বিয়ের আমেজে উচ্ছ্বসিত তরতাজা প্রাণগুলো সকাল হতে না হতেই মূর্ছা গেলো। বাহাদুর শেখের নীরবে মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে এলো শেখ বাড়িতে। আসমানী বেগম নিশ্চল,নীরব হয়ে বসে আছে ডাইনিং এর ঠিক মধ্যখানে। এখানেই দেয়ালের সাথে ঘেঁষে রাখা হয়েছে বাহাদুর শেখের খাটিয়া। আসমানী বেগম সেদিকেই শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে বসে আছেন। তার চোখে নেই এক ফোঁটা জল। হঠাৎ ধাক্কায় তিনি যেনো কাঁদতে ভুলে গিয়েছেন। এখন বুঝতে পারছেন গতকালের সেই অস্থিরতার কারণ, কিছু হারানোর অদ্ভুত এক অনুভূতি।
বাহাদুর শেখের দু মেয়ে, ছেলে, ছেলের বউ, নাতি নাতনি শোকে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। মিলি বেগম ও লিলি বেগম ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন৷ এদিকে নীলিমা ও স্মরণের অবস্থা আরোও করুণ৷ নীলিমা এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না তার নানা আর এ পৃথিবীতে নেই। সেদিন বিয়ের পর মনে হয়েছিলো তার নানার যাত্রা বোধহয় আরোও লম্বা হবে। তাদের সাথে আরোও সময় কাটাবে। কিন্তু এ যাত্রার সময়সীমা যে একেবারেই সেই সীমিত তা জানতো না কেউ।
কাঁদতে কাঁদতে নীলিমার অবস্থা করুণ৷ তাকে সামলানোর মতো অবস্থায় নেই মিলি বেগম। তাই স্মরণকে এ দায়িত্ব নিতে হয়েছে৷ তার নিজেরও অবস্থা খুব একটা ভালো না৷ তাই নীলিমাকে সামলানো দুষ্কর হয়ে যাচ্ছে।
বাদ জোহর গ্রামের মসজিদে বাহাদুর শেখের জানাজা অনুষ্ঠিত হবে৷ আর শেখ বাড়ি হতে দু মিনিটের দূরত্বে অবস্থিত পারিবারিক কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হবে৷ আসমানী বেগম পুরোটা সময় নীরবে অশ্রু বিসর্জন দিলেন। কিন্তু তাঁর দু মেয়ে মিলি ও লিলি বেগম বাবা হারানোর শোকে পাগলপ্রায় হয়ে উঠলেন। বাহাদুর শেখের খাটিয়া উঠানোর সময় মিলি বেগম চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করলেন। তিনি কিছুতেই বাবার লা' শে' র খাটিয়া নিয়ে যেতে দিবে না। সমান তালে কাঁদছেন লিলি বেগমও। এবার বাড়ির দু বউ মিলে তাদের ননদকে ধরলো। অতঃপর বাহাদুর শেখের খাটিয়া নেয়া হলো। তাঁর খাটিয়া ধরেছেন দু ছেলে ও দু জামাই। খাটিয়ার পাশে ও পিছনে তাঁর নাতিরা হাত লাগালো। এভাবেই শেখ বাড়ি হতে বিদায় নিলেন শেখ বাড়ির নির্মানকর্তা বাহাদুর শেখ।
------------------
বাহাদুর শেখ মা' রা' গিয়েছেন আজ দুদিন হলো। পরিবেশ এখনও শুষ্ক ও থমথমে। আজ তিনদিন যাবত কারোর ভালোমতো খাওয়াদাওয়া হয়নি। গতকাল থেকে বাড়িতে রান্না হচ্ছে ঠিকই। কিন্তু খাচ্ছে না কেউ।
আসমানী বেগম এখন সারাদিন রুমেই পড়ে আছেন। সবসময় বিছানায় শুয়ে থাকেন। কখনও বাহাদুর শেখের বালিশে মাথা রেখে ঘুমান, কখনও বা সেই বালিশ হাতে আগলে ঘুমান। আগের তুলনায় একদমই চুপচাপ হয়ে গিয়েছেন তিনি। মিলি বেগম ও লিলি বেগম মায়ের এই নীরবতার সহ্য না করতে না পেরে কথা বলার বেশ চেষ্টা করেছেন। কিন্তু আসমানী বেগম ছেলে,মেয়ে,নাতি,নাতনি কারোর সাথেই প্রয়োজনের অতিরিক্ত কোনো কথাই বলছেন না। এ নিয়ে মিলি ও লিলি বেগমের মাঝে বেশ উদ্বিগ্নতার সৃষ্টি হয়। পরে এ নিয়ে তাঁদের দু ভাই বুঝিয়েছে অবশ্য। বলেছেন,মা'কে একটু সময় দিতে। যেনো তিনি বাবার মৃ' ত্যু' র ব্যাপারটা ঠিক মতো মেনে নিতে পারেন।
স্মরণ অফিস থেকে আরোও পাঁচদিনের ছুটি নিয়েছে। প্রথমত বিয়ের জন্য সে তিনদিন অতিরিক্ত ছুটি নিয়েছিলো। পরে দাদা মা' রা যাবার জন্য ছুটি নিয়েছে আরোও দুদিন। বিয়ের জন্য অতিরিক্ত ছুটি নেয়া হলেও তা উপভোগ করতে পারেনি স্মরণ ও নীলিমা। বাহাদুর শেখ মা' রা যাবার পর হতে দুজনের মধ্যকার সেই জৌলুস, নবদম্পতির যে আলাদা আচরণ বা ভাব থাকে তা দেখা যায়নি। কারণ দুজনেই তাদের সবচেয়ে সম্মানের ও ভালোবাসার মানুষ হারিয়েছে, যে তাদের এ বিয়ের মূল হর্তাকর্তা ছিলেন।
পরেরদিন বাড়িতে বাহাদুর শেখের জন্য মিলাদের ব্যবস্থা করা হলো। সেই নিয়েই সারাদিন ব্যস্ত সময় কাটালো নীলিমা। স্মরণের সাথে কথা হলো না একটুও। সারা দিনের কাজ শেষে অবশেষে রাতে সময় পেলো নীলিমা। স্মরণ তখন খাতায় কি যেনো হিসাব করছিলো। সে রুমে এসে দেখলো স্মরণ চেয়ারে বসে বসে আছে। হাতে খাতা ও কলম। নীলিমা দেখে জিজ্ঞেস করলো,
" কি করছেন স্মরণ ভাই?"
স্মরণ কলম চালাতে চালাতে বললো,
" মিলাদে কত টাকা খরচ হলো,মসজিদে কত টাকা দান করা হয়েছে, কত টাকা দান করবে সেটারই হিসাব করছিলাম। "
নীলিমা একটু অবাক হলো। এর আগে স্মরণকে কখনও এ জাতীয় কাজ করতে দেখেনি সে। তাই ঈষৎ বিস্ময় নিয়ে শুধালো,
" আপনি করছেন যে? আপনাকে তো কখনও এসব করতে দেখিনি। এগুলো তো মামা...."
স্মরণ দৃষ্টি তুলে চাইলো। নীলিমার দিকে চেয়ে মৃদু হেসে বললো,
" দাদা মা' রা যাবার পর থেকে বাবাকে একদম চুপচাপ থাকতে দেখছি। এ কাজটা বাবারই ছিলো। কিন্তু তার অবস্থা দেখে আমিই কাজটা হাতে নিলাম। যেহেতু বাবার শারীরিক ও মানসিক অবস্থা ভালো না, তাই একটু রেস্ট নিক।"
নীলিমা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বিছানায় গিয়ে পা ঝুলিয়ে বসলো। মেঝের দিকে চেয়ে বিষণ্ণ গলায় বললো,
" সবকিছু কেমন যেনো অগোছালো হয়ে গিয়েছে তাই না? নানার হঠাৎ ছেড়ে যাওয়ায় সবকিছু ভেঙে পড়েছে। মাঝেমধ্যে কেমন যেনো শূন্য শূন্য লাগে সবকিছু। অথচ এমন তো হওয়ার কথা ছিলো না। আমাদের খুশি থাকার কথা ছিলো। নানার দোয়া নিয়ে ঢাকায় ফেরার কথা ছিলো। অথচ......."
বলতে বলতেই কান্নায় ভেঙে পড়লো নীলিমা। নাক টেনে টেনে কাঁদছে সে। স্মরণ খাতা বন্ধ করে উঠে এলো। নীলিমার সামনে দাঁড়িয়ে তাকে ওভাবেই কাঁধে হাত রেখে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলো সে। নীলিমাকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করলো না। কেননা আপনজন হারানোর বেদনায় কোনো ধরণের সান্ত্বনা উপযুক্ত নয়। উপরন্তু সে নিজেই দাদার শোকে কাতর। নীলিমাকে কি বলবে!
নীলিমা একসময় কাঁদতে কাঁদতে চুপ হয়ে গেলো। কান্না থামালেও স্মরণকে জড়িয়ে ধরে রাখলো সে। বেশ কিছুক্ষণ বাদে স্মরণ বেশ মোলায়েম গলায় শুধালো,
" এখন ভালো লাগছে?"
নীলিমা ছোট্ট করে জবাব দিলো,
" হুম। "
স্মরণ এবার নীলিমাকে ছেড়ে তার পাশে বসলো। আলগোছে নীলিমার হাতে হাত রাখলো। বড় নিঃশ্বাস টেনে বললো,
" মানুষের মৃ' ত্যুর মত চরম নির্মম সত্য আর দ্বিতীয়টা নেই। কেউ ভাবেনি দাদাজান এভাবে আমাদের ছেড়ে চলে যাবে। আমি এখনও নিজেকে সামলিয়ে উঠতে পারিনি। এমনকি বাড়ির কেউই না। দাদীর দিকে তাকালো কষ্টে বুকটা ফেটে আসে। শুকনো মুখটা এ কয়দিনে আরোও শুকিয়ে গিয়েছে। দাদীর সাথে কথা বলাও যাচ্ছে না। জানি না সবকিছু ঠিক হতে কতদিন সময় লাগবে। "
নীলিমা প্রত্যুত্তরে কিছু বললো না। কিছুক্ষণ পর জিজ্ঞেস করলো,
" ঢাকা যাবেন কবে?"
"পরশুদিন। তুমিও ব্যাগ গোছানো শুরু করো নীলিমা। "
নীলিমা অবাক হলো। কণ্ঠে বিস্ময় নিয়ে শুধালো,
" ওমা! আমি কেনো?"
" ফুপুর সাথে কথা হয়েছে। তুমি আমার সাথে ঢাকায় যাবে। তারা আরোও এক সপ্তাহ পর ঢাকায় ব্যাক করবে। ফুপা বোধহয় কালই চলে যাবে। আর ফুপু ক'দিন থাকবে। "
" এ নিয়ে কখন কথা হলো? আমাকে তো কিছুই জানালেন না!"
" কাল রাতে কথা হয়েছে। তোমাকে নিয়েই কথা বলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তুমি ঘুমিয়ে পড়েছিলো বলে আর ডাকিনি।"
নীলিমা এবার দিশেহারা হয়ে পড়লো। অস্থির হয়ে বললো,
" এভাবে হয় না স্মরণ ভাই। এমন হুটহাট আপনার বাসায় চলে যাবো কিভাবে! কোনো প্রিপারেশন নেই। এভাবে নতুন সংসারে যাওয়া আমার জন্য সম্ভব না।"
স্মরণ হাসলো। নীলিমাকে নিজের দিকে ঘুরালো এবং নিজ এক পা বিছানায় তুলে তার দিকে ঘুরে বসলো। অতঃপর বললো,
" এই যে, নীলিমা নামের নতুন বউটি। বাই এনি চান্স,আপনি কি ভুলে গিয়েছেন যে আপনি আমার সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী? "
নীলিমা লজ্জা পেলো খানিক। স্মরণের বলার ভঙ্গিটাই এমন ছিলো যে! সে প্রত্যুত্তর করলো না। স্মরণ বললো,
" বাসাটা এখন তোমারও নীলিমা। ঐ বাসার নতুন সদস্য এখন তুমি। হ্যাঁ, বাসাটা একটু ছোট বটে। তবে আগামী মাসেই তিন রুমে ভালো একটা বাসা খুঁজবো। একটাতে আমি তুমি থাকবো,আরেকটায় থাকবে সাদ আর অপর রুমটা হবে গেস্ট রুম। "
নীলিমা এবার একটু নড়েচড়ে বসলো। হঠাৎ সাংসারিক আলাপে মন বসাতে ইচ্ছে করলো। হঠাৎ করেই সাংসারিক মেয়ে হয়ে উঠার মনবাসনা জেগে উঠলো। সে জিজ্ঞেস করলো,
" এখন যে বাসায় আছেন সেখানের বারান্দা কেমন? ছোট নাকি বড়?"
হঠাৎ বারান্দার কথা উঠায় স্মরণের মনে পড়লো তার বাসার একমাত্র বারান্দার অবস্থা ভীষণ করুণ। সুন্দর বারান্দাটার একপাশ পুরোটাই দখল করে অব্যবহৃত জিনিসপত্রগুলো। ওপাশটা ছোটখাটো একটা জঞ্জালে পরিনত হয়েছে। স্মরণ শুকনো একটা ঢোক গিললো। নিজের অগোছালো আচরণট লুকিয়ে হাসিমুখে বললো,
" খুব বেশি বড় না। ছোট। বুঝোই তো ব্যাচেলর দেখে বাসা ভাড়া নিয়েছিলাম। "
নীলিমার একটু আফসোস হলো। আবদার করলো স্মরণকে,
" শুনুন তবে, আমার একটা বড় ব্যালকনির বাসা চাই। যেখানে বসলে বিনা বাধায় নীল সাদা আকাশ দেখা যাবে। যেখানে বসে আমি প্রতিদিন বিকালে এক কাপ চা খেতে পারবো। যেখানে আমি গাছ লাগাতে পারবো। যেখানে আমি অলস দুপুরে সময় কাটাতে পারবো। এমন একটা বারান্দা চাই আমার।"
" আর কিছু?"
নীলিমা ভাবলো। কিছুই না পেয়ে বললো,
" আপাতত এটুকুই ডিমান্ড। পরে মনে পড়লে আপনাকে জানাবো। "
স্মরণ হাসলো। নীলিমাকে কাছে টেনে গভীরভাবে জড়িয়ে ধরলো। নীলিমাও তাকে বিপরীতে জড়িয়ে ধরলো। অতঃপর নিঃশব্দে কেটে গেলো নবদম্পতির একান্ত কিছু মুহূর্ত।
--------------
শেখ বাড়ির সকলে একত্রে সকালের নাস্তা করছে। বরাবরের মতোই ডাইনিং টেবিল ও মেঝেতে বসে সবার খাবার পর্ব চলছে।
আজ দুপুরের পর লিলি বেগম সপরিবারে বাসায় ফিরবেন। ইমাদও একা ঢাকায় ফিরবেন। নওরীন ও সাজিদ আজ সাজিদের বাড়ির উদ্দেশ্যে বের হবে।
সকালের খাবার শেষে সাজিদ সবাইকে ডাইনিং এ জড়ো করলো। এভাবে হঠাৎ জড়ো করায় একটু চিন্তিত হলো সবাই। নওরীনও এসে। তাদেরকে এভাবে দেখে মিলি বেগম চিন্তিত গলায় শুধালেন,
" কি হয়েছে তোদের? এভাবে জড়ো করেছিস কেনো সবাইকে?"
সাজিদ মুচকি হাসলো। প্রায় দৌড়ে গিয়ে রুম থেকে একটা মিষ্টির প্যাকেট এনে সবার সামনে হাজির করলো। মিলি বেগমের সামনে প্যাকেট ধরে বললো,
" মিষ্টি নিন মা। আপনি নানি হচ্ছেন আলহামদুলিল্লাহ। "
হঠাৎ এ খবরটা সবার মাথায় ধরলো না। অতঃপর বুঝ আসতেই বাড়ির ছোটরা খুশিতে চিৎকার করে উঠলো। নীলিমা দৌড়ে গিয়ে নওরীনকে জড়িয়ে ধরলো। তার গালে জোরেশোরে একটা চুমু বসিয়ে বললো,
" কংগ্রাচুলেশনস আপু। কতদিন পর একটা গুড নিউজ পেলাম!"
আসমানী বেগম এবার এগিয়ে এলেন। দু হাত ভরে নওরীন ও সাজিদের জন্য দোয়া করলেন। অতঃপর আফসোসের সুরে বললেন,
" আজ তর নানা বাঁইচা থাকলে কি যে খুশি হইতো রে। তার পরনাতী আইবো এ খুশিতই বাঁইচা কূল পাইতো না। "
আসমানী বেগমের এহেন কথায় হাসিখুশি মহলটা মুহূর্তেই ভারী হয়ে এলো। কিন্তু স্মরণীয় এগিয়ে এলো তখনই। প্রায় ধমকের সুরে বললো,
" হাসিখুশি পরিবেশটা দুঃখের না করলে চলতো না দাদী? এখন তুমি নাতির জন্য শুধু দোয়া করো, যেনো দ্রুতই পরনাতী চলে আসে। "
আসমানী বেগম অশ্রুসিক্ত চোখেই হাসলেন। স্মরণের উদ্দেশ্যে বললেন,
" আমার কিন্তু এটা ফরনাতী দিয়া কাজ চলবো না। দুইডা লাগবো। "
" হ্যাঁ, তো নওরীন আপু এনে দিবে দুইটা। যদি জমজ হয় আরকি......."
" যমক লাগবো ক্যান। এটা নওরীন আর সাজিদের পোলা হইবো৷ আরেটা তোর আর নীলুর মাইয়া হইবো।"
আসমানী বেগমের এহেন কথায় লজ্জায় লাল হয়ে এলো নীলিমা। নওরীনের ওড়নায় মুখ লুকালো সে। এদিকে দাদীর কথা প্রত্যুত্তর স্বরূপ স্মরণ পরিবেশ বাছবিচার না করেই ফট করে বলে বসলো,
" শান্তিমতো বাসরই করতে পারলাম না আবার বাচ্চা! আগে বাসরটা সেরে নিতে দাও। তারপর বলো দাদী। "
স্মরণের বেঁফাস কথায় তব্দা খেলো সকলে৷ নীলিমা পারে না লজ্জায় মাটি খুঁড়ে ভেতরে ঢুকে যেতে। লিলি বেগম এসে স্মরণের পিঠে দুম করে একটা ঘা দিলেন৷ কপট ক্রোধ নিয়ে বললেন,
" ব্যাটা দেখেশুনে কথা বলবি না? বাপ,চাচা,ফুফু,ফুপা আছে এখানে। সবার সামনে কি সব কথা বলতে হয়?"
স্মরণ ঠোঁট কামড়ে ধরলো। নাহ,এবার বেশিই বলা হয়ে গিয়েছে। বাবা চাচাদের মতো সম্মানীয় ব্যক্তিদের সামনে এমন কথা বলা উচিত হয়নি। এগুলো নিয়ে দাদী,নানি,মা,খালা,ফুপুদের সামনে মজা করা যায়। কিন্তু এদের সামনে না। সে নিজের ভুল বুঝতে পারলো। ক্ষণেই বললো,
" আসলে বুঝতে পারিনি এমন কথা বলে ফেলবো। আই অ্যাম এক্সট্রিমলি সরি। নওরীন আপুর প্রেগন্যান্সির কথা শুনে বেশিই এক্সাইটেড হয়ে পড়েছিলাম। "
আনিস সাহেবসহ বাকিরা আড়চোখে শুধু দেখলেন স্মরণকে। কিছু বললেন না। সাজিদ ও মাহবুব এগিয়ে এলো মহল হালকা করতে। সাজিদ বললো,
" আরে আরে এসব কথা বাদ দিন। আমরা প্রেগন্যান্সির ব্যাপারে কখন জানতে পেরেছি সেটা জিজ্ঞেস করবেন না?"
লিলি বেগম বললেন,
" বলো বলো। কবে জানতে পেরেছো এ ব্যাপারে?"
" নীলুর যেদিন মেহেদি অনুষ্টান হয় সেদিন বিকালে নওরীন আমাকে বললো ফার্মেসি থেকে একটা কিট আনতে। টেস্ট করবে বলে৷ আমি তখন এ কথা শুনে খুশিও হয়েছিলাম আবার টেনশনেও ছিলাম। কারণ এর আগে নওরীনের যে মিসক্যারেজ হয়েছিলো সে নিয়েই টেনশনে ছিলাম। পরে মেহেদি অনুষ্টান শেষে রাতে টেস্ট করলো। সব পজিটিভ এসেছে আলহামদুলিল্লাহ। পরেরদিন আমরা দুজন বাইরে গিয়েছিলাম মনে আছে? তখন ওকে ক্লিনিকে নিয়ে গিয়েছিলাম শিওর হতে। আল্লাহর রহমতো আল্ট্রাতে সব ঠিকঠাক আসে। ও দুই মাসের প্রেগন্যান্ট৷ সেদিনই আমরা বলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এত ব্যস্ত আর ক্লান্ত ছিলো সবাই যে সুযোগই হয়নি। পরে ভাবলাম বিয়ের অনুষ্ঠানটা শেষ হোক তারপর। কিন্তু এরপর আবার নানা মা' রা গেলেন। সবদিয়ে এত লেট হলো বলতে। "
মিলি বেগম এবার সব মিলালেন। বুঝলেন এজন্যই নওরীনের শরীর ভালো ছিলো, কিছু খেতে পারছিলো না তেমন। কিন্তু ছোট মেয়ের বিয়ের টেনশনে বড় মেয়ের শরীরের উপর খুব একটা নজর দিতে পারেননি তিনি। এবার তিনি গিয়ে নওরীনকে জড়িয়ে ধরলেন। কপালে প্রগাঢ় চুমু দিয়ে বললেন,
" দোয়া করি মা,সুস্থ সবল থাক। বাচ্চাটাও সুস্থ সবল থেকে দুনিয়াতে আন। নিজের খেয়াল রাখিস মা। গতবারের মতো ভুলগুলো করিস না। বাসায় ফিরেই ডাক্তারের কাছে দেখিয়ে সব টেস্ট করাবি৷ "
নওরীন মৃদু হেসে বললো,
" আচ্ছা আম্মু।"
এরপর একে একে সবাই নওরীন ও সাজিদকে অভিনন্দন জানালো। আনিস সাহেব ও আনোয়ার সাহেব পকেট থেকে বেশ কিছু টাকা বের করে দিলেন নওরীনকে, দোয়াস্বরূপ।
--------------
স্মরণ ও নীলিমা আজ ঢাকায় ফিরেছে। সাদ এখনও আসেনি। ওর ভার্সিটি আরোও এক সপ্তাহ বন্ধ। তাই পরে আসবে।
নীলিমা পুরোটা রাস্তা অল্পস্বল্প কাঁদতে কাঁদতে এসেছে। স্মরণ এক পর্যায়ে তার কান্নার জন্য আতংকিত হয়ে গিয়েছিলো। বাসে পাশে বসা মেয়ে এভাবে কান্না করলে যে কেউ ভাববে মেয়ে ভাগিয়ে নিয়ে এসেছে। পরে তারা গণধোলাই দিতে দ্বিতীয়বারও ভাববে না৷ এজন্য বেশ ক'বার নীলিমাকে কান্না থামাতে বলেছিলো। সে কিছুক্ষণের জন্য কান্না থামালেও পরে ঠিকই কান্না শুরু করে দেয়। শেষে স্মরণ হাল ছেড়ে তাকে কাঁদতে দেয় শান্তিতে।
বাসায় এসে পৌঁছালো স্মরণ ও নীলিমা। বাসার দরজা খুলতেই ভ্যাপসা একটা গন্ধ এসে বাড়ি খেলো নীলিমার নাকে। সে নাক চেপে বাসার ভেতরে পা দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলো,
" ইশ বাসার ভেতরে এমন গন্ধ কেনো স্মরণ ভাই?"
স্মরণ এ প্রশ্নের জবাব দিলো না। মনে মনে বলতে লাগলো, 'এ তো শুধু গন্ধ। ভেতরে গিয়ে দেখো বাসার কি অবস্থা।'
সত্যিই তাই হলো নীলিমা বাসার ভেতরে গিয়ে দেখলো সবগুলো রুমই অগোছালো,অপরিচ্ছন্ন ও রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসছে তীব্র পঁচা গন্ধ। গন্ধের রহস্য বের করতে গিয়ে দেখলো স্মরণ বাড়ি যাবার আগে ময়লার ঝুড়ির ময়লা ফেলে যায়নি। তাই পঁচেই এত দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। এদিকে দুটো রুমের অবস্থাও করুণ। কাপড়চোপড়ের ঠিক নেই। সবকিছু অগোছালো। তার সাধের ব্যালকনির অর্ধেকটা পরিত্যক্ত স্টোর রুমের মতো।
বাসার এ অবস্থা দেখে নীলিমার ভীষণ কান্না পেলো। এ নিয়ে স্মরণের সাথে বিবাহিত জীবনের প্রথম ঝগড়াটা সম্পন্ন হলো। পরে অবশ্য নীলিমাই বলে গেলো শুধু। স্মরণ আর কিছু বলেনি। মাথা নিচু করে চুপচাপ শুনেছে। সাজিদের কাছে শুনেছে সংসার সুখের করতে হলে বউয়ের কথা শুনতে হবে। সে যা সত্য বলেই তাই সত্য বলতে হবে। যদিও প্রথমে ঝগড়া লাগিয়ে নিয়েছিলো।
নীলিমা কোনোমতে ড্রেস বদলিয়ে রুম গোছাতে আরম্ভ করলো। স্মরণকে ধমক দিয়ে বললো,
" কাজের খালাকে আসতে বলেন দ্রুত।"
স্মরণ সাথে সাথেই কল দিলো খালাকে। খালা অতি আনন্দের সহিত জানালো, সে গ্রামে বিয়ে খেতে এসেছে, তাই দুদিন আসতে পারবে না। এ কথাটি স্মরণ নীলিমাকে জানালো অত্যন্ত দুঃখের সহিত। তখন রাগে-দুঃখে নীলিমার মনে হলো স্মরণের মাথার সব ক'টা চুল ছিঁড়ে টাক বানিয়ে ফেলতে। কিন্তু পরে মনে হলো, তার নিজেরই তো স্বামী। এভাবে টাক বানালে পরে সারাদিন সেই টাকের উপর তবলা বাজাতে মন চাইবে। তখন তো বিপদ!
নীলিমা এবার রাগে কটমট করে স্মরণের দিকে চেয়ে বললো,
" যেহেতু খালা আসেনি, তাই তার ভূমিকা আপনি পালন করবেন। বুঝলেন?"
স্মরণ মুহূর্তেই তেতে উঠে বললো,
" আমি! আমি কেনো?"
নীলিমা কটমট দৃষ্টিতে তাকালো। বললো,
" আপনি না তো আর কে! আপনাকেই করতে হবে। কারণ আপনিই ঘর নোংরা করেছেন। এমন করলে কিন্তু পুরো বাসাই আপনাকে দিয়ে পরিষ্কার করাবো। আমি কিছুতেই সাহায্য করবো না। "
স্মরণ মিইয়ে গেলো। আর কিছু বললো না। কারণ দোষ তো তারই। অগত্যা নীলিমাকে সাহায্য করলো সে।
আজ শেষ হতে হতে সকাল গড়িয়ে দুপুর হলো। কাজের চাপে শুধু ভাত আর আলুভর্তা দিয়ে দুপুরের খাবার খেলো দুজনে। বিকালে দু কাপ চা নিয়ে পরিষ্কার বারান্দার ব্যালকনিতে বসলো দুজনে। চায়ের আড্ডায় জমে উঠলো দুজনের দাম্পত্য জীবনের শুরুর গল্প। এভাবেই শুরু হলো স্মরণ ও নীলিমার সাংসারিক জীবনের গল্প।
.
.
.
সমাপ্ত.....................................................................