“কি হয়েছে হুসনাত খাতুন? শেহজাদা ইরহান আলী শাহর দাস হতে কি আপত্তি আছে কোনো?”
হুসনাত অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো শেহজাদা ইরহানের মুখশ্রীর দিকে। শেহজাদারা তো সুন্দর হয়। সুলতান মালেক শাহর মতো শুভ্র বর্ণের হবে, তাদের পরণে হবে দামী পোশাক। চকচক করবে তাদের শরীরের আভূষণ। তবে এ কেমন শেহজাদা? কৃষ্ণবর্ণের, যার ধূসর চোখে কোনো মমতা নেই, এক নাক বরাবর ভয়ানক কাঁটাদাগ। যা প্রমাণ তার উপর হিংস্র আক্রমণের। পরণে মলিন কৃষ্ণ পোশাক। হাতে রক্তাক্ত নগ্ন তরবারি। এ কেমন শেহজাদা? উপরন্তু সুলতানের আদেশ জানার পরও সে তা ভঙ্গ করেছে। হুসনাতের সৎবিৎ ফিরলো যখন ভারী স্বর আবার তাকে ডাকলো,
“হুসনাত খাতুন?”
“না, হুজুর। আপনি আমার জীবনরক্ষক। আমার মালিক। আমার মত তুচ্ছ দাসীর এতো স্পর্ধা নেই যে আপত্তি করবে। ক্ষমা করবেন হুজুর। আমি একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম”
ইরহান কিছু বললো না। তার চোখের দৃষ্টি স্থির। যেন পরখ করছে কিছু। পরমুহূর্তেই উসমাকে বললো,
“একে হারেমে নিয়ে যাও”
!!৭!!
বিশাল হারেমে আবার ফিরে এলো হুসনাত। তবে এখন সে সুলতানের উপহার নয়। সে হুসনাত খাতুন, ইরহান আলী শাহর দাসী। উসমা তাকে যে খুব পছন্দ করছে না, তা তার মুখশ্রীতে স্পষ্ট। সে বিষয়টা লুকাবার চেষ্টাও করে নি। বরং মুখ খিঁচিয়ে বলল,
“তুই কি করে শেহজাদাকে বশ করলি? সত্যি ডাইনি দেখছি তুই! ভালোই চালাক তুই। খুব ভালো করে জানতি এই প্রাসাদে তোকে একমাত্র এই বাঁচাতে পারে”
হুসনাত কিছু বললো না। চুপ করে রইলো। উসমা আরোও বিড়বিড় করলো,
“এই শয়তান শেহজাদার পাল্লায় পড়েছিস, ভাবিস না তোর ভালো দিন শুরু হয়েছে। বরং আল্লাহ আল্লাহ কর যেন বাঁচতে পারিস। শেহজাদা যে কি জিনিস তা আমরা সবাই জানি। চার চারটে স্ত্রী তার মারা গেছে। বুঝি না কিছুই? তুই যদি ভেবে থাকিস শেহজাদার বিছানায় যেয়ে তাকে বশ করবি, রুপ দিয়ে ভোলাবি তাহলে ভুল ভাবছিস। সাংঘাতিক ভয়ংকর এই লোক”
হুসনাত ভয়ংকর ব্যক্তির সাংঘাতিক কারনামা একটু আগেই দেখেছে। কিভাবে পশুর মত সে মানুষ হ-ত্যা করে হুসনাত জানে। তাই ভয় পাওয়ার কারণ দেখছে না। একটি গণকক্ষের দরজা খুলে দিল উসমা। বললো,
“যাও ঘুমিয়ে পড় হুসনাত খাতুন। আর খবরদার সুলতানের সামনে এসো না। তোমার জন্য যদি আমার গর্দান যায় আমি তোমাকেও সাথে নিয়ে মরব”
—————
ঘরে সারিবেধে মেয়েরা ঘুমিয়ে আছে। এরা সবাই দাসী। অথচ এক প্রহর আগেই সে ছিলো সুলতানের খাস উপহার। হুসনাত ঘুমালো না। সে গণস্নানাগারে গেলো। সেখানে একটি বিশাল জায়গায় পানি থৈথৈ করছে। পানির পাশের উচু জায়গায় বসলো হুসনাত। জামার বোতাম খুললো। কুৎসিত চাবুকের দাগগুলো পানির প্রতিবিম্বে দেখা যাচ্ছে।
ভাগ্যিস উসমা তাকে সুলতানের ঘরে দেবার আগে তার কাছে কিছুটা সময় ছিলো। শৌচকর্মের বাহানায় সে তাদের থেকে আলাদা হতে পেরেছিলো। শৌচাগারে এসে দড়ি দিয়ে নিজের পিঠে নিজেই প্রহার করে হুসনাত। একটা সময় তা চাবুকের প্রহারের মতো দেখাতে শুরু করে। যে দাগ বণিকের দাসেরা মিশরীয় ঔষধ ব্যবহার করে মুছে দিয়েছিলো, সেই দাগ আবার বানায় হুসনাত। বণিকের কাছ থেকে শোনা, সুলতান মালেক শাহ স্বচ্ছ জিনিস পছন্দ করেন। সুতরাং তার গায়ে দাগ থাকলে ওই বুড়ো সুলতান তাকে ছুঁবে না। হুসনাত যখন নিজের পিঠে নিজে প্রহার করছিলো, ব্যথায় জ্বলছিলো শরীর। কিন্তু ঠোঁট কামড়ে সেই ব্যথা সে সহ্য করেছে।
কথাগুলো মনে পড়তেই চোখ ভিজে আসছে হুসনাতের। দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো সে। আজ খুব সাংঘাতিক ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো হুসনাত। তার ভাগ্য ভালো ছিল যে ওখানে ইরহান উপস্থিত হয়েছে। নয়তো ভয়ংকর কিছু ঘটতো। যে সম্ভ্রম বাঁচাতে সে এতো জটিল পরিকল্পনা করেছিলো সেই ইজ্জতের সাথে প্রাণও চলে যেত তার। হুসনাত গোসল করলো। তারপর ওযু করে নামায পড়লো। মোনাযাতে হাত উঠিয়ে বললো,
“আল্লাহ আপনার অশেষ ধন্যবাদ আমার প্রাণ এবং ইজ্জত বাঁচানোর জন্য। আমাকে আরোও হায়াত দান করুন”
—————
ইরহান ঘরে প্রবেশ করেই তার পোশাক খুলে ফেললো। পেটানো কৃষ্ণ শরীরে জড়ালো সাদা থান। হুদ উশখুশ মনে দাঁড়িয়ে আছে। কিছু জিজ্ঞেস করার জন্য মন আকুপাকু করছে যেন। ইরহান মদিরার পেয়ালা হাতে তুলে বললো,
“কি হয়েছে হুদ? এমন চিন্তিত কেন?”
হুদ খুব বিনয়ী স্বরে বলল,
“আমি আপনাকে কখনোই বুঝতে পারি না”
“এই কথাটা বলতে এতো আকাশ পাতাল ভাবতে হয় নাকি?”
“না হুজুর। আসলে………”
ইরহান হাসলো কিঞ্চিত। তারপর ভারী স্বরে শুধালো,
“প্রশ্নটা করে ফেলো হুদ। নয়তো পেট খারাপ হবে”
“আপনি কেন মেয়েটাকে বাঁচালেন? সুলতানের বিরুদ্ধে গেলেন ওই সামান্য মেয়ের জন্য”
ইরহান পেয়ালায় চুমুক দিলো। তার ঠোঁটে হাসি। তারপর আসনে গা এলিয়ে শীতল স্বরে বললো,
“হুদ, আমার মনে হয়েছে মেয়েটাকে বাঁচানো উচিত। আমার বাবা অর্বাচীন। তার কাছে নারী মানেই কেবল ভোগ্যবস্তু। কিন্তু আমার কেন মনে হয়েছে মেয়েটি গভীর জলের মাছ”
“একারণেই তাকে চর হিসেবে সুলতানা তাবিয়ার কাছে পাঠাচ্ছেন? যেমন কুমিরের মুখে মুরগী ছাড়া হয় যাতে সে ডাঙ্গায় আসে”
ইরহান এবার শব্দ করে হাসলো। সহাস্যে বললো,
“তুমি দিনদিন খুব চতুর হয়ে যাচ্ছো হুদ। অথচ ঢং করে বলো যে আমায় বুঝো না। ঠিক ধরেছো। হুসনাত আমার কুমির ধরার মুরগি। ওকে আমি বাঁচিয়েছি শুনলে তাবিয়া মরিয়া হয়ে যাবে হুসনাতের ব্যপারে। সে হুসনাতকে আমার বিরুদ্ধেও কাজে লাগাবে।”
“ও যদি ধরা পড়ে যায়?”
“কি হবে? তাবিয়া ওকে মে-রে ফেলবে”
“আর যদি বিশ্বাসঘাতকতা করে?”
“তাহলে আমি ওকে মে-রে ফেলবো। ওর মৃত্যু তো হবেই, কিন্তু প্রাসাদের পশ্চিমের আঁধারে নয়। হুদ মেয়েটি যে সে মেয়ে নয়। গভীর জলের মাছ। আমি শুধু ওর গভীরতা মাপতে চাই। যে দৃশ্য আমি ওকে দেখিয়েছি তাতে যে কারোর রুহ কেঁপে উঠার কথা। অথচ মেয়েটি ছিলো শান্ত, নিরব। সে স্থির চোখে শুধু কাঁ-টা দেহগুলোকে দেখছিলো। একজন দাস কি এতোটা শান্ত থাকতে পারে?”
ইরহান কথাগুলো বলতে বলতেই যেন গভীর চিন্তায় ডুবে গেলো। তার কপালের সমান্তরাল রেখাগুলো কুঞ্চিত হলো। হুদ বলল,
“হতে পারে ও এগুলো দেখে অভ্যস্ত?”
ইরহানের মানসপটে ভাসছিলো তার এবং হুসনাতের প্রথম মোলাকাতের দৃশ্য। মিশরের মরুভূমিতে মেয়েটিকে দেখেছিলো সে। তখন যুদ্ধ চলছিলো মিশরীয় মামলুকদের সাথে।
যুদ্ধ বিরতির এক বিকেলে একটি মেয়েটি ঢুকে পড়লো যুদ্ধ শিবিরে। তার দৃষ্টি ছিলো উদ্ভ্রান্ত। যেন পথ হারিয়ে ফেলেছে। কিছু সৈন্য তাকে ধরে ফেললো। যুদ্ধ শিবিরের প্রধান দায়িত্বে ছিলো ইরহান। ফলে তারা ইরহানের কাছে নিয়ে আসে মেয়েটিকে। তখন ইরহান শুধালো,
"তোমার নাম কি?"
ভারী পুরুষালী স্বর কানে আসতেই চোখ তুলে তাকালো তরুণী। ইরহানের তীক্ষ্ণ, সারাশির ন্যায় দৃষ্টির মুখোমুখি হল সে। ইরহান তখন তাকে নিপুণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করছিলো। তরুণীর পরণে ময়লা জামা, নিচের অংশটি ছেঁড়া। পাজোড়া রিক্ত। তপ্ত মরুভূমিতে হেঁটে ফোস্কা পড়ে গেছে। জীর্ণ হাত আঁকড়ে রেখেছে জামার কোন। শুষ্ক ঠোঁট ঈষৎ কাঁপছে। কেন? ত্রাস? শংকা? ভীতি? অথচ চোখজোড়া শান্ত, স্বচ্ছ। বরং ক্ষীণ কিছু জ্বলছে যেন সেই চোখে? দীপ্তি? হতে পারে। খুব ক্ষীণ অথচ নজর এড়াবার মতো নয়। ইরহান আবার শুধায়,
"কি হলো! বলো নাম কি তোমার?"
সৈন্যরা সাথে সাথেই অধৈর্য্য হয়ে উঠে ইরহানের প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য। নারীর উপর চেঁচিয়ে বলে,
"হুজুর কিছু জিজ্ঞেস করছেন। উত্তর দে৷ প্রাণের মায়া নেই নাকি? তার সময়ের মূল্য অনেক"
"দাসেদের কোনো নাম থাকে না, তাদের কোনো নির্দিষ্ট পরিচয় থাকে না। তাদের মালিকরা তাদের যে নামে ডাকবে সেটাই তাদের নাম। তাদের একটাই পরিচয় তারা দাস"
খুব ধীর স্বরে কথাটা বললো তরুণী। ভয়ে কণ্ঠ ঈষৎ কাঁপলেও বলার ভঙ্গিমায় জড়তা নেই। তরুণীর এমন উত্তরে ইরহানের দৃষ্টি সামান্য বদলালো। সন্দেহ! কৌতুহল নাকি বিস্ময় তার জানা নেই। তবে একটা প্রশ্ন ঠিকই উঁকি দিলো মস্তিষ্কে,
"এই নারী কি সত্যি কোনো ক্রীতদাস?"
সেই নারী এখন তার প্রাসাদে এসেছে সুলতানের উপহার রুপে। স্মৃতিটা মস্তিষ্কে হানা দিতেই ইরহান চিন্তার ঘোরে চলে গেলো। ঘোর কাটলো হুদের কথায়,
“হুজুর কি ভাবছেন?”
“নাহ হুদ, কোথাও গোলমেলে লাগছে। তুমি আমার সাথে কত বছর ধরে আছো বলতো?”
“দশ বছর হবে হুজুর”
“তোমার র-ক্তে অভ্যস্ত হতে কতদিন লেগেছিলো? এখনো তুমি কাউকে নিষ্ঠুর মৃত্যু দিতে পারো না। যখন আমি তরবারির আঘাত করি তুমি মুখ বিকৃত করে ফেলো। অথচ মেয়েটি বিন্দুমাত্র বিচলিত ছিলো না। তার মুখভাব বদলায় নি র-ক্ত দেখে”
“তাহলে কি সে কোনো বিশেষ উদ্দেশ্যে এসেছে?”
ইরহান নিরুদ্বেগ স্বরে বললো,
“সে যে হোক আমার কিছু যায় আসে না। যতদিন না সে আমার গ-লা-য় ছু-রি বসাচ্ছে। তবে ঐ বণিককে খুঁজো। মাকবুলের আগে আমার বণিকটাকে চাই হুদ। জীবন্ত। কারণ আপাতত মৃতদের সাথে কথা বলার ইচ্ছে নেই আমার”
“তবে হুজুর কাজটা কি ঠিক হল? সুলতান যদি জানতে পারেন? একেই আপনাকে কেউ পছন্দ করে না। সিংহাসনের যুদ্ধে আপনি আরোও পিছিয়ে যাবেন না?”
ইরহান চোখ মেলে হুদের দিকে তাকাতেই সে জড়োসড়ো হয়ে গেলো। মাথানত করে ফেললো। ইরহান উঠে দাঁড়ালো। কাছে গেলো হুদের। হাত রাখলো তার কাঁধে। খুব শীতল স্বরে বললো,
“আমার ওই সিংহাসন চাই না হুদ, আমার ধ্বংস চাই। মেহমুদ সাম্রাজ্যের ধ্বংস। যা কেবল আমার হাতেই”
!!৮!!
সুলতানা তাবিয়া নিজের মেয়ে রুমেলিয়ার সাথে নাস্তা করছিলো। রুমেলিয়া তার প্রিয় সন্তান। মেয়ে হলেও তার বুদ্ধিমত্তা সুলতানকেও টেক্কা দেয়। তাবিয়ার আফসোস হয় মাঝে মাঝে। কেন রুমেলিয়া ছেলে হল না। তাহলে মেহমুদ সাম্রাজ্যের উপযুক্ত সুলতান হতে পারতো। পৃথিবী একজন বুদ্ধিমান, জ্ঞানী এবং ধৈর্য্যশীল সুলতান পেত। সে উমারের মত ভীত নয়, আবু সাঈদের মত হতবুদ্ধি এবং বেপরোয়া নয় আবার ইরহানের মত ক্রুর নয়। কিন্তু ভাগ্য? রুমেলিয়া মেয়ে। তার আধিপত্য কেবল হারেম অবধিই। তবে তাবিয়া চায় রুমেলিয়ার বিয়ে কোনো রাজ্যের সুলতানের সাথে কোন। তাহলে সেও সুলতানা হবে।
নাস্তা শেষে রুমেলিয়া বললো,
“আম্মী, আমি আসছি। আপনি বিশ্রাম করুন”
ঠিক সেই সময়েই প্রবেশ করলো রোকসানা। রোকসানা তাবিয়ার দাসী প্রায় চল্লিশ বছর। রোকসানা এসে বললো,
“জাহাপনা আজ রাত আপনার সাথে থাকতে চান”
কথাটা শুনতেই তাবিয়ার মুখে অপ্রসন্নতা ফুটে উঠলো। বিরক্ত স্বরে বলল,
“মাকবুল আর কোনো মেয়েকে পায় নি?”
“জাহাপনার গতরাতে খুব খারাপ একটি অভিজ্ঞতা হয়েছে। তাই কিছুদিন হারেম থেকে কোনো মেয়ের সাথে সহবাস তিনি করতে চান না”
“উফফফ, এই বুড়ো সুলতানের ঢং আমার আর ভালো লাগছে না। নাও তোমার কাজ বাড়লো। বুড়োর জন্য আমাকে প্রস্তুত করে দেও”
রোকসানা একটু অবাক হলো। সুলতানের প্রিয় স্ত্রী তাবিয়া। অথচ সুলতানের প্রতি সে উদাসীন। হারেমের অন্য নারীদের থেকে সে খুব আলাদা ধরণের। যেখানে সবাই সুলতানের প্রিয় হতে চায় তাবিয়ার চিন্তা শুধু তার পাঁচ পুত্র আর শেহজাদী রুমেলিয়াকে নিয়েই। রোকসানা একটু রয়ে সয়ে শুধালো,
“একটা কথা জিজ্ঞেস করি সুলতানা?”
“কর”
“আপনার হিংসে হয় না সুলতানা? সুলতান অন্য নারীতে লিপ্ত হত প্রতিরাতে। অথচ আপনি থাকে নির্বিকার”
রোকসানার প্রশ্নে হেসে উঠলো তাবিয়া। তার সরু চোখে খেলে গেলো সেই হাসির ছোঁয়া। সে সহাস্যেই শুধালো,
“রোকসানা তুমি কি জানো আজ আমি সুলতানা কেন? আর নীলুফা শুধুমাত্র তার দ্বিতীয় স্ত্রী কেন?”
“কারণ আপনি সুলতানের প্রিয়”
“ভুল। কারণ আমি সুলতানকে নয় তার সিংহাসনকে ভালোবাসি। তার ক্ষমতাকে ভালোবাসি। যেকারণেই সুলতান আমাকে ভালোবাসেন। একজন সুলতান কখনো এক নারীর হতে পারে না। সুলতানের প্রথম ভালোবাসা তার সিংহাসন, তার ক্ষমতা; তারপর আসে তার সাম্রাজ্য, তারপর তার উত্তরাধিকারীরা এবং সর্বশেষ হারেম। সুলতান সেই নারীকেই সাথে রাখে যে তার সালতানাতকে শক্ত করে ধরে রাখতে পারে। আমি সুলতানে পাঁচজন শেহজাদা দিয়েছি। বর্তমানে চৌদ্দজন শেহজাদার যে সাত জন শেহজাদা বেঁচে আছে তার পাঁচজনই আমার পুত্র। সুতরাং সে আমাকে ভালোবাসবেই। বুঝলে রোকসানা”
রোকসানা হাসল। তার মালিকের বুদ্ধির কাছে সে নস্যি। নীলুফা শেহজাদী হবার পরও সে কেবলই শেহজাদা উমারের মা হিসেবেই থেকে গেছে। তার কোনো ক্ষমতা নেই। কেবল নিজের ঘরে ইবাদত করা ছাড়া। অথচ উজির কন্যা তাবিয়া এই বিশাল সাম্রাজ্যের সুলতানা। এর মধ্যে রোকসানা বললো,
“মালেকা দুটো নতুন খবর আছে”
“কি?”
“শেহজাদা উমারের একটি পছন্দের মেয়ে আছে, হামিদা। তাবায়েফের মেয়ে হামিদা। শেহজাদা তাকে ভালোবাসে। আর দ্বিতীয়টা”
“দ্বিতীয়টা?”
“শেহজাদা ইরহান একটি দাসীকে কিনে এসেছেন। উসমা বলছিলেন দাসীটিকে তিনি কিছু সৈন্যের হাত থেকেও বাঁচিয়েছেন। উসমাকে হুকুম দিয়ে বলেছেন কারবালায় যাবার আগ পর্যন্ত তার দাসির কেনো যত্নের ত্রুটি না রাখা হয়”
তাবিয়ার কপালে ভাঁজ পড়লো। কৌতুহল চাপিয়ে শুধালো,
“নাম কি দাসীর?”
“হুসনাত খাতুন”
“দেখতে হচ্ছে তাহলে”
—————
সুলতানা তাবিয়ার হুকুমে হুসনাতকে উসমা তার ঘরে নিয়ে গেলো। যাবার আগে তাকে শাসালো,
“মাথা নিচু করে থাকবে। কোনো বেয়াদবি না। যেয়ে প্রথমে সালাম দিবে, কাফতানে চুমু খাবে”
“মনে থাকবে?”
হুসনাত মাথা ঝাকালো। হারেমে তার উপস্থিতি নিয়ে বাকি দাসীরা কেমন বাঁকা চোখে দেখছে। কানাঘুষা করছে হঠাৎ তার আগমণে। রুপবতী হবার জন্যও তাদের হিংসে হচ্ছে। শেহজাদা ইরহান তাকে কিনেছে শুনে আরোও আগ্রহ জন্মেছে তাদের মধ্যে। এই আগ্রহ ঠিক কি রুপ নেয় সেটাই জানার পালা।
তাবিয়ার ঘর যেতেই সে উসমার কথামত সব কাজ করলো। তাবিয়া সরু চোখে কিছুসময় দেখলো তাকে। তারপর শুধালো,
“তোমাকে নাকি শেহজাদা উদ্ধার করেছে?”
“জি বেগম সুলতানা”
“শেহজাদা তোমাকে পছন্দ করে?”
তাবিয়ার প্রশ্নে থতমত খেলো হুসনাত। কি উত্তর দিবে বুঝতে পারলো না। খুব বিনয়ী স্বরে বললো,
“উনি কেবল আমাকে দয়া করেছেন, বেগম সুলতানা”
তাবিয়া কিছুক্ষণ চেয়ে থাকলো। কিছু একটা ভাবলো যেন। পরমুহূর্তেই বললো,
“আমি কে জানো?”
“জি”
“কারবালায় শেহজাদা কবে ফিরবে সেটা এখনো অনিশ্চিত। সে অনিশ্চিত সময়টাতে তোমাকে এই হারেমে টিকে থাকতে হবে। আর এই হারেম আমার। বুঝতে পারছো?”
হুসনাত মাথা নত করে থাকতো। তাবিয়া খিনখিনে স্বরে বললো,
“আমার আনুগত্যে থাকলে তোমার জীবন খুব সুন্দর হবে। আর নাহলে জাহান্নাম এই পৃথিবীতে দেখতে পাবে”
হুসনাত সাথে সাথেই হাটু গেরে মাথা নুইয়ে বলল,
“আমি বাঁচতে চাই মালেকা হুজুর”
তার কণ্ঠে ভয় স্পষ্ট। চোখে মুখে অসহায়ত্ব। তাবিয়ার ঠোঁটে হাসি দেখা গেলো। সে রোকসানাকে আদেশ করলো,
“রোকসানা, বিশেষ শরবত নিয়ে আসো। আনুগত্যের একটা পরীক্ষা হোক"
রোকসানা আদেশ পালন করলো। শরবত নিয়ে এলো। সেই সাথে তার মধ্যে মিশিয়ে দিলো একটা সাদা দ্রব্য। হুসনাতের বুঝতে বাকি রইলো না এই দ্রব্যটা কি! তাকে বিষ দেওয়া হচ্ছে। এটাই তার আনুগত্যের পরীক্ষা।
·
·
·
চলবে.........................................................................