রাজপ্রাসাদ আজ রং বেরঙের আলোয় ঝলমল করছে। ঝাড়বাতির সোনালি আলো পড়ে দেয়ালে তৈরি করেছে নকশার মতো অপূর্ব ছায়া। বাগানে উপস্থিত সুগন্ধি ফুলের গন্ধ মিশে আছে হাওয়ায় হাওয়ায়। দূরে কোথাও বাদ্যযন্ত্রের সুর কানে ভেসে আসছে। আবার কোথাও রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসা মশলার ঝাঁজ নাকে লাগছে। চারদিকে এত আয়োজন, এত ব্যস্ততা! বড় কোনো উৎসবের প্রস্তুতি চলছে নিশ্চয়ই। প্রাসাদের চাকর-বাকরদের এক মুহূর্ত বিশ্রাম নেই। কেউ রান্নাঘরে খাবারের আয়োজনে ব্যস্ত, কেউ অতিথিদের জন্য বিশ্রামকক্ষ প্রস্তুত করছে, কেউবা হলঘরের ঝাড়বাতি ঠিকঠাক বসাচ্ছে। তবে সবচেয়ে কঠিন কাজটা পড়েছে রাজকুমারীকে সাজানোর দায়িত্বে থাকা দাসীদের ওপর।
রাজকুমারীর রুচি পরিবর্তন হতে দেরি নেই। এক সময়ে যা পছন্দ, পরক্ষণেই তা অপছন্দের তালিকায় চলে যায়। কখনো রত্নখচিত শাড়ি ভালো লাগে না। তো আবার কখনো অলঙ্কারের ভার বেশি মনে হয়, কখনো চুলের বিনুনি একদম ঠিকঠাক মনে হয় না। সাজগোজের এই ঝামেলায় প্রতিবারই ভোগে রাজপরিবারের দাসীরা। কিন্তু কেউ কিছু বলতে পারে না। কেউ পারে না বিরক্তির ভাব প্রকাশ করতে। মুখে অনুগত হাসি ধরে রেখে শুধু রাজকুমারীর পছন্দের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকে সকলে।এই প্রাসাদে উৎসব লেগেই থাকে। আলো ঝলমলে আয়োজন কখনো কমে না। তবে আজ যে বিশেষ কিছু।
রাজকুমারীর কপালে বড় ভাঁজ পড়ল। আয়নার সামনে বসে ছিল সে। ভারী রত্নখচিত মুকুট মাথায় বসানো মাত্রই বিরক্ত হয়ে উঠল। স্বর্ণের কারুকাজ আর জ্বলজ্বলে পাথরখচিত চূড়াটি অপছন্দের সাথে এক ঝটকায় খুলে ছুড়ে ফেলল।
"হীরা! এটা ভালো লাগছে না। অন্যকিছু নিয়ে আসো!"
হীরা, রাজকুমারীর অনুগত পরিচারিকা। ইতস্তত বোধ করলো সে। মাথা নিচু করে বলল,
"রাজকুমারী, রানী সাহেবা এটাই আপনাকে পরতে বলেছেন।"
রাজকুমারী ভ্রু কুঁচকে তাকাল। তার চোখের কোণে রেশমি কাজলের আঁচড়। এতটাই তীব্র যে, যে কেউ তাতে বিভোর হয়ে পড়তে পারে কিংবা আতঙ্কে এক পা পিছিয়ে আসতে বাধ্য হয়েও যেতে পারে বলা যায় না। দাসীদের মধ্যেও শিহরণ ছড়িয়ে পড়ল। কেউ চোখের পাতা ফেলতে সাহস করলো না। নিঃশব্দে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল তারা। কিন্তু হীরার অবস্থা সবচেয়ে করুণ। বুকের ভেতর কাঁপন ধরে গেলেও মুখে কিছু প্রকাশ করল না। কারণ তাকেই তো সব সহ্য করতে হয়। তাকেই রাজকুমারীর সামনে দাঁড়াতে হয়, কথা বলতে হয়। এখানকার সবাই ভাবে হীরা সবচেয়ে সাহসী দাসী। কারণ সে-ই একমাত্র রাজকুমারীর রাগ, বিরক্তি, অভিমান সামলাতে পারে। কিন্তু ভেতরের সত্যটা হীরা ছাড়া আর কে জানে? সে আসলে প্রতিদিন রাজকুমারীর রোষের সামনে নিজেকে বলির পাঁঠা বানিয়ে রাখে। রাজকুমারীর খেয়ালখুশির ঢেউয়ে ভেসে যায়, অথচ কেউ তা দেখে না। কেউ বোঝে না রাজকুমারীকে সামলানোর সাহস নয়, বাধ্যতাই তাকে এতটা শক্ত করে তুলেছে।
রাজকুমারী কড়া গলায় হুকুম করে বসলো,
"মায়ামিকে বলো, এটা আমার পছন্দ হয়নি। অন্য কিছু দিতে বলো।"
হীরা এবার গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
"রানী সাহেবা আজ প্রাসাদের বিভিন্ন কর্মে ব্যস্ত। মনে হয় না, আপনার কথা শোনার সময় আছে উনার কাছে।"
রাজকুমারীর চোখেমুখে রাগ ছড়িয়ে পড়ল। আয়নার প্রতিবিম্বে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখে ঠোঁট কামড়াল। আজকের রাত তার জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ সে ছাড়া কেউ বুঝবে না। সামনের সেগুন কাঠের তৈরি আলমারিতে এক ঝটকায় হাত চাপড়াল রাজকুমারী। সাথে সাথেই শরীরে জড়ানো অলংকার থেকে রিনরিনে ধ্বনি বেরিয়ে এলো। চারপাশের দাসী, পরিচারিকারা নিঃশব্দে তাকিয়ে রইল রাজকুমারীর দিকে। কেউ সাহস করল না কথা বলার। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যেই সবাই থমকে গেল রাজকুমারীর রূপ দেখে। গোলাপি রঙের লেহেঙ্গার কোমল ভাঁজে রাজকুমারী যেন এক অপ্সরা হয়ে উঠেছে। রুপোর জরির সূক্ষ্ম কাজ, কপালে ছোট্ট টিপ, আর খোঁপায় আটকানো মুক্তোর কাঁটা সব মিলিয়ে যেন চাঁদের আলো ছুঁয়ে গেছে তার গায়ে। সৌন্দর্যের এমন দীপ্তি ভাষায় প্রকাশ করা যায় না, শুধু দেখা যায়, অনুভব করা যায়।
রাজকুমারী তীক্ষ্ণ দৃষ্টি সবার দিকে একবার নিক্ষেপ করল। সেই দৃষ্টি জ্বলন্ত আগুনের শিখার ন্যায় সবার হৃৎপিণ্ড অল্প হলেও কাঁপিয়ে দিল! পরিচারিকারা এক মুহূর্তের জন্য নিঃশ্বাস ই নিতে ভুলে গিয়েছিল। কেউ চোখে চোখ রাখতে পারল না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল নীরবে। রাজকুমারী আর এক সেকেন্ড ও অপেক্ষা করল না। ভারী পোশাকের ভার হাতে তুলে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। রাজকুমারীর প্রতিটি পদক্ষেপ মাটির ওপর ধাক্কা লাগছে। মনে হচ্ছে রাজপ্রাসাদের মেঝেও রাজকুমারীর ক্রোধ অনুভব করছে। কিন্তু দরজা পার হওয়ার মুহূর্তেই বিকট শব্দে ভেঙে পড়ল কক্ষের বড় আয়নাটি। কাঁচের টুকরো ছড়িয়ে পড়ল চারপাশে। সবাই একসাথে চিৎকার করে উঠল। রাজকুমারীর ক্রোধ তাদের বুকে গিয়ে আঘাত করেছে এমনটাই প্রতিপন্ন হলো সকলের।
তারপর মুহূর্তেই নীরবতা নেমে এল কক্ষে। কারণ সকল দাসীরা জানে এটি নতুন কিছু নয়। রাজকুমারীর রাগ উঠলে কেবল আয়না নয়, আরও কত কিছু যে গুঁড়িয়ে যায় তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
প্রিন্সেস আরিসা নেভুনিকা! আরহেনিয়া রাজ্যের একমাত্র রাজকুমারী। আজ তার জীবনের এক অনন্য অধ্যায়ের সূচনা হতে চলেছে। রাজ্যাভিষেকের মহিমান্বিত মুহূর্ত সমাগত যখন সমগ্র রাজ্য তার নাম উচ্চারণ করবে একমাত্র উত্তরাধিকারী হিসেবে। আজকের পর থেকে সে শুধু রাজপরিবারের আদরের কন্যা নয়, বরং এক সম্রাজ্ঞীর প্রতিচ্ছবি! যে তার প্রজ্ঞা, শক্তি ও সাহসিকতার দ্বারা রাজ্যের ভাগ্য নির্ধারণ করবে। আরহেনিয়ার প্রথা অনুযায়ী, রাজপরিবারের সন্তানদের শৈশব থেকেই কঠোর শিক্ষার মধ্যে বেড়ে উঠতে হয়। তারা কেবল রক্তের উত্তরাধিকারী নয়, বরং জ্ঞানের, শক্তির ও নেতৃত্বের উত্তরসূরি। ছোটবেলা থেকেই প্রিন্সেস আরিসাকে রাজ্যের ইতিহাস, শাসনব্যবস্থা, কূটনীতি এবং ন্যায়বিচারের শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। অস্ত্রবিদ্যা তার আঙুলের খেলায় পরিণত হয়েছে, আর জাদুবিদ্যার গভীর রহস্যও সে রপ্ত করেছে নিখুঁত দক্ষতায়। রাজপ্রাসাদের চার দেয়ালের মাঝে এতোগুলো বছর কেটেছে তার। আজ সকলের সামনে দাঁড়ানোর সময় এসে গেছে। আজকের দিনটি কেবল আরিসার জন্য নয়, পুরো রাজ্যের জন্যই এক স্মরণীয় দিন। কারণ এই মুহূর্ত থেকে সে আর শুধুমাত্র রাজপরিবারের সোনার খাঁচায় বন্দি এক কিশোরী নয়! সে হবে আরহেনিয়ার এক অনন্য আলোকবর্তিকা, যে তার শাসন দিয়ে ইতিহাসের পাতায় নিজের নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখবে।
প্রায় আঠারো বছর পূর্বে, আরহেনিয়া রাজ্যের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিল। রাজপরিবারে প্রথমবারের মতো জন্ম নিয়েছিল এক কন্যা সন্তান। এই সংবাদ রাজ্যে প্রথমে বিস্ময়ের, পরে বিতর্কের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। বহু শতাব্দী ধরে, প্রাসাদের প্রাচীরে কেবল রাজপুত্রদেরই জন্ম হয়েছে যারা রাজ্যের উত্তরাধিকার ও শক্তি বহন করে আসছে। কিন্তু কন্যার জন্ম? সে তো অশুভ এবং অকল্যাণের বার্তা!
প্রাচীন প্রথা অনুযায়ী, রাজপরিবারে কন্যা জন্ম নিলে প্রজাদের অগোচরে সেই নবজাতককে হত্যা করা হতো। কেউ কখনো এই নিয়ম ভাঙতে সাহস করেনি। কিন্তু সেইদিন সবকিছু বদলে গেল। রাজা, যিনি চিরকালই একজন কন্যার স্বপ্ন দেখেছিলেন, কোনো বাধাই মানলেন না। তিনি ঘোষণা করলেন, এই রাজকন্যাই হবে রাজ্যের ভবিষ্যৎ, এই রাজকন্যাই প্রমাণ করবে শক্তির সংজ্ঞা লিঙ্গভেদে সীমাবদ্ধ নয়। রাজ্যের রক্ষণশীল প্রজারা প্রথমে ক্ষোভ প্রকাশ করলেও রাজার ইচ্ছার বিরুদ্ধে যাওয়ার সাহস কারও ছিল না। ধীরে ধীরে, রাজার আদেশেই সেই দিনটি হয়ে উঠল উৎসবের উপলক্ষ। প্রতিবছর কন্যার জন্মোৎসব উদযাপন করা হতে লাগল রাজকন্যা আরিসার আগমনের দিনে। আজও এই রাজপ্রাসাদের বাতাসে সেই উৎসবের আমেজ বয়ে যায়। কিন্তু সেই ছোট্ট রাজকন্যা আজ আর ছোট নেই। প্রিন্সেস আরিসা পা ফেলতে ফেলতে এগিয়ে এলো রাণীর কক্ষে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল। কিন্তু ভেতর থেকে কোনো সাড়া এলো না। কক্ষের শূন্যতা দেখে হৃদয়ে একধরনের শূন্যতা নেমে এলো।
মৃদু শ্বাস ফেলে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এল সে। রাজপ্রাসাদের লম্বা সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে নামতে একবার ফের পেছন ফিরে তাকাল। তারপর আবারো ঘুরে দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে নামছিল। কণ্ঠে তীব্র উদ্বেগ নিয়ে ডেকে উঠলো,
“মায়ামি! রাণী সাহেবা!”
রন্ধন কক্ষ থেকে বেরিয়ে এলেন রাণী নায়েরা সেভেন্থা। চিরচেনা কঠোরতা ধরা দিলো তার সেই চক্ষুদ্বয়ে যা রাজ্যের শৃঙ্খলা রক্ষার প্রতিচ্ছবি বুঝিয়ে দেয়। দূর থেকেই এক হাতে ইশারা করলেন তিনি আর মুহূর্তের মধ্যেই দমকা বাতাস ছুটে আসলো আরিসার দিকে। খোলা চুলগুলো পেছনে ছলকে উঠলো তার। আরিসা থমকে দাঁড়াল। তার সামনে আওয়াজ করে এক অদৃশ্য প্রাচীর উঠে এসেছে। আরিসা তাও এক পা এগিয়েছিল। কিন্তু হলো না, সম্পূর্ণ এগোতে পারলো না সে।
আরিসা বিরক্ত স্বরে বলে উঠল,
“এটা কী হচ্ছে? আমাকে আটকাচ্ছ কেন?”
রাণী নায়েরা কঠোর কণ্ঠে বললেন,
“এই অবস্থায় কোথায় যাচ্ছ?”
“কিসের অবস্থা? আমি তো সাজগোজ করেই এসেছি, শুধু মুকুটটাই নেই! সেটার জন্যই আপনাকে ডাকছি।”
“যেটা তোমার জন্য নির্ধারিত হয়েছে, সেটাই পরবে। আর অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার আগে তুমি কারও সামনে আসবে না। এটাই আমার শেষ কথা। এবার ফিরে যাও নিজের কক্ষে।”
রাণীর কথার পরে কোনো বিতর্কের অবকাশ ছিল না। আরিসা দাঁত কিড়মিড়িয়ে উঠলো । কিছু বলতে চেয়েও বললো না। কোনো উত্তর না দিয়ে সে পেছন ফিরে হাঁটতে শুরু করল। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ থেমে গেলো। চোখ ঘুরিয়ে দুই আঙুল দিয়ে চুটকি বাজালো সে। আর সঙ্গে সঙ্গেই অদৃশ্য প্রাচীর কাঁচের মতো শব্দ করে ভেঙে পড়লো। মুখে হাসি ফুটে উঠলো আরিসার। তবে অন্তরে একটাই প্রশ্ন দোলা দিচ্ছিল, নিজের রাজ্যাভিষেকেও কি সে নিজের ইচ্ছার মূল্য পাবে না?
সন্ধ্যা নেমেছে আরহেনিয়ার আকাশজুড়ে। আকাশে মৃদু বেগুনি আভা। পশ্চিম দিগন্তের সূর্য শেষ বিদায়ের বার্তা রেখে গেছে। রাজপ্রাসাদের সুবর্ণ গেট ধীরে ধীরে খুলে দেওয়া হয়েছে। আর তখনি জনসাধারণের পায়ের শব্দ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে রাজপথে। প্রাসাদের সামনে প্রসারিত পাথরে বাঁধানো রাজচত্বর। যার ঠিক মাঝখানে স্ফটিকের মতো জ্বলজ্বল করছে ছোট্ট পুকুর। ঝর্ণার মতো কলকল শব্দ তুলে প্রবাহিত হচ্ছে সে পুকুর। চারপাশে সাজানো উঁচু মিনার। প্রতিটিতে জ্বলছে আলো যা শুধু রাতের আঁধারে ফুটে ওঠে। রাজ্যের প্রাচীন ইটের দেয়ালে খোদাই করা আছে শতবর্ষের পূর্ব পুরুষদের ইতিহাস। দেয়ালের গায়ে লেপ্টে থাকা আলো আঁধারের গল্পগুলোর দিকে তাকালে সবকিছু জীবন্ত মনে হয়।
পথের দু'পাশে রূপালি লণ্ঠন হাতে দাঁড়িয়ে রাজকীয় প্রহরীরা। দূরে রাজবাড়ির উচ্চ চূড়াগুলো আকাশ ছুঁয়েছে। চূড়ায় আরহেনিয়ার পতাকা গর্বের সাথে উড়ছে। আরহেনিয়ার জনগণ ধীরে ধীরে প্রবেশ করছে রাজপ্রাসাদে। তাদের মুখমন্ডলে উদ্দীপনা।কেউ বা কৌতূহলী আরিসাকে নিয়ে। প্রথমবারের মতো রাজ্যের রাজকুমারীকে দেখার সুযোগ হচ্ছে কৌতুহল তো হাওয়াই উচিত। কেউবা একবার এই রহস্যময় প্রাসাদের উজ্জ্বল দ্যুতি ছুঁয়ে দেখতে চায়। রাত যত গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। আলো আঁধারের খেলা আরও স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছে। আরহেনিয়া ধীরে ধীরে তার প্রকৃত রূপ প্রকাশ করছে।
রাজসভায় অনেক মানুষের আনাগোনা। সিংহাসনে বসে আছেন রাজা অ্যালারিক ফেইথ। তার পাশে রাণী নায়েরা। পাশের এক সিংহাসনে রয়েছেন ছোট ছেলে এল্রিক। যদিও সে ছোট কিন্তু রাজ্য সম্পর্কে তার কোনো ধ্যানধারণা নেই, আর না আছে রাজ্য সামলানোর কোনো ইচ্ছা। এল্রিক পরে থাকে নিজের জগতে। আর আরিসা হয়েছে তার বিপরীত।
রাজসভা সময়ের সাথে সাথে আরো জাঁকজমকে ভরে উঠেছে। বিশাল হলরুমে একত্রিত হয়েছে আরহেনিয়ার অভিজাত শ্রেণি, রাজ্যের শ্রেষ্ঠ যোদ্ধারা, জাদুশিল্পীরা, আর দূর-দূরান্ত থেকে আসা অতিথিরা। স্বর্ণখচিত স্থাপত্য, ঝাড়বাতির সোনালি আভা, আর সুগন্ধি ধূপের মৃদু সুবাস এক মায়াবী আবহ সৃষ্টি করেছে পুরো সভায়। রাজার আসন থেকে উঠে দাঁড়ালেন অ্যালারিক ফেইথ। দৃষ্টিতে গর্ব এবং কণ্ঠে দৃঢ়তা ছড়িয়ে বললেন,
“আজকের দিনটি শুধু আমার পরিবারের নয়, সমগ্র আরহেনিয়ার জন্য গৌরবের! আমার কন্যা, প্রিন্সেস আরিসা নেভুনিকা, জন্ম থেকেই নিজেকে প্রমাণ করে এসেছে। সে একাধারে জ্ঞানী, শক্তিশালী এবং নির্ভীক। আজ রাজ্যাভিষেকের মাধ্যমে সে এই রাজ্যের অন্যতম অভিভাবক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে।”
রাজার ঘোষণা শেষ হতেই একপ্রকার নিরবতা নেমে এলো রাজসভায়। তারপর মহাহৈহুল্লোড়ের সাথে রাজসভায় প্রবেশ করলো আরিসা। তার টানা টানা চোখ দুটোয় ছড়িয়ে আছে আত্মবিশ্বাসী এবং গর্বিত ভাব। সিংহীর মতো দৃপ্ত ও কঠিন তার চলন্ত পদক্ষেপ। গায়ে সুবর্ণ সুতোয় আঁকা গোলাপী রাজকীয় পোশাক। মাথার উপর অলঙ্কৃত চূড়ার শোভা।
আরিসার অনবদ্য রূপ দেখে সকলে নিঃশ্বাস আটকে তাকিয়ে রইলো। শরীরে প্রাণ এলো অনেকের। আরিসার রূপ ই ছিল এমন মোহময় যাকে দেখলেই তন মন সব জুড়িয়ে যায়। কিন্তু রূপের চেয়েও তার আঁখিতে ছিল দুর্বার প্রতিজ্ঞার আভাস। সে নামমাত্র রাজকুমারী নয়। নিজেকে ভবিষ্যতের এক মহাশক্তিধর শাসক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে এসেছে এই পৃথিবীতে।
আরিসা দৃপ্ত পদক্ষেপে সিংহাসনের দিকে এগিয়ে এলো। রাজসভায় সমবেত সবাই নিঃশব্দে আরিসার প্রতিটি পদক্ষেপ অনুসরণ করছিলো। সিংহাসনের সামনে এসে মাথা নত করলো। বাবার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানালো । তারপর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসির রেখা ছড়িয়ে দিলো। সহজে হাসে না সে। আরিসার হাসি দেখার অর্থ ভাগ্য খুলে যাওয়া অনেকের কাছে।
প্রিন্সেস আরিসা কোমরের পাশে রক্ষিত খাপে হাত রাখলো। এক টানে মসৃণ শব্দে তলোয়ার বেরিয়ে এলো। ধাতব আলোয় ঝলসে উঠলো রাজপ্রাসাদ। নিজের বাম হাতের তালুতে তলোয়ারের ধার বসালো সে। ক্ষীণ এক চিলতে কাটা পড়লো সেই স্থানে। তাজা রক্ত ফোঁটায় ফোঁটায় মেঝেতে ঝরতে লাগলো। আরিসা সেই রক্তাক্ত হাত ধুলো মাখালো। রক্তাক্ত ধুলো মাখা হাত কপালে ছুঁইয়ে গভীর স্বরে বললো,
“আমি অ্যালারিক ফেইথ কন্যা, আরিসা নেভুনিকা, প্রতিজ্ঞা করছি, এই রাজ্যের মঙ্গলই হবে আমার একমাত্র লক্ষ্য। আমি আমার জীবন উৎসর্গ করবো এই মাটির জন্য, কিন্তু কখনোই রাজ্যের বিরুদ্ধে দাঁড়াবো না।”
এক সেকেন্ডের নিস্তব্ধতা। তারপর রাজসভা গর্জে উঠলো বিজয়ের উল্লাসে। সভাসদরা করতালি দিতে লাগলো। প্রহরীরা তলোয়ার উঁচিয়ে সম্মান জানালো। আর আরিসা! সে শুধু স্থির দাঁড়িয়ে থাকলো। রক্তাক্ত হাতের শপথ নিয়ে, ভবিষ্যতের ভার নিজের কাঁধে বহন করার জন্য প্রস্তুত।
রাজা অ্যালারিক মৃদু হাসলেন। পাশে দাঁড়ানো দাসী রাজকীয় শোভাযাত্রার মতো এগিয়ে এলো। হাতে ধরে রাখা নকশা খচিত অভিষেকের মুকুট এগিয়ে দিলো রাজার দিকে। রাজা ধীরে ধীরে রাজকন্যার চূড়া সরিয়ে মুকুট বসিয়ে দিতে উদ্যত হলেন। ঠিক তখনই রাজসভার নীরবতা ভেঙে এক কর্কশ কণ্ঠস্বর ধ্বনিত হলো,
“একজন অবিবাহিত নারীর রাজ্যাভিষেক আমরা মেনে নিতে পারছি না! রাজ্য পরিচালনার ভার কোনো নারী কীভাবে বহন করবে? যদি সে ব্যর্থ হয়? যদি তার মৃত্যু হয়? তখন তো সমগ্র দায় আমাদের পুরুষদের ওপর বর্তাবে! ধিক্কার দেবে সবাই আমাদের! তাই এই অভিষেক আমরা মানি না।”
সভার ভেতর মুহূর্তের নিস্তব্ধতা নেমে এলো। কেউ ফিসফিস করছিলো। কেউ কেবল স্তব্ধ হয়ে চেয়ে ছিলো।
আরিসা ধীরে ধীরে চোখ ফেরালো বক্তার দিকে। এক বৃদ্ধ ব্যক্তি। যার কপালে রাজ্যের বহু বছরের চিন্তার ভাঁজ। রাজা অ্যালারিকের পুরনো বন্ধু। তাকে আরিসা চেনে। কিন্তু চেনা মানুষও যে এমন সংকীর্ণ মানসিকতার হতে পারে, তা যেন কল্পনারও অতীত ছিলো আরিসার জন্য। আরিসার দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হলো। রাজকীয় পোশাকের রংয়ের চেয়েও তীব্র হয়ে উঠলো তার চাহনি।
রাজসভায় বাতাস থমথমে হয়ে উঠলো। সবাই যেন বসেই আছে প্রিন্সেস আরিসা এবার কী বলবে তা শোনার জন্য। অ্যলারিক বলতে চেয়েছিলেন কিন্তু আরিসা তাকে থামিয়ে বললো,
"আমার মৃত্যুর দায়ভার কাউকে নিতে হবে না। আমার মৃত্যু হলে ল্যুমিস নদী আমাকে গ্রহণ করবে। আমি স্বাচ্ছন্দ্যে সেখানে নিজের শরীর বিলিয়ে দেব।"
সাধারণ জনগণের মধ্যে অন্য এক পুরুষ মুখ খুললেন,
"তোমার পিতার বন্ধু ফেড্রিক কিন্তু ভুল বলেননি। তুমি যা মন চায় বললেই হলো না নারী হিসেবে যে রাজ্যের প্রধান হতে পারছো এটাই তো সৌভাগ্যের। কিন্তু রাজ্য সামলানোর দায়ভার তোমাকে দেওয়া যায় না রাজকুমারী।"
রাজা অ্যলারিক রেগে উঠলেন। মাথা হেঁট করে বললেন,
"আমার মেয়ে সকল গুণের অধিকারী। তাই ওর মৃত্যু হবে সেটা বিশ্বাস করাই তো আপনাদের ভুল হয়েছে।"
অন্য এক পুরুষ দাঁড়িয়ে বললো,
"কিন্তু যদি হয়ে যায়। তখন কী করবেন আপনি? নিজের মেয়েকে চিরতরে এভাবে হারিয়ে যাওয়ার শোক সারাতে পারবেন তো?"
নিজের পিতাকে শান্ত করে আরিসা নেভুনিকা সবার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়ে বসলো,
" তো আপনারাই বলুন কি চান আপনারা? আমার রাজ্যাভিষেক না হোক এটাই তো? একটা মেয়ে রাজ্য সামলাতে চাইছে এতেই আপনাদের শরীর জ্বলা শুরু করে দিয়েছে। তাই না? পারবেন কী আমার মতো বিদ্যা অর্জন করতে?"
হুংকার দিয়ে উঠলো আরিসা। রাণী নায়েরা নেমে আসলেন নিজের মেয়েকে সামলাতে লাগলেন তিনি। এই মেয়ের ক্রোধ রাণী নায়েরা এবং তার স্বামীর সমন্বিত একটা রূপ।
ফেড্রিক ধীর পায়ে এগিয়ে এলেন। মুখে প্রশান্ত হাসি নিয়ে বললেন,
"তুমি আমার প্রাণপ্রিয় বন্ধুর মেয়ে, আরিসা। আমি কখনোই তোমার অমঙ্গল চাইবো না। বরং চাইবো তুমি দীর্ঘজীবী হও, শত বছর এই রাজ্যের গৌরব বয়ে নিয়ে যাও।"
আরিসা নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে তার কথা শুনছিলো। চোখের গভীরে জমাট বাধা আগুনের শিখা দপদপ করছিলো। আরিসার মনে হচ্ছিল তার এতো বছরের সাধনা আর স্বপ্ন সব কয়েক মিনিটের মধ্যে চুরমার হয়ে যাচ্ছিলো। ছোট থেকেই এই স্বপ্নটা নিয়ে বড় হয়েছে সে। আঠারোটা বছর ধরে রাজপ্রাসাদের এই দেয়াল ঘিরে থাকতে হয়েছে তাকে। মেয়ে বলে বাইরে যেতে দেওয়া হয়নি। তাকে আজ প্রথমবার এতো সুন্দর করে সজ্জিত অবস্থায় দেখলো সবাই। সে আজ মুক্ত হতে চলেছিলো। কিন্তু এই অযাচিত প্রশ্ন তার এতো বছরের স্বপ্ন ভঙ্গ করে দিচ্ছে।
নিজের বাবার বন্ধুকে কঠোর গলায় প্রশ্ন করলো আরিসা,
"তাহলে আপনি কী চান? আমার রাজ্যাভিষেকে বাধা দিচ্ছেন কেন?"
ফেড্রিক দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। মনে হলো কথাগুলো বলার আগে তিনি নিজেই ওজন করে নিচ্ছিলেন।
"নিজেকে সুরক্ষিত করো, রাজকুমারী আরিসা।" তিনি থেমে আরিসার দিকে তাকিয়ে রইলেন। বললেন,
"একজন যোগ্য পুরুষকে বেছে নাও, বিবাহ করো। তাহলেই তুমি সত্যিকার অর্থে রাজ্য পরিচালনার যোগ্য হয়ে উঠবে।"
রাজসভায় গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়লো। ফেড্রিকের এক কথায় সম্পূর্ণ রাজসভায় হৈ হুল্লোড় শুরু হয়ে গেলো। রাজকুমারী তব্দা খেয়ে গেলো। মুখ অল্প খুলে গেলো তার। কি ভেবেছিল আর হচ্ছেটা কি? মুখ ঘুরিয়ে বাবার দিকে তাকালো সে। বাবার চেহারায় ও একি চিন্তা দেখে আরিসার হৃৎপিণ্ড ছটফট করছে। তাকে বিয়ে করতে হবে? একদম না! সে তো কোনো পুরুষকে পছন্দই করে না। তাহলে বিয়ে কাকে করবে?
·
·
·
চলবে.........................................................................