আশিয়ানা - পর্ব ৭৯ - শারমিন আক্তার বর্ষা - ধারাবাহিক গল্প


সাতসকালে ঘুম ভেঙেই কাঠের দরজা খুলে বাহিরে এল সেহরিশ। উঠান পেরিয়ে আসতে দেখতে পেল কাঠগাছে কাঠঠোকরা পাখি। শোনা যাচ্ছে পাখির কিচিরমিচির। বাতাসের সঙ্গে ভেসে আসছে মিষ্টি একটা সুগন্ধ। একইসঙ্গে ভেসে আসছে এক ধরনের শিসের আওয়াজ। সেহরিশ উদ্বিগ্ন চোখে তাকায়। বাড়ির পরে পলাশ গাছটার ডালে ছোট একটা লাল ঝুঁটি তোলা বেগুনি আর খয়েরি রং মেশানো পাখি। লেজ নাচিয়ে গাছটার ডালে বসে শিস দিচ্ছে। সেহরিশ তার দিকে একটানা তাকিয়ে রইল। তবু পাখিটার ভয় নেই! বরং সেহরিশের দিকে তাকিয়ে আরও দু’বার শিস দিয়ে একসময়ে উড়ে চলে গেল।

রোদেলা ওর মামির সঙ্গে চুলার পাড়ে বসে সকালের নাস্তা তৈরি করছে। হরক রকমের পিঠাপুলি এরইমধ্যে তৈরি করছেন পুতুল বেগম। বাতাসের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে পিঠার মিষ্টি গন্ধ। রোদেলা উঠানে আসতে দেখতে পেল সেহরিশ দাঁড়িয়ে আছে। কিছুক্ষণ সময় নিয়ে ফ্রেশ হলো সে। বিলাসবহুল বাড়ি আর টিনের ঘর সব কিছুর সঙ্গে মানিয়ে নিতে অনেক বেগ পেতে হচ্ছে। তবু রোদেলার জন্য সব কিছু সহ্য করে নিচ্ছে সে। কোনো অভিযোগ নেই। রোদেলা টিউবওয়েল থেকে পানি তুলে দেওয়ার পর সেহরিশ ফ্রেশ হলো। এরপর ওর সঙ্গে চুলারপাড় এসে বিস্মিত হয়ে গেল সেহরিশ। এত ধরনের পিঠা একসঙ্গে দেখে চোখ চড়কগাছ। 

এক পলকে ছোটোবেলার কথা মনে পড়ে গেল। শীতকাল আসলে ফারিয়া বেগম পিঠা বানাতেন, খুব আনন্দের সঙ্গে খেতো সেহরিশ, সোহান ও আরুশি। এখন সে-সব পুরোনো স্মৃতি। ইতালি যাওয়ার পর থেকে পিঠা কি জিনিস ভুলেই গেছে সে। পিঠা খাওয়ার অভ্যেস আর নেই। শরীর ফিট্ রাখার জন্য এখন অনেক খাবার খাওয়া হয় না। এত সুন্দর পিঠা দেখে মুগ্ধ সে। পুতুল বেগম ভোর বেলা উঠে মেয়ের জামাইয়ের জন্য এত পিঠা তৈরি করেছেন। আরও করবেন বিকালে। 
পুতুল বেগম বললেন,
  'খাও বাবা। তোমার জন্যই বানাচ্ছি।'

সেহরিশ তার মন রাখার জন্য আজকের জন্য সব নিয়ম ভেঙে সবগুলো থালা থেকে একটা করে পিঠা খেলো। স্বাদ জেনো মুখে লেগে গেছে। এতে খুব খুশি হলেন পুতুল বেগম। 

সকাল বাড়তে লাগল। সূর্যের হলদে সোনালী আলো আছড়ে পড়লো বাড়ির উঠোনে। আম গাছের নিচে কাঠের বেঞ্চির উপর বসে আছে সেহরিশ। সময়টা তর ভালোই লাগছে। একই সঙ্গে মায়ের কথাও মনে পরছে। এ-সময় সেহরিশের কাছে ফোন এল ম্যানেজার ফ্রাঙ্কের। সেহরিশ রিসিভ করলো। ইমার্জেন্সি তাকে ডেকে কল কাটে ফ্রাঙ্ক। সেহরিশ উঠে দাঁড়ায়। রোদেলার থেকে বিদায় নিয়ে চলে যাবে এমন সময় রোদেলা লহু কণ্ঠে বলল, 'আবার কতদিন পর আসবেন?'
সেহরিশ তাকাল। বলল,
  'বেশি সময় নেবো না।'

ফ্র্যাঙ্ক যে জায়গার লোকেশান পাঠিয়েছিল সেখানে এসে সেহরিশ গাড়ি থামাল। সরু পথ ধরে একটু এগোল। ফ্রাঙ্ক ইন্সপেক্টর শায়ের মির্জার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। সেহরিশকে দেখে তার দিকে এগিয়ে গেল ফ্রাঙ্ক। নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল, 'স্যার, এদিকে আসুন।'

ইন্সপেক্টর শায়ের সেহরিশের দিকে তাকাল। শাহাদাত আঙুল কিছুটা দূরে ইঙ্গিত করে বলল, 'দেখুন তো লাশটা চিনতে পারছেন কি না?'

সেহরিশ ভ্রু জোড়া কুঁচকে তাকাল। পরক্ষোণেই তার কুঁচকানো ভ্রু দ্বিগুণ কুঁচকে গেল। সেহরিশ তাকাল শায়ের মির্জার দিকে। শায়ের মির্জা গম্ভীর গলায় বলল, 'এখানকার এক কাঠুরে লাশটা দেখে পুলিশে কল করে। আমিও প্রথমবার দেখে চমকে যাই।'

  'কত ঘন্টা আগে মারা গেছে?' জিজ্ঞেস করলো সেহরিশ।
  'ঘন্টা নয় বলুন কতদিন। দুদিন আগে কেউ খুন করে লাশটা এখানে ফেলে গেছে।'

সেহরিশ ভারী নিঃশ্বাস ফেলল। ফ্রাঙ্ক বলল, 'স্যার, আমার ধারণা আরুশি ম্যামকে খুন করে সে দেশ ছেড়ে পালাতে পারেনি। তাকে এই কাজের জন্য হায়ার করেছিল, কাজ শেষে তাকেও মেরে ফেলেছে।'
সেহরিশ মেরুদণ্ড টানটান করলো। 

ফ্রাঙ্ক ফের বলল,
  'তূর্ণ স্যার ও সাদাফ স্যারের সঙ্গে কথা হয়েছে। ওনারা দেশে আসতে চাচ্ছে। আপনি অনুমতি দিলে তারা আসবেন।'
সেহরিশ গম্ভীর গলায় বলল, 
  'বারন করো তাদের। আমরা আজই ইতালি ব্যাক করবো। দ্রুত ব্যবস্থা করো।'

ফ্রাঙ্ক একটু দূরে সরে কাউকে কল করলো। ইন্সপেক্টর শায়ের মির্জা অপলক তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, 'হঠাৎ চলে যাচ্ছেন কেনো? এখনো তো মৃত্যুর রহস্য উন্মোচন হয়নি।'
সেহরিশ বলল,
  'সব রহস্য সবখানে থাকে না। তাছাড়া আপনাকে আমার হয়ে একটা কাজ করতে হবে।'

  'কী কাজ? বলুন।'
  'আমার অবর্তমানে, আমার দুই পরিবারের সুরক্ষার দিকে একটু নজর রাখবেন। তাছাড়া আমি অন্য ব্যবস্থাও করবো।' 
শায়ের বলল,
  'মানুষের সেবা করা আমাদের দায়িত্ব। পুলিশের ইউনিফর্ম যেহেতু পরেছি কর্তব্য পালন অবশ্যই করবো।'


ফারিয়া বেগমের এখন আগের চেয়ে ভালো আছেন। শারীরিক ভাবে দূর্বল। চৌধুরী বাড়ির পারিবারিক ডাক্তার আজ আসেন। ফারিয়া বেগমের শারীরিক, মানসিক অবস্থা দেখে তিনি বেশ কিছু ঔষধ দেন ও পর্যাপ্ত বিশ্রামের জন্য জানান। কোনো প্রকার টেনশন তাকে দেওয়া যাবে না। আরুশির ব্যাপারে কোনো আলোচনা তার সামনে করা থেকেও নিষেধ করা হয়। দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে ঔষধ খেয়েই লম্বা ঘুম দেয় ফারিয়া বেগম। 

বিকেল গড়িয়ে গেছে এ-সময় বাড়ি আসে সেহরিশ। বাড়ির লোকেদের কাছে ছদ্মবেশী অনিকের মৃত্যুর খবর গোপন রাখার সিদ্ধান্ত নিলো। পরিবারের উপর কোনো প্রকার মানসিক চাপ দিতে চায় না। আরুশির হত্যা, মায়ের এমন অবস্থা তার উপর যদি জানতে পারে ছদ্মবেশী অনিক আসল অনিক না। আর তাকেও হত্যা করা হয়েছে। এসব সত্য জানার পর, আরুশির মৃত্যুর জন্য বাবা সারাক্ষণ নিজেকে দোষী করবে। এরচেয়ে বড় কথা ওঁরা প্রতিনিয়ত ভয়ে ভয়ে থাকবে। কে বন্ধু আর কে শত্রু? দ্বিধায় পড়বে। 

সেহরিশ ভারী নিঃশ্বাস ফেলে বলল, 
  'তোমাদের সুরক্ষার জন্য গার্ড চব্বিশ ঘণ্টা বাড়ির বাহিরে পাহারায় থাকবে। কেউ বাড়ির বাহিরে একা যাবে না। দুজন গার্ডদের সঙ্গে নিয়ে যাবে। অপরিচিতদের সঙ্গে কথা বলার দরকার নেই। সন্দেহ জনক কিছু দেখলে গার্ডদের জানাবে আর আমাকে কল করে জানাতে ভুলবে না। প্রতিদিনের খবর আমাকে দিবে। তাছাড়া মারিয়া এখন স্কুলে যাচ্ছে। ভুলেও তাকে একা ছাড়বে না।'

সোহান ঠাট্টা করে বলল, 
  'সেহরিশ, তুই যেভাবে কথা বলছিস মনে হচ্ছে, এই বুঝি কেউ আমাদের উপর আক্রমণ করতে তেড়ে আসছে। আর আমরা তাদের থেকে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছি।'

সেহরিশ খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল,
  'বিপদের হাত-পা নেই সোহান। যেকোনো সময়, যেকোনো ভাবে আসতে পারে। তাই আগে থেকে সাবধান থাকা দোষের নয়।'

শফিকুল চৌধুরী বললেন, 
  'মনির আর ওর ছেলের কোনো খোঁজ পেয়েছিস?'
  'হ্যাঁ বাবা, পুলিশ ওদের এরেস্ট করেছে। ওদের কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে।'

মাইমুনা হুট করে বলল, 
  'তুমি কি কোথাও যাচ্ছো ভাই? তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে কোথাও যাবে।'

সেহরিশ বলল, 'হ্যাঁ, ভাবী। আমরা আজ রাতের ফ্লাইটে ফিরে যাবো।'

সোহান বলল, 
  'এতো তাড়াতাড়ি? আরও কিছুদিন থেকে যা। কাল আরুশির মৃত্যুর চারদিন হবে। চারদিনের অনুষ্ঠানেের শেষে তারপর না হয় যাস।'

সেহরিশ নিবিড়ভাবে ডানে-বামে মাথা নাড়লো। বলল, 
  'আজই যেতে হবে। কিছু কাজ অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে।'

শফিকুল চৌধুরী বললেন, 
  'কিন্তু রোদেলা মাকে রেখে গেলে হয় না? তোর মা একটু পরপর ওর কথা জিজ্ঞেস করে।'

সেহরিশ বাবার দিকে তাকাল। কি অসহায় চোখে তাকিয়ে আছে লোকটা। সেহরিশ বাবার কাছে গেল। হাঁটু গেড়ে বসে শফিকুল চৌধুরীর দু-হাত আলগোছভাবে মুঠোয় নিয়ে তার দিকে তাকাল। সেহরিশ মাথা নাড়লো আনমনে। বড়ো করে শ্বাস টেনে বলল,
  'না বাবা। রোদকে এখানে রেখে যাওয়ার রিস্ক আমি নিতে পারবো না।'
শফিকুল চৌধুরী ম্লান কণ্ঠে বললেন,
 'ছোটো বউমাকে রেখে যা বাবা। আমরা ওকে আগলে রাখব যত্নে থাকবে।'

সেহরিশ নতমুখী হয়ে হাসল। হেসে হেসেই বলে ফেললো,
  'কখনো দেখেছ বাবা, পানি ছাড়া মাছ বাঁচে?'
.
.
.
চলবে........................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp