সময় নিজের ছন্দে এগিয়ে যায়। একই গতিতে মানুষের জীবন ও এগিয়ে যেতে থাকে। সময়ের এই ধারায় চলতে চলতে দেখা হয় নতুন কিছু মানুষের সাথে। নতুন কিছু উদ্দেশ্যের সাথে আর পুরোনো মানুষদের ই ভিন্ন মনোভাবের সাথে। আরহেনিয়া রাজ্যে ধীরে ধীরে প্রাসাদের গুঞ্জন থেমে আসে। রাজ্যও স্বাভাবিক ছন্দে ফেরে। আরিসার কাঁধে উঠে আসে রাজ্যের অনেকাংশের দায়িত্ব যা সে কায়েরীথের সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছে।
প্রতিদিন দু’জনে ঘুরে বেড়ায় রাজ্যের কোণে কোণে। মানুষের কথা শোনে, সমস্যার সমাধান খোঁজে। এই যাত্রায় কায়েরীথ সবসময় থাকে তার পাশে। কিন্তু এতো কিছু পাওয়ার পরেও কায়েরীথের লক্ষ্য আরও গভীর। সে চায় সবকিছুর উপর অধিকার। সেই রহস্যময় অমৃত বস্তু পেলেই সবকিছু করতে পারবে। তার প্রতিশোধ পূরণ হবে। এটাই কায়েরীথের মনের বিশ্বাস।
সাত কিংবা আট বছর পূর্বের কথা , কায়েরীথ ছিল অল্পবয়সী এক নিঃশব্দ কিশোর। হুডো শহরের প্রশস্ত বাড়িটিতে ওদের ছিল হাসিমুখের সংসার। কায়েরীথের বাবা ছিলেন রাজদরবারের প্রভাবশালী মন্ত্রী, রাজা অ্যালারিক ফেইথের ঘনিষ্ঠ সহচর। কায়েরীথের সবচেয়ে প্রিয় মানুষ ছিল তার বড় বোন কিয়ানা! রূপে-গুণে অপূর্ব এক মেয়ে। চুলে রৌদ্রছায়া এমনকি চোখে কায়েরীথের মতো আকাশি জ্যোতি। কিয়ানাকে দেখে মোহিত হতো গোটা হুডো শহর। ওকে বলা হতো জ্যোতির্ময়ী নারী।
কিন্তু সেই সুন্দর আলো ম্লান হয়ে গেল এক দিন। চুপসে গেলো, নিংড়ানো হলো তাকে। শহরের কিছু কু-চরিত্র ছেলে কিয়ানাকে প্রায়ই বিরক্ত করতো। কিন্তু কিয়ানা এসব কথা চেপে রাখতো। সংসারে অশান্তি এড়াতে বলতো না কাউকে। সে যথেষ্ট বুঝদার একজন মেয়ে ছিল। তখন ওর বয়স এখনের কায়েরীথের সমান। একদিন যখন কিয়ানা বিদ্যালয়ে যাচ্ছিলো কুখ্যাত ছেলেগুলো ওর পথরোধ করে। কিয়ানার ছিল না আত্মরক্ষার কোনো শিক্ষা। সাহস তো ছিল কিন্তু ছিল না প্রতিরোধের শক্তি। সেই দিনে ঘটে যায় অঘটন! ওরা ওর গায়ে হাত তোলার চেষ্টা করে। লাঞ্ছিত করে কিয়ানাকে।
কিয়ানা বাড়ি ফিরে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারেনি। চোখে লজ্জা অপমান আর আতঙ্ক নিয়ে ঘর বন্দী করে ফেলে নিজেকে। মনের ভার কাউকে বলতে পারেনি সে। একটাই ভয় ছিল সমাজ তো তাকেই দোষ দেবে। কেননা তখনকার আরহেনিয়ায় নারীদের গুরুত্ব প্রায় ছিল না।
তবুও সময় বদলেছে। এখন রাজকুমারী আরিসার হাত ধরে আরহেনিয়ার প্রতিটি নারী মাথা উঁচু করে বাঁচে। তবে কিয়ানা সে আলোর আগেই হারিয়ে গিয়েছিল।
কিয়ানার নিথর দেহ পড়েছিল নিজের কক্ষে। মেয়েটাকে দেখে মনে হচ্ছিল ঘুমিয়ে আছে সে কোনো চিরন্তন নীরবতায় যেখানে হয়তো শুধু শান্তি আর শান্তি ছিল। কিয়ানা সহ্য করতে না পেরে সমস্ত অপমান আর যন্ত্রণা নিজের ভেতরে লুকিয়ে রেখেই চিরতরে বিদায় নিয়েছিল এ ভুবন থেকে। কিন্তু মেয়েটা হয়তো জানে না সে কতজনের জীবন ধ্বংস করে গিয়েছিলো সেদিন। ছোট্ট কায়েরীথের ছোট জীবনে সেটাই ছিল প্রথম মৃত্যু দেখার অভিজ্ঞতা। প্রথমবার মানুষের চোখ থেকে আলো নিভে যেতে দেখা সেইদিন ই ছিল।
কায়েরীথের বাবা শোকে পাথর হয়ে গিয়েছিলেন। বুকফাটা আর্তনাদে কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন গোটা বাড়ি। মেয়ের মৃতদেহ কোলে তুলে নিয়ে ছুটে গিয়েছিলেন রাজদরবারে। সাথে ছিল প্রতিবেশীদের মুখে শোনা কাহিনি, কিছু সত্য, কিছু গুঞ্জন! সব মিলিয়ে বিচার চাওয়ার অসহায় প্রয়াস যুগিয়ে ছিলেন তিনি।
রাজদরবারে গিয়ে তিনি ব্যক্ত করেন সব কথা। বলেন, তাঁর মেয়ে কিয়ানাকে হয়রানির ঘটনায় জড়িত ছিলেন রাজার ভাই এলিরিক ফেইথের মেজো পুত্র আদ্র। কথা শুনে মুহূর্তে স্তব্ধ হয়ে যান রাজা অ্যালারিক ফেইথ এবং তার ভাই ও। এই নিয়ে ভাইয়ের সাথে বেশ কতক্ষন কথাবার্তা চলে তার। ভাই জানায় তার ছেলে কখনোই এমনটা করতে পারে না। এসব মিথ্যা কথা। শুধুই আলোচনায় আসার জন্য তাদের ক্ষমতাকে নিম্ন প্রমাণ করার জন্য মিথ্যা রটাতে চাইছে মন্ত্রী।
অনেক চিন্তা ভাবনা, কথাবার্তার পর অ্যালারিক ফেইথ মুখে একটুও অনুশোচনা না এনে ঠান্ডা গলায় মন্ত্রীকে উত্তর দেন,
"নিশ্চয় তোমার মেয়ে কিয়ানা কিছু ভুল করেছিল। তাছাড়া ওর প্রাণ ত্যাগের সাথে আমাদের কোনো ধরনের সম্পর্ক নেই। যদি কিয়ানা বেঁচে থাকতো তাহলে হয়তো কিছু একটা করা যেত। যে ভুক্তভোগী তার মুখ থেকেই যদি আসল ব্যাপার না জানা হয় তাহলে কাউকে শাস্তি দেওয়ার মানেই হয় না। আর আমাদের প্রাসাদের ছেলেদের এমন শিক্ষা দেওয়া হয়নি যে রাস্তায় গিয়ে সে মেয়েদের সাথে খারাপ ব্যবহার করবে।"
কয়েকদিন পর, রাজপ্রাসাদের ন্যায়হীনতার বিরুদ্ধে আবারও মুখ খুলতে আসে মন্ত্রীসহ দু-একজন। কিন্তু ফল একিই থাকে! নিস্তব্ধতা আর অবহেলা। কোনো কথারই দাম দেওয়া হয় না। তবু কায়েরীথের বাবা থেমে থাকেননি। আদ্রকে ডাকান, স্বীকার করতে বলেন তার ভুল। কিন্তু আদ্র সোজাসুজি অস্বীকার জানায়। প্রচন্ড ক্ষোভে কায়েরীথের বাবা রাজপরিবারের সন্তান আদ্রকে সামনে পেয়েই মারধর শুরু করেন। মেয়ের অপমান আর মৃত্যুর প্রতিশোধে অসহায় রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে ফেলেন তিনি। এই সাহসের খেসারতও তাঁকে দিতে হয় চরমভাবে। সরিয়ে দেওয়া হয় তাকে মন্ত্রিপদ থেকে। সম্মান ছিনিয়ে নেওয়া হয়। সঙ্গী হয় ঘরে দারিদ্র্যতা।তবুও আশার দীপ নিভে যায়নি তাঁর। কিছু বিশ্বস্ত মানুষকে নিয়ে গোপনে জোট গঠন করেন তিনি। বিচার না পাওয়া এই লাঞ্ছনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের রূপরেখা আঁকেন। পরিকল্পনা ছিল আরহেনিয়ার বাইরে বড় কোনো রাজ্যের কাছে গিয়ে সঠিক বিচার প্রার্থনা করা। শাসকের শেকড়ে আঘাত করার মতো সাহসী চিন্তা। সব প্রস্তুতিই সম্পন্ন হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবায়নের আগেই ঘটে অভিশপ্ত ঘটনা।
যারা এইসব পরিকল্পনায় লিপ্ত ছিল রাতের অন্ধকারে একের পর এক তাদের বাড়িতে আগুন লাগে। কারো শয়নকক্ষে, কারো উঠোনে, কারো রান্নাঘরে। কায়েরীথের মা তখন চুলার সামনে ভাত চড়ানো হাঁড়ির কাছে ব্যস্ত ছিল। আগুনের বিস্তারে মুহূর্তে চারদিক অন্ধকার হয়ে যায়। ধোঁয়া আর আগুনের দমকে আটকা পড়ে যান তিনি। কায়েরীথের বাবা বাইরে ছিলেন। কায়েরীথ ও ছিল তার সাথে। সকলে ফিরে এসে দেখেন এই অবস্থা। কিছু না ভেবেই নিজের ছেলেকে বাইরে ঠেলে দিয়ে ছুটে যান জ্বলন্ত ঘরের ভেতর। পরিবারের আরেকজনকে বাঁচাতে, আরেকবার প্রাণপাত করতে।
যাওয়ার আগে অবশ্য বলে গিয়েছিলেন,
"এই দুনিয়ায় সব মিথ্যে, কায়েরীথ। যদি আমরা না থাকি কষ্ট পাবি না। বেঁচে থাকাটা মানব জীবনের মূল উদ্দেশ্য কিন্তু তোর জীবনে আমাদের ন্যায় বিচার দেওয়াটা মূল উদ্দেশ্য বুঝলি?"
কায়েরীথ তখন হা করে নিজের বাবার কথা শুনছিলো। মাথায় কিছু ঢুকছিলো না। বাবার চলে যাওয়াটা বিস্ময়াভিভূত চোখ নিয়ে দেখছিলো সে। কিন্তু কিছু সময়ের মধ্যেই পুরো বাড়ি থেকে যখন আগুনের ফুলকি বের হতে থাকলো। সে চিৎকার করে কান্না শুরু করে দিল। তারপর তো সময়ের পর সময় যেতে লাগলো। আর কায়েরীথের মন এই প্রতিশোধ পরায়ণ মনোভাব নিয়ে বড় হতে লাগলো। একি সাথে বড় হলো উচ্চতায়। এই জীবনে বেঁচে থাকার জন্য এটাই ছিল কায়েরীথের যথেষ্ট বড় কারণ। খুব অত্যাচার সহ্য করেছে সে। তারপরই ধীরে ধীরে কঠিন হতে পেরেছে। ওই ঘটনা এরপর আর কেউ মনে রাখেনি কারণ যারা প্রতিবাদ করতে চেয়েছিল প্রায় তাদের অনেকেই মারা গিয়েছিলো সেদিন।
আর এজন্যই কায়েরীথ চায় রাজপ্রাসাদের মূল ধ্বংস করে দিতে। তাই প্রথমেই ধীরে ধীরে রাজকুমারীর মনে জায়গা করে নিতে চায় সে। রাজকুমারীকে কোমল কথায় বোঝায়, চোখে চোখ রাখে, আবেগে স্পর্শ করে। বুঝিয়ে দিতে চায় যে রাজকুমারীকে কতটা পছন্দ করে। কিন্তু ভিতরে ভিতরে তার চলতে থাকে বিপরীত প্রতিক্রিয়া। রাজকুমারী আরিসা অবশ্য কায়েরীথের মনোভাব বুঝেও না বোঝার ভান করে। মনোযোগ দিতে চায় না কায়েরীথের প্রতি। কারণ সে পড়তে চায় না কারো মোহে। একবার কারো ফাঁদে আটকা পড়লে জীবনটা তছনছ হয়ে যাবে। কিন্তু মনকে কে আর আটকায়। মন তো বুঝতে চায় না কোনো কিছু।
অনেক দিন চিন্তা ভাবনার পর একদিন কায়েরীথ সিদ্ধান্ত নিল এবার আসল খেলা শুরু করতে হবে তাকে। তাই রাজকুমারীকে নিয়ে গেলো প্রাসাদের পেছনের ধানক্ষেতের নির্জন প্রান্তে। আরিসা আগেই বুঝেছিল কায়েরীথের মনোভাব আজ একটু অন্যরকম। তাই নিজের দাসীকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিল সে। যদিও আত্মরক্ষায় সে একাই যথেষ্ট। তবুও সতর্কতাই ছিল চিন্তিত মনোভাবের কারণ।
ধানের মাঠে দাঁড়িয়ে আছে দুজনে। নির্জন বাতাস বইছে চারি পাশে। সেই বাতাসে হেলেদুলে যাচ্ছে ধানক্ষেতের গাছগুলো। কায়েরীথ আচমকাই নিচে বসে পড়লো। পোশাক হিসেবে পরনে ছিল সবুজ রঙের লম্বা রাজকীয় পোশাক যা মূলত রাজপ্রাসাদ থেকেই দেওয়া হয়েছিল তাকে। আরিসা বেশ অবাকই হলো কায়েরীথের আচরণে। সে কখনোই কায়েরীথের সাথে নরমভাবে কথা বলেনি। প্রতিবারই এমনভাবে কথা বলতো যাতে তাকে কায়েরীথ সহজভাবে না নেয়। যথাযথ কাজের হুকুম করতো। কোনো অবসর সময় দিতো না। খুব কাজ করাত কায়েরীথকে। এবং নিজেও ব্যস্ত থাকতো যাতে মন গড়ানোর সময় না পায়। কিন্তু কায়েরীথ মাথা নিচু করে এক নিঃশ্বাসে বলল,
“আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই, প্রিন্সেস।”
শুনেই আরিসা ক্রোধে কাঁপতে লাগলো। ওর মনে হচ্ছিল এতদিনের বিশ্বাস ভেঙে খান খান হয়ে গেছে। আরিসা রাগী গলায় বললো,
“তুমি ভুলে গেছো আমি তোমার চেয়ে অনেক বড়?”
কায়েরীথ শান্ত স্বরে প্রশ্নের জবাব দিলো। কিন্তু সে উত্তর শুনেও আরিসার মন গললো না। রাগে ক্ষিপ্ত আরিসা এক ঝটকায় তলোয়ার বের করলো। পাশে দাঁড়ানো দাসী ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে ছুটে পালিয়ে গেলো প্রাসাদের ভেতর। ধানক্ষেতের নিঃশব্দতা তখন ধীরে ধীরে ভারি হয়ে উঠেছিলো। বাতাস আরো জোরে প্রবাহিত হচ্ছিলো। অপূর্ণ বিশ্বাস আর অপ্রকাশিত অনুভূতিতে।
কায়েরীথ চুপ করে থাকার পাত্র ছিল না। নির্ভীকভাবে জানিয়ে দেয় সে রাজকুমারী আরিসাকে বিয়ে করতে চায়। এ কথা শুনে আরিসার চোখ মুহূর্তেই রক্তবর্ণ ধারণ করে। সে তলোয়ার হাতে এগিয়ে আসে কায়েরীথের দিকে। প্রচণ্ড রাগ, অপমান আর হতবাক অভিমানে জর্জরিত এক রাজকন্যায় রূপ নেয় তার মুখমণ্ডল! আরিসা কায়েরীথকে আঘাত করতে চায় কিন্তু তার পূর্বেই ধানক্ষেতের ওপাশ থেকে আসতে শুরু করে উৎসুক জনতা। কিছুক্ষণের মধ্যেই ভিড় জমে যায় চারদিক। কারো ফিসফাস, কারো বিস্ময়। এরপরই রাজপ্রাসাদ থেকে বেরিয়ে আসেন রাজা অ্যালারিক ফেইথ নিজে।
মাঠের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা নিজের তলোয়ারধারী কন্যাকে দেখে তিনি স্তম্ভিত। আর সাধারণ মানুষের কণ্ঠে ওঠে প্রতিবাদ।
“দেহরক্ষী বানিয়ে শেষে মেরে ফেলবে? নিশ্চয়ই এর পেছনে অন্য কিছু আছে! রাজকুমারী আরিসা নিশ্চয়ই এভাবে ধরে ধরে সাধারণ মানুষদের মেরে ফেলবে।এই রাজকন্যার তো আসল রূপই এখন প্রকাশ পেল! সে তো একটা ডাইনি।”
রাজা পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খেতে থাকেন। অবশেষে তিনি প্রকাশ্যে কায়েরীথের কাছে ক্ষমা চান।
কায়েরীথ ও নম্রভাবে সেই ক্ষমা গ্রহণ করে এবং সুন্দর কথায় জানিয়ে দেয় এই ক্ষমার পরিবর্তে তার একমাত্র চাওয়া রাজকুমারী আরিসাকে বিয়ে করা। রাজা কোনো উপায়ান্তর না দেখে সম্মতি দেন। শুরু হয় রাজকীয় বিয়ের প্রস্তুতি। এভাবেই ঘটনা পাল্টে যায় আর বিয়ের সংবাদে পরিণত হয়। আরিসা এরপর আর মুখ খুলেনি। তলোয়ার হাতে নিয়ে সোজা চলে যায় নিজের কক্ষে।
দুই মাস ধরে চলতে থাকা প্রস্তুতির সময়টুকু কায়েরীথ কাজে লাগায় আরিসার রাগ ভাঙাতে। যদিও সেই রাগ গলে গিয়েছিল অনেক আগেই। ঘটনার পরদিনই, যখন আরিসা একা বসে ভাবছিল যদি সত্যিই কাল কায়েরীথকে আঘাত করতো তাহলে কী হতো? মনের ভিতরটা কেমন শূন্য হয়ে গিয়েছিল। এরপর থেকে আরিসা কায়েরীথের প্রতি আচরণে হয়ে ওঠে খুব শান্ত এবং স্নিগ্ধ। ধীরে ধীরে কায়েরীথও জায়গা করে নেয় আরিসার হৃদয়ে। ভালোবেসে ফেলে তাকে রাজকুমারী। একদিন হঠাৎ করেই রাজকুমারী তাকে “প্রিন্স” বলে ডেকে ওঠে। এই একটা শব্দ যা প্রেমের শিরোনাম হয়ে ওঠে তাদের জীবনে। দুজনের ভালোবাসা আভিজাত্যের প্রাচীর ভেদ করে পৌঁছে যায় প্রজাদের হৃদয়েও। আসন্ন রাজবিবাহ তাই হয়ে ওঠে সাধারণ কোনো অনুষ্ঠান নয়। পুরো রাজ্যের হৈ হুল্লোড়ের একমাত্র কারণ।
বিবাহের দিন চাঁদের আলোকে সাক্ষী রেখে দুজনের বিবাহ হয়। ভরা লোকজন! মধ্যরাত! আর বিশাল বড় চাঁদ! আরিসার নতুন জীবনের শুরু। ভালোবাসার মানুষটির দিকে তাকিয়ে সুন্দর একখানা হাসি দেয় সে। সে হাসিতে শত পুরুষেরা গলে পড়লেও কায়েরীথ কখনো সেই হাসির মায়ায় পড়েনি। তার কাছে রাজকুমারী আরিসা ছিল শুধুই একটা পন্থা! তার লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাওয়ার একমাত্র পন্থা রাজকুমারী আরিসা। মধ্যরাতেই কায়েরীথ বায়না করে বসে সে দেখতে চায় সেই অমৃত পাথরটিকে যা তাদেরকে আজীবন রক্ষা করে যেতে হবে। আরিসা কিছুটা দ্বিধা বোধ করে। কিন্তু পরক্ষণেই সে ভাবে যেহেতু কায়েরীথ ও এখন থেকে এই বংশের পরিচয় বহন করবে তাহলে তার অধিকার আছে রাজপ্রাসাদের সবকিছুতে।
আরিসা কায়েরীথকে নিয়ে যায় প্রাসাদের নিচে অবস্থিত গোপন কক্ষে যেখানে প্রবেশাধিকার ছিল হাতে গোনা কয়েকজনের। সেই কক্ষের মাঝে স্থাপন করা ছিল অপার রহস্যময় নীল পাথর যার আলোয় আলোকিত হয়ে যায় সম্পূর্ণ স্থান। চারপাশ ঘিরে থাকা মোহময় নীলাভ ঝলক এক স্বপ্নজগতের দরজা খুলে দেয়।
কায়েরীথ কক্ষে প্রবেশ করেই থমকে যায়। বিস্ময়ভরা চোখে তাকিয়ে থাকে সেই অলৌকিক দৃশ্যের দিকে। তার দৃষ্টি আটকে যায় কাঁচঘেরা সেই পাথরে।
“এটা কি সত্যিই সেই নীল পাথর?”
ফিসফিস করে বলে উঠে কায়েরীথ।
আরিসা এগিয়ে এসে বলে,
“হ্যাঁ, এটি অমৃত পাথর। আরহেনিয়ার সবচেয়ে মূল্যবান গোপন রত্ন। এটি স্পর্শ করো না।”
কিন্তু কায়েরীথ রাজকুমারীর কথার ধার ধারে না। সে ধীরে ধীরে এগিয়ে যায়। কাঁচের দেয়ালের মাঝে প্রবেশ করে। তাকে দেখে মনে হয় যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি তাকে ডেকে নিয়ে যাচ্ছে।
আরিসা বাধা দেয়,
“প্রিন্স, থেমে যাও! ইহা নিরাপদ নয়!”
কিন্তু তার কণ্ঠ কায়েরীথের কানে পৌঁছায় না। সে নিঃশব্দে হাত বাড়ায় সেই নীল পাথরের দিকে। পাথরটি কায়েরীথের হাতে এলেই এক ঝলক আলো ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। তারপর আবার নিভে যায় সেই আলো। এখন নীল পাথরটি আর কক্ষকে উজালা করছে না। কায়েরীথের হাতের মধ্যে জ্বলতে থাকে সে পাথর। কক্ষের বাতাস ঘন হয়ে যায়। অনেক জোরে হাওয়া বইতে থাকে। একি সাথে কায়েরীথের চোখ জ্বলজ্বল করতে থাকে। খেলা করতে থাকে শুধুই আনন্দের দীপ্তি। যুদ্ধ এবং শত যন্ত্রণা শেষে এই মুহূর্তটিই তার প্রাপ্তি। পাথরটি তার হাতের মাঝে খানিক সময় পর পর জ্বলজ্বল করে ওঠে। আর কায়েরীথের ঠোঁটে ফুটে ওঠে প্রশান্তির হাসি।
আচমকা বাইরে চিৎকার চেঁচামেচির আওয়াজ শোনা যায়। আরিসার চোখ কুঁচকে যায়। সে কায়েরীথকে বলে বারবার চলে আসতে। কিন্তু কায়েরীথ কোনো প্রতি উত্তর করে না তাই বাধ্য হয়ে আরিসা রাজপ্রাসাদের উপরিভাগে ফিরে আসে। তখন রাজপ্রাসাদে চলছে ভয়ানক যুদ্ধ। বাইরে তখন ধোঁয়া আর রক্তের গন্ধ। উৎসবমুখর সৈন্যরা প্রস্তুত ছিল না এমন আঘাতের জন্য। চারদিকে ধ্বংস আর হাহাকার। রাজা অ্যালারিক নিজ হাতে তলোয়ার তুলে নেমে এসেছেন যুদ্ধক্ষেত্রে। আরিসা দ্রুত নিজের কক্ষে পৌঁছে তলোয়ার ধারণ করে যোগ দেয় রণক্ষেত্রে।
শুরু হয় মহাযুদ্ধ।
কায়েরীথ ও নীল পাথরটি নিজের পোশাকের ভেতর লুকিয়ে রেখে উপরিভাগে ফিরে আসে। দাঁড়িয়ে দেখে অগ্নিময় আকাশ আর মৃত্যুর ছায়ায় মোড়া ভূমি। তাঁর চোখের সামনে যুদ্ধ হচ্ছে । ভেঙ্গে চুরমার হচ্ছে চারপাশ কিন্তু হৃদয়ে চলছে দ্বিধার ভয়াল সংগ্রাম। একে তো সে রাজপ্রাসাদের বিশিষ্ট ব্যক্তি রাজা অ্যালারিক ফেইথকে শেষ করতে চায়। অপরদিকে অন্য রাজ্যের শত্রুরা এসে প্রস্তুত। সে কি প্রতিশোধ নিবে? নাকি রক্ষা করবে এই ভূখণ্ড যে তার বোনের রক্তে রাঙা?
ক্রমে প্রতিপক্ষের সৈন্য সংখ্যা আকাশছোঁয়া হয়। শহরের অলিতে গলিতে ছড়িয়ে পড়তে থাকে আতঙ্ক আর আতঙ্ক। নিরীহ মানুষদের ওপর চলে নিপীড়ন। চোখের সামনে ঘরবাড়ি জ্বলতে থাকে আর বাতাসে মিশে যেতে থাকে কান্নার শব্দ। শত্রুপক্ষ সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে আনে বিশাল বাহিনী। রাজা অ্যালারিক ফেইথকে পরাজিত করে আরহেনিয়ার মাটিকে নিজেদের অধীনে আনা এটাই তাদের প্রধান লক্ষ্য। কিন্তু এটাই প্রথম নয়। বহুবার বহু চেষ্টায় আরহেনিয়াকে দখল করতে এসেছিলো অনেকেই। কিন্তু প্রতিবারই পরাজিত হয়েছে তারা। আরহেনিয়ার অদম্য জাদুবল এবং অগাধ শক্তির প্রাচীরকে কেউ দমাতে পারেনি।
তবু এবার ভিন্ন কিছু। শত্রু এবার এসেছে প্রস্তুত হয়ে।
তারা জানে কেমন করে জাদু ঠেকাতে হয়। তারা জানে কীভাবে প্রতিরোধ করতে হয় আরহেনিয়ার আদি শক্তিকে।
আর সেই কারণেই, যুদ্ধটা এখন শুধু অস্ত্রের নয়। ইহা আত্মা এবং বিদ্যার দ্বন্দ্ব। আরহেনিয়ার যোদ্ধারা যারা একসময় অপ্রতিরোধ্য ছিল। আজ তারা থমকে যাচ্ছে।
জাদুর দেয়ালে ফাঁটল ধরেছে। সেই ফাঁক দিয়ে ধীরে ধীরে ঢুকে পড়ছে পরাজয়।
সায়েরিন এসেছিল যুদ্ধ থামাতে। কিন্তু তার জাদুশক্তিও নিষ্প্রভ। শত্রুর সামনে সেই শক্তি ছিল এক পশলা বাতাসের মতোই তুচ্ছ। একসময় চরম আঘাত পেয়ে লুকিয়ে পড়ে সে। কতক্ষণ বসে কাতরাতে থাকে। আর সেখানেই দেখা হয়ে যায় কায়েরীথের সাথে। কায়েরীথকে দেখে সায়েরিন স্বাভাবিক হওয়ার ভান করে। কায়েরীথকে ভালোমতো খেয়াল করে বুঝতে পারে ছেলেটা যুদ্ধক্ষেত্রে এখনো যায়নি।
সায়েরিন কায়েরীথের চুপসানো মুখ দেখে হেসে ওঠে।
কায়েরীথ রুক্ষ কণ্ঠে বলে,
"এটা হাসার সময় নয়। আমাদের রাজ্য এখন বিপদে।"
সায়েরিন হালকা কন্ঠে জবাব দেয়,
"তাহলে যাও। লুকিয়ে আছো কেন?"
"যেতে চাই। কিন্তু ওদের শক্তি ভিন্ন। আমি গেলে প্রথমেই আঘাত পাবো। তাই লাভ নেই।"
সায়েরিন বলে,
"ভিন্ন হোক বা ভয়ানক প্রতিরোধ করতেই হবে। পেছনে হাঁটার সময় নয় এটা। আঘাত পাওয়ার কথা ভাবলে আমরা আর রাজ্য পাবো না।"
কায়েরীথ কিছুটা দম নিয়ে বলে,
"আপনি জানেন অমৃত পাথর কীভাবে শরীরে ধারণ করতে হয়?"
সায়েরিন চোখ সরু করে জিজ্ঞাসা করে,
"অমৃত পাথর?"
"হ্যাঁ।"
"জানি। কিন্তু কেন?"
"পাথরটা আমার কাছে আছে। আমাকে শিখিয়ে দিন কীভাবে এটাকে নিজের মধ্যে ধারণ করতে হয়।"
সায়েরিন হতভম্ব। সে কায়েরীথের কাছে ঘেষে বসে ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে,
"কায়েরীথ আলেকজান্ডার, তুমি কি পাগল হয়ে গেছো? জানো না ওটার ভার কতটা?"
কায়েরীথের চোখ জ্বলজ্বল করে উঠে,
"এখন আর পেছানোর পথ নেই। দয়া করে সাহায্য করুন আমাকে।"
চুপচাপ তাকিয়ে থাকে সায়েরিন। দুই ভাগ্যজড়ানো মানুষ বসে আছে অপার সিদ্ধান্তের দ্বারপ্রান্তে। শুধু একজনের একটা সিদ্ধান্ত ই যথেষ্ট ভবিষ্যৎ নির্ধারণের জন্য।
·
·
·
চলবে.........................................................................