শাহানা বেগম আজ এতগুলো বছর পর ছেলেকে কাছে পেয়ে প্রাণভরে নিজ হাতে খাইয়ে দিচ্ছেন ছেলেকে। কোনটা আগে দেবেন আর কোনটা পরে দেবেন তা নিয়ে দোটানায় পড়ে গেছেন। শেরাজও মায়ের এই স্নেহকে অবজ্ঞা করছে না নিঃশব্দে মুখে তুলে নিচ্ছে খাবারগুলো। পাশে বসা ইহসান মির্জা চুপচাপ মা-ছেলের এই মুহূর্তগুলো দেখছেন, কিন্তু মনের মাঝে এক অজানা ভয় কাজ করছে। এই ছেলে বাংলাদেশে ফিরে এসেছে ভালো কথা, কিন্তু আবার অতীতের মতো কোনো কর্মকাণ্ড ঘটিয়ে ফেলবে না তো?
ইফা খেতে খেতে নাক সিটকে বলল, "উমম! আমাকে তো কোনোদিন এভাবে হাতে তুলে খাইয়ে দাও না মা আর আজকে একেবারে ভাইয়াকে নিজ হাতে খাইয়ে দিচ্ছো!"
শাহানা বেগম ত্যাড়া কণ্ঠে বললেন, "হ্যাঁ, এতটুকু যে বড় হয়েছিস সেটা তো নিজ হাতে খেয়ে বড় হয়েছিস। আমি তো তোকে খাইয়ে দিই নি। মায়ের পেট থেকে বের হয়েই নিজের হাতে খেতে শুরু করে দিয়েছিস।"
ইফা চোখ ঘুরিয়ে বলল, "থাক আর কথা না বাড়াই, তর্ক করলে শেষ হবে না। কথায় কথা বাড়ে।"
এই সময় আতাউর মির্জা নিজের রুম থেকে খাওয়ার ওষুধ খেয়ে এসে ডাইনিং টেবিলের পাশে বসেন। এক পলক নাতি শেরাজের দিকে তাকালেন। ডাইনিং টেবিলে পরিবারের সবাই আছে, কিন্তু একজন নেই সেটা মেহুল। আতাউর মির্জা গম্ভীর কণ্ঠে ইফাকে প্রশ্ন করলেন, "মেহুল কোথায়?"
শেরাজ থমকে গেল। মুখে থাকা খাবার চিবানোও থেমে গেল এক মুহূর্তের জন্য। ইফা নির্বিকার ভঙ্গিতে উত্তর দিল, "ওর নাকি খেতে ইচ্ছে করছে না। আমি অনেকবার ডেকেছি কিন্তু আসে নি।"
আতাউর মির্জার কপালে ভাঁজ পড়ে গেল। গম্ভীর স্বরে তিনি আকলিমাকে চেঁচিয়ে ডাকলেন, "আকলিমা!"
আকলিমা রান্নাঘর থেকে ছুটে এলো, "জি নানা?"
"যা মেহুলকে ডেকে নিয়ে আয়। যদি না আসতে চায়, তাহলে বলবি নানা ডেকেছে।"
আকলিমা সম্মতির ইঙ্গিত দিয়ে দ্রুত চলে গেল। এদিকে শেরাজের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। যেন মনে মনে খুব গম্ভীর চিন্তায় মগ্ন আছে। অথচ এই চিন্তাগুলো প্রকাশ করার বদলে সে মুখে এক অদ্ভুত কাঠিন্য নিয়ে চুপচাপ বসে রইল। শাহানা বেগম ছেলের সামনে আরেক লোকমা তুলে ধরতেই শেরাজ বিরক্ত কণ্ঠে বলল, "খাবো না।"
"কেন বাবা? এখনো তো তেমন কিছুই খেলি না!"
শেরাজ কিছু না বলে চুপ করে রইল, কিন্তু তার হাতের আঙুলগুলো মুষ্টিবদ্ধ হয়ে উঠল। তার চোখের সামনে ভেসে উঠছে মেহুলের মুখখানা হয়তো মেয়েটা কষ্ট পেয়েছে তার ওই ব্যবহারের জন্য।
—————
মেহুল ধীরে ধীরে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামছে পা টেনে টেনে। সত্যি বলতে সে একদমই আসতে চায় নি নিচে। কিন্তু যখন শুনল, নানা ভাই তাকে ডাকছে তখন আর নানা ভাইয়ের কথার অবাধ্য করতে পারে নি। মনের মধ্যে দ্বিধা থাকলেও নিজেকে সামলে রুম থেকে বেরিয়ে এলো। করিডোরে এসে নিচে তাকাতেই চোখ পড়ল ডাইনিং টেবিলে বসা শেরাজের ওপর। বুকের ভেতর অদ্ভুত এক শূন্যতা অনুভব করল মেহুল। শেরাজের সামনে যেতে ইচ্ছে করছে না কিন্তু নানা ভাইয়ের কথাও ফেলা যায় না। তাই এক রকম মনস্থির করেই নিচে নামতে শুরু করল।
শেরাজ টের পেল মেহুলের উপস্থিতি। সিঁড়ির দিকে চোখ যেতেই দেখতে পেল মেহুল ধীরে ধীরে নিচে নামছে। মেয়েটা পা টেনে টেনে হাঁটছে। তার কপালে ভাঁজ পড়ল। মুখে পুরো রাজ্যের বিস্ময়। পায়ে কী হয়েছে মেয়েটার? এমন খুঁড়ে খুঁড়ে হাঁটছে কেন? শেরাজের মস্তিষ্ক মুহূর্তেই সাড়া দিল। কুঁচকানো ভ্রু স্বাভাবিক হলো। কিছুক্ষণ আগের ঘটনাটা মনে পড়ে গেল। তার রাগ, তার উদ্যত আর তার ফলাফল এখন মেহুলের এই অবস্থা! এটা সে কী করে ফেলল? এমনটা তো করতে চায় নি শেরাজ।
শেরাজ চেয়েছিল শুধু বুঝিয়ে দিতে, এতগুলো বছর ধরে জমে থাকা রাগ আর অভিমানটা প্রকাশ করতে। কিন্তু সেই রাগের বিস্ফোরণে যে মেহুলকে রক্তাক্ত করে ফেলবে সেটা শেরাজের ভাবনায়ও ছিল না! তখন তো রাগে হিতাহিত জ্ঞান লোপ পেয়ে বসেছিলো। কেবল একটাই প্রশ্ন মাথার মধ্যে ঘুরছিল মেহুল তার মাকে এত ভয় পায় কেন? কেন মায়ের সমস্ত অন্যায়, অত্যাচার গুলো মুখ বুজে সহ্য করে? কেন প্রতিবাদ করে না? মেহুলের কফি আনার জন্য শেরাজ রেগে যায় নি। বরং এতগুলো বছর ধরে জমে থাকা রাগ, অভিমান আর ব্যথা একসঙ্গে বিস্ফোরিত হয়ে পড়েছিল। যার দরুণ সে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। আর সেই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলার ভুলের খেসারত দিতে হচ্ছে এখন মেহুলকে।
মেহুল ধীর পায়ে এগিয়ে এসে ডাইনিং টেবিলের সামনে দাঁড়ায়। পা টেনে হাঁটার কারণে অস্বস্তি স্পষ্ট, কিন্তু মুখে সে কিছুই প্রকাশ করল না। শাহানা বেগম তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন মেয়েটার দিকে। এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বিরক্তি ভরা কণ্ঠে বিড়বিড় করে বললেন, "ডং দেখলে গা জ্বলে যায়!"
মায়ের বিড়বিড় করে কথা বলাটা শেরাজের কানে গেল। সে চোখ তুলে মায়ের দিকে তাকাল। শাহানা বেগম মুচকি হেসে বললেন, "নে বাবা, তুই খা, এসব দেখতে হবে না তোকে।"
শেরাজ মায়ের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিল, কিন্তু মেহুলের দিকে তার নজর রইল স্থির। আতাউর মির্জা নাতনিকে এভাবে খুঁড়িয়ে হাঁটতে দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন, "পায়ে কী হয়েছে, নানা ভাই?"
মেহুল শেরাজের দিকে তাকাল। শেরাজ তার দিকেই তাকিয়ে ছিল। চোখাচোখি হতেই মেহুল দ্রুত দৃষ্টি সরিয়ে নিল। ইফা সত্যিটা বলে দিতে চেয়েও থেমে যায়। আগে দেখা যাক, মেহুল কী বলে। যদি সে এক কথা বলে আর মেহুল আরেক কথা বলে তাহলে তো দু কথা হয়ে যাবে। এক কথা দু ভাবে বললে তো সমস্যা হয়ে যাবে। তাই মেহুলেই যা বলার বলুক। ইহসান মির্জা চিন্তিত গলায় বললেন।
"পায়ে ব্যথা পেয়েছো কী করে মামা?"
মেহুল চোখের চশমাটা ঠিক করে ঠোঁট ভিজিয়ে শান্ত স্বরে বলল, "ওই… আসলে আমার হাত লেগে ফুলদানিটা পায়ের ওপর পড়ে গিয়েছিল। তখনই কেটে যায়।"
আতাউর মির্জা আফসোসের সুরে বললেন, "ইস! কতটা কেটেছে মনে হয়? সাবধানে চলাফেরা করবে তো নাকি!"
মেহুল হালকা হাসার চেষ্টা করল, "না না তেমন বেশি কাটে নি নানা ভাই অল্প একটু কেটেছে।"
আতাউর মির্জা মাথা নেড়ে বললেন, "আচ্ছা বসো। এরপর থেকে সাবধানে চলাফেরা করবে।"
শেরাজ চুপচাপ তাকিয়ে রইল, একদম স্থির। যেন কিছু একটা ওলট-পালট হচ্ছে তার ভেতরে। মেহুল আস্তে ধীরে চেয়ারে বসে পড়ল। মেহুল চেয়ারে বসতেই শেরাজ মুহূর্তের মধ্যে চেয়ার সরিয়ে উঠে দাঁড়ালো। আকস্মিক এভাবে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখে সকলে অবাক হয়ে তাকায় শেরাজের দিকে। শাহানা বেগম কপাল কুঁচকে প্রশ্ন করলেন, "কী হলো, দাঁড়িয়ে পড়লি কেন?"
শেরাজ কয়েক সেকেন্ড নীরব থাকলো, তারপর গম্ভীর কণ্ঠে বলল, "খাবো না আর।"
বলেই হনহনিয়ে সিঁড়ির দিকে চলে গেলো। শাহানা বেগম আগুনঝরা চোখে তাকালেন মেহুলের দিকে। একটু আগেও ছেলে শান্তভাবে খাচ্ছিল কিন্তু এই মেয়েটা আসতে না আসতেই ছেলে রেগে-মেগে উঠে চলে গেছে!
মেহুল ঠোঁট কামড়ে মাথা নিচু করে বসে আছে। নাকের পাঁটা ফুলে উঠছে বার বার। শেরাজ ভাই কি তার জন্য না খেয়ে চলে গেছে? হয়তো তার জন্যই চলে গেছে। কারণ সে চেয়ারে বসতেই শেরাজ বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। এতো ঘৃণা করে তাকে শেরাজ ভাই এতো ঘৃণা?
শেরাজ নিজের রুমে এসে ঢুকলো। চোয়াল তার শক্ত, রাগে তার মাথার রক্ত টগবগ করছে ফুটন্ত লাভার মতো। কপালের নীল রগটা দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে অতিরিক্ত রাগের কারণে। মেহুল মিথ্যা বললো কেন? কেন মিথ্যা বলল? তার দ্বারা যে এমনটা হয়েছে সেটা বলল না কেন দাদাভাইকে? কেন আড়ালে রেখে দিলো কথাটা? কেন? শেরাজ নিজের চুল খামচে ধরে শক্ত করে। নিজেকে কেমন জানি পাগল পাগল লাগছে। ঘরের এ মাথা থেকে ও মাথা পায়চারি করছে পাগলের মতো। দাঁতে দাঁত পিষে যাচ্ছে সমানতালে। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে আর বিড়বিড় করে কিছু একটা বলছে উন্মাদের মতো।
"মিথ্যা কথা বলল কেন ও হু? মিথ্যা কথা বলল কেন? আমি কি দাদা ভাইকে ভয় পাই নাকি যে দাদা ভাইকে এই কথাটা বললে আমি দাদা ভাইয়ের ভয়ে গুটিয়ে যাবো। আমি শেরাজ মির্জা কাউকে ভয় পাই কাউকে না। তোকে এর জবাব দিতে হবে মেহুল কেন তুই মিথ্যা কথা বললি কেন বললি?"
শেরাজ বেডে এসে বসলো। তার পা দুটো অনবরত নেচে যাচ্ছে। যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি তাকে ইশারা করে ডাকছে। চোখ-মুখ কেমন জানি অদ্ভুত হয়ে উঠেছে। শেরাজকে এই মুহূর্তে কেউ দেখলে আঁতকে উঠবে হয়তো। শরীরের ভেতর কী যেন চাহিদা অনুভব করছে। কিছু একটা চাইছে, খুব করে চাইছে। কিন্তু শেরাজ এটা নিতে চায় না। নিজের অনিয়ন্ত্রিত মনকে বার বার বুঝ দিয়ে যাচ্ছে, “নিস না শেরাজ, এই জিনিস নিস না আর শরীরের ভেতর। তুই নিজেকে নিজে কথা দিয়েছিস কথার বরখেলাপ করিস না।” কিন্তু শত চেষ্টা করেও পারছে না নিজেকে কন্ট্রোল করতে। তার সব চেষ্টা ব্যর্থ হচ্ছে ধীরে ধীরে। শরীরের চাহিদা আরো তীব্র থেকে তীব্র হচ্ছে।
শেরাজ হঠাৎ করে উঠে দাঁড়িয়ে এগিয়ে যায় আলমারির দিকে। আলমারি খুলে একটা কালো ব্যাগ বের করে এনে বেডের ওপর রাখল। তার দু হাতে কাঁপন স্পষ্ট। হাঁটু মুড়ে বসে ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছে। ব্যাগের চেইন খুলে সে কিছু খুঁজতে শুরু করল। অবশেষে কাঙ্ক্ষিত দুটো জিনিস তার হাতের নাগালে চলে এলো। একটি ছোট্ট শিশির বোতল এবং একটি সিরিঞ্জ বের করলো। শেরাজ দ্রুত হাতে সিরিঞ্জের মুখ খুলে শিশিরের নরম জায়গা ভেদ করে তার সূক্ষ্ণ মাথাটা ভেতরে ঢুকিয়ে, তরলটি দ্বারা সিরিঞ্জের ভেতরটা পূর্ণ করল। শেরাজের ঠোঁটে তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠল। একটু সময় নিয়ে, শেরাজ সিরিঞ্জের সূক্ষ্ণ মুখটি নিজের হাতের নরম মাংসে বসিয়ে দিয়ে পুশ করল। চোখ বন্ধ করে সে গভীর শ্বাস ফেলে। তার শরীর ভরে গেল এই তরল পদার্থে, পুরো দেহ যেন এক অদ্ভুত প্রশান্তিতে ভরে উঠলো। হাত থেকে খসে পড়লো সিরিঞ্জটা। শেরাজ মাথাটা হেলিয়ে দেয় বেডের উপর। হাত-পা ফ্লোরে ছড়িয়ে শুয়ে রইলো এভাবে। এবার যেন দেহ, মন, মস্তিষ্ক এই তিনেই এক অদ্ভুত প্রশান্তি প্রশান্তি ফিল পাচ্ছে। সব কিছু মিলিয়ে এক অদ্ভুত শান্তিতে ভেসে যাচ্ছে শেরাজ।
·
·
·
চলবে....................................................................................