নিশাতকে লং টপে সুন্দর লাগছে। শিলা একের পর এক প্রশংসা করেই যাচ্ছে। সাদা রঙে সবাইকেই একটু-আধটু ভালো লাগে। কিন্তু নিশাতকে বেশিই ভালো লাগছে। অন্যদিকে আয়নায় নিজেকে দেখছে নিশাত। সাদা প্যালাজো, সাদা টপ সাথে হালকা গোলাপি রঙের স্কার্ফ। খারাপ লাগছে না দেখতে। শিলার চয়েস খারাপ না। বেছে বেছে দোকানের সব থেকে সুন্দর জিনিসগুলোই পছন্দ করেছে সে। নিশাত একটা কথা ভেবেই শান্তি পাচ্ছে যে দুইদিনের জন্য আফরাজের সঙ্গে তার দেখা হবে না। টিমের সঙ্গে কক্সবাজার যাবে। কাজের কাজ হবে। খানিকটা ঘুরাঘুরিও হবে। সব থেকে বড় কথা, তার মাইন্ড রিফ্রেশ হবে। আর সাবরিনা তো সাথে থাকছেই। শিলা নিশাতের লাগেজ গুছিয়ে দিয়েছে। প্রয়োজনীয় সব জিনিস লাগেজে আছে। অদৃশ্য এক ভালো লাগা কাজ করে নিশাতের প্রতি শিলার। নিশাত আপা বলতে অজ্ঞান মেয়েটা। বাড়ি গেলে নিশাতের জন্য এটা-ওটা নিয়ে আসবেই আসবে৷ নয়টা বাজতেই সাবরিনার ফোন এলো।
‘নিশাত, তুমি রেডি তো? অফিসের গাড়ি পাঠিয়েছি তোমাকে আনতে।’
‘হ্যাঁ আমি রেডি।’
‘ওকে। আমরা অফিসের সামনেই আছি। দেখা হচ্ছে তাহলে।’
কথা বলা শেষ করে নিশাত ঠোঁটে লিপস্টিক লাগায়। লিপস্টিক ঠোঁটে ছোঁয়াতেই আফরাজের কথা মনে পড়ে। শুধু মনেই পড়েনি, চুমু খাওয়ার দৃশ্যটা রীতিমতো চোখের সামনে ভাসছে। নিশাত চোখ বন্ধ করে মাথাটা দুপাশে ঝাড়া দিল। অহেতুক ভাবনাকে প্রশ্রয় যত কম দেওয়া যাবে, ততই মঙ্গ।
নিশাত নিচে নেমেছে ওমন সময় গাড়িও এসেছে। হোস্টেল সুপারভাইজারের সঙ্গে কথা বলে অ্যাপ্লিকেশন জমা করে সাইন দিয়ে নিশাত শিলার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে চড়ে বসে। ড্রাইভার শফিক সাহেব নিশাতের লাগেজ গাড়ির পেছনে রাখে। তারপর গাড়ি স্টার্ট দেয়। শিলার নজর তখনও চলন্ত গাড়ির দিকে।
গাড়ি এসে অফিসের সামনে থামে। নিশাত গাড়ি থেকে নামতেই সবার নজর তার দিকে যায়। সাদা পোশাকে আবৃত নিশাত যেন তাদের সামনে এই মুহুর্তে অশরীরী কেউ একজন। সাবরিনা পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। একটা মেয়ে এতটা সুন্দর হতে পারে নিশাতকে না দেখলে বুঝতে পারত না সাবরিনা। তাদের কলিগদের মধ্যে একজন এগিয়ে এসে নিশাতের সামনে হাত এগিয়ে বলে, ওয়েলকাম হোয়াইট অ্যাঞ্জেল। কথাটা শুনে নিশাত গাল চওড়া করে হেসে বলে,
‘রাশেদ ভাই, আমি এতটাও সুন্দর নই কিন্তু।’
কথাটা বলে নিশাত আশেপাশে নজর ঘুরায়। সাতজনের টিমে তারা তিনজন মেয়ে বাকিরা ছেলে। নিশাত মনে মনে শান্তির নিঃশ্বাস ফেলে এইভেবে যে, যাক ভালোই হয়েছে ওই সাপটার থেকে দুইটা দিন দূরে থাকা যাবে। নিশাত সাবরিনাকে একটু আড়ালে এনে প্রশ্ন করল,
‘আমি তো অফিসে জয়েন হয়েছি এক মাসও হয়নি। এরই মধ্যে তোমাদের টিমে আমাকে নিলে কেন? আমার থেকেও তো অনেকের অনেক এক্সপিরিয়েন্স আছে। তাদের নিলে না কেন?’
সাবরিনা হেসে জবাব দেয়,
‘বোকা মেয়ে, আমি নিয়েছি নাকি? আফরাজ স্যারই সিলেক্ট করেছে আমাদের সবাইকে। প্রথমে তুমি বাদে ছয়জনকে সিলেক্ট করেছে। পরে তোমাকে সিলেক্ট করে মোট সাতজনের টিম বানিয়েছে।’
‘তুমি জিজ্ঞেস করোনি আমাকে কেন নিল?’
‘নিশ্চয়ই তোমার মধ্যে সেই কোয়ালিটি ছিল যার জন্য তোমাকে নিয়েছে। আর আমি জিগ্যেস করে নিজের চাকরি হারাবো নাকি?’
‘উনি কি কথায় কথায় সবাইকে চাকরিচ্যুত করে নাকি?’
‘আমাকেই তো বের করে দিয়েছিলেন একবার। পরে বড় স্যার জানতে পেরে আফরাজ স্যারকে বলেছে আমি চাকরি ছাড়ব না। আফরোজ স্যার কেমন যেন জানো, মেয়ে মানুষ দেখতেই পারে না। মেয়ে মানুষে উনার এলার্জি দেখলে মনে হয় বেচারা ছ্যাঁকা ট্যাকা খেয়েছে হয়তো।’
আফরাজ সম্পর্কে নিশাতের আর শুনতে ইচ্ছে করল না। সে কথার প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বলল,
‘গাড়ি আসেনি এখনও?’
‘চলে আসবে। এই নিশাত একটা কথা বলব?’
‘বলো৷’
‘তোমাকে সত্যিই অনেক সুন্দর লাগছে গো।’
‘তুমিও কম সুন্দরী নও।’
‘কিন্তু তুমি একটু বেশিই সুন্দর।’
‘চলো তো এখন৷’
পনেরো মিনিট পর গাড়ি চলে এলো। এরপরই বিপত্তির সৃষ্টি। গাড়িটা খুব বেশি বড় না। সাতজন বসতে কষ্ট হয়ে যাবে। কে কোথায় বসবে সেসব ঠিক করছিল সাবরিনা। এরই মধ্যে আফরাজের গাড়ি এসে হাজির। আফরাজের গাড়ি দেখে নিশাত অবাক তো হলোই সাথে বিরক্তও হলো। এই সময় এই জায়গায় আফরাজকে দেখবে এটা সে আশা করেনি। আফরাজ গাড়ি থেকে নেমে সামনে এগুতেই তার চোখ পড়ে নিশাতের দিকে। সবার থেকে খানিকটা দূরে আলাদা দাঁড়িয়ে আছে সে। আফরাজ নিশাতের পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার পর্যবেক্ষণ করে নিল। পুরোটাই সাদা। মেয়েটাকে দেখলে আফরাজের ভেতরটা কেমন যেন করে। এই অনুভূতিটা অন্যরকম। দুইদিন আগের ওই ঘটনার পর থেকেই না চাইতেও নিশাতকে মনে পড়ছে তার। অচেনা কারণেই নিশাত নামক মনুষ্যকে সে দেখতে চাইছে। তাই তো বুদ্ধি করে বিজনেস ট্যুরে নিশাতকেও রেখেছে সে। নিশাতের দিক থেকে চোখ সরিয়ে আফরাজ গাড়ির কাছে আসে।
‘মিস সাবরিনা, সব ঠিকঠাক?’
সাবরিনা ইতস্ততবোধ করে বলল,
‘সবই তো ঠিকাছে স্যার। কিন্তু গাড়িতে তো মনে হচ্ছে না সাতজন বসা যাবে।’
‘গাড়ি ঠিক করেছে কে?’
‘রাশেদ ভাই।’
আফরাজ রাশেদের দিকে তাকিয়ে বলে,
‘রাশেদ সাহেব, গাড়ির এই অবস্থা কেন?’
বেচারা রাশেদ অনামিকার সঙ্গে একত্রে কক্সবাজার যাওয়ার আনন্দে একটু ছোট গাড়ি বুক করে ফেলেছে। অনামিকা আর রাশেদ একই ফ্লোরে জব করে। তাদের দু'জনের মধ্যকার প্রণয়ের সম্পর্কের কথা পুরো অফিস জানে। খুব শীঘ্রই এই প্রণয় পরিণয়ে রুপান্তরিত হবে এটাও সবার জানা। কাজের ফাঁকে দু'জনের প্রি-হানিমুনটাও হয়ে যাবে এই ভেবেই একটু বেশি এক্সাইটেড হয়ে পড়েছিল বেচারা। রাশেদ মুখ শুকনো করে এগিয়ে এসে বলল,
‘স্যার, ভেবেছিলাম তো হয়ে যাবে। এখনও হবে স্যার তবে একটু কষ্ট হয়ে যাবে।’
আফরাজ বিরক্তি ভরা কন্ঠে বলল,
‘মাঝেমাঝে আপনি এত বোকার মতো কাজ করেন না, যা বলার বাইরে। এখন ইমারজেন্সি গাড়ি বুক করতে গেলেও সময়ের অপেক্ষা।’
‘সরি স্যার।’
‘এক কাজ করুন। গাড়িতে ছয়জনই যাক। একজন আমার সাথে আমার গাড়িতে আসুন।’
এটা শুনে সবাই চমকে যায়। আর সব থেকে বেশি চমকায় নিশাত। ওর মাথায় যেন তারা ভরা আকাশটা ভেঙে পড়ল। নিশাত মনে মনে ভাবছে, আমার সাথে আমার গাড়িতে আসুন মানে কী, উনিও কি আমাদের সাথে যাচ্ছেন নাকি? অসম্ভব। নিশাতের এই মুহুর্তে বাংলা ছায়াছবির নায়ক বাপ্পারাজের ভাইরাল ডায়ালগের কথা মনে পড়ছে-- নাহ, এ হতে পারে না। কিছুতেই হতে পারে না।
অন্যদিকে বাকি ছয়জনের একেকজন একেকজনের দিকে তাকাচ্ছে। তারা কেউই আফরাজের সঙ্গে যেতে চায় না। অনামিকা আর রাশেদ একত্রে মাথা নাড়ায়। অন্যদিকে মিনহাজ, তকিব, ইমন তারাও মাথা নাড়ায়। তারাও যাবে না। সাবরিনা আরও আগে যাবে না। রাশেদ, অনামিকা আগেই নিজেদের সিট বুক করে রেখেছে। তারা দু'জন পেছনে বসবে। ইমন ড্রাইভারের পাশের সিটে। সাবরিনা, মিনহাজ আর তকিব বসবে মাঝখানে। রইল বাকি নিশাত, ওরা ভেবেছিল নিশাতকে হয় মাঝখানের সারিতে নেবে নয় রাশেদদের সাথে পেছনে। কিন্তু এতে অনামিকা নারাজ। তারা দু'জন একা আলাদা বসতে চায়। আফরাজ ফোন টিপতে টিপতে বলল,
‘ডিসাইড করুন কে আসবেন আমার গাড়িতে। আমি অপেক্ষা করছি। তাড়াতাড়ি করুন। এখন রওনা না দিলে লেট হয়ে যাবে।’
বলেই আফরাজ ফোন কানে নিয়ে কথা বলতে বলতে সামনে এগিয়ে যায়। সাবরিনা সবার দিকে তাকালে রাশেদ আর অনামিকা আগেই হাত ধরে দাঁড়িয়ে বলে, আমাদের মধ্যে কেউই যাচ্ছে না ভাই। ইমন বলে, সাবরিনা আপু, মাফ চাই আমাকে যেতে বলবেন না। তকিব বলল, সাবরিনা, ভেজাল লাগাবা না বলে দিলাম। আমি তো যাবই না। স্যারের সঙ্গে যাওয়া মানে রোবটের সঙ্গে যাওয়া। একবার সিলেট গিয়ে আমার শিক্ষা হয়েছে। আর মিনহাজ তো এক কাঠি উপরে। সে বলল, সাবরিনা আপু, সব রোমান্টিক গানগুলো ডাউনলোড করে এনেছি। গাড়িতে চালাব আর চিল করব। আমার কাছ থেকে এই অধিকার কেড়ে নিলে জীবনেও আপনার বিয়ে হবে না। এত টেনশনের মধ্যেও মিনহাজের কথা শুনে সাবরিনা হাসতে বাধ্য হয়। কিছুক্ষণ পর সবাই একত্রে অসহায়ের দৃষ্টিতে নিশাতের দিকে তাকায়। নিশাত ওই ছয়জনের তাকানোর ভঙ্গি দেখেই ধারণা করে নেয়। সে সাথে সাথে দুই কদম পিছিয়ে বলে,
‘একদম না। একদম না। আমার কথা যদি কেউ ভেবে থাকেন তাহলে এক্ষুনি মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলুন। আমি কিন্তু কিছুতেই ওই লোকের আই মিন স্যারের গাড়িতে যাব না।’
এবার অনামিকা এগিয়ে এসে নিশাতের হাত ধরে বলে,
‘নিশাত, দেখ একটা কথা বলি। তুমি আর স্যার অনেকটা এক রকম।’
‘মানে?’
‘মানে, তুমিও গম্ভীর। স্যারও গম্ভীর। তুমিও হই হাল্লা এতটা পছন্দ করো না। স্যারও পছন্দ করে না। তোমরা দু'জন একত্রে জার্নি করতে পারবে। কিন্তু আমাদের মধ্যে কেউই স্যারের মতো না। আমরা খুব কম ঘুরতে যাওয়ার সময় পাই। তাই এই ট্যুরটা মিস করতে চাই না। বোঝোই তো, আমি তো যাবই না স্যারের গাড়িতে। আর রাশেদও না। ওরা কেউই যাবে না।’
‘তোমরা কেউ যাবে না। তাই আমাকে ঠেলে পাঠাচ্ছ। আর তোমরা জানো কীভাবে আমি গম্ভীর, আমি হই হাল্লা পছন্দ করি না। আমিও মিনহাজ ভাইয়ার মতো রোমান্টিক গান শুনতে ভালোবাসি। না না। আমি যাব না ওই গাড়িতে। আর রাশেদ ভাইয়াই তো ভুল করেছে। উনি ছোট গাড়ি বুক করল কেন?’
‘রাশেদ তো বুঝতে পারেনি। প্লিজ নিশাত।’
এবার সাবরিনা এগিয়ে আসে। নিশাত সাবরিনাকে খানিক দূরে নিয়ে বলে,
‘তুমি সব সময় আমাকে ঝামেলায় ফেল সাবরিনা। ওইদিনও তুমি আমাকে স্যারের বাসায় পাঠিয়েছ।’
‘ওইদিন কি কোনো ঝামেলা হয়েছিল?’
নিশাত বলতে গিয়েও চুপ হয়ে যায়। সে কথা ঘুরিয়ে বলল,
‘ঝামেলা না হোক। তুমি জানো আমি আফরাজ স্যারকে পছন্দ করি না। তারপরেও তোমরা নিজেরা সব ঠিক করে নিয়েছ। আর আমাকে উনার সাথে যেতে বলছ।’
‘আমি কই ঠিক করলাম। আমি শুধু বলেছি আমি যাব না।’
‘আমিও যাব না।’
‘কেন যেতে চাচ্ছ না নিশাত। সব সময় যদি এমন করো, কীভাবে হবে?’
‘সব সময় কেন আমার সাথেই এমন করো।’
‘আজকের মতো যাও। ফেরার সময় আর স্যারের সাথে ফিরতে হবে না। তখন আমরা সবাই একত্রে ফিরব। কথা দিলাম আমি।’
‘বললেই হলো। আমি আর তোমার কথা শুনব না। আর শোন, তুমি আমাকে কেন বলোনি যে স্যার যাবে আমাদের সঙ্গে?’
‘ও মা, এতে বলার কী আছে? স্যার যে যাবে এটা তো জানা কথা। মিটিংটা আমরা সবাই মিলে করব। প্রতিষ্ঠানের মালিক যাবে না সেটা কীভাবে হয়?’
‘সে যাই হোক, আমি যাব না।’
আফরাজ এবার একটু জোরেই বলল,
‘আপনারা কি এখনও সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন? কী আশ্চর্য, সময়ের তো একটা দাম আছে নাকি?’
সাবরিনা সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল,
‘স্যার, নিশাত যাবে আপনার গাড়িতে।’
নিশাত চোখ বড় বড় করে সাবরিনার দিকে তাকায়। চাপা গলায় বলল,
‘আমি কখন বললাম আমি যাব?’
সাবরিনা নিশাতের কথা কানে না নিয়ে নিশাতের হাত ধরে টেনে এনে আফরাজের সামনে দাঁড় করিয়ে বলে,
‘স্যার, নিশাত যাবে আপনার গাড়িতে।’
আফরাজ অবাক চোখে নিশাতের দিকে তাকায়। সে এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না নিশাত নিজ থেকে বলেছে যে সে এই গাড়িতে যেতে চায়। নিশাত কিছু বলতে যাবে ওমনি সাবরিনা তাদের গাড়ির ড্রাইভারকে দিয়ে নিশাতের লাগেজ আফরাজের গাড়ির পেছনে তুলে দেয়। তারপর তারা সবাই আফরাজকে বলে এক এক করে গাড়িতে যে যার মতো উঠে যায়। ওদের গাড়ি স্টার্টও দিয়ে দেয়। নিশাত তখনও গাড়ির কাছেই দাঁড়িয়ে আছে। আশেপাশে কেউ নেই সে আর আফরাজ ছাড়া। নিশাত মনে মনে সাবরিনাকে বকাঝকা করছে। সাবরিনা এমনটা না করলেও পারত। একবার ঠেলে এই লোকের বাসায় পাঠিয়েছে। সেখানে এক কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে। আর এখন এত লম্বা জার্নি। আফরাজ পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে বলল,
‘আর ইউ সিওর?’
নিশাত চোখ তুলে তাকায় আফরাজের দিকে। কপাল কুঁচকে প্রশ্ন করে,
‘হোয়াট?’
‘আমার সাথে সত্যিই যেতে চাও?’
‘না গিয়ে উপায় কী? আমি তো আর আপনাকে জরিমানার টাকা দিতে পারব না।’
আফরাজ লাইটার দিয়ে সিগারেটে আগুন ধরাতে ধরাতে বলল,
‘গাড়িতে গিয়ে বোসো। পাঁচ ছয় মিনিট পর আমি স্টার্ট দিব।’
এই বলে আফরাজ একটু দূরে সরে এসে সিগারেট টানতে শুরু করল। নিশাতও গাড়ির পেছনের সিটে উঠে বসল। ফোন হাতে নিয়ে সাবরিনাকে মেসেজ করল, ইউ আর রিয়েলি ব্যাড। গাড়িতে বসে সাবরিনা মুখ চেপে হেসে মেসেজের রিপ্লাইতে বলে, ইউ আর সো বিউটিফুল হোয়াইট অ্যাঞ্জেল। নিশাত আবারও মেসেজ করে, এমনটা না করলেও পারতে আমার সঙ্গে। সাবরিনা রিপ্লাইতে বলে, জীবনে সব কিছুর এক্সপিরিয়েন্স নিতে হয়৷ আজ না হয় স্যারের সাথে জার্নির এক্সপিরিয়েন্স নিলে। নিশাত পালটা মেসেজ করে, আমার জায়গায় তুমিই এই এক্সপিরিয়েন্স নিতে। সাবরিনা হাসির ইমুজি দিয়ে রিপ্লাইতে বলল, আমার বহুবার নেওয়া হয়ে গেছে। শুধু আমার না আমাদের সবারই হয়েছে। তুমি বাকি ছিলে। এবার তুমিও নাও। বাই দ্য ওয়ে স্যার গাড়ি স্টার্ট করেছে? নিশাত স্যাড ইমুজি দিয়ে বলল, স্যার সিগারেট টানছে। আই থিংক সিগারেট শেষ করে স্টার্ট দিবে৷ আমি গাড়ির পেছনের সিটে উঠে বসে আছি। মেসেজটা পড়ে সাবরিনা এবার শব্দ করে হেসে রিপ্লাইতে বলে, স্যার এসে ঝাড়ি মারল বলে।
ঠিকই আফরাজ গাড়িতে উঠে পেছনে তাকিয়ে নিশাতকে বলল,
‘আমাকে কি তোমার ড্রাইভার মনে হয়?’
‘মানে?’
‘নিজে পেছনের সিটে বসে আছ। আমি গাড়ি চালাব। যে কেউ দেখলেই বলবে তুমি মালিক আর আমি ড্রাইভার।’
‘বললে বলবে। তাতে আমার কী?’
‘চুপচাপ সামনে আসো।’
কিছু সময় তর্কাতর্কির পর নিশাত সামনে এসে বসে। আফরাজ গাড়ি স্টার্ট দেয়। আফরাজ গাড়ির জানালা বন্ধ করে এসি ছেড়ে দেয়। অন্যদিকে এসিতে নিশাতের সমস্যা হচ্ছে। সে আফরাজকে বলে,
‘জানালা খুলে দিন। এসি বন্ধ করে দিন। আমার অস্বস্তি হচ্ছে।’
আফরাজ বিরক্ত হয়ে বলল,
‘জানালা খোলা যাবে না। এসিও বন্ধ হবে না।’
‘আমার কিন্তু বমি হয়ে যাবে। আমি গাড়ির এসি সহ্য করতে পারি না। প্লিজ জানালাটা খুলে দিন।’
‘আর ইউ সিক? রাতের বেলায় জানালা খুলে ড্রাইভ করা রিস্কি হয়ে যাবে।’
‘আমরা এখনও ঢাকার ভেতরেই আছি। আর সবে মাত্র এগারোটা। প্লিজ একটু জানালা খুলে দিন। তারপর না হয় অফ করে দিলেন। আমার সত্যিই অস্বস্তি হচ্ছে। বমি হয়ে গেলে আপনিই ঝামেলায় পড়বেন।’
বমির কথা শুনে আফরাজের শরীর গুলিয়ে উঠে। সে জানালা খুলে দিয়ে এসি বন্ধ করে দেয়। নিশাত যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস নেয়। জানালার বাইরের দিকে মাথা ঠেকিয়ে নিশাত জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। অন্যদিকে আফরাজ গাড়ি ড্রাইভ করছে। দু'জনের কেউই কথা বলছে না।
—————
নিশাতের ঘুম ভাঙে আফরাজের ডাকে। আকাশ দেখতে দেখতে কখন যে চোখ বন্ধ হয়ে গেছে তার খবরই নেই। আফরাজের গলার স্বরটা কানে বাজতেই চোখ খোলে সে। চোখ খুলে আফরাজকে দেখে ঠিক মতো বসে। বুঝতে পারে গাড়ি চলছে না। প্রশ্ন করে,
‘পৌঁছে গেছি?’
‘নাহ।’
নিশাত মোবাইলে ঘড়ি দেখে। দুইটা দশ বাজে মাত্র। আফরাজ নিশাতকে বলল,
‘নামো গাড়ি থেকে।’
‘কেন? আপনি কি আমাকে এত রাতে মাঝ রাস্তায় নামিয়ে দিবেন নাকি?’
‘তুমি বেশি কথা বলো। ওই যে দেখ, রেস্টুরেন্ট দেখা যাচ্ছে একটা। কিছু খাবে তো নাকি। ক্ষুধা লাগেনি?’
কথা সত্য। নিশাতের ক্ষুধা লেগেছে। হোস্টেল থেকে বের হওয়ার সময় তিন পিস ব্রেড আর একটা কলা খেয়ে এসেছিল। নিশাত আবারও প্রশ্ন করে,
‘ওরা কোথায়? ওরা খাবে না?’
‘ওদের দিয়ে তোমার কী কাজ? ওরা কি আমাদের সাথে আছে, নাকি আমরা ওদের সাথে আছি? ওরা খেয়ে-দেয়ে রওনা দিয়েছে।’
‘আপনি কী করে জানলেন?’
এবার আফরাজ সত্যিই বিরক্ত হচ্ছে। এত প্রশ্ন মানুষ করে নাকি। এই মেয়ের স্কুলের টিচার হওয়া উচিত ছিল। ভুল করে কর্পোরেট অফিসে ঢুকে পড়েছে।
‘নিশাত, আর একটা প্রশ্ন করবে, আমি তোমাকে এখানে নামিয়ে দিয়েই কিন্তু গাড়ি স্টার্ট দিব।’
‘আপনার দ্বারাই সম্ভব। আপনিই পারবেন এমন করতে।’
‘তুমি নামবে?’
নিশাত আর কথা না বাড়িয়ে গাড়ি থেকে নেমে গেল। পা জোড়া ব্যথা হয়ে আছে। এতক্ষণ পর দাঁড়িয়ে ভালো লাগছে তার। আফরাজ গাড়ি লক করে রেস্টুরেন্টের ভেতরে যায়। নিশাতও পেছন পেছন যায়। সবই ঠিক ছিল কিন্তু ঝামেলা হলো তার ওয়াশরুমে যেতে হবে। এখন এই কথা সে আফরাজকে বলবে কীভাবে? এদিকে ওয়াশরুমে যাওয়াটাও জরুরী। নিশাতের ভাব-ভঙ্গি দেখে আফরাজ বলল,
‘এনিথিং রং?’
নিশাত ইতস্ততবোধ করে চোখ সরিয়ে বলল,
‘লেডিস ওয়াশরুমটা কোনদিকে?’
আফরাজ চোখ জোড়া বন্ধ করল। তারপর ঘাড়টাকে এপাশ-ওপাশ করে বলল,
‘আসো আমার সাথে।’
নিশাতও বাধ্য মেয়ের মতো আফরাজের পেছন পেছন গেল। কক্সবাজার গিয়ে সাবরিনাকে একটা ধোলাই দিবে বলে ঠিক করে আফরাজ। নিশাতকে কেন তার সঙ্গে পাঠাল এটা নিয়েই ধোলাইটা দিবে সে। লেডিস ওয়াশরুমের সামনে এসে আফরাজ নিশাতকে ইশারা করে। নিশাত কিছু না বলে ভেতরে যায়। কয়েক সেকেন্ড পর আবার ফিরে আসে। নিশাতকে এত দ্রুত বের হতে দেখে আফরাজ বলল,
‘কী হলো আবার?’
নিশাত তার হ্যান্ডব্যাগটা আফরাজের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘স্যার, আমার ব্যাগটা একটু রাখুন তো।’
আফরাজ চমকে গিয়ে বলে,
‘হোয়াট?’
নিশাত বলে,
‘স্যার, ভেতরে বুয়া টাইপ দু'জন মহিলা বসে আছে। আমার ব্যাগে ফোন আছে। আমি ব্যাগটা ওয়াশ এরিয়াতে রেখে ভেতরে গেলে যদি এই ফাঁকে তারা আমার ব্যাগে হাত দেয়?’
আফরাজ এবার বেশ রেগে যায়। রাগান্বিত গলায় বলে,
‘এই মেয়ে, মাথায় বুদ্ধি নেই। ভেতরে যারা বসে আছে তারা এইসব ব্যাগ পাহারা দেওয়ার জন্যই বসে আছে।’
‘নাহ স্যার। আমি এদের বিশ্বাস করি না। যদি আমার ফোনটা নিয়ে বলে আমরা নেই নাই তখন আমি কী করব? আপনি একটু রাখুন। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আমি চলে আসছি।’
এই বলে আফরাজের হাতে নিজের ব্যাগটা ধরিয়ে দিয়ে নিশাত দৌড়ে ওয়াশরুমের ভেতরে ঢুকে যায়। ঢুকেই মুখ চেপে শব্দ করে হাসে। পর্দা সরিয়ে আফরাজকে দেখে। বেচারা ব্যাগ হাতে রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখে-মুখে অসম্ভব বিরক্তি ভাব। অন্য হাতটা কপালে। ভাবছে, এত বড় কোম্পানির এমডি সামান্য স্টাফের ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে আছে। তাও আবার ফিমেল স্টাফ। নিশাত ইচ্ছে করেই এই কাজটা করেছে। সে এখন আরামসে কিছুক্ষণ ওয়াশরুমের এরিয়ায় থাকবে। নিজের প্রয়োজনীয় কাজও সারবে আর আরামছে হাত-মুখও ধুয়ে নিবে।
এদিকে পাঁচ মিনিটের বেশি হয়ে গেছে নিশাত এখনও বের হচ্ছে না। আফরাজ এবার একা একাই বলছে, এই মেয়ে ওয়াশরুমের ভেতরে কী করছে এখনও। আশেপাশে লোকজন তাকিয়ে আছে সেই কখন থেকে। কী বিশ্রী একটা ব্যাপার। এরই মধ্যে নিশাত টিস্যু দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বের হয়ে এলো। নিশাতকে ওই অবস্থায় হেঁটে আসতে দেখে আফরাজের রাগটা কোথায় যেন ডুব দিল। নিশাত সামনে এসে দাঁড়ায়। তারপর ব্যাগটা আফরাজের হাত থেকে নিজের হাতে নিয়ে বলে,
‘চলুন স্যার। যাওয়া যাক।’
—————
নিশাতের জন্য একটা বিফ খিচুড়ি আর নিজের জন্য একটা ব্ল্যাক কফি অর্ডার দেয় আফরাজ। বিফ খিচুড়িটা নিশাতের পছন্দ অনুযায়ী অর্ডার দেওয়া হয়েছে। কী খাবে জিজ্ঞেস করাতে নিশাত এক কথাতেই উত্তর দিল বিফ খিচুড়ি। দশ মিনিট অপেক্ষা করার কথা বলে ওয়েটার চলে গেলে নিশাতের চোখ যায় তাদের সোজাসুজি পশ্চিম দিকের কোণার টেবিলে। নিশাতের হাতটা আপনা-আপনি গালে চলে যায়। সে গালে হাত দিয়ে টেবিলে বসে থাকা নারী-পুরুষের ভালোবাসাময় মুহুর্তটা দেখছিল। তার ঠোঁটে হালকা হাসি। আফরাজের ধ্যান এতক্ষণ ফোনের দিকে থাকলেও এখন নিশাতের দিকে। সে নিশাতের দিকে তাকাতেই দেখল নিশাত অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। এই অবস্থায় নিশাতকে অপ্সরার মতো লাগছিল৷ সে-ও নিশাতকে ফলো করে পেছনে তাকায়। তার চোখও কোণার টেবিলে বসে থাকা নারী-পুরুষের দিকে যায়। কী অপূর্ব দৃশ্য! দু'জন দু'জনকে খাইয়ে দিচ্ছে। আফরাজ সেখান থেকে চোখ সরিয়ে নিশাতকে কিছু বলতে যাবে এমন সময় খাবার চলে আসে। নিশাতেরও ধ্যান ভাঙে। সে চুপচাপ খাওয়ায় মন দেয়। আর আফরাজ নিজের ব্ল্যাক কফি ঠোঁটে ছোঁয়ায়।
খাওয়া শেষে রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে আফরাজ গাড়ির লক খুলে নিশাতকে গাড়িতে বসতে বলে একটু দূরে গিয়ে সিগারেট ধরায়। নিশাত গাড়িতে ব্যাগটা রেখে আফরাজের দিকে তাকায়। আফরাজ ফোনে কী যেন দেখছে আর সিগারেট টানছে। নিশাত বোঝে না এই লোক এত সিগারেট টানে কেন? সে আর গাড়িতে বসেনি। মধ্য রাতের এই সময়টা নিশাতের খুব প্রিয়। যদিও আশেপাশে অনেক শব্দ। সে আশেপাশের জায়গাটা ঘুরে ঘুরে দেখছে।
আফরাজের সিগারেট টানা প্রায় শেষ। আর কয়েক টান দিলেই শেষ অংশটায় এসে পড়বে। আফরাজ একবার গাড়ির দিকে নজর দিল। নিশাতকে সে দেখতে পাচ্ছে। নিশাত এদিক-সেদিক হাঁটাহাঁটি করছে। এমন সময় একজন লোক এসে আফরাজের পাশে দাঁড়ায়। সে-ও সিগারেট টানছে। লোকটা নিজে থেকেই আফরাজের সঙ্গে কথা বলল। কথা বলার এক পর্যায়ে তিনি বললেন, ইউর ওয়াইফ ইজ রিয়েলি বিউটিফুল। ইউ আর লাকি ম্যান। এই কথাটা শোনার পর আফরাজ যেন ধোঁয়া ছাড়তে ভুলে গেল। তার নজর চট করেই নিশাতের দিকে গেল। নিশাত তখন গাড়ির দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আফরাজের জন্য অপেক্ষা করছে।
আফরাজ সিগারেটের শেষ অংশটা ফেলে দিয়ে বলল, এক্সকিউজ মি, আমাকে যেতে হবে। সে দ্রুত পায়ে গাড়ির কাছে এসে নিশাতকে ইশারা করল। নিশাত গাড়িতে উঠে বসতেই আফরাজ গাড়ি স্টার্ট দিল। কয়েক মিনিট মোহঘোরের মধ্যে গাড়ি ড্রাইভ করে রাস্তার এক পাশে গাড়ি থামাল। গাড়ি থেকে নামা ঠিক হবে না। তাই সে গাড়িতেই আরেকটা সিগারেট ধরাল। নিশাত এবার না বলে থাকতে পারল না।
‘আবার সিগারেট! এখন না টানলে হয় না। মাত্রই টেনে আসলেন একটা।’
আফরাজ নিশাতের দিকে তাকায়। আফরাজের চোখে চোখ রেখে নিশাতের বুকের ভেতরটা কেমন যেন করে উঠে। আফরাজের দৃষ্টি অন্য কিছু বলছে। নিশাত বাম হাতটা মুষ্টিবদ্ধ করে। আফরাজ বাম হাতের তর্জনী আঙ্গুল নিজ ঠোঁটে ছুঁইয়ে ইশারায় নিশাতকে চুপ থাকতে বলে। নিশাত আর একটা শব্দও উচ্চারণ করল না। তার নজর জানালার বাইরে। আফরাজ বিদ্যুতের বেগে সিগারেট টানছে এবার। যেন তার খুব তাড়া সিগারেটটা শেষ করার। এক মিনিটও হয়নি সিগারেটটা ফেলে দিয়ে জানালার কাচ উঠিয়ে দিয়ে গাড়ি ড্রাইভ করতে শুরু করে। নিশাতের দৃষ্টি তখনও বাইরে। সে আফরাজের দিকে তাকাবে না ঠিক করেছে। তার ভয় হচ্ছে। এতক্ষণ পর এক অজানা ভয় মনে চেপে বসেছে।
মিনিট দেড়েক পর নিশাতের কানে একটা গান বাজে-- ইয়ে রাতে ইয়ে মসাম, নাদিকা কিনারা, ইয়ে চাঞ্চাল হাওয়া।
নিশাত আড়চোখে দেখছে আফরাজ গাড়িতে গান ছেড়েছে। এবার নিশাত পুরোপুরি ঘাড় ঘুরিয়ে আফরাজের দিকে তাকায়। আফরাজের নজর তখন সামনের দিকে। সে এদিক-ওদিক না তাকিয়ে আপন মনে ড্রাইভ করে চলছে।
·
·
·
চলবে.......................................................................