কামিনী - পর্ব ১৭ - মম সাহা - ধারাবাহিক গল্প


          ভোরের নির্মল বাতাস এসে নিশ্চুপ মহলটির আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়েছে। শুদ্ধ আলোয় পবিত্রতা ছড়াচ্ছে দু'হাতে। 
 রানির মুখের উপর সেই আলো এসে নিরবে নিভৃতে চুম্বন কেটে যাচ্ছে অবলীলায়। রানির হুঁশ নেই সেদিকটায়। মূর্তির মতন স্থবির তিনি। কোন এক শিল্পীর নির্মম ভাস্কর্য যেন! যেই ভাস্কার্যের চেখে-মুখে কী বেদনার ছাপ! অথচ চোয়াল শক্ত। বাহু ছড়ানো। ভেঙে না পড়ার যু দ্ধ ভেতর ভেতর। 
গতকাল রাতেই এই মানুষটা বলেছিলেন কাউকে বিরক্ত না করতে। উনার নাকি ভীষণ রকমের নিদ্রায় চোখ আটকে আসছে। অথচ সেই নারীই দীর্ঘ এতটাক্ষণ একটানা দাঁড়িয়ে তাকিয়ে ছিলেন নিজের বড়ো জানালাটা ভেদ করে দূরে, বহুদূরে। কোনো ঘুম নেই চোখে। কেবল রাজ্যের ক্লান্তি। ভেঙে আসা বুকের জমিনটা আর স্তব্ধ ব্যথার হাহাকার ছাড়া সম্বল বলতে আর কিছুই নেই মানুষটার। 
ভোরের ম্লান আলোয় জ্বলজ্বল করে উঠল রানির চোখ। ঠোঁটে নিখুঁত তাচ্ছিল্যের হাসি। হেয় করে নিজে নিজেই বললেন,
 "আমায় ভালোবাসার জন্য বুঝি সৃষ্টিকর্তা কাউকে সৃষ্টি করার সময় পেলেন না! এতটাই অযোগ্য আমি? এতটাই ঘৃণার? আমার কেন কেউ নেই, দয়াময়? আমার জন্য কেন কাউকে রাখলে না?"

 চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ল তার একবিন্দু জল। বিষণ্ণ বাতাস ছুঁয়ে গেলো চারপাশটায়। হু হু করে দূরে ঝরে পড়ল কিছু পাতা বড়োই অবেলায়। তারাই কেবল জানল, দুঃখের ভাতের বদহজম কতটা।

 ২৪.....

রাজপ্রাসাদে একটি চঞ্চল খবর ছুটে বেড়াচ্ছে চারপাশে। মুখেমুখে চর্চিত খবরটি সীমাবদ্ধ নেই কেবল রাজপ্রাসাদ অব্দি। সেই খবর রাজ্যেও ছড়িয়ে গিয়েছে কীভাবে যেন। প্রাসাদে উৎকণ্ঠা অদমনীয়। কোনো কোনো দাসী তো ফ্রেয়াকে বার বার প্রশ্ন করছে রানির সখীর দোষ কী? কোন দোষে এই বিচার সভার আয়োজন। 
ফ্রেয়া প্রতিত্তোরে কেবল নিশ্চুপতা প্রদান করেছে। দাসী হিসেবে সে যে বিশ্বাসযোগ্য তারই প্রমাণ এটা। পুরো ঘটনা জানা সত্বেও কেউ তার মুখ থেকে একটি কথাও বের করতে পারেনি।

বিচারসভায় আজ নেই মন্ত্রী, কবি, বৈদ্য প্রভৃতিরা। কেবল তিনজন উপস্থিত। রানি, সেনাপতি এবং যামিনী। রানি তার আসনটিতে রাজকীয় বেশেই বসা। চোখ-মুখে সেই দুর্নিবার ভানুর ন্যায় তেজ। সেনাপতি পূর্বদিকেই দাঁড়িয়ে আছে মাথা নত করে। এবং মাঝে দাঁড়িয়ে আছে যামিনী। 
এই অবধারিত নিস্তব্ধতা ভেদ করে ভেসে এলো রানির তেজস্বী কণ্ঠ, 
 "যামিনী, তুমি কী বলতে চাও কিছু? নিজের জন্য কেনো সুযোগ চাও?"
রানির কণ্ঠে এই প্রথম সখীর নাম বোধহয় উচ্চারিত হলো। সেই নাম প্রাসাদের অভস্ত্য 'সখী' ধ্বনিটাকে বিদ্রুপ করে গেলো। 
 যামিনীর বিধ্বস্ত মুখমণ্ডল। নত মস্তক একবার উঠানোর সাহসটুকু করল না। কেবল ভাঙা কণ্ঠে জবাব দিল,
"না।"

 রানির চোখের পলক পড়ল। বুকের ভেতর দীর্ঘশ্বাস জমে স্তূপ হলো।
বললেন, "বিচারসভায় বিচার হওয়ার আগে আমরা অপরাধীর একটি ইচ্ছে জানতে চাই। তোমার আছে কোনো ইচ্ছে?"

যামিনী মুখ নতই রাখল। চোখে চোখ রাখার মতন আর কোনো জায়গা যে তার নেইও। রানি মনে মনে একবার চাইলেন যামিনী মুখ ফুটে বলুক কালকের কথাগুলো সে বলেনি। রানি নিজের কানের ভুল মনে করে ক্ষমা করে দিবেন। কিন্তু যামিনী তা করল না। সে নিজের অপরাধ মাথা পেতে নিলো কেবল। 
মুখ ফুটে বলল,
 "আমার শাস্তিটুকুই আমার শেষ ইচ্ছে।"

রানি ঝেড়ে ফেললেন নিজের সবটুকু আশা। দুঃখ, আকাঙ্ক্ষা যে তার সাথে মানানসই নয়। তিনি রানি কামিনীকাঞ্চন। তার ভেতর আবার মায়া কীসের? 
 রানি উঠে দাঁড়ালেন। সেনাপতির দিকে তাকিয়ে বরাবরের ন্যায় মুখ কঠিন রেখে নির্দেশ দিলেন,
"সখীকে পাশ্চাত্য জঙ্গলে পাঠানোর ব্যবস্থা করো, হ্যাব্রো। এক মাসের বনবাসে পাঠাও তাকে।"

সেনাপতি হ্যাব্রো আঁতকে উঠল, "কিন্তু রানি, ওখানে যে প্রচণ্ড হিং স্র জা নো য়া র রয়েছে!"

 "রানির নির্দেশের উপর কথা বলার অপরাধে সেনাপতি হ্যাব্রোকে রাজপ্রাসাদ এবং রাজ্যের সকল কর্মকাণ্ড থেকে সাতদিনের জন্য বহিষ্কার করা হলো। আর কিছু বলতে চাও, হ্যাব্রো?"

হ্যাব্রো থতমত খেয়ে গেলো। স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল রানির দিকে। এবার তাকাল যামিনীও। সামান্য একটি বাক্যের জন্য রানি এতটা পাষাণ হলেন এত বিশ্বস্ত সেনাপতির প্রতিও? 
যামিনীর ভীষণ অভিমান হলো। সখী তাকে শাস্তি দিয়েছিল তা নাহয় মানা যায় কিন্তু হ্যাব্রোর দোষ কী ছিলো? সামান্যই তো একটি বাক্য! এই মানুষটা তো কখনো রানির দিকে চোখ তুলে একটি কথাও বলেনি। তাহলে তার বেলাও কেন রানির আইন সমান? দণ্ড সমান?

 রানি টানা টানা চোখে তাকালেন হ্যাব্রোর দিকে। আবারও শুধালেন, "আর কিছু বলতে চাও, হ্যাব্রো? তোমার একটি ইচ্ছে বিচারসভায় রাখার অনুমতি আছে। বলো কী চাও?"

কিংকর্তব্যবিমুঢ় হ্যাব্রো সামলে উঠল নিজেকে। ধীর স্বরে বলল,
 "রাজপ্রাসাদে না এলাম, বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকতে পারি কি?"

 এবার বিস্ময়ের পালা রানির। এবং তিনি বিস্ময় হলেনও খানিকটা। তিনি ভেবে পান না, তার এমন শূন্য জীবনে এমন মানুষ জুটলো কীভাবে? এই ছেলেটি না দু'দণ্ড বিশ্রাম নিয়েছে রানির অনুমতি ছাড়া আর না কখনো চোখ উঠিয়ে একটিবার তাকিয়েছে। এমন মানুষ এই ভাগ্যে কেমন করে জুটল, রানি ভেবে পান না।
হ্যাব্রো প্রচণ্ড ভালো হলেও রানি নিজের আদেশে দাঁড়িয়ে রইলেন। নিষেধাজ্ঞা জারি করে বললেন,
"রাজপ্রাসাদের আশেপাশে যেন তোমার ছায়া না পাই। সাতদিন তুমি আমার দৃষ্টি সীমানার বাহিরে থাকবে।"

হ্যাব্রোর আরও কিছু বলার ছিলো কিন্তু বলল না। যদি রানি শাস্তির সীমা আরও বাড়িয়ে দেন! এই শাস্তি যদিও আরামদায়ক অন্যান্যদের জন্য কিন্তু হ্যাব্রোর কাছে গলার কাঁটার মতন অস্বস্তিকর, খচখচে। 
 এই প্রাসাদে রানির ভালো চায় এমন মানুষ গুটিকয়েক আছে কি-না সন্দেহ। হ্যাব্রোর অবর্তমানে তারা সুযোগ যদি নিতে চায়? তার উপর সখীর নিঃসঙ্গতায় মানুষটা তো আরও ভেঙে পড়বেন। তখন যদি কোনো শত্রু মাত দিতে চায়? তখন কী হবে!
নানান আশংকায় চিত্ত অস্থির হলেও তা মুখ ফুটে একটিবার বলবার সাহস হলো না তার। রানিও আর শোনার প্রয়োজন বোধ করলেন না। যেমন সশব্দে তার আগমন ছিলো, তেমনই সশব্দে প্রস্থান ঘটল তার। হ্যাব্রোও পেছন পেছন বেরিয়ে গেলো যামিনীর গমনের ব্যবস্থা করতে। 

শূন্য ঘরটায় কেবল যামিনী ব্যতীত রইল না কেউ। 
 রানি, হ্যাব্রোর পরিপূর্ণ প্রস্থান ঘটতেই হুড়মুড়িয়ে কয়েকজন দাসীর আগমন ঘটলো। এসে তাদের কী হা-হুতাশ! একজন বলল, "রানির সখী, আপনি কত কাছের লোক রানির। অথচ রানির এমন শাস্তি দিতে বুক কাঁপল না!" 
স্পষ্টত প্রতীয়মান যে তারা বাহিরে ধেকে সবটুকু কথোপকথনই শুনেছিল মন দিয়ে। 

 সেই একজনের সাথে ইতিবাচক সুর মিলিয়ে আরেকজন বলল,
"যে রানি নিজের খাস প্রহরী ও দাসীকেও ছাড়েননি নির্মম শাস্তি দিতে, তিনি কি আর নিজের সখীকে ছাড়বেন?"

 সুর মিলিয়ে তৃতীয় একজন বলল, "তাই বলে আপনজনের প্রতি এত নিষ্ঠুর হবে?"

সবটাই যামিনী চুপচাপ শুনল। সত্যিই কি রানি নিষ্ঠুর? আর সে কি অনেক ভালো? শাস্তির কাজ করেছিল বলেই তো শাস্তি পেয়েছে। তাহলে কেন নিজের দোষের কথা সে বুক উঁচিয়ে বলতে পারছে না? এত সঙ্কোচ কীসের? নিজের অপরাধ লুকানোর এত প্রয়াস? তাই বুঝি সখীও এই অপরাধ টুকুর কথা লুকিয়ে গেলেন। যামিনীর প্রতি ভালোবাসার থেকেই কি লুকিয়েছেন এই লজ্জাজনক অপরাধটির কথা? নাকি রানি নিজেকেও হাসির খোঁড়াক বানাতে চাননি বলে লুকিয়ে ছিলেন! রাজ্যবাসী যখন শুনতো তাদের রানি ভুল মানুষকে সখীর মর্যাদা দিয়েছেন তখন কি তারা রানিকে নিয়ে হাসতো না? অপমান কি সখী সম্পর্কটির উপর পড়তো না? তা-ই হয়তো রানি মৌন রইলেন। অপরাধটির কথা ঢেকে ফেললেন আলগোছে। কিছু কুড়িয়ে পাওয়া সম্পর্কে তবুও কলঙ্ক না লাগুক!
 অথচ সে করল কী?

 ২৫....

 শুভ্র রঙের আরেকটি ঘোড়া রানির রাজঘোড়া হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এটি দিয়েই বিভিন্ন প্রয়োজনে, বিভিন্ন জায়গায় ছুটছেন রানি। সঙ্গে অবশ্য প্রহরী, দেহরক্ষী, মন্ত্রী সব থাকে। শত্রুদের ঘ্রাণ রানির মতন কেউ চিনতে পারে না। রানির ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের একটি প্রশংসনীয় ব্যাপার হলো, তিনি প্রায়শই শত্রুর ঘ্রাণ ধরে ফেলতে পারেন। এজন্য বোধহয় এত শত্রুর পৃথিবীতে রানি বেঁচে থাকতে পারছেন আজও!

 আজ রানির সঙ্গে কোসো সেনা নেই। নেই কোনো দেহরক্ষী। রানি প্রাসাদ থেকেই বেরিয়েছেন খুব কৌশলে। বিশাল মখমলের কাপড়ে নিজের মুখটি ঢেকে নিয়েছেন অভিজ্ঞ উপায়ে। দেখেই বুঝা যাচ্ছে কোনো এক গোপন কাজের জন্য তুমুল সতর্কতা অবলম্বন করেছেন। এবং কাজটি এতটাই গোপন যে কাউকে বিশ্বাস করে বলা যাবে না কিংবা গন্তব্য অনুযায়ী নেওয়া যাবে না। 

রানির ঘোড়াটি তখন রাজ্যের সীমানা ছাড়াবে ভাব। সূর্য় ডুবে গিয়েছে প্রায়। আকাশের রঙটি ধূসর। রানি কেবল মোড় ঘুরতে নিবেন তার আগেই কয়েকটি ঘোড়া পথরোধ করল তার। আকস্মিক এই পথরোধে রানি ঘোড়া থেকে ছিঁটকে পড়ে যেতে নিয়েও সামলে উঠলেন। গর্জন দিয়ে বললেন, "কার এত বড়ো স্পর্ধা যে রানি কামিনীকাঞ্চনের পথে বিঘ্ন ঘটায়! কার এত দুঃসাহস?"

ঘোড়া থেকে তখন আরামসেই নেমে দাঁড়ালেন একটি পুরুষ। নীলাভ তার চোখের মণি, কালো আর গাঢ় বাদামি মিশেলে চুল। পোশাকে রাজকীয় কিংবা রাজার ভাব না থাকলেও বাহু দু'টো টান টান। রানির এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো এ বোধহয় দস্যুর দলের লোক। কিন্তু ধারণা স্থায়ী করতে পারছিলেন না। 

 সেই লোকটি বুক উঁচিয়ে এগিয়ে এলেন। রানি ভাবলেন এই বুঝি ধারালো কোনো অস্ত্র বের করে লোকটা তা দিয়ে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে দিবেন রানির দেহটি। 
অথচ রানিকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে লোকটি বললেন, "আমাদের সাথে একটি স্থানে যেতে হবে তোমায়, সম্রাজী।"

রানি কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে তাকালেন। তলোয়ারের বিপরীতে তিনি জবাব দিতে পারেন কিন্তু কোমলতার বিপরীতে কী উত্তর হয় তা ভাবতেই সময় চলে যায় তার। এবং অদ্ভুত ভাবে লোকটি সেটা জানেন যে, রানির কাছে শান্ত ভাষার উত্তরের বড়ো অভাব। রানি নরম ভাষায় অভ্যস্ত নন। তাই এই ভাষাতেই প্রথম সাক্ষাৎটি বিস্ময়ের করলেন। সম্বোধনে 'তুমি' শব্দটি রানির জন্য নতুন। বড্ড কৌতূহলের।
·
·
·
চলবে....................................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp