সন্ধ্যা নামার আগে ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে আসছে চড়ুই পাখির দল। দলবেঁধে বসেছে বৈদ্যুতিক খুঁটিতে, তারে, চৌধুরী বাড়ির ছাদে ও গাছের ডালে। কিচিরমিচির শব্দে মুখর হয়ে ওঠে চারপাশ। চারিদিকে গাছগাছালি। মাঝখানে কিছু ঘরের মধ্যে আলো জ্বলছে। এত পাখি একসঙ্গে দেখে কিছুটা অবাক রোদেলা। দোতলার করিডোরে বসে নজর রেখেছে জানালার বাইরে। বুকের ভেতর অস্থিরতা বাড়ছে। পুরো মুখে অস্বস্তি ফুটে উঠেছে। রোদেলা ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলে হাতে মোবাইল ধরে দেয়ালের সঙ্গে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়ায়। চোখ বন্ধ করে ভারী নিঃশ্বাস নিলো। সেহরিশ এখনো ফিরে আসেনি। আজ সকালে মেসেজ করে লিখেছে, আমার জন্য চিন্তা করবে না। নিজের যত্ন নিও।
যতোই বারণ করুন। তবু এই চিন্তা নামক শব্দটা মাথায় চলে আসে। রোদেলার মামা-মামী আজ দুপুরে বিদায় নিয়ে তাদের বাড়ি চলে গেছেন। সে থেকে মনটা আরেকটু খারাপ লাগছে। সঙ্গে শরীরটাও কেমন যেনো করছে। একটু পরপর মাথা ঘুরছে, খাবারে অরুচি ও মাছমাংসে তীব্র গন্ধ ঠেকছে নাকে। দুদিন ধরে খাওয়া দাওয়া তেমন হচ্ছে না। আজ দুবার বমি করেছে। মাইমুনা বার বার ওকে রেস্ট করার জন্য বলেছে। আর সে এখানে বসে আছে। রোদেলা চোখ মেলতেই চমকে উঠল। মারিয়া একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে। রোদেলার সঙ্গে প্রচুর ভাব মেয়েটার। মারিয়া বলল, 'চাঁচি, মা আপনাকে ডাকছে।'
রোদেলা লহু গলায় বলল, 'ভাবী কোথায়?'
'বসারঘরে।'
রোদেলা এগোল। মারিয়া আগে আগেই ছুটে চলে গেছে। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় রোদেলার মাথা চক্কর দিয়ে উঠল। আর দুটো সিঁড়ি বাকি আছে। হঠাৎ মাথা ঘুরতে ও দু’হাতে মাথা চেপে বসে পড়ল। মাইমুনা দেখে এগিয়ে আসে। রোদেলার হাত ধরে বলল, 'আবারও মাথা ঘুরছে? আমার কথা তো শুনবে না। শুনবে কেন? রক্তের তো কেউ হই না। যদি বড় বোন হতাম তাহলে ঠিকই শুনতে।'
রোদেলা জবাব দিলো না। মাইমুনা বলল,
'আমি সঙ্গে শহরে চলো। এখন গেলেও ডাক্তার পাবো।'
শরীর বেশি খারাপ লাগছে দেখে রোদেলা যেতে রাজি হল। মাইমুনা ওর স্বামীকে বলে তারপর রোদেলাকে নিয়ে বের হল। গাড়ির মধ্যে দুই একবার রোদেলার বমি পাচ্ছিল। কিন্তু শেষে আর বমি হয়নি। মাইমুনা গভীরভাবে রোদেলা কে লক্ষ্য করে। হুট করে বলল, 'রোদেলা, তুমি প্রেগন্যান্ট নও তো?'
রোদে চমকে উঠে। এই কথাটা তার মনে কয়েকবার এসেছে। কিন্তু পরেই সে ভাবনা থেকে মাথা ঝাড়া দিয়ে উঠেছে। কিন্তু বাচ্চা! রোদেলার ভীষণ প্রিয়। বাচ্চা দেখলে সে আদর করে। দু বছর ধরে চেষ্টা করেছে কিন্তু ওর কোল আলো করে কারো আশার নাম নেই। বাড়ির অবস্থা করুণ। সকলের মন খারাপ। এই সময় অন্য বিষয় নিয়ে মোটেই মাথা ঘামাতে চায় না রোদেলা। কিন্তু এখন মাইমুনার কথা শুনে, বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠল। মাইমুনা নড়েচড়ে বসে বলল, 'দেখ, তোমার অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে তুমি প্রেগন্যান্ট। বার বার বমি আসা, মাথা ঘোরানো আর মাছ মাংসে গন্ধ। এটা মূলত প্রেগন্যান্সির প্রথম তিন মাসে হয়। তারপর ধীরেধীরে ঠিক হয়ে যায়।'
রোদেলার ঠোঁটে উজ্জ্বল হাসি। সে বলল, 'আমিও কি তবে মা হবো?'
মাইমুনা সঙ্গে সঙ্গে রোদেলা কে জড়িয়ে ধরে। রোদেলার চোখ ছলছল করছে। আলগোছে দুফোঁটা অশ্রুজল গড়িয়ে পড়ে।
দুইঘণ্টা হবে হাসপাতালে বসে রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করছে রোদেলা। হাসপাতালে পরিচিত লোক ছিল বৈকি মাইমুনা ওর সঙ্গে কথা বলে প্রথমেই ডাক্তার দেখাতে পেরেছে। রোদেলার চেক-আপ করে বেশ কিছু রিপোর্ট দেন তিনি। প্রথম দু'টো রিপোর্ট দেখে ডাক্তার অবাক হন। এরপর আরও একটা রিপোর্ট লিখেন। এক ঘন্টা সময় ধরে সে রিপোর্টের অপেক্ষায় আছে। রিপোর্ট ডাক্তার কে দেখিয়ে তবেই বাড়ি ফিরবে। এরমধ্যে মাইমুনার ফোনে কল দিচ্ছে ওর স্বামী সোহান। প্রথমবার কল রিসিভ করেনি ও। দ্বিতীয় বার কল দিচ্ছে মানে জরুরী ভেবে রিসিভ করে। সোহানের কাছ থেকে জানতে পারলো ওদের শ্বাশুড়িমা কেমন অদ্ভুত আচরণ করছে। ঘুম থেকে উঠে আরুশির জন্য কান্নাকাটি শুরু করে। তার একার পক্ষে সামলানো সম্ভব হচ্ছে না। মাইমুনা একটু ভাবলো। ঘটনা রোদেলা কে জানাতে সে ঝটপট বলল, 'ভাবী, চলুন। বাড়ি ফিরে যাই। রিপোর্ট কাল তুলে ডাক্তার দেখাবো।'
রোদেলার কথা মাইমুনার ভালো লাগলো না। সে সকাল থেকে লক্ষ্য করেছে রোদেলার শরীরট ভালো না। এজন্য জোর করে হাসপাতালে নিয়ে এল। এখন মাঝপথে এসে চলে গেলে ওর শরীর ভালো হবে না। সেহরিশ বাড়ি থাকলে এ কাজটা সে করতো না।
মাইমুনা বলল,
'তুমি হাসপাতালে থাকো। কিছুক্ষণ পর রিপোর্ট ডাক্তার কে দেখাবে তারপর উনি প্রেসক্রিপশন লিখে দিবেন। সমস্ত ঔষধ নিয়ে বাড়ি ফিরবে। আমি তোমাকে সুস্থ দেখতে চাই। আর শুনো এই অবস্থায় বেশি টেনশন করতে নেই। ডাক্তার গুড নিউজ-ই শোনাবেন।'
'কিন্তু মা?'
'তুমি চিন্তা কোরো না। আমি ক্যাব নিয়ে বাড়ি চলে যাচ্ছি। তুমি ধীরেসুস্থে গাড়ি নিয়ে বাড়ি ফিরবে। ঠিক আছে? আর সিঁড়ি ভেঙে সাবধানে নামবে।'
রোদেলা মাথা নাড়লো। ঠিক বড় বোনের মতো শাসন করে মাইমুনা চলে গেল। একজন নার্স এসে রোদেলাকে তার সঙ্গে নিয়ে যায়। একটু পর রিপোর্ট সহ ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকে রোদেলা। ডাক্তার ফারহানা বসে আছেন। তিনি আগের রিপোর্ট ও এখনকার রিপোর্ট চেক করেন। ভারী নিঃশ্বাস ফেলল। হাত দিয়ে চোখের চশমা খুলে টেবিলে রাখেন। এরপর রোদেলার দিকে তাকিয়ে বললেন,
'আপনার সবগুলো রিপোর্ট আমি ভালো করে পড়লাম মিসেস চৌধুরী। আপনি প্রেগন্যান্ট নন। আপনি কোনো বিষয়ে অধিক চিন্তা করছেন এবং খাবার ঠিক মতো খাচ্ছেন না এজন্য আপনার মাথা ঘুরছে। খাবার থেকে গন্ধ আসে, বমি পায়। এর কারণ আপনার জন্ডিস হয়েছে। আমি ঔষধ লিখে দিচ্ছি নিয়ম করে খাবেন।'
রোদেলার মুখে রাতের আঁধার নেমে এল। ঠোঁট উল্টিয়ে আলতোভাবে ডানে মাথা নাড়লো সে। বোঝা যাচ্ছে কান্না আটকানোর চেষ্টা করছে। ডাক্তার ফারহানা দুই আঙুলের মাঝের কলমটা একটু ঘুরিয়ে বললেন,
'আপনার মনের অবস্থা আমি বুঝতে পারছি মিসেস চৌধুরী। নিজেকে একটু শক্ত করুন। আপনাকে দেখে বোঝা যায় আপনি অনেক নরম মনের মানুষ। বাচ্চা আপনার ভীষণ পছন্দের। তবে আমি এখন যেটা বলব সেটা শুনে আপনি কিরকম রিঅ্যাক্ট করবেন আমি বুঝতে পারছি না।'
রোদেলা চকিত তাকাল। ডাক্তার ফারহানা বললেন,
'আপনি কখনো মা হতে পারবেন না।'
রোদেলার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেছে। দুই কান দিয়ে গরম ধোঁয়া বের হচ্ছে। রোদেলা স্তব্ধ, নিথর বসে আছে। ডাক্তার ফারহানা আরও কিছু কথা বললেন কিন্তু ও কোনো কিছু শুনতে পাচ্ছে না। মাথাটা চক্কর দিচ্ছে। শরীরটা থরথর করে কাঁপছে। একটু সময় নিয়ে রোদেলা উঠে দাঁড়াল। রিপোর্ট ও ফাইল নিয়ে টলতে টলতে চেম্বার থেকে বেরিয়ে এল সে। ঔষধ নেয়নি। হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে সোজা হাঁটতে লাগল ফুটপাত দিয়ে। চারিপাশে এত কোলাহল, হইচই কোনো কিছু আজ রোদেলার কান স্পর্শ করছে না। বুকের ভেতর চাপা পড়ে গেছে আর্তচিৎকার। দুটো চোখ ভয়ংকর লাল হয়ে গেছে।
রাত দশটা বাজে। ড্রাইভার চৌধুরী বাড়ি ফিরে আসে। সে মাইমুনার হাতে দিতে সদরদরজার বেল বাজালো। রোদেলা আসছে ভেবে তড়িঘড়ি করে দরজা খুলে দেয় মাইমুনা। তার হাসি মুখটা হঠাৎ মলিন হয়ে গেল। ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে, 'রোদেলা কোথায়? গাড়িতে আছে বুঝি?'
ড্রাইভার করিম বললেন, 'বড় বউমা, ছোট বউমা তার মামার বাড়ির ওইখানে নাইমা গেছে। হাসপাতাল থেইকা বের হইয়া সে একা একা রাস্তা দিয়া হাঁটতে ছিল। আমি তারে পরে দেখতে পাই। তখন অনেক রিকুয়েষ্ট করে গাড়িতে বসাই। এলাকায় আসার পর হঠাৎ বলে সে ওর মামার বাড়িতে নামবে। আমি যেনো তাকে ওখানে নামিয়ে দিয়ে চৌধুরী ভিলায় ফিরে যাই।'
মাইমুনা বিস্মিত। 'রোদেলা এইরকম করেছে কেন? সে তো অনেক বুদ্ধিমতী মেয়ে।'
করিম বললেন, 'জানো বড়ো বউমা, ছোটো বউমা যখন রাস্তা দিয়া হাঁটতে ছিল তখন তার কোনো হুঁশ ছিল না। আর অবাক করা কান্ড তার চোখ দুইটা অনেক লাল দেখা গেছিল। আমি তো প্রথমবার দেখে ভয় পাইয়া গেছিলাম।'
মাইমুনা বলল, 'আচ্ছা চাচা। তুমি বাড়ি যাওয়ার আগে রাতে খেয়ে যেও। আর রোদেলার সঙ্গে আমি পরে কথা বলে নেব।'
করিম মাথা নেড়ে বললেন, 'আচ্ছা মা।'
গাড়ির শব্দ হল। মাইমুনা গেটের দিকে তাকিয়ে দেখল সেহরিশের গাড়ি ঢুকছে। সেহরিশ গাড়ি পার্ক করে বাড়ির ভেতরে আসে। বাবা-মা দু'জনে ঘুমের ঔষধ খেয়ে ঘুমিয়েছেন মাত্র। সোহন ওর মেয়ের সঙ্গে ড্রয়িংরুমে বসে আছে। মাইমুনা এক গ্লাস পানি সেহরিশের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, 'দুদিন কোথায় ছিলে ভাই? বাবা হাজারবার তোমার কথা জিজ্ঞেস করেছেন।'
'বাবা-মা কোথায়?'
'মাত্রই ঘুমালো।'
সেহরিশ এদিক ওদিক তাকাল। মাইমুনা বলল,
'রোদেলাকে খুঁজছো?'
'হ্যাঁ, রোদ কোথায়? দুদিন হলো দেখিনা কিন্তু মনে হচ্ছে দুই যুগ ধরে দেখতে পাইনি।'
মাইমুনা নরম গলায় বললেন,
'রোদেলার শরীরটা খারাপ করেছিল। বার বার বমি ও মাথ ঘোরানো তাই সন্ধ্যা বেলায় ওকে নিয়ে হাসপাতালে গিয়ে ছিলাম।'
সেহরিশ চোখ বড়বড় করে তাকাল। হাতের গ্লাসটা নামিয়ে রেখে সিঁড়ির দিকে দৌঁড়ে গেল। মাইমুনা উচ্চ গলায় বলল, 'রোদেলা ঘরে নেই।'
সেহরিশ তাকাল। জিজ্ঞেস করলো, 'ঘরে নেই তাহলে কোথায়?'
'ওর মামার বাড়ি গেছে।'
সেহরিশ চিন্তায় পড়ল। গম্ভীর ভঙ্গিতে বলল, 'তুমি মাত্রই বললে অসুস্থ। তাহলে মামা বাড়ি কিভাবে গেল?'
মাইমুনা বিস্তারিত সেহরিশকে বলল। সেহরিশ সদরদরজার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলল,
'আমার জন্য অপেক্ষা কোরো না। শ্বশুর বাড়ি যাচ্ছি।'
ঘরে ঢুকে দরজা দিয়েছে রোদেলা। মামস মামী কারো ডাকেই সাড়া দেয় নি। দুই বছর পর মেয়েটা তাদের বাড়িতে আসলো। আর এসেই ঘরে ঢুকে বসেছে। এর কারণ মাথায় ঢুকলো না কারো। রাফসান এসেও দুবার ডেকে গেছে। ভাইয়ের ডাকেও ফিরে তাকায়নি সে। মাসুদ মিয়ার টিনের ঘরটাই এখনো আছে। সেহরিশ মাসুদ মিয়ার সঙ্গে একবার বাড়ি তৈরীর জন্য কথা বলে। কিন্তু মাসুদ মিয়া সরাসরি না করে দেন। উনি গরীব মানুষ। মেয়ের জামাই ঘর বানিয়ে দিবে আর তারা ওখানে থাকবে। অসম্ভব! সেহরিশ অনেক বোঝানোর পর মাসুদ মিয়া রাজি হননি৷ তখন মাসুদ মিয়া বলেন, 'গরীব ঘরে রাজকুমারীর জন্ম বাবা। তুমি তারে নিজের করেই নিয়ে গেছে। সেটা পরিস্থিতির চাপেই হোক। আমি সারাজীবন তোমার কাছে কৃতজ্ঞ থাকব৷ কিন্তু বিশ্বাস করো আমার উঁচু বাড়ি দরকার নাই। তোমরা একদিন এই গরীব মামার ঘরে আইসো। ফাইভ স্টার হোটেলের মতো আরাম পাবা না কিন্তু আমি ছেলের মতো যত্নে রাখুম।'
সেহরিশ সেদিন নিশ্চুপ হয়ে গিয়েছিল। কিছু মানুষের কাছে আজও তাদের আত্মসম্মানটাই অধিক মূল্যবান। যাদের আত্মসম্মান বোধ নেই, তারা মেরুদণ্ডহীন।
গ্রামের প্রধান রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে মাসুদ মিয়ার বাড়ির দিকের সরু রাস্তা ধরে হেঁটে চলেছে সেহরিশ। আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে অনেকটা ভেতরে ঢুকে তবেই মাসুদ মিয়ার টিনের ঘরটি দেখতে পেল। সরু মাটির রাস্তা ধরে উঠানে এসে দাঁড়াল সে। দ্বিতীয় ঘরের দরজা খোলা। ঘরের মাঝখানে বসে আছেন মাসুদ মিয়া। পায়ের শব্দ শুনে তিনি চকিত তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, 'কে?'
সেহরিশ বলল, 'আমি।'
পুতুল বেগম প্রফুল্লচিত্তে বললেন, 'জামাই আসছে। তাড়াতাড়ি চলো।'
পুতুল বেগম ও মাসুদ মিয়া সেহরিশ কে নিয়ে তাদের ঘরে বসতে বলেন। রোদেলার হঠাৎ কি হয়েছে তারাও ঠিক জানে না। মেয়েটা এসেছে পর থেকে নিজেকে ঘরবন্দী করে রেখেছে। সেহরিশ ভারী নিঃশ্বাস ফেলল। হঠাৎ কী হলো তার রৌদ্রময়ীর। টুল ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। মামা মামীর সঙ্গে কথা শেষ করে। রোদেলার দরজায় কড়া নাড়লো সে। একবার দু'বার এরপর কয়েকবার। ওপাশ থেকে কোন শব্দ এল না। সেহরিশ দরজার সঙ্গে মাথা ঠেকালো। নরম গলায় বলল, 'রোদ, তুমি যদি দরজা না খুলো আমি এখান থেকে একটুও নড়বো না। পুরো রাত বাহিরেই দাঁড়িয়ে থাকবো।'
দুই মিনিট পর দরজা খুললো রোদেলা। আচমকা রোদেলার বিষণ্ণ মুখটা দেখে আঁতকে উঠল সেহরিশ চোখ বড় বড় করে বলল, 'একি অবস্থা করেছো নিজের?'
রোদেলা ঠোঁট উল্টিয়ে ফেলল। একটু পর ভাঙা ভাঙা গলায় বলল, 'আপনি কেনো এসেছেন? চলে যান।'
সেহরিশ অবাক হয়ে যায়। রোদেলার কাছে এমন কথা সে শুনবে কখনো প্রত্যাশা করেনি। রোদেলা মাথা নিচু করে কাঁদতে লাগল। সেহরিশ রুমে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দেয়। দরজার দুগালে হাত রেখে জিজ্ঞেস করলো,
'কি হইছে তোমার? আমাকে বলো।'
'আপনি আমার কাছে আর আসবেন না। আমার আপনাকে দেওয়ার মতো কিছুই নেই। আমি অপদার্থ, অপয়া।'
রোদেলা শব্দ করে কাঁদতে লাগল। মূহুর্তে উত্তেজিত হয়ে পড়ে। সেহরিশ রোদেলাকে সন্তর্পণে জড়িয়ে ধরে বলল, 'তুমি এসব কি বলছো? তুমি কেনো অপয়া হবে? তুমি আমার হৃদপিণ্ড।'
রোদেলা জবাব দিল না। নিঃশব্দে সেহরিশকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। গাল গড়িয়ে যাচ্ছে অগুনিত অশ্রুজল। সেহরিশ ওর মাথায় বুলিয়ে বলল,
'শান্ত হও, রোদ।'
ঘড়ির কাঁটা একটা ছুঁইছুঁই। শান্ত হয়েছে রোদেলা। খাটের ওপর গুটিশুটি মেরে বসে আছে। সেহরিশ সামনে বসে জিজ্ঞেস করলো, 'এখন বলো, কি হইছে? আমি আসিনি বলে এতো অভিমান জমিয়েছ?'
রোদেলা ডান থেকে বামে নিবিড়ভাবে মাথা নাড়লো। বলল,
'নাহ।'
'তাহলে?'
রোদেলা চোখ তুলে সেহরিশকে দেখল। অপরাধীর মতো করে বলল, 'আমি কখনো মা হতে পারবো না। ডাক্তার রিপোর্ট দেখেই আমার জানিয়েছেন। আপনি বরং আমাকে এবার ছেড়ে দিন। আরেকটা বিয়ে করে নতুন করে জীবন শুরু করেন।'
কথাটা বলে থামলো রোদেলা। আচমকা রোদেলাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে সেহরিশ। এই ধরার মধ্যে আলাদা এক অনুভব আছে। ভয়! সেহরিশ এলোমেলো কণ্ঠে বলল, 'এই কথা মুখেও এনো না। আমি তোমাকে ছাড়া নিজেকে কল্পনা ও করতে পারি না। তোমাকে ছাড়া আমার শ্বাসরুদ্ধ কষ্ট হয়। রোদ, তুমি কখনো আমায় একা রেখে যেও না। পৃথিবীর যেখানে যাও, আমাকে সঙ্গে নিয়ে যেও।'
বলে থামল সেহরিশ। এরপর রোদেলার দুগালে হাত রেখে ধড়মড়িয়ে বলল, 'আমার বাচ্চা লাগবে না, রোদ। বাবা হতে হবে না। আমি বাচ্চা চাই না, আমি শুধু চাই তোমাকে। নিজেকে আমার থেকে দূরে সরিয়ে নিও না। তোমাকে ছাড়া আমি ছন্নছাড়া হয়ে পড়বো। সারা পৃথিবী ত্যাগ করে হলেও আমি তোমাকে চাই।'
.
.
.
চলবে.........................................................................