নীলাম্বরে রৌদ্দুরের হাতছানি - পর্ব ২১ - বেলা শেখ - ধারাবাহিক গল্প


          মারিয়া তড়িঘড়ি এগিয়ে আসে। সখির দুই কাঁধ ধরে বিস্ময়ের সাথে বলে, "কস কি সুর? সিন ভাই জানে? তোরে জোরজবরদস্তি করে বিয়ে পড়াইছে? নাকি খুশির ঠেলায় চ্যাল চেলাইয়া কবুল কইছোস?"

 সখির উত্তেজনায় সুরেলা টাস্কি খায়। চোখ বড় বড় করে জোরে ধমকায়,

"শালির বিটি চুপ। পুরো গ্রামে ঢোল দিবি নাকি?"

ধমকে মারিয়া শান্ত হয়। ফিসফিসিয়ে বলে, "তুই তো জানোস আমার ধৈর্যের থাল কতটুক। জলদি কন না খান বাড়ির বড় বেগম?"

সুরেলা চোখ রাঙালেও অচিরেই কপোল জোড়ায় লাল আভিমা ছুঁয়ে যায়। সখির হাত থেকে নিজেকে ছুটিয়ে আবারও দোলনায় বসে হাওয়ায় ভেসে বেড়ায়। 

"সেদিন আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম। ভয়ে কথা বলা তো দূরের কথা কান্নাটাও বাড়াতে চাইছিলো না। হারামখোর লোকটা বুঝেও অবুঝ বনে সব বন্দোবস্ত করছিলো। আব্বা এলে আমি যেন ভরসা পাই। তবে আব্বা নিরাশ করেন। পারেন না নিজেই কবুল বলে ফেলেন। আমি পালানোর চেষ্টাও করছিলাম। খুঁতখুঁইত্যা লোক ধরে সে যে ধমক দিলো। রাগে ক্ষোভে কেঁদে দু'টো ঘুষিও মেরেছিলাম ওই লোহার মত শক্ত পেটে..."

"থাম থাম । মজা পাইতেছি না। একটু টক ঝাল নুন মিশাই ক তো?"

সুরেলাকে থামিয়ে দেয় মারিয়া। মুখচোপায় অসন্তোষ ভাব স্পষ্ট। সুরেলা ছোট ছোট চোখে তাকালে দাঁত ভেটকায় মারিয়া।

°°°°°°

এক অপরাহ্ন বেলায়,

"আমার আব্বা আম্মা কোনো দিন মজার ছলেও আমার গায়ে টোকা দেয় নি আর তুই আমায় আক্রমণ করিস? হু?"

"একশ বার করমু। এক অবলা মাইয়ারে কিডন্যাপ করে আনবেন আর সে বইস্যা বইস্যা আঙুল চুষবো?"

"তুই আর অবলা?"

নওরিজ মাহবুবের ভর্ৎসনায় সুরেলা করুণ চোখে চায়। মায়াবী চোখের ইন্দ্রজালে ফাঁসে না নওরিজ। সুরেলা মিনতির সুরে বলে,

"রিজ ভাই দয়া কইরা আমারে যাইতে দেন? আমি পারমু না আপনেরে বিয়া করতে!"

"বিয়েটা আমি করবো। তুই শুধু কবুল বলে আমার কাছে নিজেকে সঁপে দিবি। ব্যস!"

নওরিজের ভাবলেশহীন জবাব। সুরেলা মেজাজ তুঙ্গস্পর্শী। ভাইয়ের মতো খিটখিটে মেজাজ না পেলেও যতটুকু পেয়েছে তাতেই ধান সিদ্ধ হয়ে যাবে। সুরেলা তেজস্বী ঠাঁঠ বজায় রেখে বলে,

"আহারে ভাইজানের শখ কতো! বলি লজ্জা শরম হাঁটে বেইচ্যা দিছেন? লজ্জা করে না একটা মেয়েকে জোরজবরদস্তি করে বিয়ে করতে?"

অপমান বোধ করে নওরিজ। গম্ভীর মুখশ্রী রক্তিম হয়ে আসে নিমিষেই। শান্ত অথচ শক্ত ভরাট গলায় বলে,

"ওকে ফাইন। আমি ফোর্স করবো না। আই থিংক তুই কিছুটা হলেও চিনিস আমাকে। আমি এক কথার মানুষ। তুই আমার হলে এক্ষুনি হবি তাও স্বেচ্ছায়। নয়তো কক্ষনো না। ডিসিশন তোর।"

সুরেলা অবুঝ চোখে চায়। কথাগুলোর সারমর্ম ঠাহর করতে বেগ পোহাতে হয় তাকে। শুকনো ঢোক গিলে সে ফ্যালফ্যাল করে চায়। বেচেইন মনটা শ্বাস নিতেও ভুলে যায়। নওরিজ সুক্ষ্ম চোখে পরখ করে যায় কিশোরীর ভাবাবেগ। আরেকটু বেচেইন করতে স্পষ্ট সুরে আওড়ায়,

"আমি যতদূর জানি তোর খোলা বইয়ে নওরিজ মাহবুবের প্রতিচ্ছবি ভেসে বেড়ায়। আজ চলে যাবি তো আমাকে হারাবি সারাটা জনমের জন্য। আমি নওরিজ কখনো ফিরে চাইবো না সে যতই যাতনায় পুড়ে ছাই হয়ে যাই।"

 সুরেলার দৃষ্টি নত হয়। ওই খামখেয়ালি চোখে চোখ রাখলে সে হারিয়ে যাবে নিশ্চিত। তাঁর আবেগপ্রবণ মন এক কথা বলে তো মগজ ভিন্ন কথা। অবুঝ মন এ যাবত লোকটাকে নিয়ে নানান জল্পনা কল্পনা বুনে গেলেও লোকটাকে সত্যিকার অর্থেই কোনোদিন পেতে পারে এমন ভাবনাও উদয় হয় নি। আজ সে-ই কল্পনায় বুনো ছোট্ট সংসার হাতছানি দিচ্ছে অথচ তাঁর হাত বাঁধা লাল ওড়নায়। দোটানায় দুলতে থাকা মনের কোণে ভাইয়ের স্নেহ ভরা মুখটা স্মরণে আসে শুধু। সিন ভাইকে ছাড়া এ অসম্ভব। সুরেলা যেন নিমিষেই পথ দেখতে পায়। গম্ভীর মানবের চোখে চোখ রেখে ফিরে যায় পথে। নওরিজের হাতের মুঠো শক্ত হয়। প্রত্যাখ্যাত হৃদয় খানি অঙ্গারে রূপান্তরিত হয়।

°°°°°°

"পাষণ্ড, হৃদয়হীন, জালিম মহিলা! তোর কি একটুও বুক কাঁপলো না আলাভোলা নাদান রিজ ভাইয়ের হৃদয়ে ছুরি চালিয়ে আসতে?"

প্রাণপ্রিয় সখির ধিক্কার ধ্বনিতে সুরেলা অপরাহ্ন বেলা হতে ছিটকে বর্তমানে মুখ থুবড়ে পড়ে। দাঁত কটমট করে তাকিয়ে কিছু বলবে মারিয়া আবারও প্রশ্নবাণে বেঁধে নেয়।

"তারপর কি হলো? রিজ ভাই নিশ্চয়ই খলনায়কের মতো তোকে কাঁধে ফেলে কাজি অফিসে নিয়ে মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে বলেছেন, 'হয় কবুল বলে বাসর ঘরে ঢুকবি নয়তো কবরস্থানে সমাধিত হবি! ডিসিশন তোর?'"

ভরাট গলায় নওরিজকে নকল করার চেষ্টা করে বলে ওঠে মারিয়া। সুরেলা বুকে হাত বেঁধে ঠোঁট চেপে হেসে সায় জানালো।

"ঠিক ধরেছিস সই।"

মারিয়ার বিশ্বাস করে না। সখিকে চেপে ধরে বলে, "বল না রে দুস্ত! মাথা আমার আওলাই গেলো।"

"আমি কি কমু? তুইই তো সব কইলি। আচ্ছা বাড়িতে চল? তোরে কিছু দেখাইবাম?"

সুরেলা টেনে নিয়ে যায় সখিকে। মারিয়া নাখোশ মনে পা চালায়। তাঁর এতো এতো সমস্যার ভিড়ে আরেক সমস্যা হলো কোনো কিছু আধুরা জানলে তাঁর বুকটা ধড়ফড় ধড়ফড় করে পরবর্তী ঘটনা জানতে। যতক্ষণ না পুরোটা শুনবে শান্তি পাবে না একদন্ডি। 

°°°°°°°°

গোয়াল পাড়ে কড়কড়ে রোদ্দুর চোখ পাকাচ্ছে। তাঁর তেজে গরুটা গাইগুই করছে। কুত্তা মরা গরমে সিদ্ধ হবার উপক্রম। গলা ছেড়ে হাম্বা হাম্বা ধ্বনিতে ডাকে। তাঁর ডাক বিফলে যায় না। সিনান সালেহ এগিয়ে এসে গলায় হাত বুলিয়ে বলে,

"বিউটিফুল? রোদে গরম লাগতাছে তোমার? কারো খেয়াল নাই। খালি খাইবো আর আয়েশ কইরা ঘুমাইবো। বাইরে গাধার মতো খেটে এসেও রেহাই নাই। খ্যার না কাইটা বস্তা ভইরা রাইখা যাই খালি চাড়িতে দিবো তাতেও গায়ে তেল ধরে। সুর.."

থেমে যায় সিনান। সুরেলাকে ডাকতে নিয়েও ডাকে না। গরুর রশি খুলে ছায়ায় বেঁধে দেয়। স্টিলের বালতি ভরে পানি খাইয়ে বলে,

"বাড়ির কেউ তোর খেয়াল রাখে না, তাই না বিউটিফুল? তোর খেয়াল রাখার জন্য একটা সতিন আনবো ভাবতেছি। তবে তুই অনুমতি দিলেই আনবো তার আগে না, বুঝলি?"

গরুটা মাটিতে শুয়ে পড়ে। দুই একবার হাম্বা বুলি আওড়িয়ে জাবর কাটে আপনমনে। সিনান পাশে বসে তার বিউটিফুলের গায়ে পড়া মাছি মশা তাড়ায়। হঠাৎ মায়ের পদচারণায় সিনান ভাবলেশহীন গলায় বলে,

"কিছু কইবি?"

শান্তি বেগম হাসিমুখে ছেলের মুখে মিষ্টি পুরে দিয়ে পাশে বসেন। সিনানের হজম হয় না আগলা পিরিতি। 

"তা তো কমু দুইডা কথা। তুই বাড়িতে যে! গ্যারেজে যাবি না?"

"তোগোর রং ঢং পুরণ করতেই বেলা শেষ। গ্যারেজ যাওয়ার সময় কই? কি কইবি জলদি ক?"

স্বাভাবিক ভাবেই বলেছে সিনান। তবে অপরিচিত কেউ প্রথমবার শুনলে ভাববে চোপা ঝাড়ছে। শান্তি বেগম কাঁচুমাচু মুখে বাটি থেকে আরেকটা মিষ্টি ছেলের মুখে পুরে দেয়।এতে যদি ছেলেটার মেজাজ একটু ঠান্ডা থাকে। সিনানের বুঝতে বাকি থাকে না। মা এমন কিছু বলবে যাতে তাঁর পকেট খসবে মোটা অংকের। শান্তি বেগম রয়ে সয়ে কথা পাড়েন,

"বিয়ার সব খরচাপাতি তোর আব্বায় সামলায় নিবো কইলো। তোর চিন্তা করনের দরকার নাই।"

"যাক বাবা বাঁচা গেলো। সুমতি ফিরলো জনাবের। এমনিতেও টাকা পয়সার তো পাঁচ পা দেখা যায়। ধার দেনা করতে হইবো না আর।"

সিনান হাসিমুখে বলে । শান্তি বেগম বেগম আমতা আমতা করে বলে,

"খান বাড়ির বউ হইবো। ওরা ওদের বাড়ির বউরে সোনা জহরত দিয়া যতোই তুইল্যা নিক আমগোরেও একটা দায়িত্ব আছে না? বেশি না হউক, একটা গয়না না দিলে কেমন দেখায় ক বাপজান?"

সিনানের হাসি বাড়ে বৈ কমে না। মায়ের চোখে চোখ রেখে বলে, "তো ওহন কি করতে কস?"

শান্তি বেগম আঁচলের গিঁট খুলে স্বর্ণের একজোড়া কানের দুল সিনানের হাতে দেয়। 

"আট আনির দুল। টাকা জমাই ওর জন্যেই বানাই ছিলাম।তুই আর কিছু ভইরা একভরির একজোড়া বালা বানাই দিস বাপ।"

 সিনানের হাসি মাখা মুখটা মলিন দেখায়। হাতের দুল জোড়া নেড়েচেড়ে দেখে বলে,

"আমার কাছে এক পয়সাও নাই। তুই এইডাই দিয়া দে তোর মাইয়ারে।"

শান্তি বেগমের হাসিমুখে বিষাদ নামে। কিছু সময় নীরব থেকে বলে,

"রাগিস না বাপ। বাছুরডা হাঁটে নে না হয়? টাকা পয়সা হইলে আবার কিনিস! এই বোঝা পারি দে ওহন। পড়ে আমিও টাকা পয়সা দিমু নে!"

খিটখিটে সিনান যেন জ্বলে ওঠে। ব্যাঙ্গ স্বরে আওড়ায়,

"ওহ্! ওহন বুঝছি তোগোর নজর আমার গরুটার উপর। বুদ্ধি কেডা দিলো? জনাবে? তাইলে আমার কথা কান খুইল্যা শোন মা। আমার ঠ্যাকা পড়ে নাই তোগোর বোঝা পারি দেওয়ার। তোর মাইয়া তোরা যা ভালো বুঝোস। খাটতে খাটতে জানে পানি রাখি নাই। মায়ে বিটি যা চাইছোস তাই দিছি। আর পারুম না, মাফ কর। আমারও ভবিষ্যত আছে বুঝলি?"

শান্তি বেগম আঁচলে মুখ গুঁজে। সিনানের বুঝতে বাকি থাকে না মায়ের পরবর্তী পদক্ষেপ। সে আর এক মুহুর্ত বসে থাকে না। উঠোনের এক কোণায় কাঁঠাল গাছের নিচে সুরেলা সজল চোখে দাঁড়িয়ে আছে । সিনান খেয়াল করেও বেখেয়ালি ভাব দেখিয়ে বেরিয়ে যায় ক্ষিপ্ত মেজাজে। 

সুরেলার কন্ঠ নালীতে কান্নারা জাপ্টে ধরলো যেন। বাঁধন ছিঁড়ে বেরিয়ে পড়া বানের জলে ভাসিয়ে দিলো কপোল জোড়া। ওড়নায় ঝটপট মুছে নেয় সেই নোনাজল। মারিয়া সখির কাঁধে হাত রেখে শান্ত সুরে শুধায়,

"সিন ভাই সব জানে তাই না?"

"মনে হয়!"

সুরেলার ভঙ্গুর গলা। সেদিন রাত হতেই সিন ভাই কেমন পাল্টে গেছে। তাঁর সাথে কথা বলে না অবদি। সুরেলার বুকটা হাহাকারে ভরে ওঠে। মন মস্তিষ্ক আজ দুটোই চিল্লিয়ে বলে, তুমি ভুল করেছো সুরেলা সালেহ!

°°°°°°°°°°°

পালঙ্কে হেলান দিবো বসে রাহেলা বানু। কাজের মেয়ে ভদ্রমহিলার পা টিপে যাচ্ছেন। রেবেকা বানু চেয়ারে বসে পান বানায়। একটা বড় বোনের হাতে দিয়ে আরেকটা নিজ মুখে পুরে বলে,

"সকালে রিজ তো গয়নার জন্য আসছিলো। আমার তো গা গতর জ্বলছিলো শুধু। ফকিন্নীর ঝি নাকি আমার গচ্ছিত গয়না পড়ে আমার সামনেই ঘুরবে ফিরবে! কিচ্ছুটি বলি নি; সবগুলো বের করে বিছানায় ছুড়ে মারি। ছেলেটা কষ্ট পেয়েছে বুঝতে পারছি কিন্তু কষ্ট আমিও পেয়েছি বুবু। আমার নাড়ি ছেঁড়া ধন আমার কথা গোনায় ধরে না! ওই ঝিয়ের জন্য আমাকে অপমান করে। আমিও এর শেষ দেখে ছাড়বো। আসুক ওই মেয়ে আমার সংসারে!"

রাহেলা বানু বিরক্ত হলেও ছোট বোনের মন রাখতে বোনকে সান্ত্বনা দেয়।

"শোন ছেলের বউয়ের সাথে ঝগড়া ঝাটি করবি তো ছেলের কাছে খারাপ হবি। বউয়েরা ভয়ানক রোগ। ছেলে তোর যতোই নেওটা হোক বউ আসলে বউয়ের দোষ নজরে আসবো না। তাই বলি মেনে নিই।"

রেবেকা বানুর মুখটা বিরক্তিতে ভরে ওঠে। রাহেলা বানু হেসে বলে, "মানবার পারবি না তাই তো? তাইলে এক কাজ কর। ওহনো বিয়া হয় নাই‌। তুই বলিস তো জব্বর একখান বুদ্ধি দিমু। ছেলে ওই মাইয়ারে দুচোখের বিষ ভাববো শুধু! ‌"

রেবেকা বানু কৌতুহল দমিয়ে রাখতে পারে না। এগিয়ে এসে বোনের হাত ধরে সুরাহা চায়। দু বোনের মাঝে বেশ সময় ধরে আলাপ চলে। তাদের গুসুর ফুসুর কুবুদ্ধি শুনে বিশ্বস্ত কাজের মেয়েটা হাসে। দু'জনের গুসুর ফুসুর শেষ হলে মেয়েটি অনুমতি চায়,

"গিন্নী মা অনুমতি দিলে একখান কথা কইতাম!"

রেবেকা বানু বিরক্ত মুখে বলে, "টাকা পয়সার ব্যাপার হলে দরকার নাই। অন্য কথা হলে বল।'

কাজের মেয়েটা মনে মনে মুখ ভেংগায়। আসছে মহারানী! নত মুখে বলে,

"বাতাসে খপ্পর পাইলাম রিজ বাবা ওই মাইয়ারে বিয়া কইরা নিছে। কাজি আফিসে যাইয়া। চেয়ারম্যান সাবও লগে ছিলেন। এই হপ্তা খানেক আগের কথা।"

দুইবোনের ক্ষণপল পূর্বের পরিকল্পনা খান খান করে ভেঙ্গে যায়। রেবেকা বানু যেন বোধগম্য হারিয়ে ফেলেন। কি শুনলো সে? তাঁর ছেলে তাকে না জানিয়েই বিয়ে অবদি করে নিয়েছে! বাহ্ বাহ্ খুব ভালো। 

"রিজ বাড়িতেই না? এক্ষুনি পাঠিয়ে দিবি। যা?"

কাজের মেয়েটা হেলে দুলে বেরিয়ে যায়। রাহেলা বানু মৃদু কেশে ওঠে। ছোট বোনের দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করে বলে,

"তাইলে আর কি হইলো! সব পেলেন ভেস্তে গেল। মাইনা নেওয়া ছাড়া তোর পোলা কুনো রাস্তা রাখে নাই। ওহন তুই যদি মানতে না পারিস সংসারে ঝামেলার অন্ত থাকবো না রেবু!"

রেবেকা বানুর চোখ ভিজে যায়। বুকটা ভরে ওঠে বেদনায়। যাকে দশ মাশ দশদিন গর্ভে রেখে দুনিয়ায় আনলো। মাথায় রেখে বড় করলো সেই ছেলে মায়ের স্বপ্ন তো ভাঙলোই সাথে মায়ের অগোচরে বিয়ে নামক পাঠ চুকিয়ে ফেলেছে। যেন মায়ের থাকা না থাকায় কিছুই যায় আসেনা।

"ওই ফকিন্নীর ঝি আমার থালে খেয়ে আমারেই বুড়ো আঙুল দেখালো বুবু! আমি মরে গেলেও মেনে নেবো না। ঝামেলা যতদূর গড়ায় গড়াক। আমিও এর শেষ দেখে ছাড়বো। ওই দু'দিনের ভালোবাসার কত জোড় তা আমিও দেখবো!"

দরজা ঠকঠকানোর আওয়াজে রেবেকা বানু ভেজা চোখ মুছে নাক ঝাড়ে। রাহেলা বানু দুঃখি দুঃখি মুখ বানানোর চেষ্টায় আছে। নিজ দুঃখে এতটাই গুলে গেছে অন্যের দুঃখে অনুভূতি কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে।  

"কে? রিজ বাবা? আয় ভেতরে আয়। তোর মা কেঁদে কেঁদে চোখ মুখ লাল করে রেখেছে। তুই বুঝা তোর মা'কে!"

নওরিজ এগিয়ে আসে। মায়ের ক্রন্দনরত মুখ দেখে খালার পানে তাকায়।

"খালা অবুঝ কে বুঝ দেওয়া যায়। বুঝদারকে না। তিনি অহংকারে ডুবে আছেন। বুঝতেই চাইছেন না জীবনটা আমার। সারাটা জীবন আমাকে কাটাতে হবে। আমার ভালোলাগা ভালোবাসা এখানে মুখ্য নয় কি?"

রাহেলা বানু সায় জানালো ‌ বোনের কাঁধে হাত রেখে শান্ত গলায় বলেন,

"ঠিকই কইছোস। তোর জীবন তুই যা ভালো বুঝিস। তবে ভুলিস না জীবনটা তোর মায়ের জন্যই পাইছিস। মায়েরও তো ইচ্ছে হয় সাত গেরাম ঘুইরা আদরের পোলার জন্য একটা লাল টুকটুকে বউ আনতে। তুই তোর মায়ের একমাত্র চাঁন। তোর মায়েরও ইচ্ছা ছিলো নিজে পছন্দ করবে ছেলের বউ। নাকি মায়ের ইচ্ছা অনিচ্ছা কিছুই না?"

নওরিজ ছোট্ট স্বরে শ্বাস ফেলে। মা খালার এসব আবেগপ্রবণ কথায় জোর গলায় কিছু বলাও যায় না। বুকে হাত ভাঁজ করে কিছু বলতে উদ্যত হয় রেবেকা বানু থামিয়ে দেন। হুট করে থমথমে গলায় বলে,

"বড় হইছে! হাঁটতে শিখছে একাই খেতে পারে। দুনিয়াদারির সাথে পরিচয় হয়েছে। কামাই করতে পারে আর মায়ের কিসের দরকার বুবু? একটা বউ হলেই যথেষ্ট।"

"আম্মা আপনি অহেতুক কথা টান.."

"হ্যাঁ অহেতুক সব। থাক সে কথা। শুনলাম বিয়ে আগেই করে ফেলেছো। সত্যিই নাকি?"

নওরিজকে থামিয়ে রেবেকা বানু প্রশ্ন করেন চোখে চোখ রেখে। নওরিজ একটু হলেও থমকায়। আম্মার কানে পৌঁছালো কিভাবে? যেভাবেই আসুক আম্মা জানে মানে আর লুকোচুরি করে জল ঘোলা করার প্রশ্নই আসে না। তবে নওরিজ নজর নামিয়ে নেয়। আম্মা কষ্ট পেয়েছে নিশ্চয়ই। ছেলে হিসেবে ব্যাপারটা খুবই দুঃখজনক।

"জি আম্মা। আপনি রেগে আছেন তাই জানাই নি‌ আব্বা সাথেই ছিলো।"

ছেলের কথায় রেবেকা বানু সজল চোখে হাসেন। নওরিজ এগিয়ে গিয়ে মায়ের কাঁধ জড়িয়ে ধরে মিষ্টি স্বরে 'আম্মা' ডাকে। যে ডাকে রেবেকা বানু কখনোই অভিমান ধরে রাখতে পারে না। এবারও কি পারেন নি?

°°°°°°°°°

রমজান মিয়া চিন্তিত বদনে পায়চারী করে চলেছে অনবরত। রুমালে ঘর্মাক্ত মুখ মুছে পাশে দন্ডায়মান মানবীকে তাড়া দিয়ে বলে,

"আধা ঘন্টা হলো বসে আছি। আমার কি সময়ের দাম নাই? জলদি ডাকো মিনীরে। জলদি বাড়ি ফিরতে হবে।"

শুপ্রা কাঁচুমাচু মুখে দাঁড়িয়ে উত্তরের দিকে দরজায় তাকিয়ে থাকে। এই দামু আসছে না কেন এখনো? দুমিনিটের কথা বলে আধা ঘন্টা পার করলো।

"আপনে বসেন বাবু। দামু আসছে তো!"

"কোথায় আসছে? মাথা নষ্ট করে দিবে এই মেয়ে। ডাকো না তাকে? যাও যাও?"

শুপ্রা পা বাড়াবে খোদ দামিনীই এগিয়ে আসে। আটপৌরে শাড়ি আর বড় হাতার ব্লাউজ। নিত্যকার লাস্যময়ী রূপেই আবির্ভাব ঘটে দামিনীর। তবে নজর কাড়ে মাথার ঘোমটা। আর কপালে চেনা পরিচিত লাল টিপ টা নেই। দামিনী এগিয়ে এসে হালকা ঝুঁকে হাত নাড়িয়ে বলে,

"সালাম নিবেন বাবু। অপেক্ষায় রাখার জন্য দুঃখিত। কিছু দরকার ছিলো বুঝি?"

রমজান মিয়া থমকান ক্ষণপলের জন্য। আজকের দামুর সাথে ক'বছর আগের দামিনীর খুব বেশি তফাৎ নেই। বয়সের ছাপ পড়লেও তা সৌন্দর্যে ভাটা পড়তে দেয় নি বরং পরিপক্বতা এনে দিয়েছে। দামিনী বাঁকা হাসে। মাথার ঘোমটা আরেকটু টেনে একটু লাজুক হাসার চেষ্টা করে। নিজেই চেয়ার টেনে বলে,

"বসুন না বাবু? ভালো আছেন? বাড়ির সবাই কেমন আছে? বউ বাচ্চা?"

রমজান মিয়া থতমত খেয়ে বসেন। কপালে ঘাম ছুটে যায়। দামিনী হাসি আঁটকে রেখে শুপ্রাকে পানি আনতে পাঠিয়ে বলে,

"কি হলো বাবু? শরীর খারাপ লাগছে বুঝি? ইশ্! কি যে করি? ডাক্তার ডাকি?"

দামিনীর ধূর্ততা বুঝতে বাকি থাকে না রমজান মিয়ার। চোখ মুখে বিরক্তে ভরে ওঠে। কপাল কুঁচকে বলে,

"মিনী আগলা পিরিতি দেখানোর কোনো দরকার নাই। বসতে আসি নি। সোজাসাপ্টা কথা বলতে চাইছি।"

দামিনী হঠাৎ খিলখিল করে হেসে উঠলো। তাঁর এই হাসিটাও পুরনো নয়। এভাবে হাসলে মেয়েটাকে মনে হবে সহজ-সরল চঞ্চলা হরিণী। অথচ মেয়েটা যেন রহস্যপুরী। রমজান মিয়া শান্ত গলায় বলে,

"গাঁ থেকে যেতে কত নিবে মিনী?"

দামিনীর হাসি দীর্ঘ হয়। চোখের কোণায় জল জমতে শুরু করে। হাসতে হাসতেই বলে,

"আমারে টাকার গরম দেখাও বাবু? টাকা আমার কম আছে নাকি? চাইলে তোমারেও দিতে পারি। আমার মনট বড় উদার!"

রমজান মিয়ার মুখটা গম্ভীর দেখায়। রাগ প্রকাশ করে বলে,

"তাহলে কি চাও?"

দামিনীর মুখাবয়বের আদল পরিবর্তন হয়। হাসি নিভে জেদি মনোভাব ফুটে ওঠে। স্পষ্টতই জবাব দেয়,

"আমি সব ছেড়েছুড়ে বনবাসী হয়েছি। মা, বাবুজি, দাদা সব হারিয়ে আমি আজ নিঃস্ব। সমাজের চোখে এক বাজারি নারী হয়ে গেছি। ভদ্রলোকে মুখ দেখলেই ঘৃণায় দূরছাই করে। আমি স্বাধীন ভাবে শ্বাস নিতে পারি না বাবু।"

"পথ তুমিই বেছে নিয়েছো। নয় কি?"

রমজান মিয়ার প্রশ্নে থমকায় দামিনী। মলিন হেসে বলে, "আমি ভালোবেসেছি এটাই কি আমার দোষ?"

"আমি আলতু ফালতু কথায় সময় নষ্ট করতে চাইছি না। এই গাঁ ছেড়ে চলে যেতে হবে তোমাকে;বহুদূরে। বিনিময়ে কি চাই তোমার বলো?"

দামিনী জলন্ত চোখে চায়। মুহুর্তেই জখমিত বাঘিনীর ন্যায় গর্জে ওঠে,

"আমার খান বাড়িতে ঠাঁই চাই; পাকাপোক্ত। আমার সংসার চাই। আমার হাসিখুশি একটা জীবন চাই! আর পাঁচটা মেয়েদের মতো আমিও প্রাণ খুলে হাসতে চাই। দিতে পারবেন বাবু?"

"মাতে চিল্লাচ্ছো কেন? আমার পুতুল খেলায় বিঘ্ন ঘটছে। একটু আস্তে কথা বলো না?"

হঠাৎ সুভার অতি শান্ত কন্ঠস্বর কানে বাজতেই দামিনী চকিত দৃষ্টিতে তাকায়। শুপ্রাকে ইশারা করে সরিয়ে নিতে। রমজান মিয়া বাচ্চা মেয়ের কন্ঠে অবাক হয় ঢের। বিস্ময়কর চাহনিতে সুভাকে দেখে যায়। কে এই মেয়ে? 

°°°°°°°°°

মেহমান আর প্রতিবেশীর ভিড়ে কলপাড়ে পা রাখা দায়। সকলের মধ্যমণি সুরেলা সালেহ। কাল বিয়ে আজ কনে কে হলুদ মাখিয়ে গোসল করে ঘরে তোলা হবে। হাসি ঠাট্টার মাঝে সম্পর্কে ভাবী ও দাদিরা গায়ে হলুদ লাগিয়ে দেয়। সুরেলার মা শান্তি বেগম বড় গামলায় মুড়ি আর গুঁড় দিচ্ছেন সবাইকে। মুখ থেকে আজ তাঁর হাসি সরছেই না। এ নিয়ে কানাঘুষা চলছে দলে দলে। বড় লোক জামাই পাইছে শান্তির জীবনে তো শান্তি আর শান্তি। কেউ কেউ শুধায়, এ'ই অসাধ্য সাধন হলো কিভাবে? শান্তি বেগম হেসে জবাব দেন,

"যদি থাকে নসিবে নাচতে নাচতে আসিবে। আমার মেয়ের নসিবে লেখা ছিলো চেয়ারম্যান বাড়ির বউ হইবো তাই হইছে। সব আল্লাহ পাকের অসীম দয়া। নাও নাও গুঁড় মুড়ি খাইয়া মুখ মিঠা করো?"

তারা মুখ বাঁকা করলেও গুড় মুড়ি নিতে কুণ্ঠাবোধ করেন না।সবার হাসি আর উচ্ছ্বাসে উঠোনে যেন আনন্দ মেলা বসেছে । শফি তো হৈচৈ মাতিয়ে রেখেছে। ওদিকে শাপলা তাঁর ভাঙাচোরা রেডিও বন্ধ করার নামই নিচ্ছে না। তার সুর আপা কত বড় বাড়ির বউ হইবো খুশিতে সে নেচেছে। এসবের ভিড়ে খোদ কনের মুখটা নিরস। মিছে হাসিও ফুটছে না বাগিচায়। লাল হলুদ কাপড়ে ঘোমটা টেনে উদাস চোখে তাকিয়ে নব বধূয়া।দু'দিনের ব্যবধানে যেন মুখ চোপা শুকিয়ে গেছে। সবাই একটু কানাঘুষা করলেও শাপলার মা সুরেলার মাথায় স্নেহের হাত রেখে বলেন,

"সব সম্পর্ক ছিন্ন করে এক নতুন যাত্রায় পারি জমাইবো। মন খারাপ হইবো না কও? যে ভিটায় গড়াগড়ি খাইয়া বড় হইলো সেই ভিটা অহন ক'দিনের অতিথি আলয় তাও শ্বশুর বাড়ির লোক্কে চাইলে।"

সুরেলার শুকনো নেত্রপল্লব ভিজে যায় নিমিষেই। উপস্থিত সকলেও বুঝতে পারে। কানাঘুষা বন্ধ করে সান্ত্বনা বানী শোনায়। উপস্থিত এক বৃদ্ধা কোমড়ে আঁচল বেঁধে পান মুখে দিয়ে ভিড় ঠেলে সুরেলার সম্মুখে দাঁড়ায়। হলুদমাখা শ্যামল কনের থুতনি ধরে বলে,

"বুবু মন খারাপ করিস না তো। একদিন সব সইয়া যাইবো। মাইয়াগোরে জন্মই হয় সব সওনের লাগি। শোন একখান দুঃখের কথা কই! কিলো মাগীরা কমু?"

সুরেলার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক রমনীকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে শুধায়! রমনী মাথায় আঁচল টেনে হেসে বলে,

"কন বুবু জান!"

বৃদ্ধা পান ফেলে দিয়ে গানের সুর তুলে বলে,

"শুনো হে রমনী, শুনো দিয়া ময় 
মোর জীবনের একখান মজার কই!"

উপস্থিত সকলে হেসে স্বমস্বরে বলে ওঠে, "হ্যা হ্যাঁ কন!"
 সুরেলা কৌতুহল চোখে চায়। বৃদ্ধা সুরেলার গালে হলুদ লাগিয়ে বলে,

"কাইলা সুরত মাথায় তাহার আধা পাকা চুল
বরটুপি মাথায় দিয়া বুইড়া আইলো নিতে ফুল!

বেড়ার ফাঁকে বর দেইখা আমি কাইন্দা মরি 
 বুইড়া ব্যাটার ঘর করমু না দিমু গলায় ছুরি!

ভাবি মানায়, দাদি মানাই, জামাই বড় ভালা 
টাকা আছে, জমি আছে, সুখ দিবো মেলা।

সোনা দিলো, জহরত দিলো, আরো দিলো সোহাগ 
বছর না ঘুরতেই কোলে আইলো মোর পরাগ 

তারপর আইলো কাশেম আলী, জবে, ময়মুনা 
বুইড়া ব্যাটা ময়নারে আনার করে তালবাহানা!

রাগ গোস্বা সবি দেহাই বুড়ার নাই হুঁশ 
বউয়ের আঁচলে ঘুরঘুর করে শাউরি করে ফুঁস ফুঁস।

বলি বুবু মনে রাখিস বুড়ির একখান কথা
জামাই হইবো জরুর গোলাম নইলে জীবন বৃথা।"

উপস্থিত রমনীরা হৈ হৈ মাতিয়ে দেয়। দূর হতে খিটখিটে সিনানের চড়া গলা ভেসে আসতেই সবাই গলার আওয়াজ কমিয়ে আনে। সুরেলার মলিন মুখে লাজুক হাসি ফুটে ওঠে। বৃদ্ধা গলায়, হাতে হলুদ লাগিয়ে সুরেলার পেটেও হলুদ লাগিয়ে দিতে নিবে সুরেলা ছিটকে সরে পড়ে। বৃদ্ধা খিকখিক করে হেসে বলে,

"অহন কুচুর মুচুর করতাছোস বুবু? জামাই যহন ছুইবো তহন কি করবা?"

লজ্জায় সুরেলা পারে না মিশে যেতে। আশেপাশের আরো অনেকেই আরো বেফাঁস আলাপ চালায়। শ্যামল শুকনো মুখটা লাজে রাঙা হয়। নিয়ম কানুন মেনে বৃদ্ধা সুরেলার মাথায় পানি ঢালা হয়। গায়ে নতুন সাবান ঘষে বৃদ্ধা বলে,

"এই সময় ডা খুবই ভয়ানক বুঝলি বুবু? ভয়ে কইলজ্যা শুইকা আনচান। আমার যহন বিয়া হইলো ভয়ে খাওয়া দাওয়া ঘুম হাগা মোতা সব বন্ধ। হাসিস না লো মাগিরা!"

সবার হাসিতে বৃদ্ধা খ্যাক খ্যাক করে ধমকায়। তারপর সুরেলার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হেসে বলে,

"তারপর বুইড়া আইলো পালকি নিয়া বিয়া করতে। মওলানা বিয়া পড়ানোর জন্য মুরুব্বিদের নিয়া আইলো আমার কাছে। তহন পড়ছিলাম ফ্যাসাদে। পেটে যা মোচড় দিলো বুবু! কাঞ্চিতলা না গেলে সারে সব্বনাশ! ওদিকে মওলানা কবুল কইতে কয়। আমি মুখ বাকাইয়া ঝট পট কইয়া দিছিলাম কবুল। পেট খালি করোনের তাড়া যে। ওদিকে পাড়ায় পাড়ায় রইট্যা গেলো মতিবানু জামাই দেইখ্যা হুঁশ জ্ঞান হারাইয়া চেল চ্যালাইয়া কবুল কইছে। তোর দাদা ওহনো ক্ষ্যাপায় আমারে।"

কথা শেষ করে বৃদ্ধা কিটকিটিয়ে হেসে দেয়। মুহুর্তেই হাসির রোল পড়ে উঠোন জুড়ে। সুরেলাও হাসে শব্দহীন। যদিও বুকটা দুরুদুরু করছে। 

°°°°°°°°

একটা খাতা আর কলম নিয়ে আঁকিবুঁকি করছে সিনান সালেহ। কাল বিয়েতে রান্না বান্নার জন্য কি কি লাগবে কত পরিমাণ লাগবে তারই সূচিপত্র বানাচ্ছে। কোলাহলের মাঝেই হঠাৎ রিনিঝিনি হাসির কলতান কাজে বিঘ্ন ঘটায়। কপাল কুঁচকে পূর্ব দিকের কাঁচা রাস্তায় তাকায়। আলালের ঘরের দুলালি আসছে। মুখ থেকে হাসি সরছেই না। সাথে আসা সমবয়সী কিশোরীর সাথে গভীর আলাপণে ব্যস্ত। সিনান নজর সরিয়ে নেয়। 

রূপসা তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে বাড়ির ভেতরে চলে যায়। আড়চোখে নিষ্ঠুর নির্দয় পাষন্ড লোকটার দিকে তাকাতে ভুলে নি। অন্যসময় হলে ছুটে যেতো। কিন্তু সে এখন রেগে আছে। সে জানে তাঁর রাগ অভিমানে লোকটার কিচ্ছু যায় আসে না। তবে তাঁর অভিমান করতেও ভালো লাগছে। এমনটা কেন হয়? লোকটার উপর রাগ হয় কিন্তু তার স্থায়িত্বকাল ক্ষীণ। লোকটা উপেক্ষা করে অপমান করে তবুও সে বারবার ছুটেই বা যায় কেন? এতো কেন টানে লোকটা? নিজেই টানবে আবার কাছে গেলে খ্যাক খ্যাক করবে। শফি ছেলেটা ঠিক বলে। এ লোক তার ছেঁড়া পাগল।

রূপসার আগমণে মহল বদলে যায়। সবাই রূপসাকে নিয়ে মেতে ওঠে। রূপ সাগরের রাজকন্যা ও তাঁর মিশুক স্বভাবে সবাই যেন গুলে শরবত বনে যায়। সুরেলা নিজেও অবাক হয় রূপসার সহজ সরল আচরণ দেখে। গ্রামের সাধারণ ঝি বউ, ময় মুরুব্বিদের সাথে কি অবলীলায় মিশে গেলো। মনে হচ্ছে তাদেরই একজন। অথচ মেয়েটাকে সে অহংকারী ভাবতো। সোজাসাপ্টা বলতে গেলে হিংসে করতো।

রূপসার আগমণ ঘটেছে শুনে শফি দিক দিশা ভুলে ছুটে চলে। তবে বাঁধ সাথে তাঁর সিনভাই। ঘার ধরে টেনে বসিয়ে দেয় টুলে। ধমকে বলে,

"রকেটের গতিতে কোনে ছুটোস?"

শফির বিরক্তিতে ঠাসা মুখাবয়বে রক্তিম আভা দেখা যায়‌। লাজুক হেসে তর্জনী আঙুলের নখ খুঁটতে খুঁটতে বলে,

" শাপলা কইলো রূপসা আপা আইছে। হেরেই দেখবার যাইতেছি। আমারে সুন্দর লাগতাছে না কও তো সিন ভাই?"

সিনান ভ্রু যুগল ভাঁজ করে শফির আপাদমস্তক পরখ করে। ফুলহাতা সাদা শার্ট পড়েছে। একেবারে গলার নলি অবদি আটকানো। সেটা সমস্যা না। সমস্যা হলো ছেলেটা কোমড় নেমে পড়া ফুল শার্টের সাথে হাঁফ প্যান্ট পড়েছে। তেল চিটচিটে চুল গুলো একপাশে সিঁথি কেটেছে। সিনান ঠাস করে চড় লাগাতে নিয়েও থেমে যায়। কাঁধ চাপড়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

"শফি সাহেব? সারাদিন অনেক খাটুনি গেছে। গা গতর বিষাইতেছে। একটু টিইপা দে তো! এক্ষুনি দে?"

শফির হাস্যোজ্জ্বল মুখ ভোঁতা হয়ে আসে। মুখ থেকে ভয়ংকর দেশি গালি বের হতে নিয়েও থেমে যায়। দাঁতে দাঁত চেপে খিটখিটে চেঙ্গিস খানের গা গতর টিপে। মুখে প্লাস্টিকের হাসি ঝুলিয়ে বলে,

"গলা ব্যাথা করতেছে না সিন ভাই? গলাও টিপা ধরি নয়তে!"

°°°°°°°°°°°°

কাল পবিত্র মাহে রমজানের শুভারম্ভ। ময় মুসল্লিরা দলে দলে অতি উৎসাহী হয়ে মসজিদে ছুটে গিয়েছিল। এখন ঘুম ঘুম চোখে বাড়ি ফিরছে। নওরিজ মাহবুব রাস্তায় জিপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অপেক্ষা কাঙ্ক্ষিত রমনীর। অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে দূর হতে মেয়েলী হাসির চাপা সুর শোনা যায়। 

বাশ বাগানের আঁধারিতে সুরেলা কিছু ঠাহর করতে পারে না। বিরক্ত হয়ে বলে,

"কোথায় আনলি তোরা আমাকে? কি কালি অন্ধকার এখানে। বাড়ির ভেতরে চল শাপলা?"

"আরে সু্র আপা সবুর করো। সবুরে মেওয়া ফলে!"

রূপসার কথায় সুরেলা সন্দিহান গলায় বলে,

"কি খিচুড়ি পাকিয়েছো তোমরা? রূপসা?"

শাপলা শফি চাপা স্বরে হাসে। রূপসা তাদের চুপ থাকতে বলে। অন্ধকারে সুরেলা দুগাল টিপে বলে,

"ভাবীজান খিচুড়ি পাকাই নি তো। রিজ ভাই নিতে এসেছে আমাকে। বাড়ি ফিরবো না বলো?"

সুরেলা থেমে যায় তৎক্ষণাৎ। কিছু না ভেবে উল্টোপথে পা বাড়ায়। কি বাটপার সবগুলো! কারেন্ট চলে গেছে বিধায় গরমে অতিষ্ঠ হয়ে মাচালে বসেছিল দমকা বাতাস গায়ে মাখতে। তাকে হাঁটার কথা বলে..! রূপসা শাপলা টেনে ধরে সুরেলাকে। সুরেলা চাপা স্বরে ধমকায়। শাড়ি পড়ায় অনভ্যস্ত বিধায় টানাটানিতে মনে হয় শাড়ি খুলে পড়বে। সে ধমক দেয়,

"শাপলা শফি খবর আছে তোদের! আর রূপসা তুমি যাও তোমার ভাইয়ের সাথে। কেউ এভাবে দেখলে খারাপ ভাববে?"

"কেউ কিছুই ভাববে না। এই জায়গাটা অনেক নির্জন। কেউ আসবে না। তোমরা মন খুলে কথা বলো। আমরা আসছি !"

বলা সাঁড়া তাদের হাওয়া হওয়াও সাঁড়া। রূপসা দুয়েকবার হোঁচট খেলেও উত্তেজনায় মালুম করে না। সুরেলা পড়ে ফ্যাসাদে। চলেও যেতে পারছে না। হাতটা বাঁধা কারো হাতের বাঁধনে। সুরেলা নিজেকে স্বাভাবিক রেখে শান্ত গলায় বলে,

"বাড়ি ভর্তি মেহমান! কেউ দেখলে কি একটা বাজে অবস্থা হবে ভেবে দেখছেন?"

নওরিজ কনুই ধরে টেনে সুরেলাদের বাড়ির পেছনের সেই পুকুর ঘাটে নিয়ে যায়। সুরেলার গা ছমছম করে ওঠে। জায়গাটা দিনের আলোতেই বড্ড ভুতুড়ে শুনশান। এখন তো আঁধারির খেলায় মেতেছে। পুকুর হতে ব্যাঙের ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ ডাক ভেসে আসে। শ্বাস টেনে নিতেই শিউলি ফুলের মিহি ঘ্রাণ পাওয়া যায়। নওরিজ দুই বাহু ধরে সুরেলাকে মুখোমুখি দাঁড় করায়। পকেট থেকে মুঠোফোন বের করে আলো জ্বালায়। শাড়িতে সজ্জিত রমনীর আপাদমস্তক দেখে নেয়। বেগুনি রাঙা তাঁতের শাড়ি অঙ্গে জড়িয়ে কোমড়ে আঁচল বেঁধে নিয়েছে। রেশমী চুল খোঁপায় বাঁধা। একটা ফুল আনলে ভালো হতো। মাথায় ঘোমটা থাকলে নতুন বউ বউ লাগতো। নওরিজ আলো নিভিয়ে দেয়। কন্ঠ খাঁদে নামিয়ে গমগমে আওয়াজে বলে,

"ডার্লিং, লুকিং নাইস!"

'ডার্লিং' শব্দটা প্রথম প্রথম বখাটে পনা, লুচ্চা লুচ্চা শোনালেও এখন মন্দ শোনাচ্ছে না। সুরেলা জড়োসড়ো হয়ে এক কদম পিছিয়ে দাঁড়ায়। নওরিজ দু'কদম এগিয়ে দূরত্ব ঘুঁচিয়ে নিলো। তবে দুজনের শরীর স্পর্শ করে নি। সুরেলা ঘাবড়ায়। লোকটার হাবভাব সুবিধার ঠেকছে না। নওরিজ গম্ভীর সুরে শুধায়,

"মন খারাপ কেন?"

সুরেলা মাথা তুলে তাকায়। অন্ধকারে মুখাবয়ব অস্পষ্ট। তবে জ্বল জ্বল চাহনিতে নজর স্থির রেখে শান্ত গলায় জবাব দেয়,

"কই? কে বললো?"

পকেটে হাত গুজে খানিকটা ঝুঁকে আসে। আবারও গমগমে গলায় প্রশ্ন করে,

"যেই বলুক। মন খারাপ কেন সেটা বলো? সিন কিছু বলেছে?"

"ভাই কি বলবে?"

পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে সুরেলা। নওরিজ চুপ থাকে। সুরেলা চোখ উল্টে তাকিয়ে জবাবের আশায়। জবাব না পেয়ে বলে,

"কি হলো বলুন?"

"কিছু না। খেয়েছো কিছু?"

"হুঁ"

সুরেলার ছোট্ট জবাব।এতো শান্ত গলা আর তুমি সম্বোধনের বিপরীতে আজ তর্ক করার ইচ্ছে করছে না। নওরিজ ভ্রু উঁচিয়ে শুধায়,

"খাওয়ার শেষে ব্রাশ করেছো?"

সুরেলার মুখটায় বিরক্তির রেশ ফুটে ওঠে। নওরিজ সুক্ষ্ম চোখে চায়। ওই মুখখানা বলে দিচ্ছে ব্রাশ করে নি।

"প্রতিবার খাওয়ার পর ব্রাশ করা উচিত।"

সুরেলার মেজাজ খারাপ হবার পথে। এ খুঁতখুঁইত্যা লাট সাহেব সুধরানোর না। নওরিজ ডান হাত বাড়ায়। পেটের ডান দিকটায় গুঁজে নেওয়া আঁচল খুলে দেয়। সুরেলার চোখ যেন কোটর থেকে বেরিয়ে আসবে। নওরিজ মাহবুব ঘার বাঁকিয়ে ডাকে,

"রূপসা?"

"হ্যাঁ রিজ ভাই ব..."

থেমে যায় রূপসা। জিভ কামড়ে নিজের মাথায় গাট্টা মারে। শাপলা হায় হায় করে ওঠে। এই রূপসা আপা এতো বোকা ক্যান? রূপসা কাঁচুমাচু মুখে দাঁত দিয়ে নখ খুঁটে। এখন তাকে কে বাঁচাবে বাঘের ডেরা থেকে। 

"জিপে উঠ। পড়ে দেখছি তোকে! যা?"

ধমকে রূপসার মুখটা কাঁদো কাঁদো হয়ে যায়। শাপলাকে টেনে চলে যায় অন্যত্র।

সুরেলা চোখ মুখ খিঁচে নেয় নখের আঁচড়ে। পরপর আলতো হাতের ছোঁয়ায় কেঁপে ওঠে ঠকঠক করে। নওরিজ আঁচল খুলে ঘোমটা টেনে দেয় মাথায়। ভরাট কন্ঠে বলে,

"আষাঢ়ে ফোঁটা জারুল ফুলে আমার প্রথম ক্ষত! শুভেচ্ছা সুরেলা সালেহ।"

পরপর রুক্ষ অধর ছুঁয়ে দেয় ললাটে। মুখ নামিয়ে আনে গালে। নরম পেশব গালে আলতো ভাবে নাক ছুঁয়ে ঘ্রাণ শুষে নেয়। কাঁচা হলুদের গন্ধ যেন এখনো গায়ে লেপ্টে। সুরেলা যেন পানি থেকে স্থলে ছিটকে পড়া কোনো জলকন্যা। শ্বাস নেওয়ার জন্য ছটফট করছে। গালে মুখে আছড়ে পড়া উষ্ণ শ্বাস যেন আগ্নেয়গিরি। বাহু ঠেলে সরিয়ে দিতে চায়। নওরিজ গাল হতে থুতনিতে নাক ছুঁয়ে গলার ভাঁজে মুখ নামায়। রুক্ষ অধরের আলতো দোলায় পেরেশান করে যায়। 

"ইয়ু স্মেল নাইস ডার্লিং!"

হঠাৎ দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়ায় নওরিজ। সুরেলা চোখ মুখ খিঁচে কাঁপছে মৃদুমন্দ। শ্বাসের গতিবেগ দ্রুত! নওরিজ হাত বাড়িয়ে চোয়াল চেপে স্বাভাবিক গলায় বলে,

"এই ডার্লিং, অজ্ঞান হোস না যেন?"

সুরেলা জ্ঞান হারায় না। তবে নুইয়ে পড়ে। যেন নওরিজ সব শক্তি শুষে নিয়েছে। নওরিজ বাহুতে বেঁধে নেয়। শব্দহীন হেসে বুকের মাঝে লুকিয়ে নেয়। সুরেলা দূর্বল স্বরে বিড়বিড় করে বলে,

"লুইচ্চ্যা লোক! ঘরের লোক হওয়ায় কিছু বলাও যাচ্ছে না।"

—————

 পিনপিন নীরাবতায় ছেয়ে আছে আশপাশ। গাড়ির ইঞ্জিনের আওয়াজ শোনা যায়। মাঝে মাঝে দুয়েক কুকুরের ঘেউ ঘেউ। রূপসা আড়চোখে তাকায় নওরিজের পানে। রিজ ভাই কি রেগে আছে? বাড়ি নিয়ে গিয়ে অনেক বকবে? ইশ্ কি একটা লজ্জাজনক ঘটনা! সে কি এখন কথা বলে সব মিমাংসা করে নিবে? কিন্তু কিভাবে বলবে? লজ্জায় মুখ লাল হয়ে আসে। রিজ ভাই নিশ্চয়ই পঁচা মেয়ে ভাবছে তাকে!

"রিজ ভাই আসলে ইয়ে মানে স্যরি হ্যাঁ? আর জীবনেও হবে না। এই পিঙ্কি প্রমিজ?"

হঠাৎ গাড়ির ব্রেক কষায় রূপসা পড়তে পড়তে বেঁচে যায়। নওরিজ মাহবুব বাহু ধরে আগলে রেখেছে। ভয়ে জান পাখি যেন বেরিয়ে আসছিলো রূপসার । বুকে থুতু দিয়ে কিছু বলবে সম্মুখে মানব গুলোকে দেখে রগে রগে শীতল স্রোত বয়ে যায়। লোকগুলোর হাতে দেশীয় অস্ত্র চোখে পড়তেই রূপসার মুখ বিবর্ণ দেখায়। অস্ফুট স্বরে ডাকে,

"রিজ ভাই!"
·
·
·
চলবে.......................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp