নবোঢ়া - পর্ব ১৪ - ইলমা বেহরোজ - ধারাবাহিক গল্প


          আলমারির দরজা বন্ধ করে পেছনে ফিরতেই জাওয়াদের চোখ পড়ল দরজার কাছে দাঁড়ানো মায়ের দিকে। 

ললিতার চোখে জল। সে কম্পিত স্বরে বললেন, "বাবা, একটু কথা বলি?"

ললিতার খুব মনে পড়ে সেই দিনগুলোর কথা, যখন মা-ছেলের সম্পর্ক ছিল মধুর, হাসি-খুশিতে ভরা। তাদের বন্ধুত্ব ছিল অটুট, যেন সোনায় সোহাগা। কিন্তু আজ? আজ সব বদলে গেছে। সে নিজের চেনা ছেলেকেই আর চিনতে পারছেন না। এই গম্ভীর, শীতল দৃষ্টির যুবক কি সত্যিই তার সেই আদরের জাওয়াদ? প্রতিটি মুহূর্তে ভয়ে কাঁপছে বুক, পাছে কোনো ভুল কথা বলে ফেলেন আর ছেলে রাগ করে চলে যায়!

জাওয়াদ চোখ বুলিয়ে নিল ঘরের চারপাশে। মেঝেতে বিছানো মখমলের মতো নরম ফরাসি কার্পেট, দেয়ালে টাঙানো দামী তৈলচিত্র, অপূর্ব নৈপুণ্যে সাজানো বইয়ের তাক। মেহগনি কাঠের তাকটির গায়ে খোদাই করা সূক্ষ্ম নক্সাকাজ। তাকের পাশেই সেই আরাম কেদারা, যেখানে বসে সে একসময় রাতের পর রাত কাটিয়েছে পড়াশোনায় মগ্ন হয়ে।

জাওয়াদ বইয়ের তাক থেকে একটা বই টেনে নিতে নিতে হিম কণ্ঠে বলল, "কোনো দরকার ছিল?"

তার কথার তীক্ষ্ণতায় ললিতার হৃদয় ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। তিনি গলায় কান্না চেপে, প্রায় অভিমানভরে বললেন, "দরকার? তুই আমার ছেলে, জাওয়াদ। তোর সঙ্গে কথা বলতে আবার দরকার লাগে নাকি? এ কেমন কথা বলছিস তুই? তুই কি জানিস না, তোর প্রতিটা শ্বাস-প্রশ্বাস আমার কাছে কত মূল্যবান?"

জাওয়াদ নীরব। সে শুধু বইয়ের পাতা ওলটাতে থাকে। এমন ভাব করছে যে, মায়ের কথাগুলো তার কানেই ঢোকেনি।
ললিতা আর নিজেকে সামলাতে পারলেন না। তার কণ্ঠ থেকে বেরিয়ে এল যন্ত্রণার্ত প্রশ্নের ঝড়, "বাবা, এতদিন তুই কোথায় ছিলি? কী হয়েছিল তোর? কেন আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছিলি? কেন কিছু বলছিস না? জানিস, তোকে হারিয়ে আমাদের কী অবস্থা হয়েছিল?"

ললিতার কথাগুলো ঘরের বাতাসে ভারী হয়ে ঝুলতে লাগল। জাওয়াদের মুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই, তার চোখের কোণে একটু জল জমে উঠেছে। শুধু ঠোঁট দুটো সামান্য নড়ে উঠল, বেরিয়ে এল অস্পষ্ট স্বর, "কিছু না।"

ললিতা ধীরে ধীরে ছেলের কাছে এগিয়ে এলেন। চোখ থেকে অশ্রু ঝরছে অঝোরে। বললেন, "কিছু না মানে? তুই জানিস তোর জন্য কত কেঁদেছি? কত রাত জেগেছি? তোর বাবা, চাচা কত খুঁজেছে তোকে? আমরা প্রতিটি মুহূর্তে তোর জন্য চিন্তায় ছিলাম! প্রতিটি দরজার শব্দে মনে হত, তুই ফিরে এসেছিস। পোস্ট অফিস থেকে কেউ এলেই ভাবতাম, তোর চিঠি এসেছে। কী করে বলিস 'কিছু না'?"

জাওয়াদ বলল, "আমি একা নিজের জীবন গোছাতে চেয়েছিলাম। দয়া করে এভাবে কাঁদবেন না, এখন তো সব ঠিক আছে।" তার কণ্ঠস্বরে কোনো অনুশোচনা নেই, শুধু একটা ঠাণ্ডা নিরাসক্তি।

ললিতা ছেলের হাত ধরে নিজের দিকে ঘুরালেন। মমতা মিশিয়ে বললেন, "কিছুই ঠিক নেই! তুই ফিরে এসেছিস, কিন্তু তোর মন এখনো ফেরেনি। কী হয়েছে তোর? কে করেছে এমন? বল না বাবা... আমি তো তোর মা, আমাকে বল। তোর এই নীরবতা আমাকে ভিতর থেকে খুবলে খাচ্ছে।"

জাওয়াদ হাত ছাড়িয়ে নিল, যেন মায়ের স্পর্শ তার গায়ে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে। "মা, কিছু হয়নি আমার। সহজ জিনিসটা বুঝতে চাচ্ছেন না কেন? সারাক্ষণ এক কথা ভালো লাগে না।" 

কথাগুলো ধারালো ছুরির মতো ললিতার হৃদয়ে বিঁধল। তার বুক ফেটে আসছে যন্ত্রণায়। তার ছেলে, তার আদরের জাওয়াদ কেন এমন হয়ে গেল? কোন অদৃশ্য শক্তি তার সোনার প্রতিমাকে এমন পাথরে পরিণত করল? তিনি ছেলেকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললেম, "আমি তোর মা রে। তুই যা-ই করিস, যেমন-ই থাকিস, আমি তোকে ভালোবাসব। কিন্তু এভাবে নীরব থাকলে কী করে বুঝব তোর কষ্ট? কীসের কষ্ট তোর বাবা? আমাকে বল। আমি যে আর সহ্য করতে পারছি না। তোর এই আচরণ আমার ঘুম কেড়ে নিয়েছে, শান্তি কেড়ে নিয়েছে।"

জাওয়াদের হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেল। মমতাময়ী মায়ের কান্না কোন সন্তান সহ্য করতে পারে? সে আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখল। তার চোখ দুটি জলে ভরে উঠেছে। বহুদিনের জমা থাকা অশ্রু বেরিয়ে আসতে চাইছে। হঠাৎ করেই জাওয়াদ মাকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে দ্রুত পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। 

ললিতা পিছু পিছু ছুটলেন। আকুল কণ্ঠে বললেন, "জাওয়াদ...বাবারে। শোন, দাঁড়া! আমার কথা শোন একবার!" 

জাওয়াদ শুনল না। হাতের মুঠো শক্ত করে বেরিয়ে গেল। পিছনে ফেলে গেল ভগ্নহৃদয়ের মাকে, যার চোখের জল মেঝেতে পড়ে ক্ষুদ্র সরোবর সৃষ্টি করেছে। সেই সরোবরে ভেসে বেড়াচ্ছে ললিতার হৃদয়ের টুকরোগুলো, যেগুলো তার ছেলের প্রতিটি কথায় ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছে।

বাড়ির দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দটা ললিতার হৃদয়ের শেষ আশাটুকুকেও ভেঙে দিল। তিনি ধপ করে মেঝেতে বসে পড়লেন। মুখ দিয়ে শুধু একটি শব্দ বেরোল, "জাওয়াদ..." 

গভীর রাতে জাওয়াদ খাসমহলে ফিরে আসে। তার দেহ ক্লান্তিতে নুয়ে পড়েছে, মনের ওপর পাহাড় সমান বোঝা। আকাশে তখন পূর্ণিমার চাঁদ তার সম্পূর্ণ মহিমায় বিরাজমান, চারদিক রূপালি আলোয় স্নাত। ঘরের ভেতরে প্রবেশ করতেই জাওয়াদের মনে হলো, দেয়ালগুলো তার ওপর চেপে বসতে চাইছে। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে, বুকের ভেতরটা দমবন্ধ হয়ে আসছে। তাড়াতাড়ি সে ঘরের সবগুলো জানালা খুলে দিল। সঙ্গে সঙ্গে বাইরের শীতল বাতাস ঘরে প্রবেশ করে তার উত্তপ্ত দেহে স্বস্তি এনে দেয়। পশ্চিম দিকের জানালাটা সাধারণত বন্ধই থাকে। কারণ ওদিক থেকে দাসীদের ঘর দেখা যায়। 
আজ জাওয়াদ সেই জানালাটাও খুলে দিল। খুলতেই চোখে পড়ল দাসীদের ঘরগুলো।

খাসমহলটি মূলত এল-আকৃতির কাঠামোতে তৈরি, যেখানে দুটি অংশ ভিন্ন ভিন্ন দিকে বিস্তৃত। এলের একটি অংশ জমিদার সদস্যদের ব্যক্তিগত ঘর ও বসবাসের স্থান নিয়ে গঠিত। অন্য অংশে, নিচের তলায়, দাসীদের থাকার ও কাজ করার ঘরগুলো। এল-আকৃতির কাঠামোর কারণে দোতলার বারান্দা থেকে নিচের তলার দাসীদের বারান্দা ও কাজের আঙ্গিনা স্পষ্টভাবে দেখা যায়। এমন স্থাপত্য করা হয়েছিল যাতে উপরের তলায় বসে নিচের কাজকর্ম পর্যবেক্ষণ করা যায়। 

জাওয়াদ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল জানালার পাশে। চোখের সামনে ভেসে উঠে অতীতের ছবি। কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই খাসমহলের সঙ্গে। আজ সব কেমন অন্যরকম হয়ে গেছে। যে ঘর একসময় নিরাপদ আশ্রয় ছিল, আজ সেই ঘর কারাগারে পরিণত হয়েছে। প্রতিটি মুহূর্তে মনে হচ্ছে, এই বুঝি দম বন্ধ হয়ে যাবে। বাইরে তখনও চাঁদের আলো ছড়িয়ে আছে। কিন্তু জাওয়াদের মনের ভেতর যে অন্ধকার নেমে এসেছে, তা কোনো আলোতেই দূর হবে কি? সে জানে না কী করবে, কোথায় যাবে। শুধু জানে, এই মুহূর্তে সে একা, সম্পূর্ণ একা। 

জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই তার নজরে পড়ল চাঁদের আলোয় স্নানরত এক তরুণী। দাসীদের ঘরের বারান্দার রেলিঙে পা তুলে বসে আছে সে। তরুণীর চোখেমুখে অনন্ত উদাসীনতা।

পরনে গাঢ় বেগুনি রঙের সালোয়ার কামিজ। কালো চুল বাতাসে উড়ছে। গালের হাড় উঁচু, ঠোঁট পাতলা, নাক চোখা। জাওয়াদ মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে রইল। তরুণীটিকে চেনা চেনা লাগছে। একটু ভাবতেই মনে পড়ে গেল সেদিনের সেই ঘটনা, আহত অবস্থায় পালিয়ে যাওয়া মেয়েটির কথা! গুলনূর! সেদিন এক পলকের দেখা হয়েছিল। তখন ভালোভাবে খেয়াল করা হয়নি।

জাওয়াদ জানালায় হেলান দিয়ে দাঁড়াল। দৃশ্যটি দেখতে তার ভালো লাগছে। গুলনূরের ওড়নাটি হালকা গোলাপী রঙের। ওড়নার প্রান্তে থাকা ছোট ছোট রুপালি ঝালর বাতাসে কাঁপছে রূপকথার পরীর পাখার মতো। হঠাৎ একটা হাওয়ার ঝাপটায় ওড়নাটা উড়ে যাওয়ার উপক্রম হলে গুলনূর তাড়াতাড়ি সেটা ধরে ফেলল। 

জাওয়াদ অজান্তে আওড়াল, "বাহ্!"

তার বুকে অদ্ভুত শীতলতা অনুভব হয়। এমন শীতল অনুভূতি সে গত তিন বছর পায়নি। এ তিন বছর শুধু বুকের ভেতরে আগুনই জ্বলেছে। 

গুলনূর ধীরে ধীরে রেলিং থেকে নামে। তার সালোয়ারটি ঢিলেঢালা। পায়ের গোড়ালির কাছে আবার একটু সরু হয়ে গেছে। দুই পা সামনে এগোতেই কাপড়টা দুলে উঠল। গুলনূর ঘরে গিয়ে আবার ফিরে এসে রেলিংয়ে বসল। আগের মতোই চাঁদের দিকে তাকিয়ে রইল নিষ্পলক। 

জাওয়াদ তখনও জানালায় দাঁড়িয়ে। হঠাৎ তার মনে একটা ধাক্কা লাগল। গত দুইদিন ধরে সে যে চিঠির মালিককে খুঁজছে, তার সাথে এই মেয়ের কেমন যেন একটা মিল। সেই অক্ষরগুলো, সেই ভাষার ব্যবহার সবই এই মেয়ের সঙ্গে কোথাও একটা যাচ্ছে...

সেদিন মনিরকে সে চিঠিটা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, "এই হাতের লেখা কার? কে কে এখানে লিখতে পারে?" মনির তখন ভাবতে ভাবতে বলেছিল, "হুজুর, দুই জমিদার আর বড় বেগম ছাড়া বাড়ির আর কেউ তো পড়াশোনা পারে না।" একটু থেমে আবার বলেছিল, "তবে নতুন বেগম পারে কি না জানা নেই।"

গুলনূরের দৃষ্টি অকস্মাৎ ঘুরে গেল উপরের দিকে। চোখ পড়ল জানালায় দাঁড়িয়ে থাকা জমিদার পুত্রের উপর। সঙ্গে সঙ্গে চোখ দুটো বড় হয়ে গেল। মুখের রং পাল্টে গেল মুহূর্তের মধ্যে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে, কেউ লাল গোলাপের পাপড়িতে সাদা রঙের ছোঁয়া লাগিয়ে দিয়েছে।

তার হাত দ্রুত উঠে গেল মাথার দিকে। ওড়নাটা যে কখন কাঁধ থেকে সরে গিয়েছিল, সেদিকে খেয়ালই ছিল না। 

ঘোমটা টেনে কুর্নিশ জানাল জাওয়াদকে। তার সমস্ত শরীর যেন বলছিল, "মাফ করবেন, হুজুর। আমি আপনাকে দেখতে পাইনি।"

নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে জাওয়াদ। তার দৃষ্টি নিবদ্ধ সামনের দিকে। গুলনূরের সুকোমল দেহ কুঁকড়ে আছে কুর্নিশের ভঙ্গিতে। দুজনেই কোথাও হারিয়ে গেছে, নিস্তব্ধতার গভীর সাগরে ডুবে আছে তাদের অস্তিত্ব। 

একটি পাখির করুণ ডাক ছুরির মতো বিদ্ধ করল শান্ত বাতাসকে। সেই অপ্রত্যাশিত শব্দে চমকে উঠল গুলনূর। তার নরম দেহ কেঁপে উঠল একটু। ধীরে ধীরে, অতি সন্তর্পণে সে তার মাথা তুলল।
জাওয়াদ অনড়। গুলনূরের চমকানি তার মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া জাগায়নি।
·
·
·
চলবে........................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp