ জোক বলে যাচ্ছি আমি?”

ঠোঁট চেপে হাসি থামিয়ে বলল, “না!”

এই ‘না’ বলার ধরণটা বেশ নাটকীয় ছিল। বলা শেষ হতে না হতেই, আবারও ফিক করে হেসে দিলো। চেতে উঠল দিব্য, “তো এভাবে মরার মতো হাসছিস কেন তুই? তোকে কাতুকুতু দিচ্ছি আমি?”

ইন্দুপ্রভা আরও শব্দ করে হেসে উঠল। হাসতে হাসতে বলল, “তোর কনফিউজিং ফেইসটা যা জোস! দেখলেই হাসি পাচ্ছে!”

দিব্যর রাগ লাগল। শক্ত গলায় বলল, “আমি মোটেও কনফিউজড না।”

“তো? চেহারায় কী দেখা যায়?”

“সেসব তোর না ভাবলেও চলবে। ফোন হাতে নে, তারপর বরকে কল দে। রসিয়ে রসিয়ে জিজ্ঞেস কর—বাবুর আব্বু, কী করতেছ তুমি? আইম্মিইসিউউ!”

ইন্দুপ্রভা অনেক কষ্টে হাসি আটকাল, থেমে থেমে বলল, “সেসব আমি বলবই! তুই না বললেও বলব।”

“তা বল! আমার কাছে কী? দূর হ এখান থেকে।”

“যাব না, কী করবি?”

“ক্লাস টেনে থাকতে কী করেছিলাম—মনে নেই? তোকে ওদিক থেকে সরে আমার পাশে আসতে বলাতে, আসিসনি তুই। তাই হাতের কাছের ঘড়িটা ছুঁড়ে মেরেছিলাম। আয়নায় গিয়ে দেখ, কপালে এখনও দাগ আছে।”

“সে অনেক আগের এক কাহিনি। এখন তুইও আর বাচ্চাটি নেই, আমিও অন্য ছেলের পাশ-ঘেঁষে দাঁড়িয়ে নেই।”

থমথমে মুখে তাকাল দিব্য। আবারও হেসে ফেলল ইন্দুপ্রভা। গুনগুন করে গাইতে লাগল, 
“প্রেমে পড়েছে মন! প্রেমে পড়েছে!
অচেনা এক মানুষ আমার বন্ধুকে পাগল করেছে!”

কড়া দৃষ্টিতে তাকাল দিব্য। ইন্দু ভাবলেশহীনভাবে বলল, “আমি কিছু দেখিনি। কেউ যে ওই বিল্ডিংয়ের নিচতলায় দাঁড়িয়ে কদম গাছের নিচে একটা মেয়েকে লাফাতে দেখে দুনিয়া ভুলে গেছিল—আমি দেখিনি। ট্রাস্ট মি! কিচ্ছু দেখিনি।”

“দেখিসনি না?”

“একদম না।”

“আজ তোর হচ্ছে!”

এই বলে দিব্য সিরিয়াসমুখে ইন্দুপ্রভার দিকে এগোল। চাঞ্চল্যময়ীকে আর পায় কে! দৌড়াতে শুরু করল শাড়ির কুঁচি চেপে ধরে। পিছে পিছে দিব্যও দৌড়াতে লাগল। ঠিক সেই মূহুর্তে মানসপটে সকালের একটি দৃশ্য ভেসে উঠল। দিব্যর সাথে তামাশা রটিয়ে এভাবেই ভেগেছিল, এমনই ভাবে হাসতে হাসতে এগোচ্ছিল। সেই চলন, সেই স্বভাব, সেই আহ্লাদ, সেই শখ, সেই সব কিছু! শুধু মানুষ দুটো ভিন্ন। শুধু পার্থক্য এ-ই—একজনের পিছে দিব্য সব ছেড়ে-ছুড়ে ছুটেছে, আর অন্যজনের বেলায় সে কেবল তাকিয়ে থাকতে পেরেছে। একজন অতীতের প্রিয় অধ্যায়। আর অন্যজন! চাইলেই সে ভবিষ্যতের চির সত্যও হতে পারে।
আচ্ছা! দিব্য চায় কি?

এদিকে আশে-পাশের সকল বন্ধুরা মুগ্ধ চোখে ওদের দেখে গেল। কিছু বন্ধুত্ব কখনও শেষ হয় না। হাজার বছর বাদে দেখা হলেও সেই আগের মতোই থাকে।

•••••••••••••

সেই ঘটনার মাস পেরোল। কুন্দন বসে বসে টাইপিং করছে। ফেসবুকে খানিকটা লেখালিখির শখও তার আছে। লিখতে লিখতেই ফোনে ম্যাসেজ এলো একটা। গিয়ে ম্যাসেজটা ওপেন করতেই সে আশ্চর্য হলো। একটা প্রাইভেট নাম্বার থেকে ব্লাংক ম্যাসেজ! 
পরপরই মস্তিষ্ক অন্য কাজে বিমুখ হওয়ায় বিষয়টা থেকে পুরোপুরি দূরে চলে এলো। খানিকক্ষণ বাদে রুমে প্রবেশ করলেন সুমনা বেগম। কুন্দনকে দেখে মিষ্টি করে হাসলেন। বিনিময়ে কুন্দনও হাসল। নিত্য নৈমিত্তিক কাজ এটা।

এগিয়ে গিয়ে কুন্দনের পাশে বসে বললেন, “কী করা হচ্ছে?”

কুন্দন বলল, “এমনিই! কিছু না।”

“একটা কথা ছিল!”

“এত হেসিটেট ফিল করছ কেন? যা বলার বলে ফেলো!”

“আব্.. তোর ইয়াসিন চাচা আছে না?”

“কোন চাচা? আমার জানামতে বাপের তো ভাই নেই।”

“তোর বাপের চাচাতো ভাই।”

“ওহ্! তবে চিনলাম না। আচ্ছা, কী হয়েছে?”

“ওনার এক বন্ধুর ছেলে আছে।”

“তো?”

“বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে। বেশ সভ্য-ভদ্র!”

“আচ্ছা! ছেলেটাকে আমার কাছে পাঠাবে, আর এরপর আমি তাকে অসভ্য-অভদ্র বানাব, মানে ট্রেইনিং দেবো আর কী! তাই তো?”

কুন্দনের নির্লিপ্ততায় সুমনা বেগম কপাল চাপড়ালেন। কপালে হাত রেখেই আঁড়চোখে তাকিয়ে অবসন্ন কণ্ঠে বললেন, “তুই কি কিছুই বুঝতেছিস না?”

“না। বুঝতে পারছি না। এজন্য তোমার উচিত আমার সাথে খোলাখুলি ডিসকাস করা। উইল ইউ?”

“পারতেছি না। আর পারতেছি না। তোর ছোটোটাকে পাঠায় দিতেছি। থাক!”

সুমনা বেগম চলে গেলেন। কুন্দন যে একেবারেই কিছু বোঝেনি, ব্যাপারটা তা নয়! তার মতে—সবকিছু এত অস্বাভাবিকভাবে নিয়ে বুঝে ফেললে তো সমস্যা! বুঝেও অবুঝ হওয়ার যেই আনন্দটা, এটাও চমৎকার!
কিছুক্ষণ বাদে কুন্দনের ছোটো বোন কুমুদ রুমে প্রবেশ করল। ভ্রু-কুঁচকে নিয়ে বলল, “কী করছিস?”

কুন্দন একবার ওর দিকে তাকাল, আরেকবার নিজের ফোনে দৃষ্টি স্থির করে বলল, “লিখছি।”

“তৈরি হয়ে নে, তোকে দেখতে আসবে।”

“কখন আসবে?”

“বিকেলে।”

কুন্দন ঘড়ির দিকে তাকাল, দেখতে পেল—তিনটে বাজে। তারপর কুমুদকে বলল, “আম্মু কোন শাড়ি পরতে বলেছে?”

“কী জানি!”

“আচ্ছা, পাঠিয়ে দে। আমি তৈরি হয়ে নেব।”

এবার কুমুদ ডানে-বাঁয়ে সচেতন নজরে চোখ বুলিয়ে নিল। এগিয়ে গিয়ে কুন্দনকে চুপিচুপি শুধাল, “তোর বয়ফ্রেন্ড নাকি ওটা?”

কুন্দন শুধাল, “কোনটা?”

“যে দেখতে আসছে!”

“বয়ফ্রেন্ড কি না জানি না! হলেও অন্য মেয়ের হতে পারে, তবে আমার না।”

“বুবু, তাহলে তুই এত ঠিক কীভাবে আছিস?”

“বেঠিক থাকার কথা?”

“অবশ্যই! তোকে একটা অচেনা-অপরিচিত ছেলে পরিবারসহ দেখতে আসবে, তাতে কি তুই খানিকটাও নারভাস হবি না?”

“হওয়ার কথাও তো নয়। মেয়ে দেখতে আসা পরিবার ৭০%-ই মেয়েকে প্রথমবার দেখতে আসে, সেক্ষেত্রে মেয়ের কাছে তারা সম্পূর্ণ অপরিচিত, অচেনাই ধরা যায়।”

“তা-ও!”

কুন্দন কুমুদের গালে হাত বুলিয়ে বলল, “মেয়ে হয়ে জন্মেছি, দেখতে তো আসবেই! এতে অস্বাভাবিকত্বের কিছুই নেই।”

“কিছুই নেই?”

“না, নেই।”

“বুবু, তাহলে কি তোর এই বয়সেই বিয়ে হয়ে যাবে?”

“হলে হবে!”

“আমি তোকে ছাড়া থাকতে পারব না।”

“মেয়েরা সব পারে। সব সুষ্ঠুভাবে গুছিয়ে-সামলিয়ে চলতে পারে, চালাতেও পারে।”

কুমুদ ছলছল চোখে তাকাল। কুন্দন তাতে হেসে বলল, “জলদি আম্মুকে বল শাড়ি-গয়না পাঠাতে। সাজতেও তো হবে নাকি! নয়তো ছেলেবাড়ির লোকেরা বলবে, মেয়েটার বিয়েতে মত নেই! আমার আবার বিয়ের খুব শখ!”

কুমুদ দ্রুত পায়ে চলে গেল, আবার ফিরে এসে প্রয়োজনীয় সামগ্রী দিয়ে প্রস্থান ঘটাল। সবটাই ঘটল অতিদ্রুত! কুন্দন কুমুদের যাওয়ার পানে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর হালকা গোলাপি রঙা কাতান শাড়িটা সুন্দর মতো পরে নিল। 

••••••••••••

সন্ধ্যার আগ দিয়ে কুন্দনকে দেখতে আসা হলো। ছেলে, ছেলের বাবা আর ছেলের বান্ধবী এসেছে। মেয়েকে তাদের ভারি পছন্দ হলো। সবার মিলিত সিদ্ধান্তে ঘন্টা দুয়েক পরে, সে রাতের মাঝেই বিয়ে পড়ানো হলো। রাতারাতি কুন্দনিকা এক বাড়ির মেয়ে থেকে আরেক বাড়ির বউ হয়ে গেল। বিদায় বেলায় আর পাঁচটা মেয়ের মতো সে কাঁদল না, কিংবা কোনোরূপ খুশিও প্রকাশ করল না। নির্লিপ্ত রইল। আর তার কান্নাটা কেঁদে নিল কুমুদ। সে কী কান্না! দু'বার তার সদ্য বিয়ে করা বরকে ধাক্কা অবধি মেরেছে। আর বলেছে, ‘আমার বুবুকে আমি দেবো না।’
কুন্দনের এদিকে খানিকটা হাসি পেল, সে হাসল না। বিদায়ের আগমুহূর্তে একবার শুধু বাবার বাড়ির দেয়ালগুলো ছুঁয়ে গেল। কী আশ্চর্য! ঘন্টা কয়েক আগেও সে কত নিশ্চিন্তে ছিল! হুট করে কী থেকে কী হয়ে গেল!

কুন্দন গাড়িতে উঠতেই, পাশে তার বর বসল। নিজ থেকে জিজ্ঞেস করল, “কোনো সমস্যা হচ্ছে?”

কুন্দন ডানে-বাঁয়ে মাথা নেড়ে বলল, “হচ্ছে না।”

“আচ্ছা!”

লোকটা আর কিছু বলল না। এদিকে কুন্দন চোখও সরাল না। একদৃষ্টে চেয়ে রইল স্বকীয় স্বামীর দিকে। বরটা সুদর্শন বটে! 

—————
অন্তঃ
—————

“দ্বিতীয়বার কাউকে মনে ধরার অনুভূতি বোঝো, মেয়ে?”

সদ্য বিয়ে করা বরের মুখে এমন কথা শুনে ভ্রুকুটি করে তার দিকে তাকাল কুন্দন। কুন্দনকে নিজের দিকে তাকাতে দেখে দিব্য হেসে ফেলল। মাথা দু-ধারে দুলিয়ে বলল, “আমার সাথে তা-ই হয়েছে!”

কুন্দন এবার শুধাল, “ওহ্ আচ্ছা! এরপর?”

দিব্য আবারও হেসে ফেলল। বলল, “সেই স্কুল লাইফে একটা মেয়েকে মনে ধরেছিল। খানিকটা চঞ্চল, অগোছালো, ঠোঁট কাটা, যা-তা করার মানসিকতা সম্পন্ন এক মেয়েকে! তারপর এলো বাঁধা।”

“স্কুল-কলেজের প্রেম টেকানোর জন্য অনেক সাধনা করে যেতে হয়, মশাই!”

“সেই সাধনাই আমি করিনি। মনে ধরাটা পুরোটাই আমার ভুলবশত ছিল। উঠতি বয়সের বাচ্চা ছিলাম। সামনে যে-কোনো কিছু এনে দিলে কৌতূহল চলে আসত। আর আমার সামনে রাখা হলো আমার বেস্ট ফ্রেন্ডকে। বারো বছরের ফ্রেন্ডশিপ ছিল, বুঝলে? তাকে কাছ থেকে দেখতে দেখতে কবে যে ডুব দিলাম, বুঝতেই পারলাম না! সাঁতরাতে সাঁতরাতে দেখি, আমার কোনো কূল নেই। ওভাবেই ভেসে বেড়াতে রইলাম।”

চাপা স্বরে কুন্দন শুধাল, “মেয়েটিতে কী সমস্যা ছিল?”

“ও সনাতনী ধর্মাবলম্বী ছিল।”

চকিতে চাইল কুন্দন। শুকনো ঢোক গিলে বলল, “নিষিদ্ধ প্রেম! নিষিদ্ধ পরিণতি!”

“হ্যাঁ, তা-ই!”

“এরপর?”

“প্রেমে পড়া থেকে তো নিজেকে আটকাতে পারিনি, তবে এগোনো থেকে আটকেছি। আজ সে অন্য কারও বউ, বাচ্চাও আছে।”

মুখ ফসকে কুন্দন বলে ফেলল, “আলহামদুলিল্লাহ্!”

সরু চোখে তাকাল দিব্য। তারপর সে নিজেও হেসে দিয়ে বলল, “আলহামদুলিল্লাহ্!”

হাসি কমিয়ে দিব্য আবার বলল, “আর এরপর ঘটল এর চেয়েও বেশি ইন্ট্রেস্টিং ঘটনা।”

“কী ঘটল?”

“দ্বিতীয়বার একটা মেয়েকে মনে ধরে গেল। আশ্চর্যের বিষয় এটাও না। অবাক করা ব্যাপার হলো—দুজনের মাঝেই অদ্ভুত মিল লক্ষ করলাম আমি। দুজনের প্রতি অনুরোক্তি আসে এক বৃষ্টির বিকেলে, স্কুল ক্যাম্পাসে, সেম সিচ্যুয়েশনে, সেম টাইমিংয়ে, সেম মোমেন্টে, সেম স্টাইলে!”

“একই রকম দুজন?”

“আরশি চেন, মেয়ে? আরশির প্রতিমুখে অবস্থানরত দুজন একে অন্যের সদৃশ্য হয়, অথচ কাজ-কর্ম সব বিপরীতে। আমার প্রথম ভালোবাসা আর দ্বিতীয় ভালোলাগা দুটো ছিল আরশির প্রতিমুখী।”

কুন্দন বোকা বোকা চোখে তাকিয়ে রইল। দিব্য বলল,

“বোঝোই তো, ছেলেবেলার পছন্দ আর এই সময়ের পছন্দে থাকে বিস্তর ফারাক। সেই দুটো মেয়ের মাঝে এমনই কিছু ছিল। তবে ছিল একই টান। প্রথমজন আমাকে ১৮টা বছর ভালো থাকতে দেয়নি। দ্বিতীয়জন আমাকে টানা তিন মাস একটানা ভাবিয়েছে। এবারের জন দ্বিধায় ফেলতে পারেনি! কারণ বাঁধা নেই যে! তারপর পুরো ক্যাম্পাসে অনেক খুঁজে তাকে আবারও পেলাম। আর সব ব্যবস্থা করে তাকে নিজের করে নিয়ে এলাম। ম্যাডাম, এইটুকুও তর সইছিল না আর!”

“আমি?”

“আচ্ছা, ধাক্কা লাগলে কি প্রেম হয়?”

চকিতে তাকাল কুন্দন। শুধাল, “কী?”

হেসে ফেলল দিব্য, “প্রেম হয়েছে কি না, জানি না! তবে ইনফ্যাচুয়েশন অবশ্য হয়েছিল। ঘুম হারাম হয়ে গেছিল, নাওয়া-খাওয়া মুশকিল হয়ে পড়েছিল।”

লাজ গোপন করে বলল, “চিজি ফিলমি ডায়লগ!”

দিব্য হো হো করে হেসে উঠল। আজ হঠাৎ কুন্দনের খুব লজ্জা লাগছে। মুখ সরিয়ে গাড়ির জানালার বাইরে তাকাল। আস্তে করে বলল, “আর কতক্ষণ লাগবে?”

জবাবে দিব্য বলল, “বাড়ি ক্রস করে এসেছি। আমরা এখন সাভার যাব।”

“সেখানে কেন?”

“মায়ের কবর। মা তো বিয়েতে থাকতে পারল না, না-হয় আমিই গিয়ে বউ দেখিয়ে নিয়ে আসি।”

কুন্দন মলিন হেসে বলল, “আচ্ছা।”

দিব্য তখন উদ্বীগ্ন ভঙ্গিতে ফোন বের করল। দ্রুত গতিতে একজনকে কল লাগাতে গেল। তার আগেই কুন্দনের চোখ গেল কন্ট্যাক্টে সেভ করা সেই নম্বরটির নামে; সেখানে লেখা 'চাঁদ'। ব্যাপারটা দিব্য খেয়াল করল না। অথচ সে এডিট করে নামটা চেঞ্জ করে ফেলল। তারপর চাঁদের পরবর্তী নাম হলো, 'দূরের মানুষ'!

দিব্য ভিডিয়ো কল লাগাল সেই দূরের মানুষকে। সেকেন্ডের ব্যবধানে কল রিসিভ হলো। ওপাশ থেকে ইন্দুপ্রভা বলল, “কী রে! হঠাৎ কল দিলি যে!”

দিব্য ছেলেমানুষি করা শুরু করল। কুন্দনের একটু কাছ ঘেঁষে এলো। ক্যামেরাতে দিব্যর পাশে অদ্ভুত সুন্দর একটা মেয়েকে বসে থাকতে দেখে ইন্দুপ্রভা চোখ বড়ো বড়ো করে তাকাল। মুখের সামনে হাত নিয়ে কেশে উঠল। তারপর বলল, “বিয়ে ডান?”

দিব্য মাথা উপর-নিচ নেড়ে বলল, “ইয়েস!”

“ভেরি গুড। এবার তোর বউকে দে, কথা বলব।”

দিব্য ফোনটা কুন্দনকে দিলো। ইন্দু কুন্দনকে বলল, “শোনো! খুব জ্বালাবে ও, একদম সব মেনে নেবে না। কিছু বলবেও না, কেবল খাবারের ঝালটা বাড়িয়ে দেবে। ও একদম ঝাল খেতে পারে না। আর খুব সমস্যা হলে আঙ্কেলকে বলে দেবে। কখনও কম্প্রোমাইজ করবে না। আর চুপিচুপি একটা কথা বলি শোনো, আমার পুরো বিশ্বাস—তুমি পৃথিবীর সবচেয়ে চমৎকার মানুষকে পেয়েছ। ভালো থাকবে ভীষণ, বিনিময়ে ভালো রাখার দায়িত্বও নিতে হবে। পারবে না নিতে?”

কুন্দন জবাবে মুচকি হাসল। ইন্দুপ্রভা বলল, “ব্যাস! এতেই হবে।”

দিব্য কুন্দনের আরও কিছুটা কাছে এসে ইন্দুপ্রভাকে বলল, “জোস না?”

ইঙ্গিতটা ইন্দুপ্রভা বুঝেছে। ইন্দুপ্রভাও বোঝাল, “আসলেই জোস!”

“তোর চেয়েও বেশি জোস!”

ইন্দুপ্রভা হেসে বলল, “হ্যাঁ, আমার চেয়েও বেশি।”

তারপর আরও কিছুক্ষণ এরকম কথাবার্তা বলে কল কেটে দিলো দিব্য। কুন্দন জিজ্ঞেস করল, “আপনার বাসায় কে কে আছে?”

“বাবা আর আমি।”

“আর কেউ নেই?”

“না। বাবা-মার লাভ ম্যারেজ ছিল। বাবা চট্টগ্রামের ছিল, আর মা রংপুরের ছিল। পরিচয়টা হয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। এরপর যখন তারা পরিবারকে নিজেদের সম্পর্কের বিষয় জানায়, কেউ মেনে নেয়নি। তারা ঢাকায় চলে আসে, এখানে একাকী থাকা শুরু করে। আমার জন্মানোর সময় মা মারা যায়। তারপর থেকে পরিবার বলতে বাবা আর আমিই আছি। আজ থেকে আমাদের দুজনের ছোট্ট পরিবারটি তিনজনের হলো।”

কুন্দন তাকাল দিব্যর দিকে। হেসে দিয়ে দিব্য বলল, “মিসেস কুন্দনিকা, শেখ পরিবারে আপনাকে স্বাগত!”

“শুকরিয়া শুকরিয়া!”

কুন্দন স্বাভাবিক হলো। কিছুক্ষণের মাঝেই তারা পৌঁছে গেল দিব্যর মায়ের কবরের সামনে। দিব্য কুন্দনকে ফেরার পথে কিছু বেলি ফুল কিনে নিয়েছিল। বাবার কাছে যেদিন থেকে জানতে পেরেছিল—তার মা বেলিপ্রিয়া, সেদিন থেকে প্রতিবার এখানে আসার সময় বেলিফুল আনা তার জন্য আবশ্যক হয়ে পড়ে ছিল। 

দিব্য সেখানে ছিল মোটে সাতাত্তর মিনিট। এই এতটা সময়ে সে কোনো কথা বলেনি। কেবল কবরের দিকে তাকিয়ে ছিল। কুন্দনও কিছু বলেনি। সে আশে-পাশে তাকায়। সন্ধ্যার সেই সময়ে কেমন যেন স্তব্ধ হয়ে ছিল প্রকৃতি। গাছের পাতাও নড়ছিল না।
একদম শেষ মুহূর্তে দিব্য কুন্দনের হাত ধরল। কবরের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে ওষ্ঠ কোনে চাঁদের ফালির মতো হাসি এঁটে বলল, “মা, আমি সুখ পেয়ে গেছি। এই সুখকে অসুখ হতে দেবো না।”

বাড়িতে ফিরতে ফিরতে বাজল রাত বারোটা। দিব্য তাকে জানাল, “আমি খুব বেশি ভালো না, তবে খারাপ একেবারেই নই। খুব রসিক না, তবে রাগী একেবারেই নই। খুব একটা হাসি না, তবে দুঃখবিলাসী একেবারেই নই। আমার সাথে সংসার করাতে ঝামেলা অবশ্য হওয়ার কথা নয়।”

কুন্দন প্রসস্থ হেসে বলল, “সেম টু ইউ!”

দিব্য বলল, “কিছু সময়ের ব্যবধানে তোমার জীবনকে পালটে দেওয়ার জন্য সরি আমি বলব না। সবকিছু সুষ্ঠুভাবে হলে তো সমস্যা। মাঝে মাঝে হোক না কিছু চমকপ্রদ ব্যাপার-স্যাপার।”

কুন্দন হেসে নিয়ে বলল, “আমি অতটাও সাধারণ কিছু নই।”

“আই নো, ম্যাডাম!”

দিব্য কুন্দনের দুবাহুতে ধরে পিছে ঘোরাল। ড্রেসিং মিররে কুন্দন নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে পেল, ঠিক পাশে স্বকীয় স্বামীকে। 
দিব্য বলল, “প্রথমে স্বামী হলাম, এরপর তোমার প্রেমিক হব। প্রেমে পাগলামি করার বয়স আর আমার নেই। তবে তোমার সাথে আমার হবে ম্যাচিউর একটা প্রেম। এই প্রেমগুলো সাংঘাতিক হয়। কারণ সচরাচর প্রেমের মতো এটা নিষিদ্ধ প্রেম নয়। সবচেয়ে শুদ্ধ প্রেম, সবচেয়ে ভয়ঙ্কর প্রেম।”

“প্রেমে উন্মাদ হয়ে যাবেন, মশাই।”

“যাব আর কই? যেখানে লক্ষ্য স্বয়ং আপনি।”

“প্রিয় পুরুষ, আমার বোধহয় নাইওর যাওয়া উচিত। প্রেমে পড়ার পরই ফিরব।”

“কালই ব্যবস্থা করছি।”

আরশির প্রতিমুখে দৃষ্টি স্থির রেখেই কুন্দনিকা হাসল, দিব্য নিজেও হাসল।

——————
পরিশিষ্টঃ
——————

দিব্য, কুন্দনিকা!
তাদের প্রেমটা ঘটা করে হয়নি। বিয়ের বছর চারেক গেল, আজও একে-অপরকে ‘ভালোবাসি’ বলা হয়নি। অথচ, জীবনটাও থেমে থাকেনি। ছন্নছাড়া চেতনার কুন্দনিকা সংসারী হয়েছে! একে-অপরকে কখনই তারা নিজেদের প্রয়োজনের বহিঃপ্রকাশ করে না। না বললেও কুন্দন বুঝে যায়—দিব্যর এখন এটা প্রয়োজন। দিব্যর ব্যাপারটাও তাই।
কিছু সম্পর্ক থাকে অদৃশ্য সুতোয় গাঁথা। কেউ কখনই বাইরে থেকে দেখতে পারে না—সুতোটার আকৃতি-প্রকৃতি কেমন, কতটুকু বিস্তার! কেবল সুতোয় গাঁথা দুজন তা অনুভব করতে পারে। দিব্য-কুন্দন সবসময় সেটা অনুভব করছে।

একটা ভালো উদাহরণ দিই। দিব্য এখন ঘরমুখো হয়েছে, যতটুকু সম্ভব ঘরে থাকে। সবাইকে বলে—কাজ জলদি শেষ! ব্যাপারটা তা নয়। কুন্দনকে বেশিক্ষণ না দেখে সে থাকতে পারে না, শান্তি লাগে না। তাই তো বাড়ি ফেরার এত তাড়া, সব ছেড়ে-ছুড়ে জলদি জলদি বাড়ি ফেরা।

সন্ধ্যে বেলা কুন্দন যখন চায়ের কাপ নিয়ে বারান্দায় বসে ছিল, অফিস থেকে ফিরে দ্রুত দিব্য কুন্দনের কাছে গেল। পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল। কুন্দন ঘাবড়ে যায়নি। চায়ের কাপটা আলতো করে কর্ণার বক্সের উপর রেখে বলল, “বলো!”

দিব্য হেসে বলল, “খুব জ্বালাচ্ছ!”

“আর?”

“একটুও শান্তি দিচ্ছ না।”

“আর?”

“একদমই স্থির হতে পারছি না।”

“আর?”

“মাথা খারাপ করে দিচ্ছ।”

“আর?”

“সব ক্ষেত্রে পার্ফেক্ট আমিটা তোমার কাছে এলোমেলো হয়ে পড়ি!”

হেসে ফেলল কুন্দন, “আমিও।”

“আমার অপারগতা সব তোমায় ঘিরেই..”

“আমারও।”

“তাই বলে যে—আমি তোমায় খুব ভালোবাসি, ব্যাপারটা তেমনও না। আমি কিন্তু তোমায় সামান্যও ভালোবাসি না।”

“আমিও না।”
·
·
·
সমাপ্ত..................................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp