"আইসক্রিম কেমন লাগছে?"
"ইয়াম্মি!"
"অনেক দিন পর এভাবে বৃষ্টিতে ভিজলাম। মাঝেমধ্যে এমন বায়না করবি, অনন্যা। বাপ মেয়ে মিলে রাতের বেলা ঘুরে আসবো।"
"ঠিক আছে, বাবা! পরের বার মাকেও সাথে নিবো।"
"তোর মা রাতের বেলা বাসা থেকে বের হতে পছন্দ করে না।"
"ওহ তাহলে তুমি আর আমিই যাবো।"
অনন্যার বাবা হাসলেন। ছাউনীর নিচে বেঞ্চে বসে দুজনে আয়েশ করে আইসক্রিম খাচ্ছে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি তখনো পড়ে যাচ্ছে। হঠাৎ একটা বাস এসে ছাউনীর সামনে থামলো।
অনন্যার বাবা বললেন,
"জানিস? আমাদের জীবন একেকটা বাস রাইডের মতো।"
অনন্যা বিস্মিত হয়ে গেলো।
"বাস রাইড?"
"হুম! ধর, তুই নিজের গন্তব্য জানিস না। একটা বাসে উঠলি। বাসটা কোথাও না কোথাও থামবেই। তুই বারবার ভাবছিস, নামবি নাকি বসে থাকবি। ঠিকমতো সিদ্ধান্ত নিতে পারছিস না। তাই বাসকে বিশ্বাস করে বসে থাকছিস। শেষে যখন গন্তব্যে পৌঁছাবি, তখন নামবি। হয়তো সেই গন্তব্যেই তোর জীবনে নির্দিষ্ট কোনো কারণ ঘটার জন্য থেমেছিল বাসটা। আমাদের জীবনও ঠিক তেমন একটা বাস রাইডের মতো। ভুল কিংবা সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর, যখন শেষ গন্তব্যে পৌঁছাই, তখনও মনে হয়, এখানেই কি শেষ, নাকি আরও পথ বাকি?
জীবন মাঝেমধ্যে ভুল দরজার সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। ভুল দরজাটা খুলে দেখতেই হয়, ভেতরে কী ভুল লুকিয়ে আছে। নাহলে সেই ভুলটাকে শুধরানো সম্ভব নয়। তবে ভুল দরজার দিকে পা বাড়াতে হয় খুব সাবধানে। কারণ, সেই ভুল দরজা হয়তো অনেক মানুষের সত্যতা উন্মোচন করবে, আবার অনেকের বিশ্বাসঘাতকতার মুখোশ খুলে দেবে। সেই ভুল দরজাই হয়তো তোকে জীবনের আসল মানে শিখিয়ে দেবে। আবার সেই ভুল দরজাই তোকে সবচেয়ে বেশি কষ্ট দেবে। তবু, সেই ভুলগুলোই তো জীবনের সঠিক পথের সন্ধান দেয়। কষ্টের ভেতর দিয়েই জীবনের গভীরতাটা উপলব্ধি করা যায়।
অনেক মানুষ আসবে, যাবে, অনন্যা মা! কিন্তু মনে রাখিস, নিজের থেকে কাউকে বেশি বিশ্বাস করতে যাস না। নিজেকে ভালোবাসাটা শিখে নে, তুই-ই তোর প্রথম আর শেষ আশ্রয়। কারো সামনে নিজেকে ছোট করিস না, নিজের সম্মান নিজেই ধরে রাখ।
আর নিজেকে অতটা খোলাখুলি প্রকাশ করবি না যে, যে কেউ তোর দুর্বলতায় আঘাত হানতে পারে। মানুষ কতটা কাছের বা দূরের, সেটা সময়ই বলে। এমনকি হয়তো তোর বাবাই একদিন তোকে আঘাত করে বসবে, তখন নিজেকে সামলানোর শক্তি রাখতে হবে। তাই নিজের ভেতরের শক্তিটা কখনো হারাতে দিস না, মা।"
অনন্যা সেদিন নিজের বাবার কথা বুঝতে পারেনি, শুধু শক্ত করে বাবার কড়পোড়া হাতটা ধরে বসেছিল, অন্য হাত বেয়ে আইসক্রিম গলে পড়ছিল। কিন্তু আজ! আজ যেন সবকিছুই ধীরে ধীরে মাথায় ঢুকছে। ভুল দরজা! অনন্যা ভুল দরজা খুলেই বসে আছে। কৌশিক স্যার অনন্যার সেই ভুল দরজা যাকে বুঝতে হবে, খুলে দেখতে হবে।জানতে হবে, সত্য উদঘাটন করতে হবে।
অনন্যা পড়ার টেবিলে বসে নোটপ্যাডটা বের করে পূর্বের পেজে আরো কয়েকটি হিন্ট লিখলো,
কার রেস,
তলোয়ার চালানো,
প্রাণীদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারা,
ব্যথা সারিয়ে ফেলার ক্ষমতা,
স্মৃতি মুছে ফেলার ক্ষমতা,
অনন্যা কিছুক্ষণ এই বিষয়ে চিন্তা করে নোটপ্যাড রেখে পড়তে বসল। সারাদিন কিছুই করা হয়নি, পড়া বাকি আর কাল পরীক্ষা। তাই মনোযোগ ধরে রাখার চেষ্টা করছিল, কিন্তু কিছুক্ষণ পর বাইরের অচেনা আওয়াজ তার মনোযোগ ভাঙল। খাতা উল্টে রেখে ধীর পায়ে দরজা খুলে বাইরে গেল সে।
দেখল, এক অচেনা মহিলা আর পুরুষ কৌশিক স্যারের রুমে ঢুকছেন। নিক তাদের ভেতরে যেতে সাহায্য করে দরজা বন্ধ করে দিল। দৃশ্যটা দেখে অনন্যা বিস্মিত হলো। কিছুক্ষণ স্থির দাঁড়িয়ে থেকে মনে হাজারো প্রশ্ন ভিড় করল।
অনন্যা ধীরে নিকের কাছে এগিয়ে বললো,
"লোকগুলো কে?"
নিক একটু চমকে উঠল, কিছুটা ভেবে নিয়ে উত্তর দিল,
"আহ, ওরা? ওরা রুম দেখতে এসেছে।"
"রুম দেখতে? কেনো?" অনন্যার কণ্ঠে বিস্ময়।
"ঘন জঙ্গলে এই বাসা চোখে পড়েছিল তাদের। তাই একদিনের জন্য থাকতে চায়। এজন্য বাড়ির মালিক কৌশিকের সঙ্গে কথা বলতে গেছে।"
"ওহ, আচ্ছা," অনন্যা হালকা মাথা নাড়ল।
নিক এক মুহূর্ত চুপ থেকে বলল,
"হুম, কনগ্র্যাচুলেশন! তোমার কণ্ঠ ফিরে এসেছে।"
অনন্যা ম্লান হাসার চেষ্টা করল। তবে তার মন চিন্তায় ব্যস্ত হয়ে উঠল। হঠাৎ কিছু মনে পড়তেই বলল,
"ভাইয়া, কিছু কথা বলার আছে। রুমে আসবে প্লিজ?"
নিক এক মুহূর্ত ভেবে বলল,
"না, রুমে নয়। নিচে ড্রয়িং রুমে চল।"
কথা শেষ করে নিক এগিয়ে চলল। অনন্যা তার পিছু পিছু হাঁটল।
ড্রয়িং রুমে ঢুকতেই নিক সোফায় গিয়ে বসল। অনন্যা একটু ইতস্তত করে তার মুখোমুখি বসল। মৃদু স্বরে বললো,
"আমি স্যার সম্পর্কে কিছু জানতে চাই!"
"স্যার? নাকি তোমার হাসবেন্ড কোনটা?"
"আরে না কোনো হাসবেন্ড না! উনার সাথে আমার তেমন কোনো সম্পর্ক নেই। শুধু টিচার স্টুডেন্টের সম্পর্ক।"
নিক ভ্রু কুঁচকে বললো,
"ও অ্যানা! আমাকে তো বোকা না-ই বানাও তোমরা।"
"ওসব বাদ দাও, ভাইয়া। আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দাও, স্যার আসলে কে? আমি পনেরো দিনের বেশি সময় ধরে এই বাড়িতে আছি। এর মধ্যে অনেক কিছুই ঘটেছে। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি, স্যার মানুষ না! কোনো পশু বা ভ্যাম্পায়ার কিছু একটা হবে। কিন্তু ভ্যাম্পায়ার নিয়ে সন্দেহ আছে কারণ ফিল্মে যা দেখেছিলাম তা আমার সাথে ঘটেনি। তুমি যেহেতু ওর বন্ধু, তাই তোমার কাছ থেকেই জানতে চাইছি, উনি আসলে কে?"
নিক কিছুক্ষণ স্থির হয়ে বসে রইল, অনন্যার কথাগুলো শুনে এক অদ্ভুত অস্বস্তিতে পড়ল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে গভীর চিন্তায় ডুবে গেল। এরপর একটু ভয় মিশ্রিত গলায় বলল,
"কৌশিক আমার বন্ধু! কিন্তু সত্যি বলতে, আমিও জানি না ও কে! তোমার মতোই জানতে চেয়েছিলাম, আর তখন আমাকেও তোমার মতো শাস্তি পেতে হয়েছিল। তাই বলছি, কৌশিক সম্পর্কে জানতে চেয়ো না বা ওর সম্পর্কে কোনো সত্য উদঘাটনের চেষ্টা করো না। এসব ক্ষেত্রে কৌশিক নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।"
অনন্যার চোখে হতাশা ফুটে উঠল। "আপনারা বন্ধু হয়েও কিছু জানেন না?"
নিক অন্যমনস্ক দৃষ্টিতে মাটির দিকে তাকিয়ে বলল,
"না, কিছুই না।"
"তাহলে আপনাদের প্রথম দেখা কোথায় হয়েছিল?"
নিক একটু থেমে মৃদু হেসে বলল,
"লন্ডনে কৌশিকের সাথে আমার প্রথম দেখা হয়। আর ভেনোরার সাথে ওর পরিচয় ছিল আগে থেকেই।"
"তো আপনারা আগে লন্ডনে থাকতেন?"
"হুম!"
"এখানে কবে এসেছেন?"
"ঠিক মনে নেই, তবে দেড় বছরের বেশি সময় ধরে এখানেই আছি।"
"ওহ! তো আপনি লন্ডনে কী করতেন?"
"আমি তো পার্ট-টাইম জব করতাম, আর ঘুরে ঘুরে বেড়াতাম।"
"আর কৌশিক স্যার?"
নিকের কিছুটা অপ্রতিভ হয়ে উঠল। সে মৃদু গলায় বলল,
"আহ, কৌশিকের তো লন্ডনে নিজস্ব একটা মিউজিয়াম আছে।"
অনন্যা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে বলল,
"মিউজিয়াম?"
"হ্যাঁ," নিক মাথা নাড়ল। "মিউজিয়ামটা খুবই পরিচিত। প্রাচীন যুগের অনেক দুর্লভ জিনিস সেখানে পাওয়া যায়। কৌশিকের সেই মিউজিয়াম নিয়ে লন্ডনে অনেকেই প্রশংসা করে।"
"তো ওখানে মিউজিয়াম থাকতে উনি এখানে প্রফেসরগিরি কেন করছেন?"
"কৌশিক কাজ ছাড়া থাকতে পারে না," নিক স্বাভাবিক গলায় বলল।
"এটা কোনো যুক্তি হলো? আচ্ছা, উনি এদেশে এসেছেন কেন?"
নিক এক মুহূর্ত থেমে বলল, "আমি এত কিছু জানি না।"
"আচ্ছা, মিউজিয়ামটার নাম কি? অন্তত এটা তো জানেন?"
নিক হাসল। "হ্যাঁ, অবশ্যই জানি। 'Ancient Echoes Museum' নামে পরিচিত। ওটা লন্ডনের একেবারে বিখ্যাত মিউজিয়ামগুলোর একটি।"
অনন্যা মাথা নাড়িয়ে প্রশংসা করলো। নিক আরো বললো,
"আমাদের স্টোর রুমেও কিছু প্রাচীন কালের জিনিসপত্র আছে। তবে কৌশিকের অনুমতি ছাড়া কেউ ঢুকতে পারে না সেখানে।"
অনন্যা চিন্তিত হয়ে পড়লো, মুখে বললো,
"ধন্যবাদ, ভাইয়া। আমি আসছি!"
নিক উত্তরে হাসলো। নিকের কথাগুলো অনন্যার মাথার ভেতর অদ্ভুত একটা ধাঁধার মতো ঘুরপাক খাচ্ছিল। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে নিজের রুমের দিকে হাঁটছিল সে, চিন্তাগুলো তার আরো গভীর হয়ে আসছিল। হঠাৎই কানে এলো একটা আওয়াজ, কিসের আওয়াজ ঠিকমতো বোঝা গেলো না। কৌশিক স্যারের রুমের দিক থেকে শব্দটা এসেছে।
অনন্যা থমকে দাঁড়াল। ভ্রু কুঁচকে তাকাল দরজার দিকে। ভেতরে সেই মহিলা আর পুরুষ তো গিয়েছিল অনেকক্ষণ আগে। এখনো বের হয়নি। ভেতরে কী চলছে? কৌশিক স্যার এতোক্ষণ ধরে কী এতো কথা বলছেন দুজনের সাথে! অনন্যা চিন্তিত হয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো, লকের নবটা ঘোরানোর চেষ্টা করল সে। দরজা শক্ত করে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ঠোঁট কামড়ে থেমে গেল অনন্যা। কিছু বলার জন্য ঠোঁট খুলতেই হঠাৎ রুমে রাখা তার ব্যক্তিগত মুঠোফোনটা কেঁপে উঠল।
অনন্যা চমকে উঠে দ্রুত রুমের দিকে ছুটলো। অনেকক্ষণ ধরে ফোনটা হাতে নেওয়া হয়নি। দরজা বন্ধ করে ফোনটা বের করে নাম খেয়াল না করেই সরাসরি ধরে কানে দিল। এই সময়ে নোহারা ছাড়া কে-ই বা ফোন করবে তাকে?
"অনন্যা?" বিপরীত পার্শ্ব থেকে পরিচিত এক কণ্ঠ ভেসে এল।
অনন্যা থমকে নিজের কান হতে ফোনটা সরিয়ে দেখলো। অরণ্যকের নাম ঝলমল করছে স্ক্রিনে। অনন্যা কিছুক্ষণ নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। অতঃপর আবারো কানে দিলো ফোনটা।
কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর ধীরে ধীরে অনন্যা বলল, "হ্যাঁ, বলো।"
"যাক এতো দিনে ফোনটা ধরলি! কেমন আছিস?"
"হ্যাঁ, ভালো!"
"হ্যাঁ ভালো তো থাকবিই, আমাকে খারাপ রেখে।"
"তোমাকে খারাপ থাকতে কী আমি বলেছিলাম?"
"না বলিসনি কিন্তু করেছিস।"
"তোমার কথা শেষ হলে রাখছি।"
"না একদম না, আমি তোর বাসার বিপরীতে দাঁড়িয়ে। তুই বাসা থেকে বের হবি নাহলে আমি তোর বাসার ভেতরে ঢুকবো।"
ভড়কে গেলো অনন্যা। ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে আবারো শুধালো,
"ককক..কী বললে?"
"যা শুনেছিস তাই। বের হ!"
অনন্যা নিজেকে শান্ত করে উত্তর দিলো,
"বের হবো না,ফিরে যাও তুমি।"
"ঠিক আছে আমিই ভেতরে আসছি। তারপর সব জানাবো সবাইকে। আমাদের মধ্যে কি কি ছিল সব জানাবো।"
"নাহ!"
জোর গলায় বললো অনন্যা।
"কী!"
ভ্রু কুঞ্চিত করে ফেললো আরণ্যক।
"আমি ওই বাড়িতে এখন থাকি না।"
আরণ্যক তাচ্ছিল্যের সাথে হেসে বললো,
"মিথ্যে! মিথ্যে বলছিস তুই!"
"নাহ, মিথ্যে না। তুমি চাইলে ঈরাকে জিজ্ঞেস করতে পারো।"
"ঈরা তো আরেক পাঁজি মেয়ে। আমার ফোনটা পর্যন্ত ধরে না।"
"হুম, আমাদের বিষয়টা জানে বলে!"
"কোথায় থাকিস তাহলে? আমার গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে।"
"কিন্তু আমার নেই," অনন্যার গলা বরফের মতো ঠান্ডা। "আমি রাখছি। আমাদের বাড়িতে গিয়ে লাভ নেই, সেখানে সত্যিই আমি থাকি না।"
আরণ্যক বিরক্ত গলায় বলল, "তোর রুমটায় লাইট জ্বলছে কেনো?"
"ঈরা আছে হয়তোবা," অনন্যা স্বাভাবিক ভঙ্গিতে উত্তর দিল।
"কি হয়েছে যে... বাড়ি ছাড়তে হলো!"
"তোমায় জানতে হবে না," অনন্যা গভীর শ্বাস টানল। "শোনো, আমাদের মাঝে আর কিছু বাকি নেই। তাই প্লিজ আমাকে ভুলে গিয়ে নিজের ক্যারিয়ারের দিকে মন দাও। অথবা যদি প্রেম করার ইচ্ছে থাকে অন্য মেয়ের দিকে নজর দাও। আমার পেছনে আর সময় নষ্ট করো না।"
কথাগুলো যেন লাভার মতো পুড়িয়ে দিল আরণ্যককে। তার রাগ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল রুদ্ধ হয়ে আসা কণ্ঠে। "আমি তোকে ভালোবাসি বলেই এমনটা করছি। আমার যদি অন্য কাউকে পছন্দ হতো, তাহলে এভাবে বারবার ফোন করতাম না। সবকিছু ঠিকঠাক করার চেষ্টা করতাম না। তুই আমার সাথে এমনটা করতে পারিস না। আমি কিন্তু তোকে জোর করব।"
"যা মন চায় করো। কিন্তু আমি এসবের মধ্যে নেই। যা চলে গেছে তা গেছেই। জোর করেও লাভ নেই।"
আরণ্যক নিস্তব্ধ হয়ে গেল। দম ফেলে বললো,
"তোর জীবনে নতুন কেউ এসেছে, অনন্যা?"
অনন্যা থমকে দাঁড়ালো। কথাটা তার কাছে কেমন যেন শোনাচ্ছে। নতুন কেউ? নতুন কেউ আসলেই কি পুরোনো মানুষ পুরোনো হয়ে যায়? পুরোনো স্মৃতিগুলো ভুলাভুলি হয়ে যায়? অনন্যা বুঝতে পারে না। এসব ফিলিংসের হিসেবে সে অত্যন্ত কাঁচা হয়ে পড়েছে। আগে যা ভাবতো এখন তা ভিন্ন মনে হয়। এর চেয়ে শান্ত শীতল একলা জীবন কতো ভালো! কিন্তু...প্রথম প্রথম প্রেমে পড়ার দিনগুলিও খুব সুন্দর ছিল। অনন্যা সেই দিনগুলোকে খুব মিস করে! কিন্তু যখন সম্পর্কে জড়ালো, দুজনে কিছুটা কাছাকাছি আসলো সব কেমন যেন বিরক্তিকর হতে শুরু করলো। তাহলে প্রেম কি দূরে দূরেই সুন্দর হয়? কাছে এলে, পূর্ণতা পেলে সব কি ফিকে হয়ে যায়?
অনন্যা বুঝতে পারলো, আরণ্যকের প্রতি শুধু প্রেমই ছিল যা পূর্ণতা পাওয়ার আগ পর্যন্ত খুব সুন্দর ছিল। একদম প্রাতঃকালে উদয় হতে থাকা সূর্যের মতো। যখন সূর্য প্রচন্ড তাপ ছড়াতে থাকে, তাপমাত্রা ছাড়িয়ে যেতে থাকে, তখন মানুষের মনে বিরক্তির জন্ম নেয় ঠিক তেমনটা অনন্যার প্রেম।
অনন্যা হেসে উত্তর দিলো,
"হয়তো! অথবা হয়তো না! এর উত্তর আমি জানি না। আমি জানি আমি এখন ভালো আছি। আগে ভালো থাকতাম না। কিন্তু এখন আছি। হয়তো তাও ভুল কথা! আসলে আমি জানি না। নিত্যদিন যা চলছে , আমি খুব কনফিউজড। আমি কী ভালো আছি? নাকি ভালো থাকতে চেষ্টা করছি।"
"কি যা তা বলছিস? কি হচ্ছে তোর সাথে ক্লিয়ার করে বল, অনু!"
"বুঝতে পারছি না। তোমার জীবনে নিজের অস্তিত্ব রাখার জন্য দুঃখিত, বয়ফ্রেন্ড! এই নামে আর কখনো ডাকবো না। তাই আজ শেষ ডাকলাম। ভালো থেকো। আমার চিন্তা করো না। বাড়ি ফিরে যাও।
বাড়ি ফিরে প্রথমেই নিজের রুমের আয়নায় তাকিও। ঠিকমতো তাকাবে, ওকে? দেখতে পাবে, তুমি খুব ভালো একজন মানুষ। শুধু ভুল মানুষের প্রেমে পড়েছিলে। এমন একজনকে ভালোবেসেছো, যে তোমাকে কখনো ভালোবাসেনি। নিজেকে বোঝাও, আমি একজন ঠকবাজ মেয়ে। দেখবে হালকা লাগবে। আমাকে ভুলতে পারবে না কিন্তু আমি তোমার জীবনে খারাপ হয়ে থাকতে চাই। সেটাই থাকতে দাও, বয়ফ্রেন্ড!"
অনন্যা কল কেটে দিলো। তারপর ফোনটা বিছানায় ছুড়ে দিয়ে বসে রইল। কিন্তু মন স্থির থাকল না। ভেতরে ভেতরে এক অদ্ভুত কান্না চেপে ধরল তাকে। মানুষের মনের গভীরে আঘাত দেওয়ার পর যে ভারী যন্ত্রণা আসে, তা থেকে কখনোই নিজেকে মুক্ত করতে পারেনি অনন্যা। সৃষ্টির এমন দুর্বলতা, এমন অনুভূতিকে সে তীব্রভাবে ঘৃণা করে।
আরণ্যক আর ফোন করেনি। হয়তো আর করবে না। ছেলেটার অবস্থা এখন কী? কেমন আছে সে? হয়তো খারাপ! আচ্ছা, আরণ্যক কি এখনো অনন্যার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে? নাকি মাথা নিচু করে অনেক আগেই চলে গেছে?আরণ্যকের হৃদয় পোড়ানো কষ্ট অনন্যাকে যন্ত্রণা দিচ্ছে।
•••••••••••••
অন্ধকার রুমে একটা মাত্র ছোট বাল্বের ম্লান আলোয় চারপাশ ধোঁয়াটে মনে হচ্ছিল। কৌশিক জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছিল। তার শ্বাসের ভারী শব্দ যেন পুরো ঘরটায় প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। বিছানার উপর ছড়িয়ে থাকা পোশাক টেনে শরীরে জড়ালো সে। সাথে আরো একটি ভারী সোয়েটার গায়ে চাপাল। আবারো শীত ধরেছে তাকে। চোখ ঘুরিয়ে রিডোর দিকে তাকালো কৌশিক। রিডোর চোখে মুখে তীব্র লালসার ছায়া।
ফিসফিস করে কৌশিক বলল,
"মাংস খাবি, রিডো? যা, সব তোর!"
রিডো ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলো মেঝেতে পড়ে থাকা নিষ্প্রাণ দুটি দেহের দিকে। সেই দম্পতি, যারা আনন্দ নিয়ে প্রবেশ করেছিল এই রুমে, এখন নিস্তেজ। কৌশিকের ধৈর্য হারিয়ে যাওয়ার পরিণতি তারা বহন করছে। তাদের ঠোঁট আর মুখের জমাটভরা ভয় দেখে মনে হচ্ছে এখনো কৌশিকের দিকে তাকিয়ে আর্তি জানাচ্ছে।
রিডো মৃতদেহ দুটির গন্ধ শুঁকলো। তারপর ধীর পায়ে ফিরে এসে কৌশিকের পাশে বসলো। বিস্মিত হলো কৌশিক।
"ইচ্ছে নেই?"
রিডো অল্প গর্জন করলো। কৌশিক তার মাথায় হাত বুলিয়ে মৃদু গলায় বলল,
"প্রাণীদের ও দেখছি মন পরিবর্তন হয়! হা হা হা, তুই ও আমার মতো! আচ্ছা, আমি শিকদারকে আঘাত করেছি বলে তুই তখন ওমন আচরণ করলি? আমাকে বকলি?আমার কিন্তু খারাপ লেগেছে।"
রিডোর গর্জন এবার কিছুটা উচ্চস্বরে হলো। কৌশিকের ভ্রু কুঁচকে গেল।
"তোর কি অনন্যাকে পছন্দ হয়েছে? হা! কি বলিস? কয়দিনই বা হলো মেয়েটা এসেছে! আর এখনই?"
কৌশিক মনোযোগ দিয়ে রিডোর প্রতিক্রিয়া বুঝতে চেষ্টা করল। তারপর নিজেই হেসে বলল,
"ওহ! মেয়েটার স্পর্শ তোর ভালো লেগেছে, তাই না? গুড! গুড! আমি তো এখন পর হয়ে গেছি!"
রিডো জোরে গর্জন করে কৌশিকের পাশ ঘেঁষে আরাম করে বসলো। রিডোর আচরণ দেখে হাসলো কৌশিক।
.
.
.
চলবে...................................................................