এক হাজার টাকা - পর্ব ২৫ - মৌরি মরিয়ম - ধারাবাহিক গল্প


          আদনান যেদিন চলে গেল, আমি ওকে সি অফ করতে এয়ারপোর্টে গেলাম। আমার সাথে গেল বাবা ও ছোট চাচ্চু। বিদায়ের মুহূর্তে আদনান আমাকে জড়িয়ে ধরলো। আমি সঙ্গে সঙ্গে কেঁদে দিলাম। সে জড়িয়ে ধরা অবস্থাতেই আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল,
"আজ থেকে আমার সত্যিকারের অপেক্ষা শুরু।"

আমি আদনানকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। আমার কান্না কিছুতেই থামে না সেদিন। আদনানের হয়তো খারাপ লেগেছে আমাকে কান্নারত অবস্থায় রেখে যেতে। কিন্তু আমি শত চেষ্টা করেও কান্না থামাতে পারছিলাম না। আদনান ইমিগ্রেশনে ঢুকে যাওয়ার পরেও অনেকক্ষণ একই জায়গায় দাঁড়িয়ে রইলাম। এক সময় বাবা বলল,
"এখন চল ফিরি।"

তখন আমার খেয়াল হলো আমাদের সাথে বাবা এবং চাচ্চুও ছিল। তাদের সামনেই আদনান আমাকে এভাবে জড়িয়ে ধরল! আর আমিও ধরলাম! একবারও লজ্জা করল না! আসলে এসব মাথাতেই ছিল না। এখন ভাবতেই লজ্জা লাগছে!

আদনান চলে গেছে কয়েক সপ্তাহ হলো। প্রথম প্রথম আমি প্রচুর কান্নাকাটি করতাম। এখন কিছুটা কমেছে। আজকে আমি অনেক কিছু রান্নাবান্না করে নিয়ে ওর বড় বোনের বাসায় যাচ্ছি। আমি ঠিক করেছি যতদিন আর বাংলাদেশে আছি আপার কাছে বেশি বেশি যাব। রান্না করে খাওয়াব। আপাকে আমার প্রথমেই ভালো লেগেছিল। কিন্তু আদনানের থেকে সব শোনার পর থেকে এই মানু্ষটার মায়ায় পড়ে গেছি আমি! আদনানের থেকে মোটামুটি জেনে নিয়েছি উনি কোন কোন খাবার খুব বেশি পছন্দ করেন। সব না পারলেও তার বেশকিছু পছন্দের খাবার বানিয়েছি। যেমন, পানি কচু ভেজে তা দিয়ে ইলিশ মাছের ঝোল, লালশাক দিয়ে পুঁটি মাছের ঝোল, ইলিশ মাছের লেজ ভর্তা, পালং শাক দিয়ে মাংস, ছোট চিংড়ি দিয়ে করলা ভাজি। তার পছন্দের কয়েক পদের আচার। আচার গুলো অবশ্য কয়েকদিন বসে একটু একটু করে বানিয়েছি। সাথে ছানার পায়েশ। খুব ভোরে উঠে রান্না শুরু করেছিলাম তাই সকাল সকাল রান্না শেষ হয়ে গেল। এরপর দ্রুত রেডি হয়ে আপার বাসায় যেতে যেতে ১১'টা বেজে গেল। আপা আমাকে দেখে ভীষণ অবাক হলেন। সবচেয়ে বেশি অবাক হলেন আমার হাতে এত পোটলা দেখে। অবাক হয়ে বললেন,
"একি! এতকিছু কী এনেছো তিন্নি?"

আমি খাবারগুলো টেবিলে রেখে হেসে বললাম,
"কিছু সাধারণ খাবার। দুপুরে গরম ভাত রান্না করব, তারপর খাবো। আর তার আগ পর্যন্ত দুজন মিলে অনেক গল্প করব।"

"ওমা! তুমি আমার বাসায় আসবে, আমি তোমাকে রান্না করে খাওয়াব। তা না করে এসব কি পাগলামি করেছো!"

"আপনি রান্না করলে তো আর গল্প করতে পারব না আপা। তাই আমিই রান্না করে আনলাম। বাসায় কেউ নেই?"

"না বাচ্চারা তো যে যার মত স্কুল কলেজে গেছে। তোমার ভাইয়াও অফিসে।"

"খুব ভালো হয়েছে আপা। খালি বাসায় শুধু আপনি আর আমি অনেক গল্প করব।"

আপা হেসে দিলেন। আমি বললাম,
"আপনি একটু বক্সগুলো খুলে দেখুন না আপা।"

"একি পাগলামি বলো তো! খুবই লজ্জার কথা।"

আপা এসব বলতে বলতে একেকটা বক্স খুলে খাবারগুলো যখন দেখলো তখন তার কথা বন্ধ হয়ে গেল। আবেগে চোখে পানি এসে পড়লো। আপা চোখের পানি লুকানোর কোনো চেষ্টাই করলেন না। তার চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগলো কিন্তু তিনি হাসতে হাসতে বললেন,
"তোমাকে আদনান বলেছে আমি এসব পছন্দ করি?"

আমি হেসে বললাম,
"হ্যাঁ আপা। তা নাহলে আর জানলাম কীভাবে?"

"ও এতকিছু মনে রেখেছে আজও!"

আমি আপাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললাম,
"আপনার ভাই সবই মনে রেখেছে। ওকে তো চেনেন, বুক ফাটে তবু মুখ ফোটে না। যে কারণেই হোক দূরে সরে গেছে কিন্তু ওর আপনার জন্য মায়ের মত ভালোবাসা আজও অমলিন আছে।"

"কিন্তু এই ভালোবাসার যোগ্য আমি না। নিজের সংসারের জ্বালায় বড় বোন হিসেবে কোনো দায়িত্বই আমি পালন করতে পারিনি তিন্নি।"

আমি আপার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। তারপর তার হাত দুটো ধরে বললাম,
"কে বলেছে আপা? আপনি ওর অনেক জন্য অনেক করেছেন। আপনি যতটুকু করেছেন তা অন্য কেউ করেনি।"

"ও অনেক কষ্ট করেছে তু মি জানো না। বড় বোনের দায়িত্বটা ঠিকভাবে পালন করতে পারলে ওর সেই কষ্টগুলো করতে হত না।"

"বাদ দিন না আপা। আজকে আমরা কোনো মন খারাপের কথা বলব না। এখন আমরা আপনার ঘরের বিছানায় পা তুলে বসে আচার খাব আর গল্প করব।"

আপা বাটিতে আচার বাড়তে বাড়তে বললেন,
"আমার পছন্দের খাবারের কথা তো খুব বলেছে আদনান। ওর নিজের পছন্দের খাবারের কথা বলেছে কিছু?"

"হ্যাঁ পাকন পিঠা।"

"আর কিছু বলেনি?"

"তেমন কিছু না।"

আপা একেকটা আচার আলাদা আলাদা বাটিতে নিয়েছেন। আচারের বাটিগুলো একটা ট্রেতে করে নিজের ঘরে গেলেন। পেছন পেছন আমি। সত্যি সত্যি দুজনে পা তুলে বিছানায় বসলাম। তারপর আপা আচার খেতে খেতে বললেন,
"আদনান সবচেয়ে পছন্দ করে গরম পোলাও দিয়ে কচুর লতি ছোট চিংড়ির চচ্চড়ি।"

আমি অবাক হয়ে বললাম,
"পোলাও আর কচুর লতি?"

"হ্যাঁ আজগুবি কম্বিনেশন। ছোটবেলায় মা একবার পোলাও করেছেন। ও মাংস না নিয়ে আগের দিনের কচুর লতি নিল। এইযে মজা পেল, এরপর থেকে এটাই ওর সবচেয়ে প্রিয় খাবার।"

"আচ্ছা আমি যাওয়ার সময় তবে কচুর লতি নিয়ে যাব।"

"তাহলে চিকন লতি নিও। চিকনগুলো ওর বেশি পছন্দ। আর কাওন চাল নিও। কাওন চালের পায়েশ যে কী পছন্দ করে ভাইটা আমার।"

"আচ্ছা। আর কী পছন্দ করে ও?"

"নারকেল দিয়ে চিংড়ি ভুনা, কচি মূলা দিয়ে ছোট মাছের চচ্চড়ি, ঢেঁড়স দিয়ে যেকোনো তরকারি, লাউ চিংড়ি, টমেটো দিয়ে পাবদা মাছের পাতলা ঝোল, টমেটোর টক, হাঁসের মাংস ভুনা, ছোট আলু দিয়ে সরিষার তেলের বিফ তেহারি, ফলি মাছের কোপ্তা, আর যেকোনো ধরনের ভর্তা।"

এসব শুনে আমার কিছুটা মন খারাপ হলো। আহারে যে মানুষটার বাঙালি খাবার এত পছন্দ তাকে কিনা প্রায়ই পাস্তা খেতে হয়! আমি গিয়ে ওকে এসব খাবার রান্না করে খাওয়াব। কে জানে বাঙালি কোনো স্টোর কাছাকাছি কোথাও আছে কিনা! নাহলে কোথায় পাব এসব! অপচনশীল জিনিসগুলো আমি সাথে করেই নিয়ে যাব। সবচেয়ে বড় কথা আমি এগুলোর মধ্যে সব রাঁধতেই জানি না। যেগুলো পারিনা সেগুলো আপার কাছ থেকে শিখে নেব যাওয়ার আগে। আমার কাগজপত্র সব জমা দেয়া শেষ। এবার কেবল ভিসার অপেক্ষা! ভিসা চলে এলেই স্বপ্নের দিনগুলোর শুরু! আবার কোথাও একটা খটকাও আছে। আমি নেগেটিভ চিন্তা করতে চাই না, তবু কোথায় যেন একটা ভয় কাজ করে! যদি আদনান এয়ারপোর্টে না আসে! যদি ঠিকানা মতো গিয়ে আদনানকে না পাই! যদি সব দুঃস্বপ্ন হয়? আমি আদনানকে বিশ্বাস করি তবুও ভয় কাটাতে পারি না! কেন এই ভয়টা কাজ করে তাও জানি না!
.
.
.
চলবে......................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp