শফি কল চেপে বালতি ভর্তি পানি এনে রাখে সিনান সালেহের বা পাশে। বালতির হাতল ছেড়ে হাঁফ ছাড়তে পারে না সিনানের ঝাড়ি খেয়ে নছিমন ধুতে শুরু করে। সিনান সালেহ বিরক্ত মুখে নছিমনের কাঁদা মাখা টায়ারটা খুলে নেয়। শফি শুধায়,
" সিন ভাই তোমার মেজাজ কতদূর? একটা কথা কইবাম!"
" মেজাজ এমন, মাথায় আন্ডা রাখলে তাপে বাচ্চা দিবো। চুপ থাক বে!"
ধমকে শফির মুখখানি চুপসে যায়। তবুও বলে,
" বউ পাইলে মেজাজ পানি হইয়া যাইতো। জলদি বিয়া করো আমগোরেও দাওয়াত খাওয়ার সুযোগ দাও!"
খিটখিটে সিনান সালেহ বউয়ের কথা শুনে মুচকি হাসে। শফি অবাক হয়ে বলে,
" হাসতেছো ক্যান? বউয়ের কথা শুইনা তোমার গাল লাল হইয়া গেছে সিন ভাই! তোমার তো বিয়া করা অতি সত্তর ফরজ হইয়া গেছে।"
সিনান পাঞ্চার কৃত টায়ারটা গড়িয়ে নিয়ে যেতে যেতে বলে,
" বউ তো গাল লাল করারই জিনিসই শফি। বিয়াও শিঘ্রই করমু। এই ঝড় বাদলার রাতে একা থাকতে ডর লাগে। বউ থাকলে ডর ফুঁস।"
শফি বাঁকা চোখে তাকায়। সিনান হাসি মুখে কাজ করে যায়। শফি কিছু সময় পর আবারও শুধায়,
" তোমার ওই দলের কি হইলো? ঘর তুলবা কবে? রিজ ভাই তো মনে হয় সব ঠিকঠাক কইরাই দিছে। ভাই কত ভালা তাই না?
" তা দিছে। তয় শালা কঞ্জুস। বড় বুজুর্গরা সবাই কিছু না কিছু দিছে শালা এক পাইও দিলো না। বলে কি না, এতো দূর পর্যন্ত আগাই দিলাম আবার টাকা চাস শরম করে না? তহন মন চাইছিলো ঘার ধইরা পঁচা ডোবায় চুবাই। শালার ভাব দেখলেই গা জ্বইলা যায়। নেহায়েৎ সাহায্য করছে দেইখা চুপ ছিলাম।"
শফি কাজ বাদ দিয়ে এগিয়ে এসে বলে, " কনে ভাব দেহায়? ভাই তো সেই ভালা। একটু খুঁত খুইত্যা ওইডা সমিস্যা না। আমার না হেরে খুব ভালো লাগে।"
সিনান বাঁকা চোখে চায়। শফি মাথা চুলকায়। কিভাবে কি বলবে বুঝতে পারে না। তবে ভাইকে বলা উচিত মনে হচ্ছে। সে মাটিতে পায়ের বৃদ্ধাঙুল খুঁটে মিনমিনে গলায় বলে,
" রিজ ভাইয়ের সাথে আমাগোরে সুর আপারে মানাইতো খুব, তাই না?"
সিনানের হাত থমকায়। খানিকটা বিস্ময়কর চাহনি নিক্ষেপ করে বলে, " কি সব আজগুবি কথা কস শফি? কামচোর যা কাম কর?"
শফি যায় না। সিনান নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বাইকের লাগাতার হর্ণের আওয়াজে সিনান গলার গামছা খুলে ক্ষিপ্র গতিতে ছুঁড়ে খ্যাক করে বলে ওঠে,
" শালা সম্বন্ধি! কানের কাছে আইসা প্যা পু মারাও? চ্যাটের বাল আমারেই পায় সব।"
তাঁর ভর্ৎসনায় হাসে রওশন মাহবুব। বাইক থেকে নেমে কালিমাখা ময়লা গামছাটা হাতে তুলে শফির গলায় ঝুলিয়ে দেয়। দোকানের সিমেন্টের খুঁটিতে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে রাশভারী স্বরে বলে,
" শালা বোন দিবি কি না বল?"
সিনান ত্যাক্ত শ্বাস ফেলে ভাবলেশহীন মুখে বলে, " মানা করলাম কবে?"
রওশন প্রসস্থ হাসে। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে শার্টের কলার ঠিক করে। খানিকটা লাজুক ভঙ্গিমা ফুটিয়ে অতি বিনয়ের সাথে বলে,
" ভাবী শালাবাবু? আমি রওশন মাহবুব খান আপনার কাছে আপনার বোনের জন্য বিবাহ প্রস্তাব আনিয়াছি। বর্তমানে আমি বেকার হইলেও অতি শিঘ্রই একখানা চাকুরীর বন্দোবস্ত করিবো। আপনার বোনের যথাযথ ভোরণ পোষণের দায়িত্বের সহিত আমি মন প্রাণ উজাড় করিয়া তাহারে অতি যত্নের সহিত আগলাইয়া রাখিবো। আপনি অনুগ্রহ পূর্বক আমার প্রস্তাব খানা গ্রহণ করিয়া আমার প্রতি কৃপা দৃষ্টি ফেলিবেন। আশা করি নিরাশ করিবেন না।"
শফি গোমড়া মুখে এক কোণায় দাঁড়িয়ে আছে। রওশন ভাই অনেক ভালো তবে সুর আপার লগে রিজ ভাইরেই মানাইবো। সিন ভাই জানি মানা কইরা দেয়। সিনান সালেহ চোখ উল্টিয়ে বিরক্ত প্রকাশ করে। কিছু বলবে রওশন দ্রুত এগিয়ে এসে সিনানের মুখ আটকে দেয় হাত দিয়ে। নাটকীয় ভঙ্গিতে বলে,
" নাহ শালাবাবু নাহ! ভুলেও নিরাশ করিবেন না। আমি আরো কিছু কথা বলিতে চাই। একটু ধৈর্য ধরিয়া শোনার চেষ্টা করিবেন। আমার পরিবার আপনার বোনকে মানিয়া নিতে গড়িমসি করিবো ইহাই বলিতে চাইতেছেন তাই না?"
সিনান কিছু বলতে পারে না। সম্বন্ধির বাচ্চা পেছন থেকে হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরেছে। সে চাইলেই ছাড়িয়ে নিতে পারে তবে বন্ধুর নাটকীয়তায় সায় জানিয়ে মাথা নাড়লো। রওশন হাস্যোজ্জ্বল মুখে বলে,
" আমি ঢাকায় একখানা চাকুরী জুটিয়ে বউকে লইয়া সেখানেই উঠিবার বন্দোবস্ত করিবো। মাস্টার্স ডিগ্রিও অর্জন করিবো। আপনার বোন সকল প্রকার পারিবারিক ঝুট ঝামেলা হইতে দূরেই থাকিবে। বছর অন্তর অন্তর বেড়াইতে আসিবে শ্বশুরালয়ে। ইহার পরেও আপত্তি দেখাইলে আপনারে উল্টা করিয়া ঝুলাইয়া পেদাইবো। এখন আপনিই সীদ্ধান্ত লন!"
ছাড়া পেয়ে সিনান ঘন ঘন শ্বাস টানে। আহম্মক এতোটা জোরে চেপে ধরেছিল যে, আরেকটু হলে পটল তুলতে যেতো।
" আমার সীদ্ধান্ত এই, বাপকে বল বাড়ি এসে প্রস্তাব দিতে। বাকিটা পরে ভেবে দেখবো । নির্লজ্জের মতো নিজের বিয়ের প্রস্তাব নিজেই নিয়ে এসেছিস লজ্জা করে না?"
সিনানের স্বাভাবিক শান্ত গলা। রওশন একটু অবাক হলেও প্রকাশ করে না। বন্ধুর সাথে জোরজবরদস্তি কোলাকুলি করে, যেন বিয়ে সম্পন্ন হয়ে দুজন সম্বন্ধি বনে গেছে। সিনান মুখ বিকৃত করে খ্যাক করে বলে,
" ছাড় বে। একদম গায়ে পড়বি না। রাজি হই নাই আমি। কইলাম পড়ে ভাইবা দেখমু। ছাড়?"
রওশন ছেড়ে দেয়। মাথা চুলকে হেসে বলে, " সিন তুই কিন্তু আমার নেংটা কালের বন্ধু। আমার মনটা ভাঙ্গিস না অনুরোধ। সুরেলাকে বন্ধুর বোনের নজরে না দেখে; বউ বানাবো একদিন, এই স্বপ্নে তিনটে বছর কেটে গেলো। আমার স্বচ্ছল অনুভূতির সাক্ষী তুই। আমার পরিবারকে যেমন করেই হোক আমি মানিয়ে নিবো শুধু তুই ঠিক থাকিস।"
সিনান সালেহ বন্ধুকে ভরসা বা জবাব কোনটাই দেয় না।রওশন জবাবের আশাও করে না। বন্ধুর উপর ভরসা আছে তাঁর। সে বাইক নিয়ে যে পথে এসেছিলো সে পথেই ফিরে যায়। বাবা মানলে মানবে নইলে চাচজান আছে তো। আর সাদমান ভাইকে পাশে পেলে সুবিধা হবে। এদিকে সিনান সালেহ ভাবনায় পড়ে বেশ। ছাত্র থাকাকালীন অংকে দূর্বল ছিলো বিধায় জীবনের সমীকরণ মিলাতে হিমশিম খায়।
" ও সিন ভাই? সিন ভাই?"
" কানের কাছে প্যা প্যা করিস না। ভাল্লাগে না বাল।"
শফি ভোঁতা মুখে বিড়বিড় করে, তোর কি ভাল্লাগে খেক শিয়াল? সারাক্ষণ বুড়ি মানষের মতো খ্যাক খ্যাক খ্যাক। মন তো চায় চটকানা লাগাইতে। ছাগলের পাছার লাহান মুখ বানাই রাহে। মনে মনে পিন্ডি চটকালেও মুখে বলে,
" তুমি কি রওশন ভাইয়ের লগে সুর আপার বিয়া দিবা?"
" সোজাসাপ্টা কথা ক? পেঁচাইবি তো পাছা লাল করুম!"
শফি তৎক্ষণাৎ পশ্চাদ দেশ হাত রাখে আত্মরক্ষার জন্য। গড়গড়িয়ে বলে দেয়,
" রিজ ভাইয়ের লগেই মানাইবো সুর আপারে। রিজ ভাইয়ের হিরোর লাহান ভাব। আর আপারে ভালোবাসে।"
শেষের দিকে গলার আওয়াজ নেমে আসে। তবে সিনানের শ্রবণ ইন্দ্রিয়ে আঘাত হানে যথা সময়ে। ঘন ভ্রু যুগল একত্রিত হয়। সুক্ষ্ম চোখে তাকিয়ে বলে,
" কে কইছে? শাপলা?"
" শাপলা জানবো কোনথেন? রিজ ভাই নিজে কইছে।"
" কি কইছে?"
" কইছে হেরে দুলাভাই ডাকতে।"
" তুই ডাকছিলি?"
সিনান সালেহের স্বাভাবিকতায় শফি যেন ভরসা পায়। বুক ফুলিয়ে গর্ব বোধ করে বলে,
" হ, রিজ ভাই খুশি হইয়া একশ টাকার চকচকা নোট দিছি.."
ঠাস করে চড় পড়ে ছোট্ট গালে। শফি গালে হাত রেখে দুঃখি দুঃখি মুখ বানায়। সিনান আবারও তেড়ে আসতে নিবে শফি উল্টোপথে দৌড় লাগায়। জিভ বের করে ভেটকি মেরে বলে,
" তার ছেড়া কুনকার! আমি তর বাপের ভাত খাই যে সবসময় আমার উপর খ্যাক খ্যাক করবি? তর গ্যারেজে তুই কাম কর। আমি এই মুইতা দিলাম।"
বলে প্যান্টের জিপার খুলতে উদ্যত হয়। খ্যাপাটে সিনান প্লাস হাতে এগিয়ে আসতে আসতে বলে,
" খোল, তোর মেশিনের কত ধার চেক করমু! খাঁড়া কইলাম? পালাস ক্যান?"
শফি বড় বড় চোখ বানিয়ে আসল জায়গায় দুই হাত চেপে ধরে। কয়েক কদম পিছিয়ে এক দলা থুতু ছুঁড়ে বলে,
" তোমার কপালে বউ নাই! আমি আমার বোনরে দিমু না তোমার লগে।"
বলে উল্টোপথে এলোপাথাড়ি দৌড় লাগালো। সিনান গলা হাঁকিয়ে বলে,
" তোর বাঁচাল বোনের জন্য সিনান কানতাছে নাকি?সে রাজকন্যা ঘরে তুলবো।"
কাঁধে কারো হাতের স্পর্শে সিনান ঝটকায় সরিয়ে দেয়।
" গা ছুবি না কইলা..."
কথা অসম্পূর্ণ থেকে যায় ব্যাক্তিকে দেখে। সিনান কলার টেনে ঠিক করে। হালকা হাসার চেষ্টা করে বলে,
" আসসালামুয়ালাইকুম চাচা ভালো আছেন?"
মন্টু মিয়া দাড়ি বিহীন চোয়ালে হাত বুলিয়ে সালামের জবাব নেয়। সিনানের কাঁধ জড়িয়ে গ্যারেজের দিকে যেতে যেতে বলেন,
" ঘরে রাজকন্যা নাই বলে তরে জামাই বানাইতে পারলাম না সিন।"
সিনানের গা জ্বলে পুড়ে ওঠে। এরকম গা ঘেঁষাঘেঁষি তাঁর পছন্দ না। মেজাজ গরম হয়ে যায় এক নিমিষেই। তবুও নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বলে,
" কোনো দরকারে আইছিলেন চাচা?"
মিন্টু মিয়া মিষ্টি স্বরে হাসেন। হাসিতে ভদ্রলোকের চেহারায় এক আলাদা দ্যুতি ছড়িয়ে পড়ে। সিন খেয়াল করে লোকটার চেহারা সুরত আর মিষ্টি মিষ্টি চিড়ে ভেজানো কথা গুলো অপরপক্ষে খুব করে প্রভাব ফেলে।
°°°°°°°°°°°°
রোয়াকে বসে রেবেকা বানু। মুখাবয়বে গুমট ভাব। বার বার দরজার দিকে তাকায়। এই বুঝি ছেলে এলো আর সবটা অস্বীকার করে মাতৃমনকে প্রশান্তি দিলো। উত্তর মুখী সিঁড়িতে বসে ছবি। পাশেই সুরেলা গালে হাত দিয়ে চিন্তিত মুখে বসে আছে। এই চাচি আম্মাও না! সবসময় বাড়াবাড়ি করবে। একদম বাংলা সিনেমার দজ্জাল শাশুড়ি। সুর আপার কপালে বেশ দুঃখ আছে। তবে রিজ ভাই সব ঠিকঠাক সামলে নিবে। মা বউয়ের মাঝে দেয়াল হয়ে দাঁড়াবে। ভাবতেই চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়। তবে নিমপাতার রস মুখে লাগিয়ে থাকা বোন জামাইকে দেখে মুখটা চুপসে যায়। এই দুলাভাই আর কখনো হাসলো না। এতো রসকষহীন মানুষ হয়? দুলাভাইরা হবে রসিক হাসিখুশি মজার মানুষ। আর তার বোন জামাইকে বেরসিক বললেও বেরসিকদের অপমান করা হবে। পুরাই নিমগাছ। সে বিরক্ত হয়ে মুখ মুচরায়। ব্যাপারটা খেয়াল করতেই সাদমানের গম্ভীর মুখটা অপমানে থমথমে হয়ে যায়। ছবির কোলে আপেল দিয়ে বলে,
" খাও?"
আপেল দেখেই ছবির নাড়িভুঁড়ি উল্টে ওঠে যেন । কিছু বলবে তাঁর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে রূপসা বিনয়ী গলায় বলে,
" আপু আপেল পছন্দ করে না ভাইয়া। বেদেনাও খায় না। কমলা লেবু পছন্দ করে।"
" আপেলে কি সমস্যা? এটা অনেক উপকারী।"
ছবি আড়চোখে ছোট বোনের দিকে তাকিয়ে গোমড়া মুখে আপেলে কামড় বসায়। কিন্তু গলা দিয়ে নামাতে পারে না। ব্যর্থ ভরা চাহনিতে চোখ তুলে তাকায়। সাদমান বুঝতে পেরে হাত থেকে আপেলটা নিয়ে বলে,
" জোর করে খেতে হবে না।"
রূপসা আড়চোখে তাকিয়ে আবারও ভেংচি কাটলো। বোন জামাইকে তাঁর আগা গোড়া কোনদিকেই পছন্দ না।সে কিছু বলবে তার আগেই কাঠের বিরাট বড় রাজকীয় দরজা ঠেলে ভেতরে আসে নওরিজ মাহবুব খান। ছেলেকে দেখেই রেবেকা বানুর দেহে যেন প্রাণ সঞ্চার হয়। উঠে এগিয়ে আসেন ছেলের কাছে। তবে ছেলের হাল দেখে কুঞ্চিত হয় ললাট। ঘামে ভিজে চুপচুপে গা। চেক শার্টটা গায়ে লেপ্টে, চুলগুলোও এলোমেলো হয়ে। কপাল বেয়ে ঘাম নয় যেন বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে। রক্তিম চোখ মুখে রাগের বহিঃপ্রকাশ। তবে তাঁর নজরে বিদ্ধ হয় ছেলের হাতে। ময়লা মাখা এক জোড়া জুতা। তিনি বিস্ময়ের সাথে শুধান,
" আব্বা? এ কি হাল আপনার? কি হয়েছে? আর হাতে এই নোংরা জুতাই বা কার? এক্ষুনি ফেলুন?"
ছেলের মাছে জুতো জোড়া ফেলার হেলদোল না দেখে ভদ্রমহিলা নিজেই ছেলের বা হাত থেকে জুতো ফেলার চেষ্টা করেন। নওরিজের হাতের মুঠো শক্ত হয়। ছাড়ে না জুতো জোড়া। রাশভারী স্বরে বলে,
" আম্মা পড়ে বলবো সব। এখন রুমে যাচ্ছি। বিচলিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। ছাড়ুন?"
রেবেকা বানু ছাড়েন না ছেলের হাত। ছেলের হাতটা যে জখমিত। হালকা রক্তের ছিটেফোঁটাও খুঁজে পাওয়া যায়। তিনি আতংকিত গলায় বলেন,
" কি হয়েছে রিজ? হাতে লেগেছে তো!"
নওরিজ মায়ের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে শান্ত গলায় বলে,
" আম্মা বলছি তো কিছু হয় নি। আপনি বিচলিত হবেন না। আমি কামরায় যাচ্ছি! আই নিড আ শাওয়ার।"
বলে পা বাড়ায় নওরিজ মাহবুব। রেবেকা বানুর খটকা লাগে। কি লুকাচ্ছে রিজ? আর হাতেই বা কার জুতা? তাও আবার কোনো মেয়ের! তিনি ছেলেকে পিছু ডাকেন। আঁচলে বাঁধা চাবির গোছা পিঠে ঠেলে এগিয়ে এসে ছেলের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ান। মুখে হাসি ফুটিয়ে বলেন,
" তুই কি কাউকে পছন্দ করিস? আসলে তোর জন্য একটা মেয়ে পছন্দ করেছি। এখন কোনো পছন্দ থাকলে বলতে পারিস।"
নওরিজ মায়ের আগ্রহ ভরা মুখশ্রীতে নজর দেয়। মায়ের মন ভাবনা বুঝতে সময় লাগে না তার। সে মুচকি হেসে বলে,
" আম্মা, আমি সুরেলা সালেহকে ভালোবাসি। খুব শিঘ্রই আপনার বাড়ির আঙিনায় আপনার পুত্র বধুর আগমন ঘটবে। তাকে স্বাগত জানানোর বন্দোবস্ত করুন।"
রেবেকা বানু স্থবির হয়ে যায় কয়েক মুহুর্তের জন্য। মাথায় যেন বাজ পড়লো। নিজ কানকেই বিশ্বাস করতে পারে না। তাঁর ছেলে বলছে এ কথা? যাকে নিয়ে এতো আশা ভরসা সেই ছেলে এক নিমিষেই তাকে মুখ থুবড়ে ফেলে দিলো? তাঁর ভেতরটা জ্বলে পুড়ে ওঠে। আর সেই জলন্ত কয়লায় ঘি ছিটিয়ে দেয় ছামিনা বেগম। ভদ্রমহিলা এগিয়ে এসে বলল,
" আপা এখন তো বিশ্বাস হলো?"
রেবেকা বানু শাণিত চাহনি নিক্ষেপ করে। ছামিনা বেগম ঠোঁট চেপে হাসেন। রেবেকা বানু নিজেকে ধাতস্থ করেন। মাথা গরম করলে চলবে না। তিনি ছেলের দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করেন। খুব একটা সফল হন না তবুও কন্ঠে মধুরতা ঢেলে বলেন,
" আব্বা আপনি কি জানেন রওশনের সাথে ওই মেয়েটার বিয়ের.."
" আম্মা আমি এসব বিষয়ে পড়ে কথা বলি? আ'ম নট ফিলিং গুড। নিড হট শাওয়ার বেডলি!"
মা'কে থামিয়ে দিয়ে বলে নওরিজ। ধীর পায়ে চলে যায় বারান্দা পেড়িয়ে দোতলার দিকে। সে চলে যেতেই রেবেকা বানু ধপ করে বসে পড়েন ফ্লোরে। নওরিন, ছামিনা বেগমের পেছন থেকে ছুটে আসে মায়ের কাছে। উদ্বিগ্ন হয়ে শুধায় মায়ের হালচাল। রেবেকা বানু দাঁত কিড়মিড় করে বলে,
" ফকিন্নীর ঝিয়ের বেগম হওয়ার শখ জাগছে। আমিও দেখি কোথাকার জল কোথায় গড়ায়।"
সাদমান আপেলে কামড় বসায়। এই হলো বাঙালীর স্বভাব! নিজ ছেলের দোষ নেই, সব দোষ সুরেলা নামক মেয়েটার।
°°°°°°°°°°°°
গোধূলি বেলায় সূর্য পশ্চিম দিগন্তে হেলে। লাল আভায় ছেয়ে আছে নীলাম্বর। যেন রংতুলিতে ছুঁয়ে দেওয়া রঙিন ক্যানভাস। মায়ের বিরতিহীন বকা ঝকায় ত্যাক্ত বিরক্ত হয়ে সুরেলা শাপলাদের বাড়িতে গা ঢাকা দিয়েছে। ভেতরের উঠোনে পেয়ারা গাছের মগডালে বসে শুকনো চিড়ে চিবোচ্ছে। মাঝে মাঝে গুড়ের টুকরোয় কামড় বসিয়ে মুখ মিষ্টি করে নেয়। শাপলা ছাগল ছানা কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে গাছ তলায়।ছাগল ছানার গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করে তো কখনো চুমুতে ভরিয়ে দেয়। সুরেলা নাক সিটিয়ে বলে,
" এমন ভাবে চুমা খাইতেছিস যেন তোরই ছল! ওর মায়ের কাছে দিয়া আয়, বুড়ানি গলার রগ ছিঁড়ে ফেললো বলে!"
শাপলা ছাগলের লম্বা কান টেনে রেখে আসে মায়ের কাছে। সুরেলার চিড়ের বাটিতে হাত দিতে নিবে সুরেলা আয়হায় করে বলে,
" ছিঃ নেল্লোস কোনকার! যা সাবান দিয়া হাত ধুইয়া আয়?"
শাপলা চোখ পিটপিট করে চায়। ভ্রু উঁচিয়ে বলে,
" তুমি ওই চেয়ারম্যানের পোলার মতো করতাছো ক্যান সুর আপা? তাঁর বাতাস লাইগছে নাকি?"
সুরেলা মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিমা করে বলে,
" কে চেয়ারম্যানের পোলা? তাকে আমি চিনি না। চিনলেও ভুলে গেছি। ওই খুঁতখুঁইত্যা লোকের কথা আমার সামনে কবি না শাপলা।"
" ক্যান? ঝগড়া লাগছে আপা?"
সুরেলা অবাক চোখে চায়। সব চিড়ে ওড়নায় ঢেলে স্টিলের বাটিটা খালি করে শাপলার মাথায় গাট্টা মেরে বলে,
" তোরে বুঝান আমার পক্ষে অসম্ভব। দূর হ চোক্ষের সামনে থাইক্যা?"
শাপলা যায় না। গাল ফুলিয়ে বলে, "তুমি আমার লগে এমন করো তাই তো আমি সিন ভাইরে সব কইয়া দিছি। তোমরা প্রেম করবা চিঠি দিবা নিবা আমি কইলেই এমন ভান ধরো যেন হেরে দুই চোক্ষে দেখবার পারো না। অথচ তোমার বইয়ের বেবেক পৃষ্ঠায় এন এস লেখা আছে। আমি আগে বুঝি নাই অহন বুঝি তো। এন তে চেয়ারম্যানের পোলা আর এস তে তুমি!"
সুরেলার চোখ কপালে। কি বলে কি এই মেয়ে? সিন ভাইকে সব বলে দিয়েছে মানে কি? সে ওড়নার চিড়ে গিঁট বেঁধে গাছের মগডাল থেকে নেমে আসে। শাপলা বিপদ সংকেত বুঝতে পেরে আগেই পগারপার। সুরেলা ডেকে হয়রান। কোথায় লুকিয়েছে খুঁজে পায় না। মেয়েটা কি তাঁকে অছেলা বাঁশ দিলো? ভাই তো তাকে কুচি কুচি করে লবণ মরিচ দিয়ে মেখে রোদে শুকিয়ে শুঁটকি বানাবে। বাড়ির আনাচে কানাচে খুঁজেও শাপলাকে খুঁজে পায় না। ভয়ে কোন গর্তে লুকিয়েছে কে জানে! তাঁর ঢের শিক্ষা হয়ে গেছে, ম্যানা রা ত্যানা ছিঁড়ে কথা খাব্বে খাপ ফলে গেছে। হাতের কাছে পাক মেয়েটাকে বিন্দি মরিচ দিয়ে বানাবে। সে রাগে গজগজ করতে করতে নিজ বাড়িতে ফিরে আসে। শুরু হয়ে যায় শান্তি বেগমের গালাগাল। সুরেলা আমলে নেয় না। জানোয়ারটাকে জুতো ছুঁড়ে মেরেছে বেশ করেছে। জুতো পেটা করতে পারলে আরো শান্তি পেতো। সে ঘরে গিয়ে চিড়ে গুলো কৌটায় রেখে দেয়। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসবে খেয়াল করে জানালার ধারে চৌকিতে কিছু আছে। সুরেলা কপালে ভাঁজ ফেলে এগিয়ে যায়। হামাগুড়ি দিয়ে জানালার ধারে গিয়ে দেখে একটা রঙিন বেতের ঝুড়ি। ঝুড়িতে ডজন তিনেক রেশমী চুরি তাও লাল রাঙা। তাঁর মুখে মুখে বিস্ময়। চৌকি থেকে চটজলদি নেমে দরজা লাগিয়ে দিল। আবারও চৌকিতে উঠে ঝড়ের বেগে। পুরনো চৌকি ক্যাত ক্যাত শব্দ সৃষ্টি করে। সুরেলা ঝুড়িটা কোলে নিয়ে চুরি গুলো বের করে। একজোড়া ঝুমকা নজর কাড়ে। বেশ নজরকাড়া ঝুমকো জোড়া। একটা লাল পুঁতির মালা, কাজল, কুমকুম, চুল বাঁধার নানা রঙের ফিতে, সাথে আলতার কৌটো। সুরেলা হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া অস্বাভাবিক! এ কার কাজ? খুঁতখুঁইত্যা লোকের? সুরেলার গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে। ঝুড়ির তলানিতে একটা লাল গোলাপের নিচে সাদা চিরকুট দেখতে পায়। কাঁপা হাতে ফুলটা তুলে সুবাস নেয়। ফুলটা একপাশে রেখে চিরকুট তুলতেই দৃশ্যমান হয় গোটা গোটা অক্ষরে লেখা,
"আমার বেসুরো জীবনে সুরেলার আগমন হোক দ্রুত"
ভাইয়ের কর্কশ গলা কানে বাজতেই সুরেলা চিরকুটটা মুড়িয়ে ঝুড়িতে রাখে। ভাইয়ের হাতে ধরা খেলে শক্তপোক্ত চর নিশ্চিত। তার উপর শাপলা আগেই গন্ডগোল বাঁধিয়ে রেখেছে। সে ঘরের রঙ চটা টিনের বাক্সে লুকিয়ে রাখে ঝুড়িটা। ওই খুঁতখুঁইত্যা লোককে হাতে কাছে পাক? মুখের নকশা না বলদেছে তো তাঁর নাম সুরেলা সালেহ না। সে দরজা খুলে বেরিয়ে আসে। কানে মা ভাইয়ের কথোপকথন ভেসে আসে। তাঁর ব্যাপারেই কথা হচ্ছে। সেলিম রেজাকে জুতা ছুঁড়ে মেরেছিল সেটা নিয়েই মা নালিশ করছে ভাইয়ের কাছে। তবে ভাইয়ের কথা শুনে হাত পা কেমন ঠান্ডা অনুভূত হয়।ভয়ে অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে। আবারও ভাইয়ের রাগি আওয়াজ শোনা যায়,
" অবস্থা খুব খারাপ মা। বাঁচলে হয়। বাঁচলেও আমার হাতে মরবো। শুয়োরের বাচ্চা সাহস কত বড় আমার বোনের দিক চোখ তুইল্যা চায়। ওর তো চোখ তুইল্যা নেওয়া উচিত। রিজ ভাই না মারলে আমিই ওরে কবরস্থান পাঠাইতাম। সুর কই?"
শান্তি বেগম ভোঁতা মুখে মেয়েকে দেখায়। সুরেলা নত মুখে দাঁড়িয়ে। সিনান এগিয়ে এসে বোনের মাথায় হাত রাখে। গর্বের সাথে বলে,
-" এই না হলে সিনান সালেহের বোন। জীবনে কোনো পরিস্থিতিতে ভয় পাবি না। মনে রাখবি তোর ভাই সবসময় তোর ঢাল হয়ে আছে।"
°°°°°°°°°°°°
আধা ঘন্টার বেশি সময় নিয়ে গোসল সেরে বের হয় নওরিজ মাহবুব। নাভিকুন্ডের বেশ নিচে টাওজার। চুল হতে পানি চুঁইয়ে পড়ে বলিষ্ঠ গা ছুঁয়ে দেয় নির্লজ্জ পানির ফোঁটা। লোমহীন বলিষ্ঠ বুকে পানির কণাগুলো যেন আঠার মতো লেপ্টে। সাদা তোয়ালের ঘর্ষণে তারা বিচ্ছিন্ন হয়। নওরিজ মাহবুব আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলে তোয়ালে ঘষে। ড্রেসিং টেবিলের উপর জুতো জোড়ায় এখন আর ময়লা নেই। ঘঁষে মেজে ঝকঝকে করা হয়েছে কিছু সময় আগেই। দরজা ঠকঠকানোর আওয়াজে নওরিজ মাহবুব গায়ে ঘিয়ে রঙের চাদর জড়িয়ে বলে,
" ভেতরে আসুন আম্মা!"
নওরিজ ভাবে মা এসেছে। কিন্তু রওশনকে দেখে অবাক হয় ক্ষীণ। সকালের ঘটনা মাথাচাড়া দেয়। গায়ের চাদর বিছানায় ফেলে গম্ভীর মুখে শুধায়,
" কিছু বলবি?"
রওশন এগিয়ে আসে জড়তা ঠেলে। ভাইয়ের চোখে চোখ পড়তেই অস্বস্তি জড়তায় বুঁদ হয় তনু মন। যতই হোক বড় ভাই বলে কথা! চোখ সরাতেই রওশনের নজর ড্রেসিন টেবিলের উপর মেয়েলী জুতোয় নিবদ্ধ হলো। এটা তো সুরেলার! এখানে কি করছে? সে প্রশ্ন ভাজক চাহনিতে নওরিজের পানে ফেরে। নওরিজ জুতো জোড়া একপল দেখে শান্ত গলায় বলে,
" অবাক হওয়ার কিছুই নেই। কিছু বলতে চাইলে বল? আমি একটু বেরোবো।"
রওশন গম্ভীর মুখে বলে, " রিজ ভাই আমি সুরেলাকে অনেক.."
" এই টপিকে কোনো কথা বলতে চাইছি না। আমার যা বলার বলে দিয়েছি। এটা কোনো খেলনা বস্তু বা ফেবারিট টি শার্ট নয় যে আমি স্যাক্রিফাইস করবো। আমার প্রথম আর শেষ কথা সে আমার।"
রওশনের চোয়াল দৃঢ় হয়। ধুপধাপ পা ফেলে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। নওরিজ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এ কোন কঠিন খেলায় জড়িয়ে পড়লো তাঁরা দুই ভাই!
°°°°°°°°°°
ভর দুপুর বেলায় আর সন্ধ্যার পর তেঁতুল গাছের তলায় সাধারণ মানুষের আগমন শূন্যের কোঠায়। ভূত নামক ভ্রমের ভয়ে তেঁতুল তলায় পা মাড়াতে গা ঝমঝম করে ওঠে সাথে বেলা গড়াতেই হাড় কাঁপানো জ্বরে কাঁথা মুড়ি দিতে হয়। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নেমেছে। তেঁতুল তলায় কুটকুটে আঁধার যেন পাতিলের কালি। এই কালি অন্ধকারে গুসুর ফুসুর শোনা যায়। ভুতুড়ে শব্দ মনে হলেও তা মানবসৃষ্ট। অপেক্ষার প্রহরে অতিষ্ঠ মানবদ্বয় ক্ষুব্ধতা প্রকাশ করে হিসহিসিয়ে।
" ভাই? মনে হয় না আজ আর আইবো। আসলে এতোক্ষণে পৌঁছায় যাইতো।"
" শালারা মরছে। না জানি কনে গোমারা দিতাছে হুমুন্দির বাচ্চারা। সালেহ তোর কাছে ফোন আছে না?"
সালেহউদ্দিন লুঙির কোমড়ের ভাঁজ হতে নোকিয়া ফোনটা বের করে দেয়। অজ্ঞাত লোকটা নম্বর তুলে কল লাগায়। পুত পুত শব্দ হয় ফোনের। কিন্তু রিসিভ হয় না। লোকটা আবারও অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করে যায়। অপেক্ষার প্রহর ভেঙ্গে কাঙ্ক্ষিত ব্যাক্তির আগমন ঘটে। হারিকেনের টিমটিমে সোনালী আলোয় কালো চাদরে মুড়ে এক মেয়েলী কায়া। সাথে বিশালদেহী দু'জন দেহরক্ষী। অজ্ঞাত লোকটা সালেহউদ্দিনকে ইশারা করে এগিয়ে যায়।
" আপনে কেডা চিনলাম না তো! শফিল ভাই পাঠাইছে?"
মেয়েলী কায়া মাথা নাড়ে ঘনঘন।অজ্ঞাত লোকের কপালে সন্দেহের বীজ। শফিল ভাই হঠাৎ মেয়েটিকে কেন পাঠালো? সে বেশি প্রশ্ন করে না। সাদা কাগজে মোড়ানো কিছু বান্ডিল মেয়েটার হাতে দিয়ে কালো ব্যাগটা হাতে নেয়। মেয়েটা মিহি স্বরে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে অন্ধকারে মিলিয়ে যায়।
.
.
.
চলবে....................................................................