মেহুল ফোন বের করে গুগলে ওষুধের নামটা সার্চ করতে যাবে ঠিক তখনই আচমকা দুটো হাত চিলের মতো ছোঁ মেরে সিরিঞ্জ সহ শিশি আর ফোনটা কেড়ে নিল! হঠাৎ এমন ঝটকা খেয়ে মেহুল আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল। পাশ ফিরে তাকাতেই তার শরীর জমে যাওয়ার উপক্রম। শেরাজ দাঁড়িয়ে আছে। রাগে ফুঁসছে। চোখদুটো ধাঁধিয়ে উঠেছে, চোয়াল শক্ত, রাগের কারণে নাকের পাটা দ্রুত ফুলে-ফুলে উঠছে। চোখে এমন একটা দৃষ্টি, যেন মুহূর্তের মধ্যে সব কিছু ধ্বংস করে দিতে পারে। মেহুল আর আকলিমা দুজনেই মুহূর্তের মধ্যে গুটিয়ে গেল। শেরাজ অনেকটা রাস্তা চলে গিয়েছিলো কিন্তু মাঝ পথে কিছু একটা মনে পরতেই বাড়ি ফিরে এলো। আর ফিরে এসেই দেখলো এই ঘটনা।
শেরাজ গম্ভীর অথচ দাবানলের মতো জ্বলতে থাকা কণ্ঠে বলল, "কি করছিস তোরা?"
কেউ কোনো উত্তর দিল না। শেরাজ এবার চেঁচিয়ে উঠল, "কথা বলছিস না কেন?"
শেরাজের চিৎকারে বাড়িটা কেঁপে উঠল যেন। রান্নাঘর থেকে দ্রুত পায়ে এগিয়ে এলেন শাহানা বেগম, "কী হয়েছে রাজ? এত চিৎকার করছিস কেন?"
শেরাজ ঘুরে তাকিয়ে কটমট করে বলল, "মা তুমি রান্নাঘরে যাও!"
শাহানা বেগম থমকে গেলেন। "কিন্তু..."
"প্লিজ মা, তুমি যাও!"
ছেলের চোখের ভাষা বুঝতে দেরি হলো না। তিনি জানেন, ছেলে যখন রেগে থাকে তখন বাড়তি কিছু বলার মানে হলো আরও বড় বিস্ফোরণ ডেকে আনা। তাই কিছু না বলেই ফিরে গেলেন। আর যা হচ্ছে হোক না। নিশ্চয়ই এই মেহুল কিছু একটা করেছে।
শেরাজ এবার হাতের জিনিসগুলো উঁচিয়ে ধরে আকলিমার দিকে তাকাল, "এগুলো কোথায় পেয়েছিস?"
আকলিমা ভয়ে ভয়ে বলল, "ত-তোমার খাটের নিচ পরিস্কার করতে গিয়ে পেয়েছি..."
শেরাজ ঠান্ডা গলায় বলল, "তো খাটের নিচ পরিস্কার করেছিস?"
"হ্যাঁ..."
শেরাজ ঘাড় কাত করে বলল, "ভালো করে পরিস্কার করেছিস?"
"হ্যাঁ.."
শেরাজ ধীর কিন্তু তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল, "গুড! কিন্তু আজ থেকে, এই মুহূর্ত থেকে, আমার রুম পরিস্কার করার কোনো দরকার নেই তোর বুঝলি? আমার রুম দরকার পরলে একটা ময়লার স্তূপে পরিণত হবে। তাও সেই ময়লার স্তূপ তুই পরিস্কার করবি না।"
আকলিমা বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইল। শেরাজ আবার বলল, "বুঝেছিস আমার কথা?"
আকলিমা দ্রুত মাথা কাতিয়ে বলল, "হ্যাঁ, বুঝেছি..."
শেরাজ এবার কড়া আদেশ দিল, "যা! আর মা যদি কিছু জিজ্ঞেস করে বলবি — রাজ ভাইয়া কিছু বলতে না করেছে। মনে থাকবে?"
আকলিমা ফ্যাকাশে মুখে দ্রুত মাথা নেড়ে দৌড়ে নিচে চলে গেল। শেরাজ এবার ধীর গতিতে ফোনের স্ক্রিনে তাকালো। গুগলে কি সার্চ দেওয়ার চেষ্টা করছিল মেহুল তা দেখতে লাগল সে। চোখের কোণে একটুখানি তির্যক হাসি খেলে গেল।
মেহুল শেরাজের পাশ কেটে কয়েক কদম এগিয়ে যেতেই শেরাজ পেছন থেকে গম্ভীর কণ্ঠে আদেশ ছুড়ে দিল, "দাঁড়া, দাদার নাতনি!"
মেহুল টান টান হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। শেরাজ ভাইয়ের মুখে দাদার নাতনি ডাকটা শুনে অবাক হলো। এই দাদার নাতনি ডাকটা কি তাকে সম্বোধন করে ডাকা হলো? নাকি অন্য কেউকে ডাকল কিন্তু আর তো কেউ নেই এখানে। আর শেরাজ তো তাকে এমন ডাকে, কখন ডাকে নি! তাহলে হঠাৎ আজ কেন? শেরাজ মেহুলের মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়। মেহুল আড় চোখ একবার তাকিয়ে নজর নিচু করে ঢোক গিলল। শেরাজ হাত বাড়িয়ে তার ফোনটা এগিয়ে দিল, "নে তোর ফোনটা।"
মেহুল ফোনটা নিলো। শেরাজ ফোন দিয়ে চলে যেতে নিবে তখনই থেমে গিয়ে বলল, "আরেকটা কথা দাদার নাতনি, তুই আবার এটা ভাবিস না যে আমি নিজে থেকে তোকে হাসপাতালে নিয়ে গেছি। নেহাত দাদা ভাই বলেছিল, তাই নিয়ে গিয়েছিলাম। না হলে আমার পা জীবনে যেতো না।"
মেহুল নরম দৃষ্টি ফেলে শেরাজের দিকে তাকালো। শেরাজ এই দৃষ্টির ভাষা খুব ভালো করে বুঝতে পারছে। শেরাজ ভেতরে ভেতরে নিজেই নিজেকে বলল।
"আমার পা জোড়া সারা জীবন তোর দিকেই এগিয়ে থাকবে মেহুল... যখনই সুযোগ পাবো তখনই তোর নিকট আমি এসে হাজির হবো সে যত বাঁধাই আসুক মাঝ পথে। আমি সব বাঁধা অতিক্রম করব।"
মেহুল শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে নিচু গলায় বলল, "তোমাকে নানা ভাই বললেই যে সব কাজ করতে হবে, এমনটা তো নয়। আর হাসপাতালে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন ছিলো না আমি একদম ঠিক ছিলাম। আগ বাড়িয়ে আমার উপকার করার কোনো দরকার ছিলো না।"
কথা বলে মেহুল এক মুহূর্ত না থেকে পা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলে গেল নিজের রুমের দিকে। শেরাজ ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। দাদা ভাই তাকে মেহুলকে নিয়ে হাসপাতালে যাওয়ার কথা কখনো বলে নি বরং দাদা ভাই তাকে মেহুলের থেকে দূরে থাকতে বলেছেন। কিন্তু শেরাজ কি আর মেহুলের থেকে দূরে থাকতে পারে? পাঁচটা বছর থেকেছে তো দূরে আর কত থাকবে এবার নয় হয় কাছাকাছি আসা হোক। কিন্তু কাছাকাছি এই দুটি মানুষ আসলে সারাটা জীবন কি আদৌ কাছাকাছি থাকতে পারবে নাকি হারিয়ে যাবে কোনো একজন বহু দূর।
—————
মেহুল নিজের ঘরে ঢুকে ধীর পায়ে হেঁটে বিছানায় গিয়ে বসে। ব্যাগটা পাশে রেখে দীর্ঘশ্বাস টেনে নেয়। শেরাজ ভাই নানা ভাইয়ের কথা রাখার জন্য তাকে নিয়ে হাসপাতালে গিয়েছিলো। অথচ সে কিনা ভেবে বসে ছিলো শেরাজ ভাই নিজে থেকে তাকে নিয়ে হাসপাতালে গিয়েছে। মেহুলের ঠোঁটের কোণে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠে। শেরাজ ভাই আর তাকে নিয়ে চিন্তা করে না। কিন্তু ওপর দিকে মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে ওই ওষুধের নামটা বার বার। কিসের ওষুধ ওটা? আর শেরাজ ভাই এতোটা রিয়েক্ট করলো কেন? কী এমন ছিল ওষুধটা, যার কারণে শেরাজ এতটা হাইপার হয়ে গেল? জানতে হবে...। মেহুল দ্রুত ফোন ওন করে গুগলে ঢোকে। হাত কাঁপছে সামান্য, মেহুলের ওষুধের নামটা স্পষ্ট মনে আছে। গুগলের সার্চ বারে টাইপ করে সে সার্চ দিল। ফোনের স্ক্রিনে যা ভেসে উঠল, তাতে যেন মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠল। এটা সত্যি? নাকি ভুল দেখছে? সে আবার সার্চ দিল। যেন বিশ্বাস করতে চাইছে না। আগের মতোই রেজাল্ট এল। মেহুল বিড়বিড় করে ওঠে।
"শেরাজ ভাই ড্রা গ নেয়।"
কিন্তু পরক্ষণে মাথা নেড়ে বলতে শুরু করলো, "না, না... এটা হতে পারে না। শেরাজ ভাই এসব কী করে? নিশ্চয়ই আমি বানান ভুল লিখেছি! তাই উল্টাপাল্টা জিনিস আসছে!"
মেহুলের গলা শুকিয়ে আসে। ঠোঁট জোড়া ভিজিয়ে আবার গভীরভাবে শিশির গায়ে ঠিক কী লেখা ছিল চোখ বন্ধ করে যতটা সম্ভব মনে করার চেষ্টা করে। তারপর ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকায়। না, ভুল কিছু লিখে নি। সব ঠিক সব। বানান ভুল নয়। মেহুল যেন ধোঁয়াশার ভেতরে পড়ে গেলো। সবকিছু আবছা লাগছে। কিন্তু এই ধোঁয়াশা কাটাতেই হবে যে করেই হোক না হলে যে শান্তিতে থাকতে পারবে না। কিন্তু এটা যদি সত্যি হয় তাহলে...।
—————
আকলিমাকে রান্না ঘরে আসতে দেখে শাহানা বেগম প্রশ্ন করলেন, "কি রে কি হয়েছে? রাজ এভাবে চিৎকার চেঁচামেচি করলো কেন?"
আকলিমা ভয়ে ভয়ে বলল, "আমি কিছু না।"
শাহানা বেগম কপট রেগে বললেন, "মানে তুই কিছু জানিস মানে কি? তুই তো ওখানেই ছিলি তাহলে জানিস না কেন?"
আকলিমা ঢোক গিলে বলল, "রাজ ভাইয়া না করেছে আপনাকে কিছু বলতে।"
"তুই আমায় বল রাজ কিছু জানবে না।"
"না বাবা রাজ ভাইয়া যা রাগী যদি জানে আপনাকে বলেছি তাহলে আমার খবর আছে।"
বলেই কাজে লেগে পড়ে। শাহানা বেগম বুঝলো এই মেয়ের পেট থেকে কিছু বের করা যাবে না।
—————
দিন গড়িয়ে রাত নেমেছে। রাতও গভীর হচ্ছে ধীরে ধীরে। চারপাশ নিস্তব্ধ, কিন্তু মেহুলের মনের মধ্যে একটুও শান্তি নেই। রাত যতই বাড়ছে, মেহুলের অস্থিরতাও ততই বাড়ছে। রাতে খাওয়ার সময় বারবার আড়চোখে শেরাজের দিকে তাকিয়েছে সে—আড়ালে আবডালে, যেন শেরাজের চোখের ভাষা বোঝার চেষ্টা করছে। কখনো শেরাজের কাছে ধরা পড়েছে, কখনো বা ধরা পড়ে নি।
মেহুল শুনেছে যারা ড্রা গ নেয় তাদের চোখ লাল হয়ে থাকে। কিন্তু শেরাজ ভাইয়ের চোখ তো লাল নয়, একদম স্বাভাবিক। তাহলে কি শেরাজ ভাই ড্রা গ নেয় না? কিন্তু আকলিমা যে ড্রা গ নেওয়ার শিশি পেয়েছে শেরাজ ভাইয়ের রুমে, তাহলে? মেহুল দোটানায় পড়ে যায়।
মেহুল ঘড়ির দিকে তাকায় পাঁচ মিনিট কম বারোটা বাজে। বুকের ভেতরে চাপা উত্তেজনা। সত্যিটা না জানা পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছে না সে। কিন্তু সত্যটা জানতে হলে শেরাজের রুমে যেতে হবে। যদি শেরাজ ড্রা গ নেয়, তাহলে নিশ্চয়ই আরও ড্রা গ পাওয়া যাবে রুমে। আর মোট কথা, এত বছর যখন শেরাজ ভাই বাড়িতে ছিল না তখন রুমে এসব পাওয়া যায় নি। আর এখন যখন শেরাজ ভাই দেশে এসেছে, আর এসব পাওয়া গেছে রুমে তার মানে এসব শেরাজ ভাই নিয়ে এসেছে। কিন্তু তারপরও মেহুল নিশ্চিত হওয়ার জন্য একবার হলেও চেক করে দেখবে। রাতের বেলাটাই সবচেয়ে উত্তম হবে, কারণ দিনের বেলা শেরাজের রুমে ঢোকা মুশকিল হয়ে দাঁড়াবে। এখন নিশ্চয়ই শেরাজ ভাই ঘুমে কাদা। তাই এখনই মোক্ষম সময় চট করে রুমে যাবে আর চট করে দেখে চলে আসবে। মেহুল ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়। এই কাঁটা পা নিয়ে সে অসাধ্য সাধন করতে যাচ্ছে। একবার দরজার ফাঁক দিয়ে বাইরের পরিবেশ দেখে নেয়। তারপর নিঃশব্দ পায়ে এগিয়ে যায় শেরাজের রুমের দিকে।
—————
মেহুল পা টিপে টিপে শেরাজের রুমের সামনে এসে দরজার হাতলে ধীরে ধীরে হাত রাখলো। দম নিয়ে আস্তে করে দরজাটা ঠেলে দিলো। শেরাজের রুম ঘুটঘুটে অন্ধকার। মেহুল আরও একবার চারপাশটা দেখে নিলো, কেউ আছে কিনা। মেহুল এক পা... দুই পা করে নিঃশব্দে রুমের ভেতরে ঢুকলো। শেরাজ ঘুমিয়ে আছে। মেহুল ফোনের লাইট অন করলো। তার গন্তব্য শেরাজের আলমারি। আলমারিতে হয়তো কিছু থাকতে পারে।
হঠাৎ করে অন্ধকার ঘরের মধ্যে একটা শব্দ হলো। মেহুল ভয়ে জমে যায় তাতে! চোখ দুটো স্বাভাবিকের চেয়ে বড় হয়ে যায়। শব্দটা কোথা থেকে এলো? মেহুল ঢোক গিলল। হয়তো বিছানার দিক থেকে এসেছে! মেহুল নিঃশ্বাস বন্ধ করে আরও কিছুটা সময় দাঁড়িয়ে রইলো। তারপর ধীরে ধীরে বিছানার দিকে তাকালো। শেরাজ পাশ ফিরে শুয়ে আছে। বোঝা যাচ্ছে, শেরাজ বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। মেহুল স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। আলমারির কাছে এসে যখনই আলমারিটা খুলতে যাবে, তখনই পেছন থেকে কড়া এক আওয়াজ ভেসে এলো।
"সাহসী বতীর খুব সাহস বেড়ে গেছে না?"
মেহুলের সমস্ত শরীর জমে গেলো। তার শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেলো এক শীতল স্রোত। শেরাজ জেগে গেছে! শেরাজ পুনরায় প্রশ্ন করলো, "কি হলো সাহসী বতী? তুই আমার ঘরে কি করছিস?"
মেহুলের হাত থেকে ফোনটা প্রায় পড়ে যাচ্ছিল কিন্তু শেষ মুহূর্তে ফোনটা ধরে নেয়। তার পুরো শরীর অবশ হয়ে গেছে যেন। ধীরে ধীরে সে মাথা তুলে পেছনে তাকাল। শেরাজ বিছানায় বসে আছে। অন্ধকারের মাঝে তার চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে। গভীর, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেহুলের দিকে আটকে আছে। শেরাজ কণ্ঠ নিচু করল, কিন্তু তাতে যেন অসংখ্য রাগ মিশে আছে।
"কি হলো? উত্তর দে?"
মেহুল ঢোক গিলল। নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করল, কিন্তু শরীরের কাঁপুনি লুকানো সম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে, "আমি... আমি তো এমনি... না মানে... আমি আসলে পানি খেতে গেছিলাম। ভুল করে তোমার রুমে ঢুকে গেছি।"
শেরাজ ঠোঁট বাঁকা করল, যেন কোনো কৌতুক শুনেছে, "ও তাই? ভুল করে?"
শেরাজ বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। রুম আলোকিত হলো। মেহুল এক পা পিছিয়ে গেল। শেরাজ প্রশ্ন ছুড়ে দিলো মেহুলের পানে, "ভুল করে আমার আলমারি খুলতে চেয়েছিলি?"
শেরাজ এক পা এগোল, মেহুল আরেক পা পিছোল। তার পেছনে আলমারি, পালানোর জায়গা নেই, "ভুল করে আমার জিনিসপত্র হাতড়ে দেখার চেষ্টা করছিলি?"
শেরাজ কথাটা বলে মেহুলের একদম কাছে এসে দাঁড়ালো। মেহুলের নিঃশ্বাস দ্রুত চলছে। শেরাজ মেহুলের প্রত্যেকটা নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পারছে স্পষ্ট। শেরাজ ঠান্ডা মিশ্রিত গলায় বলল, "তুই কি মনে করেছিস, আমি ঘুমিয়ে ছিলাম? আমি জানতাম তুই আসবি আমার রুমে। আর দেখ আমার ভাবনাটা সত্যি হয়ে গেলো।"
কথাটা বলে এক ঝটকায় ফোনটা কেড়ে নিলো মেহুলের হাত থেকে। আকস্মিক আ ক্র ম ণে মেহুল চমকে উঠে। শেরাজ ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে "চ" সূচক শব্দ উচ্চারণ করে বলল, "ভয় পাচ্ছিস ধরা পড়ে গেছিস বলে?"
পুরো শরীর শিউরে উঠল মেহুলের। শেরাজের কণ্ঠস্বরে ভয়ংকর এক শীতলতা মিশে আছে। শেরাজ ঠোঁট বাঁকা করল, "ভয়? হাহ! তুই যদি জানতিস আমি আসলে কী তাহলে সত্যিকারের ভয় কাকে বলে বুঝতে পারতি!"
মেহুলের গলা শুকিয়ে আসছে। পালানোর কোনো উপায় নেই শেরাজ তার সামনে দাঁড়িয়ে পথ আটকে রেখেছে। শেরাজ ফোনটা মেহুলের সামনে তুলে ধরল, "এটা আনলক কর, দেখি কি সার্চ করেছিলি নিজের রুমে গিয়ে তখন?"
"আমি... আমি কিছু সার্চ করিনি..."
"মিথ্যা কথা বলিস না। তুই জানার চেষ্টা করেছিলি ওই ওষুধটা কিসের তাই না?"
মেহুল অসহায়ভাবে তাকাল। শেরাজ হিম শীতল কন্ঠে বলল, "হুমম তাহলে একটা কাজ করা যাক, তোর যখন এতো ইচ্ছা সব কিছু জানার তাহলে সেটা আমি নিজেই দেখিয়ে দিই তোকে চল।"
এ কথা বলে মেহুলের কব্জি শক্ত করে ধরে। মেহুল তড়িঘড়ি করে বলল, "কো... কোথায় নিয়ে যাবে আমাকে?"
শেরাজ মেহুলের চোখে চোখ রেখে ফিসফিস করল, "আমার আসল রূপ দেখাতে!"
মেহুলের শরীর হিম হয়ে গেছে। কাঁপাকাঁপা কণ্ঠে বলল, "আমি কোথাও যাবো না!"
মেহুল হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করল, কিন্তু শেরাজের গ্রিপ ছিল পাথরের মতো শক্ত। শেরাজ ঠান্ডা গলায় বলল, "খুব কৌতূহল, তাই না সব কিছু জানার? তাহলে এবার নিজের চোখেই দেখে নে।"
শেরাজ মেহুলকে ওয়ারড্রবের সামনে এনে দাঁড় করিয়ে ওয়ারড্রবের ড্রয়ার খুলে একটা কালো রঙের ব্যাগ বের করল। শেরাজ ব্যাগের চেইন খুলল। ভেতরে একাধিক সিরিঞ্জ, কাচের শিশি আর কয়েকটা ছোট ছোট পাউচ রাখা। মেহুল দম আটকে আসা গলায় বলল, "এগুলো... এগুলো কি ড্রা গ স?"
শেরাজ একদম শান্ত স্বরে বলল, "তোর কি মনে হয়?"
মেহুল চেয়ারের হাতল আঁকড়ে ধরল, যেন নিজেকে সামলাতে পারছে না, "তাহলে তুমি সত্যিই...?"
শেরাজের ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটল, কিন্তু সেটা ছিল ভয়ানক, "হ্যাঁ, আমি ড্রা গ নেই। এবার কী করবি তুই? সবাইকে গিয়ে বলে দিবি?"
মেহুল কথা বলার খেই হারিয়ে ফেলেছে। তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা কি সেই শেরাজ ভাই, যাকে সে এতগুলো বছর ধরে চেনে এসেছে? নাকি এই মানুষটা সম্পূর্ণ অন্য কেউ? শেরাজ চোখ সরু করে তাকাল মেহুলের দিকে, যেন প্রতিটা ভাবনা পড়ে নিচ্ছে।
"কী হলো? এবার চিৎকার করবি? সবাইকে বলে দিবি এই কথাটা?"
মেহুল ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল, "আমি... আমি বুঝতে পারছি না..."
শেরাজ ছোট হাসি দিয়ে একটা শিশি হাতে নিয়ে তা ঝাঁকালো আর ঠাণ্ডা গলায় বলল, "এটা যখন তোর হাতে এসেছিল, তখন খুব ইচ্ছে ছিল জানার তাই না এটা কিসের ওষুধ?"
"তুমি নিজের শরীরের কেন এসব নিচ্ছো?"
শেরাজ এবার চোখ সরিয়ে নিল, যেন এই প্রশ্নটা শুনতে চায় নি মেহুলের থেকে। কয়েক সেকেন্ড নীরব থাকার পর বলল, "শোন, মেহুল আমার জীবন নিয়ে তোর ভাববার দরকার নেই। আমি কি করব না করব সেটা আমার ব্যাপার।"
"এটা ঠিক না। তুমি যা করছো, তাতে তোমার নিজের ক্ষতি হচ্ছে।"
শেরাজ মুচকি হাসল। কিন্তু তাতে উপহাসের ছাপ ছিল স্পষ্ট, "এটা আমি বুঝে নিবো কোনটাতে ভালো, কোনটাতে ক্ষতি।"
মেহুল এবার গলা শক্ত করল, "আমি কোনো দিন ভাবতে পারি নি, আমার শেরাজ ভাই যে এইভাবে নিজের জীবন নষ্ট করবে!"
শেরাজ ঠোঁট চেপে একটু হেসে ফেলল, "ভাই? তোকে কে বলেছে আমি তোর ভাই?"
মেহুল হতবাক হয়ে বলল, "মানে?"
শেরাজ মেহুলের কাছে এল, এতটাই যে তার নিঃশ্বাস গাল ছুঁয়ে যাচ্ছে মেহুলের, "তোর ভাই হতে কখনো চাই নি মেহুল। আমি তোকে বোনের চোখে দেখি না।"
মেহুলের বুকের ভেতর ধ্বক করে উঠে। হৃদপিন্ডের গতি অধৈর্য ভাবে লাফাছে। বোনের চোখে দেখে না মানে? তাহলে কি চোখে দেখে? মেহুই কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল, "তাহলে কী চোখে দেখো তুমি আমায়?"
শেরাজ এক সেকেন্ড চুপ করে রইল। তারপর সরে গিয়ে বলল, "সেটা জানতে হলে তোর ধৈর্য ধরতে হবে দাদার নাতনি সাহসী বতী।"
মেহুল অবাক চোখে তাকিয়ে আছে শেরাজের দিকে। কেমন জানি সব কিছু তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে তার। শেরাজ শিশিটা দেখতে দেখতে বলল, "নিজের রুমে যা। এক মিনিট সময় তোর হাতে যদি এর বেশি সময় নিস তাহলে তোর সাহসের আমি বারোটা বাজিয়ে দেবো।"
মেহুল ঢোক গিলে ধীরে পায়ে হেঁটে দরজার কাছে আসতেই শেরাজ কঠিন কণ্ঠে আদেশ করল, "আরেকটা কথা, এই ব্যাপারটা যেন বাড়ির কেউ না জানে বুঝলি?"
"জানবে না।"
"গুড গার্ল। এবার যা নিজের রুমে গিয়ে চুপচাপ লক্ষ্মী মেয়ের মতো শুয়ে পড়।"
মেহুল চলে যায়। শেরাজ আপন মনে বলে ওঠে, "তোর কাছ থেকে কিছু লুকাবো না মেহুল। তুই এই শেরাজ মির্জার সব সত্যি জেনেই এই শেরাজ মির্জার কাছে এসে ধরা দিবি।"
·
·
·
চলবে...................................................................................