কামিনী - পর্ব ১৮ - মম সাহা - ধারাবাহিক গল্প


          বেনামি বাতাস অগোছালো ভাবে ছুঁয়ে যাচ্ছে গা। রানি তাজ্জব নয়নে তাকিয়ে আছেন তার সামনে দাঁড়ানো অপরিচিত সেই পুরুষটির দিকে। অদ্ভুত সেই পুরুষের আপন করে নেওয়ার মতন সম্বোধন। চোখ কেন জ্বলজ্বল করছে পুরুষটির! নীলাভ মণির এই অসাধারণ চোখ রানি প্রথম দেখলেন। এমন অদ্ভুত নয়নের দিকে তাকালেই ঘোর লেগে যাচ্ছে বারে-বারে।
 পুরুষটি আবারও খানিকটা তাড়া দিয়ে বললেন, "সম্রাজী, আমাদের রওনা দিতে হবে। তাড়াতাড়ি চলবে কি?"

রানির ধ্যান ভাঙে। অযাচিত ঘোর তার আয়ত্তে নিয়ে আসেন। এবার চোখে-মুখে প্রকাশ করেন কাঠিন্যতা। কণ্ঠে মিশ্রিত ক্ষিপ্ততা নিয়ে বললেন, "কোন সম্পর্কে আমি আপনার 'তুমি' সম্বোধনের মানুষটি হয়েছি?"

সামনের পুরুষটি সেই প্রশ্নে সামান্য বিচলিতও বোধ করেন না। না হন অবাক। কেবল ঠোঁট কিঞ্চিৎ বাঁকিয়ে হেসে জবাব দিলেন, 
 "কোন সম্পর্কে 'তুমি' বলা যায়?"
 "আমার সাথে হেঁয়ালি করার আস্পর্ধা দেখানোর কথা ভাবছেন কীভাবে? ঘাড় থেকে এখুনি আপনার মাথাটা আমি আলাদা করে দিতে পারি, জানেন?"

 "জানি। রানি কামিনীকাঞ্চন সম্পর্কে এতটুকু বোধকরি পৃথিবীর সমস্ত মানুষ জানে। রানি প্রাণ নিতে প্রচণ্ড ভালোবাসেন।"

লোকটার গা-ছাড়া ভাবে রানির যেন বিস্ময় চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে যাচ্ছে। মূক হয়ে শুধালেন, "তবে স্বেচ্ছায় কেন প্রাণ শপে দিচ্ছেন?"

 "সম্বোধনে যদি প্রাণ যায়, না-হয় গেলো। আমি তোমাকে নিতে এসেছি, সম্রাজী। আমার সাথে তোমাকে যেতেই হবে।"

"কোথায় যাবো? আর কেনই-বা যাবো?"

 "যাওয়ার পর নাহয় জানলে।"

"যদি না যাই?" রানির ঠোঁটে এবার বাঁকা হাসি। বাকি ঘোড়া গুলো থেকে নামে দাঁড়ানো পুরুষগুলোর চোখ নামানো। কিন্তু তাদের অবস্থান থেকে নির্দ্বিধায় ধারণা করা যাচ্ছে যে, তারা রানিকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। কোনোভাবেই এখান থেকে রানিকে যেতে দিবে না।

 "যেতে হবেই যে!"
 "জোর দেখাচ্ছেন? আমাকে? আমি কারো আদেশ মানি না।"

লোকটি কথা বাড়ালেন না আর। অনায়াসেই এক হাঁটু গেড়ে বসে পড়লেন রানির পায়ের কাছটাতে। ডান হাত বুকের বাম পাশটাতে রেখে প্রায় নতজানু হয়েই বললেন, "অনুরোধ করছি, আদেশ নয়।"

 রানি এবার হত-বিহবল হয়ে গেলেন। ভাষা হারিয়ে ফেললেন। ভেবেছিলেন কোথায় তলোয়ার দিয়ে ছিন্নভিন্ন করে দিবেন সকলকে! অথচ এই পুরুষতো তলোয়ারের পরিস্থিতিই তৈরি করলেন না! অনুরোধের বিপরীতে আদতেও অ স্ত্র চালানো যায়? 
রানির হাতে দ্বিতীয় কোনো পথ নেই। বিকল্প নেই। হয়তো তলোয়ার চালিয়ে দিনি এই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করতে পারেন কিন্তু রানি তা করলেন না। জীবনে তিনি সবচেয়ে বেশি যেই বিষয়টিতে দুর্বল তা হলো, ভালো আচরণ। কেউ তাকে একটু ভালো আচরণ দেখালেই তিনি ভাষাহারা হয়ে যান। 
অবশেষে তর্কবিতর্ক স্থগিত করে রানি বললেন, "ঠিক আছে, চলুন।"

 সুঠাম দেহি পুরুষটির চোখ-মুখে তেমন কোনো পরিবর্তন দেখা গেলো না। তিনি রানিকে ঘোড়ায় বসতে বলে নিজেও বসলেন নিজের ঘোড়ায়। 
ততক্ষণে ধরণীতে নেমে এসেছে অন্ধকার। অপরিচিত পথটায় ঘোড়াগুলোর টগবগিয়ে চলার শব্দ ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছে না। রানির মনে তখন হাজারও প্রশ্ন থাকলেও তিনি এগিয়ে যেতে লাগলেন। দেখাই যাক না কী অপেক্ষা করছে সামনে! জীবনকে তিনি দেখেন নতুন ভাবে। নতুন একেকটি ঘটনা জীবনে কৌতূহল এবং নতুন করে বাঁচার আগ্রহ তৈরি করে দেয়। তাই তিনি সাগ্রহে গ্রহণ করেন নতুন কিছু। এই জীবনে ততদিন অব্দিই বেঁচে থাকা যায় যতদিন অব্দি উপভোগ্য কিছু থাকে। এবং রানি নিজের জীবনের প্রতিটা সেকেন্ড উপভোগ করতে জানেন। 

 ২৬.....

প্রভাতের সদ্য উদিত ভানুর কিরণ তখনও পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়তে পারেনি। ঘোড়ার অক্লান্ত পদচারণ এসে থেমেছে একটি রাজ্যের অভ্যন্তরে। সবাই প্রায় ঝিমিয়ে এলেও রানির চোখে-মুখে নেই অবসন্নতার কোনো রেশ। 
 রাজ্যটিতে প্রবেশ করেই রানির চোখগুলো বিস্ময়ে বড়ো হয়ে গেলো। তিনি থামিয়ে দিলেন নিজের ঘোড়াটিকে। তার ঘোড়া থামতেই থেমে গেলো বাকি ঘোড়াগুলোও। নীলাভ মণির অধিকারী পুরুষটি বাকিদের যাওয়ার অনুমতি দিয়ে নিজের ঘোড়াটিকে দাঁড় করালেন রানির ঘোড়াটির সাথে। রানি কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে তাকিয়ে থেকে তাজ্জব কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়লেন,
"ক্যামিলাস রাজ্য না? ক্যামিলাস রাজ্যে কেন?"

ঘোড়ায় বসা লোকটি নিরবে নিভৃতে তাকিয়ে রইলেন৷ কোনো উত্তর দিলেন না। এমনকি টু শব্দটুকুও করলেন না। 
 রানিকে বিচলিত দেখালো। তিনি প্রায় রেগেই বললেন,
"আমাকে ক্যামিলাস রাজ্যে কেন আনা হয়েছে? আর আপনিই-বা কে? আমি তো আপনাকে এই রাজ্যে এসে দেখিনি তখন। কোন উদ্দেশ্যে আমাকে এনেছেন?"

পুরুষটি গম্ভীর রইলেন। গম্ভীর কণ্ঠেই জবাব দিলেন, "রাজ মহলে চলো। উত্তর পাবে।"

 "আমি রাজ মহলে যাবো না। রাজ মহল তো দূর, আমি এই রাজ্যেই আসতে চাইনি দ্বিতীয়বার। আপনার সাহস কীভাবে হলো আমাকে এখানে আনার? রানি কামিনীকাঞ্চন একবার যা মনস্থির করে তা আর পরিবর্তন করে না।"

"মাঝে মাঝে পরিবর্তন করতে হয়।"

 "আপনি আমাকে বলবেন, আমি কী করবো না করবো?"

 "প্রয়োজন হলে বলবো!" পুরুষটির কথার ভঙ্গিমা বদলে গেলো। কর্কশ শোনালো কণ্ঠধ্বনি। এই বদলে যাওয়া কণ্ঠ রানিকে আরও বোকা করে দিলো। কিন্তু সেই বোকা ভাব কয়েক সেকেন্ডই তার ভেতর স্থায়ী ছিলো। অতঃপর তিনি ধারণ করলেন রণমুর্তি। ঘোড়া থেকে আক্রোশ নিয়ে নেমে দাঁড়ালেন। পিঠের পেছন থেকে বের করলেন তলোয়ার। 
তৎক্ষণাৎ নেমে দাঁড়ালেন পুরুষটিও। 
রানি তলোয়ার নিয়ে এগিয়ে যান আক্রমণের জন্য। ফেঁটে পড়েন ক্রোধে। 
 "আমি আপনার সকল ধরণের হেঁয়ালিপনা ক্ষমা করেছি মানে এই নয় আপনি আমাকে প্রতারিত করবেন। রানির শাস্তি কত ভয়ঙ্কর আপনার ধারণাতেও নেই।"

"আর তোমারও ধারণাতে নেই, সম্রাজী, আমি কী কী করতে পারি।"

রানি এবার আচমকাই তলোয়ারের একটি আঁচড় বসিয়ে দিলেন পুরুষটির ডান বাহুতে। হুংকার দিয়ে বললেন, "রানি কামিনীকাঞ্চন কারো ধারণার ধার ধারে না। আমার ইচ্ছের রাজা আমি। সেই ইচ্ছে কারো দাসত্ব মানে না এমনকি কল্পনাও করে না।"

 পুরুষটি চেপে ধরে আছেন নিজের বাহুটি। ঠোঁট কামড়ে সামলানোর চেষ্টা করলেন নিজের যন্ত্রণা। অস্ফুটস্বরে বললেন,
"নরম অনুরোধের সমঝোতা আর দাসত্ব এক নয়।"

 "নরম অনুরোধ! কোনটা নরম অনুরোধ? আমাকে আমার মনস্থির করা কথা ভাঙতে বাধ্য করার আপনি কে?"
পুরুষটি এবার তলোয়ার বের করলেন। কণ্ঠে জোর দিয়ে বললেন, "প্রাসাদে তোমাকে যেতেই হবে, সম্রাজী।"

রানি তেজস্বী ভঙ্গিতে উঠে বসলেন নিজের ঘোড়ায়। একরোখামি ভাব তার। কেন যেন মনে হলো বিপদে ফেঁসে যাবেন হয়তো। কিংবা রাজা হ্যাভেনের প্রাসাদে পা দেওয়া মানে নিজের হার। তিনি গর্বের সাথে মাথা উঁচু করে গিয়েছিলেন এই রাজ্য ছেড়ে। তাহলে কেন তিনি অকারণে এই রাজ্য কিংবা রাজপ্রাসাদে যাবেন!

 রাজ ঘোড়াটির দড়ি টেনে ধরল পুরুষটি। জেদি কণ্ঠে পুনরায় বললেন, "তুমি রাজ্য ছেড়ে যেতে পারবে না, সম্রাজী। তাই সে চেষ্টা করে লাভ নেই।"

"আমাকে কে আটকাবে, আমিও দেখি।" কথাটি শেষ করেই যেই রানি ঘোড়ার লাগাম ধরতে নিবেন তখনই পুরুষটি রানির বা'হাতের কবজি চেপে টেনে ধরেন। এতে রানি সামান্য ঝুঁকে যান। এবং তখনই সেই পুরুষটি রানির গলা ও মাথার সংযোগস্থলে সামান্য চাপ দেন। ঘটনাটা এতই দ্রুত হলো যে রানি কিছু বুঝে উঠতে পারলেন না। তার আগেই চেতনা হারিয়ে ফেললেন। নিরবেই ঢলে পড়লেন পুরুষটির বুকে। যদিও প্রচন্ড স্থির রাখার চেষ্টা করেছিলেন রানি নিজেকে কিন্তু পারলেন না। তেজস্বী নারীটি লুটিয়ে পড়লেন সাথে সাথে। 
 রানির সেই নীরব মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে পুরুষটি যেন কী বিড়বিড় করলেন। ছুটন্ত পবন ছাড়া তা শোনার সাধ্যি কারো হলো না। 

—————

          সুন্দর সুগন্ধী গাঢ় নিদ্রার মাঝেও রানির নাকে এসে লাগলো। কোনো অপরিচিত ঘ্রাণ। তবে রানি চেয়েও নিজের আঁখি দু'টো মেলে তাকাতে পারলেন না। নিজের দেহটিকে ভীষণ ভারী মনে হলো। যেটা টেনে তুলবার শক্তিও তিনি নিজের মস্তিষ্কে জাগিয়ে তুলতে পারলে না। কিন্তু তিনি এই গভীর অজ্ঞান অবস্থাতেও অনুভব করলেন আশেপাশে কারো উপস্থিতি। রানির এই দৃঢ় মস্তিষ্ক যে এত সহজে হার মানতে পারে না। 

 ২৭.....

গোধূলি তখন কেবলই লুটিয়েছে ধরায়। আশপাশ থেকে ভেসে আসছে নানা পাখিদের গুঞ্জন। রানি নিজের ভারী চোখের পাতা গুলো প্রচণ্ড চেষ্টায় খুলতে সক্ষম হলেন৷ মাথা প্রচণ্ড ভার হয়ে থাকা সত্ত্বেও তিনি উঠে বসলেন। আধো অন্ধকার কক্ষটিতে বসে প্রথমেই তিনি বুঝে উঠতে পারলেন না নিজের অবস্থান। যখন একটু ধাতস্থ করলেন নিজেকে তখনই একে একে মনে পড়ে গেলো সকল ঘটনা। ছলের আশ্রয় নিয়ে তাকে এই জায়গা অব্দি যেই পুরুষটি এনেছেন, তার উপর রানির প্রবল ক্ষোভ জমে গেল। তিনি এক ঝটকায় উঠে দাঁড়ালেন। কক্ষটির চারপাশে চোখ বুলাতে বুলাতে অনুভব করলেন অপরিচিত কক্ষ এটি। তবে সাজগোছের বাহার দেখে অনায়াসেই বুঝা যায় রাজপ্রাসাদের ভেতরেই আছেন তিনি।
 রানির ভাবুকতার ছন্দে পতন ঘটিয়ে কক্ষে কারো প্রবেশ ঘটলো। নিবিড়, কোমল উপস্থিতি। রানি চোখ তুলে তাকাতেই দেখলেন তার সামনে দাঁড়ানো নীল চোখের পুরুষটি। ঠোঁটে নিখুঁত হাসি। দাম্ভিক স্বরে প্রশ্ন করলেন রানিকে, "খাবে কী, সম্রাজী?"

ছলনার আশ্রয় নেওয়া যে-কোনো মানুষকেই রানির চক্ষুশূল মনে হয়। নীল চোখের মানবটিও তাই সেই শূলের বাহিরে নয়। এবং তার উপস্থিতি রানিকে অসহ্য রকমের বিক্ষিপ্ত করে তুলল। তিনি চারপাশ হাতড়ে নিজের তলোয়ারটি খুঁজতে আরম্ব করলেন। এবং সেই মুহূর্তে মানবটি নিজের পিঠের পেছন থেকে তলোয়ারটি বের করে রানির সামনে ধরে জিজ্ঞেস করলেন, "এটা খুঁজছ?"

 রানি চোখ তুলে তাকালের। কাঙ্ক্ষিত বস্তুটি পেতেই ক্রোধে ফেটে পড়ে বললেন, "হ্যাঁ। আপনি আমার তলোয়ার ধরেছেন কোন সাহসে? ভয় নেই অন্তরে?"

"যেই আস্ত্রের বাণ মারলে অঙ্গে, সেটি দেখলে কি আর নতুন করে ভয় লাগবে, বলো? এটা ধরতে আর মোটেও সাহসের প্রয়োজন নেই।"

রানি আর অপ্রয়োজনীয় বাক্য ব্যয় করলেন না। তীব্র শীতল কণ্ঠে বললেন, "আমার বস্তু আমাকে ফেরত দিন।"

 "দিবো, তবে বলো কী ভোজন করতে চাও?"

রানি ক্রুদ্ধ হলেন, "তোমার প্রাণ চিবিয়ে খেতে চাই।"

হেসে দিলো মানবটি, "হেমলক পিয়ার্সের প্রাণ তুমি খেতে পারবে তো, কামিনী?"

 "কামিনী? রানি কামিনীকাঞ্চন আমি।"

 "তুমি রানি কামিনীকাঞ্চন তা আমি বললেও হবে, না বললেও হবে। নামের শুভারম্ভে রানি শব্দটির প্রয়োজনীয়তা আবশ্যক কি?"

"অবশ্যই আবশ্যক। রানি শব্দটি আমাকে সম্মান প্রদর্শন করে। অবশ্য যেচে সম্মান আমি নিতে চাই না কখনো। তা-ও তোমার মতন কাপুরুষের থেকে তো নয়ই, হেমলক পিয়ার্স।"
রানির তাচ্ছিল্য করা বাক্যে মোটেও বিচলিত দেখালো না হেমলককে। তিনি তারা ভাবগাম্ভীর্যতা যথাযথভাবে বজায় রাখলেন। লোকটি অত্যন্ত চতুর বলেই রানির কথা তাকে প্রভাবিত করতে পারল না। তিনি বরং কথার মোড় সম্পূর্ণ ঘুরিয়ে বললেন,

"সম্রাজী, তোমাকে আমার সাথে আরেকটি কক্ষে যেতে হবে।"

 রানি বিপরীতে জানতে চাইলেন না মোটেও যে, কোন কক্ষটিতে তিনি যাবেন। কারণ এটা শত্রু রাজ্য। তার আশেপাশে কেউ-ই নেই যে তাকে সাহায্য করবে। তাই নিজের সাহায্য নিজেকেই করতে হবে বলেই তিনি মনস্থির করলেন। 
 বেশ ধীর কণ্ঠে বললেন, "কোন কক্ষে?"
হেমলক পিয়ার্স একটু ভড়কালেন বোধহয়। কিছুটা বিস্ময় দেখা গেলো তার বাহ্যিক অঙ্গভঙ্গিতে। তিনি হয়তো ভেবেছিলেন এবারও রানি পিছু পা হবেন। যাবেন না বলে বাকবিতন্ডায় লিপ্ত হবেন। কিন্তু তার কিচ্ছুটি হলো না। বরং তিনি বেশ সাবলীল ভাবেই রাজি হয়ে গেলেন। সম্মতি দিলেন যাওয়ার জন্য। 

হেমলক নামের পুরুষটিও আর কথা বাড়ালেন না। রানিকে পথ দেখিয়ে হাঁটা আরম্ভ করলেন। 
 এর আগে এসেছিলো বলে রানির কাছে পরিচিতই এই রাজপ্রাসাদটি। তবুও ভেতর ভেতর তার শঙ্কায় আচ্ছন্ন লাগছিলো। তিনি নিজের রাজপ্রাসাদে নেই অনেকক্ষণ হলো। যদি রাজ্যে কোনো সমস্যা হয়? হ্যাব্রোরও তো শান্তিপূর্ণ হয়নি। আজ সাতদিন পূর্ণ হবে। আগামীকাল হ্যাব্রো প্রাসাদে ফিরবে। তখন রানিকে দেখতে না পেলেই খোঁজ শুরু হবে। আচ্ছা, হ্যাব্রো কি আদৌ জানতে পারবে যে তাদের রানি ছলায় আটকে গিয়েছে? শত্রুর রাজ্যে তার আগমন ঘটেছে? 
নিজের মনের ভেতর রানির থেকে-থেকে কত কথার উঁকি দিলো। তবুও বাহিরে তিনি রইলেন অটল। তাকে বুঝার উপায় নেই যে, ভেতর-ভেতর কত আশঙ্কায় তিনি বিচলিত। 

 রাজপ্রাসাদের দাস-দাসীরা বেশ বিস্ময়বিমূঢ় হয়েই রানিকে অবলোকন করছে। কারণ পূর্বের সব ঘটনাই তো তারা অবগত। রানির সেই অতি গর্বিত মুখমণ্ডল, অহংকারে পরিপূর্ণ লাস্যময়ী দেহ কি এত সহজে তারা ভুলতে পারবে? কখনোই নয়। যেই রানির কাছে তাদের রাজা হেরে গিয়েছিলের বাজে ভাবে। তারপর....
কতকিছুই ঘটে গিয়েছে তারপর। এই রানিকে ভুলতে পারবে আদৌ তারা! 
রানি দাসদাসীদের এমন হতবিহ্বল মুখশ্রী দেখে খানিক নিশ্চিন্ত হলেন। যেহেতু এতগুলো দাসদাসী তাকে দেখেছে সেহেতু রানি যে এই রাজপ্রাসাদে অবস্থান করছেন তা কারো না কারো মাধ্যমে এ্যাজেলিয়া রাজ্যে ঠিক পৌঁছাবে। 

অবশ্য কাঙ্ক্ষিত কক্ষটির সামনে এসে দাঁড়ালেন হেমলক। রানি খেয়াল করলেন কক্ষটির বাহিরে কেবল তিনি এবং হেমলক নয় রয়েছেন রাজমাতা প্রাচী, রাজকন্যা লিলি, রানি ইথুনসহ আরও বেশ কয়েকজন। যাদের রানি চিনেন। 
 কিছুটা বিব্রতবোধ করলেন রানি। এই মানুষগুলোর সামনে কখনো দাঁড়ানোর কথা ভাবেননি যে তাই অস্বস্তিতে তার গা ভার হয়ে গেলো। হেমলক পিয়ার্স কিছু সময় মৌন থেকে অতঃপর বললেন, 
"তোমাকে এই কক্ষটির ভেতর প্রবেশ করতে হবে, সম্রাজী। এই কক্ষের ভেতরের মানুষটির সাথে তোমার কথা বলতে হবে।"

রানি প্রশ্ন করলেন, "কে আছে এই কক্ষে?"
 কিন্তু উত্তর দিলো না কেউ। রাজমাতার পদ্ম পুকুরের মতন জল থৈথৈ চোখ গুলোতে হয়তো উত্তর আছে। তবে সেই উত্তর স্বচ্ছ হলো না রানির কাছে। মহিলাটির চোখগুলো আজ এমন অসহায় কেন? এই রাজ্যে, রাজপ্রাসাদে কি কিছু হলো?
রানির অন্তরে সদ্য উদিত প্রশ্নের উত্তর নেই। তিনি কারো কাছে প্রশ্নটি খুলেও বললেন না। উত্তরও চাইলেন না। ধৈর্য ধরলেন কেবল। কারণ আর কিছু মুহূর্তের ব্যবধানেই সকল প্রশ্নের উত্তর যে তার কাছে চলে আসবে। তাহলে একটু ধৈর্য ধরতে ক্ষতি নেই। 
 আজ রানি ইথুনের মুখটিও শক্ত। রানির প্রতি একটি বিতৃষ্ণার ভাব সেই মুখে। রানি আর অপেক্ষা করলেন না। প্রবেশ করলেন কক্ষটিতে। 

 ২৮......

কক্ষটিতে যৎসামান্য আলো আছে বলা যায়। চারপাশে নিগুঢ় নিস্তব্ধতা রহস্যের জাল বুনন করছে যেন। 
রানির ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় খুব করে জানান দিলো আশেপাশে কিছু একটি বিপদ আছে। বিপদের ঘ্রাণ রানির কাছে স্পষ্ট। 

এবং রানির ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের ধারণা সত্যি করে দিয়ে একটি দেহ ঝাপিয়ে পড়ল রানির উপর। আকস্মিক পুরুষালি দেহের এমন আক্রমণে রানি পথভ্রষ্ট হলেন। এরপর চ্যাঁচিয়ে উঠলেন সঙ্গে সঙ্গেই। নিজের ঘাড়ে অনুভব করলেন ভীষণ তীর্যক ব্যথা। কেউ কামড়ে ধরেছে। রানি তলোয়ারের খোঁজ করতেই তার মাথায় এলো, তলোয়ারটি হেমলকের কাছ থেকে তিনি নেননি আর। নিজের হটকারিতায় আজ তিনি নিজেকে অসহায় অনুভব করলেন। চোখের কোণায় কিছু অতীত তখন পুনর্জাগরণ হচ্ছিলো। সেই অন্ধকার কক্ষ, সেই দানবীয় পুরুষালি শরীর, সেই পশুর ন্যায় ঝাঁপিয়ে পড়া সবই তার জীবনে এর আগে ঘটে গিয়েছে। এই সর্বনাশা দৃশ্য নতুন নয়। কিন্তু আজ তো নিজেকে বাঁচানোর ক্ষমতা তার আছে। 

 আকস্মিক ঘটনার রেশ কাটিয়ে রানি ঝাঁপিয়ে পড়া লোকটিকে জোরে ধাক্কিয়ে সরালেন। আলো-ছায়ার খেলা জমানো কক্ষের ডান দিকে থাকা আরশিতে তার নজর যেতেই তিনি ছুটে গেলেন সেখানে। হাতের বলিষ্ঠ বলপ্রয়োগে ভেঙে ফেললেন আরশিটা। এবং সেখান থেকেই একটি কাঁচের টুকরো তুলে নিলেন। এবং প্রহার করার পূর্ব মুহূর্তেই তিনি খেয়াল করলেন আক্রমণ করা মানুষটি আর কেউ নয়, রাজা— হ্যাভেন। এবং সেই মানুষটির এ কী হাল! চুল গুলো এলোমেলো, পোশাক ছেঁড়া। 
 রানির কাঁচের টুকরো ধরে রাখা হাতটিও পেছন থেকে একজন ধরে নিয়েছেন। পেছনে তাকিয়ে দেখলেন এ আর কেউ নয়, হেমলক পিয়ার্স। রানি তখন একই সাথে হতবিহ্বল এবং রাগান্বিত। কী হচ্ছে তার সাথে তা বুঝেই উঠতে পারলেন না যেন। 

হেমলক পিয়ার্স তখন পেছন থেকে বলছেন— হ্যাভেন, শান্ত হও। তোমার কাছে রানি কামিনীকাঞ্চন এসেছেন। তুমি তাকে আক্রমণ করো না। এই তো, সে তোমার সামনেই। 
 হেমলক পিয়ার্সের কথা মনযোগ সহকারে শুনে সত্যি সত্যি শান্ত হলো হ্যাভেন। এবং রানিকে ভালো মতন খেয়াল করেই গিয়ে জাপ্টে ধরল। রানির হাতে তখনও কাঁচের টুকরোটি। অথচ তিনি প্রহার করবেন না প্রেম দেখাবেন বুঝেই উঠতে পারলেন না। এই প্রথম রানি বোধহয় সংশয়ে ভুগলেন। 
·
·
·
চলবে....................................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp