ঘন জঙ্গলের ঠিক মাঝখানে একটা দোতলা বাড়ি। বডিগার্ডেরা বন্দুক নিয়ে বাড়ির চারপাশে দাঁড়িয়ে আছে পাহারায়। দিনের আলোতেও ভয়ে শরীর ছমছম করে। মাঝারি সাইজের রুম। উত্তর দিকে একটি জানালা আছে। জানালা খোলা। সূর্যের আলো সরাসরি ঘরে ঢুকছপ। ঘরের দক্ষিণ পাশে একটা টেবিল ও চেয়ার পাতা। সূর্যের আলোতে একটা পুরো মুখ স্পষ্ট ফুটে উঠে। মার্কাস। পায়ের উপর পা তুলে চেয়ারে বসে আছে। দরজার সামনে বন্দুক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দুজন লোক। ওরা দুজন চেক করার পরই কেউ এই ঘরে ঢুকতে পারে। অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর জোহান ঘরে ঢোকার অনুমতি পায়। মাথা নিচু করে। সে সঙ্গে সঙ্গে নতজানু হয়ে মার্কাসের সামনে বসল। কিছুক্ষণ পর জোহানের দিকে মাথা তুলে ওর দিকে তাকাল মার্কাস।
মার্কাস ঠোঁট চেপে গম্ভীর গলায় বলল,
'তুমি কিছু করতে পারবে না, জোহান। তাই তোমাকে অনেক দূরে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি।'
মার্কাসের কথা শ্রবণেন্দ্রিয়ে পৌঁছাতে তার দিকে জোহান তাকাল। বলল,
'জেগানকে খুঁজে বের করে হত্যা করা এত সহজ নয়, বস। আপনি যত সহজ ভাবছেন এটা তার চেয়েও অধিক কঠিন। কারণ জেগান গভীর সমুদ্রের মাছ। তাছাড়া আজ পর্যন্ত তাকে কেউ দেখেওনি। আমরা কেবল তার করা হত্যাগুলোর স্টাইল জানি। আর আমরা সেভাবে কয়েকজনকে হত্যা করেও দেখেছি। তবুও, কাজ হয়নি। জেগানের কাছে পৌঁছাতে পারেনি পুলিশ।' বলে থামল জোহান। নিজের অসহায়ত্ব ঢাকতে অন্যের দোষ খুঁজে বের করছে সে। জোহান ফের বলল, 'বস, আমাকে আর একটা শেষ সুযোগ দিন। আমি আপনার শত্রুকে আপনার পায়ের কাছে এনে ফেলব।'
মার্কাস ভ্রুকুটি করল।
'তুমি সেটা কিভাবে করবে?'
জোহান চুপ হয়ে গেল। তার কাছে কোনো উত্তর নেই। সে জানেও না। ও কিভাবে কী করবে? শত্রুকে পরাজিত করতে হলে শত্রুকে চিনতে হয়। তার সম্পর্কে সব খবর রাখতে হয়। তারপর শত্রুর দুর্বলতার উপর অতর্কিত আক্রমণে সহজেই বিজয় অর্জন করা যায়। কিন্তু এখানে? কিছুই হয়নি। জেগানকে কেউ দেখেনি, চেনেও না। জেগান শুধু একটা নাম যেনো। বাঁশির সুরের মতো সবার কানে বাজে। তাকে মারার চিন্তা করা, অন্ধকারে ঢিল ছুঁড়া বা আকাশের দিকে থুতু ফেলা সমান।
মার্কাস জোরে জোরে বলল,
'আমি তোমাকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে আসছি। দুঃসময়ে তোমাকে সাহায্য করেছি। তোমার বাবা তোমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার পর আমি তোমাকে থাকার জায়গা দিয়েছিলাম। আর তুমি কি করছ? আমার একমাত্র শত্রু জেগান। সে আড়াল থেকে আমার সব ব্যবসা ডুবিয়ে দিছে। ব্যবসা নষ্ট করেছে। আর তুমি কি করছ? ওর ক্ষতি করা তো দূরের কথা, সে দেখতে কেমন এটাও আমাকে দেখাতে পারছো না।'
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল জোহান।
'বস। আমার কথাটা শুনুন।'
মার্কাস হঠাৎ চিৎকার করে উঠল,
'সব সময় সেহরিশ, সেহরিশ করো। তাকে ও তার পরিবারের ক্ষতি করার মতলব আটছো। তোমার মাথায় তাকে ধ্বংস করা ছাড়া আর কোনো জোশ নেই।'
রাগী গলায় বলল জোহান,
'আমার লক্ষ্য স্থির বস। সেহরিশ ফাতিন চৌধুরীকে এই জীবনে হারানো। এর জন্য যদি আমাকে মরতে হয়, আমি তার জন্যও প্রস্তুত। কিন্তু আমি মরার আগে ওর ধ্বংস নিশ্চিত করে যাব।'
'হিংসা মানুষকে অনেক কিছু করতে বাধ্য করে।' মার্কাস বলল।
জোহান কর্কশ গলায় বলল।,
'শুধু সহিংসতা নয়, বস। আমার জীবনে ও আসার পর থেকে সুখ ঝরা পাতার মতো ঝরে গেছে। যেখানে আমি এক নম্বরে ছিলাম, সেখানে লাস্ট হয়েছি। তার সুদর্শন চেহারা একের পর এক আমার সব প্রিয়জন কেড়ে নিয়েছে। হিংসা আর এমন কি? এমনকি যে মেয়েটিকে আমি ভালোবাসতাম।'
গম্ভীর গলায় বলল মার্কাস,
'তুমি অনেক আগেই তাকে মেরে ফেলেছ।'
জোহানের ঠোঁট কুঁচকে গেল হাসিতে। বলল,
'সে আমাকে ছেড়ে সেহরিশকে চেয়েছিল। তাই ওকে ওর সঠিক জায়গায় পৌঁছে দিয়েছি। আর যে আমার হতে অস্বীকার করেছিল, তাকে বাঁচিয়ে রাখার কোনো মানে হয় না। মৃত্যুই তার জন্য শ্রেষ্ঠ উপহার। এখন আমার একমাত্র উদ্দেশ্য সেহরিশের ধ্বংস। আমি তাই করব। এজন্য আপনি যদি আমাকে আপনার কাছে না রাখেন তবে আমি অন্য উপায় খুঁজে বের করে তার কাছে পৌঁছাব।'
'তোমার জীবনের একটাই লক্ষ্য। সেহরিশ ফাতিন চৌধুরীকে ধ্বংস করা আর আমার উদ্দেশ্য মাফিয়া গডফাদার জেগানকে হত্যা করে তার স্থান দখল করা। আমাদের উদ্দেশ্য একই শুধু লক্ষ্য ভিন্ন। সেহরিশের ব্যাপারে আমি আপনাকে সম্পূর্ণ সাহায্য করব। কিন্তু তারপর? তোমার আমাকে সাহায্য করতে হবে। জেগানের মৃত্যুর পর আমি তার জায়গা নেব। আর তুমি জেলে যাবে।' অনেক সময় নিয়ে ধীরে ধীরে কথাগুলো বলল মার্কাস।
জোহান বলল,
'জেগান, এক আতঙ্কের নাম। আজও তার নাম শুনলে সাধারণ মানুষ থেকে আন্ডারওয়ার্ল্ডের সবাই ভয় পায়। তার সব কাজ নিখুঁত। হত্যা, সশস্ত্র ডাকাতি বা অন্যান্য গুরুতর অপরাধ। বেঁচে যায় সবকিছুতে। পুলিশেরও তার বিরুদ্ধে কিছু করার সাহস নেই। এমন লোককে হত্যা করা কি সহজ হবে, বস?'
মার্কাস ভ্রু কুঁচকে বলল,
'আমার বাবা বেঞ্জামিনের ডান হাত ছিল জেগান। বাবার বেশিরভাগ কাজ জেগান নিজেই সামলাতো। এর জন্য সে অনেক বিশ্বস্ত হয়ে উঠে। আমি রাশিয়ায় ছিলাম তখন। বাবার কাজে আমি কখনো ভ্রুক্ষেপ করিনি তাই জেগান দেখতে কেমন আমার জানা নাই। কয়েকবার বাবার মুখ থেকে ওর নাম শুনেছি। বাবা ওর প্রতি এতো মুগ্ধ ছিলো যে সারাক্ষণ তার গল্প করতো এজন্য আমি কথা বলা বন্ধ করে দেই। মাস ছয়েক পর হঠাৎ কল আসে। জেগান আমার বাবাকে মেরে ফেলে তার পাপের সাম্রাজ্যের অধিপত্য হাসিল করে। তারপর হঠাৎ গায়েব হয়ে যায়। কিন্তু তার কাজ আড়ালে থেকে চালু ছিল। ধীরে ধীরে সে হয়ে উঠে ভয়ংকর। মানুষ মারা তার হাতে চুটকি বাজানোর মতো। আর সেটাকেই আমি এখন কাজে লাগাবো। আমার বাবার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিয়ে আমি আমার রাজ্যে প্রবেশ করব। আর সেখানকার রাজা হবো। জেগান যে সম্পত্তি ভোগ করছে তার একমাত্র উত্তরাধিকারী আমি। মার্কাস।'
'জেগান যেভাবে বেঞ্জামিনকে হত্যা করে তার জায়গায় নিজে বসেছিল। আপনিও সেটাই করতে চাচ্ছেন ওর সঙ্গে।' বলল জোহান।
মার্কাস বিকট শব্দে হাসতে লাগল। তারপর বলল,
'হ্যাঁ। ঠিক বুঝেছো। তার আগে তোমার কিচ্ছা শেষ করতে হবে। সেহরিশ ফাতিন চৌধুরী কে ধ্বংস করার অনেক পথ তুমি অবলম্বন করেছো। কিন্তু কাজ হয়নি। সামান্য সিঙ্গারকে মারার জন্য এত কাঠ পোড়াচ্ছ কেন? অতি সহজ উপায় আমি তোমাকে বলছি। দুদিনে তোমার পথের কাঁটা গোড়া থেকে তুলে ফেলব।'
জোহান লহু কণ্ঠে বলল,
'সেহরিশ সাধারণ মানুষের মতো নয়। ও খুব চতুর প্রাণী।'
মার্কাস হাসল। বলল,
'সে ও যাই হোক। আমার কাছে টিকতে পারবে না। আমি শুধু একজনের কাছে দূর্বল আর বাকিরা আমার কাছে।'
জোহান মাথা নিচু করল। মার্কাস কিছু কথা বলে। নিশ্চুপ হয়ে গেল। জোহান বুক ভরে শ্বাস টেনে তারপর হাসল। চোখেমুখে উল্লাস যেনো জ্বলজ্বল করছে। সেহরিশ কে মারার ‘মৃত্যু ফাঁদ’ শুনে কল্পনা করে তৃপ্ত চোখে তাকায় জোহান। বুক ফুলিয়ে বলল,
'এবার সেহরিশকে মেরে তবেই আপনার সামনে আসব। এটা আপনার কাছে আমার প্রতিশ্রুতি, বস।'
এতক্ষণ ওদের কথাবার্তা ইতালীয় ভাষায় হচ্ছিল। জোহান খুশিমনে এখন বিদায় নিয়ে বের হয়ে গেল। সন্ধ্যা হওয়ার আগে তাকে এই অরণ্য থেকে বের হতে হবে। মার্কাস চেয়ারে হেলান দিয়ে বসল। জানালার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট বাঁকা করে হাসল শুধু। এসময় দরজায় ঠকঠক আওয়াজ শুনে সেদিকে তাকায় মার্কাস। তার বিশ্বস্ত লোক আর্থেস দাঁড়িয়ে আছে। মার্কাসের সঙ্গে চোখাচোখি হতে সে ধুপধাপ পা ফেলে ঘরে প্রবেশ করে।
মার্কাস জিজ্ঞেস করলো,
'তোমাকে এতো গম্ভীর দেখাচ্ছে কেনো?'
আর্থেস মাথা নাড়ল, সে নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করে বলল,
'আমাদের দুজন লোককে জেগান ধরে ফেলেছে। ওরা যদি মুখ খুলে তাহলে জেগান যেকোনো সময় আমাদের কাছে পৌঁছে যাবে।'
মার্কাস উঠে দাঁড়াল। রাগান্বিত শক্ত গলায় বলল,
'আই কিলড হিম।'
পরোক্ষণেই আঁড়চোখে আর্থেস কে দেখল মার্কাস। চাপা গলায় জানতে চাইল। জেগান কাদের ধরেছে? নাম শুনে একগাল হাসল মার্কাস। পূর্বের ন্যায় আরাম করে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে।
দীর্ঘশ্বাস ফেলল মার্কাস। বলল,
'জেগান ধরলেও ভুল মানুষ কে ধরেছে। ওরা তো আমার হাতে বাঁধা । মুখ খুললেও জেগান ওদের মারবে আর না খুললেও মারবে। আর যদি মুখ খুলে তাহলে ওদের পরিবারের সদস্যের আমি মারব। একসাথে নির্বংশ হওয়ার চেয়ে একা মরা ব্যাটার। ওরা নিজেদের পরিবারের কথা চিন্তা করে কিছুই বলবে না।'
আর্থেস ভারী নিঃশ্বাস ফেলল। নিজেকে বাঁচার জন্য আশেপাশের মানুষের বলি দেওয়া মার্কাসের জন্য নতুন না। আর্থেস নিশ্চুপে চলে গেল।
•••••••
সেহরিশ সিলিংয়ের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মনের মধ্যে এক অদ্ভুত অস্বস্তি হচ্ছে। রাত বাড়ছে। চোখের পাতা বন্ধ করতে পারছে না। হঠাৎ মাথায় হাতের স্পর্শে পেতে ধীরেধীরে তাকাল সেহরিশ। সেহরিশের অগোছালো চুলে আলতোভাবে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে রোদেলা। শান্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
'কি হইছে আপনার? তূর্ণ ভাইয়ের বাড়ি থেকে আসার পর থেকে দেখছি কেমন অদ্ভুত আচরণ করছেন।'
সেহরিশ চোখ বন্ধ করে ফেলল। রোদেলা শুধাল,
'আপনার কোথায় কষ্ট হচ্ছে? বলেন কিছু!'
সেহরিশ তাকাল। ওর মুখটা থমকানো, চোখ দুটো শান্ত ও স্থির। সেহরিশ রোদেলাকে টানল। বুকের সঙ্গে মিশিয়ে নিল। রোদেলার কপালের ভাজে আলগোছে ঠোঁটটা স্পর্শ করে সেহরিশ। রোদেলা থমকে গেল। এক মূহুর্তের জন্য চমকাল সে। ভাবলো, আজ মানুষটার হয়েছে কী? সেহরিশের এখন শান্তি লাগছে যেনো। রোদেলাকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। বুক চিরে ছুটে বেরিয়ে এল তপ্তশ্নাস। বাতাসের সঙ্গে মিইয়ে যেতে সেহরিশ মৃদু স্বরে বলল,
'আমার কিছু হয়নি। তুমি শুধু কাছে থাকো। রোদ, তুমি যখন আমার কাছাকাছি থাকো, আমার সব দুশ্চিন্তা এক নিমিষেই দূর হয়ে যায়। তোমার স্পর্শ যেন মরুভূমির এক ফোঁটা জলের মতো।'
সেহরিশ রোদেলার দিকে তাকাল। তারপর কপালে আরও একবার চুমু খায়, কপাল ছেড়ে রোদেলার দুই গালে, থুতনিতে তারপর রোদেলার ঠোঁটে। গভীর ভাবে চুমু খায় সেহরিশ। ঠোঁটে ঠোঁট রেখে একহাত রোদেলার গলায় রাখল। এরপর অন্য হাত তার কোমড় ছুঁয়েছে। সেহরিশ রোদেলাকে ঘুরিয়ে বিছানায় শুয়ে দিল। এরপর তার উপরে উঠে হাঁটুতে ভর দিয়ে বসে। সেহরিশ চোখ বন্ধ করে ফেলেছে রোদেলার ঠোঁট ছেড়ে এরপর গলায় গভীর আবেশে চুমু খেতে লাগল। মাথার ভেতরকার ঘুনেপোকারা এখন যেনো শান্ত হয়ে গেছে। চারদিক শান্ত।
.
.
.
চলবে....................................................................