" কাল পেয়ারি দামুর বাড়িতে গেছিলো। কেন গেছিলো এখনো ক্লিয়ার না।"
" আচ্ছা ঠিক আছে। জামাল কোথায়? ওকে আমার কাছে পাঠিয়ে দে।"
সবাই সায় জানিয়ে চলে যায় জামালের খোঁজে। নওরিজ খালি কফির মগটা রেখে আবারও নীলচে খামে কিছু আঁকিবুঁকি করে। হেডফোনটা আবারও কানে লাগাবে সাদমানের আগমনে পূর্বাবস্থায় রেখে দেয়। সম্মুখ চেয়ার থেকে পা নামিয়ে স্যান্ডেল পড়ে বলে,
" সাদমান ভাই যে বসুন? বিবাহিত জীবনে প্রথমবারের মতো শ্বশুরবাড়িতে এতো গুলো দিন কাটাচ্ছেন। কেমন লাগছে?"
সাদমান খালি চেয়ার টায় বসে আয়েশ করে।
"তোমার এক বেগে স্বভাবের জন্য বাধ্য হয়ে থাকছি রিজ। তবে অনেক হয়েছে কালকেই ফিরছি সাথে রূপালীও যাবে।"
ভদ্রলোকের কথায় রিজ ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বলে,
" সে দেখা যাবে।"
সাদমান সুক্ষ্ম চোখে চায়। সে প্রসঙ্গ বদলে বলে,
" তোমরা দুই ভাই একই ঘাঁটে নৌকা ভিড়াতে চাইছো। কিন্তু সেটাতো সম্ভব নয়। কাউকে না কাউকে তো স্যাক্রিফাইস করতেই হবে। তুমি বড় বুঝদার.."
" যখন তাঁর প্রসঙ্গ উঠবে আমি বড্ড অবুঝ সাদমান ভাই। আমি হয়তো বুঝতে পারছি আপনি কি বলবেন। বাট আই কান্ট।"
থেমে যায় নওরিজ। কন্ঠে নমনীয়তা এনে বলে,
"আমি তাঁর জন্য সব হারাতে চাই কিন্তু তাকে নয়।"
গম্ভীর মুখো সাদমানের অধরকোনে ঝিলিক দেয় হাসির কণা। কাকে কি বোঝাতে এসেছে সে? রিজের আগা গোড়া ঠোঁটস্থ তাঁর। তবে রওশনের জন্য খারাপ লাগে। বেচারা হয়তোবা বুঝতে পারছে ঢাল তলোয়ার বিহীন এ যুদ্ধে তাঁর পরাজয় নিশ্চিত! তবুও চেষ্টা করেই যাচ্ছে।
"যাত্রাপালা দেখতে যাবেন?"
নওরিজের প্রশ্নে সাদমান চোয়ালে হাত বুলিয়ে বলে,
"যাত্রাপালা আমরা দেখতাম ছোটবেলায়। বেহুলা লক্ষীন্দর, নছিমন, শিরি ফরহাদ, সিরাজউদ্দৌলা, হাসন রাজা আরো বিভিন্ন কাহিনী ফুটিয়ে তোলা হতো। ভালোই ছিলো কিন্তু তোমাদের এখানে তো যাত্রাপালা নামে অন্যকিছুই হয়ে থাকে।"
সাদমানের কথায় নওরিজ হাসলো। ছোটবেলায় তারাও তো রাত জেগে দেখতো যাত্রাপালার মঞ্চ।
" যুগ দিনকে দিন আপডেট হচ্ছে ভাই। আধুনিকতার ছোঁয়ার আড়ালে অশ্লীলতা ওৎ পেতে রয়েছে। সে বাদ দিন যাবেন কি না বলুন? টিকিট কাটাই আছে। একটু সেখানকার পরিস্থিতি দেখে আসলেন। আপনি তো অভিজ্ঞ মানুষ। সহজেই ধরতে পারবেন হালচাল। "
নওরিজের কথায় সাদমান বাঁকা চোখে চায়। সম্মতি প্রকাশ করে বলে,
" বাইরের পরিস্থিতি না হয় দেখলে। ঘরের দিকে আগে নজর দিলে শিঘ্রই সমাধান মিলবে রিজ।"
নওরিজ মাহবুব উষ্ণ শ্বাস ফেলে। শান্ত চোখে চোখ রেখে বলে,
" নজর সবদিকেই রেখেছি সাদমান ভাই। প্রমাণ মিললে ঘর তছনছ করতেও হাত কাঁপবে না। অন্যায়ের সাথে কোনো আপোষ নেই।"
সাদমান রহস্যময়ী হাসে শুধু। কিছু বলে না। নওরিজের সন্দেহ হয়। সাদমান ভাইয়ের কথাবার্তায় মনে হয় ভদ্রলোক অনেক কিছুই জানেন। তবে নওরিজ কোনো প্রকার প্রশ্ন ছুঁড়ে মারে না। সে বলল,
" যাচ্ছেন তাহলে?"
সাদমান মাথা নেড়ে বলে, " তোমার বোন ফুলে বোম হয়ে থাকবে।"
নওরিজ ভ্রু উঁচিয়ে চায়। হেয় সুরে বলে,
" বাহ্ ছবিকে ভয় পাচ্ছেন নাকি? বেচারি তো আপনার সামনে মেনি বিড়াল হয়ে থাকে। ভয়ে হাঁটু কাঁপাকাপি অবস্থা।"
সাদমান মুখাবয়ব ক্ষণিকের জন্য স্বাভাবিক হলেও নওরিজের কথায় বরাবরের মতো হয়ে আসে। নওরিজ সোজা হয়ে বসে। শান্ত গলায় বলতে শুরু করে,
" ছবিটা ছোট থেকেই চঞ্চলা। রূপের মতোই টইটই করে ঘুরতো ফিরতো মস্তি মজা করতো যেন মুক্ত বিহঙ্গ। পুরো বাড়ি মাথায় তুলে নাচতো। সেই বিহঙ্গ খাঁচায় বন্দী হতেই তাঁর স্বরূপ হারিয়েছে। সেই কিশোরী ছবির সাথে আজকের ছবির আকাশ পাতাল তফাৎ। আপনি বড়, বিচক্ষণ। আশাকরি বুঝতে পারেন ছবি আপনাকে ভয় পায়। কেন পায় কখনো জিজ্ঞেস করি নি কারণ আপনাকে চিনি আমি। তবে ছবির এ হাল দেখে আজ প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করছে!"
" আমি তো তাঁর চোখে মুখে ভয় দেখি না রিজ। তার চোখে মুখে তো অভিমান ঠিকরে বেরোয়। সে আমাকে যেমন ভাবে চায় আমি তেমন কখনোই হতে পারবো না। তবে আমি খানিকটা আমার মতো করে আর খানিকটা তার মতো করে, তাকে পাশে নিয়ে হাঁটতে চাইছি কিন্তু অবুঝ সে বুঝতে চায় না।"
সাদমান মুখাবয়ব গম্ভীর। মাথা তুলে ছাদে রেলিং ঘেঁষে দন্ডায়মান বধুয়ার পানে তাকায়। সেও এদিকেই তাকিয়ে। চোখাচোখি হয় মিয়া বিবির। সাদমান কিছু না বলে উঠে অন্দরমহলের ভেতরের দিকে চলে যায়। নওরিজ ভ্রু কুঁচকে চায়। ছাদে ছবিকে দেখে যা বোঝার বুঝে নেয়। সে আবারও সম্মুখে বেতের চেয়ারে পা তুলে বসে আয়েশে। দিন দিন কেমন অলস হয়ে যাচ্ছে সে। বউটা থাকলে তাঁর সাথে চুলোচুলি করে বেশ সময় কাটানো যেতো। সে হামি তুলে শার্টের উপরের তিনটে বোতাম খুলে লম্বা শ্বাস ছাড়লো। চোখ বুজে ক্ষণিকের কল্পরাজ্যের ভ্রমণে পা বাড়াবে জামালের ডাকে পা গুটিয়ে নেয়। চোখ মুদে রেখেই ত্যাক্ত স্বরে বলে,
" কি খবর?"
জামাল ভনিতাহীন কাঠ কাঠ গলায় বলে, " আধা ঘন্টা হলো লক্ষ্য করছি ভাবী হাতে একটা ঝুড়ি নিয়ে চেয়ারম্যান বাড়ির চারপাশে চর্কির মতো ঘুর ঘুর করছে। গেইট দিয়ে উঁকি দিচ্ছে বারবার। আমি গিয়ে জিজ্ঞাসা করতেই ঝুড়িটা আমাকে দিয়ে বললো আপনাকে দিতে।"
নওরিজ মুদে রাখা নয়নাভিরাম মেলে ধরেছে আদিতেই। চেয়ার ছাড়তেও সময় নেয় নি। চ্যালাদের হাতের দিকে তাকায়। কিন্তু হাত তো খালি! হারুণ দাঁত কেলিয়ে বলে,
" ভাই আমরা আনি না ই তো। জামাল হাতে নিতে নিছিলো আমরা নিতে দিই নাই। কইছি আপনে এক মিনিট খাঁড়ান ভাবী। ভাই এক্ষুনি আইবো। জলদি যান? ভালো কাজ করি নাই কন ভাই?"
নওরিজ তাকে জবাব দেওয়ার অপেক্ষায় থাকে না। লম্বা লম্বা পা ফেলে চলে যায় গেইটের বাইরে। রিজ ভাইয়ের তাড়া দেখে হারুণ, বাবু, তমাল হেসে ওঠে সমস্বরে। বাবু ভেংচি কেটে বলে, "মাইয়া মানুষ জন্মায় পুরুষের উপর শাসন করনের লাইগা। বুঝলি সবাই?"
°°°°°°°°°°
বিরক্ত মুখে রাস্তার ধারে ছোট্ট ডোবার নিকটবর্তী জারুল গাছের নিচে দাঁড়িয়ে সুরেলা সালেহ। হাতে ঝুড়িটা এখানেই রেখে চলে যেতে ইচ্ছে করে। খুঁতখুঁইত্যা লাট সাহেবের সামনে যাওয়ার এক বিন্দু ইচ্ছে নেই তার। তবুও যেতে পারে না। শুকনো পাতার মড় মড় শব্দে ডানে তাকায়। আগত ব্যাক্তিকে দেখে মনের কোণে ভিত জমে ক্ষীণ। রক্ত লাল চাহনিতে ক্ষোভ স্পষ্ট। ক্ষোভের কারণ জানা তাঁর। সুরেলা পা চালায় চলে যাবার জন্য। মহির নামক লোকটার বিশ্রী কন্ঠে থেমে যায় পদযুগল।
"আরে ভাবীজান যে! বাইরে ক্যান খাড়াই আছেন?ভেতরে যান না? খান বাড়ির দুই পোলাই ভারী খুশি হইবো। পোলার বাপেরা আবার কি করলো! তাগোরেও খেয়াল রাইখেন। সময় পাইলে আমগোরে মতোন চুনোপুঁটিরেও সুখ দিবার পারেন। বড় গাড়ি বাড়ি নাই দেইখ্যা কিছুই নাই ভাইব্যা ভুল কইরেন না!"
সুরেলার গান ঘিন ঘিন করে ঘৃণায়। দাঁত কিড়মিড় করে বলে,
" ভাগ্যিস তোর ঘরে মা বোন নাই! থাকলে তাগোরেও রেহাই দিতি না। পায়ে স্যান্ডেল দেখছোস? এমন সুখ দিমু সব কুড়কুড়ানি জন্মের মতো থাইমা যাইবো। শালা হিজরা কোনকার!"
সুরেলার শেষোক্ত সম্বোধন মহিরের কানে জলন্ত ছুরির মতো বিঁধে। অশ্রাব্য গালি দিয়ে কিছু বলতে উদ্যত হয় তবে নওরিজকে আসতে দেখে থেমে যায়। উল্টো পথে পা বাড়িয়ে কেটে পড়ে বাতাসের গতিতে। নওরিজকে দেখেই সুরেলার মন যেন মেজাজ সপ্ত আসমানে চড়ে। হাতের ঝুড়িটা একপ্রকার ছুঁড়ে ফেলেই গরম তেলে পানির ছিঁটার মতো ছ্যাত করে বলে ওঠে,
" কি ভাবেন কি নিজেকে হ্যাঁ? আপনার দুই পয়সার উপহার দেইখ্যা আমি সুরেলা আপনার গলায় ঝুইল্যা পড়মু? সুরেলার জুতাও ঝুলতো না আপনার গলায়। ছোট ঘরের হইবার পারি আল্লাহ সম্মানবোধ কম দেয় নাই। আরেকবার এরম কান্ড করলে আমি ভাইরে জানাইতে বাধ্য হমু।"
নওরিজের সন্দেহভাজন চাহনি মাটিতে নিবদ্ধ। পায়ের কাছে মাটিতে পড়ে থাকা ঝুড়ি হতে কিছু মেয়েলী সাজনা পাতি দেখা যায়। নওরিজ ঝুঁকে বা হাতে তুলে নেয়। সুরেলার পানে সরাসরি তাকিয়ে জবাব দেয়,
"তোর কষ্ট করতে হবে না। সেসব আমি আগেই ক্লিয়ার করে রেখেছি। এখন শুধু ঘরে তোলার অপেক্ষায় মুখিয়ে।"
সুরেলার চোখে মুখে বিস্ময় খেলা করে। আগেই ক্লিয়ার করেছে মানে কি দাঁড়ায়? সে প্রশ্নবাণ ছুঁড়বে তাঁর আগেই নওরিজ মাহবুব ছুড়ে ফেলে। ঝুড়িটা কচুরিপানায় আচ্ছাদিত ডোবায় চুবানি খায়। সুরেলার চোখ মুখ হা হয়ে যায়।
" ফাইলা দিলেন ক্যান? রূপসারে দিতেন! ঢংগি খুশি হইতো খুব!"
সুরেলার কন্ঠে বিস্ময়ের সাথে আফসোস। হুদাই জিনিস নষ্ট করার মানে হয়? কিনতে ট্যাকা লাগে নাই? ট্যাকা কি গাছে ফলে নাকি? নওরিজ মাহবুব রাশভারী স্বরে প্রত্যুত্তর করে,
" ওগুলোর জায়গা ওখানেই!"
সুরেলা বিরক্তে ভ্রু কুঁচকায়। ধনীর দুলাল কি বুঝবে টাকার মর্ম! তাঁর কি? সে তো ফেরত দিয়েছে এটাই যথেষ্ট! এখন কেটে পড়তে পারলেই বাঁচে। নওরিজের শান্ত চাহনি খেলে বেড়ায় সুরেলার আপাদমস্তকে। মলিন সালোয়ার কামিজ।কালিমাখা ময়লা ওড়না মাথা আবৃত করে রেখেছে শালীনভাবে। খুবই সাধারণ ছিমছাম গরণের এক গ্রামীণ ঝি। যার আপাদমস্তক সাধারণের ছোঁয়া থাকলেও কান্তিমান আঁখি যেন উত্তাল তটিনী। নওরিজ হাত বাড়িয়ে মাথার ঘোমটা টা আরেকটু টেনে বলে,
" ডার্লিং, বেহালা পালকি সাজাচ্ছে। বাপের বাড়িতে অল্প ক'দিন প্রাণ খুলে উপভোগ করে নে। শশুর বাড়িতে বরের ফরমায়েশ খাটতেই দিন পেরুবে। অন্ধকারে হ্যারিকেনের নিভু নিভু আলোয় সুঁই সুতোর আলাপনে প্রতিশ্রুতি বুনে বাকিটা জনম আমার হাতের মুঠোয় বন্দিনী হয়েই পারি দেওয়ার জন্য নিজেকে প্রস্তুত কর সুর।"
কাজলের সুক্ষ রেখায় আঁকা কান্তিমান আঁখি যুগল শাসায় সম্মুখ ব্যাক্তিকে। তবে নওরিজ নজর কাড়ে লাজে রাঙা ফুলে ওঠা কপোলে। ছুঁয়ে দেওয়ার খায়েশ জাগলেও হাত গুটিয়ে নেয় পকেটে। বেহায়া হাতের ভরসা নেই। সুরেলা গুলিয়ে ফেলে নিজেকে। সম্মুখ ব্যাক্তিকে দু'টো কড়া কথা শুনিয়ে দিতে চায় তবে শব্দ জুড়তে ব্যর্থ হয়ে উপহাস করে বলে,
" লুইচ্চা বেডা কোনকার! শখ কতো জনাবের! মেহগনি গাছের বড়ি খাওয়াইবাম পানিতে গুইল্যা। সব শখ বাপ বাপ কইরা পালাইবো।"
বলে নিজ রাস্তা ধরে সুরেলা। জলদি বাড়ি ফিরতে হবে। সিন ভাই বাড়িতেই। টের পেলে হাতে সরিষার তেল মেখে থাপড়াবে।
" এই ডার্লিং শোন?"
সুরেলার গা শিরশির করে উঠলো যেন। চোখ মুখ খিঁচে নিজেকেই ভয়ংকর গালি ছুঁড়ে। মাটির রাস্তায় চোখ বুলিয়ে এক টুকরো ইটের খোঁজ পায়। হাতে তুলে ছুঁড়ে মারে নওরিজের উদ্দেশ্যে। কর্কশ স্বরে চেঁচিয়ে বলে,
" রিজ ভাই আপনার মুখ আমি সেলাই করা দিমু কইলাম। আপনের বউরে যা খুশি ডাকেন ডার্লিং সোনা বাবু পিতলা ঘুঘু! আমারে ডাকলে কল্লা কাইটা নিমু।"
ঢিলটা একদম বুক বরাবর আঘাত হানে। ক্ষত সৃষ্টি করে ক্ষীণকায়। নওরিজ বুকের বা পাশটা উন্মুক্ত করে দেখে নেয় হালচাল। হালের অবস্থা বেহাল। সুরেলার দিকে সুক্ষ্ম চোখে চায়।
" তোরে কহন ডাকলাম? আমার ডার্লিংরে ডাক দিছি। তুই তোর ভাইয়ের লাহান চ্যাতোস ক্যান?"
আঞ্চলিক ভঙ্গিতে বলে ওঠে নওরিজ। অধর কোণে দুষ্টু মিষ্টি হাসি। সুরেলার পা থেকে মাথা অবদি জ্বলে ওঠে। কতবড় অসভ্য লোক! রাস্তায় দাঁড়িয়ে এক অবলাকে বলিষ্ঠ বুক দেখাচ্ছে! সুরেলা ধচং বচং রাগ দেখিয়ে আবারও পা বাড়ায়। অহেতুক জঞ্জালে জড়ানোর মানেই হয় না। পিছু থেকে আবারও সেই ডাক ভেসে আসে,
" এই ডার্লিং, শুনে যা না?"
সুরেলা এ যাত্রায় থামে না। হাঁটার গতি বাড়িয়ে যেতে যেতেই জবাব দেয়,
" সাত তলা বিল্ডিং, তেঁতুল গাছের পেত্নি আপনের ডার্লিং!"
নওরিজ মাহবুব পরিপাটি চুলে হাত বুলিয়ে হাসে। বড় বড় পা ফেলে পিছু নেয় রমনীর। কিশোর ছেলেপেলেদের মতো পকেটে হাত ঢুকিয়ে ঠোঁট চোখা করে সিটি বাজায়। সুরেলা দাঁত কটমট তাকায়, তো কখনো দু তিনটে শুদ্ধ বাঙালি গালি ছুঁড়ে মারে। নওরিজ কানে নেয় না গালি। লোকালয়ে প্রবেশ করতেই আশেপাশের পথচারী বাঁকা চোখে চায়। চেয়ারম্যানের পোলা আর খিটখিটে সিনের বোন সুরেলা, দু'জনকেই ভালো করে চেনা তাদের। সেগুলো উপেক্ষা করে নওরিজ একটু আবেগে গা ভাসায়। তবে সুরেলা হেলাফেলা করতে পারে না। সে পস্তায় কেন আসতে গেলো। নওরিজ হঠাৎ ধুপধাপ পা ফেলে সুরেলার সাথে হাঁটে। শুধু হাঁটার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না। মসৃণ হাতটাকে বন্দিনী বানায় নিজ হাতের মুঠোয়। বিস্ময়ে হতবাক সুরেলার যেন চোখে অন্ধকার দেখতে পায়! এটা কি কোনো দুঃস্বপ্ন যা সে জেগে জেগে দেখছে? কোথায় টেনে নিয়ে যাচ্ছে লোকটা তাকে?
°°°°°°°°°°
অম্বর কোণে মেঘরাজ চোখ পাকিয়ে আছে। ঝড়োয়া বাতাস তাঁর রাগের বহিঃপ্রকাশ। কুত্তা মরা গরমের পর বাতাসে তনুময় শীতলতার আবেশে স্বস্তি পায়। মেলার অধিকাংশ আল্লাহর নাম জপে যাচ্ছে। ঝড় হলে মেলা ভেস্তে যাবে। কতদূর দূর থেকে দোকানিরা একটু বেচাকেনার তাগিদে ছুটে এসেছে। ঝড় হলে মালছামানা নিয়ে কোথায় ঠায় গুজবে? সবাই মনে প্রাণে আল্লাহর কাছে চাইছে ঝড়োয়া বাতাসে মেঘরাজ যেন চলে যায় কৃপা করে। ইকরাম উল্লাহ ছেলে মেয়েকে নিয়ে চাচা শ্বশুরের সাথে মেলায় এসেছে। মেয়েটাকে খুব সাবধানের সাথে আগলে রাখছে। তাঁর ভুল হয়েছে মেয়েকে মেলায় আনা। এই ছোট্ট মেয়েটাও ভিড়ে বাজে হাতের স্পর্শ থেকে রেহাই পাবে না। এইটুকুন মেয়ের গায়ে হাত দিয়েও তাঁরা যৌনতা খুঁজে বেড়ায় অথচ হাতটা হওয়ার কথা ছিলো স্নেহের। ইকরাম উল্লাহ মেয়ের জন্য মাটির খেলনা বস্তু দামাদামি করে। হঠাৎ মেয়েলী গলায় ঘার ঘুরিয়ে তাকায়। এই ভিড়ভাট্টার মাঝেও এক নারী সাচ্ছন্দ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বেনুনী ঘুরিয়ে মুখে পান পুরে মিটিমিটি হাসছে। সে কান খাঁড়া করতেই শুনতে পায় মেয়েটার নাম পেয়ারি দামু। এই সেই দামু? মেয়েটা রূপ সুরতে প্রসংসনীয়!
দামিনী সুভার জন্য ফুলের মালা কিনতে এসেছে। সাথে তাঁর বিশালদেহী দুই দেহরক্ষী। চেয়ারম্যান বাড়ির মেয়ে জামাইকে দেখে মিষ্টি হেসে দুই হাত মিলিয়ে আদাব জানায়।
" আমি ভুল না করলে আপনি নওরিনের পতিদেব তাই না? এ দু'টো রিনের ছেলে মেয়ে বুঝি?"
ইকরাম উল্লাহ অবাক হয়। মেয়েটা তাকে চিনে কিভাবে? মেয়েটা বললে ভুল হবে ভদ্রমহিলা নওরিনের বয়সীই হবে।মেয়েরা অবশ্য কুড়ি পার হলেই মহিলা বনে যায়। তবে তাঁর সুরত দেখে বয়স ঠাহর করা মুশকিল। সে ভদ্রসুলভ হেসে সায় জানালো। দামিনী ইয়ামিনের মাথায় হাত বুলিয়ে গাল টিপে দিয়ে নামধাম জিজ্ঞাসা করে।
" আপনি নওরিনকে চিনেন? ওর পরিচিত বুঝি?"
ইকরাম উল্লাহর কথায় দামিনী মুচকি হাসলো। কিছু বলবে তৃতীয় ব্যাক্তির গলা শোনা যায়। দামিনী ইয়ামিনের থেকে নজর সরিয়ে ইকরামের বাম পাশে তাকায়। ব্যাক্তিটিকে দেখে হাসি চওড়া হয়। পানের পিক ফেলে বলে,
" কেমন আছেন বাবু?"
রমজান মিয়া কেমন থতমত খেয়ে যান। হে হে সুরে হাসার চেষ্টা করে তড়িঘড়ি করে বলে, " আছি ভালোই। তুমি কেমন আছো দামিনী? এখানে কি করছো? এই ভরা মেলায় একা মেয়ে মানুষ কেমন দেখায় বলো?"
দামিনী পান খাওয়া টকটকে অধর মেলে শব্দ করে হাসে। ইয়ামিনের মাথার চুল এলোমেলো করে বলে,
" কেমন দেখায় বাবু? আমার তো আমি ছাড়া কেউ নাই। মাঝনদীতে নিয়ে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো। তাই প্রয়োজনের তাগিদে আসতে হয়।"
রমজান মিয়া তাঁর কথার গভীরতা বুঝেও বুঝতে চায় না। কথা না বাড়িয়ে তাগাদা দেয় ইকরামকে। ঝড় উঠলো বলে; জলদি ফিরতে হবে। দামিনী ম্লান চোখে দাঁড়িয়ে দেখে তাদের উপেক্ষা। মুখে থাকা পানের অবশিষ্টাংশ থুতু সহ ফেলে চোয়াল শক্ত করে নেয়। কারো পৌষ সংক্রান্তি তো কারো শনির আখড়া!
" এই সেই পেয়ারি দামু? যার চর্চা গাঁয়ে গাঁয়ে তাই না?"
ইকরামের প্রশ্নে রমজান মিয়া কোনমতে 'হুঁ' বলে। ইকরাম আবারও শুধায়,
" আপনাদের পরিচিত? মেয়েটা নওরিনকেও চিনে। এমনকি আমাকেও চিনতে পারলো। অথচ যতদূর মনে পড়ে আমি তাকে কখনো দেখিনি!"
রমজান মিয়ার কপাল বেয়ে শ্বেদজল গড়ায়। শুকনো ঢোক গিলে হাসার চেষ্টা করে বলে,
" বাদ দাও তো জামাই! ওই বাজারি মেয়েদের ব্যাপারে কথা বলতেও গা ঘিন ঘিন করে। তুমি কি আরো ঘুরবে মেলায়? চলো ওদের নিয়ে নাগরদোলায় উঠি? নানজান ভয় পাবেন না তো?"
ইকরাম উল্লাহ আর কথা বাড়ায় না। ইয়ামিন নানার হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় নাগরদোলার দিকে। ইকরাম উল্লাহ মেয়েকে কোলে নিয়ে পিছু হাঁটে।
স্বল্প দূরে রাস্তার মোড়ে জিলেপির দোকানে খোদ্দের সামলাতে ব্যস্ত মন্টু এতক্ষণ সবটাই অবলোকন করছিলো। পেয়ারি দামু আর রমজান মিয়ার হাবভাব কেমন যেন লাগলো তাঁর কাছে! কোনো রহস্য আছে নাকি? খোঁজ নিতে হবে দেখছি। খোদ্দেরের হাতে জিলেপির পুটলি দিয়ে বলেন,
" আচ্ছা শুক্কুর, পেয়ারি দামু যে এক মুসলিম গ্যাদার লগে ভাইগ্যা গেছিলো সেই গ্যাদারে কেউ চিনো তোমরা?"
পাশে বসা যাত্রাপালার সভাপতি শুক্কুর আলীর চায়ে চুমুক বসিয়েছিল। মন্টু মিয়ার কথায় হেসে বলে,
" না ভাই। আমি ক্যান, কেউ চিনে না তারে। কখনো দেখে নাই। এমনকি আমাগোরে গাঁওয়ের গ্যাদা কি না তাও জানে না। দামুরে জিগাইছি কতো বার। ময়না পাখি কতা কয় না এই ব্যাপারে। তয় ওর ওই মাসিরে ধরলে খপ্পর পাওন যাইবার পারে।"
" ওই হঠাৎ উধাও হইলো কয়েক বছরের লাইগা আবার হুট কইরা গতবছর উদয় হইলো। ভাবতেছি মেলার ভেজাল কইম্যা আইতেই গেরামে একখান শালিস বসামু। তহন না কইয়া যাইবো কই?"
মন্টুর কথায় শুক্কুর আলী দাঁড়ি বিহীন চোয়াল বুলিয়ে হাসে। চা শেষ হতেই পান বানিয়ে মুখে পুরে বলে,
" গতবছর হুট কইরা আইসা কয় হেয় ভালো নাচবার জানে। একেবারে দর্শকদের শুদ্ধ নাচায় ছাড়বো। বিনিময়ে পাঁচ হাজার টাকা চাইলো। চেহারা সুরত একেবারে জান্নাতের হুর। তাই রাজি হইলাম। দামুর কথা ফইল্যা গেলো। দর্শক যেন রাতারাতি পাগল হইলো। দামিনী 'পেয়ারি দামু' হয়ে সব যুবা বুড়া কচিদের মনে গাঁইথ্যা গেলো। আমি ট্যাকা গুইন্যা শ্যাষ করবার পারি না। এতো টিকিট বেঁচেছিলাম। এবার মাগী বিশ হাজার নিছে। তয় খালি আজ রাতের টিকিট বেঁচছি সতেরো হাজার।"
বুক ফুলিয়ে হাসে শুক্কুর মিয়া। ব্যবসার উন্নতি দেখে চোখের তারা ঝিকমিক করে। মিন্টু মিয়া চমৎকার হেসে বলে,
" শুক্কুর আলী আমগোরে দিকেও একটু নজর দিও। সবটাকা নিজ ঝোল্লায় ভইরো না।"
°°°°°°°°°°°°°°
তিরিক্ষি মেজাজে বাড়ি ফেরে সিনান সালেহ। গলার গামছা ছুঁড়ে খিটখিটে মেজাজ নিয়ে মা'কে ডাকে। শান্তি বেগম গোয়াল ঘর পরিষ্কার করছিলেন। ছেলের ডাকে বেরিয়ে আসতে সময় নেন না।
" কি হইছে গ্যাদা? পাইলি সুররে?"
সিনান যেন এমন প্রশ্নের অপেক্ষায় ছিলো। প্রশ্নের উত্তরে কর্কশ গলায় বলে,
"না। ওর বান্ধবীর বাড়ি থাইক্যা ফিইরা আইলাম ওইহানেও যায় নাই। একবার পাই তোর মাইয়ার ডিল্কি মারা ছুটাই দিমু। গরুর লাহান দড়ি দিয়া হাত পা বাইন্ধা রাখমু। কেমন মা হইছোস মাইয়া কোনে যায় না যায় খেয়াল রাখবার পারিস না?"
শান্তি বেগম ভোঁতা মুখে বলে, "আমারে কইলো যামু আর আসমু তাই.."
" তাই যাইতে দিলি! কোনে যাইবো না যাইবো কি সমাচার তা জিগাইবি না? যেমন মা তাঁর তেমন মাইয়া। মাথা ভর্তি গু সবকটার।"
সিনান খ্যাঁক করে ওঠে মায়ের উপর। শান্তি বেগম চুপ করে যায়। এখন তাঁর মেয়ে! অথচ সারাদিন জপবো 'সিনের পুতুল বুনু।' এই ছেলে কার মতো হয়েছে আল্লাহ ভালো জানেন। একটুও রসকষ নেই মুখে। সবসময় খ্যাঁক খ্যাঁক করবে। পাশের বাড়ি বুড়ি মা ঠিক বলে। বিয়া করাইলে ঠিক হইবো। সুরের বিয়ে গড়াতেই তিনি সিনানের জন্য বউ আনবেন বলে সীদ্ধান্ত নেন। ওদিকে সিনানের গলা শুনে শাপলার মা, শাপলা বেরিয়ে আসে।শাপলার মা সুরেলার কথা জিজ্ঞাসা করে। পেলো কি না! মেয়েটা সেই যে ভর দুপুরে বেরোলো আসার নাম নেই। আসরের আজান টাও দিয়ে দিয়েছে। কোথায় গেলো কোনো খোঁজ নেই। চিন্তা হওয়া অতি স্বাভাবিক। যুবতি মেয়ে এভাবে উধাও হওয়া কেউ ভালো নজরে দেখবে না। তাছাড়া অনেকেই কানাঘুষা করছে চেয়ারম্যানের পোলার সাথে নাকী দেখেছে। একথা সে বলেনি সিনকে। বললে ছেলেটা কি করবে আল্লাহ মালুম। এখন ভালোয় ভালোয় মেয়েটা বাড়ি ফিরলে হলো।
শফির গলা ভেসে আসে বাড়ির পেছন থেকে। সুর আপা সম্বোধন করে কথা বলতে বলতে বাড়ির আঙিনায় প্রবেশ করে। সকলের নজর তাঁর উপরেই পড়ে। শফির সাথে সুরেলাকে দেখে সবাই স্বস্তির শ্বাস ফেলে। তবে ক্ষ্যাপাটে সিনান তেড়েফুঁড়ে যায়। সপাটে চড় বসায় বোনে গালে। শফি দূরত্ব মেপে দাঁড়ায়। তার ছেঁড়া তারে না নিশানা বানায়।
সুরেলা থমকায়। সব কিছু বুঝে উঠতে সময় লাগে তাঁর। ভাই তাকে মারলো? ভাইয়ের হাতে মার খাওয়া দুধভাত। যা সে ছোটবেলায় খেতো। বড় হওয়ার পর খায় নি খুব একটা। সে ভরা চোখে চায় ভাইয়ের দিকে। সিনান চোখ পাকিয়ে শাসনের সুরে বলে,
" কনে হাওয়া হইছিলি? পুরা গা তল্লাশি কইরা খুঁইজ্যা পাই না। আজ তোর একদিন কি আমার একদিন। মা কুঞ্চি আন?"
সুরেলার চোখ ছেপে অশ্রু গড়ায়। নত মাথায় দাঁড়িয়ে রয়। সিনান বাহু ধরে বারান্দায় ছুঁড়ে ফেলে। শান্তি বেগম হায় হায় করে ওঠে। শাপলার মা সিনানকে আটকায়।
"বাপ, এতো বড় মেয়ের গায়ে হাত তোলে? ছিঃ ছিঃ ছিঃ মানষে দেখলে কি কইবো চুপ কর না?"
বোনের ভেজা চোখ মুখ দেখে সিনান কিছুটা শান্ত হয়। তবে কড়া গলায় বলে, " ও বড় হইছে ওর সেই খেয়াল আছে? সারাদিন টইটই কইরা বেড়ায়। ক্যান? মায়ের কাছে বইসা সেলাইয়ের কাম শিখতে গা চুলকায়? আমি সারাদিন ওই গ্যারেজে খাইট্যা মরি আর ওনারা ঘুরে ফিরেই অস্থির হয়ে পড়ে। এমনি গাঁও গেরামের মানুষ কম কথা কয়? ওর সাথকার মাইয়ারা স্বামীর ঘরে বাচ্চা পালতেছে আর নবাবজাদি ওহনো ভাইয়ের ঘরে পইড়্যা আছে। নিশ্চয়ই কোনো খুঁত আছে! তাই তো দেখবার আসে তয় বিয়া হয় না ক্যান? আরো কত মশলা মিশানো কথাবার্তা। আমি শুইন্যাও না শোনার ভান কইরা থাকি চাচি। ওর কি সেই হুঁশ রাইখা চলা লাগতো না?"
সুরেলা মলিন ওড়নায় মলিন মুখ চোপা মুছে উঠে দাঁড়ালো।ঘরের দিকে যাবে সিনান বাঁধ সাধলো। তেজি গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ে,
" সুর, ভালোয় ভালোয় ক কই ছিলি?"
" আমার সাথেই ছিলো সিন। তোর ফুপুর বাড়ি গেছিলাম গেদিরে নিয়া। তোর ফুপু বসাই রাইখা রান্ধিলো। না খাইয়া আইতে দিলো না। তাই দেরি হইলো। বকিস না সুররে।"
হঠাৎ সালেহউদ্দিনের গলায় সবাই ঘার ঘুরিয়ে তাকায়। সালেহউদ্দিন হাসিমুখে এগিয়ে আসে। হাতে লাউ আর বাজারের ব্যাগটা মাটির দেয়ালে ভর দিয়ে রেখে দেয়। সুরেলা মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
" ফরিদ চাচার দোকানে বইসা সিগারেট খাইতেছিলাম। পাশের রাস্তা দিয়া যাইতেছিল সুর। আমি ডাক দিয়া বাদাম কিইনা দিলাম।কোনথেন তোর ফুপা আইসা একপ্রকার জোর কইরা নিয়া গেলো। তোর ফুপুর বাড়ি তো দূরে না।"
সিনান বিশ্বাস করে না বাবাকে। বোনের দিকে তাকায় প্রশ্নভাজন চাহনিতে। সুরেলা নাক টেনে অভিমানী স্বরে বলল,
" টুনির বাড়ি গেছিলাম ওর অংক খাতা দিতে। ফিরতি পথে আব্বার সাথে দেখা হয়।"
সিনান সালেহ ছোট্ট শ্বাস ফেলে। শ্যামলা মুখটায় মলিনতা। সাদা চামড়া হলে পাঁচ আঙুল ফুটে উঠতো। ক্ষুব্ধ সিন চড়টা জোরেই মেরেছিল। দাগটাও নিশ্চয়ই বসেছে তবে শ্যামল বরণ তা ঢেকে রেখেছে। সুরেলা নত মাথায় চলে যায় ঘরে।
°°°°°°°°
হুতুম পেঁচার অদ্ভুত ডাক। বাঁশ বাগানে উঁকি দেওয়া শশধর লাজুক চোখে তাকিয়ে আছে। বাঁশঝাড়ে ঝুলছে বাদুড়। তাদের ডানা ঝাপটানো সুর বড্ড ভুতুড়ে। শুকনো বাঁশ পাতা মাটিতে পড়ে থাকায় পা ফেলতেই ঝনঝনা শব্দের উদ্ভব ঘটে। পায়ের মালিক সজাগ হয়। টিপে টিপে পা ফেলে এগিয়ে যায় উত্তর মুখী জানালার পাশে। বন্ধ জানালা দেখে মানবের মুখটা বিরক্তিতে তিক্ত হয়ে আসে। তবে ঘুন ধরা কাঠের জানালায় টোকা দিতেই ঘ্যার ঘ্যার শব্দ হয়। জানালার খিল আটকানো হয় নি। মানব আলগোছে জানালার পাল্লা ফাঁক করে। মেঘে ঢাকা শেষ রাতের জোৎস্না পা টিপে টিপে ঘরে প্রবেশ করে। অন্ধকার ঘরে ক্ষীণ আলোর সঞ্চার হয়। সেই আলোতে চৌকিতে শুয়ে থাকা মানবীর পা জোড়া দৃশ্যমান হয়। ঢিলেঢালা সালোয়ার একটু উপরে উঠেছে। জানালার শিকের ফাঁকে হাত গলিয়ে দেয় মানব।রূপোর নুপুরে সজ্জিত পা ছুঁয়ে দেয় তর্জনী আঙ্গুল দিয়ে। ঘুমন্ত রমনীর কম্পন অনুভব করে বাঁকা হাসে ব্যাক্তিটি। উষ্ণ খড়খড়ে হাতের ঘর্ষণে নড়েচড়ে ওঠে রমনী। তাঁর নড়াচড়া টের পেতেই মানব পায়ের গোড়ালি মুঠোয় ভরে সজোরে টান মারে।
ধড়ফড় করে উঠে পড়ে সুরেলা। পা টানে নিজের দিকে। বাঁধা পেয়ে আত্নায় পানি শুকিয়ে যায়। ভয়ে কন্ঠস্বর রোধ হয়ে আসে। সর্বোচ্চ শক্তি খাটিয়ে পা টেনেও ছাড়া পায় না। ভয়ে চিৎকার দিবে খুব করে চেনা হাতের হাতঘড়ি দেখে চোখে মুখে বিস্ময় খেলে বেড়ায়। কাঁথা টেনে মুখে গুঁজে। হায় আল্লাহ!
.
.
.
চলবে....................................................................