লড়াইয়ের দিন ঘনিয়ে এসেছে। কায়েরীথের চোখে ক্লান্তি ঝরে পড়তে দেখা যায়। কিন্তু হাল ছাড়ার লক্ষণ নেই ওর। অল্প কয়েকদিনের প্রশিক্ষণ তাতেই নিজেকে বদলে ফেলেছে সে। দুর্বল, ব্যথাতুর শরীরের স্থানে দেখা দিয়েছে সহনশীলতা। তবু বড় একটা প্রশ্ন থেকেই যায় এই জ্ঞান কতটা কাজে লাগবে বাস্তবের লড়াইয়ে? সে কি জিততে পারবে? আরিসা তাকে শেষের দিন একটি বিশেষ কৌশল শিখিয়েছিল। এমন এক বিশেষ কৌশল যা সহজেই বিজয় এনে দিতে পারে। কিন্তু কৌশলটি যেমন সহজ শোনায় তেমন সহজে আয়ত্ত ও করা যায় না। শান্ত, নিঃশব্দ পরিবেশ দরকার হয় শেখার জন্য। আর দরকার দীর্ঘ সাধনা যা কায়েরীথের পক্ষে দুষ্কর ই বটে।
আরিসা তাকে বারবার বলেছে,
"চাপ নিও না, ক্রুশ। শিখতে না পারলেও লড়াই করো মন দিয়ে। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে প্রতিপক্ষের আক্রমণকে পাল্লা দেওয়া। সেটা যদি শেষ পর্যন্ত করতে পারো তাহলে দেখবে তোমার জয় নিশ্চিত হলেও হতেও পারে।"
আরিসার কথায় কায়েরীথের মন কিছুটা শীতল হলেও, তার ইচ্ছা একটুও দমে যায়নি। কারণ, তাকে যে জিততেই হবে। এই প্রাসাদে যদি রাজকুমারীর আশেপাশে থাকা যায়, তাহলেই সে তার উদ্দেশ্য সফল করতে পারবে। অন্য বিজয়ীদের মতো শুধুই কর্মী হয়ে কাজ করে কোনো লাভ নেই। যাদেরকে প্রাসাদের ভিতরে বিলাসবহুল কক্ষে থাকার সুযোগই দেওয়া হয় না। আর অনান্য কর্মীদের মতো ছোট একটা রুমে চাপাচাপি করে থাকার কোন প্রশ্নই আসে না। কায়েরীথের লোভ লেগে গেছে বিলাসবহুল রুমে। তার আভিজাত্য পছন্দ। তার রাজত্ব পছন্দ! আর এতো সহজে এগুলোকে ছেড়ে দেবে? কখনোই না! তাই তো কায়েরীথ লড়াইয়ের আগের দিন সারা রাত প্রাসাদের উঁচু ছাদে, বিশাল চাঁদের নিচে একা বসে থেকেছিল। বাতাস আর আলোর সঙ্গে ধ্যান করছিল। ওই ছাদের নির্জনতা, ওই চাঁদের আলো! সবই সেসময় ওর সঙ্গী হয়ে উঠেছিল ।
কৌশলটি ছিল আশেপাশের যেকোনো আলো ব্যবহার করে বাতাসের সঙ্গে মিশিয়ে এক ধরণের শক্তি তৈরি করতে হয়। এরপর সেই শক্তি ছুঁড়ে দিতে হয় প্রতিপক্ষের দিকে। যার ফলে প্রতিপক্ষ হঠাৎ দিশেহারা হয়ে পড়ে। মনোযোগ হারায় এবং তখনই জয়ের সুযোগ আসে। রাজকুমারী আরিসা বলেছিল, সে নিজে এই কৌশল আয়ত্তে এনেছিল মাত্র চার দিনে। কিন্তু কায়েরীথের তো সেই সময় নেই। তাই যেভাবেই হোক রাতের মধ্যে, লড়াইয়ের আগেই এই ক্ষমতা অর্জন করতে হবে। কারণ সামনে দাঁড়িয়ে থাকা প্রতিপক্ষ সায়েরিন একজন দক্ষ যোদ্ধা। বছরের পর বছর ধরে সে শিখে আসছে এবং এই রাজ্যের অনেক স্থান সে বেশ ভালোভাবেই দেখাশোনা করছে। শত্রুদের আক্রমণ থেকে এই রাজ্যবাসীকে অনেক বার বাঁচিয়েছে সে তাই কায়েরীথকে হারানো তার জন্য খুবই সহজ একটি কাজ। আর সেটা হতে দেওয়া যাবে না। একদম না!
সায়েরিন এবং কায়েরীথের লড়াইয়ের দিন!
রাজকুমারী আরিসার সঙ্গে আর দেখা হয়নি কায়েরীথের। শেষরাতের ঠান্ডা হাওয়ায় প্রাসাদের ছাদেই কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল একদম টের পায়নি সে। শুধু একমুঠো চাঁদের আলো তার সাধনা, ধ্যান এবং অক্লান্ত পরিশ্রমের সাক্ষী ছিল। সূর্যের দেখা ধীরে ধীরে পাওয়া যাচ্ছিল তখন। আকাশটা তখন ও অল্প অন্ধকার ছিল। ঠিক সন্ধ্যা হওয়ার সময় যেমনটা চোখে পড়ে তেমন ছিল সেসময়। অল্প স্বল্প হলুদ কমলা রেখা আকাশের এক প্রান্তে ছেয়ে যাচ্ছিলো। জানান দিচ্ছিলো সূর্য মহাশয় উদিত হচ্ছে পূর্ব দিগন্তে।
হঠাৎ করেই বেশ ক’জন দাসীর ডাকে কায়েরীথের ঘুম ভেঙে যায়।
"এই যে, ওঠুন! রাজকুমারীর আদেশ। আপনাকে স্নান সেরে ময়দানে হাজির হতে হবে!"
একজন দাসী হালকা ঠাট্টার ভঙ্গিতে বলে উঠল,
"আপনার আজ জীবন মৃত্যুর লড়াই আর আপনি কিনা এখনো ঘুমাচ্ছেন!"
কায়েরীথ চোখ কচলাতে কচলাতে বলে উঠল,
"ঘুমাতে পারলাম আর কোথায়? আর স্নান করবো ঠিক আছে। কিন্তু আমার খাবার কোই? রাজকুমারী খাবারের কথা বলেনি?"
এক দাসী হেসে ফেলল,
"আমাদের রাজকুমারী তো মনে হয় জানতেন আপনি এটা বলবেন। তাই আগেই বলে দিয়েছেন আপনাকে শুধু এক গ্লাস গরুর দুধ দেওয়া হবে। শক্তি পেতে হলে এটুকুই তো যথেষ্ট।"
কায়েরীথ কপাল কুঁচকে বলল,
"শুধু দুধ? ভালো খাবার কই?"
দাসী এবার কিছুটা নাটকীয়ভাবে মুখের সামনে হাত তুলে বলল,
"আমাদের রাজকুমারী মনে হয় জানতোই আপনি খাবারের কথা জিজ্ঞেস করবেন। তাই আগেভাগেই বলে দিয়েছে। আপনাকে শুধু বড় এক গ্লাস দুধ দেওয়া হবে শক্তির জন্য।আর ভালো খাবার আপনি লড়াইয়ের পর পাবেন। এবং যদি যদি!"
কায়েরীথ ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,
"যদি?"
"যদি আপনি লড়াইয়ে জিততে পারেন তাহলেই খাবার পাবেন না হলে তো কর্মীরা যে পাখির মতো অল্প খাবার পায় তাই দেওয়া হবে আপনাকে।"
কায়েরীথ বড় বড় চোখ করে চাইলো। তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
"আমার হৃদয়টা জ্বালিয়ে দিয়েছো তোমরা। চলো তাড়াতাড়ি!"
কায়েরীথ ধড়ফড় করে নিচে নেমে যেতে লাগলো। ওর চলন বলনে দেখে হেসে ফেললো দাস দাসীরা।
যথাসময়ে রাজপ্রাসাদের অন্দরে থাকা ময়দানে জড়ো হলো সবাই। রাজপ্রাসাদের বাইরের কোনো নাগরিককে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। অ্যালারিক ফেইথ চেয়েছিলেন, রাজপরিবারের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারগুলো বাইরে ছড়িয়ে না পড়ুক। কিন্তু যে খবর আগুনের মতো ছড়ায় তা তো আটকানো যায় না। প্রাসাদের কিছু কর্মীর কারণে রাজ্যবাসীরা জেনে গিয়েছে এই লড়াই সম্পর্কে। এদিকে রাজকুমারী আরিসাকে নিয়ে দুর্নাম, সুনাম দুইই চলছে। অনেকে তো বলছে বিয়ে করতে চাইবে না কিন্তু দেহরক্ষী হিসেবে ছেলে চাইবে। এর অর্থ কী? নিশ্চয় ছেলেটার সাথে রাজকুমারী আরিসার কোনো সম্পর্ক আছে।
অ্যালারিক ফেইথ অবশ্য এসব গুজব, ব্যঙ্গ কিংবা জনমতের তোয়াক্কা করেন না। তাঁর চোখে আজকের লড়াই একেবারেই নির্ধারিত ফলাফলের খেলা। এই দুদিনের ছেলেটি যার অতীতও অজানা, ভবিষ্যৎও অনিশ্চিত সে কীভাবে জিতবে? আর রাজকুমারী নিশ্চয়ই এই সাধারণ ছেলেটাকে জাদুবিদ্যা শিখায়নি। কারণ জাদুবিদ্যা তো শুধুই সম্ভ্রান্ত রক্তের সন্তানদের জন্য। আর এই লড়াইয়ে জাদু বিদ্যা ছাড়া বিজয়! সেটা প্রায় অসম্ভব।
একে একে ডাকা হলো দুজনকে। প্রথমেই ময়দানে পা রাখলো সায়েরিন। হাতে তার ধারালো তলোয়ার। সেই পুরনো আত্মবিশ্বাসে ভরপুর ভঙ্গিমা সায়েরিনের। তার চলন, তার চোখের দৃষ্টি সব কিছু বলে দিচ্ছে। এই লড়াইয়ে সেই জয়ী হবে। ময়দানজুড়ে নীরবতা। শুধু সায়েরিনের বুটের শব্দ। কিন্তু কায়েরীথকে ডাকা হলো একবার, দু’বার, তিনবার। কোনো সাড়া নেই। মাঠে সে এখনো এসে পৌঁছায়নি। সায়েরিনের ঠোঁটে ফুটে উঠলো তাচ্ছিল্যের হাসি।
"যোদ্ধা? হুহ!"
ভেতরে ভেতরে বলে উঠলো সে।
"যার সময়জ্ঞান নেই, যে লড়াইয়ের গুরুত্ব বোঝে না। সে আবার যোদ্ধা হয় কীভাবে?"
ময়দানের এক প্রান্তে মঞ্চসদৃশ বসার স্থান। রাজপরিবারের সদস্যরা সবাই সেখানে। রাজা, রানি, দপ্তরের শীর্ষ কর্মকর্তারা। আর আছে রাজকুমারী আরিসা। চুপচাপ হয়ে সম্মুখে চোখ রেখে বসে আছে সে।
মন বিচলিত হয়ে আছে। কায়েরীথ ছেলেটা আবার কোথায় আটকে গেলো তা নিয়েই আরিসার চিন্তা।
তাই সে দূর থেকেই একজন দাসীকে সংকেত দিলো। দাসী দ্রুত ছুটে গেলো ভিতরের দিকে। অপেক্ষার মূহুর্ত শেষ হলো ঠিক পনের মিনিট পরে। মাঠের প্রবেশদ্বারে দেখা দিলো কায়েরীথ।
কায়েরীথের উপস্থিতি ছিল ঝড়ের মতো। লম্বা পোশাকের বুনটে যুদ্ধের ছাপ। চালচলনে আত্মবিশ্বাস। আর আকাশি মণির চোখ দুটো দেখলেই বোঝা যায় জোশ নিয়ে এসেছে সে। হাতে ধরা তলোয়ারটা আলোর ছটা ছুঁড়ে ছুঁড়ে দিচ্ছে চারদিকে। সায়েরিন চোখ কুঁচকে তাকালো। এই তলোয়ার, এই দীপ্তি! এটা তো আরিসার জাদুর তলোয়ারের মতোই ঝলমল করছে!
এক মুহূর্তের জন্য সায়েরিন থমকে গেলো।
"তাহলে কি? রাজকুমারী ওকে জাদুবিদ্যা শিখিয়েছে?"
সায়েরিনের মনে মনে প্রশ্নের ঘূর্ণি শুরু হলো। সে একবার তাকালো রাজকুমারীর দিকে। আর চোখে পড়লো আরিসার চোখমুখে এক অনির্বচনীয় জ্যোতি।
ময়দান থমথমে হয়ে আছে। দুই যোদ্ধা প্রস্তুত। লড়াই শুরুর আহ্বান জানানো হলো। সায়েরিন ই প্রথমে এগিয়ে গেলো। তলোয়ারের মধ্যে তার শক্তি ব্যবহার করে আক্রমণ করলো কায়েরীথকে। কায়েরীথ প্রথম ধাপে শুধু নিজেকে প্রতিরক্ষা করতে লাগলো। আর শুধু প্রতিরোধ করে যাচ্ছিলো একের পর এক আঘাত। না ছিল পাল্টা জবাব। না ছিলো কোনো বাহ্যিক শক্তির প্রকাশ। মনে হলো সে কেবল শিখছিল প্রতিপক্ষের ছন্দ এবং দুর্বলতা। কোনো প্রকার বাহ্যিক শক্তি সে ব্যবহার করেনি। লড়াই ধীরে ধীরে আক্রমণাত্মক হয়ে যাচ্ছে। সায়েরীথ যতোই আক্রমণ করার চেষ্টা করছে কায়েরীথ তা প্রতিরোধ করার চেষ্টা করছে। এক পর্যায়ে সায়েরিন কায়েরীথের উপর জাদুবিদ্যা প্রয়োগ করলো। যার ফলাফল স্বরূপ কায়েরীথ ছিটকে পড়লো দূরে। ডান হাতে প্রচন্ড আঘাত পেয়েছে সে। ব্যথায় কুঁকড়ে উঠলো কায়েরীথ। সেই ফাঁকেই সায়েরিন আবার দৌড়ে এলো চূড়ান্ত আঘাত হানতে। কিন্তু কায়েরীথ বসে থাকেনি। বাম হাতে তলোয়ার তুলে ঠেকালো সায়েরিনের আক্রমণ। বসে থেকেই প্রতিরক্ষা করছিলো। কিন্তু এক হাতে সেই ভার টানা যাচ্ছিল না। তার চোখ চলে গিয়েছিল রাজকুমারী আরিসার দিকে। আরিফা শান্ত হয়ে বসে আছে। কিন্তু কায়েরীথ যখন ই তার দিকে তাকালো সে চোখ ঘুরিয়ে সূর্যের দিকে তাকালো। কায়েরীথ ও তাই করলো । কায়েরীথ খেয়াল করলো সূর্য এখন সরাসরি মাথার উপরে আছে। অর্থাৎ এটাই সেই উপযুক্ত সময়। সে চোখ বন্ধ করলো। মনে পড়লো শেষ রাতের সাধনার কথা। পরিশ্রমের কথা। মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করলো। চোখ বন্ধ রেখেই ডান হাত তুলে ধরলো সূর্যের দিকে। আঙুল ফাঁক করে আলো টেনে নিলো সে। বাতাস কাঁপতে লাগলো। মুহূর্তেই আলো ও বায়ুর সংমিশ্রণে গঠিত হলো অদৃশ্য তীর। সপাট করে ছুঁড়ে মারলো সায়েরিনের বুকে।
এই আচমকা আক্রমণে সায়েরিন থেমে গেলো। তীব্র ধাক্কায় সে ছিটকে পড়লো পেছনে। হাত থেকে তলোয়ার পড়ে গেলো। বুকে হাত রেখে হাঁপাতে লাগলো সে। বিস্ময়ে মুখখানা থমকে গেছে তার।
উচ্চারিত হলো,
"এতটা জটিল বিদ্যা!এত অল্প সময়ে!"
এই বিদ্যা সায়েরিনের কাবু করতে ছয় মাস লেগেছিল। যদিও আরিসা ইহা খুব তাড়াতাড়িই শিখে ফেলেছিল। কিন্তু কায়েরীথ কীভাবে পারলো এতো দ্রুত! এটাই মাথায় ঢুকছিলো না সায়েরিনের। সে চিন্তায় মগ্ন ছিল। ঠিক তখনই কায়েরীথ উঠে দাঁড়ালো। এক হাতে তলোয়ার। সে খুব দ্রুত এগিয়ে এল সায়েরিনের দিকে। ঠিক তলোয়ার তুলে আঘাত করতে যাবে এমন সময়
এলিরিক ফেইথের কণ্ঠ শোনা গেলো,
"লড়াই সমাপ্ত!"
পুরো পরিবেশ নিশ্চুপ হয়ে পড়েছে। ময়দান জুড়ে অনুচ্চারিত বিস্ময় ছড়িয়ে পড়েছে হঠাৎ। একজন সাধারণ ছেলে কিন্তু আজ আর সাধারণ রইলো না।
মঞ্চে বসে থাকা রাজপরিবারের সদস্যরা একে একে উঠে দাঁড়িয়েছে। সকলে চোখে বিস্ময় এবং অবিশ্বাস। কেবল একমাত্র আরিসা বসেই রইলো। তার চোখে ছিল না বিস্ময়। শুধু ছিল প্রশান্তি এবং আত্মবিশ্বাস যা হয়তো শুধু তারই ছিল কায়েরীথের প্রতি। কেউ ভাবেনি এই লড়াইয়ে কায়েরীথ জিতবে। সায়েরিন তো শুধু বলে নয় জাদু ও কৌশলে শতগুণে শক্তিশালী। সে জন্মেছে সম্ভ্রান্ত পরিবারে। প্রশিক্ষণ পেয়েছে রাজদরবারে। আর কায়েরীথ! একজন ফুটপাতে ঘুমানো ছেলে। প্রাসাদে প্রবেশের পর একমাত্র সহায় ছিল আরিসার বিশ্বাস। আরিসা ব্যতীত এই প্রাসাদে থাকা সত্যিই মুশকিলের ব্যাপার ছিল।
কিন্তু আজ সেই সাধারণ একজন ছেলে অসম্ভবকে সম্ভব করে দিলো। সায়েরিন হেরে গেলো আর কায়েরীথ শুধু জিতলো না সে আরহেনিয়ার বৃহৎ পাতার ইতিহাস গড়লো।
*****
কায়েরীথের হাতে নিপুণ ভঙ্গিতে ভেষজ প্রলেপ দিচ্ছে চিকিৎসক। কক্ষে প্রবেশ করলো আরিসা। নিঃশব্দে এসে দাঁড়ালো কায়েরীথের সামনে। তাকে দেখে চিকিৎসক উঠে দাঁড়িয়ে বসার জায়গা ছেড়ে দিলো। আরিসা মাথা নেড়ে তাকে বসতে বললো আর কাজ চালিয়ে যেতে বললো। কায়েরীথের পোশাক আধখোলা। সে মুখ তুলে তাকালো আরিসার দিকে। গম্ভীর মুখে একটুও চিন্তা চোখে পড়ছিল না। তবুও কায়েরীথ ভালোই বুঝতে পারছে ভিতরে ভিতরে ওর জন্য উদ্বিগ্ন রাজকুমারী। লম্বা চুলগুলো মাটি ছুঁই ছুঁই করছে। কপালের পাশে আলতোভাবে লুটিয়ে পড়েছে। এই চুপচাপ আরিসার ভেতরেও আজ কোমলতা খেলে যাচ্ছে। কোমলতার কারণ স্বরূপ খোলা চুলগুলো বলাই যায়।
খানিক পর ভেষজ চিকিৎসক প্রলেপ লাগিয়ে চুপচাপ কক্ষ ছেড়ে চলে গেলো। আরিসা তৎক্ষণাৎ উঠে এলো। কায়েরীথের হাতের ক্ষত সামনে থেকে দেখতে লাগলো সে। হঠাৎ কায়েরীথ উঠে দাঁড়ালো। ডান হাতে আরিসাকে টেনে নিলো নিজের বুকের কাছে। কানের কাছে মুখ এনে নিঃশ্বাসভেজা কণ্ঠে বললো,
"আজ আপনার জন্য ই আমার জয় হয়েছে, প্রিন্সেস! এখন আজীবন আপনার দেহরক্ষী হয়ে যাওয়ার অভিনন্দন জানান।"
আরিসা থম মেরে দাঁড়িয়ে আছে। মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে হঠাৎ। হৃৎপিণ্ড থেকে প্রচন্ড জোরে আওয়াজ হচ্ছে। কেমন যেন ঢিপঢিপ আওয়াজ। আরিসা কায়েরীথের বুকে নিজের মাথার স্পর্শ পেয়ে অনুধাবন করলো কিছু একটা পরিবর্তন হয়েছে শরীরে। কি হচ্ছে এসব? এ কোন ধরনের অঘটন শুরু হলো শরীরে? কখনো তো হয়নি এমনটা। হঠাৎ ভালো লাগছে কেনো? আরিসা চোখ খিঁচে বন্ধ করে ফেললো। মনে হলো সে অন্য কোনো স্থানে পৌঁছে গেছে যেখানে শুধু সে আছে আর আছে কায়েরীথ। আর আছে সাদার দুনিয়া। রাজকুমারীর এই নতুন অনুভূতির ফলস্বরূপ রাজপ্রাসাদের বাগানে ছোট ছোট কুঁচকে পড়ে থাকা সাদা গোলাপ গুলো আজ বড় হয়ে ফুটলো। মালিগুলো ফুলগুলোতে পানি দিতে গিয়ে ফিসফাস শুরু করে দিলো।
একজন বললো,
“এই ফুলগুলো তো কালই কুঁড়ি ছিল আজ হঠাৎ ফুটে উঠলো কেন?”
*****
অ্যালারিক ফেইথ কায়েরীথের এই অপ্রত্যাশিত জয় কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না। এক সাধারণ ছেলের হাতে তার অভিজাত শিষ্যের পরাজয় তার সম্মানকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। তার চোয়াল শক্ত হয়ে যাচ্ছে এই বিষয় চিন্তা করতে করতে। ভিতরে আগুন জ্বলছে। নিজের মেয়েকে তিনি কিছু বলতেও পারছেন না। বলতেও পারছেন না সে যা করছে নিতান্তই বাচ্চা মানুষি একটা কাজ। মেয়েটার উপর জোর করে সায়েরিনকে চাপিয়েও তো দিতে পারছেন না যেদিকে তিনিই কথা রেখেছিলেন এই লড়াইয়ে যেই জিতবে তার দ্বারাই তোমার ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হবে। এই কথা তিনি কীভাবে ফিরিয়ে নিবেন? কে জানতো এই সাধারণ ছেলেটা সায়েরিনের সাথে তলোয়ার বাজিতে জিতে যাবে??
অন্যদিকে, অ্যালারিক ফেইথের পুরনো বন্ধু ফেড্রিকের মুখেও তীব্র অসন্তোষ। নিজের ছেলের জন্য আরিসাকে পাওয়ার যে বহুদিনের স্বপ্ন দেখেছিলেন সায়েরিনের পরাজয় তা এক নিমিষে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে সবটা। এখন রাজপ্রাসাদজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে একটাই প্রশ্ন! এখন কি সেই দেহরক্ষী ছেলেটাই সারাজীবন আরিসার ছায়াসঙ্গী হয়ে থাকবে?
চারদিকে উৎকণ্ঠা, অস্বস্তি, গুঞ্জন। রাজন্যবর্গ, দাসদাসী, এমনকি প্রাসাদের প্রাচীন দেয়ালগুলোও এ পরিবর্তনের মনোভাব হারে হারে টের পেয়ে যাচ্ছে। এদিকে কায়েরীথ নীরবে নতুন পরিকল্পনায় নিমগ্ন। মানুষের চাওয়ার শেষ নেই। তারা একটা পেলে পরে অন্যকিছু পেতে চায়। সেটা পেলে আরো বড় কিছু পেতে চায় তারা। কায়েরীথ ও ব্যতিক্রম নয়। সে আরিসার দেহরক্ষী হিসেবে একধাপ উপরে উঠে গেছে। তারপর সে বুঝতে পেরেছে নিজের পরিবারের প্রতিশোধ পূরণ করার জন্য মূল হাতিয়ার হবে রাজকুমারী আরিসা। কায়েরীথ ভেবেছিল সে কারো সাহায্য ছাড়াই সব করবে। এই রাজপ্রাসাদে প্রবেশ তারপর নিজের পরিবারের প্রতিশোধ নেওয়া আর বাবার ইচ্ছে পূরণ করা সব। কিন্তু বারবার, প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে, পাশে থেকেছে আরিসা। চুপচাপ, দৃঢ়ভাবে, ঠিক যেমন একজন অব্যক্ত মিত্র থাকে। তারপর ই কায়েরীথ বুঝতে পেরেছে তার পরবর্তী সমস্ত পরিকল্পনার কেন্দ্রবিন্দু হতে চলেছে সেই রাজকুমারী যাকে প্রথমে সে শুধুই লক্ষ্য ভেবেছিল। কিন্তু এখন সে ছাড়া এক পা এগোনোও অসম্ভব।
·
·
·
চলবে.........................................................................