মাই মিস্টিরিয়াস প্রিন্স - পর্ব ৪৪ - মৌমিতা মৌ - ধারাবাহিক গল্প


"ডেকেছো আমায়?"

স্যারকে দেখে অনন্যা আশেপাশে চোখ ফিরিয়ে চাদর খুঁজতে লাগলো। আলমারির দরজা খুলে তাড়াহুড়ো করে একটা চাদর বের করলো, তারপর সেটাকে শক্ত করে গায়ে জড়িয়ে নিলো। চাপা শ্বাস ছেড়ে ধীরে ধীরে শান্ত হলো সে। তারপর কৌশিক স্যারের দিকে তাকিয়ে গভীর সন্দেহমিশ্রিত কণ্ঠে বললো,
"আপনি! কী করেছেন আমার সাথে?"

কৌশিক পরিবর্তনহীন মুখভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে, তার হাতে ধরা একটি ছোট্ট বাক্স। সে কিছু না বলে বাক্সটা নিচে নামিয়ে রেখে আস্তে ধাক্কা দিল অনন্যার পায়ের সামনে। তারপর বুকের কাছে হাত ভাঁজ করে নির্বিকার গলায় বললো,

"তোমার জন্য জুতো কিনেছিলাম। সেদিন দেওয়া হয়নি। আজ দিলাম। দেখো, পায়ে লাগে কিনা। আমার প্রেডিকশন ভুল হতে পারে না।"

অনন্যা বিরক্ত গলায় বললো,
"আমি কিছু জিজ্ঞেস করেছি। সেটার উত্তর দিন।"

"কী?"

অনন্যা এবার রাগ চাপতে না পেরে গলায় জোর এনে নিজের পোশাক টেনে বললো,
"আমি এই পোশাক কখন পরলাম?"

কৌশিক ভ্রু কুঁচকে অনন্যাকে মাথা থেকে পা পর্যন্ত নিরীক্ষা করলো। এক মুহূর্ত চুপ করে থাকলো, তারপর হঠাৎ মুখ চেপে ধরে বললো,

"ওয়াও প্রিন্সেস, তুমি কি আমার জন্যই এই ড্রেস পরেছো?"

অনন্যার চোখে বিরক্তি ফুটে উঠেছে। কৌশিক কাছে এগিয়ে গেলো, আলতো করে অনন্যার গাল দুই হাত দিয়ে ধরলো, গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
"খুব ফাস্ট তুমি! বাট আই লাইক ইট! ইফ ইউ ওয়ান্ট..."

অনন্যা জোর করে হাত সরিয়ে দিলো, কৌশিককে দূরে ঠেলে দিয়ে কঠিন গলায় বললো,
"শুনুন, আমি মজা করার মুডে নেই। আপনিই কিছু করেছেন। আমার ড্রেস চেঞ্জ করেছেন?"

কৌশিক কপালে হাত রেখে দীর্ঘশ্বাস ফেললো,

"উমম.. মনে করার চেষ্টা করো। সকালে যে ড্রেস পরেছিলে, সেই ড্রেসের সবচেয়ে নিচের লেয়ারে এইটাই ছিল। আহ! নিজে পরেছো নিজেরই মনে নেই। ড্রেস নিজে খুলেছো নিজেরই মনে নেই। অথচ তোমার শরীরে কোথায় কী কী আছে, কখন কোন পোশাক শরীরে জড়াচ্ছো, আমি ধীরে ধীরে সবটা জেনে যাচ্ছি।"

কৌশিক মুচকি হাসলো। অনন্যা নিঃশ্বাস আটকে আয়নায় ঘুরে তাকালো। প্রতিচ্ছবির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে মনে করার চেষ্টা করলো। কিছুক্ষণ পরে স্পষ্ট করে মনে পড়লো বিষয়টা।

কৌশিক তখনও আয়নায় তাকিয়ে, তার ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি। 

অজ্ঞান হওয়ার বেশ কিছু সময় পর একবার অনন্যার জ্ঞান ফিরেছিল। চোখ খুলতেই কৌশিকের মুখটা দেখতে পেয়েছিল সে। ধোঁয়াটে দৃষ্টিতে বোঝার চেষ্টা করেছিল কী হচ্ছে। ঠোঁট নড়ানোর চেষ্টা করতেই কৌশিক তড়িঘড়ি করে অনন্যার কপালে হাত রাখলো, আঙুলের চাপ একটু বাড়িয়ে বললো,
"শশশ! চুপ করে শুয়ে থাকো।"

অনন্যা বুঝতে পারছিলো না কি করতে চাইছে স্যার। কিন্তু এক মিনিট পার হতেই সে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললো। 
কৌশিক চেয়ার টেনে বিছানার পাশে বসলো। ধীর স্বরে ফিসফিসিয়ে বললো ,
"অনন্যা শিকদার, নাউ ইউ আর ইন মাই কন্ট্রোল!"

অনন্যা মাথা নাড়িয়ে বললো,
"হুম!"

কৌশিক অনন্যার কপাল থেকে হাত সরিয়ে ফেললো।
"উঠে বসো।"

অনন্যা চুপচাপ উঠে বসলো। কৌশিক তার মুখোমুখি বসেছে।
"চোখ খুলে তাকাও আমার দিকে।"

অনন্যা ধীরে ধীরে চোখ খুলে তাকালো। নির্লিপ্ত তার অঙ্গভঙ্গি।
"তুমি কে? নাম কী তোমার?"

"অনন্যা! অনন্যা শিকদার।"

"কোথা থেকে এসেছো তুমি?"

"ধানমন্ডির এক সাধারণ বাড়ি থে~কে!"

"তোমার জন্ম কীভাবে হয়েছিল?"

"বিশেষ ধারণা নেই। মা বলেছিল সামনের কোনো হসপিটালে আমার ডেলিভারি হয়েছিল।"

"কোন হসপিটাল?"

"জানি না।"

কৌশিক কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললো,
"ওকে। তুমি কী প্রিন্সেস আরিসা নেভুনিকা?"

"না!"
অনন্যার নির্লিপ্ত উত্তর।

"তুমি কী প্রিন্সেস আরিসার পাঠানো কোনো দূত?"

"না।"

"তুমি কেনো এসেছিলে আমার কাছে?"

"আমি আসিনি।"

"ওহ হুম। আচ্ছা, তুমি বিয়ের দিন কোনো এক প্রক্রিয়ায় আমাকে তোমার কাছে ডেকেছিলে। রাইট?"

"হুম।"

"সেদিন আমি তোমার ডাকে সাড়া দিয়েছিলাম। তোমার এ বিষয়ে কোনো আইডিয়া আছে? কেনো এমনটা হলো?"

"না।"

"তুমি কেনো ডেকেছিলে সেদিন?"

"নিজেকে বাঁচানোর জন্য।"

কৌশিক উঠে দাঁড়ালো। কিছুক্ষণ চিন্তিত হয়ে ধীর পায়ে সামনে-পিছনে পায়চারি করতে লাগলো। হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়তেই কৌশিকের হাতের মুঠো শক্ত হয়ে এলো। আরিসার রাজবংশে প্রতিটি রাজা, রানী, রাজপুত্র ও রাজকুমারীর শরীরে জন্মগতভাবে রয়্যালিটির চিহ্ন থাকে। সেটাই বলে দেয় কে ভবিষ্যতে কোন আসন গ্রহণ করবে। যদি অনন্যা শিকদার কোনোভাবে প্রিন্সেস আরিসা হয়ে থাকে তাহলে তার শরীরেও এমন চিহ্ন থাকার কথা। আর আরিসার রয়্যালিটির চিহ্ন কৌশিক জানে, চেনে। আরিসার কক্ষের মধ্যে দেখেছিলো সে।

কৌশিক ধীরে ধীরে অনন্যার দিকে এগিয়ে এলো। অনন্যার দেহে পরিহিত উপরের পোশাকটা অর্থাৎ কুইভার খুলে দিতে সাহায্য করলো তাকে। অনন্যার চিবুকে হাত দিয়ে বললো,
"তোমার শরীরের পোশাক খুলতে হবে। আমি একটা বিষয় চেক করতে চাই। হেল্প লাগলে ডাক দিও। "

অনন্যা ধীরে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। কৌশিক নিঃশব্দে দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। কিছুক্ষণ চিন্তা করতে করতে পার হয়ে গেলো। পেছনে তাকিয়ে দেখলো, অনন্যার গায়ে শুধু একটা পাতলা ফ্রক এবং তার ভেতরের পোশাকের সীমাবদ্ধতা।
কৌশিক গভীর দৃষ্টি মেলে তাকালো, তারপর কঠোর কণ্ঠে বললো,
"ইউ ক্যান স্টপ হেয়ার।"

অনন্যা এই পোশাকটা খুলতে গিয়েও থেমে গেলো। হাত নামিয়ে ফেললো। কৌশিক কাছে গিয়ে পিছমুখী ঘুরে বসতে বললো অনন্যা কে। অনন্যা শব্দহীনভাবে নির্দেশ মেনে পিছন ফিরে বসল। কৌশিক তার পিঠের সামনে বসে চুল সরিয়ে দিলো একপাশে। তারপর পোশাকের অংশ ধীরে ধীরে উপরে উঠাতে লাগলো, নিজেকে তৈরি করে নিলো। অনন্যার পিঠে নিচের দিকে রয়্যালিটির চিহ্ন থাকার কথা। হাত বুলিয়ে দেখলো কৌশিক। স্পর্শে কিছুই টের পেলো না। চোখ আরো শাণিত করলো, পর্যবেক্ষণ করলো কিছুক্ষণ। কিন্তু না কিছুই নেই।

তারপর হঠাৎ বিরক্ত হয়ে পেছনে সরে গেলো। ভ্রু কুঁচকে গেলো কৌশিকের। অনন্যা যদি প্রিন্সেস আরিসা হতো, তাহলে এই দেশে কৌশিকের জন্য সময় দ্রুতই ফুরিয়ে যেত। প্রিন্সেস আরিসা এক না একদিন কৌশিকের সামনে অবশ্যই আসবে, কৌশিককে শেষ করে দিতে আসবে। কৌশিকের কাজ তাকে সময়ের পূর্বে খুঁজে বের করা, তার কাজকে প্রতিরোধ করা, ধ্বংস করা আর নিজেকে রক্ষা করা। কিন্তু অনন্যা প্রিন্সেস আরিসা নয়, এটা একদিক দিয়ে কৌশিকের জন্য ভালো হয়েছে। কারণ সজ্ঞানে অনন্যার শরীরে আঘাত করতেও কৌশিকের হাত কাঁপবে।

কৌশিক শ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালো। অনন্যাকে সামনে ঘুরিয়ে কাঁধে হাত রেখে সে বললো,
"তোমার কী মনে হয় তুমি আমার জীবনে কেনো এসেছো?উমম.. আমাকে মেরে ফেলার জন্য? "

অনন্যার চোখের পলক পড়ল ধীরগতিতে। একদম নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে উত্তর দিলো,
"আপনার অন্ধকার জীবনে আলো ধরিয়ে দেওয়ার জন্য।"

কৌশিক বেশ কিছু সময় অপলক তাকিয়ে রইল। হৃৎপিণ্ডে একটা ছোট্ট ধাক্কা খেলো সে। তার এক হাত বুকের বাম পাশে গিয়ে ঠেকলো। আচমকা কি হলো সেটা নিজেও বুঝলো না কৌশিক। সে ঠোঁট চেপে শক্ত করে বলল,
"তাহলে এত নিখুঁতভাবে তীরন্দাজি করলে কীভাবে?"

অনন্যা নির্লিপ্তভাবেই উত্তর দিলো,
"জানি না।"

এইবার কৌশিকের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেলো। এতো গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, যার উত্তর ওর সবচেয়ে বেশি দরকার সেখানেই অনন্যার নির্বিকার উত্তর জানি না?

চোয়াল শক্ত করে, দাঁতে দাঁত চেপে রাগ সামলানোর চেষ্টা করল কৌশিক। কিন্তু পারল না। হঠাৎ চিৎকার করে দরজা ঠেলে বাইরে বেরিয়ে গেলো সে।

"কিন্তু আমি নিজের পোশাক পরিবর্তন করেছি? এরকম কিছু মনে পড়ছে না কেনো?"
অনন্যার কথায় কৌশিকের সম্বিত ফিরলো। কৌশিক অনন্যাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে মাথায় হাত রেখে বললো,
"কিছু কিছু স্মৃতি এমন থাকে যা তোমার সাথে ঘটেছে কিন্তু সময়ের ব্যবধানে মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট স্থানে আটকে পড়ে গেছে। যেগুলো মনে করার চেষ্টা করলেও মনে করা যায় না। এ ধরনের মেমোরিকে বলা হয় সাবকনশাস মেমোরি বা অবচেতন স্মৃতি। হয়তো তোমার সাথেও এমনটা হয়েছে। তুমি হয়তো ঘোরের মধ্যে কাজটা করেছো তাই তোমার মনে পড়ছে না।"

অনন্যা নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। কৌশিকের কণ্ঠে প্রশ্ন, "কোথাও যাবে শুনলাম? কোথায়?"

এই শব্দগুলো শোনামাত্র অনন্যার মনে হঠাৎ করে নোহারার কথা চলে আসলো। সে দৃষ্টি স্থির করে মাথায় হাত দিয়ে তাড়াতাড়ি ছুটোছুটি শুরু করে দিলো। কৌশিক স্যারকে রুম থেকে জোর করে বের করে দিলো। তাড়াতাড়ি কোনো রকম রেডি হয়ে বাইরে বের হলো সে। 
কৌশিক নিজের রুম থেকে বেরিয়ে অনন্যাকে দেখে একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। সানগ্লাস চোখে, ঠোঁটে ডার্ক লাল লিপস্টিক, মুখে হালকা কোনোরকম মেকআপ এবং ফুল হাতা সালোয়ার কামিজে অনন্যা একেবারে বদলে গেছে।

কৌশিক কিছুক্ষণ তাকে পরখ করে নিলো, তারপর ঠাণ্ডা গলায় বললো,
"আমিও রেডি। চলো, পৌঁছে দিয়ে আসি।"

অনন্যা কৌশিককে থামিয়ে দিলো, 
"না না। দরকার নেই। আপনি বাসায় থাকুন। আর আপনার ক্লাস নেই? ক্লাসে যান। আমি ঠিক চলে যাবো। মামার বাসায় যাচ্ছি। যেই এলাকায় থাকি, সেখানে কেউ গাড়ি নিয়ে আসলেই সবাই দরজা খুলে দাঁড়িয়ে থাকে। আর আপনি যদি যান, তাহলে কী অবস্থা হবে চিন্তা করেন।"

কৌশিক কয়েক পল তাকিয়ে থাকলো, তারপর বললো, "তুমি একা কীভাবে যাবে? তামংও তো নেই। রিকশা নিতে হলে অনেক দূর হাঁটতে হবে।"

অনন্যা ঠাণ্ডা গলায় হালকা হাসি দিয়ে বললো, "আপনার সাইকেল বের করেন, স্যার। সেটা দিয়েই যাই।"

অনন্যা তাড়াহুড়ো করে নিচে নামতে লাগলো। কৌশিক তার পিছু পিছু আসতে আসতে বললো, "কিন্তু তুমি ঠিকমতো চালাতে পারো না। হাইওয়ে তে অনেক জোরে গাড়ি চালায়। এক্সিডেন্ট হলে...!"

অনন্যা পা থামিয়ে ফেললো। সিঁড়ির নিচে দাঁড়িয়ে সে ঘুরে উপরে সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে থাকা স্যারের দিকে তাকালো। আচমকা গভীর স্বরে বলে উঠলো, "আমাকে বিশ্বাস করেন?"

"না!" কৌশিকের নির্লিপ্ত উত্তর।

অনন্যা হেসে ফেললো। চোখে মুখে হাসি নিয়ে বললো,
"তাহলে আসুন। আমার পিছনে ঘুরুন। কিন্তু সাবধান! আমাদের এলাকায় যেতে পারবেন না।"

অনন্যা চলে গেলো। গার্ডদের সাহায্যে গ্যারেজ থেকে সাইকেল বের করলো। তারপর সজাগ মনোযোগ দিয়ে নেমে গেলো রাস্তায়। কৌশিক চুপচাপ বসে ছিল, প্রথমে ভাবছিল আর বের হবে না। কিন্তু অনন্যার চিন্তা তার মনকে জ্বালিয়ে উঠলো, কেমন যেন এক অস্বস্তি লাগছিল। তাই দশ মিনিট পর সে বাসা থেকে বের হয়ে গেলো।

অনন্যা কোথায় গেছে, তা খুঁজে পেতে খুব বেশি সময় লাগলো না। কারণ মেয়েটা খুবই সতর্কভাবে ধীরে ধীরে সাইকেল চালাচ্ছিল। সোজা সড়কে প্যাডেল চালাচ্ছিল, চোখে তাড়াহুড়ো ছিল, কিন্তু তাও সময় নিয়ে চেষ্টা করছিল। দুই দিনেই অনন্যার চালানো অনেকটা উন্নতি হয়েছে, এখন বেশ ভালোভাবেই সাইকেল চালাচ্ছিল।
অনন্যার সাইকেল ওর মামার বাড়ির গলিতে পৌঁছুতেই কৌশিক আর সামনে গেলো না।

******

দুপুরের রোদ জানালার ফাঁক গলে ঘরে পড়ছে। নোহারা চুপচাপ বসে চারপাশটা নিরীক্ষণ করছে। কাঠের কারুকাজ করা টেবিলের উপর দুটো খালি চায়ের কাপ, সে ই বসে থেকে সবটা শেষ করেছে।

ঘরের ভেতর নিস্তব্ধ পরিবেশ। শুধু ঘড়ির কাঁটার মৃদু শব্দ শোনা যাচ্ছে। অনন্যার মামী গোসলে গেছে, কাজের মেয়েটা দরজা খুলে দিয়ে গেছে, একটু পর জিজ্ঞেস করে চা দিয়ে চলে গেছে নিজের কাজে। নোহারা একবার জানালার বাইরে তাকালো, তারপর আবার চোখ ফিরিয়ে আনলো।অপেক্ষা করতে করতে নোহারার ধৈর্য্য ফুরিয়ে আসছে। মনে হচ্ছে, এইভাবেই বসে থাকলে সে বুড়ো হয়ে যাবে।

কিছুক্ষণ পর অনন্যার মামী বসার ঘরে আসলো। বিপরীত পাশের সোফায় বসে বললো,
"এই মেয়েটা বিয়ের পর এতো ফাজিল হয়েছে। মনে হয় না আসবে। আমাদের ফোন ই তো ধরে না।"

"অনন্যা বিয়ে করেছে?"
নোহারা যেন আকাশ থেকে পড়লো। অনন্যার মামী চমকে উঠলো। সে বললো,
"কেনো? তুমি জানতে না? ওই মেয়েটা না সব তোমায় বলে?"

"কাকে বিয়ে করেছে? ওর জামাইয়ের নাম কী?"

অনন্যার মামী মনে করার চেষ্টা করলো। নোহারা হাসার ভঙ্গি নিয়ে তাকিয়ে থাকলো উনার দিকে। নোহারার ধীরে ধীরে মনে পড়তে লাগলো, অনন্যা অনেক দিন ধরে তাকে বাসায় আসার জন্য মানা করছিল। বাসায় আসার কথা বললেই না করে দিত। তারপর আরণ্যক ভাইয়াকেও বললো ও বিবাহিত। তার মানে অনন্যা সত্যি বিবাহিত! নোহারা মুখ খুলে কিছু বলবে তখনি অনন্যা হাজির। ঘরে প্রবেশ করে অনন্যা প্রচন্ড পরিমাণে হাঁপাতে লাগলো। অনন্যার বেশভূষা দেখে নোহারা প্রথম দফায় চমকে উঠলো। কিন্তু সেসব চিন্তা ত্যাগ করে প্রথমেই প্রশ্ন করে বসলো,
"তুই বিয়ে করেছিস?আর আমাকে বললি না? এজন্যই আমাকে বাসায় আসতে মানা করেছিস?"

অনন্যা বললো,
"শোন, আমি ক্লিয়ার করছি।"

অনন্যার মামী তাকে মাঝপথে থামিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
"অনন্যা, তোর জামাইয়ের নাম কী? আমরা তো কিছুই জানি না।"

অনন্যার মামী হাত নেড়ে উত্তেজিতভাবে আরো বলতে লাগলেন,
"আরে জানো না? বিয়ের দিন কী কাণ্ডটাই না ঘটলো! অনন্যার বিয়ে ঠিক হয়েছিল পাশের বাড়ির সেই ডাক্তার ছেলেটার সঙ্গে। কিন্তু ঠিক যখন বিয়ে হতে যাবে, কোথা থেকে যেন এক বিদেশি এসে হাজির! আমরা ভেবেছিলাম অনন্যার প্রেমিক হবে হয়তোবা। কিন্তু ঈরার কাছ থেকে পরে শুনলাম ওর প্রেমিক আবার অন্য কেউ। বাপরে, এই মেয়ের কতো কাহিনী।

ওই বিদেশি লোক এসে বললো, এই বিয়ে হবে না! তারপর কী হলো, কীভাবে হলো, কেউ কিছুই বুঝে ওঠার আগেই, মুহূর্তের মধ্যে সবকিছু ওলটপালট হয়ে গেল।
চোখের পলকে বিয়ে হয়ে গেল, কিন্তু কার সঙ্গে হলো সেটাই কেউ জানলো না! ছেলেটার নাম কী, কি কাজ করে, কিসের ব্যবসা করে, এসব তো দূরের কথা। ফটোগ্রাফার পর্যন্ত কোনো ছবি তুললো না, ভিডিওও করা হলো না! যেন এক রহস্যময় ঘটনা ঘটলো চোখের সামনে, সবাই অবাক হয়ে ঢাকাই সিনেমার মতো দৃশ্য দেখছিল।

বিয়ের পরও মেয়েটার কোনো খোঁজখবর নেই! বর ওরে গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে গেল, তারপর? কই গেল, কোথায় থাকে, কী করে কিছুই জানা নেই! ফোন দিলেও ধরে না, মাঝে মাঝে শুধু ঈরার কাছ থেকে শোনা যায়, দরকার পড়লে অনন্যা কিছু জিনিসপত্র নিয়ে যায়। আমি তো ভাবতে বসেছি, মেয়েটা কোনো অশরীরীকেই বিয়ে করলো নাকি! অনন্যার জামাই নিয়ে মহল্লাজুড়ে কত কথা যে হচ্ছে! এই নিয়ে বিস্ময়ের শেষ নেই।"

তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে থামলেন, নিজের বলা কথাগুলো নিজেই বিশ্বাস করতে পারছেন না। অনন্যা মাথায় হাত চেপে দাঁড়িয়ে আছে। এদিকে নোহারা রাগী দৃষ্টিতে অনন্যার দিকে তাকিয়ে।

অনন্যা আর সময় নষ্ট না করে নোহারার হাত ধরে রুমে নিয়ে যেতে লাগলো। এদিকে অনন্যার মামী চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দিয়েছে। অনন্যা নোহারাকে নিয়ে নিজের রুমে ঢুকতে ঢুকতে বললো,
"মামী! আস্তে। দেখো তোমার চিৎকারে বিল্ডিংটা না ধ্বসে পড়ে।"

অনন্যার রুমের বিছানায় নোহারা মুখ গোমড়া করে বসে আছে। অনন্যা নোহারার গাল টেনে ধরে বললো,
"বেডি! কথা বল। রাগ ঝাড়! তুই ছাড়া আমার কেউ নাই।"

নোহারা আচমকা চিৎকার করে উঠলো, মনের সব রাগ এই চিৎকারের মাধ্যমে ঝাড়তে চাইলো। অনন্যা সাথে সাথেই কানে আঙুল গুঁজে ফেললো। কিছুক্ষণ পর, নোহারা যখন আর চিৎকার করলো না, তখন অনন্যা আঙুল সরিয়ে ফেললো। 
নোহারা মুখ ফুলিয়ে ঠাণ্ডা গলায় বললো,
"তুই মিথ্যে বলছিস! তোর জামাই আছে। তুই অনেক সুখে আছিস। এজন্যই আমাকে বলতে চাসনি।"

অনন্যা শ্বাস ফেলে বললো,
" আমি ইচ্ছেকৃত তোকে বলতে চাইনি এমন নয়। আমার জীবনের সবচেয়ে বিশ্বস্ত মানুষ তুই। শোন, আমি প্রথমেই তোকে সব খুলে বলতে চেয়েছিলাম কিন্তু যার সাথে বিয়ে হয়েছে ওই লোকটা আমাকে বলতে বারণ করেছে"

"এটা আবার কেমন কথা? তোর জামাই কেন কাউকে বলতে বারণ করবে? তোকে কি আদৌ ইচ্ছেয় বিয়ে করছে সে? টর্চার করে তোকে? করলে বল আমি এক্ষুনি ব্যাটাকে খু/ন করে ফেলবো কথা দিলাম।"

"না না এমন কিছু না। সমস্যা হইছে অন্য জায়গায়।"

"কোন জায়গায়?"
নোহারা ভ্রু কুঞ্চিত করে ফেললো।

"আমার জামাইরে তুই চিনিস।"

"হ্যাঁ?"

অনন্যা মাথা নাড়লো।

"কেডায়? শুনা দেখি!"

অনন্যা মাথা নত করে ঠোঁট কামড়ে ধরলো। কিছু বলার আগে সে নিজেকে প্রস্তুত করে নিচ্ছে। আসার আগে, সে স্যারকে জিজ্ঞেস করেছিল এই বিষয়ে। স্যার তখন বলেছিল, শুধুমাত্র নামটাই জানানো যাবে আর কিছুই নয়।

অনন্যা নোহারার দিকে চোখ তুলে তাকালো। নোহারার হাত চেপে ধরে বললো,
"বল রাগ করবি না?"

"কার কথা বলতে যাচ্ছিস ভাই?"

"বল না।"

নোহারা অনন্যার হাত ছাড়িয়ে বললো,
"তোর উপরে বিশ্বাস নাই। তোকে আমি বেস্ট ফ্রেন্ড থেকে উঠিয়ে দিবো।"

অনন্যা নোহারার গলা জড়িয়ে ধরে বললো,
"প্লিজ প্লিজ প্লিজ প্লিজ প্লিজ! এমন করিস না। তুই ছাড়া আমি কারো সাথে তেমন মিশতে পারি না। এমন করিস না। তুই আমার বোনের থেকেও বেশি। রাগ করলে আমি কীভাবে থাকবো?"

"ঢং ছাড়!"

"নোহা বাবু! প্লিজ রাগ করবি না বল।"

নোহারা অনন্যার হাত ছাড়িয়ে বললো,
"ঠিক আছে যা। পরের বার থেকে যাতে এমন না হয়।"

"হবে না।"
অনন্যা খুশিতে লাফিয়ে উঠলো।

"এখন বল তোর জামাই এর নাম কী?"

অনন্যা ঢোক গিলে বললো,
"কৌশিক স্যার!"

নোহারা কিছুক্ষণ থম মেরে বসে রইল। নিজের কানকে যেন নিজেই বিশ্বাস করতে পারছিল না সে। তারপর হঠাৎ ই চিৎকার করে উঠলো নোহারা। অনন্যা আবারো নিজের কান চেপে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো নোহারার দিকে।

ফিসফিসিয়ে বললো,
"স্যরি!"
.
.
.
চলবে........................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp