মাই মিস্টিরিয়াস প্রিন্স - পর্ব ৬৫ - মৌমিতা মৌ - ধারাবাহিক গল্প


আরণ্যকের বাবা শামীম সাহেব ভেতরে ঢুকতেই সম্পূর্ণ ঘর চুপচাপ হয়ে গেল। উনার গম্ভীর দৃষ্টির নিচে সবাই নিজেদের অপ্রস্তুত মনে করতে লাগলো। এক নজরে সবার দিকে তাকিয়ে নিয়ে হাতঘড়ির দিকে চোখ বোলালেন তিনি। 

কণ্ঠে শাসন মিশিয়ে বললেন,
"সাড়ে এগারোটা বেজে গেছে। খাওয়া দাওয়া এত দেরিতে কেন?"

আরণ্যকের মা রাবেয়া বেগম দ্রুত উত্তর দিলেন,
"আসলে খাবার গরম করতে করতে কখন যে সময় পেরিয়ে গেছে, খেয়ালই করিনি।"

তিনি আর সময় নষ্ট না করে তাড়াতাড়ি হাত ধুয়ে স্বামীর সাথে রুমের দিকে চলে গেলেন।

রুশা বিরক্ত চোখে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললো, "তাড়াতাড়ি খেয়ে নে। এত ঢং কেন করছিস?"

আরণ্যক ঠোঁট কুঁচকে অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বললো, 
"তুমি তোমারটা খাও। আমার খেতে ইচ্ছে করছে না। তাছাড়া বাবা তো এমনিতেই আমাকে অপছন্দ করে। খেতে বসেই হয়তো আবার বকা দেবে। জানি আমি!"

রুশা হালকা ধমকের সুরে বললো,
"আরে অপছন্দ করে কই? বাবা শুধু শাসন করে এই আর কী!"

কথার মাঝেই বাবার রুমের দরজা খুলে যেতে দেখা গেলো। উনার ভারী পায়ের শব্দে ঘরজুড়ে নেমে এলো আরেক স্তর নীরবতা। বাবার কঠিন চোখের দৃষ্টি আবারও সবার উপর পড়লো। আরণ্যক হাত উঠিয়ে খাওয়া শুরু করলো। শামীম সাহেব হাত ধুয়ে ডাইনিং টেবিলের চেয়ার টেনে বসলেন। রাবেয়া বেগম প্লেটে খাবার দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। 

শামীম সাহেব ধীরস্থির গলায় বললেন,
"আরণ্যক! তোমার তো থার্ড ইয়ার চলছে, তাই না?"

আরণ্যক মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো।
"জ্বি, বাবা!"

"চাকরি নিয়ে ভাবছো তো? নাকি এখনো সময় নষ্ট করে ঘুরে বেড়াচ্ছো?"

"ভাবছি…"

শামীম সাহেব চেয়ার ঠেলে একটু পেছনে হেলান দিলেন।
"এখন থেকেই প্রস্তুতি শুরু করো। মাস্টার্সের পরিকল্পনা আছে?"

"না, চাকরির দিকেই মনোযোগ দিতে চাই।"

বাবা মাথা ঝাঁকালেন। 
"ভালো, কিন্তু জানোই তো, আজকাল চাকরি পাওয়া কত কঠিন। প্রতিযোগিতা তীব্র, প্রস্তুতি না নিলে পিছিয়ে পড়বে।"

আরণ্যক চুপ করে থাকল।

শামীম সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
"তোমার সমান ছেলেরা কোথায় পৌঁছে গেছে! আমার বন্ধুর ছেলে এখন বড় কোম্পানিতে কাজ করছে। আমার বন্ধু প্রায়ই এসে তার ছেলের সাফল্যের গল্প শোনায়। অথচ তুমি? সারাদিন ভুল জায়গায় সময় নষ্ট করছো। এতে কী লাভ? সবার পাশে দাঁড়ানো ভালো, কিন্তু তারা কি তোমার জন্য কিছু করছে? নাকি ভবিষ্যতে করবে?"

রান্নাঘর থেকে রাবেয়া বেগম নীরবে শুনছিলেন। হাতে একটা বাটি নিয়ে আসলেন। বাটিটা টেবিলে রেখে স্বামীর পাশের চেয়ারে বসলেন। রুশা পাশে বসে থাকা ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে রইল।

"তোমাকে নিয়ে বারবার একই কথা বলতে বলতে আমি ক্লান্ত। তবু তোমার কোনো অগ্রগতি দেখি না।"
শামীম সাহেব আবারো সোজা হয়ে বসে খাওয়ায় মনোযোগ দিলেন।

আরণ্যক এক মুহূর্ত চুপ থেকে মৃদু স্বরে বলল,
"আমি তো চেষ্টা করছি, বাবা।"

শামীম সাহেব কিছুক্ষণ সময় নিলেন। মুখে খাবার পুরে আবারো বললেন,
"হ্যাঁ, যে চেষ্টার কোনো ভ্যালু নেই। "

আরণ্যকের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। সে টেবিলে জোরে হাত চাপড়ে উঠে দাঁড়ালো। কণ্ঠে বিক্ষোভ আর চোখে আগুন নিয়ে বললো,
"কি চাও তুমি? সারাক্ষণ নিজের ইচ্ছে আমার ওপর চাপিয়ে দিতে চাও? একটুখানি শান্তিতে বাঁচতে দেবে না? নাকি চাও আমি মরে যাই?"

রুশা আঁতকে উঠল। ভাইকে ইশারায় শান্ত হতে বললো। আরণ্যক হাত ছাড়িয়ে বললো,
"আমাদের ক্লাসে সবচেয়ে ভালো রেজাল্ট আমিই করে এসেছি। তোমার বন্ধুকে সেটাও শোনাও! কিন্তু না, তুমি তো শুধু খারাপটাই দেখো! কখনো আমার ভালো কিছু চোখে পড়েছিলো তোমার? সবসময় অন্যের সঙ্গে তুলনা!"

শামীম সাহেব মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেলেন। তারপর গভীর দৃষ্টিতে ছেলেকে দেখলেন। কিন্তু কিছু বললেন না। ঘরের মধ্যে একটা অস্বস্তিকর নীরবতা নেমে এলো। আরণ্যক আবারো বললো,
"আই ওয়ান্ট টু লিভ ইন মাই ওউন ড্রিমস।"

শামীম সাহেব মুখ খুললেন,
"নিজের মর্জি চালাতে হলে বাসা থেকে বের হয়ে যাও।"

রাবেয়া বেগম চুপ থাকতে না পেরে স্বামীর বাহু স্পর্শ করে বললেন,
"কি বলছেন এসব? ছেলেটার মন খারাপ তাই এসব বলছে।"

আরণ্যক বেসিনের দিকে হাঁটা ধরলো। জোর গলায় বললো,
"সময় হলে আমি চলেই যাবো। থাকবো না এই বাসায়।"

শামীম সাহেব কড়া গলায় বললেন,
"চলে গেলে মনে রাখবে আমার একটা মাত্র সন্তান ছিল। আর খাবার যে নষ্ট করছো নিজের টাকায় কিনেছো এসব?"

আরণ্যক রান্নাঘরে গিয়ে একটা প্লেট নিয়ে আসলো। নিজের খাবারটা ঢাকা দিয়ে রুমের দিকে চলে গেলো।রুমে ঢুকেই দরজাটা শক্ত করে বন্ধ করল। দরজার আওয়াজ শুনে রুশা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। শামীম সাহেব ধীর কণ্ঠে বললেন,
"এদেরকে নিজের সন্তান বলতেও মুখে বাঁধে। একজন ছোটখাটো অফিসে সামান্য হিসাব কর্মীর চাকরি করে। আরেকজন তো টইটই করে ঘুরে বেড়ায়, আমার টাকায় চলে কিন্তু বড় বড় কথা বলতে ছাড়ে না।"

রুশা একবার চোখ তুলে বাবার দিকে তাকালো। মনটা বিষিয়ে উঠলো তার। রাবেয়া বেগম স্বামীর কথা শুনেও না শোনার ভান করে খাওয়া শুরু করলেন।

রুমের বিছানায় বসেই মাথা দু'হাতে চেপে ধরল আরণ্যক। রাগে, অভিমানে গা পুড়ে যাচ্ছে তার। যদি নিজের টাকা থাকতো, তাহলে এখনই এই বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যেতো।

দিনের পর দিন তাকে শুধু ছোটোই করা হয়। তার কষ্ট, পরিশ্রম কেউ দেখে না, কেউ বুঝতেও চায় না। পাশের টেবিলে রাখা ফোনটা তুলে নিলো সে। স্ক্রিন জ্বলে উঠল। ভেনোরার অনেকগুলো মিসড কল চোখে পড়তেই মনটা আরও বিষিয়ে উঠল। এখন আর কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু ফোন তো দিতেই হবে। কিছুক্ষণ নোটিফিকেশনের দিকে চুপ করে তাকিয়ে রইল সে। তারপর আঙুল চালিয়ে ধীরে ধীরে কল ব্যাক করল ভেনোরাকে।

ওপাশ থেকে ভেনোরার রাগী, তীক্ষ্ণ কণ্ঠ ভেসে এল,

"ফোন ধরতে এত দেরি হলো কেন? আচ্ছা, যাই হোক! আমি যা বলেছি, মনে আছে তো?"

আরণ্যক ক্লান্ত স্বরে উত্তর দিল, 
"হুম! কী বলার জন্য ফোন দিয়েছেন?"

ভেনোরা এক মুহূর্ত থেমে গিয়ে বলল, 
"কাল তোমাদের ক্লাস আছে, না?"

"হ্যাঁ।"

"অনন্যার সঙ্গে কথা বলবে।"

আরণ্যক ভ্রু কুঁচকালো। "আচ্ছা।"

"তোমাকে একটা ক্যাফের লোকেশন মেসেজ করে দেবো, সেখানে নিয়ে যাবে অনন্যাকে। আর শোনো, কথাবার্তা শেষ হলে তুমি আগে বের হবে না। আগে অনন্যা বের হবে, তারপর তুমি।"

আরণ্যক এবার পুরোপুরি অবাক।
"ঠিক আছে, কিন্তু কেন?"

ভেনোরা ধীর গলায় বলল, 
"কালকেই বুঝবে। রাখছি। আর যা বলেছি, সেটা ঠিকমতো করো। যখন যাবে একটা মেসেজ দিবে শুধু।"

কথা শেষ হতেই কল কেটে গেল। ফোনের স্ক্রিনের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আরণ্যক। ভেনোরার আচরণে বেশ সন্দেহ হচ্ছে তার। এই মেয়েটাকে বিশ্বাস করা উচিত নাকি এখনো বুঝে উঠতে পারছে না আরণ্যক। দ্বিধায় ভুগছে সে।

*****

ক্লাস শেষ। টিউশনির জন্য অনন্যাকে আরও এক ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে। নোহারাকে বিদায় দিয়ে দিয়েছে সে। এক ঘণ্টার ব্যাপার, একটা মুভি ছাড়লেই সময় কীভাবে ফচাৎ করে কেটে যাবে বোঝাই যাবে না নিশ্চিত। এই ভেবে ক্যান্টিনের দিকে পা বাড়ালো। আকাশের অবস্থা ভালো না। আকাশের একরকম ধোঁয়াটে আর গুমোট চেহারা দেখে মনে হচ্ছে, হুটহাট যখন তখনই মুষলধারে বৃষ্টি নামবে। এমন ও হতে পারে একটু পরেই হয়তো বাতাসের গতি বাড়বে, ছিটেফোঁটা বৃষ্টি পড়বে, তারপর একসময় ঝুম বৃষ্টি। অনন্যার চোখ আকাশের দিকেই ছিল। মনে মনে চাইছিল, বৃষ্টি যদি ফেরার পথেই নামে, তাহলে ভালোই হবে। কৌশিক স্যারের সাথে একসাথে বৃষ্টি দেখা যাবে। হয়তো দুজন একটু ভিজেও নেবে।

ক্যান্টিনের ভেতরে প্রবেশ করতেই যাচ্ছিল অনন্যা। কিন্তু চোখের সামনে একজন চেনা মানুষ ধরা দিলো আর সঙ্গে সঙ্গেই অনন্যার পথ আটকে দাঁড়ালো সে।

"কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা ছিল।" গম্ভীর স্বরে বলল সে।

অনন্যা বিরক্ত চোখে তাকাল। আরণ্যক এক ধাপ এগিয়ে এসে আবার বলল, "চল, আমার সাথে।"

অনন্যা সোজা কথায় প্রত্যাখ্যান জানালো। সে সোজাসাপ্টা বলে দিল, 
"না, যাবো না।"

আরণ্যক মৃদু হাসলো। সে জানতো অনন্যা যেতে চাইবে না। সে আগে থেকেই জানে কোথায় আঘাত করতে হবে, কীভাবে অনন্যাকে ভাবনায় ফেলতে হয়। 
একটু থেমে আরণ্যক গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

"কৌশিক স্যারকে নিয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা ছিল।"

অনন্যা ঘুরে দাঁড়িয়ে হাঁটা শুরু করেছিল। কিন্তু "স্যার" শব্দটা কানে আসতেই পা থমকে গেল। ধীরে ধীরে পিছনে ফিরে তাকিয়ে সন্দিহান কণ্ঠে বলল,

"কি কথা?"

আরণ্যক একটু এগিয়ে এসে ফিসফিস করে বলল, 
"এখানে বলবো না।বাইরে বসবি চল।"

"না, যা বলার এখানেই বলো। আমি কোথাও যেতে পারবো না।"

"বলছি না এখানে বলা যাবে না।"

অনন্যা বিরক্ত চোখে তাকিয়ে বলল, "উফ! আমার টিউশনি আছে, আমি কোথাও যেতে পারবো না।"

আরণ্যক শান্ত কণ্ঠে বলল, "বেশিক্ষণ লাগবে না। তাছাড়া আমার বন্ধুর গাড়ি বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। তাই নো চিন্তা তোকে টিউশনির বাসায় ও দিয়ে আসতে পারবো।"

অনন্যা একদম চমকে উঠল। "গাড়ি! তুমি আসলে কি চাইছো? অন্য কোনো মতলব নেই তো?"

আরণ্যক গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, 
"অনন্যা! তোর কি আমাকে খারাপ ছেলে মনে হয়? আমি সবসময় তোর ভালো চাই, ইয়ার!"

অনেক কথাবার্তার পর অনন্যা রাজি হলো। আরণ্যক অনন্যাকে নিয়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে এসেছে। কিন্তু গাড়িতে ঢোকার আগে অনন্যা শেষ বারের মতো জিজ্ঞেস করলো,
"ভাইয়া!;স্যারের সম্পর্কে কি নিয়ে কথা বলতে চাচ্ছো?"

আরণ্যক গাড়িতে হাত চাপড়ে বললো,
"আমি যখন বলবো তখনি তো বুঝবি।"

অনন্যা একবার ওদের বিল্ডিংয়ের বারান্দার দিকে তাকালো। ছুটির পর ইশারায় স্যারকে বিদায় জানিয়েছিল, কিন্তু এখনো আছেন কি না সেটাই দেখার জন্য চোখ ঘুরে গেলো সেদিকে। নেই, তিনি নেই। দীর্ঘশ্বাস ফেলে গাড়ির পেছনের সিটে গুছিয়ে বসলো অনন্যা। সামনে, ড্রাইভারের পাশে, নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বসে আছে আরণ্যক। 

গাড়ি চলতে শুরু করলো। অনন্যা ফোনটা বের করে স্যারের নাম্বারে দ্রুত একটা মেসেজ টাইপ করলো,

"ফ্রেন্ডের সাথে একটু বাইরে যাচ্ছি। তারপর টিউশনি যাবো।"

মেসেজের ওপর চোখ রাখলো কিছুক্ষণ। ইচ্ছে করেই আরণ্যকের নাম লেখেনি। জানে, শুনলেই রেগে যাবেন স্যার।

দুই মিনিটও পেরোল না, রিপ্লাই এল। সংক্ষিপ্ত, রসকষহীন, একটামাত্র শব্দ!
"ওকে!"

হালকা হাসলো অনন্যা। এতটুকুতেই কেমন যেন মনটা ভালো হয়ে গেছে। কালকের ঘটনাগুলো বারবার মনে পড়ছে। কৌশিক স্যারের স্নেহ মাখানো স্পর্শ। ঘটনাগুলো সব মনে এলেই মন ভরে যাচ্ছে। আজ ক্লাসে মন বসেনি একটুও। মাঝে মাঝেই আনমনে হাসছিল সে।নোহারা দেখেছে সব, মজা নিতেও ছাড়েনি মেয়েটা। 

প্রায় দশ মিনিট পর গাড়ি থামতেই অনন্যার চোখ গিয়ে পড়লো ক্যাফেটার দিকে। জায়গাটা অপরিচিত, শহরের চেনা গণ্ডির বাইরে। একটু দ্বিধা কাজ করলেও আরণ্যক ভাইয়ার উপর বিশ্বাস আছে তার। ভাইয়া কখনোই খারাপ কিছু করতে পারে না। এই বিষয়ে অনন্যা একদম নিশ্চিত।

দুজনে ক্যাফেতে ঢুকে এক কোণে বসেছে। আরণ্যক কাউন্টারে গিয়ে অর্ডার দিয়ে ফিরে এলো। অনন্যার ধৈর্য ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে। অনন্যা ভণিতা পছন্দ করছে না এটা ভালোই বুঝতে পারছে আরণ্যক। 
সে প্রথমেই বললো,
"কৌশিক স্যার কে? কি তার পরিচয় তুই জানিস?"

অনন্যার ভেতর বিরক্তি জমতে শুরু করলো। কৌশিক স্যার সম্পর্কে যা জানার, তা সে আগেই জানে। এখন যদি আরণ্যক ভাইয়া সেই পুরোনো কথাই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলতে আসে, তাহলে নিছক সময়ের অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয়।

কিন্তু একটা প্রশ্ন ওকে কুরে কুরে খাচ্ছে - আরণ্যক ভাইয়া এই বিষয়টা কীভাবে জানলো? আর যদি জেনেও থাকে সে যদি এই সত্য সবার কাছে ফাঁস করে দেয়?এই ভাবনাটাই অনন্যার বুকের ভেতর অস্বস্তির কাঁটা হয়ে বিঁধছে।

অনন্যা একটু এগিয়ে এলো। দৃষ্টিতে গভীর কৌতূহল নিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো,
"তুমি কি জানো উনি কে?"

"হ্যাঁ, এজন্যই বলছি তুই ওনার সাথে থাকবি না। উনি তোর ক্ষতি করবে।"

অনন্যা হেসে উঠলো। একরকম অবিশ্বাস নিয়ে বললো,
"উনি আমাকে অনেক ভালোবাসেন। আমার কিছু হলে সর্বপ্রথম উনিই পাগল হবেন।"

আরণ্যক আচমকা অনন্যার হাত ধরে ফেললো। চমকে উঠলো অনন্যা। বড় বড় চোখে তাকিয়ে রইলো ভাইয়ার দিকে। আরণ্যকের কণ্ঠ ব্যাকুল হয়ে উঠেছে,
"শোন অনন্যা! তোর বিয়ের খবর যখন শুনলাম মনে হলো আমার পুরো দুনিয়া চোখের সামনেই উল্টে গিয়েছিল। কিন্তু তারপর যখন দেখলাম, তুই একজন ভালো মানুষের সঙ্গে আছিস, তখন নিজেকে বুঝিয়েছি, তোকে ছেড়ে দিতে হবে। আমি তোকে ধরে রাখতে চাইনি, কোনো জোর করিনি। কিন্তু আজ করতে বাধ্য হচ্ছি কারণ ওই লোকটা তোর ক্ষতি করবে!"

অনন্যা হাত ছাড়িয়ে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লো। চোখেমুখে ধরা পড়লো চাপা রাগ। কঠিন গলায় বললো,
"এটাই যদি তোমার বলার মতো কথা হয়, তাহলে আমি যাচ্ছি। এই কফি আর আমার গলা দিয়ে নামবে না।"

"অনন্যা, প্লিজ! আমার কথা শোন একবার। আমি চাই না তোর কিছু হোক!"

কিন্তু অনন্যা আর শুনতে চাইল না। ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে সোজা ক্যাফের দরজার দিকে এগিয়ে গেল। আরণ্যকও ওর পিছু নিতে গিয়েছিল, কিন্তু ওয়েটার পথ আটকালো।

"স্যার, আপনাদের অর্ডার প্যাক করে দিচ্ছি। ম্যাডামকে একটু শান্ত করতে পারবেন হয়তো!"

আরণ্যক অস্বস্তিতে মাথা নাড়ালো। কিন্তু লোকটা তখনও ব্যস্ত গুছিয়ে দিতে। সেই মুহূর্তটাই কাল হয়ে দাঁড়ালো আরণ্যকের জন্য। আরণ্যক পা উঁচিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। অনন্যা ততক্ষণে বাইরে চলে এসেছে। রাস্তার ওপারে গাড়িটা দাঁড়িয়ে, এই পাশে পার্কিংয়ের নিয়ম নেই। তাই সড়ক পার হতে হবে। অনন্যা একবার চারপাশে তাকালো। গাড়ির স্রোত থামার কোনো নাম নেই।

কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করলো। তারপর রাস্তা একটু ফাঁকা হতেই দ্রুত পা বাড়ালো। কিন্তু ঠিক তখনই একটা বেপরোয়া ট্রাক কোথা থেকে যেন ঝড়ের মতো ছুটে এলো। অনন্যা বুঝতেই পারলো না কি হলো। স্বপ্নের মতো তার চোখের সামনে ছুটে এলো বেপারোয়া ট্রাকটা। ট্রাকের ধাক্কায় অনন্যা দূরে ছিটকে পড়লো। হঠাৎ একটা বিকট শব্দ চারপাশকে কাঁপিয়ে তুললো! তারপর সাথে সাথেই মেয়েলি এক চিৎকার। পর মূহুর্তেই পিনপতন নীরবতা। কানের মধ্যে চিঁচিঁ শব্দ, শরীরের বিভিন্ন স্থান দিয়ে রক্তের ধারা বয়ে যাওয়া শুরু হয়েছে। তা যেন এক ধাপ বাড়িয়ে তুলতে ঝপঝপিয়ে বৃষ্টি নামলো। খোলা সড়কের মাঝে চোখ দুটো আপনাআপনিই বন্ধ হয়ে গেলো অনন্যার।

মানুষের চিৎকার, গাড়ির ব্রেক চাপার কর্কশ আওয়াজ, বৃষ্টির পানির ধারা সব মিলিয়ে মুহূর্তের জন্য আশেপাশের দুনিয়া থমকে গেলো। কিছুক্ষণ আগেই অনন্যার গলায় একটা তীব্র চিৎকার ফেটে বের হয়েছিল। আর সেই চিৎকারটা ঠিক তখনই পৌঁছে গিয়েছিল আরণ্যকের কানে। অনন্যার চিৎকার শুনে খেই হারিয়ে ফেলেছিলো আরণ্যক। আরণ্যকের মাথাটা শূন্য হয়ে গিয়েছিল ইতিমধ্যে। বুকের ভেতর ধুকপুক বন্ধ হয়ে আসলো। প্যাকেট ফেলে উন্মাদের মতো ছুটে এলো বাইরে।

আর তারপর! তারপর চোখের সামনে পড়লো এক জটলা, মানুষের ভীড়। জটলার ফাঁকে একটু হলেও অনন্যার ভেজা রক্তমাখা শরীর দূর থেকে চোখে পড়ছে। রাস্তার মাঝে অনন্যা পড়ে আছে। একপাশে ছড়িয়ে আছে একটা ভাঙা মোবাইল। অনন্যার স্কার্ফের এক অংশ কাঁদায় মাখামাখি হয়ে রাস্তার ওপাশে গড়িয়ে পড়েছে।

চারপাশে মানুষ জড়ো হচ্ছে। কেউ কেউ ভয় আর আতঙ্কে চেঁচাচ্ছে।

আরণ্যকের পুরো শরীর জমে গেছে। ভিজে একাকার অবস্থা। তার উপর চোখ দুটো লাল হয়ে এসেছে।
"না না না না!"

আরণ্যকের কিছুই বিশ্বাস হচ্ছে না। সে হাঁটতে চাইল, অনন্যার কাছে ছুটে যেতে চাইলো। কিন্তু ওর পা দুটো জমে গেছে। শরীরের রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে আসছে। গলার ভেতর আটকে থাকা একটা আর্তনাদ বাইরে বেরোনোর পথ খুঁজছে। কিন্তু তার ঠোঁট নড়ছে না। আরণ্যকের চোখ দুটো বন্ধ বন্ধ হয়ে আসতে লাগলো।

রাতের শহর তখন ধীরে ধীরে নিস্তব্ধ হয়ে আসছে। কক্সবাজার থেকে ফিরে কৌশিক সোজা চলে এসেছে অনন্যার মায়ের দেওয়া ঠিকানায়। অনন্যা স্যারকে একবার বলেছিল শুধু। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি যে চলে আসবে, তা ভাবেনি। অনন্যার ধারণা ছিল, রাত হয়ে যাবে বলে হয়তো কৌশিক স্যার সিদ্ধান্ত বদলাবে। কিন্তু লোকটা আসলেই চলে আসবে কে জানতো।

দরজার ঘণ্টা বাজতেই অনন্যার মা দরজা খুললেন। প্রথমে একটু হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন। এই রাত করে যে দুজনে তার কথা রাখতে এসে পড়বে তিনি একবারও ভাবেননি। আগে জানলে না খেয়ে বসে থাকতো। তবে তিনি মুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিলেন , ঠোঁটে উষ্ণ হাসি দিলেন।

"এসো, এসো। ভেতরে এসো।"

অনন্যার মা দুজনকে রুমে বসালেন। কৌশিককে ফ্রেশ হওয়ার সুযোগও দিলেন। এতো রাত করে আসার জন্য অনন্যা একটু ইতস্তত করছিল। কিন্তু তার মায়ের স্বাভাবিক আচরণ দেখে কিছু বলার সুযোগ পেল না। অনন্যার মা হুট করে এত এত খাবার বের করে আনলেন! অনন্যা বুঝতে পারলো এই খাবার তৈরির জন্য সেই সকাল থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলেন উনি। রান্নার সুগন্ধে ঘরটা ভরে গেলো।

"এসো, খেতে বসো।"
অনন্যার মা হাসিমুখে বললেন। দুজনকে খাবার টেবিলে বসিয়ে দিলেন।

বিশেষ করে কৌশিকের প্রতি তার আলাদা মনোযোগ। একটু পরপরই জানতে চাইছেন,
"এইটা খেয়েছো? এটা ভালো লাগছে তো? আরেকটু দিই?"

কিন্তু কৌশিক পল্লবীর কথায় একটুও বিরক্ত হচ্ছে না। বরং খুব শান্তভাবে, একদম ভদ্র মানুষের মতো, গুছিয়ে উত্তর দিচ্ছে। আর খাবার ঝাল হওয়া স্বত্ত্বেও স্যারের কোনো খারাপ প্রতিক্রিয়া নেই এই বিষয়টা আরো ভালো লাগছে অনন্যার ।

খাওয়া দাওয়ার শেষ পর্যায়ে পল্লবী মশকরা করে বলে উঠলেন,
"তা তোমাদের মাঝে কি ওরকম সম্পর্ক হয়েছে?"

অনন্যা থমকে গেলো। চামচ হাতে নিয়ে তাকিয়ে রইলো মায়ের দিকে। ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলো,
"ওরকম? মানে কী রকম? কী বোঝাতে চাইছো?"

পল্লবী চোখ গোল গোল করে হাসলেন। অনন্যার ভড়কানোকে উপভোগ করছেন তিনি।
"আরে মেয়ে, বিয়ে করেছিস, এখন সংসার করবি, বাচ্চা-কাচ্চার কথা ভাববি। এটা কি আমাকেই মনে করিয়ে দিতে হবে?"

এক গ্লাস পানি অনন্যার গলায় আটকে গেলো। সে কাশতে কাশতে গিললো। তাও মনে হলো গলা শুকিয়ে আসছে। চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেছে। মনে পড়লো, আজ সারাদিন কৌশিক স্যারের সঙ্গে কতটা একান্তে সময় কেটেছে। তারপর যদি মায়ের মুখে এসব কথা শুনে তাহলে কোন মেয়ের পক্ষে স্বাভাবিক থাকা সম্ভব?

কৌশিক স্যার একপাশে বসে হাসছিলেন। খাওয়া চালিয়ে যেতে যেতে একদম নির্লিপ্ত স্বরে বললেন,
"মাদার-ইন-ল, আপনার মেয়ে আমার আদর সহ্য করতেই হিমসিম খায়। তো, বাচ্চা নেওয়ার কষ্ট সহ্য করার মতো এত বড় একটা বিষয় নিয়ে আমি ছেলেখেলা করবো? উঁহু না।"

অনন্যার চোখ কপালে উঠলো। গরম পোলাও মুখে দিয়েছে। মুখ জ্বলছে কিন্তু এর চেয়ে কৌশিক স্যারের কথায় পুরো শরীরটা আগুনে পুড়ে যাচ্ছে। লোকটা এতো বদ! অনন্যা সাথে সাথে স্যারের হাত শক্ত করে চেপে ধরলো। মিনমিনিয়ে বললো,
"মায়ের সামনে এসব কী বলছেন?"

কৌশিক হাসিমুখে উত্তর দিলো,
"সত্যি কথা।"

পল্লবী বলে উঠলেন,
"ইশশশ! আমার মেয়েটা যে কবে একটু বড় হবে।"

অনন্যা বিরক্তিকর দৃষ্টি নিয়ে তাকালো। রাগী গলায় বললো,
"মা তোমার সমস্যাটা কি বলো তো? মানে প্রেম করেছি তখনো তোমার সমস্যা ছিল।বিয়ে করেছি তাতেও তোমার সমস্যা ছিল। এখন বাচ্চার কথা নিয়ে এসেছো। বলছো বড় হইনি? আগে জানলে তোমার কাছে বড় হওয়াটা শিখে নিতাম। তারপর দেখবো বাচ্চা কাচ্চা হলেও তোমার ঝামেলা হবে। "

কৌশিক একটানে অনন্যাকে কাছে টেনে নিলো। তারপর নিঃশঙ্ক চোখে পল্লবীর দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে বললো,
"ডোন্ট ওয়ারি, মাদার ইন ল। অনন্যাকে বড় হওয়াটা আমি শেখাবো। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।"

অনন্যা চোখ ঘুরিয়ে গরম চোখে তাকালো। কৌশিক বাঁকা হেসে চোখ টিপলো। পাশ থেকে পল্লবী শিকদার এই দৃশ্য দেখে মিটিমিটি হাসছেন। ওদের এই অনর্গল খুনসুটি দেখে মনটা ভরে উঠলো। বুকের গভীরে একটা প্রশান্তির অনুভূতি ছড়িয়ে পড়লো। দুচোখ ভরে দেখছিলেন মেয়ের এই সুখী মুখটা। যদি পারতেন নিজের স্বামীকেও দেখাতেন ওদের দুষ্টুমি। 

অনন্যা না পেরে বললো,
"স্যার, আপনি কিন্তু খুবই দুষ্টু হয়ে যাচ্ছেন! মা দেখছে! আপনি মায়ের সামনে কি করছেন এসব?"

কৌশিক মুচকি হেসে বললো, 
"আমার ক্লাসে কিন্তু দুষ্টুমি কমানো শেখানো হয় না।"

অনন্যা এক হাত দিয়ে লোকটার পেটে ঘুষি মেরে দিল। কৌশিক প্রতিউত্তর করলো না। সয়ে নিলো সবটা।
.
.
.
চলবে......................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp