তোমার নামে যাতনা - পর্ব ০৩ - শারমিন আক্তার বর্ষা - ধারাবাহিক গল্প


!!৫!!

বাড়িতে পৌঁছে চারুর মুখ লালচে হয়ে গেল। প্রচন্ড বিরক্ত হল সে। সুলতানা পেছন থেকে চারুকে ধরে বললেন, ‘ওনারা তোকে দেখতে আসছে। সালাম দে।’

চারু বিরক্তিটুকু সাইডে রেখে, সালাম দিল। সালামের জবাব নিয়ে সোফিয়া খাতুন বললেন, ‘মাশা আল্লাহ, ভীষণ মিষ্টি দেখতে মেয়ে আপনার ভাই। এসো মা, আমার পাশে বসো।’
সোফিয়া খাতুন চারুর প্রশংসাটুকু লোকমান রহমানের দিকে তাকিয়ে করলেন। তারপরের কথাগুলো চারুর দিকে তাকিয়ে বলে তিনি হাতের ইশারায় তাকে পাশে বসতে বলল। 

লোকমান রহমান গ্রীবা ঘুরিয়ে মেয়ের দিকে তাকায়। সোজাসাপটা হয়ে দাঁড়ানো চারু বাবার দিকে অস্থির চাহনিতে তাকাল। লোকমান রহমান বললেন, ‘মেয়েটা মাত্র কলেজ থেকে ফিরল। ও বরং রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসুক। ততক্ষণ আমরা গল্প করি?’

শাজান সিকদার বললেন, ‘আপনি ঠিকই বলেছেন ভাই। চারু মা যাও। তুমি বরং ফ্রেশ হয়ে এসো। আমরা তোমার জন্য এখানে অপেক্ষা করি।’

চারু হতভম্ব! নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না চারু। ওর সামনে বসা প্রতিটি মানুষ প্রয়োজনের চেয়ে বেশি স্বাভাবিক ব্যবহার করছে। তাদের এমন আচরণে অস্বস্তি বোধ করছে চারু। বিষয়টি মোটেই হাওয়ায় উড়িয়ে দিতে পারছে না সে। হুট করে দেখতে আসার কী মানে? পাত্রপক্ষ দেখতে আসার খবর ওকে তো আগেভাগে কেউ জানায়নি। আর আগে কখনো এমন হয়নি। এই প্রথম তাকে দেখতে আসলো। তার বাবা কিভাবে স্বাভাবিক আছেন? তার মধ্যে কোনো হেলদোল নেই। অথচ এই বাবা-ই তাকে কথা দিয়েছিল মেয়ের বিয়ে তাড়াতাড়ি দিবেন না। পড়াশোনা শেষ করিয়ে, নিজের পায়ে দাঁড় করাবেন তারপর বিয়েসাদীর চিন্তা মাথায় আনবেন। কথাটির বিপরীত ঘটে গেল। এখন সেই বাবা পাত্রপক্ষকে ড্রয়িংরুমে বসিয়ে খাওয়াচ্ছেন। চারু মেঝের দিকে তাকিয়ে হাফ ছাড়ল। নিশ্চল পায়ে রুমে দিকে যেতে পা বাড়াতেই সে দেখল একজন সুঠাম দেহের সুদর্শন পুরুষকে। ফর্সা গায়ে সাদা শার্ট ইন করে পরা, গলায় তার কালো রঙের টাই বাঁধা। 
 
শাজান সিকদারের থেকে কিছুটা দূরে একা বসে আছে মানুষটা। খানিকটা ঝুঁকে পড়ে টেবিল থেকে ফ্রুটস নিয়ে খেতে খেতে একবার তাকাল সে চারুর দিকে। পুরুষ লোকটির চোখে চোখ পড়ল তার আচমকা। সহসা গলা শুঁকিয়ে এল চারুর। লোকটার শীতল চাহনি দেখে চারুর শ্বাসরুদ্ধ হওয়ার অবস্থা হল যেন। আফনান সিকদার নির্বিক, ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে একপলক তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে ফেলল। দুর্বোধ্য দৃষ্টি স্থির করল লোকমান রহমানের ওপর। আফনান দৃষ্টি সরিয়ে ফেলতেই চারু তটস্থ ভঙ্গিতে ধাপে ধাপে সিঁড়ি ভেঙে উপরে চলে গেল। 

আফনান কথা তুলল, ‘আপনার মেয়েটাকে আমার ভালো লেগেছে। সে শান্ত আর বুদ্ধিমতী। আপনি অনুমতি দিলে আমি আগামী সপ্তাহেই বিয়েটা সেরে ফেলতে চাই। আমি একটুও দেরি করতে চাচ্ছি না। যত দ্রুত করা যায় ততই ভালো হয়।’

লোকমান রহমান বিরস মুখে বললেন, ‘একবার আমার মেয়েটার সঙ্গে কথা বলে দেখো। বিয়ের বিষয় তাড়াহু..’

লোকমান রহমানকে কথা শেষ করতে না দিয়ে আফনান জবাব দিল, ‘কথা বলার জন্য বিয়ের পর অনেক সময় পাব। এখন বিয়েটা ইম্পর্ট্যান্ট। আমি বিয়ে করতেছি শুনলে অনেকেই আছে বিয়ে ভাঙতে চাইবে। ঝামেলা সৃষ্টি করবে। তাই দ্রুত বিয়ে করতে চাচ্ছি।’

লোকমান রহমান সন্দেহী চোখে তাকিয়ে। ভ্রু কুঞ্চিত করে বললেন, ‘বিয়ে ভাঙতে চাইবে কে? বিয়ে ভেঙে কার কী লাভ?’

আফনান গম্ভীর। লোকমান রহমানের প্রশ্নের উত্তর সে দিল না। শাজান সিকদার এইবারে বললেন, ‘ওর কথায় ভুল বুঝবেন না ভাই। আমার পরে ওই তো ভবিষ্যত মন্ত্রী হবে। তাই ওর পেছনে শত্রুর অভাব নেই। তাই ছেলেটা আশংকা করছে, শত্রুর আক্রমণ হবে, তারা বিয়ে ভাঙবে।’

লোকমান রহমান গাম্ভীর্যের সঙ্গে বললেন, ‘ঠিক আছে। আমি শুক্রবারের আগেই বিয়ের ব্যবস্থা করে ফেলব।’

শাজান সিকদার প্রফুল্ল মুখে বললেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ।’
আফনান ঠোঁট বাঁকা করে রহস্যময় হাসি দিল।

চারু হনহনিয়ে রুমে ঢুকলো। কাঁধ থেকে ব্যাগটা নামিয়ে ছুঁড়ে ফেলল বিছানায় তারপর বিছানার একপাশে ধপ করে বসল। ভ্রু যুগল কুঁচকে ফেলল। নিজের চোখ দুটোকে নিজেই বিশ্বাস করতে পারছে না। এইমাত্র নিচে যে লোকটাকে বসে থাকতে সে দেখল। ওই লোকটা কী সত্যি সত্যি ওখানে বসে ছিল? নাকি ওটা ওর হ্যালুসিনেশন? চারু তাত্ক্ষণিকভাবে ডানে-বামে মাথা নাড়ল। না, ও সত্যি ওই লোকটাকেই দেখেছে। আশ্চর্য! অদ্ভুত মানুষ তো। একদিন রাস্তায় দেখা হয়েছিল সেই সূত্র ধরে লোকটা তার বাড়ি পর্যন্ত চলে এল। আবার সঙ্গে করে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসছে। রাগ হচ্ছে চারুর। ভীষণ রকম রাগ। লোকটার উপর আর নিজের উপর। সেইদিন কেনো ও ধেইধেই করে সাহায্য নিতে গেল? ওইদিন দেখা না হলে তো লোকটা এভাবে আজ বাসায়ও আসতো না। উফফ!

তন্মধ্যেই দরজায় টোকা পড়ল। চারু গ্রীবা বাম দিকে ঘুরিয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠল। অসভ্য, বদমাশ লোক পিছু পিছু রুম পর্যন্ত চলে আসছে। চারুর কুঁচকানো ভ্রু জোড়া দ্বিগুণ কুঁচকে গেল। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরে উঠে দাঁড়াল সে। 

বুকের উপর দু-হাত ভাজ করা, দরজার সাথে ড্যাশ দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আফনান। ঠোঁটে তার দূর্লভ হাসির রেখা। চারুর চোয়াল শক্ত হল। কাঠকাঠ গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘আমার রুমে আসার সাহস কে দিয়েছে আপনাকে?’

আফনান লহু কণ্ঠে বলল, ‘রুমে গেলাম কই? আমি এখনো দরজায় দাঁড়িয়ে আছি। তাছাড়া দুদিন পর এই রুমটা আমারই হবে। তাই দেখতে আসলাম।’
 
চারু শক্ত হল। আফনান ধুপধাপ পা ফেলে রুমে এল। অবিজ্ঞ চোখে ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে রুমটা পর্যবেক্ষণ করে নিল। আফনান খাটের ওপর বসল। শ্লেষের স্বরে বলল, ‘যদিও রুমটা ছোটো তবুও তোমার জন্য কষ্ট করে হলেও আমি মানিয়ে নিবো।’

চারু রাগান্বিত গলায় বলল, ‘পাগল হইছেন? আমার রুম আপনার হবে কেন?’

আফনান ঠোঁট টিপে হাসল। দুষ্টুমি করে বলল, ‘পাগল হয়েছি তোমার প্রেমে।’

আফনানের কথাশুনে চারুর শরীর জ্বলছে রাগে। দাঁত কিড়মিড় করছে সে। এই মূহুর্তে তার ইচ্ছা করতেছে লোকটাকে ধাক্কা দিয়ে রুম থেকে বের করে দিতে। উঁহু, শুধু রুম না। বাড়ি থেকে বের করতে। 

আফনান হয়তো বুঝল তার মনের কথাটা। বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। দুই কদম পা এগিয়ে এল চারুর দিকে। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে খানিকটা ঝুকে পড়ল চারুর দিকে। আফনার চারুর চোখের দিকে তাকিয়ে। চোখে চোখ রাখে, অদ্ভুত স্বরে বলল, ‘ওইদিনের কথা মনে আছে? তুমি বলেছিলে, এই জেলার মন্ত্রী টাকা খোর, অর্কমা, টাকা হাতানোর জন্যই সে মন্ত্রী হয়েছে। আরও অনেক অনেক অপবাদ দিয়েছো। মন্ত্রী, জেলার উন্নয়ন না করে নিজের পকেট গরম করছে। রাস্তাঘাট ভাঙাচোরা, কোনো উন্নতি করছে না। এখন দেখো তোমাকে বিয়ে করতে মন্ত্রীর ছেলে স্বয়ং এসেছে। বিয়ের পর দুজনে একসাথে উন্নতি দেখব।’

আফনান কথাগুলো শেষ করে বড়বড় পা ফেলে রুম থেকে চলে গেল। চারু স্তব্ধ। নির্বিক, বাকরুদ্ধ! চোখ দুটো বড়বড় হয়ে গেছে তার। মন্ত্রীর ছেলে? শুকনো ঢোক গিলল চারু। হৃদপিণ্ডটা বিশ্রীভাবে লাফাচ্ছে। চারু তখনও দাঁড়িয়ে আছে। সহসা মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল তার। চারু বিছানায় বসল। চোখ দুটো বন্ধ করে দুইহাতে মাথাটা চেপে ধরল। একেই বলে খাল কেটেছি কুমির আসছে না। তাই নিজেই নাচতে নাচতে গিয়ে কুমির থাকা জলে ঝাপিয়ে পড়েছি। কুড়ালে পা কাটছিল না বলে নিজেই কুড়ালের নিচে পা রেখে বলেছি, নে ভাই কুড়াল সারাজীবন তো শুধু গাছ কাটিস এবার না-হয় আমার পা-টা একটু কাট। চারু শ্বাস ফেলল। মস্তিষ্ক তাকে এই মূহুর্তে অদৃশ্য এক বিপদ সংকেত দিচ্ছে, বিপদ হবে। তাই সাবধান করতেছে।

চারু চোখদুটো ছোটছোট করে চাইল। বুকের মধ্যে তখনও ধকধক করছে। আড়ষ্ট হয় চারু। বিরবির করে বলল, ‘আবার কোন বিপদ নাচতাছে মাথার ওপর?’
·
·
·
চলবে......................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp