বজ্রমেঘ - পর্ব ১৮ - ফাবিয়াহ্ মমো - ধারাবাহিক গল্প


          বুকের ভেতর রহস্যজনক অনুভূতি! এই অনুভূতির নাম শিরোনাম কিছুই জানা নেই। এক অজানা আতঙ্কে সমস্ত কায়া শিউরে শিউরে উঠছে। মন জগতের উঠোন ঘূর্ণিঝড়ে কেঁপে উঠছে। জানা নেই আজকের দিনটা কেমন যাবে। কিন্তু যেমনই যাবে, এটা নিয়ে আগাম পূর্বাভাস কিছুতেই টের পাচ্ছে না। ভারি নিঃশ্বাস ছেড়ে চোখের কোলে কাজল টানাটা সমাপ্ত করল শাওলিন। কাজলের মুখটা প্লাস্টিকের ক্যাপে আঁটকে ড্রেসিং টেবিলে রাখল ও। এটা ওর টোটব্যাগের ছোট একটা পকেটে রাখা ছিল। মণির সেই কথাটা আজও মনে পড়ল ওর। সেই সুন্দর হাসির রমণীটা ওর থুতনি ছুঁয়ে কেমন যেন বলতো, কেমন উদাসী চোখে হাসি ঠোঁটে বলতো, "ও মেয়ে, তোমার অতো গম্ভীর হলে চলে? এতটুকু বয়সে অতখানি হাসিহীন থাকলে মানাবে? তুমি এতো সুন্দর দুটো চোখ পেয়েছ, এতো সুন্দর দুটো ঠোঁট পেয়েছ, এই সুন্দর দুটো চোখ-ঠোঁট কেন এমন শূন্য করে রাখো? তুমি এই দুটো দিয়ে হাসিটা উপহার দিতে পারো না? তুমি কী জানো না পৃথিবীতে হাসির মূল্যটাই অসীম? একটু বেশিই দামী? তুমি যখন কাউকে খুশি করো, সেই মানুষটা যে মনের ছাপটা ঠোঁটে রাখে। তার চোখে ফেলে। সে হাসে, সে খুশিতে কাঁদে। আর তুমি দুটোই যথাসাধ্য লুকিয়ে রাখো। তুমি আমাকে না দেখতে দাও হাসি, না বুঝতে দাও চোখের বৃষ্টি। তুমি সবসময়ই সবকিছু লুকিয়ে ফেলো শাওলিন। একদিন দেখবে, তোমার চোখ আর ঠোঁট সবকিছুতে কেউ একদিন রাজত্ব করবে। তুমি সেদিন খরখরে থাকতে পারবে না। কিছু লুকোতে পারবে না! " 

কথাগুলো এভাবে মনে পড়তে অলক্ষ্যে হেসে ফেলে শাওলিন। হাসি এবং কান্না নারীজীবনের এমন এক অধ্যায়, যা মানুষের নজরে প্রকাশ হলে মূল্যহীন হয়ে যায়। মানুষ স্বল্প দামে দুঃখের বাজারে বিক্রি করে দেয়। যথাযথ মূল্যগুলো ঠুনকো হয়ে যায়। শাওলিন যখন তৈরি হয়ে নিচে নেমে এল, ততক্ষণে তিন গাড়ির এক গাড়িতে চলে গেছে ভাবীদল। দুটো গাড়ির একটা ছিল শোয়েবের, অন্যটা ছিল রোজাদের। শোয়েবের জীপটা ছিল হুড খোলা। শাওলিন মুখ গম্ভীর করে হুড খোলা জীপের সমুখে থেমে বলল, 

  - তোমরা সবাই জীপে করে যাচ্ছ? 

শাওলিনের হঠাৎ প্রশ্নে সোহানা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। পিছু ফিরে উঁচু জীপ থেকে নিচে তাকিয়ে বলল, 

  - হ্যাঁ, এটাতেই তো যাচ্ছি। তুইও সঙ্গে যাচ্ছিস। এই জীপে দূর্দান্ত মজা হবে। পুরো প্রাকৃতিক ভিউটা চলন্ত জীপে উপভোগ করতে করতে যাব! তুই এক্ষু --

কথা আর শেষ করতে পারল না ও। তার আগেই শাওলিন সম্পূর্ণ নির্লিপ্ত থেকে স্বাভাবিক স্বরে জানাল, 

  - দুঃখিত, তোমরা যাও। আমার মনে হচ্ছে, আমার এখানে থেকে যাওয়াটাই ঠিক। তোমরা যেয়ে ঘুরে এসো। আনন্দ করো। আমি বাড়িতে থাকব। এমন হুড খোলা জীপে আমার পক্ষে জার্নি করা সম্ভব না। 

কথা শেষ হতে না হতেই কট করে কথাটা কাটল নাযীফ। দুম করে গলাটা তুঙ্গে তুলে মেজাজ দেখিয়ে বলল, 

  - তুই বাড়িতে থাকবি মানে? এইসব ভয়ংকর কথার মানে কী? তোর জন্য এতোক্ষণ কী কারণে ওয়েট করলাম? এমন টেনশন ধরানো কথাবার্তা বলিস না, প্লিজ উঠে পড় জানা। আমরা আমরা আছি, তোর কিচ্ছু হবে না। উঠ পড়।  

কথাটা স্বাভাবিক ছন্দেই বলেছিল নাযীফ। কিন্তু হঠাৎই ওর মুখটা কেমন কালো হয়ে গেল। আমরা আমরা? ওরা কী আমরা-আমরা আছে? সেদিন ওকে মৃত্যুর মুখে কারা ছেড়ে এসেছে? এই আমরা আমরা না? পাংশুটে মুখে বাকি কথাটা আর বলতে পারল না সে। ওর চেহারা দেখে বাকিটুকু বুঝে নিয়েছে শ্রেষ্ঠা। সোহানাও ঢোক গিলে চরম সত্যিটুকু গলাধঃকরণ করতে চাইছে। এমন সময় শাওলিনের চোখ কীসের উপর যেন আঁটকে গেল। চোখের উপর ডানহাতে রোদ আড়াল করে সপ্রতিভ কণ্ঠে বলে উঠল, 

  - আমি . . আমি ওই গাড়িটায় যাব! 

তৎক্ষণাৎ সবার চোখ শাওলিনের আঙুল বরাবর আঁটকে গেল। তর্জনী তাক করে কিছু একটা দেখাচ্ছে ও। সবাই ওর তাক অনুসরণ করে পেছনে তাকাতেই দ্বিতীয় গাড়ির অস্তিত্ব দেখতে পেল। অফ হোয়াইট রঙের গাড়িটায় সেলিম বসে আছে। গাড়িটা মূলত ও-ই চালাবে। সঙ্গে আছে জিদান। নাযীফ ছোট চোখে ব্যাপারটা একবার মেপে নিতেই শাওলিনের দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, 

  - তুই নিশ্চিত ওই গাড়িতে যাবি? 

  - সম্পূর্ণ নিশ্চিত। কোনো অসুবিধে দেখছি না ওটাতে। ওখানে ব্যালেন্স রাখাটা আরো ভালো হবে। আমি ওটাতে করেই যাব। 

 - সেলিম. . ওহ, জিদান তো আছে। আচ্ছা যা। তুই ওই গাড়িতে করেই যা। আমরা শোয়েব স্যারের স্পেশাল সার্ভিস পেতে পেতে যাব। তুই কিন্তু আজকের হুড খোলা জীপের আনন্দটা মিস করছিস রে শেহজানা আলম। এখনো সময় আছে, এখানে চলে আয়। একবার গ্রিপ করা শিখে গেলে এই স্পেশাল জীপে জাস্ট অসাধারণ . . চরম অসাধারণ লাগবে! পুরো পাহাড়ি সৌন্দর্যটা উপভোগ করতে করতে যাবি। আঁকাবাঁকা রাস্তা কী সুন্দর করে বাঁক নেয়, শাঁই শাঁই ঠাণ্ডা বাতাস, গাছের ঝাপটা, আরেকদিকে খাড়া পাহাড়! উফফ.. মিস করতে যাচ্ছিস রে। 

কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না শাওলিনের মুখে। বরং ক্ষীণ আভাসে হাসতে যাচ্ছিল ও, যা ঠোঁটের কোণে ঠোঁটেই মিলিয়ে গেল। পেছনের গাড়িতে একপলক নজর বুলিয়ে ওদের দিকে চোখ ঘুরাল শাওলিন, 

  - আমার হুড খোলা জীপ পছন্দ নয় ভাই। তোমরা আনন্দ করো। উপভোগ করো। আমি পেছনের গাড়িটায় করে আসব। যাই। 

কথাটুকু বলে পা চালিয়ে চলে যায় শাওলিন। অফ হোয়াইট গাড়ির ব্যাকসিটে চড়ে বসে ও। সবকিছু সুন্দরভাবে মিটমাট হলে সেলিম গাড়ি স্টার্টের জন্য হর্ণ বাজাল। বাঁদিকের জানালা সংলগ্ন বসা শাওলিন অনুভব করল, গাড়িটা ছেড়ে দিয়েছে। কোনো এক অজানা কারণে ওর বুকের ভেতরটা চিনচিন করে উঠেছে! ও তো ওই ভদ্রলোকটাকে বলে এল না! ও যে তৈরি হয়ে নিচে এসেছে এটাও তো জানানো হয়নি! এটা কেমন ব্যাপার হলো? গাড়ি যে ছেড়ে দিয়েছে! জানালার কাঁচটা তৎক্ষণাৎ নামাতে লাগল শাওলিন। উদ্বেলিত চাহনির কাজল রাঙা চোখদুটো চর্তুপাশে নজর ছুঁড়ে দিল, চলন্ত গাড়ি থেকে শেষ সীমা পর্যন্ত চোখ ঘুরাল, কিন্তু বুঝতে পারল, ভদ্রলোকটা আশেপাশেই নেই! জীপ রেখে কোথায় যেন চলে গিয়েছে! 

—————

বাংলোর ডানদিকে জংলী মেঠোপথ। কাঁচা পথটা ধরে সামনে এগোলে গহিন গভীর জঙ্গল। জঙ্গলের মতো জায়গাটায় তেমন একটা কাউকে যেতে হয় না। দিনের আলোটুকু পর্যন্ত ওই সীমানায় পৌঁছুয় না। ফলে, ওই মেঠোপথের জায়গাটা মানুষের মনে ভয়ের শিহরণ দেয়। আবছা নিঝুম জঙ্গুলে স্থানটায় গা ছমছম করে ওঠে। সেই পথ ধরে বেরিয়ে আসছিল শোয়েব ফারশাদ। পায়ের তলায় সবুজ স্যাত স্যাত মাটি মাড়িয়ে বাংলোর ডানদিক থেকে বেরিয়ে এল। কিন্তু এসেই বুঝতে পারল, একটা গাড়ি নেই। দুটো গাড়ির একটা ছিল অফ হোয়াইট নোয়াহ্ ব্রাণ্ডের গাড়ি। পাদুটো ক্ষিপ্র ভঙ্গিতে রেখে দ্রুত নিজ বাহনের সামনে পৌঁছুয় শোয়েব। পেছনের ফাঁকাস্থানটা দেখে নিয়ে ওদের দিকে তীক্ষ্ম ছুরির প্রশ্ন ছোঁড়ে, 

  - এদিকের অফ হোয়াইট গাড়ি কোথায়? কখন বেরিয়েছে? 

ছুরির ধারে চমকে উঠল রোজা। দুচোখ পিটপিট করে হতভম্ব হয়ে জানাল, 

  - কিছুক্ষণ আগে। মেবি দশ মিনিট হল বেরিয়েছে। কিন্তু কেন? 

  - ক'জন আছ? 

  - চারজন। 

  - বাকিরা কোথায়? 

  - ওই গাড়িতে। ওরা উৎসবের ওখানেই যাচ্ছে। 

  - আমাকে সেটা ইনফর্ম করেছিল? 

  - না, 

'না' উচ্চারণ করতে গিয়ে আর কিছুই বলতে পারল না রোজা। এবার মনে হচ্ছে, সাংঘাতিক ভুল হয়ে গেছে। মস্ত বড় ভুল। সেলিম তো আসলেই উনাকে জানিয়ে বেরোয়নি। এতো বড় গাফিলতিটা কী করে হল? উনার বাড়ির ত্রিসীমানা থেকে বেরুর, উনার তত্ত্বাবধানে যাচ্ছিল, কিন্তু দুটো হর্ণ দেয়া ছাড়া কিছুই করেনি ও। রোজা পাংশু মুখে নাযীফের দিকে তাকাল। নাযীফ ওদের প্রত্যেকের গাঁধামি ঠাহর করে মুখ সামনে রেখে বলল, 

  - আপনি চাইলে জীপ ছুটিয়ে ওদের ধরতে পারবেন স্যার। সেলিম অতো ভালো চালক না। এর আগেও মূর্খের মতো পাহাড়ের অফ রুটে গাড়ি চালাতে গিয়ে, আপনাদের সেই রেসট্রিক্টেড জোনে গাড়ি ঢুকিয়েছিল। 

নাযীফের কথায় চরম ভ্যাবাচ্যাকা খেল শ্রেষ্ঠা। কীসের মধ্যে কী? ও আমেরিকার যুক্তি আফগানিস্তানে দিচ্ছে কেন? দশ মিনিট আগে বেরিয়ে যাওয়া গাড়ির সাথে দক্ষ চালকের কী সম্পর্ক? আচ্ছা রেসট্রিক্টেড জোনে কী গাড়িটা ও-ই ঢুকিয়েছিল না? কী চাপাবাজ, ভণ্ড, মিথ্যুক! এদের সাথে ও খাগড়াছড়ি ঘুরতে এসেছে? ইয়া আল্লাহ মেহেরবাণী করো, এই মীরজাফরের বংশধরকে লর্ড ক্লাইভদের মতো বুদ্ধি দাও! নয়তো তুলে নাও! এদিকে ওদের কথা শুনতে শুনতে বাঁহাত পকেটে পুড়ে জীপের চাবিটা বের করেছে শোয়েব। একহাতে ড্রাইভিং সিটের দরজাটা খুলে জীপে উঠতেই ইগনিশনে চাবিটা মোচড়ে দিল। ভয়ংকর জন্তুর মতো ঘুমন্ত ইঞ্চিনটা গর্জন দিয়ে উঠেছে। ধাম্ করে পাশের দরজাটা বন্ধ করতেই স্টিয়ারিং খামচে জীপটা ছেড়ে দিল শোয়েব। একরাশ ধূলো উড়িয়ে জীপটা প্রস্থান করল ওর। গন্তব্যস্থল— বৈসাবি উৎসব। 

—————

পাহাড়ের সবচেয়ে বড় জমকালো উৎসব— বৈসাবি। পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার প্রধান তিন জনগোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব। পাহাড়ি মানুষগুলোর অটুট বন্ধন, সৌহার্দ্য, ভ্রাতৃত্ব, শান্তি ও সহাবস্থান সবকিছুকে একরেখায় টেনে দেয় এটি। ত্রিপুরার কাছে বৈসু [বৈ], মারমার কাছে সাংগ্রাই [সা], চাকমার বিজু [বি] বলে অবহিত এটি। তাই নামকরণ করা হয়েছে বৈসাবি। বণাঢ্য আয়োজনের মধ্য দিয়ে বিভিন্ন মান্যগণ্য ব্যক্তি, উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা, বিশেষ স্থানীয় শ্রদ্ধাভাজন লোক উপস্থিত হয়েছে আজ। বর্ণিল আয়োজনে সমাগম হয়েছে সেগুফতা, মিথিলা, তাহিয়া ও অধরা। তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ইলহাম। তার কিছুক্ষণের মধ্যে হাজির হয়েছে শোয়েবের আগমন। পুরো আয়োজন স্থলে আনন্দের বন্যা ছড়িয়ে আছে। চর্তুদিকে কী সুন্দর খুশি মাখো মাখো ঢল! পাহাড়ি মানুষদের নৃত্য, গান, লোক ঐতিহ্য সব যেন বাংলার বুকে এক অনন্য সুন্দর আশ্চর্য! শোয়েবের আগমনে সবচেয়ে বেশি ঘিরে রেখেছে শিশুদল। তাহিয়া অবাক বিস্ময়ে আবিস্কার করেছে, তার শ্রদ্ধাভাজন দেবর এই অঞ্চলে অত্যন্ত জনপ্রিয়। তার নাম, পরিচয়, সুখ্যাতি এই বাচ্চাগুলোর মুখে মুখে, ঠোঁটের কোণে পবিত্র হাসিতে। তাহিয়া আশ্চর্য সুরে পাশে থাকা ইলহামকে শুধায়, 

  - ও এখানে কী করে এই কাজটা করল? 

ইলহাম চট করে কথাটা ধরতে না পেরে মুখের হাসিটা নিভিয়ে বলল, 

  - কী কাজটা ভাবী? 

  - এই যে, ও পাহাড়ি ভাষাটা বুঝে নিচ্ছে! ওই বাচ্চারা কী বলছে, কী বোঝাচ্ছে সব খাপে খাপে ধরে ফেলছে ও। কিন্তু আমি ওদের ভাষাটা কিছুতেই বুঝতে পারছি না! এক বর্ণও না!

ইলহাম এবার হাসিতে মুখ উদ্ভাসিত করে বলল, 

  - উনি এই অঞ্চলে আসার পর ওদের সঙ্গে মিশে গিয়েছিলেন। ভাষা তো উনিও বুঝতেন না। ওরা কী বলতো এক অক্ষরও উদ্ধার করতে পারতেন না। কিন্তু আমি বাবার কাছে শুনেছি, উনি হাল ছাড়েননি। আগের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা যতটা ক্ষতি করেছিলেন, উনি এসে ধীরে ধীরে এই অঞ্চলে অগ্রগতি করেছেন। অনেককিছু বদলে দিয়েছেন চেষ্টা করে। অনেক সমস্যা নিরসনও করেছেন চুপচাপ। এখানকার মানুষ সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী ছিল নিরাপত্তার জন্য। এখানে নিরাপত্তা নেই। পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের জন্য প্রায়ই এখানে অন্ধকার নেমে আসে। মানুষগুলো আতঙ্কে কাটা হয়ে যায়। এখন আগের চেয়ে অনেকটাই এসব কমে এসেছে। সেনাবাহিনী বা যৌথবাহিনী সবার তৎপরতা যেমন বেড়েছে, তেমনি বনবিভাগের দূর্নীতিগ্রস্ত ডেরাটা উনি একাই লাগাম টেনে ধরেছেন। এখনো দেখে রাখার দায়িত্বটা উনি একাই পালন করছেন। কিন্তু এই কাজটা আর কতদিন, কতটুকু, কতটা শান্তিপূর্ণ ভাবে করতে পারবেন, এটা এখন কেউ বলতে পারছে না। 

মন্ত্রমুগ্ধের মতো কথাগুলো শুনে যাচ্ছিল তাহিয়া। সামনে তাকিয়ে থাকতে থাকতে দৃশ্যগুলো মানসপটে মেলাচ্ছিল ও। ভেবে যাচ্ছিল, এই বংশের সবচেয়ে শান্ত, সবচেয়ে আকৃষ্ট, সবচেয়ে বিপরীতমুখী পুরুষটা এখানেও নিজের ছাপ গাড়তে দেরি করেনি। নিজের মেধা, বুদ্ধি, যোগ্যতার সাক্ষর রেখে দিয়েছে এখানেও। কিন্তু হঠাৎ শেষের কথাটাতে এসে মতিভ্রষ্ট হলো। মুখের হাসি হাসি ভাব মেঘে ঢাকা আলোর মতো ফ্যাকাশে হয়ে ফুটল। মুখটা বাঁয়ে ঘুরিয়ে শাড়ি পরিহিতা ইলহামের দিকে বলল, 

  - তুমি এভাবে কেন বলছ? এখানে কী কিছু হচ্ছে নাকি? 

লাল-খয়েরি রঙের শাড়ি পড়েছে ইলহাম। শাড়ির পাড়টা কালো রঙা। কালো ভেলভেট কাপড়ের ফুল হাতা ব্লাউজে পরম সুন্দরীই লাগছে ওকে। হালকা সাজে নিজেকে মানানসই সাজিয়েছে। চোখে নেচারাল ফলস লেশ তথা কৃত্রিম পাপড়ির সৌন্দর্যে চোখদুটো গভীর করেছে ও। সেই কৃত্রিম গভীর চোখদুটো তুলে তাহিয়ার দিকে শূন্যকণ্ঠে বলল, 

  - মানুষের জন্য যখন কাজ করতে যাবেন, তখন একদল মানুষই আপনাকে উৎখাতের জন্য উঠে-পড়ে লাগবে। হয় আপনাকে সরিয়ে দিয়ে নিজেরা বসবে, নয়তো বেওয়ারিশ কাজকর্ম দিয়ে আপনাকে লাঞ্ছিত করবে। ওরা এখন দুই নম্বরটার পেছনে লেগেছে। 

তাহিয়া বাকরুদ্ধ হয়ে কথাগুলো গিলতে চাইল। কিন্তু পারল না ও। শ্বাসযন্ত্রের কাছে পাথরের মতো কিছু একটা চাপা দিয়ে যাচ্ছিল। একবার ভয় মাখানো দৃষ্টিতে ওই গাঢ় সবুজ শার্ট পড়ুয়া সুদেহী মানুষটার দিকে চাইল, আরেকবার চিন্তিত চোখদুটো ইলহামের দিকে ফিরাল। কণ্ঠে একরাশ ভয়মিশ্রিত প্রশ্ন নিয়ে বলল, 

  - আমি তোমার কথা বুঝতে পারলাম না ইরা! তুমি কীসের আভাস দিচ্ছ? ব্যাপারটা আসলে কী? আমাকে খুলে বলো!

দুটো চোখ ওই দীর্ঘ লম্বা মানুষটার দিকে ফেলল ইলহাম। হাঁটু গেঁড়ে ওই পুরুষ ছোট ছোট বাচ্চাগুলোর কাছে বসে আছে। এপাশ থেকে শুধু দেখা যাচ্ছে মুখের ডানপাশ, ধারালো সুন্দর চোয়াল, কানের কাছে চশমার চিকন ডাঁট, আর চশমার এপাশে পাপড়ি-ঘন ওই প্রাণঘাতী চোখ! ইলহাম বুকের অসহ্য কাঁপনটুকু দ্রুত আড়াল করল। ভীষণ স্থলিত সুরে বলে উঠল, 

  - মৌচাকে ঢিল ছুঁড়ে দিয়ে বসে আছেন। এখানে এমন একদল শ্রেণীকে উষ্কে দিয়েছেন, যাদের আরামের ব্যবসায় ভয়ানক ধস নেমে গেছে। বাবার কাছ থেকে এটুকু জানতে পেরেছি, উনার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে ঘাঁটাঘাটি করা হচ্ছে। সেখানে যদি মা, বোন, বউ কিছু থেকে থাকে, তাহলে কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলবে। বাকিটা কী হবে, আমরা কেউ বলতে পারছি না। 

পুরোটা কথা শোনার পর স্তব্ধ হয়ে গেল তাহিয়া। এখানে আসার পর কিছু একটা গড়মিল লাগছিল ওর। বাংলোর বাইরে লুকোনো সিসিক্যাম, সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা বেষ্টনী, সামনে ও পেছন গেটে দুজন দারোয়ান বেশী দক্ষ লোক। এসব তো মিছে হতে পারে না। রাফানের ওরকম মেজাজ বিগড়ানো ক্ষোভ, পার্থর শান্তমুখী ক্রোধ, বাড়ির চাকর-বাকরগুলো সজাগ টনটন; এসব তো মেকি দেখাতে পারে না। দেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ক্রিমিনোলজি বিভাগে স্নাতক সম্পণ্ণ করেছে তাহিয়া হারুন। নিজের বুদ্ধির জোরে এখন পড়াশোনা করছে স্নাতকোত্তর স্তরে। এটুকু তার ভরসা আছে, তার পর্যবেক্ষণশক্তি নগণ্য নয়। সে জানে কতটা বীভৎসতা এখানে লুকোনো। এর মানে শোয়েব ফারশাদ এখানেও বিপদমুক্ত নয়! এখানেও সুস্থির নয় সে! 

—————

ফোনের স্ক্রিনে বারবার সময় দেখছে। ডিজিটগুলো দুপুর বারোটা দেখাচ্ছে। উত্তপ্ত গরমে ধীরে ধীরে পরিবেশ গ্রীষ্ম আদলে রূপ নিচ্ছে। কিন্তু তার মন মূলত বিদ্ধ রয়েছে অন্যদিকে। এখনো কেন ওই গাড়িটা আসেনি? এভাবে কেন দেরি করছে ওটা? তবে কী ওরা বেশি দ্রুত চলে এসেছে? কিন্তু তাই বলে এখনো কেন বৈসাবি উৎসবের জায়গাটা এল না? চোখদুটো জানালার বাইরে নিবিষ্ট রেখে একমনে ভাবছিল শাওলিন। কাঁচ নামানো জানালাটা দিয়ে নাতিশীতোষ্ণ হাওয়া হু হু করে আসছিল। সামনে থেকে জিদান গুরুত্বপূর্ণ একটি ফোনে কথা বলতে বলতে চট করে সেলিমকে বলে বসল, 

  - মামা, সাইড করে চাপিয়ে দাও। আমি একবার নামব। এদিকে এক ছোট ভাইয়ের খোঁজ পেয়েছি। চাকরি করে। ওর সাথে একবার দেখা করে আসি। 

সেলিম ভ্রুঁ কুঁচকে কিয়ৎক্ষণ তাকিয়ে রইল। এরপর গাড়িটা সাইডে চাপিয়ে জিদানকে নামিয়ে দিল সে। জিদানকে দেখা গেল, সত্যি সত্যিই এক যুবকের সঙ্গে কোলাকুলি করছে। খোশমেজাজে কুশল বিনিময় করছে। গাড়ি থেকে দৃশ্যটা দেখতে দেখতে পিছনে চলে গেল ঘটনাটা। পুরো গাড়িতে এবার মানুষ রইল স্রেফ দুজন। হঠাৎ করেই বুকের ভেতরটা অন্যরকম আভাস দিয়ে যাচ্ছে। মেয়েলি চিন্তার ষষ্ঠ ইন্দ্রীয়টা ওকে ভীষণভাবে জানান দিচ্ছে। যেন কিছু একটার জন্য খুব তাড়াতাড়ি প্রস্তুত হওয়া দরকার। ব্যাপারটা যে কী, তা ও নিজেও জানে না। খুব শান্তভাবে সিটে হেলান দিয়ে বাইরের দৃশ্যপট দেখছে শাওলিন। একচুল বুঝতে দেয়নি ও যে চিন্তায় কালো! এদিকে অনুভব করছে, সেলিমের চোখ সামনের ফ্রন্ট মিরর থেকে বিদ্ধ করছিল। কিন্তু বাইরে থেকে নিজেকে সুস্থির রাখল শাওলিন। হাতের মুঠোয় যে কলটা এখন বেজে যাচ্ছিল, সেটাতেই ও পূর্ণ মনোযোগ দিল। কলার নেমে 'Zohra Anty' নাম। মানুষটাকে হঠাৎ পেয়ে কানে ফোন চাপল শাওলিন, কিন্তু 'হ্যালো' বলতেই বুঝল, নেটওয়ার্ক ডিস্টার্ব। কথা কেটে কেটে আসছে, স্পষ্ট না। কল কেটে আবার ব্যাক করল ও। এবারও কলটা রিসিভ হলে শাওলিন জানালার বাইরে মুখ রাখতে চাইল। 

  - আমি গাড়ি থামাচ্ছি। তুমি বাইরে দাঁড়িয়ে কথা বলো। এভাবে চলন্ত গাড়িতে কথা বলার জন্য কথাগুলো মনেহয় আরো শুনতেছ না। 

হঠাৎ সেলিমের উদারচিত্তে চোখ ঘুরাল শাওলিন। চোখটা সরাসরি গিয়ে সামনের বিঁধল ফ্রন্ট মিররে। যেখানে সেলিমের চোখ ড্রাইভের ফাঁকে ফাঁকে ওর দিকে ঘুরছে। শাওলিন কানে ফোন চাপা অবস্থাতেই জোরে একটা দম ফেলল। এদিকে এটাও বুঝতে পারছে, এই কলটা গুরুত্বপূর্ণ। জোহরা এমনি এমনি ওকে বারবার কল দিবে না। শাওলিন ফোনটা কেটে দিয়ে গলা নির্লিপ্ত করে বলল, 

  - গাড়িটা তবে থামানো হোক। আমার বাসা থেকে জরুরি একটা কল এসেছে। আমি দুই মিনিট কথা বলব। 

  - ওকককে . . অ্যাজ ইয়্যুর উইশ। 

ঠোঁটের কোণে তেরছা বিদ্রুপ নিয়ে গাড়িটা পার্ক করল সেলিম। বাঁপাশে সাইডে চাপিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল সে। এদিকে শাওলিন গাড়ি থামতেই চটপট বাইরে বেরিয়ে কল দিয়েছে। এক হাতে ফোন চেপে অন্যহাতটা ঠোঁটের কাছে এনে রেখেছে। বাইরে ধূলোটে বাতাস। চোখে মুখে ধূলো ঢোকে। চোখদুটো ডলতে ডলতে পানির একটা বোতল নিয়ে বাইরে এল সেলিম। মুখে বোতল কাত করে পানি ঢালতেই হঠাৎ তার চোখদুটো ব্যাকসীটের দিকে আঁটকে গেল। মনে মনে কী ভাবল কে জানে! একবার গাড়ির দিকে পিঠ দিয়ে দাঁড়ানো শাওলিনের দিকে চাইল, পরক্ষণে জানালা দিয়ে গাড়ির ব্যাকসিটটায় তাকাল। এরপর হঠাৎই গাড়ির ব্যাকসিটের দরজা খুলে দাঁড়াল সে। বোতলের সবটুকু পানি উপুড় করে পুরোপুরি ভিজিয়ে দিল সিট। যেন স্যাতস্যাতে ভেজা সিটে কেউ বসতে না পারুক। খালি বোতলটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে নিজের ড্রাইভিং সিটে উঠে বসল সেলিম। কয়েক মিনিট অপেক্ষা করতেই শাওলিন যখন এল, দরজা খুলে বসতে নিল, হঠাৎই আকস্মিকভাবে চমকে উঠল ও! এ কী! শাওলিন চরম বিস্ময়ে অবাক হয়ে বলল, 

  - সিট কী করে ভিজেছে? এটা তো এমনি এমনি ভেজার কথা নয়! 
.
.
.
চলবে........................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp