অপরাহ্নের নিষিদ্ধ অনুভূতি - পর্ব ১২ - ইসরাত তন্বী - ধারাবাহিক গল্প


          আরও একটা দিনের সমাপ্তি ঘটেছে ঘণ্টা তিনেক আগে। ঘড়ির কাঁটা ঘুরে ঘুরে দশটার ঘরে ঘাঁটি বেঁধেছে। মাত্রই হসপিটাল থেকে ফিরেছে তন্ময়ী। বাইকটা যথাযথ স্থানে রেখে ঘরের উদ্দেশ্যে হাঁটা ধরেছে। ড্রয়িং রুমে সোফায় বসে আরাধ্যা শেখ, তন্ময়কে পড়াচ্ছেন। মেয়েকে ঘরে প্রবেশ করতে দেখেই শুধালেন, "এখন কেমন লাগছে মা? ডক্টর আঙ্কেল কী বলল?"

তন্ময়ী আলগোছে দরজা লাগিয়ে সামনে ঘুরল। হাসল অল্প করে, "আলহামদুলিল্লাহ, মা। ভালো লাগছে। বাবা ঘুরিয়েছে আমায়। আঙ্কেল বলেছে তেমন কোনো সমস্যা নেই।"

মেয়ের কথায় মা নামক নারীর মনটা একটু শান্ত হলো। এতক্ষণে মনে একটু স্বস্তি মিলল। প্রাণোচ্ছল হেসে বললেন, "তুমি ফ্রেশ হয়ে নেও। আজকে তোমার ফেভারিট পোলাও, গরুর মাংস, ইলিশ মাছ ভাজা রান্না করেছি আমি।"

তন্ময়ী হেসে ফেলল। বাঙালি খাবার ওর ভীষণ পছন্দের। অধর নাড়িয়ে কিছু বলতে নিলেই ছোট্ট তন্ময় মুখ ফুলিয়ে বলল, "বাবা তোমায় ঘুরিয়েছে আপু?"

পুঁচকুর অভিমান বুঝল ও। মুচকি হেসে এগিয়ে এসে কোনো কথা ছাড়াই ফুলো গাল দুটোতে টপাটপ কয়েকটা চুমু বসিয়ে দিলো, "কালকের দিনটা শুধু তোর আর আমার। তোর পড়াশোনা, স্কুল সব বন্ধ। আমরা দুই ভাই-বোন সারাদিন ঘুরব, এনজয় করব। ওকে?"

ব্যস ছোট্ট তন্ময়ের মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বাচ্চাটার খুশি দেখে কে? লাফিয়ে উঠে তন্ময়ীর গলা জড়িয়ে দাঁড়াল। সারা মুখ জুড়ে ছোট ছোট চুমু খেল। ছোট্ট ডান হাতটা মাথায় রাখল। আদরের সহিত চুলে হাত বুলিয়ে দিলো, "ডান আপু।"

তন্ময়ীর চোখজোড়া ছলছল করে উঠল। কিছুক্ষণ ভাইয়ের নিষ্পাপ মুখটার দিকে তাকিয়ে রইল। নিজের সন্তানদের একে অপরের প্রতি ভালোবাসা দেখে আরাধ্যা শেখ ও হাসলেন। চোখের কোণে খুশির জল জমল। তন্ময়ী আর দাঁড়াল না। ইমোশনাল হয়ে পড়ছে মেয়েটা। তময়কে ছেড়ে ঘরের দিকে হাঁটা ধরল। পদযুগল চলমান রেখেই বলল, "মা, আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।"

পিছন থেকে শোনা গেল মায়ের কণ্ঠস্বর, "আচ্ছা।"

তন্ময়ী রুমে এসেই আলমিরার দিকে এগোল। কম্ফোর্টেবল দু'টো কাপড় হাতে নিয়ে ওয়াশ রুমে চলে গেল। কাপড়টা যথাস্থানে রেখে বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে মুখে পানি দিলো। বার কয়েক মুখে পানির ঝাপটা দিতেই অদ্ভুতভাবে ওয়াশ রুমের লাইট টা নিভে গেল। তন্ময়ীর হাতে থাকা পানি গুলো স্থির হয়ে রইল। ভাবল হয়তো লাইট টা নষ্ট হয়ে গেছে। হাতের পানিটুকু ফেলে দিয়ে সামনে পা বাড়াতে নিলেই লাইট টা পুনরায় জ্বলে উঠল। তন্ময়ীর কপালে ভাঁজ পড়ল। দন্ত দিয়ে অধর চেপে কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়িয়েই রইল। ঘটনা কী ঘটল বোঝার চেষ্টা করল। পরক্ষণেই ভাবল হয়তো ইলেকট্রিক কোনো প্রবলেম। এই নিয়ে এতো ভেবে কাজ নেই। আবারও বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে ফেইস ওয়াশটা হাতে তুলে নিতেই লাইট টা জ্বলতে নিভতে শুরু করল। ও একটু ভড়কাল। লাইট টার দিকে দৃষ্টিপাত করল। চারপাশে ঘন কালো ছায়া ছড়িয়েছে। লাইটের আলো ক্রমশ লাল হতে শুরু করেছে। তন্ময়ী হঠাৎ ওয়াশ রুমে আরও একজনের উপস্থিতি অনুভব করল। ঘাড় বাঁকিয়ে বেসিনের সামনের আয়নাতে দৃষ্টিপাত করল তৎক্ষণাৎ। অমনিই শরীরের প্রতিটা অঙ্গ প্রত্যঙ্গ হিম শীতল হয়ে এলো। নড়তে পারল না আর। ভয়ে অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল।

আয়নাতে দৃশ্যমান একজন ভয়ংকর মুখের মানুষ। যার চোখ দুটোর মণি গলে বাইরে বেরিয়ে এসেছে। মুখটা বেশকিছু জায়গায় কাঁ টা ছেঁ ড়া করা। যা দিয়ে গলগলিয়ে রক্ত ঝরছে। সামনের দু'টো বড়ো দাঁত অধর গলিয়ে নিচে নেমে এসেছে অনেকখানি। অবিশ্বাস্যকর বিষয় হচ্ছে আয়নার ভেতরে থাকা মানুষটা তন্ময়ীর মতোই দেখতে। কিন্তু এটা কীভাবে সম্ভব? ওর প্রতিবিম্ব এমন অদ্ভুত রকমের কেন হবে? পদতলে চ্যাট চ্যাটে তরল অনুভব করতেই ফ্লোরের দিকে তাকাল তন্ময়ী। রক্তের স্রোত বয়ে চলেছে। উৎস অজানা। ক্রমশ বাড়ছে র ক্তে র গতি‌। শ্রবণেন্দ্রিয়ে ভেসে এলো উদ্ভট, কান জ্বালা করা হাসির আওয়াজ। তন্ময়ী নিজের কর্ণ জোড়া দুই হাতের সাহায্যে চেপে ধরল। তবুও সেই শব্দের হাত থেকে নিস্তার পেল না। এই পর্যায়ে সবটা সহ্যাতীত হতেই ও বিকট এক চিৎকার দিয়ে হাতে থাকা ফেইস ওয়াশ টা আয়নার দিকে ছুঁড়ে মারল। মুহুর্তেই সেটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে ওয়াশ রুমের মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ল। এতো শক্তি তন্ময়ী কোথায় পেল? সামান্য ফেইস ওয়াশ দিয়েই আয়না ভেঙে ফেলল? শেষ বারের মতো মেয়েটা শুনতে পেল একটা কম্পিত হিংস্র কণ্ঠস্বর, 

"তোকে আমি নিতে এসেছি। চলে আয়। এরা কেউ তোর আপন নয়।"

পরপরই আরাধ্যা শেখের গলার আওয়াজ ভেসে এলো, "তনু? এই তনু? কী হয়েছে? ঠিক আছ তুমি? দরজা খোলো। তনু মা? আমার তনু শুনছ তুমি?"

সাথে সাথে লাইট টা ঠিক হয়ে গেল। চোখের পলকে ভয়ংকর পরিবেশ পরিবর্তন হয়ে আগের ন্যায় স্বাভাবিক হয়ে উঠল। তন্ময়ী শ্বাস আটকে কোনোরকমে দরজাটা খুলে দিল। মেয়েকে এমন বিভৎস অবস্থায় দেখতেই আরাধ্যা শেখ আঁতকে উঠলেন। সামনে এগোতে নিলেই তীব্র আওয়াজ তুলে ফ্লোরে লুটিয়ে পড়ল তন্ময়ীর শীর্ণ দেহ খানা। জ্ঞান হারাল বোধহয়! উনি আর্তনাদ করে ছুটে এসে মেয়ের কাছে বসে মাথাটা তুলতেই ভেজা তরল অনুভব করলেন। হাতের আঙ্গুলের দিকে তাকাতেই র ক্ত চক্ষুগোচর হলো। ডুকরে উঠে মেয়ের মাথাটা বুকের মাঝে জড়িয়ে নিলেন। ততক্ষণে কাঁদতে কাঁদতেই তন্ময় ছুটেছে বাবার কাছে কল দিতে। কিছু সময়ের ব্যবধানেই সুন্দর একটা পরিবেশ বিষাদে ছেয়ে গেল। যেন যুগ যুগ ধরে কারোর অভিশাপে জর্জরিত সকলে। এমন মর্মান্তিক ঘটনার সাক্ষী হতেই একজোড়া মণি জ্বলজ্বল করে উঠল। হাতে থাকা ল্যাপটপ টা ছুঁড়ে ফেলল দেওয়ালে। পরক্ষণেই হাওয়ায় মিশে গেল তার অস্তিত্ব। হিংস্র গর্জনে কাঁপ ধরল প্রকৃতির বুকে। সেই গর্জনে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ পাচ্ছে। হয়তো এটাই আসন্ন কোনো বিপদের সংকেত!

—————

রাত বারোটা বেজে পাঁচ মিনিট। তন্ময়ী হসপিটালের কেবিনে আধশোয়া হয়ে বসে আছে। পাশেই পরিবারের সবাই উপস্থিত। মাথায় দুটো সেলাই গেছে। সেই জায়গাটুকুর চুল কেটে ফেলা হয়েছে। মেয়েটা এই নিয়ে মন ভার করে আছে। কারণ নিজের শরীরের একমাত্র চুলগুলো ওর ভীষণ প্রিয়। শেখ সাদমান অনেকবার এই নিয়ে বুঝিয়েছেন মেয়েকে। প্রতিবার'ই ফলাফল শূন্য এসেছে। ঘটনা সবটাই উনি শুনেছেন। তখন থেকেই ওনাকে একটু ভাবুক দেখাচ্ছে। মুখটাও রক্তশূন্য হয়ে এসেছে। তন্ময়ী বাবার এই পরিবর্তন তীক্ষ্ম চোখে পরখ করে চলেছে। সময় হলে বাবাকে এই নিয়ে জবাবদিহি করতে হবে। আরাধ্যা শেখ থেকে থেকে ফুঁপিয়ে উঠছেন। মেয়েটার উপর কার কুনজর পড়েছে কে জানে? হুটহাট কী সব ঘটে চলেছে? যদিও ঘটনার অর্ধেকটা ওনার অজানা।

"বাবা?"

তন্ময়ীর ডাকে শেখ সাদমান ধ্যান চ্যুত হলেন। সামনে ঘুরে তাকালেন, "বলুন আম্মা।"

"শরীর ঠিক আছে?"

"জি।"

"কতটা?"

"আপনার থেকে ভালো আছি আম্মা।"

"আজকের রাতের একটা ঘণ্টা আমার জন্য বরাদ্দ করো। তোমার সাথে আমার কথা আছে বাবা।"

শেখ সাদমান একটু সময় নিয়ে মাথা নাড়লেন। তন্ময়ী প্রাণহীন দৃষ্টিতে জানালার দিকে তাকাতেই ওর মনে হলো কেউ একজন ওখান থেকে সরে গেল। কিন্তু পাঁচ তলাতে জানালার পাশে কে দাঁড়িয়ে থাকবে এতো রাতে? নাকি সবটাই মনের ভ্রম? ঘাড়টা বালিশের উপর রেখে ক্লান্ত আঁখি যুগল বন্ধ করে নিলো। হয়তো নিজের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর মাঝে কোনো একটা সংযোগ খুঁজে পেল। বিড়বিড় করল,

"সবটা ভালো হোক। আমার ক্ষয় যদি আপনজনদের মঙ্গল বয়ে আনে তবে সবটা মান্য।"

—————

আইফেল টাওয়ারের সামনেই ব্রিজের উপর বাইক রেখে দাঁড়িয়ে আছে রৌহিশ, তিয়াশ, রায়ান। তিন জনের'ই মুখমণ্ডল গম্ভীর। রৌহিশের হাতে জলন্ত সিগারেট। যা ক্ষণে ক্ষণে অধরপল্লবের ভাঁজে ঠাঁই মিলছে। চোখ, মুখে হিংস্রতার রেশ ছড়িয়ে আছে। তিয়াশ শুকনো ঢোক গিলল। পরপরই বলল,

"তোকে আজকে সুবিধার লাগছে না রৌহিশ। কী করতে চাইছিস তুই?"

হাতে থাকা সিগারেটটা পুনরায় ঠোঁটের ভাঁজে পিষ্ট হলো। নাক মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসলো কালো ধোঁয়া। যা ঝিরিঝিরি বাতাসের সংস্পর্শে এসেই অদৃশ্য হয়ে গেল। শোনা গেল বজ্রগম্ভীর কণ্ঠের অপ্রত্যাশিত একটা জবাব,

"বিয়ে করব। ওকে বউ বানাব আমার। ড্রুসিলা প্যালেসের রানী বানাব। ভ্লাডিমির ইম্পায়ারে রাজত্ব করার সুযোগ দেবো। নতুন একটা জীবন দেবো ওকে। যেটা ওর প্রাপ্য। আমার ভেতরে জমে থাকা ভালোবাসা দেখাব ওকে। হয়তো ওর ইচ্ছাতে নয়তো ওর বাবার ইচ্ছাতে। আর, আর! নাহলে বুদ্ধির খেলায় হারিয়ে। তবুও ওকে আমার হতেই হবে। সময় একশ আটষট্টি ঘণ্টা। স্টার্ট কাউন্ট ডাউন।"

রৌহিশের মুখনিঃসৃত কঠিন বাক্য গুলো যেন বজ্রাঘাত হানল প্রকৃতিতে। তব্দা খেয়ে গেল অপর দু'জন। আসন্ন বিপদ উপলব্ধি করতেই গলনালী শুকিয়ে কাঠ হয়ে এলো। মুখ দিয়ে একটা শব্দও উচ্চারণ করতে পারল না। কেবল ফ্যালফ্যাল করে চেয়েই রইল। রৌহিশ এইসবে উদাসীন। ওর নির্লিপ্ত দৃষ্টি সুবিশাল অম্বরে তারাদের মেলায় নিবদ্ধ। হয়তো কিছু ভাবতে ব্যস্ত। 
·
·
·
চলবে..........................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp