স্টে উইথ মি - পর্ব ০৬ - নুসরাত জাহান বৃষ্টি - ধারাবাহিক গল্প


          শেরাজ স্থির চোখে তাকিয়ে আছে সামনে দাঁড়ানো মেয়েটার দিকে। শেরাজের গভীর দৃষ্টি পুরো মেহুলকে পড়তে চাইছে, তার প্রতিটি ভাবনার মর্ম বুঝতে চাইছে। আর যেটাতে সে সফলও হয়েছে। মেহুলের চোখ-মুখ বিস্ময়ে ভরা, এমন এক বিস্ময় যা শেরাজের পাঁচ বছরের অনুপস্থিতির স্মৃতি আর বর্তমানে শেরাজকে নিজের সামনে দেখে যেন একটা ভ্রমে পড়ে গেছে।

শেরাজ নড়ে উঠল। পাক্কা পাঁচ বছর না ভুল, তার চেয়েও বেশি সময় হবে শেরাজ নিজ জন্মভূমিতে পা রাখেনি। আজ পাঁচ বছর পর শেরাজ নিজ জন্মভুমিতে, নিজ বাড়িতে পা রেখেছে। এই দেশের বাতাসে শ্বাস নিচ্ছে। নিজের হৃদয়ে যে কন্যাকে লুকিয়ে রেখেছে, আজ সেই কন্যাকে পাঁচ বছর পর সরাসরি সামনে থেকে দেখতে পাচ্ছে। কিন্তু এতে এই পাঁচ বছরের না দেখা তৃষ্ণা মিটবে তো? এই কন্যার জন্য এই‌ পুরুষটি‌ দুনিয়ার যেকোনো কাজ করতে প্রস্তুত। তার কাছে নেই কোনো সীমা‌ পরিসীমার হিসাব।

কেটে গেছে কয়েক মুহূর্ত। দুজনেই নিরব। কারো মুখ থেকে কোনো শব্দ বেরোচ্ছে না। মেহুলের নজর পড়ে শেরাজের পাশে রাখা দুটো বড়ো লাগেজের দিকে। মস্তিষ্ক নাড়া দিয়ে বলে, শেরাজ ভাই কি এক্কেবারের জন্য বাংলাদেশে চলে এসেছে কিন্তু? 

মেহুল শেরাজের দিকে তাকাল। পাঁচ বছর আগের সেই চেনা শেরাজ আর এখনকার শেরাজের মধ্যে যেন আকাশ-পাতাল ফারাক। চোখের চাওনি বড্ড তীক্ষ্ণ। এই চাওনি যেন প্রতিটি মানুষকে তলিয়ে দেখার মতো‌ ক্ষমতা রাখে। মুখ ভর্তি চাপ দাঁড়ি, কাঁধ চওড়া, দু হাতের পেশিগুলো ফুলে‌ ফেঁপে আছে । যা কালো ব্লেজারের ভেতর থেকেও তার শক্তপোক্ত কাঠামো স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। এ যেন সম্পূর্ণ অন্য এক শেরাজ, যার সঙ্গে‌ পাঁচ বছরের শেরাজের তুলনা চলে না। মেহুলের ভেতরে এক মিশ্র অনুভূতির ঢেউ আছড়ে পড়ছে—বিস্ময়, কৌতূহল আর খানিকটা দ্বিধা, ভয়। কিন্তু শেরাজের মুখে লেগে আছে একধরনের রহস্যময় শান্তি।  

পেছন থেকে আকলিমা বলতে বলতে এগিয়ে আসছে, "কে এসেছে মেহুল আপা?" 

মেহুল কিছু বলার আগেই আকলিমা দরজার কাছে এসে দাঁড়ায়। সামনাসামনি শেরাজকে দেখে ভুত দেখার মতো চমকে উঠে। আকলিমা তুতলিয়ে বলল, "রা... রা... জ ভাইয়া! তুমি এখানে?"

শেরাজ ভারী কণ্ঠে বলল, "কেন? আসতে পারি না? নাকি বাংলাদেশে আসা আমার জন্য সারাজীবনের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে?"

আকলিমা বোকার মতো হেসে হেসে বলল, "কি যে বলো না তুমি, রাজ ভাইয়া। এসো, ভেতরে আসো।" 

আকলিমা এগিয়ে গিয়ে একটা লাগেজ হাতে তুলে ভেতরে ঢুকে পড়ল। শেরাজ এবার মেহুলের দিকে তাকাল। চোখে চোখ পড়তেই মেহুল তড়িঘড়ি করে নজর সরিয়ে নিয়ে, দরজার সাথে চেপে গেলো। শেরাজ তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে লাগেজ হাতে তুলে নিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল।

শেরাজ ভেতরে চলে গেলেও মেহুল দাঁড়িয়েই রইল। মেহুল শেরাজের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে শুকনো ঢোক গিলল। শেরাজকে দেখে সেই পাঁচ বছর আগের ঘটা দৃশ্যটা চোখের সামনে বাস্তব রুপে ভেসে উঠেছে। কতটা ভয়ানক ছিলো সেই দিনটা। শেরাজের সেই ভয়ংকর রূপ। মেহুল চোখের চশমাটা নাকের উপরে ঠেলে দিয়ে জোরে নিঃশ্বাস ফেলে নিজেকে ঠিক করলো।

শেরাজ ড্রয়িং রুমের মধ্যস্থলে এসে দাঁড়ালো। চোখ ঘুরিয়ে সে পুরো বাড়িটা পর্যবেক্ষণ করছে। এই পাঁচ বছর সময়ে অনেক পরির্বতন এসেছে বাড়িতে। তবে বাড়ির প্রতিটি কোণায় কোণায় তার শৈশবের স্মৃতি লুকিয়ে আছে। বাড়ির প্রতিটি ইট যেন তার জীবনের গল্প বলে দিচ্ছে। যে জীবনে রয়েছে সুখ, দুঃখ, পাওয়া না পাওয়ার আনন্দ বেদনা। শেরাজের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল। ভেতরে কোথাও একটা চাপা ক্ষোভ নয়তো ভেতরে অদ্ভুত এক শূন্যতা আছে। আকলিমা পেছনে এসে দাঁড়াতেই শেরাজ প্রশ্ন করল।

"বাড়িতে কেউ নেই?"

"বাড়ির সবাই দাওয়াতে গেছে।"

শেরাজ এক মুহূর্ত নীরব থেকে ধীর কণ্ঠে বলল, "তাহলে ফোন করে বল, আমি এসেছি।"

আকলিমা মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল, "আচ্ছা।"

শেরাজ কিছুক্ষণ চুপ থেকে প্রশ্ন করল, "আমার রুমটা ঠিক আছে তো?"

আকলিমা হাসিমুখে বলল, "তোমার রুমটা মাসে দু-তিনবার পরিষ্কার করা হয়। এক্কেবারে ঝকঝকে। তাই কোনো চিন্তা নাই তুমি যাও রুমে সব পরিস্কার পাবে। আমি খালা আম্মাকে ফোন দিয়ে বলি তুমি যে আসছো।"

আকলিমা চলে গেল। শেরাজ ঘাড় ঘুরিয়ে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মেহুলের দিকে তাকাল। মেহুল শেরাজের চাওনি দেখে‌ সাথে সাথে দৃষ্টি সরিয়ে নিল। শেরাজ চ জাতীয় শব্দ উচ্চারণ করে দু হাতে দুটি লাগেজ তুলে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিজের ঘরে চলে যায়। 

শেরাজ উপরে যেতেই মেহুল চোখ বন্ধ করে জোরে নিঃশ্বাস ছাড়ল। শরীরটা ছেড়ে দিল দরজায়। সবকিছু যেন কল্পনিক মনে হচ্ছে। শেরাজ যে এভাবে কাউকে কিছু না জানিয়ে হুট করে বাংলাদেশ চলে আসবে এটা সত্যিই অপ্রত্যাশিত। মেহুলের মাথায় একটা প্রশ্নের ঢেউ খেলে গেল শেরাজ ভাই কি তার সঙ্গে কথা বলবে না? তাকে কি অবহেলা করবে? নাকি রুঢ় আচরণ করবে? মেহুল তা জানে না। তবে এতটুকু সময়ে এটা বুঝে গেছে আর যাই হোক তাদের সম্পর্কটা সেই আগের মিষ্টি সম্পর্কের মতো আর হবে না।

মেহুল সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে সিড়ির দিকে এগিয়ে গেল‌উদ্দেশ্য নিজের ঘরে যাওয়া। ধীরে ধীরে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠল সে। উপরে এসে করিডোরে নিজের ঘরের দরজার সামনে এসে স্থির হয়ে দাঁড়াল। দৃষ্টি গেল শেরাজের ঘরের খোলা দরজার সাদা পর্দার দিকে। পর্দাগুলো মৃদু বাতাসে মুক্তভাবে দুলছে। এই ঘরের মালিক আজ পাঁচ বছর পর নিজের ঘরে ফিরে এসেছে। হয়তো ঘরটাও পাঁচ বছর ধরে নিজের মালিককে মিস করছিল। আজ থেকে এই ঘর থেকে ভেসে আসবে পরিচিত গন্ধ, টের পাবে কারো উপস্থিতি।

আকস্মিক পর্দার আড়াল থেকে শেরাজ বেরিয়ে এসে দরজার সামনে দাঁড়াল। শেরাজকে এভাবে হঠাৎ করে আসতে দেখে মেহুল চমকে উঠে চোখ বড়ো বড়ো করে তাকায়। শেরাজের গভীর চাহনি, তীক্ষ্ণ চোখের শীতলতা মেহুলকে অস্থির করে তুলল। বুকের ভেতর যেন অদ্ভুত কিছু একটা হু হু করে উঠল। মেহুল তড়িঘড়ি করে নিজের রুমে ঢুকে দরজা আটকে দিল। দরজা বন্ধ করে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়াল। তার শ্বাস ভারী হয়ে এসেছে। এমন অদ্ভুত অনুভূতি কেন হচ্ছে আজব? এ কোন যন্ত্রণায় পড়ল সে?

শেরাজ রুমে এসে ঢুকল। কয়েক সেকেন্ড থম‌‌ মেরে দাঁড়িয়ে থেকে চোখ বন্ধ করে জোরে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ল। চোখের সামনে ভেসে উঠল মেহুলের অবাক বিস্মিত আর খানিকটা ভীত চেহারা। মেয়েটা ভীষণভাবে চমকে গিয়েছিল তাকে দেখে। মেহুলের ফোলা ফোলা চোখ আর বিভ্রান্তকর মুখাবয়ব যেন অদ্ভুতভাবে শেরাজের মনকে এক মুহূর্তের জন্য কাঁপিয়ে দিয়েছিল। খুব ইচ্ছে হচ্ছিল মেহুলের কাছে গিয়ে মেয়েটার ফোলা ফোলা গাল দুটো ছুঁয়ে দিতে। কিন্তু না শেরাজ নিজেকে সামলে নেয়। নিজের হাত আর মনটাকে শক্ত করে নিয়ন্ত্রণে আনল। এই নিয়ন্ত্রণটা সে ধরে রাখবে। মেহুল এই পাঁচ বছরে তাকে যতটা ভেতর থেকে জ্বলিয়ে-পুড়িয়ে শেষ করে দিয়েছে, ঠিক ততটাই সে মেহুলের মন আর হৃদয় জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাড়খার করবে। সে এতটুকু জানে মেহুল আর যাই হোক তার শেরাজ ভাইয়ের অবহেলা সহ্য করতে পারবে না। আর এই অবহেলাই হবে শেরাজের অস্ত্র। এই অবহেলা দিয়েই সে মেহুলকে নিজের সঙ্গে সবটুকু দিয়ে জড়িয়ে নেবে। মেহুলকে সে ছাড়বে না এই জীবনে তো নয়ই।

—————
 
 এনা আকস্মিক রাহীবের কেবিনের দরজা জোরে ধাক্কা দিয়ে খুলে ভেতরে ঢুকে নিজের সর্বশক্তি দিয়ে দরজাটা আবার পেছন থেকে বন্ধ করে চিৎকার করে বলল, "শেরাজ কোথায়? কোথায় গেছে ও?"

রাহীব মনোযোগ দিয়ে ফাইল দেখছিল, এমন আচমকা আক্রমণে চমকে উঠে চেয়ারসহ পিছিয়ে গেল। সামনে দাঁড়ানো মেয়েটার চোখ মুখ রাগে লাল হয়ে আছে। মনে হচ্ছে যেন তাকে এই রাগ দিয়ে ঝলসে দেবে। রাহীব হতভম্ব হয়ে শুকনো ঢোক গিলল। এনা চেঁচিয়ে উঠল, "আন্সার মি, রাহীব! হোয়্যার ইজ শেরাজ?"

রাহীব উঠে দাঁড়িয়ে হেলেদুলে রাগান্বিত এনার দিকে এগিয়ে এসে হালকা হেসে বলল, "রিল্যাক্স এনা! শান্ত হও। এত উত্তেজিত হলে শরীর খারাপ করবে তো সোনা।"

এনা দাঁত চেপে রাগে গজরাতে গজরাতে বলল, "জাস্ট শাট আপ!"

রাহীব দু'কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, "ঠিক আছে, তুমি যখন বললে জাস্ট শাট আপ হয়ে গেলাম।"

কিন্তু এনার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেলো। সে রাহীবের ব্লেজারের কলার ধরে হঠাৎ টেনে নিজের ধারে এনে বলল, "শেরাজ কোথায়? কোথায় গেছে ও আমাকে কিছু না বলে? ওর বাড়িতে গিয়েছিলাম ও সেখানেও নেই। কোথায় গেছে ও?"

রাহীব চোখ বন্ধ করে জোরে নাক টেনে ঘ্রাণ নিয়ে শক্তপোক্ত বা হাতটা এনার মেদহীন কোমরে রেখে নেশামাখা কণ্ঠে বলল, "উফফ! কী মাখো গায়ে যে এতটা মাতাল করা গন্ধ আসে তোমার গা থেকে আমি তো জাস্ট পাগল হয়ে যাচ্ছি।"

এনা নাক ফুলিয়ে রাহীবকে ধাক্কা মেরে দূরে সরিয়ে দিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে রেখে বলল, "একদম অসভ্যতামো করবে না, রাহীব। না হলে এর ফল কিন্তু ভালো হবে না।"

রাহীব বাঁকা হেসে বলল, "কেন? এই অসভ্যতামোটা শেরাজ করলে খুব এনজয় করতে তাই না?"

এনা রাগে আবার রাহীবের কলার ধরতে চাইল, কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে সরে দাঁড়াল। রেগে মাথার চুল দু'হাতে আকড়ে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বলল, "শেরাজ যেখানেই যাক না কেন, ওর কাছে আমি তো পৌঁছাবই যে করেই হোক।"

রাহীব ঠোঁটের কোণে হাসি রেখে দু'হাত বুকের উপর বেঁধে ডেস্কে হেলান দিয়ে বসে বলল, "ঠিক আছে, চেষ্টা করো।"

এনা চোখ সরু করে বলল, "তুমি বলবে না তো‌ ও কোথায় আছে?"

রাহীব গা ছাড়া ভঙ্গিতে বলল, "জানলে তো বলবো।"

এনা মাথা নাড়াতে নাড়াতে বলল, "ওকে ফাইন বলতে হবে না তোমায়।"

এনা তীক্ষ্ণ চোখে রাহীবের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। এরপর নিচ থেকে ব্যাগটা তুলে নিয়ে হনহনিয়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল। রাহীব দু'হাত প্যান্টের পকেটে গুঁজে শিশ বাজাতে বাজাতে চেয়ারে বসে ফোন হাতে তুলে নিয়ে একটা নাম্বার ডায়াল করল। ওপাশের লোকটা ধরতেই রাহীব শরীরটা চেয়ারে হেলিয়ে বলল, "দোস্ত তোমার পাগলা প্রেমিকা তো তোমার অনুপস্থিতিতে পাগল হয়ে গেছে। তোমায় খুঁজে নাকি বের করবে সে।"

ভেসে এলো‌ শেরাজের রাশভারী কণ্ঠ, "ও আমার প্রেমিকা নয় সেটা তুই‌ খুব ভালো করে জানিস রাহীব।"

রাহীব রসিয়ে রসিয়ে বলল, "আই নো সোনা। তুমি‌‌ তো এখন তোমার পিচ্চি প্রেমিকা‌র সাথে আছো তাই না শের বেবি। তা পাঁচ বছর পর পিচ্চি প্রেমিকাকে কাছে পেয়ে কি করলি চুমু টুমু খেয়েছিস নাকি?"

শেরাজ চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, "বিশ্বাস কর তুই যদি এখন আমার হাতের নাগালে থাকতি তাহলে তোর বা গালে আমার পাঁচ আঙুলের চাপ পড়তো।"

রাহীব বা হাতটা, বা গালে চেপে ধরে বলল, "আমি তোর নাগালে নেই বলেই তো বললাম।" 

ভেসে এলো একজন মহিলার বুকভরা আহাজারির কণ্ঠ। কণ্ঠে জড়িয়ে আছে গভীর বেদনা। রাহীব কথা বার্তা শুনে বুঝলো শেরাজের মায়ের কণ্ঠ। তাই আর কথা না বাড়িয়ে কল কেটে দিলো। পাঁচ বছর পর ছেলে বাড়ি ফিরে এসেছে সেই মায়ের মন কেমন হতে পারে সেটা রাহীব খুব ভালো করেই জানে। 
·
·
·
চলবে..................................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp