মাই মিস্টিরিয়াস প্রিন্স - পর্ব ২৭ - মৌমিতা মৌ - ধারাবাহিক গল্প


"মেয়েটা শ্বাস নিচ্ছে, কৌশিক! কতক্ষণ বাঁচবে জানি না। যা করার, এক্ষুনি করতে হবে!" নিক অনন্যাকে পরখ করে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলে উঠল।

কৌশিক দ্রুত হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। অনন্যার নিস্তেজ মাথাটা নিজের কোলে তুলে নিল। অনন্যার গলায় কৌশিকের আঙুলের ছাপ গাঢ় লাল হয়ে ছেপে গেছে, খানিকটা ডেবে গেছে। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছে কৌশিকের। অনন্যার এই অবস্থা দেখে নিজের হাতেই নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করছে তার।

পাশেই রিডো থেমে থেমে গর্জন করছে। তার তীক্ষ্ণ চোখে অগ্নি ঝরছে। কৌশিকের দিকে তাকিয়ে সে বারবার ক্ষুব্ধভাবে ঝাঁকিয়ে উঠছে। রিডোর ভেতরের ক্রোধ পুরো পরিবেশকে থরথর করে কাঁপিয়ে দিচ্ছে। নিক তাকে শান্ত করার চেষ্টা করল, কিন্তু রিডো কেবল কৌশিকের কথা মেনে চলে, কৌশিকের কথা বুঝতে পারে। তাই সে কৌশিকের বলার অপেক্ষায় ছিল।

নিক ব্যর্থ হয়ে বলল, "আমি ডাক্তার ডেকে আনছি। মেয়েটা বাঁচতে পারে।"

"নাহ! ডাক্তার আসতে আসতে অনেক দেরি হবে। বাড়িটা রাস্তার উপরে নয়, ঘন জঙ্গলের মাঝে।"

"তো কী করবে?"

কৌশিক প্রতিউত্তর করলো না। তার চোয়াল শক্ত, চোখে একগুঁয়েমিতা ফুটে উঠেছে।
নিক গর্জে উঠলো,
"ডোন্ট টেল মি.....! ব্রো, তুমি নিজের শক্তি খরচ করতে পারো না।"

কৌশিক একটুও কর্ণপাত করল না। সে ধীরে ধীরে অনন্যাকে পাঁজাকোলা করে তুলল। নিক এগিয়ে এসে বাধা দিয়ে বলল,
"আমাকে দাও। তুমি মাথা ঠান্ডা করে আসো।"

কৌশিক নিকের দিকে তাকাল না, কেবল দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
"নাহ! 
আঘাত আমি দিয়েছি, সারাবোও আমি। ক্ষতস্থান আমি তৈরি করেছি, দূর করবোও আমি। প্রয়োজন হলে আমার শরীরে অগণিত ক্ষত হোক, কিংবা জীবনটাই চলে যাক তাতেও সমস্যা নেই।

রিমেমবার ওয়ান থিং, এই মেয়েটা আমার। ওর সবকিছু, ওর অস্তিত্ব আমার। ওকে কেউ ছুঁতে পারবে না, তুমিও না। বিকজ, শি ইজ অল মাইন।"

নিক গভীর শ্বাস নিয়ে নিজের মাথা দু’হাত দিয়ে চেপে ধরল। বিরক্তি ঝরে পড়ল তার কণ্ঠে।
"কৌশিক, তোমার জীবন হয়তো যাবে না, কিন্তু অনেক ব্যথা সহ্য করতে হবে তোমায়।

আর হ্যাঁ, আমি জানি, এই মেয়েটা তোমার! এটা তুমি প্রথমদিনেই বলেছিলে। নাহলে সেদিনই মেয়েটার জীবন আমার হাতে শেষ হয়ে যেত। কিন্তু আজ তুমি এটা কি করলে?"

কৌশিকের কণ্ঠ শান্ত হলেও ভারী শোনাচ্ছিলো,
"আমি ইচ্ছে করে কিছু করিনি, নিক। তুমি সেটা জানো।"

এ কথা বলে কৌশিক তাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো। অনন্যার রুমের দিকে হাঁটতে হাঁটতে পেছনে ফিরে বলল,
"লারা আর তামং যেন এই বিষয়ে কিছুই জানতে না পারে। এটা সামলানোর দায়িত্ব তোমার ওপর ছেড়ে দিলাম।"

••••••••••••

অনন্যার গলায় নিজের আঙুল ছুঁয়ে রেখেছে কৌশিক। বিছানায় শুয়ে থাকা অনন্যাকে দেখে তার বুকের ভেতর অপরাধবোধের পাহাড় জমেছে। এই হাত দিয়েই সে মেয়েটাকে আঘাত করেছে। কীভাবে পারলো এমনটা করতে! নিজের ওপরেই যেন ঘৃণা ধরে গেছে কৌশিকের।
চোখ নামিয়ে, নিঃশব্দে কাঁপতে থাকা আঙুলগুলো অনন্যার ললাটে রাখলো কৌশিক। তারপর চোখ বন্ধ করে নিজের শক্তিকে কেন্দ্রীভূত করলো।

ধীরে ধীরে সেই শক্তি প্রবাহিত হতে শুরু করলো অনন্যার শরীরে। তার প্রতিটা স্পন্দন জীবনের ছোঁয়া দিতে লাগলো। কিন্তু একই সাথে কৌশিকের শরীর থেকে এক ধরনের কালো ধোঁয়া বের হতে লাগলো, একেবারে ভাঙা ইঞ্জিনের মতো। ধোঁয়ার ঘনত্ব বেড়েই চলল, যেন পুরো রুমটা ঢেকে ফেলবে।

জন্ম-মৃত্যু সবই উপরওয়ালার হাতে। কোনো জীব যদি সেই নিয়ম ভাঙার চেষ্টা করে, শাস্তি তো তাকে পেতেই হবে। কৌশিক জানতো এটা হবে, তবু নিজেকে থামাতে পারেনি।

পাঁচ মিনিটের মাথায় সে অনন্যার ললাট থেকে হাত সরিয়ে চেয়ার থেকে পড়ে গেলো। তার শরীর দাউদাউ আগুনে জ্বলছে যেন। ব্যথার তীব্রতায় পুরো শরীর মোচড়াচ্ছে। দাঁড়ানোর চেষ্টা করেও পারলো না। চিৎকার করতে ইচ্ছে করলেও ঠোঁট কামড়ে চেপে ধরলো সে। অনন্যা যদি জেগে যায়?

নিজেকে টেনে, হামাগুড়ি দিয়ে কোনোভাবে রুম থেকে বেরিয়ে নিজের ঘরে ঢুকলো কৌশিক। দরজা বন্ধ করার মতো শক্তি অবশিষ্ট নেই। অবশেষে যন্ত্রণায় দম ছেড়ে এক ভয়ঙ্কর চিৎকার বের হলো তার কণ্ঠ থেকে।

নিক তৎক্ষণাৎ ছুটে এলো। কৌশিকের অবস্থা দেখে থমকে গেলো সে।
নিকের এখনো মনে আছে,
ভেনোরা বলেছিল, কৌশিকের শক্তি কাউকে দিতে হলে সম্পূর্ণটাই দিতে হবে। যদি শক্তি কোথাও স্থানান্তরিত হতে থাকে এর শাস্তি সহ্য করার ক্ষমতা কারোর নেই।

কৌশিক যন্ত্রণায় কুঁকড়ে গিয়ে নিকের দিকে তড়িত গতিতে এগিয়ে গেল। তার চোখে যেন আগুন জ্বলছে। জোরালো কণ্ঠে বলে উঠল,
"কয়েকজন মানুষ নিয়ে আসো। আমি আর সহ্য করতে পারছি না। ব্যথায় পাগল হয়ে যাচ্ছি!"

নিক মুখে হতাশার ছাপ এনে বলল,
"আমি তো আগেই বলেছিলাম।"

এ কথা শুনে কৌশিক পশুর মতো গর্জন করে উঠল। তার ভেতরের রাগ চেহারায় ফুটে উঠছে। দিশেহারা কণ্ঠে সে চিৎকার করে বলল,
"দুইজন হলেও চলবে! এমন দু’জনকে নিয়ে আসো, যাদের পৃথিবীতে কেউ নেই। তারা চলে গেলেও কেউ খুঁজতে আসবে না। প্লিজ, নিক, দেরি কোরো না। তাড়াতাড়ি করো।"

নিক এক মুহূর্তের জন্য চুপ করে থাকল, তারপর বলল,
"এখন আমি বের হতে পারবো না। সন্ধ্যা হলে পারতাম।"

কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে কৌশিক তার রাগ ধরে রাখতে পারল না। হতাশায় গর্জন করে নিকের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ল। তার পায়ে আঁচড় কেটে দিলো, যেন সেই ব্যথার অর্ধেকটাও নিকের সাথে শেয়ার করতে চাইছে।

নিক দ্রুত পিছিয়ে গিয়ে হাত তুলে থামার ইঙ্গিত করল। শান্ত গলায় বলল,
"আমি তামংকে কাজে লাগাচ্ছি। তুমি নিজেকে সামলাও। এমন বিরূপ আচরণ কোরো না।"

কৌশিক কাঁপতে কাঁপতে চিৎকার করে উঠল,
"কীভাবে শান্ত থাকি, বলো! সেদিন তো এমন হয়নি, আজ কেন হচ্ছে? কেনো, নিক? হুয়াই?"

নিক গভীর একটা শ্বাস নিয়ে বলল,
"ব্রো, তুমি নিয়মিত শক্তি গ্রহণ করছো না। হয়তো এটাই কারণ। আমি যাচ্ছি, শান্ত থাকো।"

নিক দরজা বন্ধ করে চলে গেলো। কৌশিক নিজের হাত দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরলো। নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করতে লাগলো।

••••••••••••

কয়েক ঘণ্টা পর অনন্যা ধীরে ধীরে চোখ খুললো। মাথায় ভার অনুভব করলো, মনে হচ্ছে কোনো দুঃস্বপ্নের ভেতর থেকে উঠে এসেছে সে। নিজেকে বিছানায় শোয়া অবস্থায় দেখে কয়েক সেকেন্ড স্তব্ধ হয়ে থাকলো। পাশেই লারা বসে মাথায় জলপট্টি দিচ্ছে। ঠান্ডা স্পর্শটা খানিকটা স্বস্তি এনে দিলেও মনের ভেতর ছটফটানি থামলো না।

অনন্যা মুখ খুলে কিছু বলতে চাইল। কিন্তু কোনো শব্দ বের হলো না। বিস্মিত হয়ে গলায় হাত রাখলো সে। হালকা ব্যথার অনুভূতি হলো। ভয়টা আরও জাঁকিয়ে ধরলো তাকে। সে কী কণ্ঠ হারিয়ে ফেলেছে? কথা বলতে পারছে না কেনো? এই ভয়াল প্রশ্ন তাকে তাড়িয়ে বেড়াতে লাগলো।

লারা তার অবস্থা দেখে বলল, "শুয়ে থাকো। কথা বলার চেষ্টা কইরো না। সব ঠিক হয়ে যাইবে।"

কিন্তু অনন্যা কোনোভাবেই শান্ত হতে পারছিল না। তার মনের মধ্যে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল সেই মুহূর্ত, যখন স্যার তার গলা চেপে ধরেছিল। চোখের কোণ ভারী হয়ে এলো অনন্যার।

লারা তাকে সামলে এক গ্লাস শরবত এগিয়ে দিল,
"এটা খাইয়া নাও। তোমার শক্তি দরকার।"

অনন্যা এক নিঃশ্বাসে শরবত শেষ করার পরও নিজেকে শান্ত করতে পারছিল না। গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের করার ব্যর্থ চেষ্টায় চোখ ভিজে গেল। কান্নায় ভেঙে পড়লো সে। প্রতিটা অশ্রু তার অসহায়তার সাক্ষ্য দিচ্ছিল। শব্দহীন যন্ত্রণা তাকে ঘিরে ধরেছিল। লারা যতই শান্ত করার চেষ্টা করুক, অনন্যার মনের ভেতরের অস্থিরতা থামছিল না। কান্না করতে করতে অনন্যা ক্লান্ত হয়ে পড়লো। লারা তাকে খাওয়া দাওয়া করতে সাহায্য করলো। 

খাওয়া দাওয়া সেরে অনন্যা আবারো শুয়ে পড়লো, শরীরটা যেন চলছে না আর। এই অসহায় মুহূর্তের সময় মা বাবার কথা খুব করে মনে পড়ছে অনন্যার। লারা অনন্যার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলতে লাগলো,
"চোখ বন্ধ করো, মাইয়া। সুখের দিনের কথা মনে করো। সব ঠিক হইয়া যাইবো!"

সুখের দিন? অনন্যার জীবনে সুখ বলতে ছিল শুধু ছোটবেলার দিনগুলো। তখন পৃথিবীটা ছিল মায়া আর মমতায় ভরা, যেখানে ভালোবাসার স্পর্শে জুড়ে যেত সমস্ত দুঃখ। বাবা-মায়ের অগাধ স্নেহ, তাদের সঙ্গে কাটানো প্রতিটি মুহূর্ত, সবকিছুতেই লুকিয়ে ছিল সুখ আর সুখ। কিন্তু সময় যতই এগিয়েছে, অনন্যার জীবনের সেই উষ্ণতা ধীরে ধীরে হারিয়ে গেছে। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিটি সম্পর্ক, প্রতিটি মানুষ থেকে সে যেন একটু একটু করে দূরে সরে যাচ্ছে। একসময় যাদের চোখে দেখেছিল নির্ভেজাল স্নেহ আর সত্যতা, আজ তাদের মুখে ধরা পড়েছে অদৃশ্য এক মুখোশের চিহ্ন।

অনন্যার মনে হয়, এই মুখোশগুলো বহু বছর ধরে তাদের মুখে ছিল। সে হয়তো আগে বুঝতে পারেনি, হয়তো দেখেও দেখেনি। কিন্তু সময়ের স্রোতে, অভিজ্ঞতার ঝড়ে একে একে সব মুখোশ খুলে পড়ছে। যাদের ভেবেছিল আপন, তাদের আসল চেহারা দেখে এখন সে হতভম্ব। এই মুখোশধারী মানুষদের ভিড়ে, ছোটবেলার সেই ভালোবাসা আর স্নেহের দিনগুলোই তার জীবনের একমাত্র নিখুঁত সুখের স্মৃতি। যতই এগিয়ে যাচ্ছে জীবন, সেই সুখ যেন আরেকটু করে আরও দূরে সরে যাচ্ছে, দৃষ্টির আড়ালে মিলিয়ে যাচ্ছে এক স্মৃতির কোণে।

লারা আবারো উচ্চারণ করলো,
"আমারে শোনাও। শুনি তোমার সুখের দিনের কথা।"

অনন্যা আবারো কেঁদে ফেললো, মুখ দিয়ে সে একটা অক্ষর ও উচ্চারণ করতে পারছে না। শুধু গলার ভেতর থেকে আসছিল মৃদু গোঙানির আওয়াজ। লারা চুপচাপ তার মাথায় হাত বুলিয়ে যাচ্ছিল, সান্ত্বনার স্পর্শে শান্ত করার চেষ্টা করছিল তাকে।

হঠাৎই অতীতের স্মৃতিগুলো ভেসে উঠলো অনন্যার মনের মধ্যে। ছোটবেলার সেই নির্ভেজাল দিনগুলো। যখন পৃথিবীটা ছিল স্রেফ তার বাবার কোলে শুয়ে থাকা এক টুকরো নিরাপদ আশ্রয়। অনন্যার মাও মেয়েকে কম আদর করেননি। প্রথম বলেই হয়তো বেশি আদর পেয়েছে! 

বয়স তখন ৪ কি ৫। একদিন রাতের বেলা অনন্যা হঠাৎ বায়না উঠলো, সে আইসক্রিম খাবে। ওর মা পল্লবী তখন ঘরের কাজ গুছিয়ে বিশ্রাম নিতে বসেছিলেন। মেয়ের এমন বায়না শুনে বললেন, "রাতের বেলা আবার আইসক্রিম কেন? সকাল হলে খেয়ো।"কিন্তু অনন্যা মানলো না। কান্না জুড়ে দিলো, তার জেদ আইসক্রিম খেতেই হবে, আর সেটা বাবার সঙ্গেই। 

পল্লবী রাগে চোখ কপালে তুলে মেয়েকে ধমক দিলেন, "চুপ করো! রাতে বাইরে যাওয়া ঠিক না।" কিন্তু তাতেও থামলো না অনন্যা। জেদ চেপে বসে থাকলো আইসক্রিম না খেতে পারলে সে ঘুমোতে যাবে না।

অনেক জোরাজুরির পর অধীর শিকদার মেয়ের কথা মানলেন। মেয়েকে রেডি করিয়ে বাইরে বের হলেন। কিন্তু কিছুদূর যেতে না যেতেই ঝপঝপে বৃষ্টি শুরু হলো। হয়ে গেলো না আরেক কাণ্ড? অনন্যার মুড নষ্ট হয়ে গেলো, সে আর যেতে চাইলো না । কিন্তু অনন্যার বাবা মেয়ের ইচ্ছে পূরণ করেই ছাড়বেন। বৃষ্টির মধ্যে মেয়েকে নিয়ে চলা ঝুঁকিপূর্ণ হবে, তাই তিনি কাছের রাস্তার ধারের একটি ছাউনীর নিচে মেয়েকে দাঁড় করালেন। 
মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, 
"তুমি এখানেই দাঁড়াবে। এক পা-ও নাড়াবে না, বুঝেছ? আর কোনো অপরিচিত লোক যদি কথা বলতে চায়, দরকার ছাড়া একটাও উত্তর দেবে না।"

অনন্যা খুব মনোযোগ দিয়ে বাবার কথাগুলো শুনলো। মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। অনন্যা বাবার কথা মানলো। এক পাও নাড়ালো না। জড়োসড়ো হয়ে রাস্তার পাশে ছাউনীর নিচে দাঁড়িয়ে রইল। কতো ভদ্রলোক এসে জিজ্ঞেস করলো তাকে, নাম কি তোমার? কে আছে তোমার সাথে! অনন্যা উত্তর দেয়নি। বাবা মানা করেছে। দিবে কেনো?

বেশ অনেকক্ষণ পর দূর থেকে বাবাকে বৃষ্টিতে ভিজে আসতে দেখতে পেলো অনন্যা। চুল, জামা সবকিছু একেবারে ভিজে গেছে। বৃষ্টির ভারে ক্লান্ত হলেও তার হাতে ছিল অনন্যার প্রিয় আইসক্রিমের ফ্লেভার। সেই মুহূর্তে বাবার মুখে এক অদ্ভুত শান্তির হাসি দেখা গিয়েছিল। অনন্যা অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিল সেই হাসিতে। তারপর আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না। তার ছোট্ট পা দুটো দ্রুত দৌড়ে গেলো বাবার দিকে। বাবার হাত ধরে কেঁদে ফেললো সে।

অনন্যা জানতো না তার বাবা কতো দোকানে গিয়েছেন, কতোটা পথ হেঁটেছেন। কেবল জানতো, তার বাবা বৃষ্টির ফোঁটার মতোই নিঃস্বার্থ। নিজের কষ্টের কথা একবারও না ভেবে মেয়ের ইচ্ছেটাই তার কাছে সবচেয়ে বড় ছিল।

অনন্যা বুঝেছিলো, 
বাবারা সন্তানের জন্য বৃষ্টির পানি কি আগুনের জ্বলন্ত ফোঁটাও তোয়াক্কা করবে না, সন্তানের সুখের জন্য তার নিচ দিয়েই অনেক পথ হেঁটে যাবে। শরীর ভেজাবে! আগুনে জড়াবে! কিন্তু মুখে এমন ফুটফুটে হাসি থাকবে যেন কিছুই হয়নি।

এটাই অনন্যার জীবনের সবচেয়ে সুখের সময় ছিল। চোখের পাতা ভারী হয়ে আসতে লাগলো অনন্যার। অবশেষে ক্লান্ত দেহটা অজ্ঞানপ্রায় ঘুমে তলিয়ে গেল।

সন্ধ্যায় দরজার খোলার শব্দে চমকে উঠলো অনন্যা। ঘাড় ঘুরিয়ে অন্ধকার ঘরে দরজার সম্মুখে একটিমাত্র ছায়ামূর্তি দেখতে পেল। ধোঁয়াটে সেই ছায়া দেখে মুহূর্তেই বুঝে ফেললো, লোকটা এসেছে। কৌশিক স্যার। অনন্যার শরীর রাগে রি রি করতে লাগলো। ছায়ামূর্তির দিকে তাকিয়ে তার ভেতরের সমস্ত ক্ষোভ জ্বলে উঠলো। শোয়া থেকে উঠে বসলো। হাতের কাছে কাঁচের গ্লাস পেলো সে। গ্লাসটা তুলে নিয়ে, কোনো দ্বিধা না করেই ছুঁড়ে মারলো স্যার দিকে।

গ্লাসটা সটান গিয়ে কৌশিকের কপালে লাগলো। তবে পড়ে যাওয়ার আগেই কৌশিক গ্লাসটা ধরে ফেললো।
কিন্তু থেমে থাকার মেয়ে নয় অনন্যা। গলা দিয়ে শব্দ বের না হলেও তার ক্ষোভ থামতে দেয়নি। কথা দিয়ে আঘাত না করা গেলে, হাত দিয়ে আঘাত করবেই।অনন্যা হাতের কাছে যা পাচ্ছে তাই ছুঁড়ে মারছে। সবকিছুই কৌশিকের শরীরে গিয়ে লাগছে। 

কৌশিক সব আঘাতই আস্তে ধীরে সয়ে নিল। ধীর কণ্ঠে বললো,
"স্যরি!"

অনন্যা উত্তরে কিছুই বললো না। পাশের টেবিলে ল্যাম্প টান দিয়ে খুলে ফেললো তারপর ছুঁড়ে মারলো স্যারের দিকে। কৌশিক সেটাও ধরে ফেললো।

তবে হঠাৎ, আশ্চর্যজনকভাবে, অনন্যার গলা থেকে আওয়াজ বের হলো। সে চিৎকার করে বললো,
"আপনাকে আমি পুলিশে দিবো। যখন মেরেই ফেলতে হতো, তাহলে বিয়ে কেনো করেছিলেন? 

আপনার মতো হৃদয়হীন পুরুষ কোনো মেয়ের ভালোবাসার ও যোগ্য নয়। আমি ভাবতেও পারছি না আমি এতো বোকা যে এমন একটা পুরুষকে মনে জায়গা দিতে যাচ্ছিলাম যে কিনা মানুষ নয়, একটা পশু!

মেরে ফেলতে চেয়েছিলেন তাই না? তাহলে বাঁচালেন কেনো? আজকের পর থেকে, এই কুৎসিত মুখখানা আর কখনো দেখাবেন না। আর কখনো আমার সামনে আসবেন না।

আজ প্রমাণ করে দিলেন, আপনিও সবার মতো কিন্তু.... তাদের থেকেও জঘন্য। আমার আপনজনেরা তাও আমাকে কথা বা নিজের কাজ দিয়ে আঘাত করেছে কিন্তু আপনি! আপনি নিজের হাত দিয়ে আমাকে আঘাত করেছেন। আমি দ্রুতই আপনার সত্য প্রকাশ্যে আনবো। সবাইকে জানাবো আপনি কি জিনিস!"

কৌশিক জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। সে মাথা নিচু করে শান্ত গলায় বললো,
"আমাকে নিয়ে ঘাঁটতে যাবে না, শিকদার! নাহলে আজকের মতোই ব্যথা পাবে। 

ঠিক আছে, আর কখনো তোমার সামনে আসবো না। তবে কথা দাও, আজ যা হয়েছে, তা কারো সামনে প্রকাশ করবে না। যদি প্রকাশ করো, আমাদের দুজনেরই ক্ষতি হবে।"

কৌশিক কিছুক্ষণ থেমে আবারও বললো,
"দেখো, তোমার মুখ দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে। তুমি সম্পূর্ণ আগের মতো হয়ে গেছো। ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যাবে দেখে নিও।

আরেকটা কথা, আমি জোরপূর্বক কাউকে আঘাত করি না। 

হ্যাঁ, আমি হৃদয়হীন কিন্তু নির্দয় নই। আমি হৃদয়হীন তবে নির্মম নই।"

অনন্যা স্থির হয়ে তাকিয়ে রইল কৌশিক স্যারের দিকে। স্যার চলে গেলো কিন্তু রুমটায় ধোঁয়াশা রেখে গেলো।
.
.
.
চলবে........................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp