স্টে উইথ মি - পর্ব ০৫ - নুসরাত জাহান বৃষ্টি - ধারাবাহিক গল্প


          শেরাজ ল্যাপটপটা ধীরে ধীরে বন্ধ করে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। এগিয়ে গেল মেহুলের হাস্যোজ্জ্বল ছবিটার সামনে। প্যান্টের পকেটে হাত গুঁজে শরীর টানটান করে ছবিটার দিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে রইল। তীক্ষ্ণ তার চেহারা, পরিপাটি করা চুলগুলো থেকে গুটি কয়েক চুল কপাল ছুঁয়েছে, কালো শার্টের হাতা দু হাতের কনুই পর্যন্ত গুটানো। ঠোঁটের কোণে তার এক চিলতে রহস্যময় হাসি। এতক্ষণ ধরে জাফিরের সাথে যা যা ঘটেছে সবটাই শেরাজের হাতের ইশারায়। শেরাজ পকেট থেকে হাত বের করে মেহুলের ছবিটায় আলতো করে ছুঁয়ে শীতল কণ্ঠে বলল।

"মেহু, কাজটা ঠিক করি নি। ওই জাফিরের জন্য এই শাস্তিটুকু যথেষ্ট তাই না জান? ভেবেছিলাম ওকে এক্কেবারের জন্য দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেব। কিন্তু পরে ভেবে দেখলাম না ওকে বাঁচিয়ে রাখাই ভালো। ওকে মেরে ফেললে তো ওর জীবনের খেলা শেষ। মরে গেলে তো এই অসহনীয় যন্ত্রণা অনুভব করার সুযোগই থাকবে না।"

শেরাজ শ্বাস ফেলে মেহুলের ছবির দিকে আরও এক ধাপ এগিয়ে গেল। চোখে পাগলামির ঝলক। গলায় ঝাঁঝ এনে বলল, "এই হাতের যন্ত্রণা ওকে প্রতিদিন মনে করিয়ে দেবে ও কী অপরাধ করেছে? ও কাকে ছুঁয়েছে? কাকে প্রেম নিবেদন করেছে?"

শেরাজ দাঁতে দাঁত চেপে হাসল যেন হিংস্রতা মিশে আছে এই হাসিতে, "পাঁচ বছর আগে যা করেছিলাম, পাঁচ বছর পরেও ঠিক তাই তাই করব দরকার পড়লে এর থেকেও ভয়ংকর কাজ করব তোকে যেই স্পর্শ করবে তার সাথে।"
 
—————

মেহুল ক্লাস শেষে কম্পাসে এসে দাঁড়ালো। তার পাশের তিনজন নাকে মুখে কথা বলে যাচ্ছে। কিন্তু মেহুল চুপ! তার মস্তিষ্কে আর মনে রাতের আসা ওই দুটো মেসেজের কথা ঘুরপাক খাচ্ছে বার বার। কে হতে পারে? কে পাঠালো এই ধরনের মেসেজ তাকে? রাত থেকে এটা ভেবে ভেবে মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে তার।

আকস্মিক পেছন থেকে দুর্বল এক পুরুষালী কণ্ঠ কানে ভেসে এলো। মেহুল পেছন ফিরে তাকাতেই চমকে উঠলো জাফিরকে দেখে। জাফিরের চোখে মুখের করুণ অবস্থা। এক রাতের মধ্যে যেন ছেলেটা নিজের সত্তা হারিয়ে ফেলেছে। ডান হাতটা ব্যান্ডেজ করা যা আর্ম স্লিপ দ্বারা সর্পোটে। মেহুল চিন্তিত স্বরে বলল।

"জাফির ভাইয়া, আপনার হাতে কী হয়েছে?"

মেহুল জাফিরের হাতটা ছুঁতে নিলে জাফির দুর্বল শরীর নিয়ে দু'কদম পিছিয়ে গিয়ে ভাঙা গলায় বলল, "ছোঁও না তুমি আমায় মেহুল। তোমাকে একবার স্পর্শ করার জন্য যা যন্ত্রণা সইতে হচ্ছে না জানি দ্বিতীয়বার তোমার ছোঁয়া লাগলে আমাকে কতটা যন্ত্রণা সইতে হবে!"

মেহুল ভ্রু কুঁচকে হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে আছে। জাফির ভাইয়া কী বলছে এসব? তাকে ছোঁয়ার জন্য যন্ত্রণা সইতে হয়েছে মানে? মেহুল বিস্মিত কণ্ঠে বলল, "কী বলছো তুমি এসব জাফির ভাইয়া? আর তোমার হাতে কী হয়েছে? গতকাল তো ভালো ছিলো।"

জাফির চোখে মুখে একটা অস্থিরতা ফুটে উঠলো যেন। শুষ্ক ঠোঁট জোড়া বিছিয়ে আকস্মিক দু হাঁটু মুড়ে মেহুলের সামনে বসে পড়ল। মেহুল চমকে দু কদম পিছিয়ে যায়। কলি, ইকরা, লামিয়া একে অন্যের দিকে অবাক চোখে তাকায়। জাফির কি আজকেও মেহুলকে প্রপোজ করবে নাকি কোনো ভাবে? ভার্সিটির মধ্যমণি আপাতত মেহুল আর জাফির। মেহুল অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে জাফিরের দিকে‌ বোঝায় চেষ্টায় আছে জাফিরের পরবর্তী পদক্ষেপ কি হতে পারে। 

জাফির আচমকাই দু হাত জোড় করে নিচু গলায় বলতে শুরু করল, "মেহুল, আমায় তুমি ক্ষমা করে দাও বোন। গতকাল তোমাকে প্রপোজ করাটা আমার জীবনে সবচেয়ে বড়ো ভুল ছিল। তুমি আমায় ক্ষমা করো, বোন।"

জাফির এক পলক চুপ থেকে কিছু একটা ভেবে পাগলের ন্যায় মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, "না না, বোন না! তুমি আজ থেকে আমার মা। মা হয়ে সন্তানের ভুল তো ক্ষমা করা যেতেই পারে, তাই না? সে সন্তানের যত ভুলই হোক মায়ের কাছে সব ভুল মাপ।"

মেহুল আশ্চর্যভরা চোখে তাকিয়ে দেখছে জাফিরকে। গতকাল যেই জাফির নিজের মধ্যে এতোটা আত্মবিশ্বাস নিয়ে তাকে প্রপোজ করেছিল সেই জাফির আজ তাকে মা বলে ডাকছে, ভাবা যায়?

ইকরা, লামিয়া আর কলি নিজেদের হাসি চেপে রাখতে গিয়ে মুখ ঢাকল। কিন্তু পারল না ফোঁস করে হেসে ফেলল। আশপাশে যারা ছিল সবাই ঠোঁট চেপে হেসে চলেছে জাফিরের কান্ড দেখে। সবার মনে এখন একটা প্রশ্ন উঠছে জাফির কি কোনোভাবে পাগল হয়ে গেলো নাকি? না হলে ভার্সিটিতে এসে পাগলের প্রলাপ বকবে কেন? জাফিরের বন্ধুরা সবাই হতবাক জাফিরের‌ থা‌ শুনে। একজন এগিয়ে এসে রাগী গলায় জাফিরকে বলল,‌ "এই জাফির! কী বকছিস তুই এসব? নেশা করেছিস নাকি, হা রা মি?"

জাফির চেঁচিয়ে উঠল, "আমি নেশা করিনি! আর প্লিজ, তুই এর মাঝে বা হাত ঠোকাবি না!"

জাফিরের বন্ধু সরে গেল। জাফির মেহুলের দিকে ফিরে প্রায় কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলল, "মা আমার, আমাকে প্লিজ ক্ষমা করে দাও। যদি দরকার হয়, তাহলে আমি তোমার পায়ে পড়ছি।"

জাফির মেহুলের পায়ের দিকে হাত বাড়াতে নিলে মেহুল তড়িঘড়ি করে পিছিয়ে গিয়ে হতভম্ব গলায় বলল, "কি করছো তুমি, জাফির ভাইয়া?"

জাফির কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে জবাব দিল, "তুমি শুধু এতোটুকু বলো তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছো তাহলেই হবে। আমি তোমার কাছে আমার প্রাণ ভিক্ষা চাইছি মেহুল।"

মেহুল কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে কথাটা শুনে। তার মুখ থেকে কোনো কথা বেরোচ্ছে না। তার কাছে প্রাণ ভিক্ষা চাইছে কেন জাফির? কি এমন হয়েছে জাফিরের সাথে যে ছেলেটাকে এভাবে দুমড়ে মুছরে দিয়েছে। এমন সময় কলি মেহুলের কানে কানে ফিসফিস করে বলল, "মেহুল, তুই বলে দে জাফির ভাইয়াকে তুই ক্ষমা করে দিয়েছিস। না হলে ব্যাপারটা আরও জটিল হয়ে যাবে।"

মেহুল একটু সময় নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, "জাফির ভাইয়া। আমি আপনাকে ক্ষমা করে দিয়েছি। প্লিজ এবার উঠুন সবাই তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে।"

মেহুলের কথায় জাফিরের চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তার মুখে যেন এক টুকরো প্রশান্তি নেমে এলো। সে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল, কিন্তু শরীর এতটাই দুর্বল যে নিজের ভারসাম্য রাখতে হিমশিম খাচ্ছে। তবে জাফিরকে তার এক বন্ধু এসে ধরলো‌। চারপাশে লোকজন ফিসফিস করে নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। কিছু লোক মজা পাচ্ছে, কেউ আবার বিষণ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। 

জাফির আজ ভার্সিটিতে আসতে চায়নি। তার শরীর এতটাই দুর্বল ছিল যে বিছানা থেকে উঠতে পারছিল না। ভোর রাতে যখন জাফির বাড়ি ফিরেছিলো বাবা মা তার এই অবস্থা দেখে কারণ জানতে চাইলে কোনো উত্তর দেয় নি। সময় গড়িয়ে ঘড়ির কাঁটা বেলা বারোটার ঘরে যাবে যাবে ঠিক তখনই একটি অচেনা নাম্বার থেকে জাফিরের ফোনে কল আসে আর হুমকি দিয়ে বলে, "আজ যদি তুই মেহুলের কাছে ক্ষমা না চাস, তাহলে পরবর্তীতে তোকে যেখানে পাবো, সেখান থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে এমন শাস্তি দেব যা গত রাতের চেয়ে হাজার গুণ বেশি ভয়ঙ্কর হবে।" জাফির এই ভয়ঙ্কর হুমকি শুনে ভার্সিটি আসতে বাধ্য হয়। 

—————
 
শেরাজ তার ল্যাপটপের স্ক্রিনে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। স্ক্রিনে ভেসে ওঠা মেহুলের কাছে জাফিরে ক্ষমা চাওয়ার প্রতিটি দৃশ্য, প্রতিটি শব্দ সে গভীর মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে। তার বাঁ হাতে ধোঁয়া ওঠা কালো কফির কাপ যা মাঝে মাঝে ঠোঁটে ছুঁয়ে যাচ্ছে। ডান হাতে থাকা লাইটার ঘুরাতে ঘুরাতে নিজ মনে বলে উঠে।

"মেহু, তুই জানিস না, তোর জন্য আমি ঠিক কত দূর পর্যন্ত যেতে পারি। তোকে রক্ষা করার জন্য নিজেকে হারিয়ে ফেলতে হলেও আমি পিছু হটব না।"

কথাটা বলে এক চুমুক কফি খেয়ে বলল, "খুব জলদি তোর আমার দেখা‌ হবে। এই‌ পাঁচ বছরে তোকে কাছ থেকে না দেখে‌ যতোটা তৃষ্ণা জমেছে আমার দুচোখে এই সব তৃষ্ণা‌‌ আমি মিটাবো‌ এবার নিরবে নিভৃতে।"

বলে ফোনটা হাতে নিয়ে একটা নাম্বারে ফোন করে বলল,"আমার পাসপোর্ট রেডি হয়েছে বাংলাদেশে যাওয়ার জন্য।"

"জি স্যার আগামী সপ্তাহে আপনার ফ্লাইট।"

"ওকে।"

শেরাজ ফোন কেটে দিয়ে বেলকনিতে চলে যায়। ভোরের আলো ফুটে গেছে প্যারিস শহরে। সকালের দৃশ্যটা যেন মনোমুগ্ধকর করে তুলেছে আশপাশ। ঠান্ডা বাতাস বইছে যা ছুঁয়ে যাচ্ছে শেরাজের সর্বাঙ্গে। শেরাজ চোখ বন্ধ করে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করে মেহুলের মিষ্টি মুখখানা। কখন যাবে সে বাংলাদেশের কখন তার চোখের তৃষ্ণা মিটবে মেয়েটাকে দেখে। আর যে সহে না এ যাতনা।  

—————

কেটে গেছে এক সপ্তাহ। মির্জা বাড়ির সকলে গেছে একটা দাওয়াত রক্ষা করতে। কিন্তু মেহুল একা বাড়িতে রয়ে গেছে, যদিও আকলিমা আছে। মেহুলের শরীর ভালো লাগছে না বলেই যায়‌ নি। আতাউর মির্জা অনেক বার বলেছিলেন ওখানে গেলে ভালো লাগবে কিন্তু নাতনীর এক কথা তার যেতে ইচ্ছে হচ্ছে না। তাই আর আতাউর মির্জা জোর করেন নি। শুধু যাওয়ার আগে মাথায় হাত বুলিয়ে বলে গেছেন সাবধানে থাকবে। 

মেহুল গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে সে একটু আগেই ঘুম থেকে উঠেছে। চোখ মুখ ফুলে গেছে‌ মেয়েটার দীর্ঘ সময় ঘুমানোর জন্য। ঘড়ির কাঁটা এখন তিনটা এগারোর ঘরে। আকস্মিক কলিং বেল বেজে উঠল। মেহুল চমকে উঠে ভ্রু কুঁচকে নেয় এটা ভেবে, এই সময় আবার কে আসল? কলিং বেল তিন বার বাজার পর মেহুল বিরক্তবোধ‌ করলো আকলিমা খুলছে না কেন দরজাটা? ঘুমিয়ে গেলো নাকি মেয়েটা? মেহুল নিজেকে পরিপাটি করে চোখে চশমা পড়ে নিচে নামল। নিস্তব্ধতায় ঘিরে‌ আছে পুরো বাড়িটা। মেহুল সদর দরজা খুলতেই সদর দরজার সম্মুখে দাঁড়ানো মানুষটাকে দেখে স্তম্ভিত হয়ে পড়ে। চোখে মুখে ফুটে উঠল বিস্ময় আর অবিশ্বাস। নিজের চোখ দুটোকে যেন বিশ্বাস করতে চাইছে না। বার কয়েক বার চোখের পাতা ফেলে ঠোঁট নাড়িয়ে শুধু একটা কথাই আওড়ালো।

"শেরাজ ভাই।"
·
·
·
চলবে....................................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp