মাই মিস্টিরিয়াস প্রিন্স - পর্ব ৫২ - মৌমিতা মৌ - ধারাবাহিক গল্প


বড় টেলিভিশনের পর্দায় এক ভয়ঙ্কর দৃশ্য, রক্তস্নাত বিভীষিকা ঘটছে। চারদিকে আর্তনাদ, ছুটোছুটি আর পেছন থেকে ধেয়ে আসা বিশাল দানবের বিকট গর্জন। সকলের ছায়া ভেসে উঠছে রুমটির পর্দায়। তবুও টেলিভিশন অনড়। কেউ থামাচ্ছে না, কেউ দেখছেও না টেলিভিশন।

টেলিভিশনের বিপরীত দিকের সোফায় নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে কৌশিক। আজ অস্বাভাবিকভাবে তাড়াতাড়ি ফিরেছে সে। অন্য দিন তো অর্ধেক রাত ফুরোলেও ফেরার নাম করতো না, কিন্তু আজ সব কাজ শেষ হয়ে গেছে আগেভাগেই। অনন্যাও বাসায় নেই।

কৌশিকের হাতে ধরা মোবাইল, আঙুলের দ্রুত গতির স্পর্শে স্ক্রিনের বুকে একের পর এক মানুষের মৃ/ত্যু লেখা হচ্ছে। ভিডিও গেমের ভার্চুয়াল দুনিয়ায় সে এক অপ্রতিরোধ্য শিকারি! একটা, দুটো, তিনটে একের পর এক প্রতিপক্ষ ধূলিসাৎ হয়ে যাচ্ছে তার সামনে। রক্ত ছিটকে পড়ছে পর্দায়, আর তার আকাশি চোখের জ্বলজ্বলে ছটায় প্রতিফলিত হচ্ছে সেই নিষ্ঠুরতা। ভার্চুয়াল দুনিয়ায় ও সে নিজেই এক দানব, এক রাক্ষস, যে মাংসের স্বাদ বুঝে নিয়েছে একবার, আর ফিরে তাকাতে চায় না পেছনের জগতে।

সম্পূর্ণ বাড়িটা অন্ধকার, একমাত্র আলোর উৎস টেলিভিশন আর মোবাইল স্ক্রিন। হঠাৎ পর্দায় এক বিকট চিৎকার! এক নারীর আর্তনাদ, দুঃস্বপ্নের গহ্বর থেকে উঠে আসা এক বেদনাদীর্ণ আওয়াজ। মুহূর্তে কৌশিকের আঙুল স্থির হয়ে গেল, তার মুখের হাসিটা জমাট বাঁধলো। এক ঝলকে চোখ তুললো পর্দার দিকে, তারপর আবার স্ক্রিনে মনোযোগ দিলো।

নিক তড়িঘড়ি করে বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। সেই দূর থেকে আসাতে কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে গেছে, শ্বাস দ্রুত চলছে। নিক সাধারণত যানবাহন খুব কম ব্যবহার করে, দেহকে সুন্দর রাখতে হলে রক্তের পাশাপাশি এক্সারসাইজ করাও খুব প্রয়োজন, এটা তাহার ব্যক্তিগত মতামত। একবার, দু বার কয়েকবার কলিং বেল বাজাল নিক। কিন্তু ভেতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেলো না। অপেক্ষা করতে করতে অধৈর্য হয়ে উঠল সে।

বাধ্য হয়েই গার্ডের কাছ থেকে চাবি নিয়ে দরজা খুলল। দরজার কব্জা ধীরে ধীরে কড়কড় শব্দে খুলে গেল। নিক ও নিঃশব্দে ভেতরে প্রবেশ করল।

চোখের সামনে নিস্তব্ধ ঘর ধরা দিলো। শুধু বসার রুম থেকে টেলিভিশনের শব্দ আসছে। ধারণা করলো, সেখানে হয়তো কেউ আছে। সাধারণত পেটের টান আর নতুন মুভি দেখার টান না পড়লে রাতের দিকে নিক বাসায় ফেরা পড়ে না। হ্যাঁ, সে মুভি পাগল। একবার তো নোহারার মার খেয়ে সারারাত বসে কষ্টের মুভি দেখেছে আর রুমে টিস্যুর গঙ্গা বহিয়ে দিয়েছে। 

হাতের ফোন ধরে, পা টিপে টিপে এগিয়ে গেল নিক। আধো অন্ধকার ঘরে টেলিভিশনের পর্দায় রক্তাক্ত দৃশ্য ভেসে উঠছে, আলো-আঁধারিতে তার প্রতিচ্ছবি খেলা হচ্ছে মেঝেতে। সোফায় বসে থাকা কৌশিকের চোখ এখনো ফোনের স্ক্রিনে আটকে। দেখে মনে হচ্ছে সে টেলিভিশনের ভয়ংকর দৃশ্যের চেয়েও ভীতিকর।

নিক একপা এগিয়ে এসে ঠাণ্ডা কণ্ঠে বলল,
"ওহ হুম! তোমার প্রিয় বউ মনে হয় তোমাকে ছেড়ে দিয়ে আমাকে পছন্দ করা শুরু করেছে। নাহলে এতবার ফোনকল করছে কেন? মেসেজ ও দিয়েছে। কি লেখেছে দেখি তো!"

কৌশিকের ভ্রু কুঁচকে গেল। চোখ না তুলেই গেমের চরিত্রটাকে আরও একবার শত্রুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে দিলো, তারপর ঠাণ্ডা স্বরে বলল,
"কি হয়েছে? কি বলেছে?"

নিক এবার হাঁটতে হাঁটতে সোফার দিকে এগিয়ে গেলো। কৌশিকের পাশে সোফার হাতলে বসে পড়লো, পায়ের ওপর পা তুলে উপভোগ্য ভঙ্গিতে কৌশিকের দিকে তাকালো।

"কিছু একটা হয়েছে, আর তুমিই জানো না? অবাক লাগছে! তোমার মতো ছায়ার মতো পিছু নেওয়া মানুষটা নিজের বউয়ের খোঁজ রাখছে না? ফোন ধরো না কেন?"

কৌশিক এবার ফোন নামিয়ে রাখলো। ফোনের স্ক্রিনে Game Over ভেসে উঠলো। কললিস্টে যাওয়ার জন্য সে হাত বাড়াতেই নিক ঠোঁটে বিদ্রুপের হাসি টেনে বলল,
"তোমার জন্য এতো দূর দৌড়ে আসতে হয়েছে। নাউ গিভ মি সাম মানি, ডিয়ার।"

কৌশিক বিরক্ত ভঙ্গিতে নিকের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে কিছু না বলে মানিব্যাগ বের করে নিকের হাতে দিলো। আর এর পরিবর্তে নিকের ফোনটা ছিনিয়ে নিল।নিক কিছু বলতে যাবে, কিন্তু কৌশিক ততক্ষণে এক হাতে অনন্যার পাঠানো মেসেজ খুলে পড়ছে, আর অন্য হাতে নিজের ফোনে সরাসরি মেয়েটাকে কল দিচ্ছে।

অনন্যা ফোন ধরতে বেশি সময় নিলো না। কৌশিক কানে ফোন তুলতেই ওপাশ থেকে ভেসে এল এক পরিচিত ডাক,
"প্রিন্স!"

কৌশিক চুপচাপ শুনতে থাকল, কোনো প্রতিক্রিয়া জানালো না। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে অনন্যা আবার বলল,
"আপনি একটা ফাজিল ইঁদুর!"

কৌশিক ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, 
"কাঁদছো কেন?"

ওপাশ থেকে অনন্যার শ্বাস ভারী হয়ে কানে ঠেকলো। নাক টানার শব্দ শোনা যাচ্ছে। কিছুক্ষণ নিঃশব্দে থাকার পর অনন্যা বলল, 
"আমি আসলে কিছু বুঝতে পারছি না।"

"কি বুঝতে পারছ না?"

অনন্যা অনেকক্ষণ নিশ্চুপ রইলো। দুপুরের কথাগুলো একের পর এক মাথার ভেতর ঘুরপাক খেতে লাগলো। 
কৌশিক অপেক্ষা করলো, কিন্তু অনন্যার কোনো সাড়া শব্দ পেলো না। তাই আবারও বলল, 
"কে কী বললো?"

অনন্যা গভীর শ্বাস নিয়ে ধীর গলায় বলল, 
"মা আর ভাই এসেছে। বলছে আমাকে নিয়ে যেতে চায়।"

"এখনই?"

"না, এখন না। এক দুই মাসের মধ্যে সব ব্যবস্থা করবে, তারপর নিয়ে যাবে আমাকে।"

কৌশিকের যথেষ্ট স্বাভাবিক গলায় কথা বলছে। 
"হঠাৎ এমন ডিসিশন?"

"কারণ বলেছে আমাকে!"

"তুমি যেতে চাও?"

অনন্যা কিছু বললো না, কিন্তু দুই পক্ষের নীরবতার মাঝেও কৌশিক শুনতে পেলো অনন্যা রাশভারী শ্বাস, মাঝে মাঝে আটকে আসা নাক টানার শব্দ।

কৌশিক চোখ বন্ধ করলো এক মুহূর্তের জন্য। তারপর নিঃশব্দে ফোনটা নামিয়ে কল কেটে দিলো। ধীর পায়ে উঠে দাঁড়ালো, ঠান্ডা মুখে বসার ঘর পেরিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেলো।

নিক দ্রুত উঠে আসলো। কৌশিকের পিছু পিছু হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করলো,
"কোথায় যাচ্ছো, ব্রো?"

"ঘুমাতে!"
কৌশিকের নির্লিপ্ত উত্তর।

নিক ভ্রু কুঁচকে তাকালো কৌশিকের দিকে। সন্দেহের হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে বললো,
"তাহলে বাইরের দরজার দিকে হাঁটছো কেনো?"

কৌশিক থমকে দাঁড়ালো, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নিকের দিকে তাকালো। তারপর নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে ঘুরে সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালো। গলা ভারী করে বললো,
"আমি ঘুমাই না। তারপরও ঘুমাতে যাচ্ছি।"

নিক একপাশে হেলান দিয়ে কৌশিকের চলে যাওয়া দেখলো, ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি টেনে বললো,
"হ্যাঁ হ্যাঁ, যাও। বিশ্বাস করলাম!"

*******

অনন্যার রাগে শরীর কাঁপছে। ইচ্ছে করছে ফোনটা আছাড় মেরে টুকরো টুকরো করে ফেলতে। কিন্তু তা না করে দাঁত কিঁচিয়ে চেয়ারে গা এলিয়ে দিলো। লোকটার সাহস কত বড় ফোন কেটে দেয়? সামনে পেলে নির্ঘাত একটা কামড় বসিয়ে দিত।

ঘরের ভেতর অস্বস্তিকর নীরবতা। মাঝে মাঝে ঘড়ির কাঁটার শব্দ শোনা যাচ্ছে। সামনের বিছানায় অনন্যার মা গভীর ঘুমে, নাক ডাকার মৃদু শব্দ ভাসছে বাতাসে। অথচ অনন্যার চোখে এক ফোঁটা ঘুম নেই। 

দুপুরে যখন জানতে পারলো, সে আসলে এই বাড়ির মেয়ে নয় একটা অদ্ভুত শূন্যতা গ্রাস করলো তাকে। প্রথমে সব মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছিল। তারপর ধীরে ধীরে কথাগুলো শরীরের রক্তের সঙ্গে মিশতে শুরু করলো। নিজের জন্য খারাপ লেগেছিল, কিন্তু তার চেয়েও বেশি কষ্ট পেয়েছিল মায়ের কথা শুনে।

মায়ের চোখেমুখেও তখন একরাশ বেদনা খেলা করছিল। অনন্যা যখন প্রশ্ন করলো,
"আর তোমাদের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে খুব খারাপ কিছু হয়েছে। কি হয়েছে আসলে?"

পল্লবী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে শুরু করলেন সেই অতীতের গল্প।

অনন্যাকে নিয়ে আসার পর পল্লবীকে কম কথা শুনতে হয়নি। সংসারের সবাই বলেছিল, কার না কার বাচ্চা! এভাবে নিয়ে আসা কি ঠিক হলো? কিন্তু পল্লবী কারও কথা শোনেননি। মেয়েটিকে নিজের কাছে রেখেছেন, পরম যত্নে বড় করেছেন। নামও তিনিই দিয়েছেন, অনন্যা। কারণ, অন্যদের চেয়ে আলাদা এই মেয়েটি, শেষ সময়ে যুদ্ধ করে নিজের প্রাণ রক্ষা করেছিল সত্যিই অনন্য সে।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সবাই ভুলে যেতে থাকে যে অনন্যা বাইরের মেয়ে। ঈরার মাও বিষয়টা জানতেন না। অনন্যা আসার পরেই উনার বিয়ে হয়। কয়েক বছর পর যখন অনন্যার ছোট ভাই জন্মায়, তখন বাবার ভালোবাসাও অনন্যার প্রতি দ্বিগুণ হয়ে যায়। বাবার সবচেয়ে আদরের সন্তান হয়ে ওঠে অনন্যা।

তবে সবচেয়ে অদ্ভুত বিষয় হলো অনন্যাকে ঘরে আনার পর থেকেই ওর বাবার ব্যবসা রাতারাতি উন্নতির দিকে যেতে থাকে। ছোট্ট মোবাইলের দোকান বড় হয়, কর্মচারী বাড়ে, আয় রোজগারও দ্বিগুণ হয়ে যায়। জীবনটা হঠাৎ করেই বদলে যেতে শুরু করেছিল। সবকিছু খুব ভালোই চলছিল। কিন্তু একদিন অনন্যার বাবার বন্ধু একটা নতুন সম্ভাবনার কথা জানালেন। তার চাচাতো ভাই কানাডায় মোবাইল ফোনের একটি আউটলেট চালান, যেখানে কাজ করলে ভালো ভবিষ্যৎ গড়া যাবে। বিদেশের সুযোগ শুনে প্রথমে অনন্যার বাবা খুব একটা আগ্রহী ছিলেন না। কিন্তু বন্ধুর প্রতিনিয়ত বোঝানো, ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখানো, আর বারবার বলা কথাগুলো, "তিন চার বছর কষ্ট কর, তারপর ঠিকঠাকমতো সেটল হয়ে যাবি। "
এইসব কথায় আস্তে আস্তে তিনি মত বদলে যেতে থাকে।

শেষমেশ যখন বন্ধুর চাচাতো ভাই বললো, 
"সব ব্যবস্থা আমি করব, শুধু কাগজপত্র ঠিক করে দিলেই হবে।" 
তখন অনন্যার বাবা রাজি হয়ে যান।

কাগজপত্র সব প্রস্তুত, সমস্ত কিছু ঠিকঠাক হলো, একের পর এক ধাপে ধাপে সব এগোতে লাগলো। কিন্তু যেদিন ফাইনাল প্রসেসিংয়ের জন্য সময় এলো, হঠাৎ বন্ধুর চাচাতো ভাই বলে দিলো,
"চারজনকে একসাথে পারবো না, ধরা খাবো। প্রথমে তিনজন যেতে পারবে।"

এখন, যেহেতু অনন্যা বড়। রেখে দিলে, মেয়েটাকেই রাখতে হবে। কিন্তু মেয়েটাকে রেখে যেতে হবে শুনে প্রথমে মন মানতে চাইলো না। অনেক ভাবনা চিন্তার পর, দুইজনেই সিদ্ধান্ত নিলেন,কী করা উচিত? একবার মনে হলো, সবকিছু বাদ দিয়ে না যাওয়াই ভালো। কিন্তু পরে ভাবলেন, ছেলে-মেয়েকে তো কিছু জানানোই হয়নি। তাছাড়া, এখন ফিরে যাওয়াতে কোনো লাভ নেই। এরকম সুযোগ বারবার আসেনা। বন্ধুর কথায় অবশেষে তাঁরা সায় দিলেন।

বন্ধু বললেন, "যেকোনো একজনকে এখানে রেখে যা, পরে আস্তে আস্তে নিয়ে আসবি।"

এই বুদ্ধিটাও খারাপ লাগেনি অনন্যার বাবার, তাই তিনি রাজি হয়ে গেলেন। 

তড়িঘড়ি করে যাওয়ার পর প্রথমে সব ঠিকঠাকই চলছিল। কাজ শুরু হলো, আয়ও হচ্ছিল। কিন্তু তিন বছর পর একটা বড় ঝামেলা বাধলো।

একদিন হঠাৎ পুলিশ এসে আউটলেটে তল্লাশি চালায়। অভিযোগ, চোরাচালানের সামগ্রী রাখা হয়েছে সেখানে। অনন্যার বাবা তো এসবের কিছুই জানতেন না। তার কাছে সবকিছুই স্বাভাবিক ব্যবসা ছিল।

কিন্তু তদন্তে উঠে এলো, চাচাতো ভাই এবং তার পার্টনারদের অনেক আগের থেকেই অবৈধ ব্যবসার সাথে সংশ্লিষ্টতা ছিল। অনন্যার বাবার নামে কাগজপত্র থাকায় তাকেও জড়িয়ে ফেলা হলো। পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে গেল।

এরপর শুরু হলো আসল বিপদ। তার বন্ধু, যে এত বড় বড় কথা বলেছিল, একবারও খোঁজ নেয়নি। উল্টো কানাডায় গিয়ে চাচাতো ভাইও নিজের হাত ধুয়ে ফেললো, বললো,
"আমার কিছু জানা নেই, আমি তো শুধু সুযোগ করে দিয়েছিলাম।"

এদিকে, পুলিশের তদন্ত আরও গভীর হলে, চাচাতো ভাইয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে। তাঁকে আটক করা হয় এবং অভিযুক্ত করা হয় চোরাচালান এবং অবৈধ ব্যবসার সাথে সংশ্লিষ্টতার জন্য।

অনন্যার বাবাকে ছাড়াতে প্রচুর টাকা খরচ করতে হলো। সব জমানো টাকা শেষ, ঋণের বোঝা চেপে বসলো। অনেক মানসিক চাপ, হতাশা, ধোঁকাবাজির শিকার হওয়ার কষ্ট সব মিলিয়ে শেষমেশ তিনি স্ট্রোক করলেন।
এখন আপাতত ভালো আছেন, বাসায় থাকছেন। কিন্তু ওষুধ ছাড়া চলতে পারেন না। ওদিকের যা অবস্থা, কেউই ঠিকমতো চলতে পারছেন না। কানাডায় পল্লবীর দূর সম্পর্কের আত্মীয় থাকে, সেই বাসায়ই এতদিন আশ্রয় নিয়েছেন। সারাদিন হাসপাতালের চক্কর, ডাক্তারদের পরামর্শ, টাকার চিন্তা। সব মিলিয়ে এক দুঃস্বপ্নের জীবন কাটছে। এর মধ্যে অনন্যার ভাইয়ের পড়াশোনার অবস্থা একেবারে যাচ্ছেতাই হয়ে গেছে। এজন্য পল্লবীকেও কাজে নামতে হয়েছিল। অনেক কষ্টে টাকা জোগাড় করে অনন্যার মা ভাই বাংলাদেশে পা রেখেছেন।

এতো কথা শোনার পর অনন্যা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে প্রশ্ন করল,
"আমি গেলে তো আরো বাড়তি ঝামেলা হবে?"

পল্লবী গভীর শ্বাস ফেলে বললেন,
"হ্যাঁ, ঝামেলা হবে। কিন্তু তুই থাকলে সব ঠিক হয়ে যাবে। তোকে রেখে চলে গিয়েছি বলেই এত বিপদ পোহাতে হলো। যখন তুই ছিলি, তখন আমাদের জীবনটা অনেক সুন্দর ছিল। আমরা দুজনেই বিশ্বাস করি, তোর কাছ থেকে দূরে চলে যাওয়াটাই আমাদের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল।"

কয়েক সেকেন্ড নিশ্চুপ থেকে অনন্যা বলল,
"তাহলে তোমরা ফিরে আসো। এখানেই সব নতুন করে শুরু করবো। আমি আছি, আমি তোমাদের সাহায্য করবো।"

পল্লবী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
"এসব নিয়ে আমরা অনেক ভেবেছি। কিন্তু মান-সম্মানের একটা ব্যাপার আছে। তার ওপর তোর বাবার বয়স হয়েছে, তাও চাকরি করছে। কিন্তু এই বয়সে ভালো কাজ কে দেবে বল? আর আমরা তো টাকাও পাঠাতে পারছি না। অনেক মাস ধরেই টাকা পাঠানো বন্ধ হয়ে গেছে। তোর এমনিতেও পড়াশোনা বন্ধ করে দিতে হবে। আর আমাদের এই অবস্থায় রেখে এখানে তোকে পড়তে দেখলে সবাই বলবে, আমরা বুড়ো হয়েও খেটে মরছি, আর তুই শুধু বই মুখে দিয়ে বসে আছিস।"

"তাহলে ওখানে গেলেও তো আমার পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাবে।" 
অনন্যার গলা শুষ্ক হয়ে এলো।

পল্লবী ধীরে ধীরে বললেন,
"ওখানে তোর মতো বাঙালি মেয়েরা এত পড়াশোনা করে না। সবাই চাকরি করে, সংসার সামলায়। তুইও কোনো কাজ খুঁজে ঢুকে যাবি, আমাদের সাহায্য করবি। আমরা তো ভুল করেছিলাম, কিন্তু মানুষ ভুল থেকেই শেখে, তাই না? তাছাড়া তোর হাসবেন্ড আছে সে তো দিবেই। আর না দিলেও সমস্যা নেই। আমরা সবাই মিলে কিছু না কিছু করে ফেলবো। ঠিক আছে? যেহেতু অনিচ্ছায় বিয়ে হয়েছে ছেঁড়ে দে।‌ এক মাস হয়েছে মাত্র। ছাড়তে আর কী?"

একটু থেমে পল্লবী কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন,
"অনন্যা! আমরা প্রথম থেকে আবার সব শুরু করব। আমি জানি, তুই এখনো আমাদের সাথে থাকতে চাস। এখনো আমাদের মিস করিস, তাই না? সত্যি করে বল।"

অনন্যার দমবন্ধ লাগছিল। সে বুঝতে পারছিল না, এটা মমতা, নাকি অন্য কিছু। দ্বিধায় পড়ে গেলো।

কিন্তু এক মুহূর্ত পরেই আরেকটা ভাবনা তার মাথায় এলো, ছোট থেকে যে পরিবার তাকে সন্তানের পরিচয় দিয়ে তাকে আগলে রেখেছে, ভালোবাসায় বড় করেছে, তারা এখনো কষ্টে আছে। এই বিষয়টা ওকে সবচেয়ে বেশি নাড়া দিচ্ছিল।সে কি নিজের সুখের কথা ভাববে, নাকি পরিবারের দুঃখ ঘোচানোর চেষ্টা করবে?

মায়ের কথাগুলো মাথায় ঘুরছিল,
এক মাস হয়েছে মাত্র। ছাড়তে আর কি?

মায়ের কাছে হয়তো এটা খুব স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। কিন্তু অনন্যার কাছে? অনন্যা বিয়ে করেছে একজনকে। তাকে নিজের স্বামীর স্থানে বসিয়ে ফেলেছে। মনে অফুরন্ত জায়গা দখল করে বসে আছে লোকটা। তার রহস্যময় কীর্তিকলাপ অনন্যার জীবনের একটা অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই এক মাসের প্রতিটা দিন জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে তার। এই সময়ের মধ্যেই কত কিছু হয়ে গেছে!

কৌশিক স্যার! তার অদ্ভুত আচরণ, কখনো বিরক্তিকর, কখনো উদাসীন, আবার কখনো এমন কিছু, যা ব্যাখ্যা করা কঠিন। প্রথমে বিরক্ত লাগত, রাগ হতো, রহস্য রহস্য খেলা করতো, প্রশ্ন জাগাতো এখনো তো জাগায়। তবে তার পাশাপাশি অনন্যার মন ও ধীরে ধীরে তার দিকে ঝুঁকে গেছে। কিন্তু এসব মাকে বোঝানো সম্ভব? মা তো জানেও না, এই এক মাসের ভেতর তার জীবন কীভাবে বদলে গেছে।

মনের মধ্যে হাজারো প্রশ্ন, চিন্তার পাহাড়! সে কি সত্যিই সব ফেলে রেখে চলে যাবে? না কি থেকে যাবে?
.
.
.
চলবে........................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp