অভিমানিনী - পর্ব ০৩ - মৌরি মরিয়ম - ধারাবাহিক গল্প


          আজ খুব বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টি আমার কোনো কালেই পছন্দ ছিল না। এর প্রধান কাজ হচ্ছে রাস্তাঘাট ভিজিয়ে কাদায় মাখামাখি করে দেয়া। সঙ্গে আবেগী মানুষজনের মন ভেজাতেও এদের জুড়ি নেই। এইসব আবেগী মানুষদের মধ্যে অন্যতম ছিল মানসী। বৃষ্টি নামলেই পাগল হয়ে যেত ভেজার জন্য, শুধু যে নিজে ভিজবে তাই নয়, সঙ্গে ওর আশেপাশের সবাইকে ভেজাবে। তার অন্যতম শিকার ছিলাম আমি। আর আমার কখনোই ভিজতে ইচ্ছে করত না, কিন্তু শুধু ওকে খুশি করার জন্যই।ভজতে হতো। দিনের বেলায় বাইরে থাকার কারণে অনেক সময় বেঁচে যেতাম। কিন্তু রাতে বৃষ্টি হলে আর রেহাই নেই, ভিজতেই হতো। তখন অবশ্য আপত্তি করতাম না, কারন তখন শুধু আমি আর ও। ওকে কাছে পাওয়ার একটা লোভ তো সবসময়ই কাজ করত।

এমনই একটা বৃষ্টির দিনে মানসী, সৌরভ, অনন্যা, মোনালিসা আর আমি ঝুম বৃষ্টিতে ভিজছিলাম। মোনালিসা আমার একমাত্র ছোট বোন, আমার আর সৌরভের কলিজার টুকরা। অনেক ছোটো, তবু আমাদের সবকিছুতেই ওকে রাখতে হতো। না হলেই গাল ফুলাতো।

তখন অনন্যা প্রেগন্যান্ট ছিল। তাই ভিজতে ভিজতে বেশ অনেকক্ষণ পর হঠাৎ মানসী অনন্যাকে বলল,

“অনু, তুই আর ভিজিস না। ঠাণ্ডা লেগে যাবে। এ সময় অনেক সাবধানে থাকতে হয়।”

আমি সুযোগ পেয়ে মানসীকে ক্ষ্যাপানোর জন্য বললাম,

“অনন্যা, ওর কথা শুনছিস না কেন? দশটা বাচ্চার মা হয়েছে, ওর কত অভিজ্ঞতা!”

সবাই হাসতে লাগল, আর মানসী তেড়ে আসলো আমাকে মারার জন্য। আমি কিন্তু দাঁড়িয়ে থেকে ওর মার খাচ্ছিলাম। কারণ যতক্ষণ ও আমাকে মারবে ততক্ষণ আমি ওর স্পর্শ পাব। আমি ওর একটু ছোঁয়া পেলেই মরিয়া হয়ে উঠতাম আরেকটু পাওয়ার জন্য। যেন একটু স্ফুলিঙ্গ থেকে আমার সারা শরীরে দাউদাউ করে জ্বলে উঠত আগুন। আর আজ সেই জ্বলন্ত নীরব কত ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। এখন যদি একবার মানসী এসে আমাকে দেখে যেত কত অবাকই না হতো! ওর কি আমাকে একটু দেখতেও ইচ্ছে করে না?

নীরব ইশতিয়াক
১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬

পৃষ্ঠা উল্টাতে গেল অদ্রি। অৰ্পি বলল,

“আচ্ছা আপ্পি, মেয়েটা কে ছিল সেটা তো কোথাও লেখা নেই কিন্তু আমার অস্থির লাগছে জানার জন্য।”

“আমারও লাগছে, কিন্তু লেখা যখন নেই তখন তো আর কিচ্ছু করার নেই, তাই না?”

“না, আমাকে জানতেই হবে।”

“আচ্ছা, পড়ে দেখি সামনে তো থাকতেও পারে। তবে হ্যাঁ সে যেই হোক আম্মুর সাথে একটা ভালো সম্পর্ক ছিল।”

“তুই কী করে বুঝলি? বৃষ্টিতে ভিজতে না করছিল বলে?”

“নাহ, আম্মুকে অনু বলে ডাকছিল। আম্মুকে কিন্তু কেউ অনু বলে ডাকে না, সবাই অনন্যা বলেই ডাকে। তাই যেহেতু অনু বলছে আদর করেই বলছে এবং এরকম একটা সম্পর্কই ছিল আম্মুর সাথে, আর বয়স হিসেব করে দেখ একই বয়সী হবে। কারণ প্রেগন্যান্ট মানে আমি পেটে ছিলাম, তখন তো আম্মুর বয়স অনেক কম ছিল। আর আমাকে কোলে নিয়ে ওনার যে ছবিটা ওটাতে ওনার বয়স ওরকমই ছিল।”

“হুম, তুই ঠিক বলেছিস।”

“কালো হলেও দেখতে খুব মিষ্টি, তাই না?”

“হুম, তবে দিতিয়া চাচির মতো সুন্দর না।”

“দুজন দুরকম সুন্দর।”

“না চাচি বেশি সুন্দর। তবে নামটা সুন্দর… মানসী।”

“হুম।”

“তবে আপ্পি, চাচ্চুর ওপর খুব রাগ হচ্ছে আমার।”

“কেন?”

“এতই যদি ভালোবাসে ওই মেয়েটাকে তাহলে দিতিয়া চাচিকে বিয়ে করেছে কেন? চাচিকে ঠকানো হলো না?”

“এমন তো হতে পারে চাচি সব জানে।”

“না হতে পারে না।”

“এত জোর দিয়ে বলছিস কিভাবে?”

“জানি না, আমার মনে হচ্ছে।”

“দেখ, প্রথম কথা হচ্ছে, মেয়েটা চাচ্চুকে ছেড়ে চলে গেছে। যেহেতু ব্রেকাপ হয়ে গেছে সেহেতু তার কথা ভেবে সারা জীবন একা কাটানো যায় না, বিয়ে করতেই হয়। আর দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, চাচি আমাদের অনেক আদর করে তাই কাহিনী চাচির বিপক্ষে যাচ্ছে বলে আমাদের গায়ে লাগছে। কিন্তু এসব পড়তে গিয়ে পারসোনাল সম্পর্ক নিয়ে ভাবতে নেই। লেখক যেভাবে লেখে সেভাবেই ভাবতে হয়।”

“হইসে জ্ঞান দিস না। পরের পৃষ্ঠায় যা।”

অদ্রি পৃষ্ঠা উল্টালো…

মানসী তখন কলেজে পড়ত আর আমি মেডিকেল ফাইনাল ইয়ারে পড়ছিলাম। বয়সের ডিফারেন্সটা নেহাৎ কম না, তবে ভালোবাসার কমতি ছিল না কোনো। তখনই সৌরভ-অনন্যার বিয়ে হয়েছিল। হঠাৎ করেই হলো ব্যাপারটা। অনন্যাকে ওর বাবা-মা বিয়ে দিয়ে দিচ্ছিলো, ১৮ বছর তখনো হয়নি। অবশ্য সে আমলে বয়স টয়স মেনে কেউ বিয়ে দিত না। অনন্যা মানসীর স্কুলফ্রেন্ড ছিল। তখন থেকেই মানসীর সাথে অনন্যা আমাদের বাসায় আসত। এই আসা-যাওয়ার মধ্যেই কেমন করে সৌরভের সাথে ওর প্রেমটা হয়ে গিয়েছিল। অনন্যার বিয়ে ঠিক হয়ে যাওয়ায় আমরা সবাই বাবা মাকে জানালাম। বাবা-মাকে রাজি করানোর জন্য সৌরভের অনশন আর মানসীর কান্নাকাটিই যথেষ্ট ছিল। তারপর তারাই সৌরভ- অনন্যার বিয়ের ব্যবস্থা করল।

মায়ের অনেক আগে থেকেই ইচ্ছে ছিল আমাদের দুই ভাইয়ের বিয়ে একসাথে দেবে। আর মানসীর সাথে আমার সম্পর্কের কথা মানসীর ফ্যামিলির কেউ না জানলেও আমার ফ্যামিলির সবাই জানত, তাই আমাদের বিয়ের কথাও উঠেছিল। কিন্তু আমি বললাম,

“অন্তত আমার পড়াশোনা শেষ হওয়ার আগে আমি বিয়ে করব না। এত তাড়া কিসের? মানসীর তো আর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে না।”

মায়ের পাগলামির কাছে বাবা সবসময় হার মানতো কিন্তু বাবাও এরকমটা চাচ্ছিল না তাই সে আমাকে সাপোর্ট দিল।

সেবার সৌরভ-অনন্যার বিয়েটা ঠিকই হয়েছিল। কিন্তু আমাদেরটা হলো না। মানসীর খুব ইচ্ছে ছিল। মানসী খুব বায়না করছিল, “চলো বিয়ে করে ফেলি। এমন করছ কেন?” আমার ঝাড়ি খেয়ে থেমেছিল। মেয়েরা যে কেন এত তাড়াতাড়ি বিয়ে করতে চায় তা আমার মাথায় ঢুকছিল না তখন। রেগে গিয়েছিলাম মানসীর ওপর। পরে অবশ্য বুঝেছিলাম প্রত্যেকটা মেয়ের জীবনেই এমন একটা সময় আসে যখন খুব বউ হতে ইচ্ছে করে, ঘর-সংসার করতে ইচ্ছে করে। সময়টা হয়তো একেক মেয়ের জীবনে একেক বয়সে আসে। মানসীর বোধ হয় সেই সময়টা এসে গিয়েছিল।

সৌরভ-অনন্যার বিয়ের দিন রাতে একটা ঘটনা ঘটলো। অনন্যাকে বউ সাজে দেখে মানসীর মন খারাপ লাগছিল। তাই হয়তো কোনো না কোনো ভাবে একই কথা বারবার বলছিল,

“ইশ, তুমি চাইলে আজ আমাদের বিয়েটাও হতে যেত।”

খুব রগচটা ছিলাম। বলে বসলাম,

“এত বিয়ে বিয়ে করছিস কেন? শরীরে জ্বালা ধরে গেছে? বললেই তো পারিস, বিয়ে করা লাগে?”

কথাটা শুনে মানসী হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইল আমার দিকে। হঠাৎ মনে হলো কথাটা খুব বিশ্রী হয়ে গেল। এরকম কথা তো বন্ধুদের সাথে হরহামেশাই বলা হয়। কিন্তু মানসী তো আমার মুখে এসব শুনে অভ্যস্ত নয়। ও কি রাগ করল না লজ্জা পেল তা বোঝার আগেই এক দৌড়ে নিজের ঘরে চলে গেল। উসখুস করতে লাগলাম। ওকে কি সরি বলা উচিত? আমি কাউকে এত সরি টরি বলি না কিন্তু মানসীর কথা ভিন্ন। ওর পা ধরে মাফ চাইতেও আমার কোনো সংকোচ নেই। তাই মাফ চাইতে গেলাম। ওর ঘরে ঢুকে আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। এভাবে কাঁদছে কেন মেয়েটা! বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে বালিশে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠে গেছে। কান্নাটা আটকে রাখতে চাচ্ছে ও, সেজন্যই এই অবস্থা। বুকের ভেতরটা কেমন করে উঠল। আমি কাছে গিয়ে ওর পাশে বসে মাথায় হাত রাখলাম। বললাম,

“এই পাগলি কাঁদছিস কেন?”

ও কোনো কথা বলল না। আমি আবার বললাম,

“তাকা আমার দিকে।”

ও তাকালো না। যেভাবে ছিল সেভাবেই রইল। তবে কান্না থামানোর ব্যর্থ চেষ্টাটা ঠিকই করল। আমার খুব মায়া হলো। আমি ওকে দুহাতে ধরে কোলে তুলে নিলাম। বাচ্চা মেয়েটার অভিমান ভাঙাতে হবে তো। ও অবশ্য কাঁকড়ার মতো বালিশটাকে ধরে দূরে থাকতে চাইল, কিন্তু তাতে বিশেষ লাভ হলো না। আমি বললাম,

“সরি, আমি কথাটা মজা করে বলেছি, রাগ করে না। এত কাঁদিস না, তুই কথাটা এত সিরিয়াসলি নিবি বুঝিনি। তুই কাঁদলে আমার ভালো লাগে বল? তাছাড়া তোকে কাঁদিয়েছি টের পেলে মা আমাকে আস্ত রাখবে না।”

কে শোনে কার কথা। ও কেঁদেই যাচ্ছে। আমি ওর চোখের পানি মুছে দিয়ে বললাম,

“আমার দুষ্টু দুষ্টু বাচ্চাদের লক্ষ্মী আম্মু, কাঁদিস না।”

ও আমাকে জড়িয়ে ধরল, শক্ত করে। ওর গায়ে এত জোর আগে বুঝিনি। কান্নার বেগ আরো বাড়ল। এটাকে বলে আহ্লাদের কান্না, তাই আর থামানোর চেষ্টা করলাম না। তাছাড়া যতক্ষণ কাঁদবে ততক্ষণ আমার বুকে থাকবে। এই লোভটা সামলানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

কিছুক্ষণ পর ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম,

“একই কথা বারবার শুনলে আমার মাথা গরম হয়ে যায়। তোর এখনো বিয়ের বয়স হয়েছে, বল? এখনই বিয়ে করার কী দরকার! এই যে কত সুন্দর প্রেম করছি, লুকোচুরি করছি। এরও তো একটা মজা আছে। আগেভাগে বিয়ে করে বুড়ি হওয়ার কোনো মানে আছে?”

ও কোনো কথা বলল না। আমি চোখটা বন্ধ করে ওকে আরেকটু ভালো করে জড়িয়ে ধরলাম। কতক্ষণ ওভাবে ছিলাম বলতে পারব না। শুধু মনে আছে পরদিন আমি গোসল পর্যন্ত করিনি। মানসীর শরীরের ঘ্রাণ, স্পর্শ আমার শরীরে লেগে আছে। তা কি ধুয়ে ফেলা যায়?

নীরব ইশতিয়াক
১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬
·
·
·
চলবে.........................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp