সোনালি আলোয় ঝলমল করছে পুরো বাগান। নানা রঙের ফুলে ছেয়ে গেছে চারপাশ। রক্তিম গোলাপ, শুভ্র বেলি, বেগুনি জবা, নীল অপরাজিতা, হলুদ গাঁদা আরো কত কি! প্রকৃতি নিজ হাতে রঙের তুলিতে এঁকেছে এক মোহময় ছবি। বাতাসের আনমনে হাওয়ায় মিশে গেছে মিষ্টি ফুলের সুবাস। ফুলের সুবাস ছোঁয়া মন ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়। দূর পাখিরা আপন মনে গান গাইছে, কিছু দূরে কোথাও মৃদু জলপ্রপাতের শব্দ শোনা যাচ্ছে।
সূর্যটা আজ আরও বড়, আরও উজ্জ্বল হয়ে উদিত হয়েছে। দীপ্তিতে চারপাশ স্নিগ্ধ হয়ে উঠেছে। গাছের পাতায় আলো পড়ে ছোট ছোট হীরার টুকরো জ্বলছে। বাগানের সরু পথের ধারে দাঁড়িয়ে আছে এক তরুণী। সূর্যের আলো ঠিকরে পড়ছে তার গায়ে, এতটাই যে মুখমণ্ডল দৃশ্যমান নয়, শুধু এক রহস্যময় সৌন্দর্যের আভাস পাওয়া যায়।
লম্বা, কোমর ছুঁই ছুঁই কালো চুলের বেণী করা হয়েছে পরিপাটি করে। সেই বেণীর ভাঁজে ভাঁজে ছোট ছোট সাদা ফুল গেঁথে রাখা। প্রকৃতি নিজ হাতে সাজিয়েছে তাকে। মাথার ওপর উঁচু করে বাঁধা চূড়া। সেই চূড়াতে হালকা সোনালি ঝিলিক চোখে লাগার মত। গলায় পরিহিত এক অপূর্ব নেকলেস। ঝরনার ফোঁটার মতো চিকচিক করছে মুক্তোগুলো।
তরুণীর নরম হাতের মাঝে ধরা তিনটি শ্বেত গোলাপ। ফুলগুলোর পাপড়িতে ভোরের শিশির এখনো জমে আছে, একটুখানি আলো পড়তেই তারা মুক্তোর মতো ঝলমল করে উঠল। তরুণী নাকের কাছে নিয়ে ফুলের সুবাস নিলো, অল্প হাসলো। তরুণীর পরনে নীলচে রুপালি গাউন। হালকা বাতাসে কাঁধের ওড়নাটা কিছু সময় পর পর দুলে উঠছে, উড়ে যেতে চাইছে।
তরুণীর কিছু সামনে পা ভাঁজ করে মাঝ রাস্তায় বসে আছে এক কমবয়সী তরুণ, বয়সে তরুণীর থেকে কিছুটা ছোট। তরুণটির পরনে গাঢ় সবুজের সমারোহে প্রাচীন কালের ভারী পুরোনো পোশাক। মাথা নত করে রেখেছে সে। তার কেশ কিছুটা লম্বা। পেছন থেকে নেমে আসা কিছু সরু হয়ে আসা চুল ঘাড় ছুঁই ছুঁই করছে।
তরুণী উচ্চারণ করলো,
"আমার শ্বেত গোলাপ পছন্দ এটা তুমি কীভাবে জানলে, রেন (ছেলে)?"
তরুণটি মাথা নিচু করেই শান্ত স্বরে বলল,
"আপনাকে কয়েক দিন ধরে পর্যবেক্ষণ করেছি, প্রিন্সেস। এর জন্য দুঃখিত।"
তরুণীর কণ্ঠস্বরে কোমলতা, চোখে মায়া জড়ানো,
"তিনটে শ্বেত গোলাপের অর্থ জানো তুমি?"
তরুণ শ্রদ্ধার সঙ্গে বলল,
"জ্বি! শ্বেত গোলাপ বিশুদ্ধতার প্রতীক। আপনি পবিত্র, নির্মল তাই আপনি শুভ্র! খুব দ্রুতই আপনার বিবাহ হবে, বিভিন্ন রাজ্য থেকে আপনার জন্য রাজপুত্ররা আসবেন। তবে তার আগেই আমি আমার মনের কথা জানাতে চাই, আমে তুর আবেন, প্রিন্সেস ( অর্থাৎ আমি আপনাকে ভালোবাসি)। ইহাই তিনটে শ্বেত গোলাপের অর্থ।"
তরুণীর ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি খেলতে দেখা গেল। কিন্তু সেই হাসি মুহূর্তের মধ্যেই মিলিয়ে গেল। শ্বেত গোলাপ তিনটে পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা একটিমাত্র দাসীর হাতে দিয়ে সামনে ফিরলো সে। কিছুটা এগিয়ে নিজের কোমড়ে বেঁধে রাখা তলোয়ারের খোপ থেকে তলোয়ার বের করলো। সূর্যের আলোয় তলোয়ারের ফলক ঝলসে উঠল। কমবয়সী তরুণের গর্দনের সামনে রেখে কঠোর গলায় বললো,
"রেন! তুমি ঘোর অপরাধ করেছো। প্রথমত, তুমি আমার পিছু নিয়েছো। যার শাস্তি একটাই, মৃত্যুদণ্ড। দ্বিতীয়ত, তুমি সাধারণ এক ব্যক্তি হয়ে রাজবংশের রাজকুমারীকে ভালোবাসার দুঃসাহস দেখিয়েছো।"
তরুণী নিখুঁত নিশানায় তলোয়ার তুলে নিল, খুব দ্রুত কৌশলে যখনই গলার কাছে নামিয়ে আনতে যাবে ঠিক তখনই আবার তরুণের কণ্ঠস্বর শোনা গেলো। কিন্তু কিছু শুনতে পেলো না অনন্যা। তার আগেই অনন্যার স্বপ্ন নিঃশেষ হয়ে গেলো, ঘুম ভেঙ্গে গেল তার।
অনন্যা ধড়মড়িয়ে উঠে বসল। শ্বাস দ্রুত হয়ে আসছে, মাথার ভেতর অগোছালো ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছে। কী দেখলো সে? অপরিচিত ভাষা অথচ সব কিছু ঠিকঠাক বুঝতে পারছিলো অনন্যা! বিষয়টা কেমন যেন লাগছিল।
অনন্যা ধীরে ধীরে বিছানা ছেড়ে নেমে এল। এক পা দু পা করে এগিয়ে বাম পাশের আলমারির দরজা খুলল। চোখ সরাসরি গিয়ে আটকালো ফুলদানিতে রাখা তিনটি সাদা গোলাপে।একদিন আগেও যেগুলো ছিল টকটকে লাল অথচ আজ সম্পূর্ণ সাদা? গলায় কী যেন একটা দলা পাকিয়ে উঠলো অনন্যার। তাড়াতাড়ি আলমারির দরজাটা বন্ধ করে পিঠ ঠেকানো আলমারিতে। বুকের ভেতর অজানা আতঙ্ক ছটফট করছে।
বিষয়টা কৌশিক স্যারকে বলা দরকার ছিল। কিন্তু যদি তিনি ভাবেন, অনন্যা ফুলগুলোর যত্ন নেয়নি? যদি ধরে নেন, এটা নিছকই তার ভুলের ফল? কিন্তু স্বপ্নটা? স্বপ্নে সে একটা অল্প বয়সী তরুণকে দেখেছে কিছুটা কৌশিক স্যারের মতো যদিও পুরোপুরি বোঝা যাচ্ছিল না। কেমন আবছা আবছা দেখাচ্ছিলো তাদের মুখখানা। অনন্যার মুষ্টিবদ্ধ হাত একটু একটু করে কেঁপে উঠলো।
******
কৌশিক বাড়ির পেছনের দিকটায় দাঁড়িয়ে আছে, তার চোখ দুটো নিবদ্ধ হয়ে আছে সিকিউরিটি গার্ডের নিষ্প্রাণ দেহটির দিকে। আশপাশে কয়েকজন গার্ড জটলা করে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে কথা বলছে। সকালের বাতাস থমথমে হয়ে আছে, এক আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে সিকিউরিটি গার্ডদের মধ্যে।
কৌশিক ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ করে এক দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর চোখ খুলে গম্ভীর স্বরে বলল,
"ওনার পরিবার থাকলে দ্রুত খবর পাঠাও। আর যদি কেউ না থাকে!"
কিয়ৎক্ষণ চুপ করে সবাইকে পর্যবেক্ষণ করল সে।
"তাহলে বিষয়টা অন্যভাবে সামলাতে হবে।"
নিক ও বাইরে বেরিয়ে এসেছে,হাতে কালো হ্যান্ড গ্লাভস, মাথায় টুপি পরিহিত অবস্থায় নিচুতে বসে লোকটাকে পর্যবেক্ষণ করলো। অতঃপর চোখ ঘুরিয়ে টুপির ফাঁকে কৌশিকের দিকে তীক্ষ্ণ নজর দিলো। কৌশিক তৎক্ষণাৎ পা ঘুরিয়ে বাড়ির ভেতরে চলে গেলো। নিক ও কিছু কথাবার্তা বলে ভেতরে চলে গেলো। কৌশিকের পিছু পিছু হেঁটে দ্রুত তার বাহু ধরে থামালো তাকে। নিকের আঙুল কৌশিকের বাহুতে শক্ত হয়ে বসে আছে।
কণ্ঠে ধমকের সুরে উচ্চারণ করলো,
"রুমে আসো, কৌশিক। কথা আছে।"
কৌশিক ঘুরে নিকের চোখের দিকে তাকালো। নিকের দৃষ্টি অস্বাভাবিক ঠান্ডা। তবুও বোঝা যাচ্ছে তার ভেতরে একটা আগুন দাউদাউ করে জ্বলছে।
কৌশিক শান্ত স্বরে বললো,
"আমার এখন কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।"
"কথা বলতে হবে। তুমি আমাকে ভুল প্রমাণিত করো। বলো আমি যা ভাবছি তা সম্পূর্ণ ভুল।"
কৌশিক হাত ছাড়িয়ে উত্তর দিলো,
"তুমি ভুল নও, এটাই বলবো।"
নিক এক মিনিট ও দেরি করল না, কৌশিকের ঢিলেঢালা সোয়েটার এক ঝটকায় টেনে গালে সজোরে ঘুষি বসিয়ে দিলো। সে শব্দ ঘরে প্রতিধ্বনিত হলো। কৌশিকের ফর্সা হলুদ গালে লাল টুকটুকে ছাপ পড়ে গেলো। নাক দিয়ে কয়েক ফোঁটা রক্ত ঝরলো কৌশিকের।
ঘুষির ভার সামলাতে কৌশিকের মাথা একপাশে হেলে গেল, তবুও সে প্রতিরোধ করল না। গালে প্রচন্ড জ্বালা ধরেছে, কিন্তু তার দৃষ্টিতে কোনো ক্ষোভ নেই। সে জানে সে ভুল করেছে। কাল রাতে তার দ্বারা লোকটির প্রাণ গিয়েছে। কিন্তু কিছু করার ছিল না।
নিক কঠিন স্বরে বললো,
"তুমি নিজের শর্ত ভেঙেছো। আমরা একটা পরিবার, কৌশিক। এটা ভুলে গেছো? তোমার আরও কঠিন শাস্তি পাওয়া উচিত। তুমি কীভাবে পারলে নিজের পরিবারের সদস্যকে....? সিকিউরিটি গার্ড গুলো আমাদের জন্যই কাজ করছে, কৌশিক।"
কৌশিক নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল, হাত উঠিয়ে ক্ষতস্থান আলতো করে স্পর্শ করল।
নিক এক নিঃশ্বাসে বলল,
"আমি খুব রাগ করেছি তোমার উপর, কিন্তু চাই না এটা আবার ঘটুক। দ্বিতীয়বার যেন এমন ভুল না হয়। তুমি জানো তোমার অনেক শক্তি দরকার তাও কেনো এমন করছো?"
নিক তারপর আর এক মুহূর্ত দাঁড়াল না, সোজা হেঁটে নিজের রুমের দিকে চলে গেল। কৌশিক মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ধীরে ধীরে নিজের বাম হাতের কব্জির দিকে তাকালো সে। চামড়ার নিচে শিরাটার একটা অংশ নীল রঙ ধারণ করেছে। কৌশিক ডান হাত দিয়ে সেই অংশ ঘষতে শুরু করলো। কিন্তু ঠিক হচ্ছে না, নীল অংশটা যাচ্ছে না। এই নীল অংশ দিয়ে কি বোঝাতে চাইছে আসলে?
*******
নোহারা শপ থেকে বাড়ি ফিরছিল। আজ বেশ ধমক খেয়েছে শপের মালকিনের কাছ থেকে। একদিনের ছুটি নিলেই মহিলা তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে। অথচ বের হওয়ার সময় তিনিই আবার কিছু শুকনো খাবার হাতে ধরিয়ে দিলেন। নোহারার ভীষণ হাসি পাচ্ছিল, কিন্তু সেই কঠোর মুখের পেছনের অদৃশ্য মমতাটুকু দেখে মায়াও লাগছিল। হয়তো সে কারণেই মুখের হাসিটা লুকিয়ে ফেলেছিল। শুধু নরম স্বরে ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে এলো।
নোহারা ঠোঁটের ফাঁকে বাঁশির সুর তুলতে তুলতে হাঁটছিল। তার কাঁধ পর্যন্ত নেমে আসা চুলগুলো হালকা বাতাসে দুলে উঠছিল। হাতে ধরা পলিথিন ব্যাগটা সে দুই আঙুলে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে খেলাচ্ছলে দোলাচ্ছিল। চেনা গলিটায় পা দিতেই চোখে পড়ল এক অচেনা পুরুষকে। কিছুটা থমকে গেল সে। লোকটি হাত ভাঁজ করে নিস্পৃহ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে, মুখ পুরোপুরি অন্যদিকে ঘোরানো, মাথায় লাগোয়া টুপি। এই হালকা গরমেও লোকটা ভারী পোশাক পড়ে বসে আছে। ভারী অন্ধকারে তার পিঠের অবয়বই শুধু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। নোহারা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে রইল, অন্তরে অজানা অস্বস্তি খচখচ করছিল।
কিন্তু পরক্ষণেই মাথা ঝাঁকিয়ে মনে মনে নিজেকে শান্ত করলো। হয়তো শুধুই ভুল ভাবছে সে। কাঁধ ঝাঁকিয়ে গলির পথ ধরে এগিয়ে গেল সে। লোকটাকে পাশ কাটিয়ে কয়েক কদম এগোলো।
কিন্তু পা দুটো থেমে গেলো লোকটির গম্ভীর চেনা পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনে,
“লিটিল গার্ল! তোমার জন্য পানিশমেন্ট ঠিক করেছি। কোথায় যাচ্ছো?”
নোহারা হঠাৎ পেছনে ফিরে তাকালো। তার চোখ দুটি বিস্ময়ে আরও বড় হয়ে উঠল। কিছুটা সঙ্কোচে, এক পা এক পা করে সামনে এগিয়ে নিককে ভালোভাবে দেখতে লাগলো। নিক ধীরেসুস্থে তার মাথা থেকে টুপি নামিয়ে, মুচকি হেসে বলল,
"এমন ভাব করছো মনে হচ্ছে প্রথমবার দেখছো আমাকে।"
নোহারা অস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করলো,
"ভীতু ভাল্লুক!"
"হাঁ?"
নোহারা দাঁত কিড়মিড়িয়ে নিকের গালে কয়েকটা চাপড় দিল। তারপর দু'হাত দিয়ে চেপে ধরে নিকের মুখটা টেনে দেখল।
রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল,
"হ্যাঁ, ঠিক ধরেছি! তুই ই তো সেই বীর সাহসী পালিয়ে বাঁচা ভাল্লুকটা, যে আমাকে একা রুমে রেখে গায়েব হয়ে গিয়েছিলি! ইশশ! আয়নায় নিজের মুখ দেখতে পারি না আমি। ওই দিন সকালে কার মুখ দেখে যেন ঘুম ভেঙেছিল? উম! সন্ধ্যা ব্রো, তুই ই তো ছিলি তাই না? যার মুখ দেখে আমার পুরো দিনটা মাটি হয়ে গিয়েছিলো!"
নিক হতভম্ব হয়ে গেলো,
"কি যা তা বলছো? অভদ্রের মতো আচরণ করছো কেন?"
নোহারা নাক ফুলিয়ে পা দিয়ে নিকের পায়ে আঘাত করে বললো,
"পছন্দ করি বলে আমাকে ব্যবহার করবি?"
নিক আহ্ উচ্চারণ করে পায়ে হাত দিয়ে বললো,
"ব্যবহার করলাম কখন?"
"আমি তোকে নিয়ে অনেক ভেবেছি। তুই সুযোগ বুঝে আমাকে ব্যবহার করছিস! তাই না?"
নিক বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে বললো,
"আমি ভাবলাম, তুমি আমাকে দেখার জন্য কাতরাচ্ছো।"
নোহারা ঠোঁট উল্টে বললো,
"হ্যাঁ কাতরাচ্ছি অবশ্যই। আমার হাত দুটো খচখচ করছে। চুলকাচ্ছে হয়তো তোকে উরাধুরা মারতে চায়। স্টার্ট করি কী বলিস?"
নিক একটু থেমে কিছুক্ষণ নোহারাকে পর্যবেক্ষণ করলো, তার কাঁধে হাত রেখে শান্ত গলায় বলল,
"নোহারা, তুমি ঠিক নেই মনে হচ্ছে।"
নোহারা গভীর শ্বাস নিয়ে নিকের দিকে একপলক তাকাল। গম্ভীর স্বরে বললো,
"কয়েক দিন পর পর এভাবে আসলে আর আসার দরকার নেই। শুধু একটা কাজ করবেন, সন্ধ্যা ব্রো। আমার মস্তিষ্ক থেকে আপনার স্মৃতিগুলো মুছে দিয়ে যাবেন আর না পারলে আমাকে মেরে চলে যাবেন।"
নোহারা উল্টো ঘুরে হাঁটতে লাগলো। নিক তার পেছনে হাঁটতে হাঁটতে উচ্চারণ করলো,
"সত্যি বলছো?"
"মিথ্যে বলবো কেন?"
নিক পিছু হাঁটতে হাঁটতে বললাম,
"আমি স্বাভাবিক মানুষ নই। তাই স্বাভাবিকভাবেই তোমার সাথে আমার কিছু হবে না।"
"ওকে!"
"কিন্তু আমিও তোমাকে পছন্দ করি।"
"ওকে।"
"বাট ইউ নো, আই নিড ব্লাড ফর মাই সারভাইবেল।"
নোহারা মাথা নিচু করে হাঁটতে লাগলো, মুখটা শুষ্ক। নিক আবারো বললো,
"তাই না চাইতেও আমাকে অনেক মেয়েদের সাথে মিশতে হয়।"
"আমাকে এসব বলার দরকার কী?"
"তুমি যদি চাও, তাহলে আমার এই বৈশিষ্ট্য মেনে নিয়ে আমার সাথে থাকতে পারো। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, আমি তোমাকে ভালোবাসতে পারবো না।"
নোহারা থমকে গেলো, ভ্রু কুঞ্চিত করে পিছনে তাকালো। নিক বললো,
"আমার চোখ তোমাকে শিকার ভেবে নিয়েছে। শিকারকে ভালোবাসলে আমি সব হারিয়ে ফেলবো। আমার সুন্দর দেহ এমনকি আমি যে ভ্যাম্পায়ার সেটাও।"
নিক নোহারার সামনে এসে দাঁড়ালো। নোহারা চিন্তিত হয়ে বললো,
"এর মানে আপনি মানুষে পরিণত হবেন?"
"হ্যাঁ। কিন্তু আমি বয়স্ক মানুষে পরিণত হবো। আমার জীবনের সময় সীমা খুব দ্রুতই শেষ হতে থাকবে।"
নোহারা নিশ্চুপ হয়ে রইলো। নিক ও তার মাথায় টুপি পরে নিলো।
ভ্যাম্পায়ার শ্রেণিদের মধ্যে প্রতিযোগিতার শেষ নেই। অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে, ক্ষমতার শীর্ষে উঠতে তারা প্রতিনিয়ত লড়াই করে। কারো রক্তপানের ক্ষমতা প্রবল, কেউ তীক্ষ্ণ বুদ্ধির খেলায় অপ্রতিরোধ্য, আবার কেউ দ্রুতগতিতে ছায়ার মতো মিলিয়ে যেতে পারে।
ভ্যাম্পায়াররা মানুষের রক্ত পান করে জীবনধারণ করে, অন্ধকারে তাদের শক্তি বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। কেউ চিন্তা পড়তে পারে, কেউ চোখের এক পলকে বহু দূর পাড়ি দিতে সক্ষম। কিছু ভ্যাম্পায়ার অন্যকে তাদের ইচ্ছামতো নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, আবার কেউ দীর্ঘ শতাব্দী ধরে অপরিবর্তিত থাকে, সময়ের সঙ্গে তারা অমরতার গল্প লেখে।
নিক ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ থেকে টিকে আছে। সময়ের নিষ্ঠুরতা আর অমরত্বের ওজন বহন করে চলেছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর ভ্যাম্পায়ারদের মধ্যে সে মোটামুটি শক্তিশালী হিসেবে পরিচিত। না কোনো মোহ তাকে গ্রাস করেছে, না কোনো মানবীয় বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে। প্রেম, ভালোবাসা কিংবা বিবাহ। এসব কখনোই তার চিন্তার পরিসরে ছিল না, কারণ তার স্বভাবের সঙ্গে যায় না। কিন্তু এক দুর্ঘটনাই বদলে দিয়েছিল অনেক কিছু। কৌশিক আর ভেনোরার সঙ্গে নিকের বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে, এক অদৃশ্য সুতোয় তারা জড়িয়ে যায়। তারপর থেকে তারা একসঙ্গে আছে, একে অপরের ছায়া হয়ে বেঁচে আছে, বিপদে একে অপরকে আগলে রেখেছে।
তবে জীবন সব সময় নিজের নিয়মে চলে না। কখনো কখনো এমন কিছু ঘটে, যা পরিকল্পনার বাইরে। সেই কিছু একটা হয়তো জীবনকে আরো সুন্দর করে দেয় অথবা আরো ভয়ংকর আরো শূণ্যতায় ছেড়ে দেয় তাদেরকে।
নিক হেঁটে চলে যাচ্ছিলো। নোহারা হঠাৎ বলে উঠল,
"আমি! আমি ভালোবাসতে থাকবো, আপনি শুধু পছন্দ করলেই হবে।"
নোহারার কথায় পদধ্বনি থেমে গেলো নিকের। নিক পিছমুখী থাকা অবস্থাতেই নিচু হয়ে হেসে ফেললো। বললো,
"পাগলামি করছো। পরে পস্তাবে।"
"সন্ধ্যা ব্রো, আজ কিন্তু চলে গেলে আমার হাতে আপনার মরণ হবে!"
নিক ফিক করে হেসে পিছনে ঘুরলো। নরম গলায় বললো,
" সাধারণ একজন মানুষকে পছন্দ করো, লিটিল গার্ল। আমি তোমার জীবনে পুরোপুরি প্রবেশ করলে তুমি শেষ হয়ে যাবে। আমি কোনো বাঙালি পুরুষ নই যে তোমাকে সুস্থ রাখতে নিজেকে বিসর্জন দিবো।"
"জানি।"
"আমি সবার থেকে বেশি নিজেকে পছন্দ করি। তাই তোমার অতো কেয়ার করতে পারবো না।"
"মেনে নিলাম। শুধু আমার পছন্দের প্রেমিক হয়ে থাকবেন তাতেই হবে। শত মেয়েদের সাথে আপনার ঘেঁষাঘেঁষিও মেনে নিলাম, কিন্তু মাঝেমধ্যে আমার হাতের মার খেতে হবে এটা মেনে নিবেন।"
নিক বাঁকা হাসলো,
"তোমার হাতের মার খাওয়া আমার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।"
নোহারা মুচকি হাসলো। মাথা নিচু করে বললো,
"অন্ধকারে আমাকে একা ফেলে যাবেন না যেমনটা সেদিন চলে গিয়েছিলেন।
আমাকে যত্ন করার দরকার নেই। শুধু আমার এই হাতটা ধরে থাকবেন। তাহলেই বুঝবো আমি আপনাকে পছন্দ করে ভুল করিনি।"
নিক মাথা নাড়লো। নোহারা কিছুটা কাছে এগিয়ে এসে বললো,
"সন্ধ্যা ব্রো! কি যেন শাস্তি দিতে চেয়েছিলে?"
নিক ভ্রু কুঁচকে মনে করার চেষ্টা করলো, কিন্তু নির্দিষ্ট করে কিছুই মনে পড়লো না। নোহারা তখন এক ধাপ এগিয়ে এসে নিঃশব্দে নিকের টুপিটা মাথা থেকে নামিয়ে দিলো, তারপর আচমকা নিকের চুল মুঠো করে ধরলো। কঠোর গলায় বললো,
"চুলের হাল এমন কেনো? কী বিচ্ছিরি! একদিকে নীল, আরেকদিকে কালো! একদম উদ্ভট দেখায়!"
নিক বিরক্তির সঙ্গে নোহারার হাত সরিয়ে দিয়ে বললো,
"এটা ফ্যাশনেবল হেয়ার, বোঝো? তোমার মতো ছোট মেয়েরা এসবের কদর করতে জানে না।"
"ছিহ! ধরে বেলতলায় নিয়ে যাবো। মাথা টাক না করে ছাড়বো না অথবা কদমছাট করবো। কোনটা ঠিক হবে?"
"এই কদমছাটটা আবার কী জিনিস?"
নিক চোখ মুখ কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো।
নোহারা বাঁকা হাসলো,
"চলেন, তারপর বুঝবেন।"
নিক ভ্রু উঁচু করে তাকালো,
"ওয়েট! এই বেলতলাটা কোথায়?"
নোহারা মুচকি হেসে ফেললো। আশেপাশের কয়েকজন লোক তাদের দিকে সন্দেহের চোখে তাকিয়েছিল। রাস্তায় একজন মেয়ে আর একজন ছেলে একসাথে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। লোকে তো তা দেখে বাঁকা চোখে তাকাবেই!
তাই নোহারা ধীর পায়ে এগিয়ে নিকের হাত টেনে ধরলো, "চলো, সন্ধ্যা ব্রো! এত প্রশ্ন করলে চলবে না।"
নিক কিছু না বলে অনুসরণ করলো। ধীরে ধীরে তারা অন্ধকার গলির দিকে ঢুকে গেল।
বাতাসে ভেজা মাটির গন্ধ, কোথাও একটা পুরোনো সাইনবোর্ডের চেইন দুলে দুলে শব্দ তুলছে।
হঠাৎ নিক ফিসফিস করে বললো,
"আবার এখানে? বিড়াল আছে বিড়াল!"
নোহারা থামলো না, হাত টেনে ধরে বললো,
"আরেহ তো? বিড়াল বিড়ালের কাজ সারছে। আমি আমারটা সারি?"
নিকের চোখ কুঁচকে গেল।
"মানে?"
কিছু বুঝে ওঠার আগেই নোহারা আচমকা তার দিকে ঘুরে এল। নিক হতভম্ব হয়ে গেল, শরীর শক্ত হয়ে গেল তার। নোহারা নিঃশব্দে তার বাহুতে হাত রাখলো, ধীরে ধীরে আরেকটু কাছে এগিয়ে এলো। নোহারার উষ্ণ নিঃশ্বাস নিকের গালের কাছে লেগে যাচ্ছে। রাতের নিস্তব্ধতার মাঝেও নিক নিজের হৃদস্পন্দন শুনতে পাচ্ছিল।
হঠাৎ, নোহারা দুই হাত বাড়িয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলো। শক্ত করে, একদম নিজের কাছাকাছি টেনে নিলো নিককে।
নিক এক মুহূর্তের জন্য নিঃশ্বাস বন্ধ করে ফেললো। সে অভ্যস্ত নয় পছন্দের ব্যক্তি থেকে প্রাপ্ত এমন উষ্ণতায়, এমন ঘনিষ্ঠতায়। এই পর্যন্ত যা করে এসেছে শুধুমাত্র নিজেকে টিকিয়ে রাখতে। কিন্তু আজ অনুভূতি অন্য কথা বলছে।
নিক নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইলো। নোহারার মাথা তার বুকে ঠেকানো। ক্লান্ত শিশুর মতো আশ্রয় খুঁজছে মেয়েটা। রাতের হালকা বাতাস তার চুল উড়িয়ে দিচ্ছিল, কিন্তু সে একটুও নড়ল না।
নোহারা গভীর শ্বাস নিয়ে ফিসফিস করে বললো,
"আহ! কি শান্তি! থ্যাংকস সন্ধ্যা ব্রো, এত সুন্দর শাস্তি দেওয়ার জন্য।"
অল্প সময় পর নিক ধীর স্বরে বললো,
"লিটিল গার্ল, আমি এই শাস্তি দিতে চাইনি।"
নোহারা মুখ তুলে ধমক দিয়ে বললো,
"চুপ থাক, ভীতু ভাল্লুক। আমি যেটা নিচ্ছি নিতে দে। নাহলে সবার সামনে মাঝ রাস্তায় নিয়ে থাপ্পড় মারবো। তোর ইজ্জত লুটবো।"
নিক পড়লো মহা ফ্যাসাদে। একে তো ভ্যাম্পায়ার, তার ওপর চিরকাল নির্বিকার জীবন কাটিয়েছে। এই মেয়ে একেবারে তার স্বাভাবিকতাকে ধূলিসাৎ করে দিয়েছে! মুখ বিকৃত করে নোহারাকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলো সে। কিন্তু না মেয়েটা তো আঠার মত লেগে আছে।
নিক ফিসফিসিয়ে বললো,
"কি ডেঞ্জারাস মেয়ের পাল্লায় পড়লি, নিক।"
নোহারা মিষ্টি হেসে বললো,
"কনগ্রাচুলেশন, সন্ধ্যা ভাইয়া। আমরা এখন কাপল। ইয়েয়ে!"
নিক হাসার চেষ্টা করলো। নোহারা মুখ তুলে আবারো কটমট করে তাকিয়ে বললো,
"এই! দুই হাত এভাবে জড়িয়ে ধরো যেভাবে আমি ধরেছি। নাহলে একদম ফিল আসছে না।"
নিক বাধ্য ছেলের মতো ধীরে ধীরে হাত নোহারার পিঠে রেখে আলতো করে জড়িয়ে ধরলো। তার হাতের উষ্ণতা নোহারার পিঠে অনুভূত হলো। নোহারা মুচকি হেসে নিকের বাহুডোরে আরো গভীরভাবে আবদ্ধ হয়ে পড়লো।
.
.
.
চলবে.........................................................................