গোধূলি লগ্ন। সূর্যের তেজ কমে এসেছে, চারপাশে মিষ্টি বাতাস বইছে। পাখিরা মনের সুখে আকাশে উড়ছে—কেউ ফিরছে নিজের নীড়ে, কেউ আবার নিজ সন্তানের খাবারের সন্ধানে ছুটছে।
বিশাল বিস্তৃত একটা মাঠ তার সবুজ নরম ঘাসের ওপর ছোট ছোট বাচ্চারা দৌড়ঝাঁপ করছে। কেউ খিলখিলিয়ে হাসছে, আবার কেউ একটু আঘাত পেয়ে কেঁদেঘুটে, দৌড়ে বাড়ি যাচ্ছে মায়ের কাছে নালিশ করতে।
ইফা মাঠে এক কোণে চুপচাপ বসে এসব দেখছে। দৃশ্যগুলো তার শৈশবের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে—বন্ধুদের সঙ্গে কত ঝগড়া হয়েছে ছোট বেলা আবার সেই ঝগড়া ভুলে সময়ের সাথে সাথে বন্ধুত্বের হাতও বাড়িয়ে দিয়েছে…
ইফার সামনে আকস্মিক একটা হাত চুটকি বাজাল। ইফা চমকে উঠে পাশ ফিরতেই দেখে, একটা হাস্যজ্জ্বল চেহারা তার দিকে তাকিয়ে আছে। ইফা নাকের পাটা ফুলিয়ে মানুষটার বাহুতে কিল মারল।
মানুষটা ব্যথা পাওয়ার ভান করে বলল, “আহ! ব্যথা পাই তো।”
ইফা গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “একদম ভাব ধরবে না।”
মানুষটা ইফার বাতাসে উড়তে থাকা চুলগুলো আলতো করে কানের পাশে গুছিয়ে দিয়ে হেসে বলল, “এত রেগে আছেন কেন, মহারাণী?”
ইফা চুপ, কোনো কথা বলল না। মানুষটা হতাশার নিঃশ্বাস ফেলে আকাশের দিকে চেয়ে বলল, “এরে তুহিন! তোর মহারাণী তো তোর উপর ভীষণ রেগে আছে!”
ইফা একেবারে রেগে তুহিনের দিকে ঘুরে বলল, “সবসময় তুমি দেরি করো! একবারও কি সময়মতো আসতে পারো না? আমাকে এসে বিশ-ত্রিশ মিনিট বসে থাকতে হয়! একদিন আমি তোমাকে বুঝাবো, অপেক্ষা করা ঠিক কতটা কষ্টের!”
তুহিন মুচকি হেসে বলল, “আচ্ছা সরি। কিন্তু কেন দেরি হয়েছে, সেটা জিঙ্গাস করবে না?”
ইফা তেড়া গলায় বলল, “হ্যাঁ অবশ্যই শুনি এবার কী অজুহাত আপনার জনাব?”
তুহিন মাথা চুলকে বলল, “তোমার ভাইয়ের ভয়ে তোমার কাছে আসতে ভয় লাগে! না জানি কখন তোমার সাথে আমাকে দেখে ফেলে!”
ইফা খোঁচা দিয়ে বলল, “উম্ম, তিন বছর আগে যখন আমাকে প্রপোজ করেছিলে, তখন ভয়টা কোথায় ছিল?”
তুহিন ঠোঁট ফুলিয়ে বলল, “তখন আবেগ কাজ করেছিল, তাই প্রপোজ করে ফেলেছিলাম।”
ইফা ভ্রু উঁচিয়ে বলল, “ওহ আর এখন বিবেক কাজ করছে তোমার তাই না?”
তুহিন দ্রুত বলল, “আচ্ছা, সরি। তোমার সাইকো ভাইয়ের প্রসঙ্গ বাদ দেই আমরা।”
ইফা রেগে গিয়ে বলল, “এই! একদম আমার ভাইয়াকে সাইকো বলবে না! আমার ভাইয়া সাইকো না, আমার ভাইয়া যথেষ্ট ভালো!”
তুহিন মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে চোখ-মুখ বিকৃত করে মনে মনে বলল, “হুম! তোমার ভাই যে কেমন সাইকোর সাইকো, এটা আমার থেকে ভালো আর কে জানে? শালা সাইকো!”
ইফা ভ্রু কুঁচকে বলল, “কি হলো? কী ভাবছো?”
তুহিন দ্রুত স্বাভাবিক হয়ে বলল, “কিছু না, চলো ওই দিকটায় যাই…”
—————
বাস থেকে নেমে লামিয়ার বাসার কাছাকাছি আসতেই মেহুল হঠাৎ গড়গড়িয়ে বমি করে বসে। তার শরীর কাঁপছে, চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়ছে। পাঁচ বছর আগেও এমনই একটা ঘটনা ঘটেছিল, বরং তখনকারটা ছিল আরও ভয়ংকর। এত বছর নিজের সাথে লড়াই করে নিজেকে যথেষ্ট স্বাভাবিক করেছিল, আর ঠিক সেই সময়েই কেউ এসে তাকে আবারও সেই দুঃসহ অতীতের সামনে দাঁড় করিয়ে দিল। পাঁচ বছর আগে তো শেরাজ ভাই এসে তাকে বাঁচিয়েছিল, কিন্তু এবার? এবার তো শেরাজ ভাই আসলো না?
লামিয়া মেহুলকে আকস্মিক বমি করতে দেখে দুশ্চিন্তায় বলল,
“কি হয়েছে মেহুল? ঠিক আছিস?”
মেহুল দ্রুত শ্বাস নিতে নিতে বলল, “ঠিক আছি…”
ঠিক তখনই একটা হাত পানির বোতল এগিয়ে দিল, “পানিটা খান, ভালো লাগবে।”
মেহুল চোখ তুলে তাকাল। চেক শার্ট পরা একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। শার্টের বোতাম খোলা, ভেতর থেকে উঁকি দিচ্ছে ধবধবে সাদা গেঞ্জি। ছেলেটার মুখ দেখে মনে হচ্ছে, বেশ ভদ্র স্বভাবের। কিন্তু কেন যেন ওর চাহনিটা মেহুলের ভেতর অদ্ভুত অস্বস্তি তৈরি করল। বাসের ঘটনাটার জন্য, নাকি অন্য কোনো কারণে—মেহুল নিজেও বুঝতে পারল না। মেহুল ঢোক গিলল। লামিয়া ছেলেটার হাত থেকে বোতলটা নিয়ে মেহুলকে পানি খেতে বলল। মেহুল সরাসরি না করে দিল।
ছেলেটা হালকা হেসে বলল, “পানিটা খেলে ভালো লাগবে তাই দিলাম। আপনার যদি মনে করেন, এতে কিছু মেশানো হয়েছে, তাহলে ভুল ভাবছেন।”
মেহুল ভ্রু কুঁচকে তাকাল, কিন্তু কিছু বলল না। শুধু লামিয়ার হাত থেকে বোতলটা টেনে নিয়ে ছেলেটার দিকে বোতলটা এগিয়ে দিয়ে বলল, “ধন্যবাদ। লামিয়া, চল।”
দুজন চলে গেল। ছেলেটা স্থির দাঁড়িয়ে রইল হাতে বোতলটা নিয়ে। বোতলের ক্যাপটা খুলে এক ঢোক পানি খেলো সে। তার চোখ-মুখে একটা অদ্ভুত রহস্য খেলা করছে। ঠোঁটের কোণে অদ্ভুত এক হাসি ফুটে উঠল…
—————
রাতের অন্ধকার। চারিদিক নির্জন। মাঝে মাঝে নির্জনতার বুক ছিঁড়ে নিশাচর প্রাণীর ডাক ভেসে আসছে দূর থেকে। অন্ধকারে ডুবে আছে একটি কক্ষ। কক্ষের ভেতরে একটা স্যাতস্যাতে গন্ধ ছড়িয়ে আছে, যেন বহু বছর ধরে কেউ এই কক্ষ ব্যবহার করে নি। কোণায় কোণায় মাকড়সার জাল, মেঝেতে ইঁদুরের ছোটাছুটি। নিঃসঙ্গ, ঠাণ্ডা, ধুলো জমে থাকা একটা পরিত্যক্ত জায়গা।
ঘরের মাঝখানে একমাত্র আলোর উৎস হলো হলদে একটা বাল্ব, যার আলো খুবই ক্ষীণ আর মৃতপ্রায়। সেই আলোর ম্লান ছায়ায় বোঝা যাচ্ছে একটা শক্ত কাঠের চেয়ারের সাথে কেউ বাঁধা। তার মাথা ঝিমিয়ে পড়েছে সামনের দিকে, হাত-পা দড়ি দিয়ে শক্ত করে বাঁধা।
কিন্তু কে সে? কী তার অপরাধ? কেন এমন নিষ্ঠুরভাবে আটকে রাখা হয়েছে তাকে?
হঠাৎ দরজার খোলার শব্দ হলো। নিস্তব্ধ রাতের বুক চিরে শব্দটা এতটাই তীব্র লাগল যেন বজ্রপাত হলো। তিনজন পুরুষ দরজা পেরিয়ে ঘরে ঢোকে। মাঝের জন সামনের দিকে এগিয়ে আসে আর তার দুই পাশে দুজন দাঁড়িয়ে, সতর্ক দৃষ্টিতে চারপাশ পর্যবেক্ষণ করছে। সামনের পুরুষটি গম্ভীর কণ্ঠে শীতলতা মিশে বলল, “ওর জ্ঞান ফিরা?”
মুহূর্তের মধ্যেই আরেকজন একটা পানি ভর্তি বালতি নিয়ে এসে বাঁধা লোকটার মুখে পানি ছুড়ে মারে। ঠান্ডা পানির ঝাপটা পড়তেই লোকটা ধড়ফড়িয়ে ওঠে। তীব্র শ্বাস নিতে নিতে চোখ মুখ খিচিয়ে ফেলে। কিছুক্ষণ ধাঁধিয়ে থাকার পর ধীরে ধীরে চোখ খোলে। চোখের সামনে চারটে অবয়ব স্পষ্ট হয়।
ছেলেটা ভয়ার্ত কণ্ঠে ফিসফিস করে, “কারা আপনারা?”
একজন এগিয়ে এসে সামনে থাকা পুরুষটির জন্য একটা চেয়ার এগিয়ে দিলো। লোকটি পায়ের ওপর পা তোলে ধীরেসুস্থে বসলো। কণ্ঠ ঠান্ডা অথচ ভয় জাগানো কণ্ঠে বলে, “তোর যম রে, শালা!”
ছেলেটার গলা শুকিয়ে গিয়েছে, কথা বলতে গিয়ে ঢোক গিলে। চোখ দুটো ভয়ে বিস্ফারিত, আতঙ্কে কাঁপছে তার পুরো শরীর। ধীরে ধীরে চারপাশটা বোঝার চেষ্টা করল সে—অন্ধকার কক্ষ, পুরনো স্যাঁতসেঁতে গন্ধ, সামনে দাঁড়িয়ে থাকা তিনজন পুরুষ। বুকের ভেতর ধুকপুকানি আরও বেড়ে গেল।
সামনে বসে থাকা পুরুষটি ধীরগতিতে এক পাশের জনকে ইশারা করল। মুহূর্তের মধ্যেই পুরো কক্ষ আলোকিত হয়ে উঠল। আলোর ছটায় স্পষ্ট হয়ে উঠল শেরাজের চেহারা। তার চোখদুটি রক্তিম, চোয়াল শক্ত। ছেলেটা শেরাজকে দেখেই আতঙ্কে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে কাঁপা কণ্ঠে বলল, “আমাকে এখানে কেন আনা হলো? আমি কিছু করিনি!”
শেরাজ ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি টেনে ধীর পায়ে এগিয়ে এসে ছেলেটার চুলের মুঠি চেপে ধরল। মাথাটা শক্ত ধাক্কায় পেছনে ঠেলে দিয়ে ঠান্ডা কণ্ঠে বলল, “তুই কি করিস নি সেটা আগে বল?”
ছেলেটা আতঙ্কিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল, গলা শুকিয়ে এল। “আমি... আমি কিছু জানি না... দয়া করুন!”
শেরাজ নির্লিপ্ত হেসে বলল, “দয়া?”
তারপর জোরে হেসে উঠল, কণ্ঠে অবজ্ঞার ছোঁয়া, “যখন তুই ওর গায়ে হাত দিয়েছিলি, তখন কি দয়া করেছিলি?”
শেরাজের কথা শুনেই বাসের ঘটনাটা মনে পড়ে গেল ছেলেটার। মুহূর্তের মধ্যে তার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। আতঙ্কে মাথা নাড়িয়ে বলল, “আমি কিছু করি নি! বিশ্বাস করুন!”
শেরাজ কোমর বাকিয়ে চেয়ারের হাতলে দু'হাত রেখে ছেলেটার চোখে চোখ রেখে শান্ত গলায় বলল, “কোন হাত দিয়ে ওর গায়ে স্পর্শ করেছিলি?”
ছেলেটা কেঁপে উঠে মাথা নাড়ল, “আমি কিছু করিনি বিশ্বাস করুন!”
শেরাজ এবার কণ্ঠ চড়িয়ে বলল, “কোন হাত? ডান হাত নাকি বা হাত? নাকি কোনো হাত দিয়েই না?”
শেষ কথাটা শেরাজ চিৎকার করে বলতেই ছেলেটা ভয় পেয়ে কেঁপে উঠল। শেরাজ আকস্মিক বলে উঠল, “বিকাশ, ওর প্যান্ট খোল।”
ছেলেটা চমকে উঠে অস্পষ্ট স্বরে কাঁপতে কাঁপতে বলল, “না! না! প্লিজ!”
বিকাশও থমকে গেল। একটু দ্বিধাগ্রস্ত স্বরে বলল, “জি, স্যার?”
শেরাজ তার দিকে ফিরে দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “যেটা বলছি, সেটা কর! ও ওর দু হাত দিয়ে আমার কলিজায় স্পর্শ করে নি, বরং ও ওর নোংরা এক অঙ্গ দিয়ে আমার কলিজায় স্পর্শ করেছে।”
কথাটা বলেই ছেলেটার দিকে ফিরে শেরাজ ছেলেটার মুখ শক্ত করে চেপে ধরল, চোখ দুটো জ্বলছে ঘৃণায়, “ঠিক বলছি তো আমি? তোর এই নোংরা অঙ্গ দিয়ে ছুঁয়েছিস ওকে তাই না?”
শেরাজ ছেলেটার প্যান্টের চেইনের দিকে তাকিয়ে বলল কথাটা। ছেলেটা থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে মাথা নাড়তে লাগল, “না! প্লিজ! দয়া করুন!”
এক মুহূর্তের নীরবতা। তারপর শেরাজ উদাস কণ্ঠে বলল, “বাজে কথা।”
ছেলেটা কাঁদো কাঁদো গলায় বলতে লাগল, “আমি শুধু... আমি শুধু দাঁড়িয়ে ছিলাম! ওর গায়ে লেগে যাবে ভাবি নি!”
শেরাজ এবার হেসে উঠল একটা ভয়ংকর, ধীর, আত্মবিশ্বাসী হাসি, “তাই বুঝি! আচ্ছা, এভাবে আর কয়টা মেয়েকে হেনস্তা করেছিস তুই?”
তারপর ছেলেটার চুল শক্ত হাতে খামচে ধরে বলল, “তোদের জন্য মেয়েদের কোনো নিরাপত্তা নেই। প্রতিনিয়ত নারী থেকে শুরু করে ছোট ছোট শিশুরাও তোদের লোভ, লালসার শিকার হয়। আমি আজ দেখাবো, তোদের মতো কীটদের জন্য শাস্তি কেমন হওয়া উচিত।”
শেরাজ পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা এক জনকে ইশারা করল। লোকটা একটা ছোট ট্রে এগিয়ে দিল। ট্রেতে ছুরি, চিমটা, ধারলো কাঁচি—নানান কিছু সাজানো।
ছেলেটার চোখ বড় হয়ে গেল। কাঁপা কণ্ঠে অনুনয় করে বলল, “প্লিজ! প্লিজ! আমাকে ক্ষমা করে দিন! আমি আর কখনো এমন করব না!”
কিন্তু শেরাজের চোখে কোনো করুণা নেই। সে চুপচাপ গিয়ে চেয়ারে বসে। ছেলেটা অনবরত চেঁচিয়ে ক্ষমা চেয়ে যাচ্ছে কিন্তু শেরাজের তাতে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। সে চুপচাপ বসে চেয়ে দেখে যাচ্ছে। কি অপেক্ষা করছে ছেলেটার জন্য? কি হবে এর পরিনীতি? মৃত্যু নাকি ক্ষমা?
·
·
·
চলবে..................................................................................