ভেজা চোখদুটো স্থির হয়েছিল কিয়ৎক্ষণ। অল্প সময়ের জন্য বিদ্ধ হয়েছিল নীল চক্ষু তারায়। সহসা কী হলো বোঝা গেল না, শাওলিন চোখ নামিয়ে ফেলল। ডাগর চোখের সৌন্দর্য থেকে অশ্রুপূর্ণ জলধারাটা দুচোখের কার্নিশ বেয়ে ঝরতে লাগল। নীরব নিশ্চুপ বনে সমস্তই দেখছিল বনরক্ষী ব্যক্তিটা। বাঁহাতের বজ্র দৃঢ় চাপে কুঁকড়ে উঠেছিল নরম মুঠোটা। ইচ্ছে করছিল, ওই নারীর গাল ছুঁয়ে অশ্রু বিন্দুগুলো মুছে দিতে। গোলাপের আভা মেশানো নরম ওষ্ঠযুগলে খরতাপ ছুঁয়ে দিতে, চোখদুটোর মোহনীয় গর্ভে নিজের ধারালো ছুরির চোখদুটো বসিয়ে দিতে। অথচ, বনরক্ষক ব্যক্তিটি কিছুই যেন করল না। ডানহাত বাড়িয়ে তার মাথা ছুঁয়ে দিল। আলতো স্পর্শে হাত বুলিয়ে বুলিয়ে বলল,
- ক্ষমা করো। হয়ত বুঝতে পারিনি তোমার মা হারানোর গল্প আমার থেকেও ব্যতিক্রম। আমি ভেবেছিলাম তোমার কাছ থেকে সাধারণ কিছুই শুনব। এরকমটা শোনার প্রত্যাশায় আমি তোমাকে আহত করতে চাইনি। কেঁদো না শাওলিন।
মাথা কিঞ্চিত ঝুঁকিয়ে রাখা শাওলিন চোখদুটো উপরে তুলল। পাপড়িগুলো সিক্ত হয়ে অদ্ভুত রকম মায়া বিস্তার করছে। সেই ঐন্দ্রজালিক মায়া-মোহতে কিঞ্চিত অবগাহন করল বন মানুষ। মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়া স্পর্শগুলো ক্ষান্ত দিল সে। সে জানে এই নারীর মনে কী প্রশ্ন জেগেছে, ওইটুকু বিশুদ্ধ অন্তরে কীসের কৌতুহলী ফুল ফুটিয়েছে। চোখের চশমায় সামান্য বজ্রবিদ্যুতের ঝলকানি ফুটে উঠল, সেই ঝলকানির উপর জ্বলজ্বল করে ফুটল দুটো নক্ষত্র তারা। যাকে বলা উচিত ক্রিস্টাল বা স্বচ্ছ নীল নক্ষত্রজোড়া। গলার স্বর অদ্ভুত এক স্থিরতায় হিম হয়ে ফুটল, যেন কানের কাছে হিমবরফ ছুঁয়ে দিয়েছে কেউ,
- তুমি আজ ভ্যালিতে চলে গেলে এই কথাগুলো জানাতে পারতে না। আমিও জানার সুযোগ পেতাম না। আজ প্রথমবার মনে হলো, এমন কেউ আমার সামনে বসে আছে, যে বুঝতে পারবে শূন্যতার নির্মম অর্থ কী।
কথাগুলো শুনে সম্পূর্ণ নীরব হয়ে গেছে শাওলিন। নীরব হয়ে গেছে ওর চাহনিযুগল। এমন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, যেন নব অঙ্কুরিত কোনো পুষ্প বিশাল ছায়াঘেরা কোনো বটবৃক্ষের কাছে আশ্রয়টুকু পাচ্ছে। তার নির্ভরতার নিকট নির্ভয় খুঁজে নিচ্ছে। তার কথার কাছে মুগ্ধ শ্রোতা বনে যাচ্ছে সরল মন। লোকটা কথার মাঝে চাপা ইঙ্গিত বসিয়ে বলল,
- তোমার পরনের পোশাক অন্য কারোর কেনা নয়। এটা কেউ ভুলবশত ফেলে যায়নি। সেদিন রাতে যখন দুর্বৃত্তদের কাছ থেকে উদ্ধার করে আনি, তখন তুমি একপর্যায়ে ছিলে বেহুঁশ। তোমার পিঠে ছিল ছুরির আঘাত। গাছে পিঠ ঠেকিয়ে খালের দিকে নীরব দৃষ্টিতে তুমি তাকিয়ে ছিলে। তুমি কী জানো? সেদিন তোমার জামার কিছু অংশ সামান্য ছিঁড়ে গিয়েছিল?
মাথা থেকে হাতটা সরিয়ে নিল শোয়েব। অর্ধ খাওয়া কফির কাপটাও সন্তপর্ণে রেখে দিল ট্রেতে। পুরো ব্যাপারটা কয়েক সেকেণ্ডের জন্য ঘটলেও এই সেকেণ্ডের অঙ্কে একবারও চোখ নিচু করেনি শাওলিন। অপলক নিষ্পাপ চোখে তাকিয়ে আছে সমুখের এই সৌম্যকান্তি পুরুষটির দিকে। যাকে সে দলের ছয়জনের চাইতেও বেশি, বড্ড ভয়ংকর রকম বেশি বিশ্বাস করে ফেলেছে। চোখে ভাসছে ফাঁকা গাড়িতে সেলিমের চাহনি, এখন চোখে ভাসছে এই পুরুষের অন্তর্দৃষ্টি। দুটো দৃষ্টির পরিমাপ এতো অসংলগ্ন, এতো উচুঁ-নিচু, এতো গড়মিল সম্পণ্ণ যে, শাওলিন আজ স্পষ্ট বুঝতে পারল একজন পুরুষের চোখ তার আদর্শপূর্ণ ব্যক্তিত্বের প্রতিচ্ছায়া। যে ছায়ায় একজন নারী যেমন সুরক্ষিত, সে ছায়ায় গোটা এক প্রজন্ম নির্ভরতা খুঁজে পায়। শোয়েব ফারশাদ বইটা তুলে নিয়ে কম্বলটা পা থেকে সরিয়ে নির্লিপ্ত পদক্ষেপে চলে গেল। যাওয়ার আগে গলা উচ্চ করে গফুরের উদ্দেশ্যে বলে গেল,
- রাতের খাবার খাইয়ে তাকে ঘুমোতে পাঠাবেন। হারিকেনগুলো নেভানোর দরকার নেই। প্রত্যেকটাতে কেরোসিন ভর্তি করে দিয়ে যাবেন। বাংলোতে অন্ধকার থাকুক এটা আমি পছন্দ করব না।
এরপর ভারী, দৃঢ়, অকপট চিত্তের পদ গর্বে একজোড়া পা নির্দিষ্ট ঘরে মিলিয়ে গেল। দরজা চাপানোর ক্যাঁচ করে মৃদু আর্তনাও ফুটল। কিন্তু অখণ্ড নীরবতায় শান্ত শাওলিন বাক্যস্ফুরণ ঘটাল না। যে সমীকরণে আজ সে অমীমাংসিত, সেই সমীকরণের উত্তর কিছুটা হলেও জানা। ভারি শ্বাস ফেলে পাশের ওম জড়ানো কম্বলটা টেনে নেয় শাওলিন। সমস্ত গায়ে কম্বলটা জড়িয়ে নিতেই পুরুষোচিত দেহের খরোত্তাপ আপন স্পর্শে যেন অনুভব করল। কাঠের দেয়ালে পিঠ দিয়ে দু হাঁটু বুকের কাছে ভাঁজ করে তাতে থুতনি রাখল সে। বৃষ্টির হিম মাখানো ভেজা বাতাস ওর কালো চুলে, ওর কোমল ঠোঁটে, ওর কৃষ্ণাভ চোখে বেপরোয়া দুষ্টুমি চালাল। মনে হলো, এই দুষ্টু বুনো হাওয়া বনের বনমানুষটার মতোই বোধহয় দুষ্টু।
—————
রাতের চাদর ফুঁড়ে ফরসা আলোক রেখা ফুটল। পূব আকাশ থেকে ছড়িয়ে পড়ল সোনা মিঠে রোদ। পাখির কিচিরমিচির মত্ত শোরগোলে ঘুমটা টুটে গেল শাওলিনের। আলস্য মাখানো তন্দ্রায় বিছানা ছেড়ে উঠে গেল। বাইরে ধূ ধূ প্রান্তরের মতো সৌন্দর্য বিকিরণ করছে মুক্ত আসমান। আকাশি নীলাভ রঙে কেমন যে অপরূপ লাগছে! শাওলিন নিজের শব্দভাণ্ডারে ব্যাখ্যা করবার শব্দ খুঁজে পেল না। হাতমুখ ধুয়ে চুলটা এলোমেলো হাতে বাঁপাশে বেণী করল ও। চিরুনি বিহীন বেণীটা ‘ম্যাসি হেয়ার ব্রেইড’ এর ন্যায় অল্প অল্প চুলে কানের দুপাশে, মুখের উপর লুকোচুরি খেলছিল। ঘর থেকে বেরিয়ে ডাইনিং স্পেসের কাছে যেতেই হঠাৎ পা থমকে দাঁড়াতে হল। বিস্মিত আঁখিজোড়ায় দেখল, অদূরের ঘরটা থেকে সামান্য দৃশ্য উন্মোচিত হয়েছে। মেঝে ছুঁই ছুঁই পর্দাগুলো বাতাসে হুটোপুটি খেয়ে মাঝখানে যে ফাঁকটুকু সৃষ্টি করছে, তাতে দেখতে পাচ্ছে ওই মানুষটা গফুরের হাতে হটব্যাগটা ফিরিয়ে দিল। যেটা এতোক্ষণ শার্ট উন্মুক্ত সুঠাম দেহের ডানকাঁধে ব্যবহার করছিল। এখনো ওই জায়গাটা ফোলা, কালশিটে, প্রায় নীলবর্ণ হয়ে আছে। গফুর মিয়া আন্ঞ্চলিক ভাষায় শুধিয়ে উঠলেন, যার অর্থ ছিল,
- দুপুরে থাকবা না? একেবারে দুপুর পর্যন্ত থাইকা যাও? এই অবস্থা নিয়া গাড়ি চালাইতে পারবা? সাজেকের রাস্তা তো অতো সোজা না!
কথাটাকে সম্পূর্ণ খারিজ করে দিয়ে সে একটা ছোট্ট শিশি বের করল। ডাফেল ব্যাগেই বোধহয় এককোণে সঞ্চিত ছিল। ছোট্ট কাঁচের শিশিটার মুখে একটা সিরিঞ্জ বিদ্ধ করল মানুষটা। হাতের দক্ষ কৌশলে পুরো সিরিঞ্জটা একটানে ভর্তি করে ফেলল। দূর থেকে দৃশ্যটা ঢোক গিলে দেখছিল শাওলিন। এ কেমন ব্যাপার আল্লাহ্! নিজেরটা নিজেই ইনজেকশন রেডি করছে! কী ভয়াবহ! ওই লম্বা মোটা সূঁচটা কী নিজেই পুশ করবে নাকি? প্রশ্নগুলো যখন আনমনে উদগ্রীব চিত্তে ভাবছে শাওলিন, তখনই ও দেখল, সত্যি সত্যি-ই বাঁহাতের কৌশলে সিরিঞ্জটা দক্ষভাবে ধরেছে সে। চোখের পলকে চট করে পুরো সিরিঞ্জটা ব্যথাতুর স্থানে বিঁধিয়ে নিয়েছে। দেহে সম্পূর্ণ ঔষুধটা পুশ করার পর গফুরের হাতে দিয়ে ফাঁকা শিশি, ভাঙা সূঁচ, ব্যবহৃত সিরিঞ্জটা দিয়ে দিল সে। মনে হচ্ছিল, এরকম ব্যথানাশক ইনজেকশনে স্বতঃস্ফূর্ত দক্ষ লোক ইনি। সামান্য চোখ কোঁচকানো, হাতের কাঁপুনি কোনোটাই একবিন্দু ঘটেনি। শিশিটা যে তীব্র অসহনীয় ব্যথা কাটাতে ব্যবহৃত হয়, তা ওই কৌটো দেখেই চিনতে পেরেছে শাওলিন। পায়ে সেলাইয়ের যন্ত্রণা যখন হয়েছিল, তখন এরকমই একটা ব্যথানাশক ছোট্ট শিশি দেখেছিল ও। গফুর মিয়া ব্যস্ত পায়ে বাইরে বেরোলে শাওলিনকে অমন দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন,
- ঘুম থেকে গেছ? আমি ভাবছিলাম তোমারে ডাকতে যাব। দাঁড়াও আমি এখুনি চা পানি নিয়ে আসতেছি।
কথাটা বলতেই কর্মব্যস্ত গফুর মিয়া দ্রুত কাজে ছুটে গেলেন। এদিকে গফুরের গলা শুনতে পেয়েছিল শোয়েব। মাথা ঘুরিয়ে পিছু চাইতেই পর্দার ফাঁক গলে অদূরে থাকা নারীটির দিকে পড়ল। ওর চোখ তার দিকে প্রশ্নচিহ্ন ঝুলিয়ে তাকিয়ে আছে। যেন জিজ্ঞেস করতে চাইছে, এমন ভয়ংকর কড়া ডোজের ইনজেকশন কেন? এতো দক্ষ হাতে ইনজেকশন দেওয়া কীভাবে শিখল? চামড়া, মাংস, রক্তনালীতে মোটা সূঁচের ব্যথাটা অনুভূত কী হয় না? বড় অদ্ভুত লাগল শাওলিনের। বড় অদ্ভুত ঠেকল। কাঁচের গ্লাসটা পানিভর্তি করে চুপচাপ চলে গেল।
—————
সকালের নাশতাটা সমাপ্ত করেই দলবল সবাই বেরিয়ে গেল। পরিষ্কার, মসৃণ, পাকা পাহাড়ি সড়কের সাজেক রাজ্যে আপন মনে ঘুরতে লাগল সবাই। কেউ কেউ গেল সেনাদের হেলিপ্যাডে, সেখান থেকে সূর্যোদয় পূর্ণাঙ্গ রূপে দেখবে বলে। কেউ গেল ছোট ছোট কাঠের স্টলে চা-কফি-গল্প পেটে চালান দিতে। রাস্তায় ভ্রমণপিয়াসী পর্যটক কম। এখনো ঘুমের আলস্য ত্যাগ করে জেগে উঠেনি শহুরে মানুষগুলো। হাটুঁ পর্যন্ত ঢাকা লং কালো টিশার্ট, নিচে জিন্স কাপড়ের ঢোলা প্যান্ট, গলায় কালো ওড়না ঝুলিয়ে দুহাত বুকে ভাঁজ করেছে শ্রেষ্ঠা। নতুন কেনা স্নিকার জুতোয় সাজেকের ধূলোহীন স্বচ্ছ রাস্তাটায় শান্ত মনে হাঁটছে। ডানপাশে রোজা, বাঁপাশে অধরা। অধরা এখানে আসার পর শাড়ির বেশভূষা পালটে ঢিলেঢালা সুতির সালোয়ার-কামিজ পড়েছে। ল্যাভেণ্ডার রঙের কামিজ, সঙ্গে সাদা রঙের পাজামা ও ওড়না। বতর্মানে ওড়নাটা হিমেল বাতাসে দুলে দুলে উড়ছে। প্রকৃতির নীরবতার মাঝে প্রথম শব্দ করল অধরা,
- শোয়েব খুব সুন্দর একটা জায়গা নির্বাচন করেছে। ওর বাংলো থেকে কয়েক কিলোমিটার ড্রাইভ করলেই এতো সুন্দর পর্যটক কেন্দ্র। এতোদিন শুধু সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি, ভিডিয়োগ্রাফিতে বাংলাদেশের এই মেঘের রাজ্য দেখেছি। এখন মনেহয়, জায়গাটায় আসা হলে মন্দ হয় না। চমৎকার সুন্দর!
পাশ থেকে শ্রেষ্ঠা মৃদু ঠোঁটে হাসি দিল। মনেপ্রাণে ও নিজেই বিশ্বাস করছে, নিজ দেশের প্রাকৃতিক লীলাভূমিগুলো বড্ড সুন্দর। শুধু সৌন্দর্য দেখার চোখদুটো আল্লাহ তা'য়ালা সকলের মাঝে বোধহয় দেননি। তাই তো মানুষ যত্রতত্র সৌন্দর্য হরণের জন্য বদ্ধপরিকর হয়ে নেমেছে। ত্রাস, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, শ্লীলতাহানী সবকিছু ছড়িয়ে দিয়েছে। খাগড়াছড়ি জেলাটাও বাদ পড়েনি এই তালিকাভুক্ত থেকে। বরং, এখানকার গল্প বোধহয় অন্যান্য জেলার চেয়ে বড্ড ভিন্নরকম। ডানপাশে কালো জমিনের উপর সাদা ফুল তোলা প্রিন্টের কূর্তি পড়েছে রোজা। লিনেনের কাপড় বলেই হয়ত হাতের কাছে ঢোলা স্লিভটা বাতাসে ফড়ফড় করে উড়ছে। জামার দুদিকে দুটো ইউনিক সিস্টেমে পকেট থাকায় সেই পকেটে হাত গুঁজে ভারী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
- আজকেই আমাদের শেষদিন। কেমন জানি শূন্য শূন্য লাগছে। এই জায়গাটা থেকে এতো ভয়ংকর ভয়ংকর অভিজ্ঞতা পেয়েছি; অথচ এখন মনে হচ্ছে জায়গাটা মায়া লাগিয়ে দিল।
ভূতের মুখে রাম রাম শোনার মতো ঝট করে পাশে তাকাল শ্রেষ্ঠা। ভ্রুঁ দুটো কিঞ্চিত প্রশ্ন-বিভোর করে ডানে তাকিয়ে বলল,
- ভুলে মাথায় বারি টারি খেয়েছিস নাকি? তোর কথা শুনে রোজা হায়দারের চটান চটান ভঙ্গি মনে হচ্ছে না। তুই কে? সত্যি করে বল।
- যা তো, ফালতু ফাজলামি করিস না। আমার কাল থেকেই মন খারাপ। ওই একটা ফালতু ঘটনার হামলা ছাড়া আমাদের সাথে পরবর্তীতে আর কোনো কিছুই হয়নি। কটা দিন স্যারের বাড়িতে ভালো কাটল। অধরা আপু, তাহিয়া আপু, বাকি আরো দুজন, দাদী সব মিলিয়ে খারাপ কাটেনি। এখন ওটার জের ধরে এবারের অ্যাডভেঞ্চারটাকে তো আনসাকসেসফুল ঘোষণা দেয়া যায় না।
এভাবে দুই বান্ধবির কথা চলতে থাকলে বাঁদিক থেকে সামান্য হাসলো অধরা। দুহাত কোমরের পেছনে পিছমোড়া করে বেঁধে সামনে হাঁটতে হাঁটতে ভাবল, এদের কাউকেই ও চেনে না। আবার কোনোদিন দেখা হবে কিনা তাও জানে না। তবু তাকদিরের লিখনে আজ অজ্ঞাত থেকে জ্ঞাত পরিচয়ে চিনছে অধরা। কেমন হবে যদি ওদের সঙ্গে চমৎকার একটা বন্ধন জুড়ে যেত? যদি ওরাও এভাবে ছুটির অবকাশে খাগড়াছড়ি চলে আসতো? শোয়েব তো এখানে একা একা থাকে। নিঃসঙ্গ, ব্যাচেলার মানুষ। ফাঁকা বাংলোটা ভূতের বাড়িতে ধূঁ ধূঁ করে। পেছনের জঙ্গলটা, জঙ্গলের পরে পুকুরের মতো দিঘিটা, দিঘির ওপারে আরেক সীমানার দৌরাত্ম। ইশ! কী সুন্দর হতো যদি এই প্রকৃতির মাঝে থাকার জন্য যদি শোয়েবের একটা রমণী এসে যেতো! কল্পনার চোখে দেখল অধরা, এমন নৈসর্গিক ভূমিতে তার ব্যাচেলার, হ্যাণ্ডসাম দেবর তার প্রেয়সী বউ নিয়ে চমৎকার দিন কাটাচ্ছে। অথচ, সেই নারীটাকে নির্বাচন করতে হিমশিম খাচ্ছে ও। চোখ ঘুরিয়ে শ্রেষ্ঠার দিকে তাকাল অধরা। যে কথাটা বলি বলি করেও বলা হচ্ছিল না। সেই কথাটা হালকা কাশি দিয়ে বলে উঠল,
- তোমাদের মধ্যে বড় কে?
রণে ভঙ্গ দিয়ে ডান থেকে মুখ সরিয়ে বাঁদিকে তাকাল শ্রেষ্ঠা,
- আমি মেয়েদের মধ্যে সিনিয়র। এরা তো দুধের পিচ্চি। এই তো সেদিন ক্যাম্পাসে কচি শিশুদের মতো ভর্তি হল। আর দেখুন এই কদিনেই এরা কেমন অসভ্য, বর্বর, পাকনা হয়ে গেছে। সিনিয়রকে সম্মান করে না, শ্রদ্ধা জানায় না। প্রত্যেকটা পাষণ্ড!
বড় বড় নীতিবাক্য শুনে কথার খই ফোটাল রোজা। চটান চটান ভঙ্গির রোজা হায়দার হয়ে সপাটে উত্তরটা দিল,
- ছোটরা সবসময় বড়দের দেখেই শেখে অধরা আপু। আমরাও বড়দের দেখে দেখে শিখেছি। বড়রা যদি নিজেরাই অসভ্য, বর্বর, এমন মিথ্যুক হয়; তাহলে তো ছোটরা ছাইপাঁশ সব গিলবেই।
- তোরে ধরে না... ধাম করে এক ঘা লাগানো দরকার! দাঁড়া নাযীফ আসুক। ওকে দিয়ে তো. কে গ্রিল চিকেনের শিকের মতো আগু. নে ঝল. সাবো।
দুই অসম সখীর তেরছা যুদ্ধে আবারও বাঁধ বসালৌ অধরা। আরেকটু সাবধানে কথা গুছিয়ে বলল,
- তোমরা সবাই তো মনেহয় সিঙ্গেল জীবন পালন করছ? ঘুরাঘুরি, আড্ডা, সবার সঙ্গে প্যাচ-আপ।
এবারের প্রশ্নটা রোজা দিয়ে উঠল। সেই উত্তরটা গোছগাছ করে পরিপাটি অর্থে বলল,
- ছয়জন বতর্মানে সই করা সিঙ্গেল আপু। তবে একজনের ব্যাপারে নিশ্চিত না। ওর ব্যাপার নিয়ে আমরা অতো ঘাঁটাঘাটি করি না। যে যারটা ভালো বোঝে।
কথার ধরণটা পছন্দ হল না শ্রেষ্ঠার। কাকে ইঙ্গিত করে কথাগুলো বলছে তা বুঝতে পেরেছে ও। রোজার দিকে চোখটা ঘুরিয়ে চাপা ক্রোধ বুঝিয়ে কৃত্রিম হাসিতে বলছিল,
- কাউকে নিয়ে মানুষের ঘাঁটাঘাটি করা উচিতও না ছোট বোন রোজা। কাউকে নিয়েই বাড়তি মাখামাখি ঠিক না। সবারই তো প্রাইভেসি ট্রার্ম বলে একটা ফেজ থাকে, জানো তো?
দাঁত কিড়মিড় করে বলার ভঙ্গিটা একমাত্র রোজা ঠাহর করতে পারল। বুঝতে পারল না শ্রেষ্ঠার বাঁপাশে থাকা অধরা। শ্রেষ্ঠা নিজের চোখটা সামনের দিকে ঘুরিয়ে কিছুটা ঠাণ্ডা সুরে বলল,
- আরো হাঁটবেন আপু? নাকি পাশের স্টলে বসে এক কাপ চা খাওয়া যাক?
- হ্যাঁ হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। চলো।
পরিস্থিতিটাকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে চায়ের একটা স্টলে রওনা দিল। কিন্তু পথিমধ্যে রোজার একটা কল চলে আসায় ও কিছুটা আলাদা হয়ে দূরে চলে গেল। একটা ফাঁকা স্থান দেখে পাহাড় থেকে পূর্বদিকের সূর্য মুখোমুখি করে বসে পড়ল দুজন। চায়ের পেয়ালা আসতে আসতে শ্রেষ্ঠা একটা সরলকণ্ঠে গুরুত্বপূর্ণ কথা তুলল,
- আপু, কিছু মনে না করলে একটা প্রশ্ন করব?
- করতে পারো। সুন্দর প্রশ্ন হলে আমি উত্তর দিতে ভালোবাসি।
হালকা হাসল শ্রেষ্ঠা। কণ্ঠে শান্ত ভাব ফুটিয়ে খুব সাবধানে একদফা প্রশ্ন রেখে দিল,
- আপনি কী শাওলিনের ব্যাপারে কিছু জানতে চান?
আচমকা মুখের উপর অমন সত্যিটা শুনে হতভম্ব হয়ে যায় অধরা। শ্রেষ্ঠার দিকে চট করে মুখ ঘুরিয়ে ঠেলেঠুলে একটা হাসি দিচ্ছিল। কথা বলতে গিয়ে আমতা আমতা করে বলল,
- ক-ক-কী ব-বলছ তুমি? মানে শাওলিনের ব্যাপারে . . আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না।
থতমত ভঙ্গিটা একনজরে দেখে বাকিটা বুঝে নিয়েছে শ্রেষ্ঠা। ঠোঁটদুটো জিভের আগায় আলতো ভিজিয়ে কণ্ঠ সিক্ত করে বলল,
- দেখুন, আমি মিথ্যে বলব না। আমার ভেতরে লুকোচুরির ব্যাপারটা নেই। রোজার ভেতরে যতটা না বুঝে থাকার ভান পাবেন, আমার ভেতরে তা একটুও নেই। আমি প্রথমদিনই কিছু অঙ্ক মিলাতে চেয়েছি। পরবর্তীতে সেই অঙ্ক কিছুটা ভুল হয়েছে, কিছুটা ঠিক হয়েছে; কিন্তু একেবারে হাল ছেড়ে দেয়া হিসাব কষিনি। শোয়েব স্যার অসম্ভব ভালো মানুষ। একজন ডিসেন্ট, জেন্টেলম্যানের সংজ্ঞা যেরকম হওয়া উচিত; অথবা একজন পুরুষের ভেতর কী রকম পার্ফেক্ট পার্সোনালিটি থাকা লাগে, এটা আমি প্রথমদিনেই উনাকে দেখে টের পেয়েছি। কিন্তু টের পাইনি শুধু একটা কারণ। উনি কেন কাল আর্মি এসকর্টটা পোস্টপন করালেন না? উনার একটা কলে পুরো আর্মি প্রোটোকল আধঘণ্টার অ্যাডজাস্টমেন্টে দাঁড়িয়ে যেতো। সেখানে উনি এসকর্ট মিস দিয়ে পথে আঁটকে গেলেন। সঙ্গে উনি ওকে ---
হঠাৎ মাঝপথে কথা আঁটকালো অধরা। চোখমুখ শান্ত স্বাভাবিক দেখালেও কণ্ঠে একরকম আত্মবিশ্বাস রেখে বলল,
- ও তোমার বান্ধবিকে কিছুই করবে না। আমি তোমাকে কাগজে কলমে সই করে দিচ্ছি। যদি তোমার বান্ধবি সামান্য বিব্রত হবার অনুযোগটাও করে, তবে আমি আমার পরিচয় পরিবর্তন করে ফেলব। তোমাদের স্যার সাহেব সম্পর্কে আমার ছোট দেবর হন। কিন্তু বয়স বিচারে তাকে আমি বড় ভাই হিসেবেই মানি। আমি নাম ধরে মানুষটাকে ডাকছি বলে দূর্বিনয় ভেবো না। ও নিজেই আমাদের চার ভাবীকে এই জোরপূর্বক অনুমতিটা দিয়েছে। আমরা কেউ স্পর্ধা থেকে বয়সে বড় একজনকে নাম ধরে ডাকি না। তুমি কী বুঝতে পারছ? যেখানে আমি ভাবী হয়েই তার বিরুদ্ধে ওরকম ভয়ংকর কথা শুনতে পারি না; সেখানে ওর ভাই-দাদী-চাচারা এসব শুনলে কেমন প্রতিক্রিয়াটা দিবেন?
- গোস্তাখি মাফ করবেন আপু। আমি শুধু আমার চিন্তার কারণগুলো বলছি। আপনার দেবর হন, বয়সে বেশ বড়, তেমনি জানা আমার বোনই হয়। বয়সে আমি ওর বড়। ওর জীবনের প্রত্যেকটা ঘটনা আমি জানি। আমি জানি ওর জন্য এই মুহুর্তে ঢাকায় পৌঁছালে কতটুকু ঝামেলা ভিড়মি খেয়ে পড়বে। সেখানে আপনি যে কথাটা বোঝাচ্ছেন, আমিও সে কথাটাই ইঙ্গিত করে বোঝাচ্ছি। প্লিজ, থামান! এভাবে এসব খাটে না। প্রথম দেখায় পছন্দ হয়ে যাওয়া এগুলো শুধু সিনেমাতেই সম্ভব। বাস্তব জীবনে কোনোদিনও সম্ভব না। যদি সম্ভব হতো, তাহলে পৃথিবীতে বিচ্ছেদের ঘণ্টা ঢং ঢং করে ভয় ছড়াতো না। মানুষ কোনোদিন নিজ মুখে বিচ্ছেদ চাইতো না। এতো সহজ না অধরা আপু, সোসাইটির চাপ্টার এতো ইজি না।
- তুমি বলেছ তুমি বিভিন্ন সামাজিক কার্যক্রমে জড়িত। নানাভাবে মানুষের সঙ্গে মেশো, তাদের জীবনমুখী গল্প শোনো। সেখানে কী এটা কোনোদিন শোনোনি আল্লাহর এই দুনিয়ায় সবকিছুই অনিশ্চিত? তুমি আজ বাঁচবে না মরবে সেটা তোমার তাকদির লিখে দেয়া এক স্রষ্টা ব্যতীত আর কেউই জানবে না। সেখানে সেই স্রষ্টাই যদি জীবনের গল্পটা এরকম করে সাজিয়ে রাখেন, সেখানে তুমি-আমি বলার কে?
ঝট করে বসাটা থেকে দাঁড়িয়ে পড়ল শ্রেষ্ঠা। যিনি জানে না, বোঝে না, ঘটনা কোনোদিন শোনেনি; তার কাছে এইসব দুদিনের রঙিন ঘটনা মিষ্টিমধুরই লাগবে। কিন্তু মুদ্রার ওপিঠের গল্প কতটা নৃশংস, রক্তাক্ত সেটা তো উনি জানবেন না। শাওলিন আর কখনো কোনো বাজে পরিস্থিতির সম্মুখীন হোক, এটা কোনোভাবেই আর চায় না শ্রেষ্ঠা। হাতের ফোনটা প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে বেশ তীক্ষ্ম গলায় বলল,
- মার্জনা চাইছি অধরা আপু। মনে হচ্ছে আমাদের আলাপ এখানেই শেষ করা দরকার। কথা বাড়ালে সমস্যা বাড়তে পারে, কথা কাটাকাটি হতে পারে, এমন ছেলেমানুষি কাজকর্ম আমার ভালো লাগে না। শাওলিন যদি পজিটিভ সাইন দেখাতো, আমি অবশ্যই সাপোর্ট করতাম। কিন্তু জোরপূর্বক পজিটিভ সাইন আনানোর ব্যাপারে আমি একটুও রাজি নই। উনি সিনিয়র লোক, সিনিয়রের মতো থাকুক। এখানকার উচ্চপদস্থ বনবিভাগের ডিভিশনাল ব্যক্তি, সেটা এখানেই মজুত থাকুক। আমি মনে করি, শাওলিন যদি নিজ মুখে আমার সামনে সামান্যতম আভাস দিতো; আমি মনেহয় নির্দ্বিধায় আপনাদের সাথে আলাপ জমাতে পারতাম। কিন্তু ওর প্রতিক্রিয়া জিরো। উলটো দিকে প্রতিক্রিয়া আমার মনে হচ্ছে হাই। তাই কোনটা ঠিক, আর কোনটা বেঠিক এটা সময়ের হালে ছেড়ে দিন। আমরা এবার কাকতলীয় ভাবে এদিকে ট্যূর দিতে এসেছি; এটাকে অপ্রত্যাশিত ভেবেই স্বাভাবিক ভাবে নিন।
কাট কাট গলায় কথাগুলো বলে পা চালাল শ্রেষ্ঠা। দু কদম এগোতেই হঠাৎ পা থামিয়ে মাথা পিছু ঘুরাল। অধরা অমন চাঁছাছোলা কথা শুনে মুখ বিষণ্ণ বানিয়ে ফেলেছে। তাহিয়ার সঙ্গে যা আলাপ হয়েছিল, যে ভাবনায় অন্তরে খুশি পাচ্ছিল, সেটা যে এভাবে ভষ্ম হয়ে যাবে তা একটুও ভাবেনি ও। অধরার পাংশুটে মুখে নজর বুলিয়ে শ্রেষ্ঠা কিছুটা শান্ত হল। গভীর করে দম টেনে সেটা সশব্দে ছাড়তে ছাড়তে বলল,
- শাওলিন অ্যাঙ্গেজড অধরা আপু। যেকোনো সময় বিয়ের দিন-তারিখ ফিক্সড হবে। এমন অবস্থায় বুঝতেই পারছেন, কেন আমি একা ওই বাংলোতে থাকাটা নিয়ে রাগ করছি। জানি উনি কিছুই করবেন না। উনি ওরকম মানুষ-ই নন। কিন্তু মানুষের ঠোঁট আর জিভ নৈতিকতা মানে না। সত্যটাকে মিথ্যা বানাতে কিছু মানুষের জুড়ি নেই। আমি চাই না একজন মেয়ে হিসেবে যে কথাগুলো মানুষরা অবিবেকের মতো বলে; সেটা ওর ক্ষেত্রে বলুক। তাছাড়া ওর শ্বশুর বাড়ির পরিবারটাও সুবিধার না। এবার যে ও খাগড়াছড়ি ট্যূর দিচ্ছে, এটা শুধুমাত্র আমার কারণে। ওর পরিবার আমাকে অন্ধবিশ্বাস করে। এই বিশ্বাসটা মেকি হতে দিবেন না। বিয়ের আগে ওর জীবনে যতটুকু দিন অবশিষ্ট আছে, আমি চেয়েছি একজন আত্মাসম্পর্কীয় বড় বোন হিসেবে সেটা পালন করতে। ওর সঙ্গে আমার রক্তের বন্ধন নেই। চলি।
আর দাঁড়াল না নূপুর ইসলাম শ্রেষ্ঠা। মাথা সামনে ঘুরিয়ে জায়গাটা ছেড়ে রাস্তায় উঠে গেল। পিছু ফিরে দেখল না, কতটা ভয়ংকর ভাবে বিস্মিত হয়েছে অধরা! কতটা সাংঘাতিক ভাবে ধাক্কা খেয়েছে ও। শাওলিন অ্যাঙ্গেজড্? কিন্তু ওর হাতে চিহ্ন কই? আঙুলে আংটি কোথায়?
—————
পূর্ণ প্রতিবেদন আকারে একটা রিপোর্ট সাজিয়েছে রাফান সিদ্দিকী। সেখানে সাতজনের নাম, ঠিকানা, যাবতীয় তথ্যাদি সংগ্রহ করে রেখেছে। ফাইলটা পাঠিয়ে দিয়েছে তদন্ত দলের কাছে। এরই উপর ভিত্তি করে আগামী থেকে ঘটনাগুলোর জট মীমাংসা হবে। কিন্তু কবে হবে, তার কোনো সঠিক জ্ঞান নেই। এটা বাংলাদেশ। এখানে মানুষ মরলে বিচার হয় আল্লাহর দরবারে। পৃথিবীর ন্যায়-অন্যায় পরিমাপ হয় খারাপের দাড়িপাল্লা দিয়ে। সেখানে কবে “সাত পর্যটকের উপর রহস্যময় হামলা” শিরোনামটা উন্মোচিত হবে জানা নেই। সবকিছু জায়গামতো পৌঁছে দিয়ে নিজের গাড়িতে উঠল রাফান। গন্তব্য এখন শোয়েব ফারশাদের বাসস্থান। ইঞ্জিন চালু দিয়ে ড্রাইভ স্টার্ট করতেই ব্লু টুথে যুক্ত হল মোশাররফ। ঘড়ঘড়ে কণ্ঠে কর্কশ গলাটা বেজে উঠল,
- শূয়ো... বাচ্চারা আবার উনারে অ্যাটাক করছে। জীপের ডানপাশ পুরা ডাম্প।
- কোন শূ... দল? বংশধর তো একটা না।
- শনির আখড়ারটা। আপনারে তো জানাইছিলাম, ওই নাটকীর পুতে আকাম বাজাইন্না ইসকুরু খুঁজতাছে। হেশেলা পাইছে একখান সুযোগ, মারছেও হালার ব্যাডা কোপ। স্যারের ভুরু কাইট্টা গেছে, শইল্যে আর কুনো ব্যথা পাইছেনি হেইডা শার্ট খুইলা ব্যায়ামে খাড়াইলে দেহা যাইব।
- পার্থ শুনলে তোর চাকরি নট করবে দেখিস। সাবধানে থাকিস তুই। তোর আসল গুরু পার্থ ছিল, তুই রাঙামাটি থেকে ঘুরান্টি দিয়ে এসে সব ভুলে গেছিস। পার্থ তোকে বারবার সতর্ক করে বলেছে, তুই যেন ছায়ার মতো উনার সাথে সাথে থাকিস। তুই যে কতটুকু বাটপার, আর বাটপারের দারোগা সর্দার সেটা পার্থ তোকে ভালোভাবে বুঝাক। ও আসুক।
শুনে মনটা দমে গেল মোশাররফের। ডান গালটা চুলকাতে চুলকাতে বলল,
- আপনে স্যার খাঁটি ইবলিশ। কষ্ট কইরা খবরটা আমি দিলাম, স্যারের জীপটা নিয়া গিয়া মাইক্কা মদনের দোকানে ফিট করাইতে আনলাম, আপনে আমারে এইহানেও টাউড দিতাছেন।
মোশাররফের বেঢপ কথায় ছ্যাঁত করে উঠল রাফান। কঠিন এক হুঙ্কার দিয়ে মোশাররফের কান বাজিয়ে বলল,
- তোকে আমি চুমা দিব, ব্যাটা বদমাইশ! ভ্রুঁ কেটেছে, ইঞ্জুর্ড হয়েছে এই খবর তুই যত্ন করে পাঠাস? ধাওয়া পালটা ধাওয়া অ্যাটাক করে ওদের তুই কচুকাটা করবি, তা না, আমার কানে এখন ইঞ্জুরির গপ্পো দিচ্ছিস!
চোখ কুঁচকে কান থেকে ফোনটা দূর করেছে মোশাররফ। “খাইছে রে, চেতছে!” মনে মনে কথাটা বলতেই তাড়াতাড়ি প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বলল,
- স্যার একটা গুরুত্তুপূন্ন বিষয়। উনার সাথে ওই সুন্দরী কে? এনারেই কী স্যারে উদ্ধার কইরা তুইলা আনছে? গফুর বুইড়া দেহি ‘মা’ কইতে অজ্ঞান। আজকা বিকালেই নাকি ঢাকা চইলা যাইতেছে?
—————
- “ আবার কখনো দেখা হবে? ”
প্রশ্নটা করে উঠলেন দাদী ফাতেমা নাজ মির্জা। প্রশ্নটা করেছেন সামনে টোটব্যাগ গুছাতে থাকা মেয়েটির প্রতি। বিছানায় সমস্ত জড়ো করা জিনিস থেকে চুলের কাটাটা সবে ব্যাগে পুড়ছিল, চোখ উঠিয়ে দরজামুখো তাকাল সে। ঠোঁটে আন্তরিকতার হাসি টেনে সরল কণ্ঠে বলল,
- যদি কখনো সুযোগ হয়, একবার ঢাকায় আসবেন। আমি খুব খুশি হব। আপনার পরম সেবায় দ্রুত সুস্থ হতে পেরেছি। এখন পায়ের যন্ত্রণা, পিঠের চোট কোনোটাই গুরুতর তীব্র না।
ঠোঁটে হাসি সংক্রমিত হলেও বৃদ্ধার চোখদুটো ম্লান চাহনি দিচ্ছিল। তিনি চাননি শেষটা এমন হোক। আশা করেননি, বিদায় বেলায় ছোট্ট একটা রহস্য তিনিও জানতে পারলেন। বুকের ভেতর শূন্যতা পাকানো নিঃশ্বাসটা বড্ড পীড়াই দিচ্ছিল। ভেবেছিলেন, মেয়েটা বাকিদের মতোই অবিবাহিত। পিছুটান কিছু নেই। তবে ডায়েরির প্রথম পাতায় যে তথ্যটুকু পেয়েছিলেন, এরপর আর সামনে আগাননি। জীবনের এই দ্বারপ্রান্তে এসে সবচেয়ে অমার্জনীয় কাজটি করেছিলেন তিনি। মহান স্রষ্টা ক্ষমা মার্জনা করুক এটার। কারোর ব্যক্তিগত ডায়েরিতে চোখ বুলোনোর স্পর্ধা কখনো করেননি; অথচ নিষিদ্ধ চাওয়ায় আকৃষ্ট হয়ে ডায়েরিটা আর ফেরতও দেননি। ডায়েরিটা গতকাল থেকে হারিয়ে গেছে। কোথায় যে রেখেছিলেন, মনভুলো রোগটার জন্য মনে নেই।
- তোমার ডায়েরিটা আর পেয়েছ? হাসপাতাল বা অন্যান্য জায়গায় খোঁজ করেছ?
প্রশ্নটা শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলল ও। বাকি জিনিসগুলো ব্যাগে পুড়ে চেইনটা টেনে বলল,
- ওটা হারিয়েছে। আমি আর ফিরে পাবার আশা করি না। যা গিয়েছে, গিয়েছেই। হয়ত নতুন কিছু আসার জন্য তৈরি হবে। আপনাকে এতোগুলো দিন কষ্ট দিলাম বলে দুঃখ প্রকাশের ভাষা পাচ্ছি না। তবু দুঃখিত, ভুল হলে আমাদের ছোট ভেবে মাফ করবেন।
বলতে বলতেই নিচ থেকে সোহানার সচকিত কণ্ঠ ভেসে এল। গলা চ্যাঁচিয়ে তাড়া দেখিয়ে বলল,
- জানা, নেমে আয়। আমরা সবাই রেডি! বাস ধরতে হবে, তাড়াতাড়ি!
- দুই মিনিট সোহা, আমি রেডি!
পালটা জবাবে উত্তরটা পাঠাতেই টোটব্যাগটা কাঁধে ঝুলাল শাওলিন। বৃদ্ধা সহ বাড়ির সবার সাথে শেষ সাক্ষাতটা আন্তরিকভাবে সমাপ্ত করল। বাংলোর বাইরে পা দিতেই হঠাৎ কী ভেবে মাথাটা পিছু ঘুরাল শাওলিন। জীবনে এই প্রথম অচেনা, অজানা, অজ্ঞাত জায়গায় কটা দিন কাটলো ওর। সম্পূর্ণ আপনজন ছাড়া, চেনামুখ ব্যতীত, স্বজন সঙ্গ পিছনে ফেলে থেকে গেল। অথচ, যাবার বেলায় সে কী মায়া! মুখ সামনে ঘুরাতে যাবে, এমন সময় একটা স্থানে চোখ আঁটকে গেল ওর। এক কদম এগিয়ে বাংলোর দেয়ালে একটা নামফলক দেখতে পেল। খোদাই কৃত বহু পুরোনো ধূলো জমা নামফলক। শাওলিন ডানহাত দিয়ে ধূলো ঝেড়ে বাংলোর সত্যিকার নামটা পড়তে চেষ্টা করল, যা কালের গর্ভে স্বদর্পে নিজের অস্তিত্বটুকু টিকিয়ে রাখতে তৎপর। চার অক্ষরে লেখা— ‘বজ্রমেঘ ’.
—————
পড়ন্ত বেলার সূর্যপিণ্ড অস্তে ঢলে পড়ছে। আকাশে ছড়িয়ে পড়েছে রক্তলাল সিঁদুর। বিকেলের রঙে প্রাণবন্ত মুহুর্তটা বড্ড মিঠে মধুর। আরো একবার নজর ঘুরিয়ে চারিদিকটা ছেঁকে দেখল শেহজানা আলম। কোথাও নেই সেই ব্যক্তি। নেই তার দুর্বিনয় অবয়ব। বাসের সিঁড়িতে পা চেপে উঠে গেল ভেতরে। দুধারে সারিবদ্ধ সিট, মধ্যখানে চলাচলের পথটুকু দিয়ে ডানদিকের সিটে ঢুকে পড়ল শাওলিন। বাসটা সবে ভরতে শুরু করেছে। একে একে উঠে পড়ছে পর্যটক। কিছুক্ষণ পর নিজের ডানপাশে শ্রেষ্ঠাও এসে বসলো। বাকিরা সামনে-পেছনে একত্র হয়ে সিট দখল করে নিল। বাস হেল্পার হেড কাউন্ট শেষে যাত্রা শুরুর হুঁশিয়ারি দিতেই ইঞ্জিনটা চালু করে ফেলেছে ড্রাইভার। বুকের মাঝে তীব্র উচাটন টের পেল শাওলিন। প্রচণ্ড অস্থিরতা শিরায়-উপশিরায় বয়ে গেল। পায়ের নিচে ইঞ্জিন চালুর ঝাঁকুনি টের পেতেই হঠাৎ বাঁদিকে জানালার বাইরে তাকাল। তাকাতেই চমকে উঠল শাওলিন! রাস্তার ওপাশে জীপ থামিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে ভদ্রলোক। গাঢ় সবুজ শার্ট, কালো প্যান্ট, কোমরে বেল্টধারী গেটআপে দাঁড়িয়ে আছে। জীপে গা হেলান দেয়া, দুহাত বুকের কাছে ভাঁজ করা। ওই শার্টটা কী বেশি আঁটসাঁট? বাহুদুটো যে ভয়ংকর ফুলে ফেঁপে উঠেছে? ডান ভ্রুঁতে সাদা ওয়ান-টাইম ব্যাণ্ডেজ, ভ্রুঁয়ের নিচে দুটো নীল চোখজোড়া সেই বিখ্যাত অসভ্য চশমায় ঢাকা! মুখে হাসি নেই, তবে চাহনিতে শীতল সম্মোহন। কাছে আসেনি, বরং দূর থেকেই যতটুকু দেখছিল। শাওলিন একবার ভাবল, জানালা দিয়েই শেষ বিদায়টুকু জানাবে কিনা, কিন্তু ব্যাপারটা বিশ্রী দেখাবে বলে পরক্ষণে আর এগোল না। সেকেণ্ডের ভগ্নাংশে টোটব্যাগ থেকে ফোনটা বের করল শাওলিন। ফটাফট কিবোর্ডে আঙুল চালিয়ে ছোট একটা বার্তা পাঠিয়ে দিল।
— “ যদি কখনো দেখা হয়, যদি সুযোগ হয় পরিস্থিতির, ফের কথা হবে তখন। ভালো থাকুন। আপনার আশপাশের মানুষদের এভাবেই ভালো রাখুন। আজ আসি, সুস্থ থাকুন। আল্লাহ হাফেজ।”
বাসটা অবশেষে ছেড়েই দিল। পেছনে ফেলে গেল একদল তরুণ-তরুণীর অ্যাডভেঞ্জার, বিপদসংকুল পথ, অজ্ঞাত হামলা, হাসপাতালে চক্কর, অদ্ভুত ঘটনা, অবশেষে খাগড়াছড়ি ভ্রমণ। জীবনের ঘটনাবহুল অংশটা যেন এভাবেই ছুটে যায়। দীর্ঘ মাইলের পর মাইল এগিয়ে যায় নিজস্ব গতিধারায়। আঁকাবাঁকা পাহাড় বেয়ে যখন চলে যেতে লাগল, তখন ওর মন ও চোখ আগের মতো মুগ্ধ হতে পারল না। একরাশ বিষণ্ণমেদুর আভা চোখের চাহনিতে, ঠোঁটের গাম্ভীর্যে, গালের নরম ত্বকে মলিনতা মাখিয়ে দিল। বুকের কোণে গোপন করে রাখল, কোনো নাম না জানা অনুভূতির ইতিহাস। সিটে হেলান দিয়ে মনে মনে শাওলিন উচ্চারণ করে উঠল, চোখদুটো বাইরে বিদ্ধ করেই বলল,
— “জীবনের সবচেয়ে সুন্দর দিনগুলো আজ থেকে অতীত। আর ফিরে পাওয়া হবে না। আর কোনোদিন ফিরে দেখাও হবে না। অতঃপর, হে বিদায়।”
মৃদু ভাইব্রেশনে ফোনটা কেঁপে উঠল। জানালা থেকে চোখ সরিয়ে মোবাইল স্ক্রিনটায় চোখ বুলাল শাওলিন। অপর পাশ থেকে পালটা বার্তা,
“ When flowers bloom,
they look like spring,
they reminds me a girl,
whose name is Shawleen. ”
— S. Farshad .
·
·
·
চলবে..........................................................................